পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/ঋতুসংহার (১)
ঋতুসংহার
যখন ভারতবর্ষের ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’, তখন সাধারণতঃ যে যে পাখী আমাদের নয়নগোচর হয়, এবং বর্ষার সহিত যাহাদের নিবিড় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দাঁড়াইয়া গিয়াছে বলিয়া আমাদের দেশে কবিপ্রসিদ্ধি, তাহাদের কয়েকটির যথাসম্ভব বৈজ্ঞানিক পরিচয় আমি ‘মেঘদূতের পক্ষিতত্ত্ব’ প্রবন্ধে দিবার চেষ্টা করিয়াছি। মানুষের সঙ্গে পাখীর এই যে আনন্দ-সম্পর্ক, সুখে, দুঃখে, বিরহে, মিলনে, কতকটা সজ্ঞানে কতকটা অজ্ঞানে, এই যে পরস্পরের প্রীতিবন্ধন, ইহা যে কেবল বর্ষাঋতুতেই প্রকটিত, তাহা নহে; সমস্ত বৎসর ব্যাপিয়া ইহা তাহাদের উভয়ের জীবন-নাট্যের সহিত বিচিত্র রহস্যসূত্রে গ্রথিত হইয়া আছে। ঋতুপরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাখীগুলির হাবভাব-ভঙ্গীর বিচিত্র পরিবর্ত্তন আলোচনা করিবার সুযোগ কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যে আমরা কতকটা পাই। বিহঙ্গ-তত্ত্ব-জিজ্ঞাসু বাঙ্গালী পাঠক-পাঠিকা যদি প্রকৃতির উন্মুক্ত লীলাকুঞ্জে মানবসম্পর্কবিরহিত স্বাধীন পাখীর গতিবিধি প্রভৃতি লক্ষ্য করিতে চান, তাহা হইলেও ঋতুসংহারের যৌবনভারনিপীড়িতা নায়িকাকে স্বচ্ছন্দে দূরে রাখিয়া কেবলমাত্র বৎসরের বিভিন্ন ঋতুতে মহাকবিবর্ণিত পাখীগুলিকে লইয়া যথেষ্ট আনন্দ ও জ্ঞান লাভ করিতে পারিবেন। রসসাহিত্যে, বিশেষতঃ ঋতুসংহারের মত কাব্যে, নায়কনায়িকা একান্ত আবশ্যক বটে; কিন্তু আমরা আমাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সেই রসসাহিত্যের কেন্দ্রস্থ মানুষ দুটিকে যতদূর সম্ভব পশ্চাতে রাখিয়া, মুখ্যতঃ পাখীগুলিকে লইয়া, এই আতপতপ্ত নিদাঘের অবসাদক্লিষ্ট অবসরটুকু অতিবাহিত করিতে চেষ্টা করিব।
প্রচণ্ডসূর্য্য-স্পৃহনীয়চন্দ্রমা[১] নিদাঘকাল সমুপস্থিত; সুবাসিত হর্ম্ম্যতল মনোহর বোধ হইতেছে[২]। চন্দ্রোদয়ে সুরম্য নিশায়গ্রীষ্মবর্ণন সুতন্ত্রী গীত নিতান্ত মধুর বলিয়া অনুভূত হয়[২]—এইখানে এমনি সময় সীমন্তিনীদিগের নিতান্ত লাক্ষারসরাগরঞ্জিত সনূপুর চরণধ্বনিতে পদে পদে হংসধ্বনিকে স্মরণ করাইয়া দিতেছে[১]। মেঘদূতের কালিদাস ঋতুসংহারে গ্রীষ্ম বর্ণনায় সমস্ত ক্লান্তি এবং অবসাদের মধ্যে ভারতবর্ষের অত্যন্ত পরিচিত পাখীগুলিকে মানবজীবন হইতে স্বতন্ত্র ও বিশ্লিষ্ট করিতে কিছুতেই রাজি হইতেছেন না। প্রকৃতি মূর্চ্ছিতা; নায়কনায়িকা ক্লান্ত ও অবসন্ন; তথাপি নায়িকার চরণের নূপুরনিক্কণ হংসরুতানুকারী বলিয়া মনে হইতেছে। ভূচর মানবের সঙ্গে খেচর পাখীগুলিকে ঋতুবিশেষে এমন করিয়া ঘনিষ্ঠসম্বন্ধ না করিলে যেন বিশ্বশিল্পী কালিদাসের তুলিকায় সমগ্র চিত্রটি ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠিত না। এই যে আল্তাপরা রাঙা চরণে নূপুর বাজিতেছে,—কেমন করিয়া ইহা পদে পদে হংসকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারে?—পাঠকপাঠিকার হয়’ত স্মরণ থাকিতে পারে যে, মেঘদূতপ্রসঙ্গে আমি এক জাতীয় হংসের রূপবর্ণনা করিয়াছিলাম—চঞ্চুচরণৈর্লোহিতৈর্সিতা,হংসকাকলী অর্থাৎ চঞ্চু ও চরণ লোহিত, দেহটি সাদা। অতএব নায়িকার অলক্তাক্ত চরণের নূপুর-শিঞ্জিতে লোহিতচঞ্চুচরণ শ্বেতাবয়ব হংসের গীত স্বতঃই করিকল্পনায় জাগিয়া উঠিতে পারে।
যে হংসকে প্রচণ্ড রবিকরোদ্দীপ্ত নিদাঘকালে আমরা ক্বচিৎ দেখিতে পাই; ঋতুসংহারে গ্রীষ্মবর্ণনায় যাহার প্রতি কেবল একটু ইঙ্গিত করিয়া কামিনীর কমনীয় চরণকমলের মঞ্জীরধ্বনির আভাসের মধ্য দিয়া কবি যাহাকে বিদায় দিয়াছেন; যাহাকে মুখ্যভাবে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করেন নাই; বর্ষাঋতুবর্ণনার মধ্যে যাহার দর্শনলাভ আমাদের ঘটিয়া উঠিল না; হঠাৎ শরৎবর্ণনার মধ্যেশরদ্বর্ণন সেই আমাদের পূর্ব্বপরিচিত কতিপয়দিনস্থায়ী যাযাবর হংসটি কোথা হইতে উড়িয়া আসিয়া শরৎলক্ষ্মীর নূপুরধ্বনিকে জাগাইয়া তুলিতেছে! মৌনা প্রকৃতি আজ হংসকাকলীতে মুখরিতাা।
কাশাংশুকা বিকচপদ্মমনোজ্ঞবক্ত্রা
সোন্মাদহংসরবনূপুরনাদরম্যা।
আপক্বশালিরুচিরা তনুগাত্রযষ্টিঃ
প্রাপ্তা শরন্নববধূরিব রূপরম্যা॥
কাশপুষ্প যাহার অংশুক, বিকচ কমল যাহার বদন, উন্মত্ত হংসকাকলী যাহার নূপুরশিঞ্জিত, ঈষৎপক্ব শালিধান্য যাহার দেহযষ্টি, সেই শরৎকাল রমণীয় নববধূবেশে আসিয়া উপস্থিত।
কাশৈর্মহী শিশিরদীধিতিনা রজন্যো
হংসৈর্জলানি সরিতাং কুমুদৈঃ সরাংসি।
সপ্তচ্ছদৈঃ কুসুমভারনতৈর্বনান্তাঃ
শুক্লীকৃতান্যুপবনানি চ মালতীভিঃ॥
মহী কাশকুসুমে শুভ্র বর্ণ ধারণ করিয়াছে, রজনী চন্দ্রকরদীপ্তিতে শুক্লা, শ্বেত হংস নদীর জলকে সাদা করিয়াছে; সরোবর কুমুদপুষ্পশোভায়, বনান্ত সপ্তপর্ণীবিকাশে, এবং উপবন মালতীকুসুমে শুভ্র হইয়া রহিয়াছে।
নিদাঘপ্রকৃতির অন্তরালে যে হংস প্রচ্ছন্ন ছিল; বর্ষাগমে মেঘদূতের কবি যাহাকে ক্রৌঞ্চরন্ধ্রের ভিতর দিয়া মানসসরোবরাভিমুখে উড়াইয়া লইয়া গিয়াছেন; শরৎকালে আর্য্যাবর্ত্তের নদীবক্ষে সন্তরণশীল সেই হংস বর্ষাশেষে ঈষন্মলিন নদীজলকে শুভ্র করিয়া, হিল্লোলিতকমলদলরাগরঞ্জিত বীচিমালাকে মুখরিত করিয়া, সিতা শরৎলক্ষ্মীর বাহনরূপে আমাদের অত্যন্ত নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
কারণ্ডবাননবিঘটিতবীচিমালাঃ
কাদম্বসারসচয়াকুলতীরদেশাঃ।
কুর্ব্বন্তি হংসবিরুতৈঃ পরিতো জনস্য
প্রীতিং সরোরুহরজোরুণিতাস্তটিন্যঃ॥
যে তটিনীর বীচিমালা কারণ্ডবচঞ্চু কর্ত্তৃক সঙ্ক্ষোভিত; যাহার তীরদেশ কাদম্বসারসসমাকীর্ণ; পদ্মরেণুরাগরঞ্জিত সেই নদী হংসকাকলীতে চতুর্দ্দিক্ মুখরিত করিয়া মানবের আনন্দ সঞ্চার করিতেছে।
সোন্মাদহংসমিথুনৈরুপশোভিতানি
স্বচ্ছপ্রফুল্লকমলোৎপলভূষিতানি।
মন্দপ্রভাতপবনোদ্গতবীচিমালা-
ন্যুৎকণ্ঠয়ন্তি সহসা হৃদয়ং সরাংসি॥
যে সকল সরোবরে হংসমিথুন উন্মত্ত হইয়া ক্রীড়া করিতেছে; তাহাদের জল স্বচ্ছ এবং প্রফুল্লকমলোৎপলশোভিত; মন্দ প্রভাতপবনহিল্লোলে তাহাদের বক্ষ আন্দোলিত; ইহাই হৃদয়কে সহসা ব্যাকুল করিয়া তুলিতেছে।
নৃত্যপ্রয়োগরহিতাঞ্ছিখিনো বিহায়
হংস নুপৈতি মদনো মধুরপ্রগীতান্।
শিখিগণ এখন আর নৃত্য করে না; কামদেব তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া কলকণ্ঠ হংসগণকে আশ্রয় করিয়াছেন।
সম্পন্নশালিনিচয়াবৃতভূতলানি
স্বস্থস্থিতপ্রচুরগোকুলশোভিতানি।
হংসৈঃ সসারসকুলৈঃ প্রতিনাদিতানি
সীমান্তরাণি জনয়ন্তি নৃণাং প্রমোদম্॥
ভূতল জলসিক্ত শালিধান্যে আবৃত; গো-কুল সুস্থভাবে অবস্থান করিতেছে; সারসহংসনাদে সীমান্তর ধ্বনিত হইতেছে।
প্রস্ফুটিত কুমুদপুষ্পশোভিত, মরকতমণির ন্যায় দীপ্ত জলাশয়ে রাজহংস রহিয়াছে—
স্ফুটকুমুদচিতানাং রাজহংসস্থিতানাং
মরকতমণিভাসা বারিণা ভূষিতানাম্।
মত্তহংসস্বনে অসিতনয়না লক্ষ্মীর ক্বণিতকনককাঞ্চীকে স্মরণ করাইয়া দিয়া শরৎ-শ্রী বিদায় লইতেছেন। বিদায়ের প্রাক্কালে নারীর বদনে শশাঙ্কশোভা রাখিয়া এবং মণিনূপুরে হংসকাকলী অর্পণ করিয়া তিনি চলিয়া যাইবেন,—
স্ত্রীণাং বিহায় বদনেষু শশাঙ্কলক্ষ্মীং
কামং চ হংসবচনং মণিনূপুরেষু
… … …
কাপি প্রযাতি সুভগা শরদাগমশ্রীঃ।
শরৎ চলিয়া গেল; হেমন্ত আসিল, তুষারপাত আরম্ভ হইল। হংসকাকলীকে অনুকরণ করিয়া রমণীর নূপুরনিক্কণহেমন্ত এখন আর শ্রুত হয় না। কিন্তু প্রফুল্ল-নীলোৎপল-শোভিত প্রসন্নতোয় সুশীতল সরোবরবক্ষে কাদম্বের উন্মত্ত প্রলাপ শোনা যাইতেছে।
অবশেষে ঋতুসংহারের পঞ্চম সর্গে শিশিরবর্ণনায় আর আমরা আমাদিগের পরিচিত হংসটিকে দেখিতে পাই না। ষষ্ঠ সর্গে সহচর কোকিলকে সঙ্গে লইয়া বসন্ত আসিল,—কিন্তু হংস কোথায় গেল?
হংসজাতীয় প্রায় সমুদয় পাখীর যাযাবরত্বের কথা লইয়া আমি মেঘদূতপ্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিবার চেষ্টা করিয়াছি। মনে রাখিতে হইবে যে, কতকগুলি হংস বৎসরের মধ্যেহংসের প্রব্রজন কেবল চারি মাস এবং অপরগুলি প্রায় ছয় মাসকাল ভারতবর্ষে যাপন করিয়া মধ্য এসিয়ার এবং তিববতের হ্রদতড়াগাভিমুখে উড়িয়া যায়। বিদেশীয় পক্ষিতত্ত্বজ্ঞেরা ইহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়াছেন; এমন কি, কেহ কেহ হংসকে ভারতবর্ষে ঋতুবিশেষে নবীন আগন্তুক হিসাবে দেখিয়া থাকেন। একজন লিখিতেছেন[৩]—
“Some of our web-footed visitors, such as the pintail, Dafila acuta, red-crested pochard, Branta rufina, gadwall, Chaulelasmus streperus, pearl-eye, Filigula nyroca and the grey goose, Anser cinerus, remain in India for some four months only, arriving in November, to depart again in February; while others, such as the bar-headed goose, Anser indicus, the grey teal, Karkedula creca, blue-winged teal, Kerkedula circia, remain with us fully six months—from October to the end of March.”
এই বিবরণ হইতে বুঝা যাইতেছে যে, শরদাগমে অথবা শিশিরের পূর্ব্ব হইতেই হংসগুলি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আসিয়া উপস্থিত হয়; সমস্ত শীত ঋতু তাহারা এদেশে অতিবাহিত করিয়া ফাল্গুন চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তাগমের সঙ্গে সঙ্গে দেশান্তরে উড়িয়া যায়। কেবলমাত্র দুই এক জাতীয় হংস বর্ষার প্রাক্কাল পর্য্যন্ত এদেশে থাকিয়া যায়। মেঘদূতে কবি ক্রৌঞ্চরন্ধ্রের মধ্য দিয়া প্রব্রজনশীল এইরূপ হংসের ছবি আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছিলেন। ঋতুসংহারে কিন্তু মহাকবি নানা ঋতুতে বিভিন্ন-জাতীয় হংসকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে দেখিবার সুযোেগ আমাদিগকে দিয়াছেন। প্রচণ্ড গ্রীষ্মে যে হংসগুলি সহজে আমাদের নয়নগোচর হয় না; কোথায় তাহারা বিক্ষিপ্তভাবে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে, তাহার সন্ধান লইবার চেষ্টা পর্য্যন্তও গতিবিধি আমাদের প্রায় থাকে না; কবি তাহাদিগকে মুখ্যভাবে আমাদের সম্মুখে না আনিয়া কেবলমাত্র কামিনীর নূপুরধ্বনির আভাসের মধ্য দিয়া তাহাদের অস্তিত্ব স্মরণ করাইতেছেন। অতএব গ্রীষ্মবর্ণনায় হংসকে আমরা সম্মুখে পাইলাম না। গ্রীষ্ম ঋতুর অবসানে বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইহারা কেমন করিয়া ভারতবর্ষ হইতে চলিয়া যায়, তাহা আমরা মেঘদূত-প্রসঙ্গে আলোচনা করিয়াছি; এস্থলে তাহার পুনরুল্লেখ নিয়োজন। সুতরাং বর্ষাবর্ণনায় কবি তাহাদিগকে একেবারে বাদ দিয়াছেন;—ইহার মধ্যে আমরা হংসের অস্তিত্বের আভাসমাত্রও পাই না। বর্ষাপগমে ইহারা যখন ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া এদেশের নদ-নদী-হ্রদ-তড়াগসমূহ পুনরায় অধিকার করিয়া বসে,—শ্বেতা শরৎলক্ষ্মীর সেই দৃশ্যটুকুই বারম্বার আমরা ঋতুসংহারের শরৎবর্ণনায় দেখিতে পাই। তখন ইহাদের কলগীতি শরৎ-শ্রীর নূপুরশিঞ্জিত বলিয়া ভ্রম হয়। ইহাদের শুভ্র পতত্রে নদীর জল সাদা হইয়া উঠে। বিচিত্রলীলাভঙ্গে চঞ্চুপুট সাহায্যে ইহারা তটিনীর ক্ষুদ্র বীচিমালাকে সংক্ষোভিত করিয়া তুলে। কাদম্বসারসের কলধ্বনি তটিনীর তীরদেশকে আকুলিত করে। সরোবরে হংসমিথুনের উন্মত্ত ক্রীড়া ও উদ্দাম চাপল্য পথিকের চিত্তহরণ করে। সীমান্তর ঘন ঘন হংসনাদে প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠে। কুমুদশোভিত জলাশয়ে রাজহংস প্রকৃতির সৌন্দর্য্যবর্দ্ধন করিয়া থাকে। হেমন্ত ঋতুতে প্রফুল্লনীলোৎপলশোভিত প্রসন্নতোয় সুশীতল সরোবরে কাদম্বজাতীয় হংসের কলোচ্ছ্বাস আমাদের হৃদয়ের তটমূলে আসিয়া আঘাত করিতে থাকে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, শিশিরবর্ণনায় আর আমরা আমাদের পরিচিত হংসজাতীয় বিহঙ্গগুলিকে দেখিতে পাই না। কেন কবির শিশিরবর্ণনার মধ্যে হংসের স্থান রহিল না, ইহার উত্তর কবিবর নিজেই যেন কতকটা দিয়াছেন বলিয়া মনে হয়;—
নিরুদ্ধবাতায়নমন্দিরোদরং
- হুতাশনো ভানুমতো গভস্তয়ঃ। ইত্যাদি
দারুণ শীতে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া তন্মধ্যে অবরুদ্ধ হইয়া বসিয়া থাকিতে ভাল লাগে; হুতাশন এবং সূর্য্যরশ্মি অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ। চন্দন ভাল লাগে না; চন্দ্রকিরণ ভাল লাভে না; হর্ম্ম্যতল সুখকর নয়; সান্দ্রতুষার-শীতল বায়ুও সহ্য হয় না। সেই নিরুদ্ধবাতায়ন মন্দিরমধ্যে থাকিয়া পূর্ব্বের মত বহিঃপ্রকৃতির সহিত সম্বন্ধ রক্ষা করা অত্যন্ত সুকঠিন। প্রকৃতিবর্ণনায় এখন কেবলমাত্র তুষারসংঘাতনিপাত-শীতলা রাত্রিকে কবিবর তাঁহার নায়কনায়িকার backgroundরূপে বড় করিয়া দেখিতেছেন; আর পশুপক্ষী নদী-হ্রদ-তড়াগ প্রভৃতি অন্য সমস্তই যেন তাঁহার উপেক্ষণীয়। এ অবস্থায় কবিবরের তুলিকায় শিশিরচিত্রে হাঁসের চেহারার রেখাটি পর্য্যন্ত যে কোথাও ফুটিয়া উঠিল না, ইহা আর বিচিত্র কি? বাস্তবিক কিন্তু শীতকালে হংসজাতীয় অনেক পাখী এদেশে থাকে, এ কথার উল্লেখ পূর্ব্বে করিয়াছি। হয়ত’ শীতের পাণ্ডুরতার মধ্যে আমাদের Grey Gooseএর পাণ্ডুরতা কোনও বিশিষ্ট সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করে না বলিয়া সৌন্দর্য্যের কবি তাহাকে আমলে আনেন নাই। এস্থলে আমি শুধু নিছক সৌন্দর্য্য তত্ত্বের দিক্ হইতে এইটুকু ইঙ্গিত করিলাম মাত্র। কিন্তু যাঁহারা পক্ষী শিকার করিয়া আনন্দ পান, তাঁহারা গভীর শীতের মধ্যে হাঁসের রূপবর্ণনা শতমুখে করিয়া থাকেন। বৎসরের মধ্যে যে কয় মাস হাঁসেরা নদী-হ্রদ-সরোবর-সীমান্তে বিচরণ করে, তাহার অধিকাংশই শিশিরের প্রাক্কাল হইতে অবসান পর্য্যন্ত, একথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। আশ্বিন কার্ত্তিক মাসে দূর দেশান্তর হইতে আর্য্যাবর্ত্তে উড়িয়া আসিয়া মাঘ ফাল্গুনে তাহারা চলিয়া যায়।
এখন বোধ হয় সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাকে বুঝাইতে হইবে না যে, যখন পিকসহচর বসন্ত আসিয়া উপস্থিত হইল, হংসজাতীয় পাখীগুলির দেখা পাই না কেন। পূর্ব্ব হইতেই প্রব্রজনশীল কতিপয়দিনস্থায়ী হংস আর্য্যাবর্ত্তের বাহিরে, হিমালয়ের পরপারে, তিব্বতীয় হ্রদসান্নিধ্যে, উত্তর-মেরু প্রদেশস্থ জলাশয়-তটদেশে তাহার গার্হস্থ্যলীলার অভিনয় করিবার জন্য ক্রৌঞ্চরন্ধ্রের ভিতর দিয়া উড়িয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে। তাই যখন নবীন বসন্তে কুঞ্জে কুঞ্জে কোকিলের কুহুধ্বনি বসন্ত ঋতুর আগমনবার্ত্তা ঘোষণা করিল, তখন আর কাদম্ব, কারণ্ডব রাজহংসের কলধ্বনি শ্রুত হয় না।
এখন এই ঋতুসংহারের হংসজাতীয় পাখীগুলির কিঞ্চিৎ বৈজ্ঞানিক পরিচয় আবশ্যক। ইহাদিগের মধ্যে একটির সহিত আমাদের পূর্ব্বেই পরিচয় হইয়া গিয়াছে—সেটি রাজহংস।রাজহংস পক্ষিতত্ত্বজ্ঞের-নিকটে ইহা Phoenicopterus বা Flamingo নামে পরিচিত। এই পক্ষীটি যাযাবর; ইহার চঞ্চু ও চরণ লোহিত। শরতের সুনীল আকাশতলে কুমুদশোভিত সরোবরমধ্যে বিরাজমান Flamingoকে ঋতুসংহারের কবি উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত করিয়াছেন। আমরা অন্যত্র দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, উদ্ভিজ্জ পদার্থ ইহার প্রিয় খাদ্য;—সেই খাদ্য সরোবর-মধ্যে অথবা সরোবর-সান্নিধ্যে সে প্রচুর পরিমাণে পাইয়া থাকে; তাই আমরা তাহাকে মহাকবির শরদ্বর্ণনায় অনুকূল পরিবেষ্টনীর মধ্যে চিত্রিত দেখিতেছি। আশ্বিন কার্ত্তিক হইতে আসন্ন বর্ষা পর্য্যন্ত ইহাকে ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে বিচরণ করিতে দেখা যায়। অতএব প্রচণ্ড নিদাঘে কামিনীর নূপুরনিক্কণ যদি “হংসরুতানুকারী” বলিয়া ভ্রম হয়, তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; এবং তাহা অবাস্তব বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না।
যে হংসটি কাদম্ব নামে পরিচিত, তাহার আর একটি আখ্যা কলহংস। অমরকোষে দেখিতে পাই—“কাদম্বঃ কলহংসঃ স্যাৎ”। অভিধানরত্নমালায় এইরূপ লেখা আছে—কাদম্ব“পক্ষৈরাধূসরৈর্হংসাঃ কলহংসা ইতি স্মৃতাঃ”। অর্থাৎ ইহার পক্ষ ধূসরবর্ণ এবং ইহা কলহংস নামে পরিচিত। মেঘদূতপ্রসঙ্গে আমরা পাঠকপাঠিকার সহিত একজাতীয় হংসের পরিচয় করাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, তাহার ইংরাজি নাম Grey goose;—ইহার অঙ্গে ভস্মবর্ণের বা ধূসরবর্ণের ছায়া স্বল্পাধিক পরিমাণে লক্ষিত হয়। ভারতের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে ইহা রাজহাঁস বা কড়হাঁস নামে প্রসিদ্ধ। ইহার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট। পাখী শিকার করিতে গিয়া শ্বেতাঙ্গেরা ইহার কণ্ঠধ্বনিতে মুগ্ধ হইয়াছেন। মার্শ্যাল ও হিউম প্রণীত Game Birds of India, Burmah and Ceylon নামক পুস্তকে এইরূপ লিপিবদ্ধ আছে[৪]
“The cackle of a large flock flying overhead at night, high in air, is most sonorous and musical, and there are few sportsmen through whose hearts it does not send a pleasant thrill.”
এই ansirinæ জাতিভুক্ত হাঁসটি ঐ কবিবর্ণিত কলহংস বা কাদম্ব। শরৎঋতুতে ভারতবর্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহারা উড়িয়া আসে। বসন্তাগমে এদেশ হইতে চলিয়া যায়। ইহাই এই জাতীয় যাযাবর হাঁসের রীতি।
এস্থলে বলা আবশ্যক মনে করি যে, আমি মেঘদূতপ্রসঙ্গে রাজহংসকে কতকটা Grey goose জাতীয় বলিয়া পরিচয় দেওয়া যাইতে পারে, এরূপ আভাস দিয়াছি; কিন্তু তাহাকে Flamingo পরিবারভুক্ত করিবার বিশেষ কারণ দেখাইবার চেষ্টাও করিয়াছি। এখনকার সহিত সে উক্তির কোনও বিরোধ নাই। মেঘদূতে কাদম্ব শব্দটি পাওয়া যায় না বলিয়া যে এ সম্বন্ধে কোনও বিরুদ্ধ তর্ক উঠিতে পারে, তাহা মনে হয় না। পরন্তু Grey gooseএর পতত্রের ও অঙ্গের বর্ণ এত পরিবর্ত্তনশীল, যে একই speciesকে কখনও লোহিত-চঞ্চুচরণ শ্বেতাবয়ব রাজহংস ও লোহিত চঞ্চুচরণ কৃষ্ণধূসরাবয়ব কাদম্ব বলিয়া পরিচিত করিলে আভিধানিক হিসাবে কোনও ভুল হয় না। ইহাদের বর্ণবৈচিত্র্য সম্বন্ধে একজন বিশেষজ্ঞ লিখিয়াছেন[৫]—
“Generally the tone of plumage varies much more than it usually does in wild birds, or than it does in any other Goose with which I am acquainted.”
ধূসরবর্ণ পক্ষের দ্বারা কাদম্বের বিশেষভাবে পরিচয় পাওয়া যায়, একথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। অভিধানচিন্তামণিকার বলিতেছেন—“কাদম্বাস্তু কলহংসাঃ পক্ষৈঃ স্ফুরতি ধূসরৈঃ।”
এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে রঘুবংশের ত্রয়োদশ সর্গে রামচন্দ্র গঙ্গাযমুনাসঙ্গম দেখিয়া জানকীকে বলিতেছেন—হে অনবদ্যাঙ্গি! ঐ দেখ, যমুনাতরঙ্গের সহিত গঙ্গাপ্রবাহ মিশিয়া কেমন শোভা পাইতেছে। ঠিক যেন মানসসরোবরপ্রিয় রাজহংসের সহিত কাদম্বপঙ্ক্তি মিলিত হইয়াছে,—“ক্বচিৎ খগানাং প্রিয়মানসানাং কাদম্বসংসর্গবতীব পঙ্ক্তিঃ”। এই কাদম্ব রাজহংস শ্রেণীবদ্ধ হইয়া তটিনীতে, নদীতটে, সরোবরে ও সীমান্তরে বিচরণ করে। যেখানে প্রচুর শালিধান্য রহিয়াছে, সেখানে ইহাদের উন্মত্ত প্রলাপ শোনা যায়; যেখানে কুমুদপুষ্প বীচিবিক্ষোভিত হইয়া দুলিতে থাকে, সেখানে ইহারাও তরঙ্গবক্ষে ভাসিয়া বেড়ায়; যেখানে জলাশয়, সেখানে ইহাদের কলকণ্ঠ শরৎলক্ষ্মীর জয় ঘোষণা করিতে থাকে;—প্রকৃতির চিত্রপটে হংসের ছবির সহিত কবিবর্ণিত এই কাদম্বরাজহংসের কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। বাস্তবিক তাহারা জলচর ও স্থলচর; শালিধান্য ও বিসকিসলয় তাহাদের আহার্য্যের মধ্যে অন্যতম।