ধূলিরাশি/পিতৃমাতৃহীনা বালিকা

পিতৃ-মাতৃ-হীনা বালিকা।

আজি এ গভীর গভীর নিশিথে,
 কে গাহিছে ওই কিসের গান?
উদাস অন্তরে নিঝরের সাথে,
 মৃদুল মৃদুল ধরেছে তান॥

এ বিজন বনে এ হেন সময়,
 কে দুখিনী গাহে খুলিয়ে প্রাণ।
গানের একটি একটি কথায়
 কেনরে বিঁধিছে বিষাদ-বাণ॥

ওই যে হোথায় বটতরুতলে,
 আঁচল পাতিয়ে কে আছে শুয়ে?
ভাসিছে মু’খানি নয়নের জলে,
 বিরলে গাহিছে একটি মেয়ে॥


“ত্যজিয়ে সংসার ত্যজিয়ে সকল,
 “এসেছি প্রকৃতি তোমার পাশে।
“জীবনের এই অবশিষ্ট কাল,
 “যাপন করিব বিরলে বসে॥

“জগতের যত যাতনা অসার,
 “এড়াইতে আজি এসেছি হেথা।
“শৈশব সঙ্গিনী বীণাটি আমার,
 “ঘুচাইবে মম মরম-ব্যথা॥

“তোমারে বারিধি, বলিব সকল,
 “তোমারি কূলেতে গাহিব গান।
“তোমারি জলেতে নয়নের জল,
 “মিশাব আজিকে খুলিয়ে প্রাণ॥

“অবশিষ্ট এই জীবন আমার,
 “তোমাদের কাছে কাটা’তে চাই।
“যেদিকে নেহারি সকল(ই) আঁধার
 “কিছু দিন তরে দাও গো ঠাঁই॥


“এই অনুরোধ, জলবি, তোমায়,
 “চিরনিদ্রা যবে ডাকিবে মোরে।
“মোরি তীরেতে ঘুমা’ব হেথায়
 “চির শান্তি আসি’ ঘেরিবে মোরে॥

“আমায় তোমার উর্ম্মিমালা যেন,
 “প্রক্ষালন করে আসিয়ে কূলে।
“এ দেহ, জলধি, রাখিও তখন,
 “চাপা দিয়ে তব স্নেহের কোলে।”

আজিও সেথায় আছে জনশ্রুতি,
 একাটি একাটি একটি মেয়ে।
পাগলের প্রায় সাগরের প্রতি,
 উদাস-নয়নে থাকিত চেয়ে॥

জাহাজ হইতে নাবিক সকলে,
 কতবার, আহা, দেখেছে তা’য়।
ডাকে পরমেশে যোড়কর তুলে,
 কভু বা নিবিড় বনেতে ধায়॥


এইরূপে যায় দিবসযামিনী,
 তখনো তখনো সাগর-কূলে।
বেড়া’ত বালিকা মলিন মু’খানি,
 পড়েছে কালিমা নয়ন-কোলে॥

একদা নিশীথে সে গহন বনে,
 ডাকিতেছে বালা কাতর স্বরে।
“কোথা দয়াময়! এই শেষ দিনে,
 “ও চরণে ঠাঁই দাও হে মোরে॥

“কে আছে আমার এই পৃথিবীতে,
 “দুখের দুখিনী হইবে বলে।
“তাই আজি, পিতঃ, বিদরিত চিতে,
 “কাঁদিতে এসেছি চরণ-তলে॥

“জীবন-প্রদীপ আসিছে নিবিয়ে,
 “জীবনের ফুল পড়িছে ঝরে।
“এই হে এসেছি কাতর হইয়ে,
 “শান্তি-বারি, নাথ, দাও হে মোরে॥”


আচম্বিতে সেই বিজন-বিপিনে,
 স্বর্গীয় আলোকে পূরিয়া গেল।
স্বর্গ-দূতগণ নামিয়া সেখানে,
 লইয়া ভাহারে অদৃশ্য হ’ল॥

যাইবার কালে নাবিকগণেতে,
 দেখেছে বালারে দূতের সনে।
তূষার জিনিয়া ধবল বেশেতে,
 দূতগণ পাশে হরষ মনে॥

দীপ্ত মুখখানি সুবিমল সুখে
 শাদা পাখদুটি ছড়ায়ে ফেলে।
চলেছে সত্বরে বাড়ী অভিমুখে,
 বারেক না চেয়ে আকাশতলে॥

বহুদিন পরে যেমন প্রবাসী,
 চিরপরিচিত স্বদেশ হেরে।
নয়নে বিমল আনন্দের হাসি,
 বারেক পশ্চাতে চাহে না ফিরে॥


তেমনি বালিকা বহুদিন স’য়ে,
 জগতের যত অসার জ্বালা।
সে সব ফুরাল বাড়ীপানে চেয়ে,
 তেমনি হরষে চলেছে বালা॥

শান্তি পরিপূর্ণ আজি সে আননে,
 হাসিরাশি কেহ দেখেনি তা’য়।
আজি তা’র দেহ এ বিজন বনে,
 প্রকৃতির কোলে বিরাম পায়॥

আজিও, হায়রে! জলধি সেথায়,
 হুহু শব্দে গায় তাহারি গান।
আজিও নিঝর ঝর ঝর বহে,
 ধৌত করে তা’র শয়ন-স্থান॥