শান্তিদেবী।

 গভীর নীরব নিশি,
 পরিশ্রান্ত ধরাবাসী,
সুখের স্বপনে সুপ্ত ধরণীর কোলে।

 চাঁদখানি অন্ত প্রায়,
 ঈষৎ আঁধারময়,
কালো ছায়া পড়িয়াছে তটিনীর জলে।

 গিরিগণ উচ্চশিরে,
 পড়ি’ছে গগণোপরে,
কি লিখিত আছে হোথা তারার আখরে

 দিবসের কার্য্য যত,
 জাগতিক ক্লেশ শত,
ভাবিতেছিলাম আমি শু’য়ে নিজ ঘরে॥


 না পেরে ভাবিতে আর,
 অন্তরের চিন্তাভার
ফেলিতে চলি আমি তটিনীর কূলে।

 সুদূর গগণ পানে,
 চাহি’ চাহি’ আনমনে,
গাহিলাম এক মনে জগতেরে ভুলে॥

“কোথা, সখি কলপনা,
“বারেক বাজাও বীণা,
“নাহি আর তোমা বিনা,
 “সুখ-দুখ-ভাগিনী।

“ভালবাসি তো’রে সখি,
“হই যে লো কত সুখী,
“মানসনয়নে দেখি,
 “যবে ভোরে সজনি॥

“কাঁপাইয়া মহীধরে,
“ঝংকারি বীণার তারে,
“গাওলো মধুর সুরে
 “অনুরোধ করিলো।


 “উঠুক বীণার তান,
 “নাচিবে তটিনী-প্রাণ,
 “ভুলিবে আমার প্রাণ,
  “অসার জগত লো॥”

গাহিতে গাহিতে অবশ পরাণ,
 অলস মাথাটি অবশ কায়।
দেখিনু ঝকিছে হীরকসমান,
 একটি তারকা গগণ-গায়।

আচম্বিতে, ওকি, সুমধুরবীণ,
 ধ্বনিত হইল গহন বনে।
চমকিয়া দেখি দেবী কলপনা,
 বাজাইছে বীণা মধুর তানে॥

ফুটিল চৌদিকে কুসুমনিকর,
 জ্বলিল দ্বিগুণ তারকা-হাসি।
বীণার সনেতে গাহিল ভ্রমর
 দেববালা বর্ষে মুকুতা-রাশি॥


সহসা একটি তারা তেজোময়,
 আলোকিয়া ধরা বিদীর্ণ হ’লো।
দেখিতে দেখিতে নিশীথ সময়,
 সে আলো আঁধারে মিশিয়ে গেল॥

 হেরিনু অবাক হ’য়ে,
 আমার পানেতে চেয়ে,
 একটি রূপসী মেয়ে,
  নামিছে ধরাতে।

 আসিয়া তটিনী-তীরে,
 মৃদু মৃদু হাস্য করে,
 বসিলেন ধীরে ধীরে,
  আমার পাশেতে॥

 মোহিনী মূরতি তার
 অসিত কুন্তল ভার,
 আকাশের তারা-হার,
  জ্বলে কেশোপরে।


কহিল কল্পনা কাণে,
“কি দেখ মোহিত মনে?
“শান্তিদেবী নাম, জানে
 “সর্ব্ব চরাচর॥”

পরশিল দেবী মোরে,
কাঁপে অঙ্গ থরথরে,
কহিল মধুর স্বরে,
 “নাহি কোন ভয়।”

জানি না সহসা কেন,
সুখের বিজলী হেন,
ঝকিল অন্তরে যেন,
 করি’ আলোময়॥

“মম নাম শান্তিদেবী,
কেন, বৎসে, মোরে ভাবি,
 অনর্থক দিবানিশি যাপ লো সময়।
অসার জগত বন,
হরষের সম্পূরণ,
 মানবের কভু নাহি হয় গো হেথায়॥


 “হেথায় দুদিন তরে,
 থাকরে হরষ ভরে,
পরকালে পা'বে শান্তি নাহি তা’র শেষ॥

 জগতে তিষ্ঠিতে নারি,
 তারকায় বাস করি,
সেথায় নাহিরে বাছা যাতনার লেশ॥

 “আকাশের প্রান্তে হের,
 তারাটি উজলতর,
ওইখানে বাস মম, যাইব ত্বরাতে।

 পোহাইল বিভাবরী,
 আর ত রহিতে নারি,
যতদিন থাক ভবে রহিবে সুখেতে॥”

 উজলি গগণ-পথে,
 শান্তিদেবী ধরা হ’তে,
চলিয়া গেলেন কোথা’ নক্ষত্রভবনে।


  ক্ষণেক অবাক হ’য়ে,
  তারাটির পানে চেয়ে,
 মন্ত্রমুগ্ধ-প্রায় হেরি অনন্ত বিমানে।

কোথা’ রহিয়াছি, কোথা’ কলপনা,
  কোথা শান্তিদেবী, একি রে মায়া?
আর ত বাজেনা সে মোহিনী বীণা!
  একি রে কালের অফুট ছায়া?

শুইয়া রয়েছি তটিনীর তীরে,
  অবশ মাথাটি পাষাণে রাখি।
প্রাতঃসমীরণ পরশিছে মোরে,
  তারাগণ ক্রমে মুদিছে আঁখি।

চমকি তখন উঠি ত্বরিতে,
  নিশা জাগরণে অবশ কায়।
বুঝিনু রজনী কেটেছে ভ্রমেতে,
  পাখীরা তখন প্রভাতী গায়॥