কামকন্দলা ষষ্ঠ পুত্তলিকা

হাসিতে হাসিতে বলিল, হে ভােজরাজ, রাজা বিক্রমাদিত্য যে সিংহাসনে বসিতেন, তুমি তাহাতে কি সাহসে বসিতে বাসনা কর, তুমি কি আপনার দুর্বুদ্ধি বিবেচনা করিয়া দেখনা, তােমার দুর্বুদ্ধি দর্শনে আমার অন্তঃকরণে দুঃখােদয় হইতেছে। যিনি বিক্রমাদিত্যের তুল্য সৰ্বগুণ সম্পন্ন, তিনিই এই সিংহাসনােপবেশনের উপযুক্ত পাত্র। রাজা বলিলেন বিক্রমাদিত্য এমত কি গুণের কর্ম্ম করিয়া ছিলেন। কামকলা কহিল তাহ কহিতেছি, শ্রবণ কর।

 এক দিবস রাজা সভাতে বসিয়া আছেন এমত সময়ে এক ব্রাহ্মণ আসিয়া বলিলেন মহারাজ উত্তর। দিকে অতিদুরে এক অরণ্য আছে, তাহার পরে এক পবব্ত আছে, এবং তাহার পরে এক সরােবরে একস্ফটিকের স্তম্ভ আছে। ঐ স্তম্ভ সুর্য্যোদয় কালে সরােবর হইতে উচ্চ হইতে আরম্ভ হয় এবং সুর্য্য যেমন উর্ধে গমন করেন স্তম্ভও সেই প্রকার ক্রমশঃ উর্ধে বৃদ্ধি পাইতে থাকে, মধ্যারুকালে তাহা সুর্য্যরথের নিকটবর্তী হয়, তখন সূর্য্যদেব রথ স্থগিত করিয়া স্তম্ভের উপর গিয়া আহার করেন। পরে যথােপরি আরোহণ করিলে, রথ যেমন গমন করে স্তম্ভও ক্রমে ক্রমে তেমনি হ্রস্ব হইয়া সন্ধ্যার সময় পুষ্করিণীতে একবারে লীন হয়। এই আশ্চর্য স্তম্ভ এখন পর্যন্ত কেহ দেখেন নাই। অন্যে কি, দেবতা বা গন্ধর্ব্ব ইহারাও তাহার সমাচার জানেন না।

 রাজা ব্রাহ্মণের স্থানে এই কথা শুনিয়া তাহা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ না করিয়া, ব্রাহ্মণকে কিছু অর্থ প্রদানপূর্বক বিদায় করিলেন। পরে তাল বেতালকে স্মরণ করিলেন। তাহারা উপস্থিত হইয়া কহিল মহারাজ কিঙ্করেরা উপস্থিত, আমাদিগের প্রতি কি আজ্ঞা হয়। স্বর্গ পাতাল বা সমুদ্র-পার যেখানে ইচ্ছা হয়, আজ্ঞা করুন, আমরা সেই খানে আপনাকে লইয়া যাইতেছি। রাজা ঈষদ, হাস্য পূর্বক বলিলেন এক কৌতুক দর্শনে উত্তর খণ্ডে গমন করিতে হইবে, তথায় তােমরা আমাকে লইয়া চল। ইহা বলিয়া রাজা তাহাদিগের স্কন্ধে আরােহণ করিলেন। তাল বেতাল তাহাকে স্কন্ধে লইয়া শূন্য দিয়া মুহু ত্তেকের মধ্যে সেই স্থানে উপস্থিত হইল। দেখিলেন সরােবরের চারি দিকে চারি পাষাণময় ঘাট আছে, হংস ও বক প্রভৃতি নানা জাতীয় জলচর পক্ষিগণ আনন্দে ক্রীড়া করিতেছে, ডাহুক চকোর প্রভৃতি অন্যান্য বিহঙ্গমেরা নানাবিধ মধুর ধ্বনি করিতেছে, প্রফুল্ল কমল দল মধ্যে ভ্রমরগণ ভ্রমণ করিতেছে, কোকিলগণ কুহু কুহু ধ্বনি করিতেছে, আর আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মধুরালাপী পক্ষিগণ নানা প্রকার গান করিতেছে, গন্ধবহ কুসুম সমূহের সুগন্ধ বহন পূর্ব্বক চারি দিক আমােদিত করিয়াছে, সরােবর-তীরস্থ তরুগণ ফলভরে অবনত হইয়া আছে, এবং নানা জাতীয় পক্ষী তাহাতে বসিয়া কৌতুকে আহার বিহার করিতেছে।

 রাজা, এই মনােহর শােভা দর্শনে অত্যন্ত আনন্দিত হইয়া, সেই সরসী তীরে যামিনী যাপন করিলেন। নিশাবসানে ভানুদয় হইলে দেখিলেন ব্রাহ্মণ যে স্তম্ভের কথা কহিয়া ছিলেন সেই স্তম্ভ সরােবর হইতে উঠিতে লাগিল। তখন রাজা তাল বেতালকে কহিলেন আমাকে ঐ স্তম্ভের উপর স্থাপন করিয়া তোমরা প্রস্থান কর। তাল বেতাল আজ্ঞা মাত্র রাজাকে স্তম্ভোপরি রাখিয়া অন্তর্হিত হইল। ঐ স্তম্ভ ক্রমে ক্রমে জল হইতে উচ্চ হইতে লাগিল। তাহাতে রাজার অন্তঃকরণে ত্রাস জন্মিতে লাগিল, এবং তিনি সুর্য্যের যত নিকটবর্তী হইতে লাগিলেন তুতই তাঁহার উত্তাপে তাপিত হইয়া দগ্ধ-কলেবর হইতে লাগিলেন। অবশেষে ঐ উত্তাপে শরীর একবারে দগ্ধ হইয়া অঙ্গার বর্ণ হইল।

 অনন্তর যখন স্তম্ভ রথের সমান উচ্চ হইল তখন সারথি স্তম্ভোপরি দগ্ধ দেহ দর্শন করিয়া, রথ স্থগিত করাতে অশ্বগুলা লম্ফ দিয়া উঠিল। তাহাতে সুর্য্যদেব চেতন প্রাপ্ত হইয়া দেখিলেন স্তম্ভের উপর এক শব পড়িয়া আছে। তদ্দষ্টে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন একি আশ্চর্য্য, মনুষ্যের এরূপ সাহস কখন হইতে পারেনা, এব্যক্তি দেবতা কিম্বা গন্ধর্ব্ব অথবা তপস্বী হইবেক, যাহা হউক স্তম্ভোপরি এই মৃতদেহ থাকিতে ভােজন করা হইতে পারে না। ইহা কহিয়া রাজার শরীরে অমৃত সেচন করিলেন। তাহাতে রাজা রাম নাম উচ্চারণ পূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিলেন, এবং সুর্য্য দেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত পূর্ব্বক করপুটে বলিলেন হে দিবাস্বামিন, আমি কত পুণ্য করিয়াছি যে তাহার ফলে এ শরীর ধারণে আপনার চরণ দর্শন করিলাম। সংসারে সকলেই আপনার দর্শনে ইচ্ছা করেন, কিন্তু যাহার প্রতি আপনি প্রসন্ন হয়েন কেবল সেই ব্যক্তিই আপনাকে দেখিতে পায়। আমার জীবন সার্থক হইল। সূর্য্যদেব জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কে, তােমার নাম কি, তােমাকে দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে ত্রাস। জন্মিতেছে। রাজা বলিলেন হে স্বামিন, আমি অম্বাবতী নগরীয় গন্ধর্ব্বসেন রাজার পুত্র, আমার নাম বিক্রমাদিত্য। আমি এক ব্রাহ্মণের স্থানে আপনার কথা শুনিয়া আপনার চরণ দর্শনার্থ আসিয়াছি। এক্ষণে আপনার কৃপায় আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হইল, আজ্ঞা হউক বিদায় হই। ইহা শুনিয়া সুর্য্যদেব সন্তুষ্ট হইয়া আপনার কুণ্ডল রাজাকে দিলেন, আর বলিলেন ইহা পরিধান করিলে প্রতিদিন শতভার সুবর্ণ প্রাপ্ত হইবে, আর এখন অবধি নিঃশঙ্কে রাজ্য করিতে পারিবে। তদনন্তর সূর্য্যদেবের রথ গমন করিতে লাগিল, স্তম্ভও ক্রমে ক্রমে নত হইয়া দিবা অবসান হইল। স্তম্ভ জলমগ্ন হইবার কিঞ্চিৎকাল পূর্বে রাজা তাল বেতালকে স্মরণ করিলেন। তাহারা উপস্থিত হইলে রাজা তাহাদের স্কন্ধারােহণ পূর্ব্বক স্ববাসে গমন করিলেন।

 অনন্তর যখন রাজা নগর প্রবেশ করেন তখন এক সন্ন্যাসী তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। ঐ সন্ন্যাসী যােগবলে জানিয়াছিল রাজা সুর্যের কুণ্ডল প্রাপ্ত হইয়াছেন, অতএব রাজাকে বলিল মহারাজ তুমি যে কুণ্ডল পাইয়াছ তাহা আমাকে দান কর, তাহাতে আমার বিস্তর উপকার হইবেক। এই প্রার্থনায় রাজা ঈষদ, হাস্য করিয়া তখনি তাহাকে কুণ্ডল প্রদান করিয়া আহলাদ পূর্ব্বক স্বভবনে গমন করিলেন।

 কামকন্দলা এই কথা সমাপন করিয়া ভােজরাজকে কহিল হৈ নৃপতে যদি তােমার এতদ্রুপ ক্ষমতা ও বদান্যতা থাকে তবে সিংহাসনা রূঢ় হও। এই কথায় রাজা ক্ষুব্ধ হইয়া সে দিবস সিংহাসনােপবেশনে ক্ষান্ত থাকিলেন। পরিদবস বররুচি মন্ত্রীকে আহ্বান করিয়া কহিলেন অদ্য আমি কাহারাে নিষেধ শুনিব না, সিংহাসনে বসিব। কিন্তু যখন সিংহাসনে উপবেশনার্থ পাদ প্রসারণ করিলেন, তখন