বত্রিশ সিংহাসন/৭
কামুদী সপ্তম পুত্তলিকা
রাজার পদার্থে পতিত হইল। রাজা বিস্ময় যুক্ত হইয়া পাদ সংহার পূর্বক পুত্তলিকাকে কহিলেন তুমি কি জন্য ভূমিতে পড়িলে। পুত্তলিকা কহিল আমরা সতা যুগের অবলা, তুমি কলিযুগে অবতীর্ণ হইয়াছ। আমরা এক পুরুষের মুখাবলােকন করিয়াছি, তদ্ভিন্ন অন্য কাহারও মুখ দর্শন করি নাই, অতএব প্রথমতঃ আমাদিগের বিবরণ শ্রবণ কর। বিশ্বকর্ম্মা আমাদের জন্মদাতা। আমরা বাহুবল রাজার নিকটে বাস করিতাম, তিনি আমাদিগকে রাজা বিক্রমাদিত্যকে অর্পণ করিয়া ছিলেন। এবং রাজা বিক্রমাদিত্য আমাদিগকে গৃহে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। যে পর্যন্ত তাহার সহিত আমাদের বিচ্ছেদ হইয়াছে সে পর্যন্ত আমরা একবার সুখী নহি, কেননা ততুল্য অতুল্য গুণশালী মনুষ্য দুল্লভ।ভোজরাজ বলিলেন বিক্রমাদিত্যের কি গুণ ছিল তাহা বর্ণন কর। পুত্তলিকা কহিল।
এক দিবস রজনীতে রাজা বিক্রমাদিত্য স্বীয় শয়নমন্দিরে শয়ন করিয়াছিলেন, এবং নগরস্থ সমস্ত লােক এমত নিদ্রিত হইয়া ছিল যে কাহারও কিছুমাত্র শব্দ ছিলনা। ঐ নিশীথ সময়ে নদীর উত্তরাংশে এক স্ত্রী অতি উচ্চৈঃ স্বরে রােদন করিতে ছিল। তাহার ক্রন্দন ধ্বনি রাজার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে, রাজা মনে মনে কহিলেন আমার নগরে কোন্ দুঃখিনী আসিয়া এত রাত্রে এই প্রকার রােদন করিতেছে। ইহা বলিয়া রাজা খজ চর্ম গ্রহণ পূর্ব্বক রােদনধ্বনি লক্ষ্য করিয়া নদীতটে গমন করিলেন, এবং সন্তরণ দ্বারা নদী পার হইয়া দেখিলেন এক পরম সুন্দরী যুবতী দণ্ডায়মান হইয়া রােদন করিতেছে। ঐ যুবতীর সন্নিকট গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সুন্দরি তুমি কি জন্য রােদন করিতেছ, তােমার স্বামি-বিয়োেগ, কি পুত্র-শােক, হইয়াছে আমাকে বল। যুবতী কহিল আমার স্বামী চৌর্য কর্ম্ম করিতেন। পরে নগরপাল তাহাকে ধরিয়া শূল দান করিয়াছে, আমি প্রণয় বশতঃ তাহার নিমিত্ত কিঞ্চিৎ আহারীয় দ্রব্য আনিয়াছি, কিন্তু স্বামী স্তম্ভের উপরে আছেন, আমি নানা যত্ন করিয়া ও তাহাকে দিতে পারিতেছি না, এই জন্য রােদন করিতেছি। রাজা কহিলেন এ সামান্য কথা, ইহার জন্য রােদনের আবশ্যক কি। নারী কহিল এই সামান্য কর্ম্মই আমার পক্ষে দুষ্কর হইয়াছে। রাজা বলিলেন তুমি আমার স্কন্ধে আরােহণ করিয়া তােমার স্বামীকে ভােজন করাও। এই কথায় যুবতী রাজার স্কন্ধে আরােহণ করিয়া শূলস্থ চোরের মাংস ভক্ষণ করিতে লাগিল, তাহাতে তাহার মুখ হইতে রক্ত দ্বারা নির্গত হইয়া রাজার তাবৎ বস্ত্র ও অঙ্গ শােণিতময় হইল। তাহাতে রাজা মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন এই নারী সামান্য নারী নহে, অবশ্য কোন মায়াধারিণী হইবেক, আমাকে প্রতারণা করিল। ইহা ভাবিতে ভাবিতে রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ললনে, তােমার প্রিয় ভােজন করিতেছেন কি না। নারী বলিল হা, ইনি আহার করিলেন, ইহার উদর পরিপূর্ণ হইয়াছে, এই ক্ষণে তুমি আমাকে স্কন্ধ হইতে অবতরণ করাও। রাজা তাহাকে ভূমিতে নামাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন, তৃপ্তি পূর্ব্বক আহার হইল কি না। যুবতী হাস্য করিয়া বলিল আমি কস্কালিনী, তােমার প্রতি তুষ্ট হইয়াছি, তুমি বরপ্রার্থনা কর, আমাকে ভয় করিওনা। রাজা বলিলেন আমি তােমাকে কি জন্য ভয় করিব, এবং তুমি আমার স্কন্ধে আরােহণ করিয়া শবাহার করিলে অতএব তােমার স্থানে কি বর চাহিব। কঙ্কালিনী কহিল আমি যাহাই করিয়া থাকি তাহা চিন্তা করিয়া কি করিবে, তােমার যে বর বাঞ্ছা হয় আমার স্থানে প্রার্থনা কর। রাজা বলিলেন যদি আমাকে অন্নপূর্ণা দান করিতে পার তবে প্রার্থনা করি। কঙ্কালিনী উত্তর করিল অন্নপূর্ণা আমার কনিষ্ঠা সহােদরা, তুমি আমার সঙ্গে আইস, আমি তােমাকে অন্নপূর্ণা দান করিব।
ইহা বলিয়া কঙ্কালিনী রাজা বিক্রমাদিত্যকে নদীতীরে লইয়া গেল, এবং তত্রস্থ এক দেবালয়ের দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া করতালি দিল। তাহাতে দ্বার মুক্ত হইয়া অন্নপূর্ণা নির্গত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন এ ব্যক্তি কে। কঙ্কালিনী কহিল ইনি রাজা বিক্রমাদিত্য, ইনি আমার সেবা করিয়াছেন এজন্য আমি ইহার প্রতি তুষ্ট হইয়া অঙ্গীকার করিয়াছি ইহাকে অন্নপূর্ণ। দনি করিব, অতএব যাহাতে আমার সত্য রক্ষা হয় তাহা কর। এই কথায় অন্নপূর্ণা হাস্য করিয়া রাজার হস্তে একটা ঝলী দিয়া কহিলেন তােমার যখন যে আহারীয় দ্রব্যের প্রয়ােজন হইবে তাহা এই ঝলী হইতে পাইবে।
রাজা এই ভক্ষপ্রদ অমূল্য ঝলী পাইয়া মহা আনন্দে তথা হইতে বিদায় হইলেন। পরে প্রাতঃ- কালে নদীতে স্নানাত্নিক করিয়া সচ্ছদচিত্ত হইয়াছেন এমত সময়ে এক ব্রাহ্মণ তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার কিছু আহারের ইচ্ছা আছে। বিপ্র কহিলেন হাঁ আমার অত্যন্ত ক্ষুধা হইয়াছে, যদি কিছু আহারীয় সামগ্রী পাই তবে ভক্ষণ করি। রাজা পুনৰ্বার জিজ্ঞাসা করিলেন কি আহার করিতে বাঞ্ছা হয়। ব্রাহ্মণ বলিলেন পান্ন ভােজনে পূহা হইতেছে। তাহা শুনিয়া রাজা মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যদি প্রকৃাম দিতে পারি তবে মিথ্যাবাদী হইব। ইহা চিন্তা করিয়া ঝলীর মধ্যে হস্তাৰ্পণ করিলেন এবং হস্ত বাহির করিয়া দেখিলেন পৰ্কাই নির্গত হইয়াছে। ঐ পায়ে ব্রাহ্মণের উদর পরিপূর্ণ হইল। আহারান্তে ব্রাহ্মণ বলিলেন আমি ভােজন করিলাম, এইক্ষণে কি দক্ষিণ দিবে দাও। রাজা বলিলেন কি দক্ষিণ চাহ। ব্রাহ্মণ বলিলেন যদি আমাকে ঐ ঝলীটী দাও তবে আমি পরমানন্দিত হই। রাজা তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণকে ঝলী প্রদান করিয়া গৃহে আসিলেন।
পুত্তলিকা এই আখ্যায়িকা সমাপন করিয়া ভােজরাজকে কহিল মহারাজ দেখ, রাজা বিক্রমাদিত্য এবস্তৃত ক্লেশে যে অন্নপূর্ণার ঝলী পাইলেন তাহা অনায়াসে ব্রাহ্মণকে দিলেন। যদি তােমার এমত সাহস ও বদান্যতা থাকে তবে সিংহাসনে উপবেশন কর, নতুবা পাপগ্রস্ত হইবে। এই প্রকারে সে দিবস অতীত হইল। পরদিবস রাজা পুনর্ব্বার সিংহাসনােপবেশন জন্য আগমন করিলে,