পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/মেঘদূতের পক্ষিতত্ত্ব (২)

মেঘদূতের পক্ষিতত্ত্ব

(২)

 হংস-সারস-বলাকা-চক্রবাকের কথা কতকটা বলা হইয়াছে, কিন্তু মেঘদূতের কবি ময়ূরকে উপেক্ষার চক্ষে দেখিতে পারেন নাই। অন্য পাখীর বিলাসসুভগ লাস্যলীলা মনোহারিণী বটে, কিন্তু শুক্লাপাঙ্গ শিখীর জলভরা আঁখি দুটি ও বিচিত্র কেকাধ্বনি হয়’ত দৌত্যকার্য্য-সম্পাদনতৎপর মেঘকে ক্ষণেকের জন্য আত্মবিস্মৃত করাইয়া অভিশপ্ত প্রবাসী যক্ষের বিরহবেদনার কিছুমাত্র উপশম না করিয়া বিরহিণী যক্ষপত্নীর নিকটে পঁহুছাইতে বিলম্ব ঘটাইতে পারে, এই দুশ্চিন্তা রামগিরি পর্ব্বতের যক্ষটিকে পীড়িত করিতেছে। অন্য বিহঙ্গ’ত আকাশপথে মেঘদূতের সহযাত্রী হইতে পারে,শিখী কিন্তু ককুভ-সৌরভামোদিত পর্ব্বতে পর্ব্বতে ময়ূরগণ তাহাদিগের সজল আঁখি তুলিয়া জলভরা মেঘকে যদি কিছুক্ষণের নিমিত্ত আট্‌কাইয়া ফেলে, সেই ভয়ে যক্ষ তাঁহার দূতটিকে আগে হইতেই সাবধান করিয়া দিতেছেন—

উৎপশ্যামি দ্রুতমপি সখে! মৎপ্রিয়ার্থং যিযাসোঃ,
কালক্ষেপং ককুভসুরভৌ পর্ব্বতে পর্ব্বতে তে।
শুক্লাপাঙ্গৈঃ সজলনয়নৈঃ স্বাগতীকৃত্য কেকাঃ,
প্রত্যুদ্‌যাতঃ কথমপি ভবান্ গন্তুমাশু ব্যবস্যেৎ॥

 যে পাখীর অপাঙ্গ শুক্ল, নয়ন সজল, বর্হ স্ফূরিতরুচি ও উজ্জ্বল রেখাবলয়সমন্বিত, কণ্ঠ নীল এবং কেকারবচেষ্টায় উন্নমিত; সেই মেঘসুহৃৎকে কেমন করিয়া বিরহী যক্ষের দূত এড়াইয়া যাইতে পারে? অলকায় গিয়াও মেঘদূত নীলকণ্ঠ ভবনশিখীর দর্শনলাভ করিতে পারে! দিবসাপগমে যিনি কাঞ্চনবাসযষ্টির উপরে সেই ময়ূরকে নাচাইয়া একদিন আনন্দ উপভোগ করিতেন, তাঁহার কাছেই যাইবার জন্য’ত মেঘকে দৌত্যকার্য্যে ব্রতী করা হইয়াছে। তাই দেখিতে পাই, কালিদাসের মেঘদূতে ময়ূর কতখানি স্থান অধিকার করিয়াছে।

 কিন্তু তাই বলিয়া কি কবিবরের বর্ণনায় কেবলমাত্র বর্ণ ও শব্দপ্রাচুর্য্যে পাখীটিকে তাহার বাস্তব জীবন হইতে বিচ্যুত করিয়া কবির খেয়াল-প্রসূত একটা অবাস্তব জিনিষে পরিণত করা হইয়াছে? রোমান্সের কুহেলিকায় আমরা কি আসল পাখীটির খাঁটি পরিচয় পাইব না? তাহার নয়ন কি সজল নয়, অপাঙ্গ শুক্ল নয়? আসন্ন বর্ষায় উত্তরপশ্চিম ভারতের পর্ব্বতে তাহার কেকাধ্বনি কি শ্রুত হয় না? মেঘের সহিত তাহার সম্বন্ধ দেখিয়া সাধারণ লোকে কি তাহাকে মেঘসুহৃৎ বলিতে পারে না? পুত্রবৎসল ভবানী ইন্দীবরদলশোভিতকর্ণে যে বর্হটি স্থাপিত করেন, যে ময়ূরপুচ্ছ গোপবেশধারী বিষ্ণুর শিরোভূষণ, তাহা কি উজ্জ্বলরেখাবলয়ি নহে? আবার কবি যে তাহাকে গলিত অর্থাৎ স্বয়ংছিন্ন বর্হ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাও কি বৈজ্ঞানিক হিসাবে সত্য নহে? এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনা করিবার পূর্ব্বে মেঘদূত হইতে ময়ূরের রূপ ও স্বর-বর্ণনাসূচক কয়েকটি শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না—

জ্যোতির্লেখাবলয়ি গলিতং যস্য বর্হং ভবানী,
পুত্ত্রপ্রেম্না কুবলয়দলপ্রাপি কর্ণে করোতি।
ধৌতাপাঙ্গং হরশশিরুচা পাবকেস্তং ময়ূরং
পশ্চাদদ্রিগ্রহণগুরুভির্গর্জ্জিতৈর্নর্ত্তয়েথাঃ॥

 যাহার উজ্জ্বল রেখাবলয়সমন্বিত বর্হটি স্বতঃ স্খলিত হইলে পর যাহাকে পুত্রবৎসলা ভবানী ইন্দীবরদল-শোভিত কর্ণে ভূষণার্থ স্থাপিত করেন, হরশশিকিরণ কর্ত্তৃক ধৌতাপাঙ্গ সেই ময়ূরকে মেঘ অদ্রিগ্রহণগুরু গর্জ্জন দ্বারা সহজে নৃত্য করাইতে সমর্থ হইবে।

 *                    *                    *                    
রত্নচ্ছায়াব্যতিকর ইব প্রেক্ষ্যমেতৎ পুরস্তাদ্
বল্মীকাগ্রাৎ প্রভবতি ধনুঃখণ্ডমাখণ্ডলস্য।
যেন শ্যামং বপুরতিতরাং কান্তিমাপৎস্যতে তে,
বর্হেণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ॥

 গোপবেশধারী বিষ্ণুর তনু স্ফুরিতরুচি ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা মণ্ডিত হইলে যেমন অপরূপ শোভা হয়, হে মেঘ! তোমার শ্যামবর্ণ দেহ রত্নচ্ছায়াব্যতিকরের ন্যায় দর্শনীয় বল্মীকস্তূপাগ্র হইতে উদীয়মান ইন্দ্রধনুঃখণ্ডের সংসর্গে অত্যন্ত শোভা ধারণ করিবে।

 *               *               *               *               
কেকোৎকণ্ঠা ভবনশিখিনো নিত্যভাস্বৎকলাপাঃ

 অলকায় ভবনশিখিগণ নিত্যই সমুজ্জ্বল কলাপ বিস্তার করিয়া কেকারবে উদ্গ্রীব হইয়া থাকে।

 *               *               *               *               
শ্যামাস্বঙ্গং চকিতহরিণীপ্রেক্ষণে দৃষ্টিপাতং।
বক্ত্রচ্ছায়াং শশিনি শিখিনাং বর্হভারেষু কেশান্।
উৎপশ্যামি  *          *          *          *          

 প্রিয়ঙ্গুলতায় তোমার গাত্রসৌকুমার্য্য, চকিত হরিণীনয়নে তোমার দৃষ্টিপাত, চন্দ্রে আননশোভা, ময়ূরপুচ্ছে তোমার কেশভার অবলোকন করিতেছি।

 *               *               *               *               
জালোগ্দীর্ণৈরুপচিতবপুঃ কেশসংস্কারধূপৈ-
র্বন্ধুপ্রীত্যা ভবনশিখিভির্দত্তনৃত্যোপহারঃ।

 গবাক্ষবিনির্গত নারীগণের কেশসংস্কারধূপের দ্বারা বর্দ্ধিতাবয়ব হইলে হে মেঘ! তোমাকে গৃহপালিত ময়ূরগণ স্বকীয় বন্ধুপ্রীতিবশতঃ নৃত্যোপহার প্রদান করিবে।

তালৈঃ শিঞ্জাবলয়সুভগৈনর্ত্তিতঃ কান্তয়া মে
যামধ্যাস্তে দিবসবিগমে নীলকণ্ঠঃ সুহৃদ্বঃ॥

 দিবসাপগমে যখন তোমাদের (মেঘের) সুহৃৎ নীলকণ্ঠ ময়ূর বাসযষ্টির উপর উপবেশন করে, তখন যক্ষপ্রিয়া বলয়াদিশিঞ্জনের তালে তালে তাহাকে নাচাইয়া থাকেন।

 শ্লোকোক্ত নীলকণ্ঠ, শুক্লাপাঙ্গ, ধৌতাপাঙ্গ, সজলনয়ন প্রভৃতি শব্দগুলি বৈজ্ঞানিকের নিকটে মেঘসুহৃৎ ময়ূরগণের সবিশেষ পরিচয় করাইয়া দেয়। কেবলমাত্র দুই শ্রেণীর ময়ূর ভারতবর্ষে দৃষ্ট হয় বলিয়া আধুনিক যুগের পক্ষিতত্ত্ববিদ্‌গণ স্থিরীকৃত করিয়াছেন, তন্মধ্যে Pavo cristatus পক্ষী যে কবিবর্নিত ময়ূর, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। ইহার গলদেশ নীলবর্ণ, মস্তকে শিখা, অপাঙ্গ শুক্ল, পুচ্ছ জ্যোতির্লেখাবলয়ি। মিঃ ব্লান্‌ফোর্ডের গ্রন্থ[] হইতে আমরা ইহার কিছু বিবরণ উদ্ধৃত করিলাম।

 “Neck all round rich blue (নীলকণ্ঠ), crest (শিখা) of long almost naked shafts terminated by fanshaped tips that are black at the base, bluish green at the ends; * * the longest plumes (পুচ্ছ) ending in an ‘eye’ or ocellus consisting of a purplish-black heartshaped nucleus surrounded by blue within a coppery disk, with an outer rim of alternating green and bronze (জ্যোতির্লেখাবলয়ি)”।

 ময়ূরের অপাঙ্গবর্ণনা আমরা ডাক্তার ব্রেমের (Dr. Brehm) পুস্তকে[] এইরূপ দেখিতে পাই—“The eye is dark brown, and the bare ring that surrounds it whitish.” গুজরাট্, কচ্, রাজপুতনা, সিন্ধু প্রভৃতি ভারতের উত্তরপশ্চিম প্রদেশে এই জাতীয় ময়ূর অধিক সংখ্যায় দৃষ্ট হয়। বর্ষাঋতু ইহাদের গর্ভাধানকাল। মেঘদর্শনে পর্ব্বতে পর্ব্বতে ইহাদিগের নৃত্য এবং স্বাগত কেকাধ্বনি শিখিদম্পতির কেবলমাত্র অহেতুক আনন্দের পরিচায়ক নহে; ইহা তাহাদিগের পরস্পরের প্রীতির উচ্ছাসসূচকও বটে। যখন ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’ তখন প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে ময়ূর ময়ূরীর দাম্পত্যলীলার প্রশস্ত সময়;—মেঘের সহিত ময়ূরের এই নিবিড় সম্পর্ক কোনও পক্ষিতত্ত্ববিৎ অস্বীকার করিতে পারেন না। মিঃ ব্লান্‌ফোর্ড এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন,—

 Several males with their tails and trains raised vertically and expanded, may be seen strutting about and ‘showing off’ before the hens. The latter lay ......for the most part in the rainy season from June lo September.”[]

 এই জুন হইতে সেপ্টেম্বর মাস পর্য্যন্ত মোটামুটি আমাদের দেশের বর্ষাকাল। তাই যদি বিরহী যক্ষ মেঘসুহৃদের প্রতি মেঘের বন্ধুপ্রীতির কথা তুলিয়া তাঁহার দূতটিকে সাবধান করিয়া দিয়া থাকেন, তাঁহার আশঙ্কা যে কেবলমাত্র বিরহীর বুভুক্ষু হৃদয়ের অমূলক দুশ্চিন্তাপ্রসূত তাহা নহে; তাহার পশ্চাতে একটা বাস্তব বৈজ্ঞানিক সত্য প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।

 এখন দেখা যাক্, গলিত বর্হের তাৎপর্য্য কি? মল্লিনাথ ইহার টীকা করিয়াছেন—“গলিতং ভ্রষ্টং, ন তু লৌল্যাৎ, স্বয়ং ছিন্নমিতি ভাবঃ” অর্থাৎ যে পালক আপনা আপনি খসিয়া পড়িয়া যায়। বাস্তবিক বর্ষাঋতুর শেষে এই পতত্রস্খলন ব্যাপার দৃষ্ট হয়; এই সময়ে পুংপক্ষিগণের পুরাতন সুদীর্ঘ পুচ্ছ খসিয়া যায়। তৎপরির্ত্তে যে নূতন পুচ্ছের আবির্ভাব হয়, তাহা সম্পূর্ণরূপে গজাইয়া উঠিতে প্রায় পাঁচ ছয় মাস সময় লাগে[]। মেঘদূতে দেবদেবীর মস্তক বা কর্ণাভরণ রূপে ময়ূরের গলিতবর্হের ব্যবহারের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু মনুষ্যসমাজে অতি প্রাচীনকাল হইতে ইহার ব্যবহার বড় কম দেখা যায় না। ভারতবর্ষে ময়ূরপুচ্ছের আদর এখনও যথেষ্ট আছে; কিন্তু এই পুচ্ছ আহরণের নিমিত্ত জীবহিংসা না করিয়া কেবলমাত্র স্বয়ংস্খলিত বর্হের ব্যবহারই অনুমোদিত হয়। এখনও আর্য্যাবর্ত্তে ময়ূর পবিত্র জীব বলিয়া পরিগণিত। জ্যর্ডন (Jerdon) তাঁহার Birds of India নামক গ্রন্থে লিখিতেছেন[]

 “It is venerated in many districts. Many Hindoo temples have large flocks of them; indeed, shooting it is forbidden in some Hindoo States.”

 কচ্, রাজপুতনা প্রভৃতি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রদেশসমূহে বন্য ময়ূর অধিক সংখ্যায় দেখা যায় বটে; কিন্তু গৃহপালিত ভবনশিখীর সংখ্যাও বড় কম নয়। এমন কি, যেখানে স্বাধীন বন্য অবস্থায় ইহাদিগকে দেখিতে পাওয়া সম্ভবপর নহে, সেখানেও গৃহস্থেরা তাহাদিগকে পোষ মানাইয়া রাখে; কখনও কখনও বা তাহারা কোন বিশিষ্ট গৃহস্থ কর্ত্তৃক পালিত না হইয়া দলে দলে নগর মধ্যে স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করিতে পায়। এই গৃহপালিত ময়ূরগণ প্রায়ই মেঘদূতের নেত্রপথবর্ত্তী হইতেছে। অলকায় অশোকবকুল-তলে ভবনশিখীর জন্য বাসযষ্টি রচিত রহিয়াছে—

তন্মধ্যে চ স্ফটিকফলকা কাঞ্চনী বাসযষ্টি-
র্মূলে বদ্ধা মণিভিরনতিপ্রৌঢ়বংশ-প্রকাশৈঃ॥

 অশোক ও বকুল বৃক্ষের মধ্যে এক সুবর্ণনির্ম্মিত বাসযষ্টি আছে, যাহার তলদেশ তরুণ বংশের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট মণিদ্বারা বদ্ধ এবং যাহার উপরিভাগে একটি স্ফটিক-ফলক স্থাপিত আছে।

 কৃত্রিমতার মধ্যে প্রকৃতির অনুকরণ করিয়া বাসযষ্টিটি নির্ম্মাণ করিবার উদ্দেশ্য যে শুধু নীলকণ্ঠ ময়ূরকে আকৃষ্ট করিবার নিমিত্ত, তাহা বেশ বুঝা যায়। তরুণ বংশের নীল আভাবিশিষ্ট মরকতমণি দ্বারা রচিত হইলেও বাসযষ্টিটি প্রকৃত বংশখণ্ডের সবুজ শোভা ধারণ করিয়াছে। সন্ধ্যাগমে বংশভ্রমে নীলকণ্ঠ ইহার উপরে উপবেশন করিয়া রাত্রিযাপন করে। ময়ূরের স্বভাব[] এই যে, সে রাত্রি যাপনের নিমিত্ত একটি উপযোগী বাসযষ্টি বাছিয়া লয়; প্রতি সন্ধ্যায় সেই নির্দ্দিষ্টস্থানে আশ্রয় লইবার নিমিত্ত উপস্থিত হয়;—বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্‌গণ ইহা বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়াছেন। গৃহপালিত ময়ূরগণের বাসযষ্টির ব্যবস্থা নির্দ্দেশ করিয়া কবি তাৎকালিক পক্ষিপালন-প্রথার সুস্পষ্ট আভাস দিয়াছেন। আর্য্যাবর্ত্তে গৃহপালিত ময়ূরটিকে গৃহস্থ কুলবধূ কেমন করিয়া বলয়শিঞ্জিতে নাচাইয়া থাকেন, তাহার জন্য সাক্ষ্য লইতে আমাদের পাঠকপাঠিকাকে পাশ্চাত্য ornithologistএর নিকটে যাইতে হইবে না, কিন্তু গৃহের বাহিরে ময়ূরীর সম্মুখে ময়ূর কলাপবিস্তার করিয়া কেমন নৃত্য করে, তাহা দেখিয়া অনেক বিদেশী পক্ষিতত্ত্ববিৎ মুগ্ধ হইয়ছেন। Living animals of the world নামক পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগে[] মিঃ পাইক্রাফট্ রচিত পক্ষিপ্রসঙ্গে এইরূপ বর্ণনা আছে—

 “Watch the bird trying to do his best to persuade his chosen what a handsome fellow he is. He first places himself more or less in front of her, but at some little distance off; and then watching his opportunity walks rapidly backwards, going faster and faster till arrived within a foot, he suddenly, like a flash, turns round and displays to the full his truly gorgeous vestments. This turning movement is accompanied by a violent shaking of the train, the quills of which rattle like the pattering of rain upon leaves. Often this movement is followed by a loud scream.”

 এইরূপে ভবনশিখীকে নাচাইয়া যক্ষপত্নী যেমন কতকটা সময় অতিবাহিত করিতেন, তেমনই আবার আর একটি পোষা পাখী তাঁহাকে তাঁহারসারিকা নির্ব্বাসিত স্বামীর কথা স্মরণ করাইয়া দিত। সেটি একটি সারিকা। এই সারিকা যক্ষের অতিশয় প্রিয় ছিল। দূতকে বিদায় দিবার সময় যক্ষ এই সারিকার উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন,—

আলোকে তে নিপততি পুরা সা বলিব্যাকুলা বা,
মৎসাদৃশ্যং বিরহতনু বা ভাবগম্যং লিখন্তী।
পৃচ্ছন্তী বা মধুরবচনাং সারিকাং পঞ্জরস্থাং
কচ্চিদ্‌ভর্ত্তুঃ স্মরসি রসিকে! ত্বং হি তস্য প্রিয়েতি॥

 আর্য্যাবর্ত্তে অতি প্রাচীনকাল হইতে গৃহস্থ সারিকা পালন করিতে ভালবাসিতেন, তাহার ভূরি ভূরি নিদর্শন প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে দেখিতে পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতাকার লিখিতেছেন,—

সরস্বত্যৈ শারিঃ শ্যেতা পুরুষবাক্ সরস্বতে শুকঃ শ্যেতঃ
পুরুষবাক্।—৫ ৫ ১২

 মহাভারতে অনুশাসন পর্ব্বে লিখিত আছে—

গৃহে পারাবতা ধন্যা শুকাশ্চ সহ সারিকাঃ
গৃহেষ্বেতে ন পাপায়।—অধ্যায় ১০৪, শ্লোক ১১৪।

 শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধে সারিকাকে স্রক্, চন্দনমালা, দর্পণ প্রভৃতির ন্যায় নারীদিগের অত্যাবশ্যক বিলাসের সামগ্রী বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। সতী দক্ষযজ্ঞ-সভায় যাইতেছেন,—

তাং সারিকা-কন্দুকদর্পণাম্বূজৈঃ
শ্বেতাতপত্র-ব্যজন-স্রগাদিভিঃ
*               *               *               *               
বৃষেন্দ্রমারোপ্য বিটঙ্কিতা যযুঃ—৪র্থ অধ্যায়, ৫ম শ্লোক।

 এখন প্রশ্ন এই যে, এই সারিকা কোন্ জাতীয় পক্ষী? উপরে উদ্ধৃত তৈত্তিরীয় সংহিতার শারিঃ শ্যেতা শব্দদ্বয়ের সায়নাচার্য্য এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন,—শারিঃ শুকস্ত্রী, কীদৃশী? শ্যেতা অরক্তবর্ণা। আমাদের মনে হয় যে, সায়ন এস্থলে একটা বিষম ভুল করিয়াছেন। সারিকা এবং শুক দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রজাতীয় পক্ষী;—একটি ময়না জাতীয়, অপরটি আমাদের সর্ব্বজন পরিচিত টিয়া পাখী; উভয়ের মধ্যে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক প্রকৃতির বিধিবিরুদ্ধ, অথচ সাধারণতঃ আমরা শুক সারি শব্দ দুইটি যেরূপে ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহাতে বোধ হয়, যেন উভয়ের মধ্যে স্বামী স্ত্রী সম্বন্ধ আছে এবং উভয়েই এক জাতীয় বলিয়া ধরিয়া লওয়া হয়। হিন্দুস্থানে সালিক পাখীকে ময়না নামে অভিহিত করা হয়। অধিকাংশ বিদেশী পক্ষিতত্ত্ববিদ্‌গণের রচিত প্রবন্ধে ও পুস্তকে এই নাম বজায় রাখা হইয়াছে। কিন্তু বাস্তবিক যে শ্রেণীর পক্ষী পার্ব্বত্য ময়না বলিয়া পরিচিত, তাহা যে সালিক জাতীয় পক্ষী নহে এবং বৈদেশিক গ্রন্থাদিতে বর্ণিত ময়না হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তাহা সম্প্রতি মিঃ ওটস্-প্রমুখ বৈজ্ঞানিকগণ স্থির করিয়াছেন[]। তাঁহারা এই পার্ব্বত্য ময়নাকে Eulabes পরিবারভুক্ত করিয়াছেন। ইহার ইংরাজি নাম Grackle। মানুষের বুলি অনুকরণ করিতে ইহারা বড় পটু; এই নিমিত্ত ইহারা গৃহস্থের নিকটে অন্য পোষাপাখী অপেক্ষা অধিক আদর পায়। সালিক পাখীকে এখনকার বৈজ্ঞানিকগণ Sturnidae পরিবারভুক্ত করিয়া পার্ব্বত্য ময়না হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌ জাতীয় মনে করেন। ইহারাও কিছু কিছু মানুষের বুলি বলিতে শিখে[] এবং সাধারণ গৃহস্থের বাড়ীতে পালিত হইয়া থাকে। আমাদের মনে হয় যে, গৃহস্থপালিত এই দুই পাখীই সংস্কৃত সাহিত্যে সারিকা নামে পরিচিত[১০]। এতদিন পর্য্যন্ত সালিক এবং পার্ব্বত্য ময়না উভয়েই বিহঙ্গতত্ত্ববিদের নিকটে একই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলিয়া গণ্য হইতেছিল। সাধারণ লোকের নিকটে ও ভারতবর্ষের অধিকাংশস্থলে উহারা উভয়েই ময়না নামে চলিয়া আসিতেছে।

 একটা কথা বোধ হয় এখানে বলা আবশ্যক যে, তৈত্তিরীয় সংহিতার শারি শ্যেতা ও উপরে উদ্ধৃত মহাভারত এবং ভাগবতের সারিকা আভিধানিক হিসাবে একই পক্ষীকে বুঝায়। সারি শব্দের বানানে “স” কিম্বা “শ” দুইই ব্যবহৃত হয়। আর একটি প্রশ্ন এই, তৈত্তিরীয় সংহিতায় যে শ্যেতা শারির উল্লেখ আছে, তাহা বৈজ্ঞানিক হিসাবে যথার্থ কি না? অর্থাৎ সারিকার বর্ণ শুভ্র হয় কি না? আমরা কিন্তু সাধারণতঃ সারিকার অঙ্গে কৃষ্ণধূসর বর্ণের প্রাধান্যই লক্ষ্য করিয়া থাকি। শুভ্রতা বা albinism যে অনেক সময়ে সালিক জাতীয় পক্ষীর বর্ণে প্রতিফলিত হয়, তৎসম্বন্ধে বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ মিঃ ফ্রাঙ্ক ফিন্ লিখিয়াছেন—“Albinism is not very uncommon in this (House or common) Mynah[১১]। এই House-Mynah বা Common mynah পার্ব্বত্য ময়নাকে বুঝাইতেছে না; ইহা সালিক পাখী।

 এইবার পথিমধ্যে গৃহবলভিতে সুপ্ত পারাবত ও অম্ভোবিন্দুগ্রহণচতুর চাতকের উপর কিঞ্চিৎ বৈজ্ঞানিক আলোকরশ্মি নিপাতিত করিয়া সঞ্চরমাণ মেঘদূতকে অলকার পথে বিদায় দিয়া, আমরা আমাদের বক্তব্য শেষ করিব। মেঘকে সম্বোধন করিয়া যক্ষ বলিতেছেন—

তাং কস্যাঞ্চিদ্ভবনবলভৌ সুপ্তপারাবতায়াং,
নীত্বা রাত্রিং চিরবিলসনাৎ খিন্নবিদ্যুৎকলত্রঃ।
দৃষ্টে সূর্য্যে পুনরপি ভবান্ বাহয়েদধ্বশেষং,
মন্দায়ন্তে ন খলু সুহৃদামভ্যুপেতার্থকৃত্যাঃ॥

 যে গৃহবলভিতে পারাবত সুখে নিদ্রিত, সেই স্থানে চিরবিলসনক্লান্ত বিদ্যুৎপত্নীর সহিত রাত্রিযাপন করিয়া সূর্য্য উদিত হইলে তুমি অবশিষ্টপারাবত পথ অতিক্রম করিবার জন্য চেষ্টা করিবে। বন্ধুগণের কার্য্যসম্পাদন করিতে অঙ্গীকার করিয়া কেহ বিলম্ব করে না।

 এই যে পারাবত গৃহবলভিতে আশ্রয় লইয়া রাত্রিতে নিদ্রা যায়, ইহার সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন করিতে পারেন,—এই পাখী সাধারণ গৃহকপোত, না ঘুঘু? মল্লিনাথ অমরকোষ হইতে উদ্ধৃত করিয়া লিখিয়াছেন “পারাবতঃ কলরবঃ কপোতঃ”; কপোত কিন্তু পায়রা এবং অন্য বিহগকেও বুঝায়—‘পারাবতঃ কপোতঃ স্যাৎ কপোতো বিহগান্তরে’ ইতি বিশ্বঃ। এই বিহগান্তর অবশ্যই ঘুঘুপাখীকে নির্দ্দেশ করিতেছে। এখন মেঘদূতের পারাবত ইহাদের মধ্যে কোন্‌টি? বৈজ্ঞানিকের নিকটে পায়রা এবং ঘুঘু একই জাতীয় পাখী। মিঃ ব্লানফোর্ড লিখিয়াছেন[১২]

 “There is no doubt that Pigeons and Doves must be regarded as forming an Order by themselves.”

 মানবাবাসে আশ্রয় লইয়া রাত্রি যাপন করা উভয়েরই অভ্যাস। গোলা-পায়রার (Rock Pigeon) এবম্বিধ অভ্যাস সম্বন্ধে উক্ত গ্রন্থকার লিখিতেছেন[১৩]

 A bird haunting rocky cliffs, old buildings, walls, and when encouraged, human habitations generally, nesting in all the places named.”

 অবশ্যই এ বিষয়ে পায়রা ও ঘুঘুর স্বভাবগত সাদৃশ্য থাকিলেও, যক্ষ যে শুভকার্য্যসাধনতৎপর মেঘদূতকে পারাবতের পরিবর্ত্তে ঘুঘুপক্ষীর সহিত একত্র রাত্রিযাপন করিতে উপদেশ দিবেন, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। কারণ, ঘুঘু অশুভশংসী;—ইহা ‘গৃহনাশন,’ ‘ভীষণ’, ‘অগ্নিসহায়’, ‘দহন,’ ইত্যাদি নামে আখ্যাত। মেঘদূতের পারাবত যে ঘুঘকে না বুঝাইয়া ‘বাগ্‌বিলাসী,’ ‘ঘরশ্রিয়’, ‘মদন’, ‘মদনমোহন,’ ‘গৃহকপোত’ বা পায়রাকে বুঝাইতেছে তাহা নিঃসন্দেহ। এই ভারতীয় Rock-Pigeonকে (Columba intermedia) সমগ্র ভারতবর্ষে দেখিতে পাওয়া যায়। এইবার চাতকের কথা। মেঘদূতের কবি পাখীটির উল্লেখ চারবার করিয়াছেন;চাতক প্রতিবারেই ইহার সহিত মেঘের নিবিড় সম্পর্কের নির্দ্দেশ করিয়াছেন। দৌত্যকার্য্যে ব্রতী হইতে না হইতেই মেঘের বামভাগে মধুরভাষী চাতক কূজন করিতেছে—

বামশ্চায়ং নদতি মধুরং চাতকস্তে সগর্বঃ।

 পুনশ্চ, সিদ্ধপুরুষগণ অম্ভোবিন্দুগ্রহণচতুর চাতককে নিরীক্ষণ করিতেছেন, এমন সময়ে অসন্ন মেঘের গর্জ্জন শুনা গেল—

অম্ভোবিন্দুগ্রহণচতুরাংশ্চাতকান্ বীক্ষ্যমাণাঃ,
*               *               *               *               
ত্বামাসাদ্য স্তনিতসময়ে মানয়িষ্যন্তি সিদ্ধাঃ,
সোৎকম্পানি প্রিয়সহচরীসম্ভ্রমালিঙ্গিতানি।

 অন্যত্র যক্ষ তাঁহার দূতটির বদান্যতার উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন—

নিঃশব্দোঽপি প্রদিশসি জলং যাচিতশ্চাতকেভ্যঃ

 শুধু মেঘদূতে নয়, সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে মেঘের সহিত এই পাখীটির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা আমরা দেখিতে পাই। অভিধানকারগণও চাতকের পরিচয় দিতে গিয়া মেঘের আকর্ষণী শক্তির কথাটাই বড় করিয়া বলিয়াছেন:—“চততি যাচতে সততম্ভোমেঘং” ইতি শব্দস্তোমমহানিধিঃ। বাচস্পত্য অভিধানে চাতকার্থে এইরূপ লিখিত আছে—“যাচনে কর্ত্তরি খুল্। সারঙ্গে স্বনামখ্যাতে খগভেদে”। অভিধানোক্ত সারঙ্গ শব্দটি চাতকের নামান্তর মাত্র; তদ্রূপ স্তোকক ইহার আর একটি নাম। “সারঙ্গস্তোককশ্চাতকঃ সমাঃ ইত্যমরঃ।” মেঘদূতে এই সারঙ্গের উল্লেখ আছে—

সারঙ্গাস্তে জললবমুচঃ সূচয়িষ্যন্তি মার্গম্।

 যদিও সারঙ্গ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে স্থানবিশেষে ব্যবহৃত হয় (সারঙ্গশ্চাতকে ভৃঙ্গে কুরঙ্গে চ মতঙ্গজে ইতি বিশ্বঃ), তথাপি আমরা বেশ বুঝিতে পারি যে, এস্থলে ইহা চাতকপক্ষীকেই বুঝাইতেছে। এই সারঙ্গ অথবা চাতক জললবমুচের অর্থাৎ মেঘের মার্গ সূচনা করিয়া দেয়। মেঘ ভিন্ন চাতকের গত্যন্তর নাই। চাতকাষ্টক কাব্যের কবি মেঘকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন:—

বাতৈর্বিধূনয় বিভীষয় ভীমনাদৈঃ
সঞ্চূর্ণয় ত্বমথবা করকাভিঘাতৈঃ।
ত্বদ্‌বারিবিন্দু-পরিপালিতজীবিতস্য
নান্যাগতির্ভবতি বারিদ! চাতকস্য॥

 এই সারঙ্গ অথবা চাতক পাখীটির বৈজ্ঞানিক পরিচয় কি? এই যে “মেঘদরশনে হায় চাতকিনী ধায় রে,” ইহা কি বৈজ্ঞানিক হিসাবে সত্য? জ্যর্ডনপ্রমুখ বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্‌গণ চাতককে Cuckoo বা কোকিল-পরিবারভুক্ত বলিয়া মনে করেন। তাঁহাদের মতে ইহার বৈজ্ঞানিক নাম Coccystes melanoleucus[১৪]। বর্ষাগমে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এই পাখী অধিক সংখ্যায় দৃষ্ট হয়; ইহার কাকলী পথিকের শ্রুতিপথবর্ত্তী হইয়া থাকে। কিন্তু পাখীটির কবিবর্ণিত প্রকৃতি—উহার অম্ভোবিন্দুগ্রহণের নিমিত্ত অস্থিরতা—আজ পর্য্যন্ত কোনও পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। তাঁহারা এই পর্য্যন্ত বলিয়াছেন যে, প্রত্যূষে এই পাখী আকাশমার্গে উড্ডীয়মান হইয়া গান করিতে থাকে; কিন্তু সেই গান শুনিয়া কোন কবি ‘নদতি মধুরং’ বলিয়া বর্ণনা করিতে পারেন কি না, সন্দেহ। কারণ, ইঁহারা বলিতেছেন—বর্ষাঋতুতে এই পাখী অতিশয় কলরব করিয়া থাকে এবং ইহার কণ্ঠস্বর খুব চড়া,—“a high-pitched wild metallic note”। তাঁহারা আরও বলেন যে, এই বর্ষা ঋতুই ইহাদের গর্ভাধান-কাল। বর্ষার সহিত Coccystes melanoleucus পাখীর এইটুকু সাধারণ সম্বন্ধ ব্যতীত ইঁহাদিগের পুস্তকাবলীতে আর কোনও কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আমাদের কবিগণ যদি ময়ূরের মত চাতকের রূপ বর্ণনা করিতেন, তাহা হইলে সে বাস্তবিক কোন্ জাতীয় পক্ষী তাহার নির্দ্ধারণ করিতে কিছুমাত্র বেগ পাইতে হইত না। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা কোথাও এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাই না। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, যে পাখীটিকে বিদেশীয়েরা চাতক বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন, তাহা Cuckoo পরিবারভুক্ত। এই পরিবারস্থ কয়েকটি পাখী আমাদের দেশে পাপিয়া, বৌ-কথা-কও, কোলা বা শা-বুলবুল ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইহাদের কেহই অম্ভোবিন্দুগ্রহণচতুর নহে। অবশ্যই একই পরিবারভুক্ত বিভিন্ন পাখীর স্বভাব বিভিন্ন হইতে পারে বটে, কিন্তু কেহই কি কোনটিরই সম্বন্ধে এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করিলেন না? তাই বোধ হয়, বেগতিক বুঝিয়া অধ্যাপক কোল্‌ব্রুক্ এই সনাক্ত করাতে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন[১৫]। মিঃ ওট্‌স্ তাঁহার গ্রন্থে[১৬] Iora পরিবারভুক্ত পক্ষিগণের নাম করিতে বসিয়া Aegithina tiphia পাখীর সম্বন্ধে বলিতেছেন যে, ইহা বঙ্গদেশে চাতক, তফিক্, ফটিক-জল ইত্যাদি নামে পরিচিত। এস্থলে এটুকু বলা আবশ্যক মনে করি যে, বঙ্গের বাহিরেও এই পাখীকে তফিক্ বলে। সাধারণতঃ বর্ষাকালে ইহাদের সন্তানসন্ততি হয়। এই সময়ে পুংপক্ষীটি মধুর ধ্বনি করিতে থাকে। ইহার কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে জ্যর্ডন তাঁহার গ্রন্থে বার্জেসের কথা উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন যে, ইহার কণ্ঠস্বর অপূর্ব্ব; কখন বা অতিশয় মন্দ ও করুণ, পরক্ষণেই আবার সপ্তমে চড়া[১৭]। বৃষ্টির পূর্ব্বে ইহারা যে শব্দ করে, তাহা যেন ঠিক ‘শোভিগ’ অথবা কোথাও ‘তফিক’এর মত শুনা যায়। বোধ হয় এইরূপ ধ্বনি করে বলিয়া উহা তফিক্ নামে পরিচিত। হইতে পারে যে, আসন্ন বর্ষায় কোমল করুণ তীব্র কণ্ঠস্বরে চাতকের এই স্বাগতধ্বনি শুনিয়া আকাশ-মার্গে উড্ডীয়মান উন্নমিতচঞ্চু চাতককে অম্ভোবিন্দুগ্রহণচতুর বলিয়া কল্পনা করা হইয়াছে।

 অতএব কবি-বর্ণিত চাতক সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ আমাদিগকে আমরা যেটি চাই, ঠিক সেইটি দিতে পারিলেন না, অথচ তাঁহারা সকলেই বলিতেছেন যে, এই পাখী ভারতবর্ষের কাব্যসাহিত্যে অনেকখানি স্থান অধিকার করিয়া আছে। এইখানে পাঠক-পাঠিকাদিগের নিকটে ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষিগৃহমধ্যে এই Iora জাতীয় বিহঙ্গের আচরণ সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ পর্য্যবেক্ষণের ফল জ্ঞাপন করিতে চাই। প্রাতঃকালে aviary মধ্যস্থিত গাছের ডালপালাগুলি পিচকারির সাহায্যে ধৌত করা হইত। পাখীটা তখন বৃক্ষান্তরে উড়িয়া যাইত। আবার যখন সেই গাছটার উপর জল বর্ষণ করা হইত, তখন প্রথমোক্ত গাছে ফিরিয়া আসিয়া বৃক্ষপত্র হইতে পতনোন্মুখ জলবিন্দুগুলি সুকৌশলে চঞ্চপুটে গ্রহণ করতঃ সে শাখা প্রশাখায় বিচরণ করিত। কৃত্রিম পক্ষিগৃহে এমনভাবে জলবিন্দু গ্রহণের চেষ্টা আর কোন পালিত পক্ষীর দেখি নাই। কোনও কোনও পাখী কৃত্রিম গৃহমধ্যে গলদচ্ছবিন্দু পত্রান্তরালে স্নান করিতে ভালবাসে বটে, কিন্তু এইরূপ shower bath বা ধারাস্নানের সময়ে তাহারা চঞ্চপুটে জলবিন্দু গ্রহণ করে না। এই Iora জাতীয় পাখীকে বঙ্গদেশে আমরা চাতক অথবা ফটিকজল বলিয়া জানি।

  1. Fauna of British India, Birds, Vol. IV, p. 68.
  2. Book of Birds from the text of Dr. Brehm by Thomas Rymer Jones, Vol. III, p. 254.
  3. Fauna of British India, Birds, Vol. IV, p. 70.
  4. “The males moult their long trains after the breeding season with the other feathers about September in Northern India, and the new train is not fully grown up till March or April.”—Blanford.
  5. Vol. III., p 507.
  6. “Peafowl roost on trees and they are in the habit, like most Pheasants, of returning to the same perch nigbt after night”—Blanford.
  7. পৃষ্ঠা—৪০৯।
  8. “I exclude from this (Sturnidae) family the Grackles (Eulabes) and the Glossy starlings (Calornis) which have hitherto been associated with the true starlings by nearly all writers. These two genera differ in so many important matters .... that I cannot look upon them as in any way closely allied to the Sturnidae.”—Oates, Fauna of British India, Vol. I, p. 517.
  9. “Like the European starling, it (the House-Mynah of India—Acridotheres tristis) will learn to talk, but the true talking mynahs (Eulabes) are very different birds.”—Frank Finn, The World’s Birds, p. 114.
  10. মিঃ উইলসন্ মেঘদূতের টীকায় সালিক পাখীকে Gracula religiosa বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। এই Gracula শব্দটি এখনকার Grackle শব্দের রূপান্তর মাত্র। মনিয়ার উইলিয়ামস্ কিন্তু সারিকার্থে ময়না ও সালিক (Gracula religiosa ও Turdus Salica) এই দুইটার মধ্যে যেটা হউক একটাকে নির্দ্দেশ করিয়াছেন। পার্ব্বত্য ময়না বুঝাইতে ওট্‌স্ প্রমুখ বৈজ্ঞানিকগণ Gracula religiosaর পরিবর্ত্তে Eulabes religiosa শব্দের ব্যবহার প্রশস্ত মনে করেন এবং সালিক পক্ষী বুঝাইতে তাঁহারা Turdus Salicaর পরিবর্ত্তে Acridotheres tristis শব্দদ্বয়ের প্রয়োগ করেন। Acridotheres শ্রেণীর পক্ষিগণ Sturnidae পরিবারভুক্ত। এখনকার বৈজ্ঞানিকগণ Thrush জাতীয় পক্ষী বুঝাইতে Turdus শব্দের প্রয়োগ করিয়া থাকেন।
  11. Garden and Aviary Birds of India, page 47.
  12. Fauna of British India, Birds, Vol. IV, p. 1.
  13. Ibid, p. 30.
  14. This bird makes a great figure in Hindu poetry under the name of chatak,—Rev. T. Philipps—Notes on the Habits of some Birds observed in the plains N. W. India, published in the Proceedings, Zoological Society of London, 1857, pp. 100-101; cf. also Jerdon’s Birds of India, Vol. I, p. 341.
  15. অমরকোষে চাতকের টীকাপ্রসঙ্গে অধ্যাপক কোলব্রুক বলিতেছেন—“Pipiha. Cubulus Radiatus. But it is not certain whether the chataca be not a different bird.”
  16. Fauna of British India, Birds, Vol. I, p. 230.
  17. “Burgess, speaking of its notes says “truly, it has a wonderful power of voice; at one moment uttering a low plaintive cry (নদতি মধুরং এর সহিত মিলে না কি?), at the next, a shrill whistle.”—Birds of India, Vol. II, p 103.