বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/ঝাঁসীর রাণী সেনা বাহিনী
ঝাঁসীর রাণী সেনা বাহিনী
(Rani of Jhansi Regiment)
ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাই স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭ সালে অশেষ কষ্ট স্বীকার করিয়া যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছিলেন। তাঁহার নামানুসারে এই নারীবাহিনীর নাম দেওয়া হইয়াছিল—‘ঝাঁসীর রাণী সেনা বাহিনী’। ১৯৪২ সালের ২২শে অক্টোবর ঝাঁসীর রাণীর জন্মদিবস উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে এই বাহিনীর গঠন মূলক কার্য্য আরম্ভ হয় এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিয়া ও জাতীয় সঙ্গীত গান করিয়া এই বাহিনীর উদ্বোধন করা হয়। সকল ধর্ম্মের শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী নির্ধন স্বেচ্ছাসেবিকা আসিয়া এই বাহিনীতে যোগদান করে। ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথম্ উক্ত বাহিনীর সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। আজাদ গভর্ণমেণ্টের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা ও সাধারণ সেবা শুশ্রূষা করা ব্যতীত স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীলোকদিগকে যুদ্ধ বিভাগেও নিয়োগ করা হইত।
আজাদ হিন্দের অন্যান্য বিভাগের ন্যায় এই সেনাবাহিনী সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ইহার শিক্ষা শিবির ও কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
বিস্তৃত প্রাঙ্গণে সমবেত হইয়া এবং জাতীয় বাহিনীর পোষাকে সজ্জিত হইয়া এই নারীবাহিনী প্রত্যহ সকালে সমস্বরে প্রার্থনা করিত এবং নেতার প্রতি আস্থা রাখিয়া আমরণ দেশ সেবা করিবার সংকল্প গ্রহণ করিত। কঠোর দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যের কথা স্মরণ করিয়া এবং প্রত্যহ নূতন করিয়া স্বাধীনতার সংকল্পবাণী গ্রহণ করিয়া এই সৈন্যবাহিনী দৈনন্দিন কার্য্যে যোগদান করিত
শিক্ষা
উপযুক্ত শিক্ষা প্রাপ্ত হইলে নারীগণকে এই বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করা হইত। ইহাদিগকে অঙ্গচালনা, কুচকাওয়াজ, অস্ত্রচালনা, নানাবিধ কৌশল, মানচিত্র গঠন ও সাধারণ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইত। তিন মাস শিক্ষার পর যাহারা কষ্টসহিষ্ণু ও সকলপ্রকার বিপদ আপদ তুচ্ছ করিয়া দেশমাতৃকার সেবা করিতে উৎসুক, কেবলমাত্র তাহাদিগকেই জাতীয় বাহিনীতে নিয়োগ করা হইত ও ত্রিবর্ণ বিশিষ্ট ব্যজ দেওয়া হইত। রোমান হিন্দুস্থানির সাহায্যে সকলকে শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা ছিল। বিশ্রামের সময় ব্যতীত সকলকেই সামরিক পোষাক পরিধান করিয়া থাকিতে হইত এবং সামরিক নিয়মানুবর্ত্তিতা মানিয়া চলিতে হইত। পূর্ব্ব এশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়, থাইল্যাণ্ড, ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি সকল দেশেরই নারীগণ এই বাহিনীতে যোগদান করে। জাতিধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে সকলেই একত্রে আহার বিহার করিত এবং একই ভাষায় কথা কহিত।
শিক্ষাকেন্দ্র
শিক্ষাকেন্দ্রের আভ্যন্তরীণ দৃশ্য অতি মনোরম ছিল। প্রথমতঃ দ্বাররক্ষিগণ উত্তম সামরিক পোষাক পরিচ্ছদে সজ্জিত হইয়া বন্দুক ও তরবারি হস্তে দণ্ডায়মান থাকিত। রক্ষিগণ তাহাদের অধিনায়কগণ সর্ব্বদাই তৎপর হইয়া আপনাপন কর্ত্তব্য সাধনে নিযুক্ত থাকিত। শান্ত্রীগণের কার্য্য ছিল অস্ত্রাগার রক্ষণ। তত্ত্বাবধায়কগণ মধ্যে মধ্যে শিক্ষাকেন্দ্রের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করিয়া রক্ষিদের ও অন্যান্য সকলের কার্য্যকলাপ ও নিয়মানুবর্ত্তিতা লক্ষ্য করিতেন। প্রাতঃকালিন কুচকাওয়াজের অব্যবহিত পরে ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে সকলেই আপনাপন আহার ও পানপাত্র লইয়া জলযোগের জন্য রন্ধনগৃহের সম্মুখে সারি দিয়া দণ্ডায়মান থাকিত এবং আহার সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হইয়া পুনরায় কুচকাওয়াজের মাঠে উপস্থিত হইত ও আপনাপন অধ্যক্ষের আদেশের অপেক্ষায় থাকিত। ইহার পরই সর্ব্বপ্রকার সামরিক শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা ছিল। এই শিক্ষা সমাপ্ত হইলে তাহারা প্রত্যহ বেলা ১টার সময়ে স্নান আহার করিত। অপরাহ্ণে বক্তৃতাদ্বারা শিক্ষা দেওয়া হইত। রোমান হিন্দুস্থানী শিক্ষা দেওয়াই এই ক্লাশের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সপ্তাহে দুইদিন কুচকাওয়াজ করিয়া ভ্রমণের জন্য নির্দ্দিষ্ট থাকিত। তাহারা যখন পৃষ্ঠে থলি, স্কন্ধদেশে বন্দুক, পায়ে বুট ও পট্টি পরিয়া এবং দলের অধিনায়িকাকে সম্মুখে লইয়া কুচকাওয়াজের গান (Marching song) গাহিতে গাহিতে তালে তালে পদক্ষেপ করিয়া চলিয়া যাইত, সে দৃশ্য দেখিতে বড়ই মনোরম বোধ হইত। এইরূপ একটি দল একবার মেমিও হইতে মান্দালাই পর্য্যন্ত প্রায় ৪৪ মাইল পথ কুচকাওয়াজ করিয়া যায়। ক্লান্তি বোধ হইলে তাহারা গান গাহিয়া, গল্প করিয়া ও যুদ্ধেরত ভ্রাতৃগণের কথা স্মরণ করিয়া শক্তি সঞ্চয় করিত।
নারীবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য
এই সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য এই যে তাহারা যেন স্বাধীন ভারতে পুরুষের সঙ্গে থাকিয়া সমানভাবে সকলপ্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কেবল গৃহকর্ম্মে লিপ্ত থাকাই স্ত্রীলোকের একমাত্র কর্ত্তব্য নহে, পরন্তু পুরুষগণের সহিত পাশাপাশি দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিতে করিতে জীবন বিসর্জ্জন করাও তাহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। যেহেতু স্বাধীনতার সুখ পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েই ভোগ করিবে। সুতরাং এই সংগ্রামে যোগদান করিতে হইলে শারীরিক যোগ্যতা ও কঠোর শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশ অশিক্ষিতের দেশ—স্ত্রীলোকগণ আপনাপন শুভাশুভ বুঝিতে পারেন না। একবার যদি তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে তাঁহারা দেশের জন্য জীবন বিসর্জ্জন দিতে কখনও পশ্চাৎপদ হইবেন না। ভারতে এমন দিনও ছিল যখন মাতা ও ভগিনীগণ তাঁহাদের পুত্র ও ভ্রাতৃগণকে রণসাজে সজ্জিত করিয়া হাসিমুখে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিতেন। যে শক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া মাতৃজাতি পুরুষ জাতিকে এইরূপ উৎসাহিত করিতেন, সে শক্তি বর্ত্তমানে সুপ্ত অবস্থায় আছে। তাহাকে জাগ্রত করাই এই নারীবাহিনীর উদ্দেশ্য। কারণ ‘বীরমাতাই কেবল বীরসন্তান প্রসব করিতে পারে।’ ঝাঁসীর রাণী এইরূপ একজন আদর্শ বীর রমণী ছিলেন। সুতরাং তাঁহার নামানুসারে এই বাহিনীর নামকরণ হইয়াছিল। নেতাজীর প্রতিষ্ঠিত নারীবাহিনীর অধিনায়িকা ডাক্তার লক্ষীবাইও ঝাঁসীর রাণীর ন্যায় তেজস্বিনী রমণী। ইঁহার অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব এই নারীবাহিনীর প্রত্যেক রমণীর চিত্ত জয় করিয়াছিল। সকলেই তাঁহাকে অশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিত।
কিরূপ মহান্ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া শত সহস্র নারী আপন আপন গৃহ পিতামাতা পুত্রসন্তান এবং সুখ সম্ভোগ বিসর্জ্জন দিয়া কঠোর জীবন যাপন করিতে পারে তাই ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ দ্বারা যে এই নারীগণকে এই কার্য্যে নিয়োগ করা হয় নাই তাহা বলাই বাহুল্য। তাহাদের এই মহান্ স্বার্থত্যাগ যে বৃথা হইবে না এই মনোবৃত্তি লইয়াই তাহারা নারীবাহিনীতে যোগদান করিয়াছিল। তাহারা কখনও মনে করে নাই যে ভবিষ্যৎ ইতিহাসে তাহাদের মহীয়সী কীর্ত্তি অক্ষয় হইয়া থাকিবে।
গোবিন্দরাও নামক জাতীয় বাহিনীর জনৈক সেনানী এই নারীবাহিনীর শৌর্য্য বীর্য্য সম্বন্ধে যে একটি দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহার উল্লেখ করিয়া এই প্রবন্ধের উপসংহার করা যাইতে পারে।
মিত্র-সৈন্য ব্রহ্মদেশ জয় করিবার জন্য যখন অগণিত সৈন্য এবং অপর্য্যাপ্ত রণসম্ভার লইয়া অগ্রসর হইতে থাকে, সেই সময়ে মৌলমেনের নিকটে এই নারী বাহিনীর সহিত তাহাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। যে সময়ে মিত্র শক্তি বড় বড় কামান বন্দুক ট্যাঙ্ক প্রভৃতির সাহায্যে শত্রুসৈন্য ধ্বংশ করিতে উদ্যত, সেই সময়ে এই নারীবাহিনী কেবলমাত্র রাইফেল ও গুলির সাহায্যে যুদ্ধ করিয়াছিল। পরিশেষে এই সৈন্যগণ পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হইলেও ইহাদের বীরত্ব-কাহিনী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরদিন অঙ্কিত থাকিবে।
আর এক কথা—ভারতীয়গণের অর্থ, ভারতবাসীর বুদ্ধি এবং ভারতবাসীর রক্তদ্বারা এই নারীবাহিনী গঠিত হইয়াছিল। জাপানীদের সহিত ইহার কোনও সম্বন্ধ ছিলনা। রেঙ্গুণ ব্রিটিশের হস্তগত হইবার সঙ্গে সঙ্গে এই নারীবাহিনী বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়।