বত্রিশ সিংহাসন/২৯
বৈদেহী ঊনত্রিংশ পুত্তলিকা
কহিল, হে ভোজরাজ তুমি কেন ভ্রান্ত হইয়াছ, তোমাকে সখীগণ এত বুঝাইল তথাপি তোমার জ্ঞানোদয় হইল না। তুমি অগ্রে আমার বাক্য শ্রবণ কর, পশ্চাৎ সিংহাসনারোহণ করিও। রাজা বলিলেন, শুনিতেছি বল। পুত্তলিকা কহিতে লাগিল।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য নিদ্রাবস্থায় স্বপ্ন দেখিলেন, চতুর্দিকে প্রফুল্ল কুসুমোদ্যানবেষ্টিত, নানাবিধ সুস্বাদু সুগন্ধীয় সুখাদ্য দ্রব্যে পরিপূর্ণ, নানা রত্নে খচিত এক অপূর্ব্ব মনোহর স্বর্ণ অট্টালিকাতে, কতিপয় অতি রূপবতী যুবতী রমণী রমণীয় বেশ ভূষায় ভূষিত হইয়া সুকোমল সুমধুর স্বরে গান করিতেছে। এক ভাগ্যবান, তপস্বী বসিয়া তাহা শ্রবণ করিতেছেন। রাজা এই স্বপ্ন দর্শন করিয়া মনে মনে কহিলেন এই অট্টালিকাবাসী তপস্বী সাতিশয় সুখী, বোধ হইতেছে। ইহা চিন্তা করিতে করিতে রাজার নিদ্রাভঙ্গ হইল।
প্রত্যুষ সময়ে, রাজা মান পূজা করিয়া বেতালকে আহ্বান পূর্বক আজ্ঞা করিলেন, আমি স্বপ্নে যে অট্টালিকা দেখিয়াছি তথায় গমন করিব। এই আজ্ঞায় বেতাল তাহাকে স্কন্ধে করিয়া সেই অট্টালিকাতে লইয়া উপস্থিত করিল। রাজা তাহাকে তথা হইতে বিদায় দিয়া অট্টালিকার উদ্যানে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশমাত্রেই অট্টালিকার সৌন্দর্য্য সন্দর্শনে মুগ্ধ হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন এই অট্টালিকা কে নির্মাণ করিল, মনুষ্যের সাধ্য নাই এমত অপূর্ব্ব প্রাসাদ নির্মাণ করে, ব্রহ্মা আপনিই প্রস্তুত করিয়া থাকিবেন।
অনন্তর রাজা অট্টালিকার মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক সঙ্গীতকারিণী কামিনীগণ সমক্ষে উপস্থিত হইলেন। তাহারা মনুষ্যান্তর দর্শনে ভয়-চকিত হইয়া গানে ক্ষান্ত হইল। তাহাতে তপস্বী রাজাকে সম্বোধন পূর্বক ক্রোধাভাসে বলিলেন তুমি কিজন্য এখানে আসিয়াছ। এই সকল নারী সুখে সঙ্গীতাদি করিতেছিল, তুমি আসিয়া কেন ভঙ্গ করিলে। আমি তোমাকে এখনি অভিসম্পাত করিয়া ভস্ম করিব। রাজা কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন আমি অনভিজ্ঞ, না জানিয়া এখানে আসিয়াছি। আপনাকে দর্শন করিব এই আমার অভিলাষ, আপনি ক্রোধ করিয়া অভিসম্পাত করিলে, আমার সাধ্য কি তাহা সহকরি। আমি আপনার আজ্ঞাকারী, অতএব আমার অপরাধ মার্জনা করুন।
তপস্বী এই কথা শুনিয়া বলিলেন বিক্রমাদিত্য, তুমি যথার্থ কহিয়াছি, আমার বড় ক্রোধ হইয়াছিল। তুমি আপন অপরাধ স্বীকার না করিলে, আমি তোমাকে অভিসম্পাত করিতাম। এখন আমি তোমার বাক্যে তুষ্ট হইলাম, তোমার কি প্রার্থনা বল। রাজা বলিলেন প্রভো আমি কি প্রার্থনা করিব, আপনার অনুগ্রহে আমার সকলি আছে, অন্ন অর্থ অশ্ব রথ কিছুর অভাব নাই। কিন্তু এক দ্রব্য যাচাএর জন্য আমি এখানে আসিয়াছি, যদি কৃপা করিয়া দেন তবে তাহা প্রকাশ করিতে পারি। যোগী বলিলেন তোমার যে বস্তুর প্রার্থনা থাকে বল, আমি অবশ্য দিব। রাজা বলিলেন যদি আমার প্রতি এতাদৃশী দয়া প্রকাশ করিলেন তবে আমাকে এই অট্টালিকা প্রদান করিতে আজ্ঞা হউক। তপস্বী বচনবদ্ধ হইয়াছিলেন, সুতরাং অনিচ্ছক হইয়াও অন্যথা করিতে না পারিয়া, তৎক্ষণাৎ তাহাকে অট্টালিকা দিলেন। আপনি উদাসীন হইয়া নানা তীর্থে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।
রাজা অট্টালিকা পাইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে সিংহাসনে উপবেশন করিলেন। কামিনীগণ, তপস্বীর অগ্রে যে প্রকার গান বাদ্য করিতেছিল সেই প্রকার করিতে লাগিল। রাজা তথায় বাস করিয়া নানা প্রকার সুখ সম্ভোগ করিতে লাগিলেন।
যোগী রাজাকে অট্টালিকা দান করিয়া মনে মনে অতিশয় দুঃখিত হইলেন। এবং, তীর্থ পর্যটন করিতে করিতে যাহার সহিত সাক্ষাৎ হইত তাহাকেই আপনার দুঃখের কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেন। একদা এক তীর্থে উপস্থিত হইয়া এক তপস্বীকে আপনার দুঃখের বৃত্তান্ত কহাতে, তপস্বী বলিলেন যদি তোমার ঐ অট্টালিকা পুনগ্রহণের বাসনা থাকে তবে ছদ্মবেশে রাজার স্থানে গিয়া তাহা যাচ ঞা কর, রাজা অতিশয় দাতা, অনায়াসে তোমাকে তাহা দিবেন।
এই পরামর্শে, যোগী এক বৃদ্ধ বিপ্রের বেশ ধারণ পূর্ব্বক ঐ অট্টালিকার দ্বারে উপস্থিত হইয়া করতালি দিতে লাগিলেন। রাজা করতালির শব্দে দ্বারদেশে আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কি অভিপ্রায়ে এখানে আসিয়াছ, তোমার যাহা অভিলাষ থাকে প্রকাশ করিয়া বল আমি তাহা পূর্ণ করিব। বিপ্র বলিলেন মহারাজ আমি তাবৎ ধরণী ভ্রমণ করিলাম, কিন্তু যোগ সাধনের উপযুক্ত আশ্রম কোথাও পাইলাম না। রাজা বলিলেন যদি এই অট্টালিকা তোমার মনোনীত হয় তবে লও। এই কথায় ব্রাহ্মণ তাঁহাকে ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন। রাজা তাঁহাকে ঐ অট্টালিকা প্রদান করিয়া আপন গৃহে প্রত্যাগত হইলেন।
পুত্তলিকা কহিল, শুন ভোজরাজ, তুমি বিবেচনা না করিয়া রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য হইতে ইচ্ছা কর, কিন্তু তণ্ডুল্য গুণ না থাকিলে কিপ্রকারে তাহার সিংহাসনে বসিবে। এইরূপ কথোপকথনে সে দিবসও অতীত হইল। রাজা দুঃখিতান্তঃকরণে অন্তঃপুর প্রবেশ পূর্ব্বক, কোন প্রকারে রজনী বঞ্চন করিলেন। পরদিবস মান পূজার পর পুনর্ব্বার সভায় আসিয়া সিংহাসনারোহণার্থ অগ্রসর হইলে,