পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/নাটকে পাখীর পরিচয়
নাটকে পাখীর পরিচয়
কালিদাসের তিনখানি নাটকে আমরা মোটামুটি যে সকল পাখীর উল্লেখ দেখিতে পাই, নাম হিসাবে সেগুলিকে তালিকাভুক্ত করা যাইতে পারে। আলোচনার সুবিধার জন্য তালিকাটি বৈজ্ঞানিক হিসাবে না দিয়া আপাততঃ নাম হিসাবে নিম্নে প্রদান করিতেছি।
১। রাজহংস (মানসোৎসুকচিত্ত), রাজহংসী (মৃণালসূত্রাবলম্বিনী) ২। হংস (পত্রচ্ছায়াসু মুকুলিতনয়ন ইত্যাদি), হংসমিথুন (সৈকতলীন ইত্যাদি), হংসযুবা (সহচরী-সঙ্গত) ৩। চক্রবাক (প্রিয়াসহায়, গোরোচনাকুঙ্কুমবর্ণ), রথাঙ্গনামা (অহং প্রিয়াসহচরীব মে ইত্যাদি), চক্রবাকবধূ, চক্রবাকী (প্রিয়বিরহে বিষাদদীর্ঘতরা রজনী আশায় অতিবাহিত করিতেছে ইত্যাদি) ৪। সারস ৫। কারণ্ডব (তপ্তং বারি বিহায় তীরনলিনীং সেবতে) ৬। ময়ূর ৭। শুক ৮। পারাবত, কপোত (বন্ধনভ্রষ্ট গৃহপালিত ইত্যাদি) ৯। চাতক ১০। গৃধ্র ১১। শ্যেন ১২। কুররী ১৩। পরভৃত, পুংস্কোকিল, কোকিলা।
রাজহংস
যে রাজহংস রাজহংসী লইয়া আমরা তালিকাটি আরম্ভ করিয়াছি তাহাদের কথা লইয়া আলোচনার সূত্রপাত করা যাক্। মানসোৎসুকচিত্ত রাজহংস ও মৃণালসূত্রাবলম্বিনী রাজহংসী—ইহার তাৎপর্য্য কি? এই রাজহংস-জাতীয় পাখী পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের নিকটে flamingo (Phœnicopterus) নামে পরিচিত, এ কথা আমি পূর্ব্বে মেঘদূত-প্রসঙ্গে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি। সাধারণ পাঠকবর্গেরও এই পাখীটিকে চিনিবার সহজ উপায় এই যে, অমরকোষোক্ত “রাজহংসাস্তুতে চঞ্চুচরণৈর্লোহিতৈঃ সিতা” এই শারীরিক লক্ষণ পাখীটিকে grey goose বা কাদম্বজাতীয় হংস হইতে পৃথক্ করিতেছে। ইহার যাযাবর। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে—গুজরাত, পঞ্জাব, সিন্ধু, রাজপুতানা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের জলাভূমি-সন্নিধানে ইহাদিগকে বর্ষার প্রাক্কাল পর্য্যন্ত অবস্থান করিতে দেখা যায়। বর্ষাগমে ইহারা মানসসরোবরাভিমুখে প্রয়াণ করে। যাইবার সময় ইহাৱা যে পাথেয়স্বরূপ চঞ্চুপুটে কোমল মৃণালসূত্র অথবা বিসকিসলয় লইয়া আকাশমার্গে উড্ডীন হইবে, তাহা আদৌ আশ্চর্য্যের বিষয় অথবা অবাস্তব কবিকল্পনা মাত্র নহে; কারণ এই জলচর বিহঙ্গ উদ্ভিজ্জাশী। প্রধানতঃ জলজ উদ্ভিদই ইহাদের আহার্য্য। এখন সহজে প্রতীয়মান হইবে যে, রাজা পুরুরবার হৃদয়-পদ্ম ছিন্ন করিয়া অপ্সরা উর্ব্বশীকে আকাশমার্গে উড্ডীয়মানা দেখিয়া যদি কবির মনে লোহিতচঞ্চুচরণা সিতাবয়বা চঞ্চুপুটে ছিন্নবিসকিসলয়ধৃতা মানসোৎসুকচিত্তা রাজহংসীর ছবি জাগিয়া থাকে, তাহা কাব্য-সৌন্দর্য্যকে বাড়াইতে গিয়া তিলমাত্র সত্যের অপলাপ করে নাই।
এই flamingo জাতীয় পাখীর যাযাবরত্বের কারণ আমি মেঘদূতের পক্ষীতত্ত্ব প্রসঙ্গে এইরূপ নির্দ্দেশ করিবার চেষ্টা করিয়াছি—“আহার্য্যের অভাব বৎসরের যে ঋতুতে হইবার সম্ভাবনা থাকে সেই ঋতুর প্রাক্কালেই যাযাবর বিহঙ্গগণ যে স্থলে আপনাদিগের অভ্যস্ত উপাদেয় খাদ্যের স্বচ্ছলতা বর্ত্তমান আছে, তথায় প্রয়াণ করিয়া থাকে। পক্ষিজাতির যাযাবরত্বের অন্যান্য গৌণ কারণ থাকিতে পারে, কিন্তু এই আহার্য্যের অভাবের আশঙ্কাই যে মুখ্য কারণ এ সম্বন্ধে বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্গণের মধ্যে মতদ্বৈধ নাই।” এ সম্বন্ধে এ স্থলে ইহার অধিক কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। আর বর্ষাসমাগমে যে মানসসরোবর হংসকাকলীতে মুখরিত হইয়া উঠে, তাহা মূরক্রফ্ট্, স্বেন্ হেডিন্ প্রভৃতি পাশ্চাত্য পর্য্যটকগণ স্বচক্ষে লক্ষ্য করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই মানসসরোবর কৈলাসের পাদদেশে অগ্নিকোণে অবস্থিত।
হারীত |
চকোর |
রাজহংস [পৃঃ ২২০ | |
U. RAY & SONS, CALCUTTA. |
বিক্রমোর্ব্বশীর মানসোৎসুকচিত্ত রাজহংস এবং মৃণালসূত্রাবলম্বিনী রাজহংসী দেখিয়া আমাদের মনে স্বতঃই মেঘদূতের “মানসোৎক আকৈলাসাৎ বিসকিসলয়চ্ছেদপাথেয়বান্” রাজহংসের চিত্র জাগিয়া উঠে।
আর বিক্রমোর্ব্বশীর রাজহংসচিত্রটি কি সেই সঙ্গে ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠে না? উন্মত্ত রাজার প্রলাপবাক্য স্মরণ করুন; রাজহংস তাহার সমস্ত রূপ ও সঙ্গীতোচ্ছ্বাসে সরোবরতট ও কাননতল উচ্ছ্বসিত করিয়া এখনই ’ত উড়িয়া যাইবে:—“নূপুরশিঞ্জিতের মত ও কি শুনা যায়? হা ধিক! এ ত মঞ্জীরধ্বনি নয়। দিঙ্মণ্ডল মেঘশ্যাম দেখিয়া মানসোৎসুকচিত্ত রাজহংস কূজন করিতেছে; এই সমস্ত মানসোৎসুক রাজহংস এই সরোবর হইতে উড়িয়া যাইবার পূর্ব্বে ইহাদিগকে আমার প্রিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করি।—হে জলবিহঙ্গরাজ! তুমি মানসসরোবরে কিছু পরে যাইও; একবার তোমার বিসকিসলয় পাথেয়টুকু রাখ; আবার তুমি তুলিয়া লইও। আমার দয়িতার সংবাদটুকু দিয়া আমাকে শোকমুক্ত কর। রে হংস! তুই যদি সরোবর-তটে আমার নতভ্রূ প্রিয়াকে না দেখিয়া থাকিস্, তাহা হইলে কেমন করিয়া তুই তাহার কলগুঞ্জিত গতিভঙ্গিটুকু চোরের মত অপহরণ করিলি? তুই আমার প্রিয়াকে ফিরাইয়া দে। জঘনভারমন্থরা প্রিয়ার গতি দেখিয়া তুই নিশ্চয়ই তাহা চুরি করিয়াছিস। * * * এ কি! চৌর্য্যাপরাধে দণ্ডিত হইবার ভয়ে রাজার নিকট হইতে এ যে পলায়ন করিল!”
ইহার মধ্যে আমাদের পরিচিত flamingo পাখীটির সম্বন্ধে একত্র মোটামুটি অনেক কথা পাওয়া গেল; তাহার কণ্ঠস্বর মঞ্জীরধ্বনির ন্যায়; তাহার কলগুঞ্জিত গতিভঙ্গিটুকু জঘনভারমন্থরা নারীর গতিকে স্মরণ করাইয়া দেয়; সে জলবিহঙ্গরাজ; মানসসরোবরে যাইবার জন্য তাহার চিত্ত উৎসুক হয়, যখন দিঙ্মণ্ডল মেঘশ্যাম দেখা যায়; প্রয়াণকালে সে পাথেয়স্বরূপ বিসকিসলয় চঞ্চুপুটে গ্রহণ করে।
Flamingo সিতাবয়ব কি না, এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হইলে কবিবর্ণিত রাজহংসের সহিত ইহার জাতিগত ঐক্য সংস্থাপনের কোনও অন্তরায় থাকে না। কারণ flamingo যে লোহিতচঞ্চুচরণ, সে বিষয়ে মতদ্বৈধ নাই। যাঁহারা সতর্কভাবে এই পাখীটিকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে ইহার দেহের বর্ণ প্রধানতঃ শাদা, তবে বর্ণে ঈষৎ গোলাপী আভা বিদ্যমান আছে। শাবকদিগের দেহের বর্ণে কিন্তু এই গোলাপী আভা নাই বলিলেই চলে। সাধারণ পর্য্যবেক্ষণের ফলে এই পর্য্যন্ত সকলেই বলিতে পাবেন। এখন প্রশ্ন এই যে, তাহা হইলে ইহাকে সিতাবয়ব বলা চলে কি না?
“সিত” শব্দের আভিধানিক অর্থ বিচার করিয়া দেখিলে সহজেই প্রতীতি জন্মে যে, ইহা শুক্ল কিংবা শ্বেতের পর্য্যায়ভুক্ত হইয়াও, শুক্ল ও শ্বেত বলিলে যাহা বুঝায়, ইহাতে তাহার কিছু ব্যতিক্রম আছে। শুক্ল ও শ্বেত একেবারে শাদা;—অভিধানকার বলিতেছেন ‘রক্তেতর’। শব্দার্ণব-রচয়িতা স্পষ্ট করিয়া বলিতেছেন যে, সিত রংটি—কদলীকুসুমোপম, কলার ফুলের মত। এই কলার ফুল যে একেবারে সম্পূর্ণ শাদা নয়, একথা বাঙ্গালী পাঠকবর্গকে অবশ্যই বুঝাইতে হইবে না; শাদার সঙ্গে অন্য রঙের সংমিশ্রন আছে। ‘সিত’ শব্দের আভিধানিক তাৎপর্য্যেও এই বিভিন্ন বর্ণ-সংমিশ্রণের আভাস পাওয়া যায়; কোথাও শ্বেতের সহিত পীত, কোথাও বা শ্বেতের সহিত কৃষ্ণের সম্পর্ক থাকিলেও, ‘সিত’ শব্দ বা তৎপর্য্যায়ক কতকগুলি শব্দের প্রয়োগ হইয়া থাকে। যখন শ্বেতের সহিত কৃষ্ণ মিলিল, তখন সেই সিতকে অর্জ্জুন আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। যখন শাদার সহিত লাল মিশিল, তখন তাহা সিতপর্য্যায়ভুক্ত শ্যেত দাঁড়াইল;—এই শ্যেত শব্দটি আমরা “খাঁচার পাখী” প্রসঙ্গে বৈদিক সারিঃশ্যেতায় পাইয়াছি। ম্যাক্ডোনেলের অভিধানে[১] ইহাকে reddish white বলা হইয়াছে। আবার দেখুন, ‘গৌর’ শব্দটি সিতপর্য্যায়ভুক্ত বটে, কিন্তু ইহা নিরবচ্ছিন্ন শুক্ল নহে,—‘পীতো গৌরো হরিদ্রাভঃ’[২];—শাদা এখানে হরিদ্রাভ হইয়া গিয়াছে। শব্দার্ণব বলিতেছেন—সিতঃ শ্যাবঃ কদলীকুসুমোপমঃ;—অমরকোষ বলিতেছেন, ‘শ্যাবঃ (স্যাৎ) কপিশঃ’, ম্যাক্ডোনেল ব্যাখ্যা করিলেন—dark brown। যে কৃষ্ণলেশবান্ সিতকে অর্জ্জুন বলা হইয়াছে, অভিধানকার[৩] তাহাকে কুমুদচ্ছবি বলিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। অমরকোষ এই কুমুদফুলের রং বুঝাইয়া দিবার জন্য বলিয়াছেন—‘সিতে কুমুদকৈরবে’। অতএব বিচার করিয়া দেখিলে বুঝা যাইবে যে, যদিও সিত প্রভৃতি তেরটি শব্দ[৪] শুক্লপর্য্যায়ভুক্ত, ইহাদিগের অধিকাংশই নিরবচ্ছিন্ন শুক্লবর্ণপরিচায়ক নহে;—শাদার সহিত কৃষ্ণপীতরক্তাভার অল্পবিস্তর বিমিশ্রণ আছে। মিঃ কোলব্রুক্-সম্পাদিত অমরকোষে দেখিতে পাই যে, ‘পাণ্ডুর’ শব্দ শুক্লপর্য্যায়ভুক্ত রহিয়াছে,—টীকাকার ব্যাখ্যা করিলেন, ‘white’; কিন্তু পরশ্লোকেই দেখা যায়—হরিণঃ পাণ্ডুরঃ পাণ্ডুঃ—ব্যাখ্যা, ‘yellowish white’।
অতএব সিতাবয়ব নিরবচ্ছিন্ন শুক্লতার পরিচায়ক হইবে, এমন কোনও কথা নাই। Flamingo পাখীকে অসঙ্কোচে সিতাবয়ব বলা যায়। তাহার শাদা রঙের সঙ্গে গোলাপী রক্তিম আভা অল্পবিস্তর বিদ্যমান থাকিতে পারে; তাহাতে কিন্তু সে সিতপর্য্যায়ভুক্তই রহিয়া গেল। জার্ডন[৫] ইহার এই প্রকার বর্ণনা করিয়াছেন,—Throughout of a rosy white, অর্থাৎ আগাগোড়া গোলাপী শুভ্রতামণ্ডিত। ব্লানফোর্ড বলিতেছেন[৬]—Head, neck, body and tail white, more or less suffused with rosy pink, অর্থাৎ মাথা, ঘাড়, দেহ এবং পুচ্ছ শাদা, অল্পবিস্তর গোলাপিবর্ণচ্ছটাসমন্বিত। আবার ইহার শাবকের গায়ের রঙে ঐ গোলাপিভাব নাই; আছে কেবল শাদার ধূসরতা;—body whitish, tinged with greyish brown (ব্লানফোর্ড)। এ ক্ষেত্রেও সিতাবয়ব আখ্যা সম্যক্রূপে প্রযোজ্য। পুনশ্চ দেখিতে পাওয়া যায় যে, স্ত্রীপক্ষীটির বর্ণ পুংপক্ষীর অপেক্ষা হীনাভ,—The colouring of the females is generally subdued; ইহাকেও পুংপক্ষীর সহিত সিতাবয়বপংক্তিতে বসাইতে হইবে।
এই রাজহংসী প্রতি বৎসর আসন্ন বর্ষায় মৃণালসূত্রাবলম্বিনী হইয়া মানসোৎসুকচিত্ত রাজহংসের সহিত আকাশমর্গে উড্ডীয়মান হয়, ইহা মাত্র কবিবর্ণনা নহে। ইহার যাযাবরত্বের আলোচনা এস্থলে নিষ্প্রয়োজন।
এই রাজহংস-মিথুন সম্বন্ধে পাঠককে একটু সতর্ক হইতে হইবে। ইহাদিগকে সাধারণ হংসপর্য্যায়ভুক্ত করা চলে কি না, সে সম্বন্ধে অনেক তর্ক উঠিতে পারে। এতদিন তাহাদিগকে মোটামুটি হংস- (Duck) শ্রেণীমধ্যে পরিগণিত করা হইতেছিল; কিন্তু সম্প্রতি হক্সলিপ্রমুখ পণ্ডিতগণ বিশিষ্টলক্ষণাক্রান্ত রাজহংসকে স্বতন্ত্র করিয়াছেন। কিন্তু ইহাদের কণ্ঠস্বর হংসজাতীয় পাখীর মত। যে গতিভঙ্গি লক্ষ্য করিয়া কবিবরের মনে জঘনভারমন্থরা নারীর পদক্ষেপ বলিয়া ভ্রম হইয়াছে, সে সম্বন্ধে পাশ্চাত্য অকবি বৈজ্ঞানিক সুধু walk বা পদচারণ[৭] বলিয়া ক্ষান্ত হন নাই; কতকটা বিশদ বর্ণনা করিয়া এইরূপ বলা হইয়াছে[৮]—Its steps are longer, more regular, and more vacillating, as might be expected from the extraordinary length of its legs, but at the same time its movements are easy। এস্থলে সাধারণ হংসজাতীয় পাখীর চলনভঙ্গির সহিত Flamingo বা রাজহংসজাতির গতিবিধির তুলনা করা হইয়াছে। এই anatidæ পরিবারভুক্ত কোনও কোনও হংসকে আমরা অন্যত্র anserinæ পর্য্যায়ভুক্ত করিয়া কিছু আলোচনা করিয়াছি। এই জলবিহঙ্গ বোধ করি পাঠকের নিকটে এত পরিচিত যে, মালবিকাগ্নিমিত্র-বর্ণিত দীর্ঘিকায় প্রখর দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে পদ্মপত্রচ্ছায়ায় তাহাকে মুকুলিতনয়ন দেখিয়া অথবা অভিজ্ঞান-শকুন্তলায় স্রোতোবহা মালিনীর সৈকতে হংসমিথুনের চিত্রে তিনি কিছুমাত্র বিস্মিত হইবেন না।
চক্রবাক
এই anatidæ পরিবারভুক্ত আর একটি পাখীকে আমরা কালিদাসের নাটকে দেখিতে পাই,—সেটি চক্রবাক। সেই গোরোচনাকুঙ্কুমবর্ণ প্রিয়াসহায় বিহঙ্গের সহিত বৈজ্ঞানিক পরিচয়-স্থাপনের একটু চেষ্টা করা যাক্। অধ্যায়ান্তরে আমরা এ সম্বন্ধে কতকটা আলোচনা করিয়াছি; আমরা স্থিরনিশ্চয় করিয়া বলিতে পারিয়াছি যে, আমাদের চকাচকী ইংরেজের নিকটে Ruddy Sheldrake বা Brahminy Duck নামে পরিচিত; তাহাদের দাম্পত্য-লীলা পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকের চক্ষু এড়ায় নাই;—সে সকলের পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু পাঠক বোধ হয় লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে, কালিদাসের সমস্ত নাটকগুলিতে চকাচকী ছড়াইয়া রহিয়াছে। শুধু তাহাই নহে; এক স্থলে তাহার রূপবর্ণনা পাওয়া যাইতেছে; ইহা আমাদের বৈজ্ঞানিক আলোচনার পক্ষে যথেষ্ট সাহায্য করিবে। চক্রবাক যে “প্রিয়াসহায়,” তাহা সকলকেই মানিয়া লইতে হইবে; কিন্তু সে যে গোরোচনাকুঙ্কুমবর্ণ, তাহা কি সকলে লক্ষ্য করিয়াছেন? ব্লানফোর্ডের পুস্তকে[৯] চক্রবাক বা Casarca rutila পাখীর বর্ণবৈচিত্র্য সম্বন্ধে এইরূপ লেখা আছে—Head and neck buff (গোরোচনাবর্ণ), generally rather darker on the crown, cheeks, chin and throat, and passing on the neck into the orange brown or ruddy ochreous (কুঙ্কুমবর্ণ) of the body above and below। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, চক্রবাক প্রিয়াসহচর ইহা সকলকেই মানিয়া লইতে হইবে;—কেবল যে আমাদের দেশে এইরূপ কবিপ্রসিদ্ধি আছে বলিয়া আমরা অবিচারে ইহা মানিয়া লইব, তাহা নহে। বিদেশীয় পক্ষিতত্ত্বজ্ঞেরা এ বিষয়ে অনেকটা অনুকূল সাক্ষ্য দিতেছেন। এই জাতীয় বিহঙ্গ মিথুনাবস্থায় তাঁহাদের নয়নগোচর হইয়াছে। তবে এ কথা তাঁহারা জোর করিয়া বলিতে পারেন নাই যে, রজনী চক্রবাক মিথুনের মধ্যে বিরহ ঘটাইয়া দেয়; কিন্তু ইহা স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে যে, দিবাভাগে চক্রবাক সহচরীসঙ্গত হইয়া বিচরণ করে। ধারিণী যে রজনীর মত নায়ক-নায়িকার মধ্যে বিরহের ব্যবচ্ছেদ আনিয়া তাহাদিগকে চক্রবাক-মিথুনের নৈশ অভিশাপগ্রস্ত করিয়াছে, মহাকবিবর্ণিত এই বিরহব্যাপার বাস্তবপক্ষে কতটা সত্য, তাহা বিচারসাপেক্ষ। নিশীথে শীতকালে নদীবক্ষে বিচরণ করিবার সময় চক্রবাক চক্রবাকীর করুণ কণ্ঠধ্বনি পাশ্চাত্য পক্ষিতত্ত্ববিদের কর্ণগোচর হইয়াছে,—This call seeming often to come and being answered from opposite banks[১০], অর্থাৎ মনে হয়, যেন এই আহ্বানধ্বনি নদীর এক তীর হইতে উত্থিত হয় এবং অপর তীর হইতে তাহার প্রত্যুত্তর আসে। নদীর দুই তীর হইতে এই ডাকাডাকি, উত্তর প্রত্যুত্তর, ইহা যেন বিরহক্লিষ্ট নিশীথের অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন বিহগবিহগীর করুণ আলাপ অথবা বিলাপ বলিয়া মনে হয়। কেহ কেহ চকাচকীকে নদীর উভয় পারে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া রাত্রিযাপন করিতে দেখিয়াছেন;—তবে তাঁহারা বলেন যে, নদী যদি অপ্রশস্ত হয়, তাহা হইলেই এই বিহগমিথুনের বিরহাভিনয় প্রায়ই দেখা যায়[১১]। অমরকোষে এই পাখীর যে কয়টি আভিধানিক আখ্যা পাওয়া যায়—“কোকশ্চক্রশ্চক্রবাকো রথাঙ্গাহ্বয়নামকঃ”—তাহাদের সম্বন্ধে অন্যত্র প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিয়াছি; এস্থলে বেশী কিছু বলার প্রয়োজন দেখি না। শুধু এই রথাঙ্গনামা বা চক্রবাকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিবার জন্য অমরকোষ হইতে উক্ত সংজ্ঞা উদ্ধৃত করিলাম। ইহার যাযাবরত্ব সম্বন্ধেও মেঘদূতপ্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিয়াছি; বাহুল্য ভয়ে এবং অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আপাততঃ সে আলোচনা হইতে বিরক্ত হইলাম।
সারস
হংসজাতীয় পাখীগুলিকে ছাড়িয়া এখন Grus পরিবারভুক্ত সারসের পরিচয় লওয়া যাক্। নাটকের মধ্যে আমরা দেখিতেছি যে, রাজা অনুমান করিতেছেন, সারসের উচ্চ কণ্ঠস্বর যখন শোনা যাইতেছে, তখন নিশ্চয়ই জলাশয় সন্নিকটে আছে;—রাজার এই অনুমান কতটা সত্য, অর্থাৎ সারসের সঙ্গে জলাশয়ের সম্পর্ক এতটা নিবিড় কিনা, তাহা দেখিতে হইবে। এ স্থলেও বিদেশীয় পর্য্যবেক্ষণকারীর সাক্ষ্য লওয়া যাক্।
মিঃ ব্লানফোর্ড লিখিতেছেন—“The sarus is usually seen in pairs, each pair often accompanied by a young bird or occasionally by two, in open marshy ground or on the borders of swamps or large tanks * * They have a loud trumpet-like call. * * Pairs for life, and if one of a pair is killed, the survivor is said not unfrequently to pine and die.”
ইহারা যে জলাশয়ে বিচরণ করিতে ভালবাসে, সে বিষয়ে বোধ হয় কাহারও সন্দেহ থাকিতে পারে না। জলাশয়ের সহিত ইহাদের এতই অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ যে, পাখীটির অন্য আভিধানিক আখ্যা—“পুষ্করাহ্বঃ” সার্থক বলিয়া মনে হয়। যে loud trumpet-like call পথিককে সচকিত করে, তাহা শুনিলে অভিধানকারের আর একটি আখ্যা “গোনর্দ্দঃ” শব্দের মর্ম্ম বুঝিতে বিলম্ব হয় না।
এখন সারসের আভিধানিক আখ্যাগুলি একত্র করিয়া ব্লানফোর্ডের বর্ণনার সহিত মিলাইয়া লওয়া যাইতে পারে।—সারসো মৈথুনী কামী (Seen in pairs) গোনর্দ্দঃ পুষ্করাহ্বয়ঃ। উপরে উদ্ধৃত সারসবর্ণনার সহিত আভিধানিক সংজ্ঞাগুলি আগাগোড়া মিলিয়া গেল। মেঘদূতে সারসের যে ইঙ্গিত আছে, তাহাতে দেখিতে পাই যে, সে শিপ্রাতটে বিচরণ করে, এবং তাহার মদকলকূজন শিপ্রাবাতকর্ত্তৃক বহুদূরে নীত হইতেছে।—ঋতুসংহারের কাদম্বসারসচয়াকুলতীরদেশ-চিত্রে সারস ও নদী অবিচ্ছিন্নভাবে রহিয়াছে।
কারণ্ডব
নাটকের মধ্যে যে কারণ্ডবকে আমরা দেখিতেছি, যে দ্বিপ্রহরে সরোবরের তপ্তবারি ত্যাগ করিয়া তীরনলিনীকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহাকে আমরা পূর্ব্বে ঋতুসংহারে যখন পাইয়াছিলাম, তখন তাহার সম্বন্ধে যতটুকু আলোচনা করিয়াছিলাম, তাহার অধিক কিছু বলিবার মত এমন কিছু নূতন উপকরণ নাটকগুলির মধ্য হইতে পাওয়া গেল না, যাহাতে আমরা পাকাপাকি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি। চক্রবাক সম্বন্ধে নাটকের বর্ণনা যেমন পাখীটিকে আমাদের সম্মুখে পরিষ্কার ভাবে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে, এক্ষেত্রে তাহার কিছুই হইল না। প্রথম আলোচনায় যে কয়টি মুখ্য প্রশ্ন উত্থাপিত করিয়াছিলাম, তাহা এই:—(ক) কারণ্ডব হংসজাতীয় কি না? (খ) ডল্লনাচার্য্যের বর্ণনানুসারে সে কাকতুণ্ড, দীর্ঘাঙ্ঘ্রি, কৃষ্ণবর্ণভাক্ হওয়া উচিত; এই বর্ণনা হংসজাতীয় কোনও পাখীর প্রতি প্রযোজ্য কি না? (গ) যদি সম্পূর্ণভাবে প্রযোজ্য না হয়, তবে অস্মদ্দেশীয় আর কোনও পাখীর সহিত এই বর্ণনা মিলে কি না? (ঘ) কারণ্ডব কি সারসের নামান্তর? (ঙ) অথবা ডল্লনাচার্য্যের করহরের নামান্তর? (চ) না বৈদ্যকশব্দসিন্ধুর জলপিপির সহিত ইহা অভিন্ন?
যে যে কারণে আমরা উল্লিখিত কোনও পাখীর সহিত ইহাকে সম্পূর্ণরূপে মিলাইতে পারি নাই, তাহা আমরা ঋতুসংহারের আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলাম। এ সম্বন্ধে আমার ব্যক্তব্য প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হইলে পরে, উক্ত পত্রিকায়[১২] কারণ্ডবকে “কোড়া” পাখীর সহিত অভিন্ন বলিয়া নির্দ্দেশ করিবার যখন চেষ্টা হইয়াছিল, তখন আমি সেই মত খণ্ডন করিবার জন্য পক্ষিবিজ্ঞানের দিক্ হইতে যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা উদ্ধৃত করা নিষ্প্রয়োজন; কারণ তাহাতেও আমরা একপদ অগ্রসর হইতে পারিলাম না। আগাগোড়া আমরা নেতি নেতি করিয়া আসিতেছি; যখন ভাল করিয়া ইহার স্বরূপ পরিচয় দিতে পারা যাইবে, তখন একটা কূট বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান হইবে।
ময়ূর
কালিদাসের কাব্য-সাহিত্যে ময়ূরকে এত বেশী দেখিতে পাওয়া যায় যে, মেঘদূতেই বলুন আর মালবিকাগ্নিমিত্রেই বলুন, কোথাও তাহাকে অন্বেষণ করিবার আয়াস স্বীকার করিতে হয় না। একটা বিষয় বোধ করি পাঠকগণ কালিদাসের নাটকে লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন—ময়ূরকে গৃহপালিত অবস্থায় মানবাবাসে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। আসন্ন বর্ষায় মেঘদূতে যে ভবন-শিখীকে দেখিয়াছি, তাহাকে স্বাধীন ভাবে পর্ব্বতে পর্ব্বতে বিচরণ করিতেও দেখা গিয়াছে। এখানে ময়ূরকে শুধু বর্ষায় দেখিতেছি না, প্রখর রৌদ্রে সে আলবালে আশ্রয় গ্রহণ করিতেছে; দিবাবসানে বাসযষ্টির উপর চিত্রার্পিতের মত সে বসিয়া থাকে; মাতৃরূপিণী শকুন্তলার আসন্ন বিরহে সে নৃত্য পরিত্যাগ করিয়াছে; রাজপ্রাসাদে মধ্যাহ্নকালে ঘূর্ণ্যমান জলযন্ত্র হইতে উৎক্ষিপ্ত বারিকণা দেখিয়া পিপাসা নিবৃত্তির জন্য সে সেই দিকে ধাবিত হইতেছে; সে আবার রাজপুত্রের অঙ্কে শিখণ্ডকণ্ডূয়নে সুখবোধ করিয়া আরামে নিদ্রা যাইতেছে—মানুষের সঙ্গে তার এত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দাঁড়াইয়া যায়! এস্থলে এই domesticationটাই বিশেষভাবে বৈজ্ঞানিকের আলোচ্য। এই pavo cristatus পাখটির সম্বন্ধে পক্ষিতত্ত্বহিসাবে অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয় লইয়া অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। এই নীলকণ্ঠ বিহঙ্গ আমাদের গৃহের সহিত এমন অবিচ্ছিন্নভাবে সম্বদ্ধ হইয়া পড়ে যে, গৃহনীলকণ্ঠ শব্দটি ময়ূরের নামান্তর হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অবশ্যই আমাদের গৃহে তাহাকে কখনও খাদ্যদ্রব্যে পরিণত করা হয় নাই। বাইবেলে দেখতে পাওয়া যায় ষে, হিব্রূরাজা সলোমনের সময়ে বিদেশ হইতে ময়ূরকে আমদানি করিয়া রাজ-উদ্যানে রক্ষা করা হইত, কিন্তু তাহাকে যে খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পরিগণিত করা হইত, এমন আভাস পাওয়া যায় না। খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীক্ সাহিত্যে ময়ূরের পরিচয় পাওয়া যায়। আরিষ্টোফেনিসের নাটক ইহার প্রমাণ। রোমে ধনী গৃহস্থ ও কোন কোন সম্রাট্ শিখীকে ভোজ্যদ্রব্য না করিলে আনন্দবোধ করিতেন না। প্লিনির পুস্তকে দেখা যায় যে, কেহ কেহ ময়ূরকে বাড়ীতে অতি যত্ন করিয়া পুষিত এবং কিছুদিন পরে তাহারা সেই সকল গৃহপালিত হৃষ্টপুষ্ট শিখী ভক্ষ্যহিসাবে বিক্রয় করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন করিত। অতএব ইহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ময়ূর বহুকাল হইতে মানবগৃহে পালিত হইয়া আসিতেছে। আবার ময়ূরের পুচ্ছ ডাকাতের আভরণ বলিয়া নাটকের মধ্যে উল্লেখ দেখিয়াছি। পাখীর পালক যে মানুষের আভরণ-রূপে অনেক দিন হইতে মানব-সমাজে কোনও কোনও শ্রেণীর মধ্যে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, সে সম্বন্ধে অবশ্যই সন্দেহ নাই। যাহারা ময়ূরের মাংস ভক্ষণ করিতে চায় না, তাহারা ময়ূরপুচ্ছের লোভ সম্বরণ করিতে পারে না। বর্ষাঋতুর সঙ্গে ময়ূরের আনন্দসম্পর্কের কথা অনেকবার আলোচনা করিয়াছি; বাহুল্যভয়ে এস্থলে প্রলোভন সত্ত্বেও তাহার অবতারণা করিলাম না; শুধু উল্লেখমাত্র করিয়া ছাড়িয়া দিলাম।
শুক
এইবার আর একটি পাখীর কথা আসিয়া পড়িতেছে,—সেটি শুক; মহাকবির পুষ্পবাণবিলাসে এই মধুরবচন গৃহপালিত পাখীটির এইরূপ বর্ণনা আছে—“মন্দিরকীর-সুন্দরগিরঃ”। এই কীর অবশ্যই শুকের নামান্তর,—“কীরশুকৌ” সমৌ ইত্যমরঃ। প্রচণ্ড নিদাঘে এই পিঞ্জরস্থ শুক পিপাসার্ত্ত হইয়া বারিবিন্দু যাচ্ঞা করিতেছে। এই শুকপক্ষীর উদর শ্যামবর্ণ;—শ্যামল শাদ্বল দেখিয়া উদ্ভ্রান্তচিত্ত রাজার মনে শুকপক্ষীর উদরের মত শ্যামবর্ণ উর্ব্বশীর সিক্ত স্তনাংশুক বলিয়া ভ্রম হইল। সখী প্রিয়ম্বদা শকুন্তলাকে বলিতেছেন, শুকের উদরের মত সুকুমার নলিনীপত্রে তিনি নিজ নখদ্বারা চিঠি লিখিয়া ফেলুন। নাটকের মধ্যে আরও দেখিতে পাই যে, শুকপক্ষী তরুকোটরে নীড় রচনা করে; নীবার শস্যগুলি তাহার মুখ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া তরুমূলে পড়িয়া রহিয়াছে। এই শুকের (Psittacidæ শ্রেণীভুক্ত parrot) বর্ণ সম্বন্ধে স্বনামখ্যাত বিদেশীয় পক্ষিতত্ত্ববিৎ ফ্যাঙ্ক ফিন্[১৩] দুইটি কথায় সহজে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন;—the prevailing colour is grass or leaf-green অর্থাৎ প্রধানতঃ বর্ণ তৃণের মত কিংবা পত্রের মত সবুজ। এখন কবির বর্ণনার সঙ্গে মিলাইয়া লইতে বোধ করি পাঠকের কষ্ট হইবে না। এই grass-green আর শ্যামল শাদ্বলে কিছু প্রভেদ নাই। আবার সুকুমার নলিনীপত্র যে leaf-green পাখীটির উদরকে স্মরণ করাইয়া দিবে, ইহা আর বিচিত্র কি? ইহার নীড় সম্বন্ধে ফ্র্যাঙ্ক ফিন্ বলিতেছেন[১৪] যে ইহার বাসা নাই বলিলেই হয়, সাধারণতঃ তরুকোটরই নীড়রূপে ব্যবহৃত হয়—“usually none, a hole being dug out in a tree”। নীবার শস্যগুলি পাখীর মুখ হইতে পড়িয়া গিয়া গাছতলায় ছড়াইয়া রহিয়াছে দেখিয়া পাখীটার স্বভাব সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশ না করিয়া থাকা যায় না। সে কি ধান সমেত গাছ মুখে করিয়া আনিয়াছিল—তাহার নীড় রচনার জন্য? বাসা করা হইল বটে, কিন্তু ধানগুলি ছড়াইয়া পড়িল? কখনও কখনও সে nests of twigs (ফ্রাঙ্ক ফিন্) তৈয়ার করে বটে, কিন্তু সাধারণতঃ বৃক্ষকোটর তাহার নীড়াধার নয়; বৃক্ষ-কোটরই নীড়-রূপে ব্যবহৃত হয়। তবে ঐ নীবারধান্য তাহার মুখ হইতে পড়িয়া যায় কেন? এইখানে তাহার দুষ্ট প্রকৃতির প্রতি কটাক্ষ না করিয়া থাকা যায় না। যে শুককে পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখিয়া মানুষের বুলি শিখাইয়া অতি প্রাচীনকাল হইতে আমরা পালন করিয়া আসিতেছি, তাহার মত শত্রু কৃষিজীবী মানবের খুব কমই আছে। মানুষের—সমাজবদ্ধ কৃষিজীবী মানুষের—যে কয়টি পরম শত্রু বলিয়া পরিগণিত, এই শুক তাহাদের অন্যতম—
অতিবৃষ্টিরনাবৃষ্টিঃ মূষিকাঃ শলভাঃ শুকাঃ।
প্রত্যাসন্নাশ্চ রাজানঃ ষড়েতা ঈতয়ঃ স্মৃতাঃ॥
শস্য নষ্ট করিতে যে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মূষিক প্রভৃতির সমকক্ষ, তাহার নীড়সমীপে যে নীবারশস্য চঞ্চুপুট-ভ্রষ্ট হইয়া ভূমিতলে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়া থাকিবে, ইহা আদৌ বিস্ময়কর নহে। ফ্রাঙ্ক ফিন্ বলেন—They are often extremely destructive to grain and fruit crops; এবং অন্যত্র লিখিয়াছেন—Parrots are usually not only non-provident but, like monkeys, wantonly wasteful,......with......suicidal tendency to squander their supplies। এই ব্যাপারটি কবির সূক্ষ্ম দৃষ্টিকে এড়াইতে পারে নাই।
এই শুক ভারতবর্ষে অতি প্রাচীন কাল হইতে মানবের গৃহে পালিত হইয়া আসিতেছে; তাহার যতই দোষ থাকুক, সে মানুষের বুলি অনুকরণ করিতে পারে বলিয়াই এতাবৎ গৃহস্থের কাছে আদর পাইয়া থাকে। ইহাও লক্ষ্য করা হইয়াছে যে, তাহার এই অনুকরণপটুত্ব স্বাধীন বন্য অবস্থায় প্রকটিত হয় না। বনে জঙ্গলে সে ’ত অন্য পাখীর কিংবা পশুর কণ্ঠস্বর অথবা বিশ্বপ্রকৃতির অন্য কোনও বিচিত্র শব্দের অনুকরণ করিতে পারিত; কিন্তু যতদূর জানা গিয়াছে, সে তাহা করে না। ফ্রাঙ্ক ফিন্ বলেন—In captivity many, if not most species, display a great imitative capacity, and their fame as talkers is very ancient; but they do not seem to be mimics in a wild state, curiously enough.
প্রাচীন মিসরে কিম্বা যুডিয়ায় এই পাখী যে মানুষের গৃহে আশ্রয় পাইয়াছিল, এমন বোধ হয় না; কারণ, মিসরবাসীদিগের চিত্র-লিপিতে (hieroglyphics) অথবা বাইবেলে শুকের প্রতিকৃতি বা নামোল্লেখ নাই। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের মত এই যে, ভারতবর্ষ হইতে প্রত্যাবর্ত্তনকালে দিগ্বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের অনুচরবর্গ কর্ত্তৃক শুকপক্ষী গ্রীসদেশে প্রথম আনীত হয়। পরবর্ত্তীকালে রোমকেরা অতি যত্ন সহকারে রৌপ্যনির্ম্মিত অথবা কূর্ম্মপৃষ্ঠ-রচিত পিঞ্জরমধ্যে পাখীটিকে রক্ষা করিয়া তাহাকে মানুষের বুলি শিখাইবার জন্য ভাল লোক নিযুক্ত করিত। বাইবেলে অথবা hieroglyphicsএ ইহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু বেদে ইহার উল্লেখ আছে। অন্যত্র বৈদিক বচন উদ্ধৃত করিয়া আমরা তাহা সপ্রমাণ করিয়াছি।
কপোত
এখন এই পোষা পাখীটির কথা ছাড়িয়া দিয়া, আমরা কপোত, পারাবত সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি। ইহাদিগকে সাধারণতঃ বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় Columbæ বলা হয়। বন্য কপোতকে ইংরাজিতে dove বলে; কিন্তু গৃহপালিত কপোত পারাবত বা পায়রার (ইংরাজী pigeon) নামান্তর মাত্র। এই dove এবং pigeon গৃহ-বলভিতে বাস করিতে অভ্যস্ত। শুকের মত, পারাবতও অতি প্রাচীন কাল হইতে মানুষের ঘরে অল্প-বিস্তর সমাদর পাইয়া আসিতেছে। যখন মিসরবাসীরা টিয়া পাখীর সঙ্গে পরিচিত ছিল না, সেই অতি প্রাচীন যুগেও তাহারা পায়রা পুষিত। নাটক-বর্ণিত পারাবত মার্জ্জার সম্বন্ধ অনেকেরই নিকটে সুপরিচিত। একটু মজা আছে। পাখীর শত্রু মূষিক, আবার মূষিকের শত্রু বিড়াল; তাই বলিয়া যে বিড়াল পাখীর মিত্র হইবে, এমন কোনও কথা নাই। বরং বিপরীতই হইয়াছে। কাজেই মূষিকমার্জ্জাররূপ উভয় সঙ্কট হইতে পোষা পাখীকে রক্ষা করিবার জন্য পক্ষিপালককে চেষ্টা করিতে হয়, আবার কতকটা বিনা চেষ্টায়ও একটা বিপদ্ হইতে পাখীটা নিষ্কৃতি পাইয়া থাকে,—যখন মূষিককে গৃহপালিত মার্জ্জার বিনষ্ট করে। মূষিকের অপকারিতা সম্বন্ধে কৃষিজীবী (agriculturist) ও পক্ষিপালকের (aviculturist) মতদ্বৈধ নাই; উভয়েই ইহাকে একটা উৎকট ঈতি বলিয়া গণ্য করে। পাশ্চাত্য পক্ষিপালক মূষিকধ্বংসের জন্য বিড়াল পুষিবার পরামর্শ দেন।
Columbæ জাতীয় পাখীগুলির মধ্যে বিশিষ্ট লক্ষণাক্রান্ত কপোত ও পারাবত (dove এবং pigeon)—এই দুইটিকে লইয়া একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পরিবার বলিয়া বিবেচনা করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। বৈজ্ঞানিক এই যে ক্ষুদ্র পরিবার গড়িয়া তুলেন, তাহার মধ্যে অন্য কোনও পাখীর প্রবেশ নিষেধ,—যতই কেন তার জ্ঞাতিত্বের দাবী থাকুক না। এই হেতু ইহাদিগের Columbidæ জ্ঞাতিবর্গ হইতে পৃথক্ করিবার জন্য ইহাদিগকে Columbinæ আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। তবে কি dove ও pigeon সর্ব্বতোভাবে এক? অবশ্যই নহে। তবে যাঁহারা উভয়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে অমিল দেখিয়া উভয়কে বিভিন্ন কোটারমধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈজ্ঞানিক নাম দিয়া ফেলিতে চাহেন, তাঁহারা যদি আর একটু মনোযোগ সহকারে ইহাদিগের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠনপ্রণালীর প্রতি প্রধানতঃ দৃক্পাত করেন, তাহা হইলে এই জাতিগত বিরোধের সম্বন্ধে সমস্ত সন্দেহ দূরীভূত হইয়া যাইবে।
এখন দেখা যাইতেছে যে, আমাদের নাটকগুলির মধ্যে পারাবত বা গৃহকপোত কখনও বা প্রখর মধ্যাহ্নে সৌধবলভিতে বিচরণ ত্যাগ করিতেছে; কখনও বা আসন্ন সন্ধ্যায় গবাক্ষজালবিনিঃসৃত ধূপে সন্দিগ্ধভাব ধারণ করিতেছে; সাধারণতঃ প্রাসাদের এমন দুর্গম স্থানে সে বাস করে, যে স্থান সে ব্যতীত আর সকলের দুরধিগম্য। বাস্তবিক ইহারা আমাদের দেশে অট্টালিকায়, মন্দিরচূড়ায়, প্রাচীরগাত্রে সাধারণতঃ বাস করে। ইহা বিদেশীয় পণ্ডিতগণও বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়াছেন। নাটকগুলির মধ্যে কোথাও আমরা বন্য কপোতের সাক্ষাৎ পাইলাম না। অতএব এস্থলে তাহার আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
চাতক
পারাবত সম্বন্ধে আপাততঃ আর কিছু না বলিয়া, চাতকের কথা আলোচনা করা যাক্। মেঘদূতে আমরা ইহার অম্ভোবিন্দুগ্রহণ চতুরতার পরিচয় পাইয়াছি। বিক্রমোর্ব্বশী নাটকে দেখিতেছি যে, রাজা পুরুরবা “চাতক-ব্রত” অবলম্বন করিয়াছেন; এস্থলে বুঝিতে হইবে যে মহাকবি এমন একটি শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন, যাহাতে রাজার তাৎকালীন অবস্থা বুঝিতে কাহারও কষ্ট হইবে না; এই চাতকব্রতটা কি, এ প্রশ্ন যেন আদৌ উঠিতে পারে না, ইহা এতই অত্যন্তপরিচিত। আমরা কিন্তু কালিদাস-সাহিত্যের মধ্য হইতে মহাকবির ভাষায় ইহার তাৎপর্য্য গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব। মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে বিদূষক পারিশ্রমিক স্বরূপ কিছু দক্ষিণা চাহিয়া বলিলেন—“আমি শুষ্ক মেঘগর্জ্জিত অন্তরীক্ষে জলপানের ইচ্ছা করিয়া চাতকবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছি।” এখানেও যেন মহাকবির মনে কোনও সংশয় নাই যে, আপামর সাধারণে এই বৃত্তিটি অতি সহজে বুঝিয়া লইবে। যেন চাতক পাখীর স্বভাবই এই যে—সে মেঘের নিকট হইতে বারিবিন্দু যাচ্ঞা করে। আবার অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকে রাজা স্বর্গলোক হইতে প্রত্যাবর্ত্তনকালে রথচক্রবিবরের মধ্য দিয়া নিষ্পতনশীল চাতককুল দেখিয়া স্থির করিলেন যে রথ বারিগর্ভোদর মেঘের ভিতর দিয়া চলিতেছে। এই পাখীটি যেন জলের জন্য সদাই উৎকণ্ঠিত; জলবিন্দু গ্রহণ করিবার চেষ্টাই যেন ইহার একমাত্র ব্রত। সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে আর কোনও পাখীকে এই বৃত্তি অবলম্বন করিতে দেখা যায় না। অতএব মানুষের চিত্ত রসপিপাসায় যখন অস্থির হইয়া উঠে, যদি সেই পিপাসানিবৃত্তির জন্য সে একাগ্রভাবে চেষ্টা করে, তাহা হইলে তাহাকে চাতকতাবলম্বী বলিলে, অন্ততঃ সাহিত্যহিসাবে কোনও ভুল হয় না।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবে ইহা ভুল কি না তাহা বিচারসাপেক্ষ। এই পাখীটির জাতি লইয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিত-সমাজে মতদ্বৈধ আছে। যাঁহারা ইহাকে Cuckoo শ্রেণীভুক্ত করিয়া পরিচয় দেন তাঁহাদের পর্য্যবেক্ষণের ফল আর যাহাই হউক, এই জলবিন্দুগ্রহণচতুরতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কবি-বর্ণিত বিহঙ্গের চরিত্রে যেটি অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, সেটি যে কোনও বৈজ্ঞানিক দ্রষ্টার নজরে পড়িল না, ইহা বড় আশ্চর্য্যের বিষয়। কাজেই তাঁহাদের এই জাতিবিচারে সন্দেহের কারণ রহিয়াছে। অধ্যাপক কোলব্রুক্ও বেগতিক দেখিয়া লিখিতে বাধ্য হইয়াছেন[১৫]—“but it is not certain whether the chatack be not a different bird”—অর্থাৎ নিশ্চয়ই বলা যায় না যে চাতক ভিন্নজাতীয় (Cuculus Radiatus হইতে) পাখী নহে। কোনও কোনও অনুসন্ধিৎসু বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ চাতককে Iora পরিবারভুক্ত করিবার স্বপক্ষে যে সকল যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, তাহা অনেকটা সমীচীন বলিয়া মনে হয়। অন্ততঃ আমার পক্ষিগৃহমধ্যে (aviary) এই Iora জাতীয় পাখীর জলবিন্দুলালসা লক্ষ্য করিবার যথেষ্ট সুযোগ হইয়াছে, একথা মেঘদূত-প্রসঙ্গে আমি বিশদভাবে বলিয়াছি। মহাকবিবর্ণিত চাতক মেঘলোকে রথচক্রনেমির ভিতর দিয়া সঞ্চরণ করিতেছে। শুধু যে Cuckooজাতীয় কোনও কোনও পাখী ভূমি হইতে বহু ঊর্দ্ধে উড়িয়া থাকে তাহা নহে Iora জাতীয় পাখীকেও তিন চার হাজার ফুট উচ্চ পর্ব্বতগাত্রে অবস্থান করিতে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন; ঠিক যে তাহারা দল বাঁধিয়া আকাশমার্গে মেঘের ভিতর দিয়া উড়িতে থাকে, এমন নহে। ইহার অধিক চাতক সম্বন্ধে আপাততঃ কিছু বলা চলে না।
গৃধ্র, শ্যেন
যে গৃধ্র আমিষভ্রমে অশোকস্তবকের মত লাল মণিটিকে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, যাহার নিবাস-বৃক্ষের অনুসন্ধানে রাজার অনুচরবর্গ সচেষ্ট হইল, তাহার প্রকৃত পরিচয় লইতে কোনও বৈজ্ঞানিক ঘৃণা বোধ করিবেন না। বৈজ্ঞানিকের পরিচিত Vulturidæ পরিবারভুক্ত গৃধ্রের কথা যখন আসিয়া পড়িল, তখন তাহার জ্ঞাতিসম্পর্কীয় শ্যেন (Falconidæ) ও কুররের (Pandionidæ) কথা না উঠিয়া পারে না। এই জন্য মহাকবি-বর্ণিত এই তিনটি পাখীকে আমরা একত্র করিয়া আলোচনা করিবার সুযোগ পাইয়াছি। উহাদের পরস্পরের সম্পর্ক খুব দূরের কি নিকটের, সে বিচারও অতিসহজে নিষ্পন্ন হইতে পারে। ইহারা সকলেই যে Accipitres পর্য্যায়ভুক্ত সে বিষয়ে সংশয় নাই; আরও, ইহাদের দেহাবয়বের বিশিষ্ট লক্ষণগুলি অনুধাবন করিলে, অর্থাৎ সাম্য ও বৈষম্যের প্রতি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিলে, একেবারে নিঃসংশয়ভাবে বলা যাইতে পারে যে, এই তিনটী পাখী শ্রেণী সম্বন্ধে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিয়া পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে নাই। শারীরিক বৈলক্ষণ্য প্রথমেই চোখে পড়ে; গৃধ্রের মাথায় ও ঘাড়ে লোম নাই বলিলেই হয়; এই লোমশূন্যতা ইহাকে শ্যেন হইতে পৃথক করিতেছে[১৬]। আরও যে সব লক্ষণ এই প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিকের আলোচ্য, বিজ্ঞানশাস্ত্রের দিক হইতে দেখিলে সেই সমস্ত খুঁটিনাটি তুচ্ছ নহে; কিন্তু সাধারণ পাঠকবর্গের নিকটে সে সমস্ত উপস্থাপিত করা নিষ্প্রয়োজন। মোটামুটি এই কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে এই তিনটি Accipitres পর্য্যায়ভুক্ত পাখী আমাদের চরক ও সুশ্রুতকারের মতে “প্রসহ” শ্রেণীর মধ্যে সন্নিবিষ্ট। এই প্রসহ শব্দের তাৎপর্য্য—প্রসহ্য ভক্ষয়ন্তীতি, অর্থাৎ যাহারা ছোঁ মারিয়া ভক্ষ্য দ্রব্য গ্রহণ করে। ইহাতে সহজে বুঝা যায় যে, এই প্রসহ জাতীয় বিহঙ্গ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের Accipitres অথবা diurnal birds of prey। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যেমন হিংস্র বিহঙ্গগুলিকে মোটামুটি তিনটি স্বতন্ত্র পরিবারে বিভক্ত করিয়াছেন, তদ্রূপ আমাদের দেশের সুধীগণও উহাদিগকে তিনটি স্বতন্ত্র পরিবারভুক্ত করিয়াছেন। Vulturidæ, falconidæ, এবং pandionidæ যথাক্রমে গৃধ্র, শ্যেন ও কুরর রূপে দেখা দিতেছে।
সুশ্রুতের টীকাকার ডল্লনাচার্য্য মিশ্র গৃধ্রের এইরূপ পরিচয় দিতেছেন—গৃধ্রঃ মাংসাশী যোজনদৃষ্টিঃ। পাশ্চাত্য পণ্ডিত বলিতেছেন[১৭]—“They feed on dead animals, and congregate in an extraordinary manner wherever a carcass is exposed * * * * the vultures are dependent for the discovery of their food upon their eyesight.” বিক্রমোর্ব্বশী নাটকেও মহাকবি এই “বিহগতস্কর”কে “ক্রব্যভোজন” (অর্থাৎ মাংসাশী) বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। এই ক্রব্যভোজী শবভুক্ পাখীর উল্লেখ অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কে রাজপুরুষের মুখে এইরূপ পাওয়া যায়; চোরসন্দেহে ধীবরকে গ্রেপ্তার করিয়া ভয় দেখান হইতেছে—“তুই গৃধ্রবলি হইবি অথবা কুকুরের মুখে যাইবি।” শুধু পাখীটার এই হেয় খাদ্যের এবং স্থলবিশেষে ইহার এই চৌর্য্যবৃত্তির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া যে ইহাকে “বিহগাধম”, “শকুনিহতাশ” আখ্যা দেওয়া হইয়াছে এমন মনে হয় না; এইরূপ আখ্যাপ্রদানের তাৎপর্য্য আমরা বুঝিতে পারি, যখন পাখীটার শারীরিক গঠন এবং ইহার দেহবিনির্গত সহজ একটা দুর্গন্ধ আমাদের নেত্র এবং ঘ্রাণপথবর্ত্তী হয়। তাই ব্লানফোর্ড লিখিয়াছেন[১৭]—On the ground vultures are clumsy, heavy and ungainly, as foul in aspect as in smell। প্রায়ই শৈলশিখরে ইহারা বাসা নির্ম্মাণ করিয়া থাকে; তবে কতকগুলা জাতি বৃক্ষশাখায় আপনাদের গৃহস্থালী পাতিয়া লয়। পার্ব্বত্য গৃধ্রেরা সুদূর ভূভাগ হইতে আপনাদের আহার্য্য সংগ্রহ করিয়া পর্ব্বতশৃঙ্গে উড়িয়া গিয়া আহারক্রিয়া সমাপন করে। তাহাদের বিশ্রামস্থানও পর্ব্বতশিখর। মহাকবিবর্ণিত গৃধ্রের কিন্তু “নিবাসবৃক্ষে”র উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় যে পক্ষীটা ঠিক পার্ব্বত্যজাতীয় (mountain vulture) নহে। গৃধ্রজাতীয় পাখীরা সাধারণতঃ কোনও বৃক্ষে যে বাসা নির্ম্মাণ করে এমন নহে; প্রায়ই তাহারা পার্ব্বত্য স্থানে গিরিশিখরের সমীপবর্ত্তী উচ্চ স্থানে থাকিতে ভালবাসে। নিবাস-বৃক্ষের তাৎপর্য্য এই যে, ইহারা বৃক্ষের উপর নীড় নির্ম্মাণ না করিলেও, অভ্যাস মত আহার্য্য সংগ্রহ করিয়া প্রায়ই কোনও না কোনও গাছে বসিয়া তাহা উদরস্থ করিয়া থাকে। কোনও কোনও বিশিষ্ট বৃক্ষের উপরে তাহাদিগকে এইরূপ পুনঃ পুনঃ বসিতে দেখিলে অবশ্যই মনে হইতে পারে যে সেই সকল গাছ ইহাদের নিবাসবৃক্ষ। পার্ব্বত্য গৃধ্রগণের এইরূপ roosting place পর্ব্বতশৃঙ্গ; কিন্তু যে সকল গৃধ্র ঠিক পার্ব্বত্য জাতীয় নয়, তাহাদের roosting place প্রায়ই বৃক্ষাগ্র[১৮]। সাধারণতঃ খাদ্যাহরণকালে গৃধ্রেরা আকাশে মণ্ডলাকারে ঘুরিয়া ঘুরিয়া উড়িয়া বেড়ায়। মহাকবিও এই উৎপতনভঙ্গীর এইরূপ আভাস দিয়াছেন,—“মণ্ডলশীঘ্রচার”। ব্লানফোর্ড বলেন[১৭]—“When in search of food, vultures and some other Accipitrine birds soar and wheel slowly in large circles, very often at an elevation far beyond the reach of human vision.”
Falconidæae অথবা শ্যেন পরিবারকে কিন্তু এক হিসাবে আমাদের সংস্কৃতসাহিত্যে প্রায়ই কিছু ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হইয়াছে; এমন কি ইহার মধ্যে বাজ ’ত আছেই, গৃধ্রও আসিয়া পড়ে। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে[১৯] শ্যেনের এই ব্যাপক অর্থ পাওয়া যায়; সেখানেও গৃধ্র অর্থে শ্যেন ব্যবহৃত হইয়াছে। কালিদাসের নাটকেও শ্যেনের যে পরিচয় পাওয়া যাইতেছে,—অর্থাৎ “শ্যেন যেমন প্রাণিবধস্থানের নিকটে আমিষলোভে বিচরণ করে,” রাজার বয়স্যপ্রমুখাৎ এই বাক্যে দেখা যায় যে পাখীটা গৃধ্র, তাহাতে সন্দেহ নাই। আধুনিক বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্গণ কিন্তু গৃধ্র এবং শ্যেন এই দুই পক্ষীকে কখনই এক শ্রেণীভুক্ত করিতে রাজী নহেন। যদিও উহাদিগের চরিত্রগত কতকটা সাম্য লক্ষিত হয়, তথাপি উভয়ের অবয়বসংক্রান্ত বৈষম্য, বিশেষতঃ মাথায় ও ঘাড়ে লোমের প্রাচুর্য্য অথবা বিরলতা এত সহজেই আমাদের চ’খে পড়ে যে, এই একটা লক্ষণ দেখিয়াই তাহাদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে স্থির নিশ্চয় করা যাইতে পারে।
এই হিংস্র পাখীগুলার শারীরিক লক্ষণের কথা যখন আসিয়া পড়িল, তখন কুররীর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই। পূর্ব্বে আমরা কুরর পক্ষীকে Pandiondæ পরিবারভুক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছি; ইংলণ্ডপ্রদেশে ইহা osprey নামে পরিজ্ঞাত। Osprey পাখীর পক্ষ এবং পদাঙ্গুলির এমন কিছু বৈচিত্র্য আছে যাহাতে তাহাকে শ্যেন পক্ষী হইতে পৃথক বলিয়া গণ্য করা যায়। এই বৈচিত্র্য কিন্তু গৃধ্রপরিবারে আদৌ লক্ষিত হয় না বলিয়া পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক লিখিয়াছেন[২০]—It (the osprey) differs from the Falconidæ much more than the vultures do. Osprey পক্ষী জলাশয়সমীপে নদীতটে বৃক্ষাগ্রে থাকিতে ভালবাসে; প্রধানতঃ মৎস্যই ইহাদের খাদ্য। ইহাদের দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে উড়িতে উড়িতে হঠাৎ অব্যর্থ সন্ধানে পদাঙ্গুলির সাহায্যে প্রবলবেগে ছোঁ মারিয়া অনায়াসে জলমধ্য হইতে মাছ ধরিয়া থাকে। মৎস্যের সন্ধানে প্রায়ই ইহাদিগকে জলাশয় হইতে কিছু ঊর্দ্ধে শূন্যে দ্রুতপক্ষসঞ্চালনে সামান্য ক্ষণের নিমিত্ত এক জায়গায় স্থির থাকিতে দেখা যায়; হয় পরক্ষণেই জলে ঝাঁপাইয়া মাছ ধরে, নতুবা মৎস্য সরিয়া গেলে, অন্যত্র উড়িয়া বসে।
সংস্কৃতসাহিত্যে কুররের যাহা কিছু বিবরণ পাওয়া যায় তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে, আমরা আর একটি জাতির উল্লেখ করিব—মৎস্যাশী ঈগল (Fishing Eagle)। ইহাদের স্বভাব osprey পাখীর ন্যায়; মৎস্য ইহাদের প্রধান আহার। জলাভূমি এবং নদীসান্নিধ্য ইহাদিগের বিহারভূমি। ইহাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ এবং কর্কশ।
ভারতবর্ষে দুই শ্রেণীর মাংসাশী ঈগল দেখা যায়; Haliætus এবং polioætus ইহাদের বৈজ্ঞানিক আখ্যা। উভয়েই শ্যেন জাতির অন্তর্ভুক্ত; তবে polioætus শ্রেণীর পাখীগুলার পদাঙ্গুলির গঠন কতকটা ospreyর মতন এবং পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকেরাও ইহাদিগকে Osprey পাখীর সহিত একত্র করিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। Osprey, haliætus এবং polioætus—ইহারা সকলেই হিংস্র পাখী; ছোঁ মারিয়া শিকার ধরে। Osprey যখন আয়াস স্বীকার করিয়া অব্যর্থ সন্ধানে নখরসাহায্যে মাছ ধরিয়া আনে, মৎস্যাশী ঈগলকে তখন প্রায়ই চোরের উপর বাটপাড়ী করিতে দেখা যায়[২১]। জলাশয় হইতে মাছ গাঁথিয়া যখন osprey আকাশে উঠিতে থাকে, ঈগল তখন কোথা হইতে তাহার উপর আসিয়া পড়ে; নিরুপায় দেখিয়া চীৎকার শব্দে osprey মৎস্য ফেলিয়া দেয়, জলে মাছ পতিত হইতে না হইতে, ঈগল তাহা দ্রুতপক্ষক্ষেপে ধরিয়া লয়। Osprey পাখীর এইরূপ করুণ আর্ত্তধ্বনি বিদেশী বৈজ্ঞানিকেরও[২২] কর্ণ এড়ায় নাই। সাধারণের নিকটে এই osprey অনেক সময় fishing eagle, fish-hawk ইত্যাদি নামে পরিচিত।
এখন বিক্রেমোর্ব্বশীনাটকে যে কুররীর কণ্ঠধ্বনির উল্লেখ আছে, তাহা সহসা ঈগল-বিতাড়িত উল্লিখিত ospreyর চীৎকারের সহিত মিলাইয়া দেখিলে ক্ষতি কি? নেপথ্যে সহসা আর্ত্তনাদ শুনিয়া সূত্রধার বলিয়া উঠিলেন “কিং নু খলু মদ্বিজ্ঞাপনানন্তরম্ আর্ত্তানাং কুররীণামিব আকাশে শব্দঃ শ্রূয়তে।” সাধারণতঃ Accipitres পর্য্যায়ভুক্ত পাখীগুলার কণ্ঠধ্বনি তীব্র হইলেও, ospreyর স্বরে[২৩] যথেষ্ট মাধুর্য্য আছে; কিন্তু যখন ঈগলপক্ষীর তাড়নায় ইহাকে মৎস্যের গ্রাস পরিত্যাগ করিতে হয়, তখন ইহার স্বর কর্কশ আর্ত্তনাদে পরিণত হয়। বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ মিঃ উইল্সন্ ইহা বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া এইরূপ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন—“A sudden scream, probably of despair and honest execration”[২৪]। এখন অসুর কর্ত্তৃক অপহৃত বন্দিনী উর্ব্বশীর আর্ত্তস্বর যে কুররীর কণ্ঠস্বরের অনুরূপ হইবে, অর্থাৎ ঈগলতাড়িত ospreyর কণ্ঠস্বরের মত হইবে, ইহা বিচিত্র কি?
এইবার সংস্কৃত সাহিত্যের সাহায্যে কুররের স্বরূপ পরিচয় লইতে হইবে। অমরকোষে এইটুকু আছে,—“উৎক্রোশকুররৌ সমৌ” অর্থাৎ উৎক্রোশ ও কুরর একই পাখী। এখানে কেবল নামান্তর পাওয়া গেল, আর কোনও বিশেষ পরিচয় পাইলাম না। অতএব অন্যত্র অন্বেষণ করা যাক্। বৈদ্যকশাস্ত্রে কুররের সাক্ষাৎ পাইতেছি। সুশ্রুতসংহিতায় দেখিতে পাই যে, কুরর গৃ্ধ্র-শ্যেন-চিল্লি প্রভৃতি প্রসহজাতীয় বিহঙ্গের অন্যতম। আবার উক্ত গ্রন্থেই প্লবজাতীয় হংস-সারস-কাদম্ব-কারণ্ডব প্রভৃতি বিহঙ্গগুলির মধ্যে উৎক্রোশ বিরাজ করিতেছে। এখন ব্যাপারটা দাঁড়াইল এই:—অভিধানকার বলিতেছেন যে, কুরর ও উংক্রোশ একই পাখী; কুরর কিন্তু বিশেষ ভাবে প্রসহ-বিহঙ্গপর্য্যায়ভুক্ত হইয়া দেখা দিতেছে; আর উৎক্রোশ প্লবজাতির মধ্যে এক পঙ্ক্তিতে বসিয়া গিয়াছে। সোজাসুজি দাঁড়াইল এই যে, কুরর = উৎক্রোশ = প্লব ও প্রসহ। প্লব পাখীগুলি web-footed হংসাদির ন্যায় জলচর; আর প্রসহ পাখীগুলি বলপূর্ব্বক চঞ্চুপুটে অথবা নখরসাহায্যে আততায়ীর মত আমিষের উপর আসিয়া পড়ে। তাহা হইলে এই কুরর অথবা উৎক্রোশের প্রকৃতিতে এই উভয়বিধ লক্ষণ দৃষ্ট হয় কি না? Osprey পাখীর সম্বন্ধে বিদেশীয় জনসাধারণের ধারণা এতাবৎ এই ছিল যে, সে প্লবও বটে, প্রসহও বটে। ফ্র্যাঙ্ক ফিন্ সেকেলে বিহঙ্গতত্ত্ববিদের আপেক্ষিক অবৈজ্ঞানিকতার প্রতি কটাক্ষ করিয়া লিখিয়াছেন[২৫]—We laugh at the error of the old naturalists who credited the osprey, as a fishing bird of prey (প্রসহ) with one taloned foot and one webbed one (প্লব)। এরূপভাবে বিষয়টাকে উপহাস করিয়া উড়াইয়া দিবার জিনিষ নহে। পূর্ব্বোক্ত লক্ষণ দুইটি পরস্পর বিরোধী বলিয়া সহজেই প্রতীয়মান হইতে পারে, এই জন্য মিঃ ফিন্ ইহাদিগকে “odd extremities” বলিয়াছেন। কিন্তু, তাই বলিয়া যদি পুরাতন পাশ্চাত্য বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্গণ এই বিরুদ্ধ লক্ষণগুলির সামঞ্জস্য যথাযথ বিবেচনা করিয়া থাকেন, অর্থাৎ একটা পাখীর প্রকৃতিতে যে প্লবের ও প্রসহের স্বভাবের অদ্ভুত সংমিশ্রণ সম্ভবপর হইতে পারে একথা যদি তাঁহারা বলিয়া থাকেন, তাহা হাসিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। অবশ্যই একটা পা web-footed আর একটা taloned এরকম বর্ণনা হাস্যকর বটে, কিন্তু বস্তুগত্যা যদি উক্ত পাখীর স্বভাবে web-footed পাখীর ও taloned পাখীর বিশিষ্টতা প্রকট হয়, তাহা হইলে পক্ষিবিজ্ঞান হিসাবে বর্ণনাটা স্থূলভাবে গ্রহণ না করিলেও উহার সার মর্ম্ম সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে আপত্তি কি? কুরর পাখীকে প্লব বলা যাইতে পারে এই হিসাবে যে, সে জলাশয়প্রিয়, মৎস্যই তাহার প্রধান খাদ্য; সুতরাং তাহাকে জলসন্নিকটে ঘুরিতে ফিরিতে হয়। টীকাকার ডল্লনমিশ্র তাহার পরিচয় দিয়াছেন এইরূপ—“নদোত্থাপিতমৎস্য” অর্থাৎ নদী হইতে মাছ উঠাইয়া খায়। আবার প্লবান্তর্গত উৎক্রোশের পরিচয় তিনি দেন—“উৎক্রোশঃ কুররভেদঃ মৎস্যাশী”। কুরর সম্বন্ধে তিনি আরও লিখিয়াছেন—“কুররঃ (প্লবান্তর্গতঃ) তস্য প্রসহেষ্বপি পাঠঃ তত উভয়েষামপি গুণা বোধব্যাঃ”, অর্থাৎ প্লব এবং প্রসহ এই উভয়বিধ গুণ কুররে দৃষ্ট হয়।
শকুনি
নাটকগুলির মধ্যে শকুনি ও শকুন্তের উল্লেখ দেখিয়া পাঠক যেন মনে না করেন যে উহার শবভুক্ গৃধ্রের নামান্তর মাত্র। সংস্কৃতসাহিত্যে শকুন, শকুনি ও শকুন্ত খুব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। বৈদিক সাহিত্যে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই তিনটি শব্দের অর্থ পাখী মাত্র; তবে একটু প্রকারভেদ আছে। কোনওটা অপেক্ষাকৃত বড় পাখীকে বুঝায়, কোনটা বা কেবলমাত্র হিংস্র গৃধ্র বা শ্যেনের পরিচায়ক; আবার কোনটা শ্যেন অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর বিহঙ্গও বুঝায়[২৬]। নাটকের মধ্যে “শকুনিহতাশ” এবং “শকুনিলুব্ধক” এই দুইটি শব্দ বুঝিতে এখন পাঠকের বোধ হয় ভুল হইরে না; উভয়ত্রই শকুনি শব্দের অর্থ পাখী। তবেই অর্থ দাঁড়াইল,—যথাক্রমে বিহগাধম এবং পক্ষিশিকারী (ব্যাধ)। আর শকুন্ত শব্দের অর্থ যে পাখী, তাহা অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের পাঠকমাত্রেই অবগত আছেন।
কোকিল
এখন পাঠকের অত্যন্ত পরিচিত কোকিলের কথা পাড়া যাক্। বিক্রমোর্ব্বশী নাটকের প্রারম্ভে সূত্রধার দূরে আকাশমার্গে কি একটা আর্ত্তস্বর শ্রবণ করিয়া ঠিক করিতে পারিতেছেন না যে, উহা আর্ত্ত কুররীর শব্দ, না কুসুম-রসে মত্ত ভ্রমরের গুঞ্জন অথবা ধীর পরভৃতনাদ। অসুরকর্ত্তৃক অপহৃতা উর্ব্বশীর আর্ত্তনাদে কেমন করিয়া কুররী, ভ্রমর ও পরভৃতের স্বর বলিয়া ভ্রম হইতে পারে ইহা বিচার্য্য;—শুধু কাব্যের দিক হইতে নহে, বিজ্ঞানের দিক হইতেও ইহার কৈফিয়ৎ লওয়া আবশ্যক। কুররীর সম্বন্ধে অনেক কথা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি; সুদূর গগনপথে তাহার কণ্ঠধ্বনি কেমন করিয়া করুণ shriekএ পরিণত হয়, তাহার আলোচনা করিয়াছি। এই মিষ্ট, তীব্র অথচ আর্ত্ত কণ্ঠস্বর, পরক্ষণেই কিন্তু কোমল মধুর ভ্রমরগুঞ্জন বলিয়া মনে হইতে না হইতেই, উহা ধীর পরভৃতনাদ কি না এইরূপ সংশয় উপস্থিত কেমন করিয়া হইতে পারে? দেখা যাইতেছে যে,—শব্দটা প্রথমে খুব তীব্র, পরে অপেক্ষাকৃত কোমল অথচ করুণ; কিন্তু সেই ধ্বনিতরঙ্গের মধ্যে একটা মত্ত প্রবাহ আছে; তার পরেই ধীর কোকিলের কুহুরবের মত,—করুণ আর্ত্তনাদ নয়, মত্ত গুঞ্জনও নয়। এই পরভৃতনাদ যে ধীর অথবা ইংরাজিতে যাহাকে বলে mellow note হইতে পারে সে সম্বন্ধে বোধ করি কাহারও সন্দেহ নাই; যদিও কোকিলের পঞ্চম স্বর পাশ্চাত্য শ্রোতার কাণে অনেক সময়ে অধীর বা shrill বলিয়া অনুমিত হইয়া থাকে। ফ্রান্ক ফিন্ প্রমুখ পণ্ডিতগণ পরভৃতনাদ আলোচনা করিতে বসিয়া ইহার “fine mellow call” এর উল্লেখ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। উর্ব্বশীর আর্ত্তনাদেও যেন এই mellow call বা সকরুণ আহ্বানের ভাব সূচিত হইতেছে। এস্থলে বলা অবশ্যক যে কোকিলের কণ্ঠস্বর সাধারণতঃ পর্দ্দায় পর্দ্দায় চড়িতে থাকে,—এমন কি বিদেশীয়েরা এই জন্য ইহাকে Brain-fever bird আখ্যায় অভিহিত করিয়া থাকে। কোকিলের গলার সেই আওয়াজটার প্রতি মহাকরি মোটেই লক্ষ্য করিতেছেন না; প্রায়ই যখন পাখীটা আকাশমর্গে উড়িতে উড়িতে ডাকে, তাহার এই অবস্থার ডাক ঐ পূর্ব্ববর্ণিত “melodious and rich liquid call”। এখন এই ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনায় বোধ হয় সকল কথাই পরিষ্কার করিয়া বলা হইল; বিশেষ করিয়া আর বুঝাইবার আবশ্যকতা নাই, কেমন করিয়া আকাশমার্গে অন্তর্হিতা উর্ব্বশীর কাতরোক্তি ভীত কুররীর আর্ত্তস্বর, অথবা উড্ডীয়মান পরভৃতের ধীর নাদ বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। কিন্তু তাই বলিয়া যে কাব্যের মধ্যে পরভৃতের উচ্চ তীব্র বণ্ঠস্বরের উল্লেখ একেবারে নাই এ কথা বলা চলে না। বিক্রমোর্ব্বশী নাটকে আমরা বাদ্যমান পরভৃত-তূর্য্যের ধ্বনি কিছুতেই ধীর পরভৃতনাদ বলিয়া ভুল করিব না। আবার পুংস্কোকিল ও স্ত্রীকোকিলের কণ্ঠস্বর যে স্বতন্ত্র, তাহা কোকিলার প্রলাপে এবং “কণ্ঠেষু স্খলিতং পুংস্কোকিলানাং রুতম্”এ সহজেই ধরা পড়ে। ইংরাজ-লেখকও বলিতেছেন—“The male bird has also another note”[২৭]। সাধারণতঃ লোকে মনে করে যে পক্ষিজাতির মধ্যে স্ত্রী-পক্ষী গান করে না। কিন্তু কোকিলার সম্বন্ধে এ কথা একেবারেই খাটে না। হয়ত, তাহার কণ্ঠধ্বনি বিলাপের মত শোনায়; কিন্তু তাহার মধ্যে সঙ্গীতের note আছে ইহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।
তবেই দেখা গেল যে, পরভৃতনাদ তিন প্রকার হইয়া থাকে;—ধীর, অধীর বা shrill, এবং কোকিলার বিলাপ। পাশ্চাত্য-পণ্ডিতেরাও এই বিহঙ্গের কণ্ঠ-স্বরে এই রকম তিনটি প্রকারভেদ লক্ষ্য করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
এখন দেখিতে হইবে যে ইহাকে “পরভৃত”, “পরপুষ্ট” আখ্যা দেওয়া হয় কেন? ইহার আলোচনায় এই বিহঙ্গের জন্ম-কাহিনী বিবৃত করিতে হইবে। তবেই বুঝিতে পারা যাইবে যে, উপর্য্যুক্ত আখ্যাগুলি বিশেষভাবে এই জাতীয় পাখীর প্রতি প্রযোজ্য কি না, অথবা ইহা অলীক অপবাদমাত্র। কাহার নীড়ে ইহার প্রথম আবির্ভাব, পিতৃ-মাতৃপরিত্যক্ত ডিম্বটিকে আর কেহ ফুটাইয়া তোলে কি না, জীবনারম্ভে কে ইহাকে পোষণ করে এবং কেমন করিয়াই বা করে, এই সমস্ত ব্যাপার কম রহস্যময় নহে। কেন ইহাকে বলা হইল—“বিহগেষু পণ্ডিতৈষা জাতিঃ?” রাজা তাহাকে ‘মদনদূতী’ সম্বোধনে অভিহিত করিলেন কেন?
আমরা শেষের প্রশ্নটা লইয়া এই আলোচনার সূত্রপাত করিব। বসন্ত সখা মদনের দূতী বলিয়া কোকিলাকে পরিচিত করিবার কারণ অন্বেষণ করিতে আমাদিগকে বাঙ্গালা ছাড়িয়া বেশী দূরে যাইতে হইবে না। শিশিরাপগমে বসন্ত ঋতুর আগমন-বার্ত্তা নবপুষ্পকিসলয়শোভিত ভারতের কুঞ্জে কুঞ্জে এই পরভৃত পরপুষ্ট পাখীটি যেমন করিয়া ঘোষণা করে, তেমন আর কেহ করে না। মালবিকাগ্নিমিত্রে “আমত্তানাং শ্রবণসুভগৈঃ কূজিতৈঃ কোকিলানাম্” বসন্তের আগমন সূচিত করিতেছে। আবার নাটকের পঞ্চম অঙ্কে দেখা যাইতেছে যে “রতি-সহচর মন্মথ পরভৃত-কল-কূজনে বসন্তের আবির্ভাব প্রকাশ করিয়া থাকেন।” এই সকল বর্ণনা কিছুমাত্র অপ্রাকৃত বা অতিরঞ্জিত নহে। ইংরাজ লেখক বলিতেছেন—“In the breeding season, from March or April till July, its cry of ku-il, ku-il, repeated several times, increasing in intensity and ascending in the scale, is to be heard in almost every grove”[২৮]। মিথুনাবস্থায় বিহঙ্গদম্পতির এই যে আনন্দোচ্ছ্বাস, ইহার পরিণতি ডিম্বপ্রসবে হয়; কিন্তু এই ডিম্বের ইতিহাস বিহঙ্গদম্পতির জীবনের একটি অত্যন্ত অভিনব রহস্যময় অধ্যায়। আমরা সে কাহিনী বিবৃত করিবার পূর্ব্বে ইহাদের কলস্বর সম্বন্ধে যে কথাটি বলিতে চাই, সেটি এই যে কোকিল যাযাবর বিহঙ্গ নহে; অর্থাৎ ঘূর্ণ্যমান ঋতুচক্রের আবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে যে দেশদেশান্তরে ঘুরিয়া বেড়ায় তাহা নহে; দেশের মধ্যেই অন্য ঋতুতে সে যখন অজ্ঞাতবাস করে, তখন তাহার কোন সন্ধান আমরা সহজে পাই না। ফাল্গুন চৈত্রে যখন দখিণে বাতাস প্রকৃতিকে চঞ্চল করিয়া তোলে, তখন সেই বায়ুবিকম্পিত পত্রান্তরালে ইহার আবাহন-সঙ্গীত পথিকের কর্ণগোচর হয়। এতদিন যে পাখী প্রকৃতির অন্তরালে মূক ও মৌন অবস্থায় প্রচ্ছন্ন ছিল, হঠাৎ সে আসন্ন বসন্তে আমাদের দেশের বন উপবনকে সঙ্গীতে মুখরিত করিয়া তোলে। মিঃ ষ্টুয়ার্ট বেকার পরিষ্কারভাবে লিখিয়াছেন—“In March it practises its voice and gets its throat into working order, and in September its voice breaks, gradually ceases, and the world has rest for a few cold weather months.”[২৯]
এখন ইহার জীবনের যে অধ্যায়টি আলোচনা করিব সেটি রহস্যবিজড়িত এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। প্রথমতঃ ইহারা ডিম্বপ্রসবের অথবা ডিম্বরক্ষার জন্য সচেষ্ট হইয়া কোনও নীড় রচনা করে না। অথচ ইহাদের প্রসূত ডিম্ব ফুটাইয়া শাবকোৎপাদনের জন্য যে আয়াস স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইতেও ইহারা পরের নীড়ে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া নিষ্কৃতি লাভ করিয়া থাকে। ডিম্ব সুকৌশলে অন্য পাখীর নীড়ে যখন উপনীত করা হয়, তখন সেই নীড়াভ্যন্তরস্থ বিজাতীয়া স্ত্রীপক্ষী—অসংশয়ে এই ডিমগুলিকে স্বীয় ডিম্বের মত ফুটাইয়া তোলে। আবহমান কাল হইতে এইরূপ প্রথা চলিয়া আসিতেছে; কখনও কোথাও এমন কোন বিষম বাধা বিপত্তি ঘটিল না যে প্রকৃতির বিপুল প্রাঙ্গণ হইতে এই কৃষ্ণবর্ণ পরনির্ভর পাখীটির জীবনেতিহাস একেবারে লুপ্ত হইয়া Dodo প্রভৃতির ন্যায় কেবলমাত্র নামটুকুতে পর্য্যবসিত হইয়া জীববিদ্যাগারের একটা biologic curiosity দাঁড়াইয়া যায়। কেমন করিয়া এ বাঁচিয়া গেল এবং এখনও উপায়ান্তর অবলম্বন না করিয়া বাঁচিয়া যাইতেছে, এইটাই কৌতুকময়ী প্রকৃতির বিস্ময়কর রহস্য। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজিজ্ঞাসু কার্য্যকারণের আলোচনা করিতে গিয়া কতকগুলি প্রত্যক্ষ সত্য ব্যতীত আর কোনও গভীর তথ্যে এখন পর্য্যন্ত এমন করিয়া প্রবেশলাভ করিতে পারেন নাই যাহাতে সাধারণ মানবের নিকটে সমস্তটা পরিষ্কার হইয়া যায়। তাহাকে বাঁচিতেই হইবে এই জন্যই বোধ হয় স্ত্রী-পক্ষীর অদ্ভুত অশিক্ষিতপটুত্ব—“স্ত্রীনাম্ অশিক্ষিতপটুত্বম্”—অন্যান্য পাখীর তুলনায় এত বেশী যে বায়স প্রভৃতি যে সকল পাখী কোকিলের ডিম নিজ নিজ নীড়ে ফুটাইয়া তোলে, তাহাদের সহজ প্রখরবুদ্ধিও বিপর্য্যস্ত হইয়া যায়। কথাটা আর একটু পরিষ্কার করিয়া বলা আবশ্যক। কাক স্বভাবতঃ তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, সুচতুর; কিন্তু পরম কৌতুকের বিষয় এই যে, যখনই সে নীড়রচনা করিয়া তন্মধ্যে ডিম্বপ্রসব করে, তখন হইতেই সে এমন নির্ব্বোধ হইয়া যায় যে, সে আর কোন কিছুরই হিসাব রাখিতে সমর্থ হয় না; দুটা একটা ডিম বাড়িল কি না এবং সেই নবীন ডিম্বগুলার বর্ণ এবং পরিমাণ বিষয়ে তারতম্য আছে কি না এ সকল সে আদৌ লক্ষ্য করে না। এই যে অন্ধভাব, সব ডিমগুলাকেই যন্ত্রচালিতের মত তা’ দেওয়ার অভ্যাস, ইহা না থাকিলে পরভৃত টিকিয়া যাইত না। তবেই দাঁড়াইল এই যে, একদিকে মহাকবি-বর্ণিত “বিহগেষু পণ্ডিতৈষা জাতি”র “অশিক্ষিতপটুত্ব,” আর একদিকে তাহার প্রসূত ডিম্বের আশ্রয়দাতা বায়সাদির নির্বুদ্ধি ও যন্ত্রচালিতের ন্যায় ব্যবহার, এই উভয়ে মিলিয়া সমগ্র জাতিটার প্রাণরক্ষা করিয়া আসিতেছে। কি ছলে পুংস্কোকিল নীড়ের সমীপবর্ত্তী হইবামাত্র ক্রুদ্ধ বায়স কর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া পলায়নের ভান করিয়া বায়সকে নীড় হইতে বহু দূরে লইয়া যায়; সেই অবসরে সুচতুরা কোকিলা কি কৌশলে স্বীয় ডিম্বকে কাকডিম্বগুলার মাঝখানে সযত্নে প্রসব করিয়া অথবা প্রসূত ডিম্বকে রক্ষা করিয়া চলিয়া আসে; কোকিলের অনুসরণকারী পূর্ব্বোক্ত বায়স প্রত্যাবর্ত্তন কবিয়া অসন্দিগ্ধচিত্তে সব ডিমগুলিকে সমানভাবে তা’ দিতে থাকে, অণ্ড হইতে কোকিলশাবক নির্গত হইলে তাহার প্রতি কাকের কোনও আক্রোশের লক্ষণ দেখা যায় কি না;—এই সমস্ত জটিল রহস্যময় ব্যাপার আমরা অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। এখন পরভৃত ও পরপুষ্ট শব্দ দুইটির তাৎপর্য্য ও সার্থকতা সহজেই উপলব্ধি করা যাইবে। বায়সের তুলনায় কোকিলের বিচারবুদ্ধি অথবা instinct-এই দুইয়ের মধ্যে কোন্টা অপেক্ষাকৃত প্রবল, সেই Reason ও Instinctএর প্রসঙ্গ এস্থলে উত্থাপিত করিতে চাই না। তবে এই কোকিল যে বিহগদিগের মধ্যে “পণ্ডিত” তাহা তাহার কার্য্যপ্রণালী হইতে বুঝা যায়;—সে যেভাবে কাককে বোকা বানায়, এবং কাকের নিকট হইতে কাজ আদায় করে, শুধু সেইটুকু অনুধাবন করিলেই ইহার বুদ্ধিবৃত্তির প্রাখর্য্য অথবা ইহার “পাণ্ডিত্য” স্বীকার করিতে আমরা বাধ্য। বায়সরচিত নীড়ের মধ্যে নিজের ডিম্বটিকে রাখিয়া আসিবার জন্য কোকিলের চতুরি ও লুকোচুরি বিস্ময়জনক ’ত বটেই; কিন্তু এইখানেই তাহার কাজ শেষ হইল না। যদি সে মনে করে যে নীড়স্থ কাকডিম্বগুলি থাকিলে তাহার ডিম্ব ফুটিয়া শাবকোৎপাদনের বাধা ঘটিবার সম্ভাবনা আছে, তাহা হইলে সে নির্দ্দয়ভাবে আশ্রয়দাতা কাকের ডিম্বগুলি নীড়চ্যুত করিয়া নষ্ট করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না। কৌতুকের বিষয় এই যে, কাক আদৌ বুঝিতে পারে না যে তাহার নিজের ডিম সেখানে নাই; সে অভ্যাস মত কোকিলের ডিমের উপর বসিতে থাকে। হয়’ত, কাকের সব ডিমগুলি কোকিল নষ্ট করিতে সমর্থ হয় নাই; প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে কোকিলশাবক অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যেই ডিম্ব হইতে নির্গত হয়; কিছুদিন পরে যখন কাকের ছানা অণ্ড হইতে বাহির হইল, তখন অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ অতএব বলিষ্ঠতর কোকিলশাবক কাকের ছানাগুলিকে নীড় হইতে ভূতলে নিক্ষেপ করে। এই সকল নৈসর্গিক ব্যাপার হিংস্র ও নিষ্ঠুর বটে; কিন্তু এই হিংসাপ্রবৃত্তি ও নিষ্ঠুরতা কোকিল জাতীয় পাখীর জীবনরক্ষার যে সহায়তা করিয়া আসিতেছে ইহাই বিশেষ করিয়া ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। যদি প্রশ্ন উঠে যে কাকের ডিম নষ্ট করিবার কি দরকার ছিল; কোকিলশাবকের অশিক্ষিতপটুত্ব অথবা instinct কেন তাহাকে হিংস্র করিয়া তুলিল, তদুত্তরে আমরা বলিব যে—হয়’ত, কোকিলেতর ডিম্বগুলি থাকিলে যদিই অল্প সময়ের মধ্যে তন্মধ্য হইতে কাকশিশু নির্গত হয় (কারণ কাকের ডিমগুলা অনেক পূর্ব্বে প্রসূত হইয়া থাকিলে এতদিনে তন্মধ্য হইতে ছানা বাহির হইবার সম্ভাবনা) তাহা হইলে ধাড়িকাক আর কোনও ডিম্বের উপর না বসিতেও পারে, এবং তাহা হইলে কোকিলডিম্ব ফুটাইয়া তুলিবে কে? বায়সকোকিলের জীবন-নাট্যে এই প্রথম tragedy। পরে যখন কোকিলশাবক সদ্যঃপ্রসূত কাকের ছানাকে নীড়চ্যুত করিয়া কাকের বাসার ষোলআনা অংশ দখল করিয়া বসে, তখন যে করুণ tragedyর অঙ্ক অভিনীত হয় তাহাতেও তাহার আত্মরক্ষার চেষ্টাই উৎকটরূপে দেখা দেয় মাত্র।
এই পরভৃতকে শুধু কি বায়সের উপর নির্ভর করিতে দেখা যায়? আর কেহ কি ইহাকে পোষণ করে না? অবশ্যই বিভিন্ন জাতীয় কাকের বাসায় ইহার ডিম্ব পাওয়া যায়। কিন্তু “অন্যৈঃ খলু পোষয়ন্তি”—এই যে অন্য পক্ষিগণের দ্বারা কোকিলশাবক পালিত হয়, ইহার মধ্যে নানা রকম কাক ’ত আছেই—corvus splendens (House crow), corvus insolens (Burmese crow), corvus macrorhynchus (Jungle crow) ইত্যাদি—অন্য পাখীর বাসা হইতেও কোকিলের ডিম্ব পাওয়া গিয়া থাকে। কাপ্তেন হ্যারিংটন্ বলেন যে তিনি Magpie (Pica ructica) পাখীর বাসায় দুইবার কোকিলের ডিম পাইয়াছেন[৩০]।
এইখানে বলা আবশ্যক যে সংস্কৃত অভিধানগুলিতে দেখিতে পাওয়া যায় “পরভৃত” শব্দটি সর্ব্বত্রই কোকিলকে বুঝাইয়া থাকে; কিন্তু “পরভৃৎ” বলিতে বলিভুক্ বায়সকে বুঝায়। এখন দাঁড়াইল এই যে কাক কোকিলকে পোষণ করে বলিয়া সে “পরভৃৎ”, কোকিল বায়স কর্ত্তৃক পুষ্ট হয় বলিয়া সে “পরভৃত”। তাই বলিয়া কোকিল-শাবক কাকেতর বিহঙ্গ কর্ত্তৃক পুষ্ট হইবে না এমন কোনও কথা নাই; বরং অনেক স্থলে এইরূপ ঘটনা বিহঙ্গতত্ত্ববিদের নজরে আসিয়াছে, তাহার উল্লেখ পূর্ব্বেই করিয়াছি। “পরভৃৎ” এবং “পরভৃত” শব্দদ্বয়ের তাৎপর্য্য হইতে বুঝা যায় যে, যে পাখী অপর পাখীর শিশুকে পোষণ করে সে পরভৃৎ এবং যে পাখী অপরের দ্বারা পুষ্ট হয় সে পরভৃত। কাকের বাসায় কোকিলশিশু প্রায়ই পুষ্ট হয়, এই জন্য পরভৃৎ কাকের নামান্তর দাঁড়াইয়াছে এবং কোকিল পরভৃত সজ্ঞায় অভিহিত হইয়াছে। অনেক সময়ে এরূপ দেখা যায় যে পরভৃৎ শুধু কাক নয়, কাকেতর বিহঙ্গ (যথা Pica ructica) যাহার নীড়ে কোকিলের ডিম্ব রক্ষিত হয়, তদ্রূপ পরভৃত শুধু কোকিল নয়, কোকিলের জ্ঞাতি-সম্পর্কীয় পক্ষিকুল, যাহারা বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্গণের মতে কোকিলের সহিত এক বৃহৎ পরিবারভুক্ত। এই সমগ্র পরভৃতপরিবার বৈজ্ঞানিকের নিকট cuculinæ family বলিয়া পরিচিত। এই পরিবারকে মোটামুটি দুইটি বিশিষ্ট শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়,—Cuculinæ এবং phœnicophainæ। পরভৃতের সমস্ত লক্ষণগুলি cuculinæ শ্রেণীতে বিশেষভাবে প্রকট; পাপিয়া, বউ-কথা-কও প্রভৃতি বাঙ্গালার পরিচিত পাখীগুলি এই শ্রেণীভুক্ত। আমাদের কোকিল (বা Eudynamis honorata) কিন্তু Phœnicophainæ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কোকিল ব্যতীত এই শ্রেণীর আর কোনও পাখীতে পরভৃতলক্ষণ আদৌ দেখা যায় না, কারণ সকলেই ইহারা নিজ নিজ নীড় রচনা করিয়া তথায় অপর পক্ষীর ন্যায় ডিম্বপ্রসব ও শাবক প্রতিপালনাদি ক্রিয়া সম্পাদন করিয়া থাকে। Cuculinæ পাখীরা সর্ব্বতোভাবে পরনির্ভর, অন্যভৃত। শুধু যে কাকের বাসায় তাহাদের শাবক প্রসূত ও পালিত হয়, তাহা নহে; অন্য পক্ষীদিগের নীড়েও তাহাদের শাবক আজন্ম পরিপুষ্ট হইয়া থাকে। বাস্তবিক ইহারা বায়স ব্যতীত অন্য বিহঙ্গ কর্ত্তৃক সাধারণতঃ এমন ভাবে প্রতিপালিত হয় যে বিশেষভাবে এই শ্রেণীর পাখীগুলির কথা আলোচনা করিবার সময় “অন্যৈঃ খলু পোষয়ন্তি” উক্তির সার্থকতা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারা যায়। এই “অন্যৈঃ” এর মধ্যে যে অতি ক্ষুদ্র টুনটুনি পাখী (Orthotomus sutorius) থাকিবে ইহা কম বিস্ময়ের কথা নহে; কারণ টুনটুনি বড়জোর দৈর্ঘ্যে দেড় কিম্বা দুই ইঞ্চির অধিক হইবে না, তাহার ডিম্বও তদনুপাতে অতিশয় ক্ষুদ্র; আর cuculinæ শ্রেণীর পাখীর সাধারণতঃ এক ফুট দেড় ফুট দীর্ঘ হইয়া থাকে, এবং তাহাদের অণ্ড টুনটুনি পাখীর অণ্ড অপেক্ষা অনেক বড় এবং সাধারণতঃ বর্ণ, আকার ও পরিধি এত বিসদৃশ যে কেমন করিয়া ঐ ছোট পাখীটি নিজের ছোট ডিমগুলির মাঝে ঐ বৃহৎ ডিমগুলির উপর বসিয়া ফুটাইয়া তোলে, ইহা না দেখিলে পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্তি হওয়া অসম্ভব। ছাতারে পাখীর বাসায় পাপিয়ার জন্মকাহিনীও এইরূপ রহস্যময়। এই সব স্থলে স্বতঃই এই প্রশ্ন আমাদের মনে উঠে যে, এত ক্ষুদ্র নীড়ে সঞ্চিত অত্যন্ত ভঙ্গপ্রবণ উপকরণগুলির মধ্যে বৃহৎকায় আগন্তুক বিহঙ্গ বসিয়া ডিম পাড়িয়া যাইবে ইহা কি সম্ভবপর? তাই বিহঙ্গতত্ত্বজ্ঞেরা অনেক পর্য্যবেক্ষণের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, নিশ্চয়ই অন্যত্র প্রসূত ডিম্বটিকে cuculinæ তাহাদের বিশালায়ত চঞ্চুপুটে ধারণ করতঃ অতি সন্তর্পণে এই সকল নীড়ের মধ্যে রাখিবার জন্য সুকৌশলে নানা উপায় উদ্ভাবিত করে। এইরূপ অন্যান্য অনেক পাখী আছে যাহাদের সাহায্যে পরভৃতপরিবার বাঁচিয়া আসিতেছে।
যে কোকিলাকে নাটকের মধ্যে আমরা সহকার কুসুমের কাছে ভ্রমরীর সহিত দেখিতে পাই; কোথাও বা চূত-মুকুল দেখিয়া সে উন্মত্ত হইয়া থাকে, এই আভাস পাওয়া যায়। আবার কোথাও বা সেই বিজ্ঞ পাখীটিকে জম্বুফল খাইয়া উড়িয়া যাইতে দেখা গেল; তাহার খাদ্যাদি সম্বন্ধে একটু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মে যে, এই পরভৃত বিহঙ্গটি তাহার অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গের তুলনায় প্রায় সম্পূর্ণভাবে ফলভুক্। পাশ্চাত্য দর্শয়িতাও তাহাকে frugivorous, এমন কি “most frugivorous of all the cuculinæ” এই আখ্যায় বিশেষিত করিয়াছেন।
পরিশেষে একটি বিষয়ে সামান্য ইঙ্গিতমাত্র করিয়া আমাদের বক্তব্য শেষ করিব। মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে বিদূষক “বিড়ালে ধরিলে কোকিলার যে অবস্থা হয়” তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। পোষাপাখী না হইলে যে মুক্তপ্রকৃতির মধ্যে এইরূপ হওয়া সম্ভবপর নহে ইহা বলা বাহুল্যমাত্র। মহাকবি উপমার ছলে যে এই পাখীর গৃহপালিত অবস্থার প্রতি একটু কটাক্ষ করিয়াছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
- ↑ Sanskrit English Dictionary (1893)
- ↑ অমরকোষ।
- ↑ “অর্জ্জুনস্তু সিতঃ কৃষ্ণলেশবান্ কুমুদচ্ছবিঃ”—রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর সম্পাদিত অমরকোষ-টীকা ৩০ পৃঃ দ্রষ্টব্য।
- ↑ শুক্লশুভ্রশুচিশ্বেতবিশদশ্যেত পাণ্ডরাঃ
অবদাতঃ সিতো গৌরোঽবলক্ষো ধবলোঽর্জুনঃ।—ইত্যমরঃ - ↑ The Birds of India by T. C. Jerdon, Vol. III.
- ↑ Fauna of British India, Birds, Vol. IV.
- ↑ Frank Finn in World’s Birds, p. 36.
- ↑ Dr. Brehm’s text, translated by Thomas Rymer Jones (Cassell’s Book of Birds), Vol. IV, p. 117.
- ↑ Fauna of British India, Birds, Vol. IV.
- ↑ Small game shooting in Bengal by “Raoul”, p. 93.
- ↑ হিউম ও মার্শ্যাল রচিত Game Birds of India, Burmah and Ceylon, Vol. III. p. 129
- ↑ প্রবাসী, শ্রাবণ-ভাদ্র ১৩২৬।
- ↑ The World’s Birds, p. 89.
- ↑ Ibid, p. 90.
- ↑ অধ্যাপক কোলব্রুক সম্পাদিত অমরকোষ।
- ↑ “Head and neck more or loss bare or only clothed with short stubby down; never any true feathers on crown of head—the above appears the only really distinctive character by which vultures are distinguished from Falcons, Eagles, and Hawks.”—Blanford, Fauna of British India, Birds, Vol. III.
- ↑ ১৭.০ ১৭.১ ১৭.২ Fauna of Br. India, Birds, Vol. III.
- ↑ কেহ কেহ বলিতে পারেন যে কোনও কোনও গ্রামে বৃক্ষাগ্রে গৃধ্ররচিত নীড় যখন দেখা যায়, তখন নিবাসবৃক্ষ কেবলমাত্র roosting place ধরিয়া লইব কেন? গাছের উপর যে শকুনির বাসা হয় না এমন নহে। মহাকবির নাটকের মধ্যে যখন সহসা গৃধ্রের নিবাসবৃক্ষের কথা আসিয়া পড়িল, তখন উক্ত বৃক্ষকে গৃধ্রের নীড়াধার সিদ্ধান্ত করিবার পূর্ব্বে বৈজ্ঞানিক পক্ষিতত্ত্ব-জিজ্ঞাসার দিক হইতে এই প্রশ্ন প্রথমেই আসিয়া পড়ে যে, যে ঋতুকে background করিয়া নাটকবর্ণিত কোনও বিশিষ্ট ব্যাপার সঙ্ঘটিত হইতেছে সে ঋতুতে Vulturidæ শ্রেণীর কোনও পাখীর বৃক্ষাগ্রে nidification বা নীড়রচনা সম্ভষপর কি না? দেখা যাইতেছে যে গৃধ্রনিবাসবৃক্ষপ্রসঙ্গের অব্যবহিত পূর্ব্বেই বর্ষা ঋতুর প্রাদুর্ভাব,—বিকৃতমস্তিষ্ক রাজা পুরুরবা মাথার উপরে ঘনঘটা দেখিয়া মনে করিতেছেন যে বিশ্বপ্রকৃতি তাঁহার মাথার উপরে রাজছত্র ধরিয়াছেন,—
বিদ্যুল্লেখা কনকরুচিরং শ্রীবিতানং মমাভ্রং
ব্যাধূয়ন্তে নিচুলতরুভির্মঞ্জরীচামরাণি।
ঘর্ম্মচ্ছেদাৎ পটুতরগিরো বন্দিনো নীলকণ্ঠা
ধারাসারোপনয়নপরা নৈগমাশ্চাম্বুবাহাঃ॥এখন ইহারই কিছু পরে যদি গৃধ্রের নিবাসবৃক্ষের অন্বেষণে বাহির হইতে হয়, তাহা হইলে গৃধ্রের roosting place ব্যতীত আমরা আর কিছু দেখিতে পাইব কি? Vulturidæ শ্রেণীর প্রায় সকল পাখী শীতকালে অর্থাৎ পৌষ মাসের মধ্যে আরম্ভ করিয়া, লাগাইৎ চৈত্রের শেষ অথবা কোন কোন স্থলে বৈশাখের প্রারম্ভের মধ্যে স্বরচিত নীড়ে ডিম্বপ্রসব, শাবকোৎপাদন ইত্যাদি গৃহস্থলীর যাবতীয় কর্ম্ম শেষ করিয়া থাকে। তাহার পর বর্ষাকালে কোনও বৃক্ষ শকুনির nesting place হইতে পারে না, কিন্তু roosting place হইতে পারে। এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থা হিসাব করিয়া আমি নিবাসবৃক্ষ অর্থে roosting place সমীচীন বিবেচনা করি। কেহ যেন মনে না করেন যে কাউয়েল (E. B. Cowell) সাহেবের অনুবাদে roosting place আছে বলিয়া আমি তাহা নির্ব্বিচারে গ্রহণ করিয়াছি।
অতএব দেখা যাইতেছে যে ঋতুবিশেষে গৃধ্রের নিবাসবৃক্ষ বা nesting place থাকিলেও, কবিবর্ণিত ব্যাপারের সময় নিশ্চয়ই গ্রামপ্রান্তে কোনও বৃক্ষ হয়’ত দলবদ্ধ শকুনির roosting place ছিল। তাহাই কবিবর্ণিত নিবাসবৃক্ষ। এই নিবাসবৃক্ষের নিকটে যে ভাগাড় থাকা চাই, নহিলে ইহার উপর শকুনির নিত্য আসিয়া বসা সম্ভবপর নয়, এরূপ অনুমান করা নিষ্প্রয়োজন। এই যোজনদৃষ্টি বিহঙ্গ যেখানেই মৃত পশু দেখিতে পায়, প্রান্তরেই হউক, অথবা নদীবক্ষেই হউক, মানবাবাসের সন্নিকটে অথবা দূরে হইলেও কিছু আসিয়া যায় না, সেখানেই সে ভোজন ব্যাপার সম্পন্ন করিয়া জলাশয়ে অবগাহন পূর্ব্বক বালুতটে পক্ষ বিস্তার করিয়া কিছুক্ষণ রৌদ্রে বিশ্রামের পর তাহার অভ্যন্ত নিবাসবৃক্ষের উপর নিশ্চিন্তভাবে উপবেশন করিয়া খাদ্য পরিপাক করে ও নিদ্রা যায়। এ সময়ে সে মোটেই পক্ষ বিস্তার করিয়া থাকে না; তাহার শিরোদেশ সঙ্কুচিত ও পুচ্ছ শিখিল ভাবে নত হইয়া পড়ে, মোটের উপর সে তাহার সমস্ত দেহ কোঁকড়াইয়া গুটিয়া সুটিয়া সুদীর্ঘকাল (প্রায় ১৭|১৮ ঘণ্টা) নিদ্রায় অতিবাহিত করে। জনৈক বিদেশী পক্ষিতত্ত্বজ্ঞ ভারতবর্ষের শকুনিপ্রসঙ্গে লিখিয়াছেন—
“The toils of the day completed, they go in search of water, and, after preening themselves, lie down to roll in the sand and bask in the sunshine; this performance over, they retire to their sleeping place in a tree, where they perch bolt upright, with head drawn in, and tail hanging loosely down, until a late hour in the following morning. So large an amount of rest do these Vultures require, that they do not commence the duties of the day until about ten o’clock, and seldom seek for food after about four or five in the afternoon.”
যে বৃক্ষকে আশ্রয় করিয়া গৃধ্র প্রায় দিনরাত roost করে, তাহাকে নিবাসবৃক্ষ বলিলে roosting place বুঝিতে হইবে বৈকি।
- ↑ Macdonell and Keith’s Vedic Index I, p. 229; II, 401.
- ↑ ব্লানফোর্ড।
- ↑ It (the white-bellied sea-eagle) not unfrequently robs the osprey of its prey.—Fauna of British India, Birds, Vol. III, p. 369
- ↑ Rev. C. A. John’s British Birds in their Haunts, edited by J. A. Owen, p. 155.
- ↑ Butler’s British Birds with their nests and eggs, Vol. 3, p. 158.
- ↑ Quoted in Rev. C. A. John’s British Birds in their Haunts, p. 155.
- ↑ Bird Behaviour, by Frank Finn, p. 10.
- ↑ Macdonell and Keith’s Vedic Index, Vol. II, p. 317.
- ↑ Jerdon’s Birds of India, Vol. I, p. 343.
- ↑ ব্লানফোর্ড (Fauna of Br. India, Birds, Vol. III.)
- ↑ “The Oology of Indian Parasitic cuckoos” নামক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য—Bombay Natural History Society Journal, Vol. XVII, p. 695.
- ↑ Jour. Bom. Nat. Hist. Soc., Vol. XVII, p. 695.