বাঙ্গ্‌লার বেগম/আলিবর্দ্দী-বেগম

আলিবর্দ্দী-বেগম

 নবাব আলিবর্দ্দী খাঁর রাজত্বের বহু ঐতিহাসিক ঘটনা তাঁহার বেগমের সহিত ঘনিষ্টভাবে বিজড়িত। বেগম সাহেবা ছায়ার ন্যায় তাঁহার স্বামীর অনুবর্ত্তিনী ছিলেন, নিম্নলিখিত ঘটনা দুইটী হইতে তাহা জানিতে পারা যায়।

 মীরহবিবের নিকট রত্নপ্রসূ বঙ্গভূমির বিপুল ঐশ্বর্য্যের কথা শ্রবণ করিয়া, রঘুজী ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতকে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেন। এই মহারাষ্ট্র-অভিযানের কথা নবাব আলিবর্দ্দীর কর্ণগােচর হইলে, তিনি বর্দ্ধমানের নিকটে তাহাদের সম্মুখীন হ’ন। এই সময় তাঁহার বেগমও তাঁহার সহিত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। মহারাষ্ট্রীয় গণ লুণ্ঠনে ও নানারূপ নির্য্যাতনে লােকদিগকে বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল এবং এই কার্য্যে তাহারা এতদূর অগ্রসর হইয়াছিল যে, ‘লণ্ডা’ নামক যে হস্তীর উপর নবাব-বেগম আরূঢ়া ছিলেন, সেই হস্তী সমেত তাঁহাকে বন্দিনী করিয়া নিজেদের শিবিরে লইয়া যায়। নবাবের জনৈক সেনানী ওমার খাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুসাহেব খাঁ, এই অবমাননায় মর্ম্মাহত হইয়া, বীরবিক্রমে আত্মজীবন-বিনিময়ে বহু কষ্টে বেগমের উদ্ধার সাধন করিয়া, তাঁহার মান মর্য্যাদা রক্ষা করেন![১]

 বালেশ্বরের যুদ্ধক্ষেত্রেও আলিবর্দ্দী খাঁর পার্শ্বে আমরা বেগম সাহেবাকে দেখিতে পাই। রণকোলাহলের মধ্যে, অগণিত দ্বিষতের প্রাণহীন দেহ দেখিয়া, যে কোমলহৃদয়া নারী আপনাকে প্রকৃতিস্থ রাখিতে পারেন— শত্রুশিবিরে বন্দিনী হইয়াও যিনি আপনার শৌর্য্য ও আত্মগরিমার পরিচয় দিতে পারেন, তিনি যে নারীকুলের শিরোমণি, তাহা সকলকেই অকুষ্ঠিত চিত্তে স্বীকার করিতে হইবে। তাঁহার সম্বন্ধে হলওয়েল সাহেবের ধারণা অতি উচ্চ ছিল। তিনি লিখিয়াছেন—“জ্ঞানগরিমা, মহানুভবতা, কারুণ্য ও অপরাপর কমনীয় সদ্‌গুণাবলী-ভূষিতা বেগম সাহেবার চরিত্র তাঁহার পদমর্য্যাদানুরূপই ছিল এবং এ সকল সদ্‌গুণ যে তাঁহাকে চিরকাল নারী কুলোত্তমা করিয়া রাখিবে, তাহাতে অনুমাত্র সন্দেহ নাই।”[২] তিনি উৎসবে আনন্দময়ী—সোহাগে প্রেমবিহ্বল লাজময়ী—রোগে শুশ্রূষা পরায়ণা সহচরী—বিপদে পরামর্শদাত্রী। কি রাজনৈতিক উন্নতিবিধানে— কি সামাজিক মঙ্গলকল্পে এবং প্রজাদিগের হিতার্থে পরদুঃখকাতরা বেগম সাহেবা স্বামীকে সৎপরামর্শ দিয়া ঐ সকল শুভকর্ম্মে উদ্বুদ্ধ করিতেন, আর যখনই নবাব সাহেব কোন শুভকর্ম্মানুষ্ঠানের পূর্ব্বে তাঁহার পরামর্শ লইতেন, তখনই তিনি সুপরামর্শ দানে তাঁহাকে কর্ম্মে উৎসাহিত করিতেন।

 ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর পর রঘুজী যখন বিপুল বাহিনী লইয়া বাঙ্গালা আক্রমণ করেন, সেই সময়ে সমসের, সর্দ্দার প্রভৃতি আফগান সেনাপতি গণ মহারাষ্ট্রীয়দিগের সহিত যড়যন্ত্রে লিপ্ত হ’ন। নবাব আলিবর্দ্দী এই সংবাদ শ্রবণে অতিশয় বিচলিত হইয়া পড়েন। তিনি কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া বেগম সাহেবার নিকট পরামর্শ গ্রহণের জন্য উপস্থিত হইলে, তিনি সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণান্তে সন্ধির প্রস্তাব করিয়া মজঃফর আলি ও ফকীর আলি নামক দুইজন দূতকে রঘুজীর নিকট প্রেরণ করিলেন।[৩] এদিকে রঘুজীও নানারূপে বিপর্য্যস্ত হইয়া সন্ধিস্থাপনের ইচ্ছা করিতে ছিলেন; কিন্তু গৃহশত্রু মীরহবিব তাঁহাকে বুঝাইলেন—“আর কিছুদিন যুদ্ধ চালাইলে আলিবর্দ্দীকে বাধ্য হইয়া সন্ধি সংস্থাপিত করিতে হইবে, কারণ তাঁহার রাজকোষ এখন প্রায় শূন্য; সৈনিকেরা রীতিমত বেতন না পাইয়া ক্ষুণ্ণ; অসন্তুষ্ট আফগান সামন্তগণের মধ্যে শীঘ্রই বিদ্রোহানল প্রধূমিত হইয়া উঠিবে—আমির ওমরাহগণ তাঁহার ব্যবহারে প্রীত নহে, এরূপস্থলে আপনি কেন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইবেন?” মীরহবিবের পরামর্শমতে রঘুজী নবাব-বেগমের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিলেন। রঘুজী তাঁহার প্রস্তাব অমান্য করিল দেখিয়া, বেগম সাহেবা সৈন্যগণকে মহারাষ্ট্রীয়-শিবির আক্রমণ করিতে আদেশ দিলেন।

 এই সময়ে আফগানসামন্তবর্গ নবাবকে বড়ই বিপন্ন করিয়া তুলিল। মুস্তাফার পরাজয়ের পর হইতেই তাহারা এক প্রকার বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছিল, এক্ষণে মহারাষ্ট্রীয়দিগের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে পদচ্যুত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়া, প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিল এবং তাহারা কৌশলে নবাবের জামাতা জৈনুদ্দীনকে হত্যা করিয়া তৎপত্নী আমিনা বেগমকে আবদ্ধ করিয়া রাখিল।

 এই অপ্রত্যাশিত বিপদে আলিবর্দ্দী অধীর হইয়া পড়িলেন; কিন্তু ধীর প্রকৃতি বেগম সাহেবা আমিনার উদ্ধারের জন্য ও উদ্ধতপ্রকৃতি আফগানদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্য, অগৌণে সৈন্য-সামন্ত লইয়া নবাবকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিলেন। এ যুদ্ধের পরিণাম—আমিনার উদ্ধার ও আফগানসামন্তবর্গের বশ্যতা-স্বীকার।

 এদিকে আবার যখন সুচরিত্রা বেগম সাহেবা হোসেন কুলির সহিত ঘসিটী ও আমিনা বেগমের অবৈধ প্রণয় দেখিয়া মর্ম্মাহত হইলেন—যখন কন্যাদিগকে বুঝাইয়াও পাপমার্গ হইতে সুপথে আনয়ন করিতে পারিলেন —রূপােন্মত্ত হােসেন কুলিকেও প্রণয়াস্পদের নিকট হইতে দূরে রাখিতে অকৃতকার্য্য হইলেন, তখন মাতৃস্নেহের বশবর্ত্তিনী হইয়া কন্যাদিগের দোষ না দেখিয়া হােসেন কুলিকেই তাহাদের সর্ব্বনাশের মূল ভাবিয়া, তাহার হত্যার জন্য সিরাজকে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন। সিরাজও তাঁহার আদেশে হােসেন কুলিকে হত্যা করাইলেন।

 ইহার কিছুদিন পরে নওয়াজিস মহম্মদের মৃত্যু হয়। তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ঘসিটী বেগমের অর্থের প্রতি সিরাজের লােলুপ দৃষ্টি পড়িয়াছিল; কিন্তু ঘসিটীও এই কথা জানিতে পারিয়া, পূর্ব্ব হইতে ধনরত্নাদি লইয়া মতিঝিলে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। আলিবর্দ্দীর জীবদ্দশায় সিরাজ ঘসিটীর বিপক্ষতাচরণ করিতে পারেন নাই। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দে আলিবর্দ্দীর মৃত্যুতে রাজলক্ষ্মী যখন সিরাজের অঙ্কশায়িনী হইলেন, তখন পিতৃব্যধন-লুণ্ঠন-প্রয়াসী সিরাজ মতিঝিল অবরােধ করিলেন। বিপদ গুরুতর দেখিয়া আলিবর্দ্দী-বেগম স্বয়ং এই বিপদ ভঞ্জনার্থ অবরুদ্ধ দুর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করিলেন এবং স্থির করিয়া দিলেন, ঘসিটীর পােষ্যপুত্র বাঙ্গালার মসনদে বসিতে পারিবে না বা ঘসিটী আপনার পােষ্যপুত্রের জন্য যুদ্ধাদি করিতে পারিবে না। সিরাজকে বাঙ্গালার নবাব বলিয়া সে স্বীকার করিবে, আর সিরাজও ঘসিটীর স্বামীত্যক্ত-সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না। কিন্তু যে দিন বিবাদ মিটিল, সিরাজ তাহার পরদিবসেই মতিঝিলের যাবদীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিলেন। এই সমস্ত কারণে ঘসিটী সিরাজের আশ্রয় লইলেন। ইহারই ফলে সিরাজের ইংরাজদিগের সহিত ঘােরতর বিবাদের সূত্রপাত হইল ও তিনি কলিকাতা আক্রমণ করিলেন। হলওয়েলকে ধৃত করিয়া মুর্শিদাবাদে আনা হইল; কিন্তু অল্পদিন পরেই তিনি মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন। সিরাজ যে এত শীঘ্র হলওয়েলকে অব্যাহতি দিয়াছিলেন, তাহার একটা বিশেষ কারণও আছে। আলিবর্দ্দী বেগম ও আমিনা বেগম, হলওয়েলের দুঃখে ব্যথিত হইয়া তাঁহার মুক্তির জন্য সিরাজকে বারবার কাতর কণ্ঠে উপরোধ করেন।[৪] স্নেহময়ী মাতামহী ও জননীর কাতর প্রার্থনায় সিরাজ তাঁহাকে স্বাধীনতা দান করিয়াছিলেন।

 যে সময়ে হলওয়েল মুর্শিদাবাদে বন্দীভাবে অবস্থান করিতেছিলেন, সেই সময়ে একদিন তিনি আলিবর্দ্দী-বেগমের প্রধান পরিচারিকা ও জনৈক সেকের কথোপকথন হইতে জানিতে পারিয়াছিলেন যে, পূর্ব্বরাত্রে ভোজের সময় আলিবর্দ্দী-বেগম সিরাজকে তাঁহার মুক্তির জন্য অনুরোধ করেন।[৫] তাহার পর তিনি অবগত হ’ন যে, তাঁহাকে কলিকাতায় নির্ব্বাসিত হইতে হইবে; কিন্তু সিরাজের সহিত পরদিন সাক্ষাৎ হইলে, তিনি তাঁহাকে মুক্তিদান করেন। নবাব-বেগম যে হলওয়েলের মুক্তির জন্য সিরাজকে বিশেষভাবে অনুরোধ করিয়াছিলেন, তজ্জন্য় হলওয়েল সাহেব তাঁহার পুস্তকে তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধন্যবাদ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই।[৬]

 পলাশীর যুদ্ধাবসানে সিরাজের হত্যাকাণ্ড সাধিত হইবার পর, মীরজাফরের পুত্র মীরণ আলিবর্দ্দী-বেগম, তাঁহার দুই কন্যা ঘসিটী ও আমিনা, সিরাজ-পত্নী লুৎফুন্নিসা ও তাঁহার শিশুকন্যাকে বন্দী করিয়া জাহাঙ্গীর নগরে প্রেরণ করেন এবং তাঁহাদিগকে গােপনে হত্যা করিবার জন্য তথাকার শাসনকর্ত্তা জেসারৎ খাঁর উপর পরওয়ানা পাঠান; কিন্তু সদাশয় শাসনকর্ত্তা এ কার্য্যে অসম্মতি জ্ঞাপন করিলে, মীরণ তাঁহার একজন বন্ধুর প্রতি এই কার্য্যের ভার অর্পণ করেন। ঘসিটীর ও আমিনার শোচনীয় পরিণাম—তাহাদের সলিল-সমাধি ও নির্ম্মম মৃত্যু-যন্ত্রণা আমাদিগের সহানুভূতির উদ্রেক করে। অত্যাচারের কঠিন হস্ত হইতে আলিবর্দ্দী-বেগম ও লুৎফুন্নিসা কি প্রকারে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিলেন ও কেমন করিয়া বেগম-সাহেবা মুর্শিদাবাদে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন, ইতিহাস তাহার কোন সন্ধানই বলিয়া দিতে পারে না।

 ভাগ্যলক্ষ্মীর বিপর্যয়ে, বাঙ্গালার নবাব-বেগমের শােচনীয় পরিণাম দেখিয়া, আলিবর্দ্দীর পদতলে-সমাহিতা বেগম-সাহেবার কবরের উপর দুই বিন্দু অশ্রু না ফেলিয়া থাকিতে পারা যায় না।

  1. “The Mahrattas continued their depredations, so much so that they laid their hands on the very elephant on which the Begum was riding, and were leading it away to their camp, when Musaheb Khan, eldest son of Omer Khan rescued the Begum and the elephant.” alsn's Murshidabad —P. 146.
  2. Holwell's “Interesting Historical Events.” Pt. I—Chap. P. 170-71.
  3. Mutaqherin—i—522.
  4. বেগমগণের ইংরাজদের প্রতি সহানুভূতি দেখাইবার একটা বিশেষ কারণও ছিল। হিল সাহেব তাহার পুস্তকের একস্থলে লিখিয়াছেন:—“The interest of these ladies in the English Merchants may have been partly due to the fact that they also were accustomed to speculate in commerce.” Indian Records Series: Bengal—i—xcii.
  5. A letter from J. Z. Holwell, Esq. to William Davis Esq. from on board the ‘Syren’ sloop, 28th February 1757. Ibíd-iii-151.
  6. ‘India Tracts’—Edited by Lal Gopal Goswami Pt. IV—35.