বত্রিশ সিংহাসন/৩০
রূপবতী ত্রিংশ পুত্তলিকা
কহিল, হে রাজন, তুমি কি ক্ষিপ্ত হইয়াছ, তোমার এমত পুরুষত্ব কি আছে যে তুমি এই সিংহাসনে বসিতে আসিয়াছ। আমি তোমাকে রাজা বিক্রমাদিত্যের এক দিবসের বৃত্তান্ত কহি, শ্রবণ কর।
এক সময়, রাজা বিক্রমাদিত্য রজনীযোগে শয়ন করিয়াছিলেন, হঠাৎ তাহার অন্তঃকরণে কি উদয় হইল, তখনি তিনি গাত্রোত্থান করিয়া কটিবন্ধন ও অসি চর্ম্ম গ্রহণ পূর্বক নিশীথ সময়ে নগর ভ্রমণার্থ নির্গত হইলেন। কতক দূর গিয়া দেখিলেন, এক স্থানে চারি জন তস্কর দণ্ডায়মান হইয়া, কোন স্থানে কিপ্রকারে চুরি করিবেক তাহার পরামর্শ করিতেছে। একজন বলিতেছে ভাই অদ্য এমত শুভক্ষণ ও সুবিধা বুঝিয়া চল যাহাতে অবশ্যই ধনলাভ হয়। সুবিধা না বুঝিয়া যাওয়া হইবেনা, তাহা হইলে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিতে হইবে। রাজা এই কথা শুনিলেন। পরে তস্করগণ, রাজাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল তুমি কে। রাজা কহিলেন তোমরা যে ব্যবসায়ী আমিও তাহাই। এই কথায় তস্করগণ রাজাকে সমভিব্যাহারে লইয়া চৌর্য্য কার্য্যে চলিল। কতক দুর গিয়া একজন চোর আর জনকে জিজ্ঞাসিল ভাই, তোমার কি গুণ আছে বল। তাহাতে সে কহিল আমি এমত শুভক্ষণ বলিয়া দিতে পারি, সেইক্ষণে যাত্রা করিলে কখন রিক্তহস্তে ফিরিতে হয় না। আর এক জন কহিল আমি সকল জন্তুর বাক্য বুঝিতে পারি। তৃতীয় জন কহিল আমি কোন স্থানে গমন করিলে, আমাকে কেহ দেখিতে পায়না, আমি সকলকে দেখিতে পাই। চতুর্থ ব্যক্তি কহিল আমার স্থানে এমত এক দ্রব্য আছে তাহাতে আমাকে কেহ নষ্ট করিতে আসিলে নষ্ট করিতে পারেনা। চারিজন চোর এই প্রকার বলিয়া, রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল তোমার কি বিদ্যা আছে বল। রাজা বলিলেন যেস্থানে ধনীর ধন প্রোথিত আছে আমি তাহা বলিয়া দিতে পারি। তাহারা বলিল তবে যেখানে ধন আছে সেইখানে আমাদিগকে লইয়া চল, আমরা তোমার সঙ্গে যাইতেছি।
এই কথায় রাজা অগ্রে অর্থে চলিলেন, তস্করগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। পরে রাজা তাহাদিগকে আপন আলয়ের পশ্চাদ্বর্ত্তী উদ্যানে আনিয়া, যেস্থানে আপনার ধন প্রোথিত ছিল, তাহা দেখাইয়া দিলেন। তস্করেরা সেই স্থান খনন করিল, এবং মৃত্তিকার মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন পুরীতে প্রবেশ পূর্ব্বক দেখিল নানাবিধ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাতে গৃহ পরিপূর্ণ। তস্করগণ ঐ সমস্ত রত্ন মোট বান্ধিয়া মস্তকে করিয়া লইয়া চলিল। ইহাতে একটা শৃগাল চীৎকার করিয়া উঠিল। তাহা শুনিয়া, যে চোর চতুষ্পদের ভাষা বুঝিত সে বলিল ভাই, শৃগালটা বলিতেছে এ ধন লইয়া কুশল নাই, অতএব ইহা লওয়া হইবেকনা। আর এক ব্যক্তি বলিল শৃগাল যাহা বলে বলুক, হস্তগত ধন কখন ত্যাগ করা হইবেক না, ত্যাগ করিলে আমাদের ধর্মের উপর দোষ আসিবে। আর এক ব্যক্তি কহিল ধন অনেক পাইলাম বটে, কিন্তু বস্ত্র পাইলাম না, অতএব চল অন্য কোন স্থানে যাইয়া বস্ত্র আনি। তাহার পরে চোর্য্য ব্যবসায় একবারে ত্যাগ করিব। চতুর্থ ব্যক্তি কহিল একথা ভাল বলিয়াছ, এইখানে রাজার রজক বাস করে, চল, তাহার ঘরে গিয়া সিঁধ দিই, তাহা হইলে নানাপ্রকার রাজভোগ্য উত্তম উত্তম বস্ত্র পাইব।
তস্করগণ এই পরামর্শ করিয়া, অর্থের মোট সকল জকের গৃহের পশ্চাদ্ভাগে রাখিয়া, তাহার ঘরে সন্ধি খনন করিতে লাগিল। রজকের একটা গর্দভ ছিল, বাহিরে বাঁধা থাকিত। ঐ গর্দভ চোরদিগকে দেখিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। তাহাতে রজকের নিদ্রাভঙ্গ হওয়াতে, সে অতিশয় বিরক্ত হইয়া বাহিরে আসিয়া গদ ভকে প্রহার করিতে লাগিল। আর বলিল আমি সমস্ত দিবস শ্রম করিয়া রাত্রে ক্ষণকাল স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইব, ইহাতেও এই হতভাগা গর্দভটা আমায় নিদ্রা যাইতে দেয় না। তদনন্তর দ্বার বন্ধ করিয়া পুনর্ব্বার নিদ্রা গেল। গদত কতক ক্ষণ পরে পুনর্বার চীৎকার করিতে লাগিল, তাহাতে রজক পুনর্ব্বার বাহিরে আসিয়া তাহাকে সেই প্রকার প্রহার করিল। এই প্রকার পাচ ছয় বার উঠিয়া উঠিয়া প্রহার করিল। অবশেষে আর না পারিয়া, তাহার রঞ্জু চ্ছেদনপূর্বক তাহাকে বাটীর বাহির করিয়া দিয়া, স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইতে লাগিল। চোরেরাও স্বচ্ছন্দে চুরি করিতে লাগিল।
রাজা মনে মনে কহিলেন ইহাদিগের প্রাক্তনে যে ধন ছিল তাহা আমারি ভাণ্ডার হইতে লইয়া আসিআছে, এইক্ষণে আমি পরধনহরণের সময়ে ইহাদের সঙ্গে থাকিয়া কেন কুকর্মের ও অধর্মের ভাগী হই। ইহা ভাবিয়া রাজা আপন গৃহে আসিলেন। দস্যগণ রজকের গৃহ হইতে বস্ত্রাদি লইয়া প্রস্থান করিল।
রজনী প্রভাত হইলে জনরব হইল রাজভাণ্ডারে চুরী হইয়াছে। নগরপাল চোরের অনুসন্ধানর্থ স্থানে স্থানে চর পাঠাইল, এবং নগরের পথ ঘাট সকল রুদ্ধ করিল। চরগণ অনেক অনুসন্ধানের পর, চারিজন চোরকে বন্ধন করিয়া আনিল। নগরপাল তাহাদিগকে রাজার সম্মুখে উপস্থিত করিলে, তাহারা রাজাকে দেখিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিল এই আকৃতির এক মনুষ্য কল্য আমাদের সঙ্গে চুরি করিতে আসিয়াছিল, কিন্তু যখন আমরা রজকের গৃহে চুরী করি তখন সে আমাদিগকে না বলিয়াই প্রস্থান করিয়াছিল, আপন অংশের ধনও লইয়া যায় নাই।
দস্যুগণ এই চিন্তা করিতেছে এমত সময়ে, রাজা ঈষদ্ধাস্থ্য পূর্ব্বক তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন তোমর। আমার মুখাবলোকন করিয়া মনে মনে কি চিন্তা করিতেছ। যদি মঙ্গল চাহ তবে, যে ধন লইয়া গিয়াছ তাহ শীঘ্র আনিয়া দাও। চোরগণ বলিল মহারাজ আমাদের এক বিষয়ে বড় আশ্চর্য্য বোধ হইয়াছে। কল) রাত্রে আমাদের সঙ্গে আর একজন চোর আসিয়াআমরা যখন চুরি করি তখন সে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছিল, কিন্তু অংশ লইবার সময় কোথায় গেল জানিতে পারিলাম না। রাজা বলিলেন সে চোর কোথায়। একজন বলিল মহারাজ, আপনি আমার প্রাণ দণ্ডই করুন, বা, মার্জনাই করুন, আমি যথার্থ কহিব, মহারাজ আপনি রজনীতে আমাদের সঙ্গে চুরী করিতে গিয়াছিলেন। কেননা আমরা অনেককে লইয়া চুরী করিয়াছি, কাহাকেও এ প্রকার দেখি নাই যে, আপনার অংশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। অতএব চোর্য্য কার্য্যে আপনিই আমাদের সঙ্গী ছিলেন।
রাজা ঈষদ্ধাস্য পূর্বক চোরকে বলিলেন আমি তোমাদের প্রাণদান করিলাম, তোমরা প্রাণনাশের আশঙ্কা করিওনা। কিন্তু আমি এক কথা বলি, তোমাদিগকে তাহা অবশ্যই করিতে হইবেক। তোমরা এখনপর্যন্ত আর চৌর্য্য কার্য্য করিও না, তাহা হইতে একবারে ক্ষান্ত হও। বরঞ্চ তোমাদের যদি আরো অধিক অর্থের প্রয়োজন থাকে, আমার ভাণ্ডার হইতে লইয়া যাও। দস্যগণ এই কথায় সম্মত হইল, এবং আর যে ধন চাহিল রাজা তাহাদিগকে দিলেন। তাহারা ঐ ধন লইয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া স্ব স্ব গৃহে গমন করিল।
পুত্তলিকা বলিল, শুন ভোজরাজ, তুমি রাজা বিক্রমাদিত্যের ন্যায় দাতা কখন হইতে পারিবে না। অতএব সিংহাসনে বসিবার আশা ত্যাগ করিয়া, আপনার রাজকার্য্য পর্যালোচনা কর। রাজা এই কথায় মৌন হইয়া উঠিয়া গেলেন, সিংহাসনে বসিতে পারিলেন। রাত্রি অতিশয় চিন্তায় গেল। রজনী প্রভাত হইবা, মাত্র রাজা পুনর্বার সিংহাসনের নিকটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। মনে মনে কহিতে লাগিলেন হায়, আমার সকল আশা বিফল হইল, আমি এই সিংহাসনে বসিতে পারলাম না, ইহা শুনিলে সকলে আমাকে উপহাস করিবে। আমি আপন নির্মল কুলে কলঙ্ক পঙ্ক প্রলেপ দিলাম। ভোজরাজ মনে মনে এই সকল চিন্তা করিয়া অধোবদনে সিংহাসনের সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকিলেন। পুনর্ব্বার মনে মনে কহিতে লাগিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য যেপ্রকার মাতৃগন্ত হইতে উদ্ভব হইয়াছিলেন আমিও সেই প্রকার হইয়াছি, অতএব আমি কেন আপন অভিলাষ সিদ্ধ না করিব। ইহা ভাবিতে ভাবিতে কখন কখন তাহার অন্তঃকরণে লজ্জা বোধ, ও কখন কখন ক্রোধোদয় হইতে লাগিল। তাহাতে অধৈর্য্য হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন অবশ্যই সিংহাসনে উপবেশন করিব। এই প্রতিজ্ঞা করিয়া সিংহাসনে উঠিতে উদ্যত হইলে,