কৌশল্যা একত্রিংশ পুত্তলিকা

কহিল, হে ভোজরাজ তুমি অতি মূখ, তুমি জ্ঞানের কথা শুননা, এবং সাহস যে পদার্থ, তাহাকে অতিসামান্য জ্ঞান কর হে রাজন, পিত্তল কখন কাঞ্চনের ন্যায় গণ্য হইতে পারেন, শীসা কখন হীরকের তুল্য হয় না, এবং নিস্ব কখন চন্দনের গুন প্রাপ্ত হয় না। অতএব তুমি কি সাহসে রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য হইতে চাই। তোমার ইহাতে লজ্জা হয় না। পুত্তলিকার এই বাক্যে রাজা অতিশয় লড়িত হইয়া মনে মনে আপনাকে ধিক্কার দিতে লাগিলেন। তৎপরে পুত্তলিকা কহিলা হে ভোঙ্গরাজ আমি তোেমাকে রাজা বিক্রমাদিত্যের এক দিবসের বৃত্তান্ত কহিতেছি শ্রবণ কর।

 রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুকাল নিকটবর্তী হইলে, তিনি তাহা জানিতে পারিয়া, বাই নগরে জাহুবীতটে এক অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া, তথায় বাস করিতে লাগিলেন। তাবৎ রাজধানীতে ঘোষণা করিয়াদিলেন যাহার যাহা যাচ ঞা করিতে ইচ্ছা হয়, তাহারা তাহার নিকটে যাইয়া প্রকাশ করুক। এই সংবাদ পাইয়া যাবতীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও ভাট ভিক্ষুক তাহার নিকটে উপস্থিত হইল। তাহারা যে যাহা প্রার্থনা করিল রাজা তাহাদিগকে দিতে লাগিলেন।

 দেবতাগণ রাজার এইরূপ দানের বৃত্তান্ত শুনিয়া তাঁহার দানশীলতার পরীক্ষাজন্য নানা বেশ ধারণ পূর্ব্বক তাহার নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং যাহার তাহ যাচ ঞা করিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য তাহাদের ইচ্ছানুযায়ী, যিনি যাহা চাহিলেন তাহাই দিলেন। দেবগণ তুষ্ট হইয়া রাজাকে আশীর্বাদপূর্ব্বক বলিলেন বিক্রমাদিত্য, তুমি ধন্য, তোমার মাতা পিতাও ধন্য। তুমি যে কীর্তি করিলে তাহাতে স্বর্গ মর্ত্য পাতালে তোমর নাম চিরকাল স্মরণীয় হইল। রাজা হরিশ্চন্দ্র সত্যযুগে অতি সত্যবাদী ছিলেন, ত্রেতাযুগে বলিরাজা অনেক দান করিয়া ছেন, দ্বাপরে রাজা যুধিষ্ঠির অতিধর্ম্মশীল ছিলেন। কিন্তু কলিযুগে তুমি যেরূপ ধর্ম্ম কর্ম প্রচার ও বীরত্ব প্রকাশ করিলে,এই চারি যুগের মধ্যে কোন রাজা কখন এরূপ করিতে পারেন নাই। রাজা বিক্রমাদিত্যের এই প্রকার গুণানুবাদ ও স্তুতিবাদ করিয়া দেবগণ বিদায় হইলেন।

 দেবতাগণের গমনের পর, রাজা বিক্রমাদিত্য বহিঃস্থিত পদার্থ সমুদয় দর্শনার্থ অট্টালিকার এক গরাক্ষে উপবেশন করিলেন। সময়ে যদৃচ্ছাক্রমে এক সুবর্ণমৃগ আসিয়া তাহার দৃষ্টি পথের অতিথি হইল। রাজা তাহাকে সংহার করিবার মানসে ধনুর্বাণ গ্রহণ করিলেন। ঐ মৃগ, রাজাকে ধনুর্বাণধারী দেখিয়া বলিতে লাগিল হে ভূপতে আমি প্রকৃত মৃগ নহি, আমি পূর্ব্বজন্মে ব্রাহ্মণ ছিলাম। এক দিবস ক্ষুধাতুর হইয়া অসময়ে এক ঋষির আশ্রমে উপস্থিতি পূর্ব্বক অন্ন যাচ ঞা করিয়াছিলাম, তাহাতে তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া এই বলিয়া আমাকে অভিসম্পাত করিলেন তুই আগামি জন্মে হরিণ হইবি। আমি এই অভিসম্পাতগ্রস্ত হইয়া সাতিশয় দুঃখিত হইলাম, এবং বিনয় বাক্যে তাহাকে কহিলাম প্রভো আপনি আমাকে মৃগ করিলেন, কিন্তু কত দিনে কিপ্রকারে এই পশুজন্ম হইতে আমার মুক্তি হইবে, অনুগ্রহ করিয়া আজ্ঞা করুন। তিনি কহিলেন অতিদাতা রাজা বিক্রমাদিত্য কলিযুগে জন্ম গ্রহণ করিবেন, তাঁহাকে দর্শন করিলে তোমার মুক্তি হইবে। এই কথা বলিতে বলিতে হরিণ তৎক্ষণাৎ মৃগদেই পরিত্যাগ ও দ্বিজদেহ ধারণ পূর্বক রাজাকে যথোচিত সম্বন্ধ না করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল। রাজা তাহার শব জাহ্নবীনীরে নিক্ষেপ করিয়া, তাহার পুণ্যার্থে দীন দরিদ্র অনাথদিগকে অনেক অর্থ বিতরণ করিলেন।

 পুত্তলিকা কহিল হে ভোজরাজ তুমি রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য কোন প্রকারে হইতে পারিবে না। ততুল্য ব্যক্তি ব্যতিরিক্ত অন্য কাহারও এই সিংহাসনের অধিকার নাই। অতএব তুমি তাহার এই সিংহাসনে বসিবার বাসনা একবারে পরিত্যাগ কর। এবং, যেস্থান হইতে এই সিংহাসন আনয়ন করিয়াছ সেই স্থানেই পুনর্ব্বার স্থাপন করাও।

 এই কথায় ভোজরাজ সিংহাসনোপবেশনে নিতান্ত নিরাশ হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। এবং, সমস্ত দিবারাত্র অতিমাত্র চিন্তায় মগ্ন থাকিলেন। পর দিবস প্রত্যুষে সন্ন্যাসীর বেশে সিংহাসন সমীপে আসিলে,