মীরজাফরের অন্যতমা সহধর্ম্মিণী মণিবেগমের জীবন-বৃত্তান্ত সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত বড় একটা আলোচনা হয় নাই। কেহ বা বেগম-সাহেবার নামমাত্র করিয়াছেন; কেহ বা ক্কচিৎ তাঁহার জীবনের কোন ঘটনা-বিশেষের অবতারণা করিয়াছেন মাত্র। তাঁহার জীবনের ধারাবাহিক ঘটনাবলীর একত্র সমাবেশ সম্ভবপর না হইলেও, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলী হইতে যে চিত্রের আভাষ পাওয়া যায়, তাহাই অঙ্কিত করিবার চেষ্টা পাইলাম।

 মণিবেগম কোন সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তিনি ও বব্বু বেগম উভয়েই প্রথমে নর্ত্তকী ছিলেন। নৃত্যকলাই বব্বু বেগমের বংশের উপজীবিকা ছিল। বব্বু বেগমের মাতার নাম ‘বিশু’। সম্মন আলি খাঁ নামক জনৈক মুসলমানের ঔরসে বব্বুর জন্ম। শিকান্দ্রার নিকটবর্ত্তী বলকুণ্ডা গ্রামে একজন দরিদ্র বিধবা বাস করিতেন। দারিদ্র্যের কঠোর পীড়নে তিনি নিজ কন্যার ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ হইয়া, তাহাকে বিশুর হস্তে অর্পণ করেন। বালিকা সাজহানাবাদে (দিল্লীতে) পাঁচ বৎসর কাল অবস্থিতি করিয়া, তথায় বিশুর অনুগ্রহে নৃত্যকৌশল শিক্ষা করে। বিশুর কন্যা বব্বু ও নর্ত্তন-বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিল। এই সময়ে নবাব সাহামৎ জং (নওয়াজিস মহম্মদ) সিরাজুদ্দৌলা ও তদীয় ভ্রাতা ইক্রামুদ্দৌলার মহা সমারোহে বিবাহোপলক্ষে নৃত্যগীতাদির নিমিত্ত সাজহানাবাদ হইতে ১০০০০৲ টাকা দিয়া বিশুবেগ ও তাহার নর্ত্তকী-সম্প্রদায়কে মুর্শিদাবাদে আনয়ন করেন। এই নর্তকীগণের মধ্যে প্রাগুক্ত বালিকা মণিও ছিল। উৎসবান্তে নবাবের অনুরোধে দলস্থ লোকদিগকে তথায় কিছুদিন অবস্থিতি করিতে হয়। তৎপরে নবাব তাহাদিগকে বিদায় দিলে,তাহারা কিছুদিনের জন্য ঐ নগরেই বাস করিতে থাকে। গুণমুগ্ধ মীরজাফর মণির নৃত্যগীতের এতই পক্ষপাতী হইয়াছিলেন যে, প্রত্যহই তিনি তাহার গৃহে একবার করিয়া যাইতেন। ক্রমাগত যাতায়াতে তিনি তাহার প্রতি এতদূর আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন যে, মাসিক ৫০০৲ টাকা বেতনে আরও কিছুদিন তাহাকে তথায় থাকিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। মণিও স্বীকৃত হইল। মণির কিন্তু আর নৃত্যগীত ভাল লাগিল না—হৃদ্বিনোদন-বিদ্যাকুশলা মণি দেখিল, নবাবের মনোহরণ করিতে গিয়া সে নবাবকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে। নবাবের অঙ্কশায়িনী হইবার দুরাশা হৃদয়ে সে কিছুতেই পোষণ করিতে না পারিলেও, আল্লার নিকট প্রার্থনা করিল, দিনান্তে এক বারমাত্র মীরজাফরের দর্শন যেন তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে—ঘটিলও তাহাই। কিছুদিন পরে মীরজাফর মণিকে ভার্য্যারূপে গ্রহণ করিলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে বব্বুবেগমের সহিতও তাঁহার পরিণয়-ক্রিয়া সম্পাদিত হয়।[] এই সময় হইতেই মণিবিবি ‘মণিবেগম’ নামে খ্যাত হ’ন ও তাঁহাকে বাল্যের সঙ্গিনীদিগের সহিত সম্বন্ধ একেবারে বিচ্ছিন্ন করিতে হয়। স্বাধীনতাপ্রিয় যূথভ্রষ্ট বন্য করিণীকেও প্রেমের মোহন ফাঁসে আবদ্ধ হইতে হয়, কলাবিদ্যানিপুণা নর্ত্তকী মণিকে পর্দ্ধানশীনা হইয়া নবাবের অন্তঃপুরে বাস করিতে হইয়াছিল। মণিবেগমের গর্ভে নিজামুদ্দৌলা ও সৈয়ফুদ্দৌলা এবং বব্বু বেগমের গর্ভে মোবারকউদ্দৌলার জন্ম হয়। উত্তরকালে বুদ্ধিমত্তা ও আন্তরিক প্রণয়ের জন্য মণিবেগমই মীরজাফরের প্রধান বেগম হইয়াছিলেন। ইনিই মীরজাফরের নিকট সর্ব্বাপেক্ষা আদরের পাত্রী হইয়া উঠিয়াছিলেন। সিরাজের হিরাঝিলের প্রাসাদ হইতে মীরজাফর যে সমস্ত রত্নরাজি গোপনে আত্মসাৎ করিয়াছিলেন, পরে মণিবেগমই তৎসমুদয়ের অধিকারিণী হ’ন।

 নবাব মীরজাফর বৃদ্ধবয়সে শাসনকার্য্য পরিচালনে অসমর্থ হওয়ায় মীরকাশিমকে ডেপুটী নাজিমরূপে নিযুক্ত করেন। তিনি মুর্শিদাবাদে নামে-নবাব হইয়া থাকিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই কারণে তিনি শাসনভার পরিত্যাগ করায়, অনতিবিলম্বে কাউন্সিল কর্ত্তৃক পদচ্যুত হইলেন। ১৭৬০ খৃষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসে মীরকাশিম নবাব-নাজিম হইলেন। জাফর ও তাঁহার পত্নী মণিবেগম অনুচরবর্গসহ অর্থাদি লইয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। কলিকাতায় পৌঁছিয়া তিনি ময়দাপটীতে জমী ক্রয় করিয় তথায় গৃহ নির্মাণপূর্ব্বক মণিবেগমের সহিত কিছুদিন অবস্থান করিয়াছিলেন।[]

 ১৭৬৫ খৃঃ অব্দে মীরজাফরের মৃত্যু হইলে, নূতন নবাব নিয়োগের জন্য মুর্শিদাবাদের রাজকোষ কোম্পানীর কর্ম্মচারিবৃন্দের সম্মুখে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। মীরজাফরের পুত্রগণের মধ্যে যাহারা জীবিত ছিলেন, তন্মধ্যে নিজামুদ্দৌলাই জ্যেষ্ঠ; বৃদ্ধ নবাব অন্তিম কালে তাঁহাকেই মসনদে বসাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া যান। তাঁহার জীবদ্দশাতেই তদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র মীরণের মৃত্যু হইয়াছিল। কলিকাতা কাউন্সিলের সভ্যগণ মীরণের শিশুপুত্রের আবেদন অগ্রাহ্য করিয়া, নিজামুদ্দৌলাকেই মসনদে বসান। দেশীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা কেহই মীরণের শিশুপুত্রের অনুকূলে ছিলেন না, কারণ তাহার নিকট হইতে অর্থ প্রাপ্তির কোনই সম্ভাবনা ছিল না, অধিকন্তু মুসলমান ব্যবহার-শাস্ত্রানুসারে পিতৃব্য জীবিত থাকিলে, পৌত্রেরা পিতামহের বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইতে পারে না, এই সমস্ত কারণে পঞ্চদশবর্ষবয়স্ক নিজামুদ্দৌলাই[] মসনদ প্রাপ্ত হ’ন।

 নিজামতি প্রাপ্ত হইয়া নিজামুদ্দৌলা ও তাঁহার মাতা মণিবেগম উভয়েই নন্দকুমারকে দেওয়ান নিযুক্ত করিবার জন্য বিশেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু কলিকাতা কাউন্সিলের সভ্যেরা তাঁহার প্রতি তাদৃশ প্রসন্ন না থাকায়, তাঁহার মনস্কামনা সিদ্ধ হয় নাই। প্রচুর অর্থব্যয়ে অবশেষে রেজা খাঁই নায়েব-সুবাদার নিয়োজিত হন।[] ১৭৬৬ সালের এপ্রিল মাসে ক্লাইভ নিজামুদ্দৌলার সহিত মতিঝিলে কোম্পানীর প্রথম ‘পুণ্যাহ’ করেন। এই ঘটনার এক মাস পরেই তিনি বিষমজ্বরে প্রাণত্যাগ করেন।

 মীরজাফর ক্লাইভকে প্রকাশ্যভাবে যে ৫ লক্ষ টাকার দানপত্র লিখিয়া দিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পর সেই টাকা লইয়া যাইবার নিমিত্ত মণিবেগম ক্লাইভকে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে অনুরোধ করিয়া একখানি পত্র লেখেন; কিন্তু এই সময়ে নানা কার্য্যে ব্যস্ত থাকায়, বেগম সাহেবার নিকট হইতে ঐ টাকা বুঝিয়া লইতে ক্লাইভের কিছু বিলম্ব ঘটিয়াছিল। জাফরের ও নিজের স্মৃতি রক্ষার্থ ক্লাইভ এই টাকায় বিলাতে পিতৃমাতৃহীন বালকদিগের ও সৈনিকগণের বিধবা রমণীদের জন্য একটা দাতব্যভাণ্ডার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।

 নিজামুদ্দৌলার মৃত্যুর পর তদীয় ষোড়শবর্ষীয় সহোদর সৈয়ফুদ্দৌলা ১৭৬৬ খৃঃ অব্দের ২২শে মে তারিখে বাঙ্গালার মসনদে অধিরূঢ় হন। তাঁহার সময়ে মাতা মণিগেমের হস্তে সমস্ত কর্ত্তৃত্বের ভার অর্পিত হয়। সৈয়ফুদ্দৌলা নাবালক বলিয়া মণিবেগম অভিভাবক-স্বরূপে রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। ১৭৭০ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে মন্বন্তরের বর্ষে বসন্তরোগে সৈয়ফুদ্দৌলার মৃত্যু হয়।

 সৈয়ফুদ্দৌলার মৃত্যুর পর মীরজাফরের অন্যতমা ভার্য্যা বব্বু বেগমের দ্বাদশবর্ষীয় পুত্র মোবারক-উদ্দৌলা নবাব হন। পূর্ব্বের ন্যায় মহম্মদ রেজা খাঁই নায়েব রহিলেন। ১৭৭২ খৃঃ অব্দের প্রারম্ভে ওয়ারেন হেষ্টিংশ বাঙ্গালার গভর্ণর হইয়া আসিলেন। ইতিমধ্যে বাঙ্গালা হইতে আশানুরূপ অর্থাগম হওয়ায়, নব ব্যবস্থার আয়োজন হইতে লাগিল। ইংরাজের ক্ষতিপূরণ, মনরোর প্রাপ্য ও সেনাদলের প্রতিশ্রুত টাকা প্রভৃতি নাবালক নবাবের নিকট হইতে কি ভাবে আদায় করিতে পারা যায়, তাহার পরামর্শ চলিতে লাগিল।[] রাজকোষ হইতে অর্থাগমের সুবিধা হইতেছে না দেখিয়া নবাবের কর্ম্মচারীদিগের কার্য্যকলাপ পরিদর্শনের জন্য একটী গুপ্ত কমিটীর সৃষ্টি হইল। নন্দ কুমারের প্ররোচনায় ও সাক্ষ্যে, কমিটী নায়েব রেজা খাঁকে সকল অনর্থের মূল সাব্যস্ত করিলেও, তাঁহার নিকট হইতে সন্তোষজনক হিসাব নিকাশ লইবার জন্য পূর্ব্বাহ্ণে তাহাকে গোপনে কারাবদ্ধ করিয়া রাখিতে রেসিডেণ্ট মিড্‌ল্‌টন্ সাহেবকে পত্র লিখিলেন। ইহার কিছুদিন পরে রেসিডেণ্ট রেজা খাঁকে বন্দী করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করেন। মণিবেগম রেজা খাঁর ঈদৃশ অবমাননায় অত্যন্ত ব্যথিত হইয়াছিলেন। তিনি ইচ্ছা করিলে এ সময় যদিও অত্যাচারী রেজা খাঁর অনিষ্ট করিতে পারিতেন, কিন্তু তথাপি তিনি তাহা করেন নাই। তিনি রেজা খাঁর মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন। মণিবেগমের কৌশলে কলিকাতার কাউন্সিল নন্দকুমারের দ্বাবিংশতি বর্ষবয়স্ক পুত্র গুরুদাসকে ‘রাজা গৌরপৎ’ উপাধি ভূষিত করিয়া, দেওয়ান ও হিসাবরক্ষকের পদে এবং বিমাতা মণিবেগমকে নবাবের অভিভাবকরূপে রাজকার্য্য পরিদর্শন করিতে নিযুক্ত করিলেন। এইরূপে বুদ্ধিমতী মণিবেগম ক্ষমতাশালী মহারাজ নন্দকুমারকে বশীভূত করিয়া স্বপক্ষ সমর্থন করিবার সুযোগ পাইলেন।

 মোবারকের মাতা বুব্বু বেগমের পরিবর্ত্তে বিমাতা মণিবেগম কেন যে অভিভাবিকা নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাহার কোন সন্তোষজনক কারণ আমরা জ্ঞাত নহি; তবে এইমাত্র জানিতে পারা যায় যে, বব্বু বেগম স্বীয় পুত্রের অভিভাবিকা নিযুক্ত হইবার জন্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু গভর্ণর হেষ্টিংশ তাঁহার আবেদন অগ্রাহ করিয়া, মণিবেগমকে ঐ পদের উপযুক্ত স্থির করেন।

 কার্য্যের সুবিধার জন্য মণিবেগম রাজা গুরুদাসের অধীনে ইৎবর আলি খাঁ নামক একজন খোজাকে নিযুক্ত করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ইৎবর আলিই নায়েবপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। তিনি অতিশয় নির্ব্বোধ ও নীচমনা ছিলেন। পদগর্ব্বে-গর্ব্বিত ইৎবর সন্ত্রান্ত লোক দিগকে নির্যাতিত করিয়া রাজ্যে অশান্তি আনয়ন করিয়াছিলেন। মণিবেগম এই নির্ব্বোধ, শাসনকার্য্যে-অনভিজ্ঞ খোজার প্রতি কৃপাপরবশ হওয়ায়, অনেকেরই বিরাগভাজন হইয়াছিলেন এবং ইহারই কুপরামর্শে তিনি মোবারকের অভিভাবিকা হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 গভর্ণর হেষ্টিংশ মোবারকের ২৪ লক্ষ টাকা বৃত্তির পরিবর্ত্তে ১৬ লক্ষ টাকা ধার্য্য করিয়াছিলেন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্য্যন্ত ঐ টাকার ব্যয়ভার মণিবেগমের হস্তে দিয়াছিলেন। মণিবেগম ঐ টাকা নিম্নলিখিত বাবদে ব্যয় করিতেন।

 (১) নবাবের বিলাসিতা, সাংসারিক খরচ ও সামরিক ব্যয় নির্ব্বাহার্থ।

 (২) মীরজাফরের আত্মীয়স্বজন ও তাঁহার ‘রক্ষিতা’ স্ত্রীলোকদিগের বৃত্তি।

 (৩) আলিবর্দ্দীর বংশধরগণের বৃত্তি।

 (৪) পূর্ব্ববর্ত্তী নবাব-নাজিমগণের অনুগ্রহভাজন কয়েকজন উপযুক্ত লোকের বৃত্তি।

 ইহার পর নন্দকুমারের পরিণাম যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাস পাঠকের অবিদিত নাই। জাল অপরাধে তাঁহার ফাঁসি হয়। প্রায় ২ বৎসর কাল বিচারের পর রেজা খাঁ নিষ্কৃতি পাইলেন। তিনি তাঁহার পূর্ব্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করিলে, মণিবেগমকে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়া পদচ্যুত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে গুরুদাসও অপসৃত হইলেন। ১৭৯৩[] খৃঃ অব্দে মোবারকের মৃত্যু হয়।

 মণিবেগমের কার্য্যকালের হিসাব নিকাশের সময় তহবিলে অনেক টাকা কম পড়ায়, তিনি বলেন যে, গভর্ণর জেনারেল হেষ্টিংশ ও তাঁহার কর্ম্মচারীদিগের প্রীত্যর্থে ঐ টাকা ব্যয়িত হইয়াছে। নবাব বাবর জং তাঁহার প্রমাণে সন্তুষ্ট হইয়াই হউক, অথবা অপ্রতিহত-শক্তিসম্পন্ন মণিবেগমকে বশে রাখিবার জন্যই হউক, এ সম্বন্ধে কোনরূপ উচ্চবাচ্য করেন নাই।

 মােবারকের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র বাবর আলি খাঁ বাহাদুর ১৭৯৩ খৃঃ অব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তারিখে গভর্ণর জেনারেলের সম্মতিক্রমে নিজামতি প্রাপ্ত হন। তিনি ১৮১০ খৃঃ অব্দের ২৮ শে এপ্রেল তারিখে মৃত্যুমুখে পতিত হ’ন।

 বাবর জঙ্গির মৃত্যুর পর কাহাকে মসনদে বসান হইবে, এই বিষয় লইয়া অনেক বাদানুবাদ উত্থাপিত হইয়াছিল। মণিবেগম, রাজসভাষদবর্গ ও কয়েকজন সন্ত্রান্ত লােক মােবারকের দ্বিতীয় পুত্র কাশিম খাঁকে মসনদে বসাইবার জন্য মত দিলেন; কিন্তু রেসিডেণ্ট সাহেব এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন, বাবরজঙ্গের পুত্রকে মসনদে না বসাইয়া, তাঁহার খুল্লতাতকে নিজামতি দিলে, ন্যায়ের মর্য্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকিবে না। তিনি আরও বলিলেন, মহম্মদীয় ব্যবহার-শাস্ত্রানুসারে পিতার সমস্ত সম্পত্তি পুত্রেরই প্রাপ্য। ন্যায় ও আইনের অবমাননা করিতে আমি অসমর্থ। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রেসিডেণ্ট সাহেবের যুক্তির সারবত্ত্বা দেখিয়া, অগত্যা মণিবেগম তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন।

 ১৮১০ খৃঃ অব্দের ৫ই জুন আলিজা মসনদে আরূঢ় হইলেন। এইরূপে ১১ বৎসর ছয় মাস কাল রাজ্য চালাইবার পর ১৮২১ খৃঃ অব্দের ৬ই আগষ্ট রবিবার ৩টার সময় তাঁহার মৃত্যু হয়।

 ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী মণিবেগমকে অতিশয় সম্মানের চক্ষে দেখিতেন। ১৮১৩ খৃঃ অব্দে মণিবেগমের মৃত্যু হইলে,[] তাহার সম্মানার্থ তাঁহার বয়ঃসংখ্যা অনুসারে তোপধ্বনি করিবার আদেশ দিয়াছিলেন। জাফরগঞ্জ সমাধিভবনে নবাব-নাজিমদিগের সমাধির উত্তরে একটী প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে মণিবেগম সমাহিত হ’ন।

 মণিবেগমের মৃত্যুর পর তাঁহার সম্পত্তি লইয়া অনেক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছিল। আমরা কয়েকখানি পত্রে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাইয়াছি। বাহুল্যভয়ে এস্থলে আর সেগুলি উদ্ধৃত হইল না।

 মণিবেগমের মৃত্যুর পর তাঁহার অন্তঃপুর হইতে প্রাপ্ত ধনরাজী হইতে ১৬০৫৩৲ টাকা কর্ত্তন করিয়া অবশিষ্ট ১৪৮৫৪৫৪৸৹ টাকা তাঁহার নিজস্ব বলিয়া স্থিরীকৃত হয়। এই টাকা হইতে ৫০,০০০৲ টাকা মূল্যের বন্ধকী বহুমূল্য প্রস্তররাজির উদ্ধারকল্পে ও অন্যান্য বাবদে টাকা বাদ দিয়া ৫৮২৭৬০৸৴৫ টাকা নবাব বাহাদুরকে প্রদান করা হয়। অধিকন্তু মণিমুক্তা, স্বর্ণ-রৌপ্যের বাসন প্রভৃতি ও অন্যান্য সম্পত্তিও নবাবকে দেওয়া হইয়াছিল—ইহার মূল্যও প্রায় ৮৫০০০০৲ টাকা। এইরূপে মণিবেগমের মৃত্যুর পর, নবাব বাহাদুর জমি-জমা ও প্রাসাদ সংলগ্ন চক-বাজার

(যাহার বার্ষিক আয় ১২,০০০৲ টাকা) ব্যতীত অন্যূন ৫ লক্ষ টাকা পাইয়াছিলেন।[]

 বুদ্ধিমতী মণিবেগম কোপনস্বভাবা ছিলেন; কিন্তু তৎকালে পরদুঃখকাতরা রাণী ভবানী ব্যতীত তাঁহার ন্যায় দানশীলা রমণী কেহ ছিলেন না বলিলে অত্যুক্তি হয় না। এই দানশীলতার জন্য সকলে তাঁহাকে “মাদর-ই-কোম্পানী” অর্থাৎ ‘কোম্পানীর মাতা' নামে অভিহিত করিত। স্নেহময়ী জননীর আখ্যায় আখ্যাত হওয়া যে কম সৌভাগ্যের কথা নয়, এ কথা বলাই বাহুল্য। আমরা এখানে মণিবেগমের দানশীলতার একটী নিদর্শনের উল্লেখ করিলাম।

 এক সময়ে তাঁহার একজন সামান্য দাসী কিছু টাকার অভাববশতঃ স্বীয় কন্যার বিবাহ দিতে পারিতেছিল না। এই কথা কোনরূপে মণি বেগমের কর্ণে প্রবেশ করে। তিনি ইহা শুনিবামাত্র ঐ দাসীকে ৭০।৮০টী মোহর ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যাদি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। এই ঘটনাটী মুতাক্ষরীণে[] বিশেষরূপে বর্ণিত আছে। মুতাক্ষরীণ-অনুবাদক গোলাম হোসেন এই সময়ে মুর্শিদাবাদে ছিলেন। তাঁহার সমক্ষেই এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।

 নবাব-নাজিমদিগের প্রধানা মহিষীকে ‘গর্দ্দিনাসীন’ বেগম বলে। গর্দ্দিনাসীন বেগমেরা বাৎসরিক লক্ষ টাকা বৃত্তি পাইতেন। মণিবেগম এই বৃত্তির সমস্ত টাকা দানাদি পুণ্যকার্য্যে ব্যয় করিতেন।

 এক সময়ে প্রাতঃস্মরণীয় রাণী ভবানী মণিবেগমকে একখানি পালকী, ৩০ জন বাহক এবং তাহাদের ভরণপোষণের জন্য চাক্‌রাণ জমি উপঢৌকন দিয়াছিলেন। এই জমি অদ্যাপি নিজামতভুক্ত আছে।[১০]

 মণিবেগম মাসিক ১২০০০৲ টাকা[১১] ও বব্বুবেগম ৮০০০৲ টাকা বৃত্তি পাইতেন। মুর্শিদাবাদ সহরে যে চক মসজিদ অদ্যাপি বিদ্যমান আছে, তাহা মণিবেগমেরই কীর্ত্তি। তিনি ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে উহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

 অধ্যাপক শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাঁহার পুস্তকাগার হইতে কিছুদিন পূর্ব্বে আমায় একখানি মূল পারস্য গ্রন্থ দিয়াছিলেন। তাহাতে একজন সম্ভ্রান্ত ইংরাজ মণিবেগমের লিখিত একখানি পত্রের উত্তরে যাহা লিখিয়াছেন, তাহার বঙ্গানুবাদ আমরা নিম্নে প্রদান করিলাম। ইহা হইতে ইংরাজদের প্রতি তাঁহার যে একটা সহানুভূতি ছিল এবং তাঁহাদের সহিত আত্মীয়তা করিতে যে তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। পত্রখানি ১৩ই জানুয়ারী ১৮০০ খৃঃ অব্দে লিখিত।

 “আপনার বিনীত ভৃত্যের অসুস্থতার বিষয় অবগত হইয়া, আপনি যে সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন ও পুনরায় আরোগ্য-সংবাদ পাইয়া আমার প্রিয় বন্ধু নসীর মহম্মদ খাঁর মারফৎ আনন্দ প্রকাশ করিয়া যে অনুগ্রহ-লিপি পাঠাইয়াছেন, তাহা পাঠে যে কি পর্য্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম, তাহা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না। আপনি আমার ও আমার পরিবারবর্গের কুশলবার্ত্তা জানিতে চাহিয়া মহানুভবতারই পরিচয় দিয়াছেন; তাহার জন্য আমি আপনার নিকট চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ রহিলাম। ভগবানের নিকট প্রার্থনা, এই উদারমতি ও পরম হিতৈষিণী রমণীকে দীর্ঘজীবন দান করুন। শীতের প্রকোপবশতঃ আপনার বিনীত ভৃত্য কয়েক দিন যাবৎ অসুস্থ ছিল, কিন্তু এক্ষণে ভগবানের কৃপায় ও আপনার শুভ ইচ্ছায় সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত হইয়াছে। আমার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ, আপনি কৃপা করিয়া আপনার শারিরীক সর্ব্বাঙ্গীন কুশলদানে বাধিত করিবেন। অধিক আর কি নিবেদন করিব। ইতি—”

 সামান্য বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া, স্বীয় স্বাধীন সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে কেমন করিয়া একজন অবলা রমণী আপনার চতুঃপার্শ্বে প্রভুত্ব-বিস্তার করিতে পারে, মীরজাফর-বণিতা মণিবেগম তাহার প্রকৃষ্ট ও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মণিবেগম প্রভুত্ব ও বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারিণী হইয়া, দানাদি পুণ্যকার্য্যে মুক্তহস্তে অর্থ ব্যয় করিয়া, আত্মীয়-স্বজন এবং অধীন কর্ম্মচারী ও ভৃত্য দিগের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সতত দৃষ্টি রাখিয়া, বাঙ্গালায় অক্ষয় কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। তৎকালে নবাবের উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারিগণ গোপনে কলিকাতা কাউন্সিলের সদস্য ও অন্যান্য সম্রান্ত ইংরাজদিগের সহিত পরামর্শ করিয়া, আপন আপন ক্ষমতা ও প্রাধান্য বৃদ্ধি করিবার জন্য সতর্ক যত্নপর ছিলেন; বুদ্ধিমতী মণিবেগম তাঁহার নিয়োজিত গুপ্তচরের সাহায্যে ও অধিকাংশস্থলে তাঁহার ইংরাজবন্ধুগণের নিকট হইতে পূর্ব্বাহ্নেই সে সমাচার অবগত হইয়া, উদ্ধত প্রকৃতি কর্ম্মচারিগণকে সদয় ব্যবহার তাহাদের অভিষ্ট পথে অগ্রসর হইতে দিতেন না। তাঁহার মধুর প্রকৃতি গুণে সেই সকল কর্ম্মচারীই তাঁহার প্রধান সহায় হইয়া উঠিতেন।


চক মসজিদ।

  1. Burke's Speech at the Impeachment of Warren Hastings (Bangabasi Edition)-i-366-67.
  2. Walsh's “Murshidabad"-P. 152.
  3. নিজামুদ্দৌলা যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার মাতা মণিবেগমের ‘ফুলুরী’ খাইবার স্পৃহা বলবতী হয়। সময়ে সময়ে তাহার দোহদ-ক্রীয়া প্রচুর ফুলুরী সহযোগে সম্পন্ন হইত। তজ্জন্য নিজামুদ্দৌলা ভূমিষ্ঠ হইলে তাঁহার জননী তাঁহাকে ‘মীর ফুলুরী’ বলিয়া ডাকিতেন। Translator's Note. Mutaqherin-iii-2.
  4. Letter to the Court from Calcutta Council. September 1765—Long's Selections.
  5. Courts General Letter 15th April, 1771 and Consultations thereupon. Nizamat Records, Paper Book No. 3.
  6. ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’র ২৫৭ পৃষ্ঠায় শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়, বি-এল মহাশয় ১৭৯৬খৃঃ অব্দে মোবারকের মৃত্যু হইয়াছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু ওয়ালশ, সাহেব বলেন যে, ১৭৯৩ খৃ: অব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে মোরকের মৃত্যু হয়।
  7. শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়, বি-এল মহাশয় তাঁহার মুর্শিদাবাদ কাহিনীর ২৬২ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন, ১৮০২ খৃঃ অব্দে মণিবেগমের মৃত্যু হইয়াছিল; কিন্তু ওয়াল্‌শ সাহেবের ‘Murshidabad’ পুস্তকের ১৮৯ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে, মণিবেগম আলিজার নিজামতি প্রাপ্তির সময় (১৮১০ খঃ অব্দ জুন মাস) তাঁহাকে মসনদে বসান হইবে কি না, এই বিষয় লইয়া অনেক বাদানুবাদ উত্থাপিত করিয়াছিলেন। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে যে, ১৮১০ খঃ অব্দেও তিনি জীবিত ছিলেন। আবার আমরা Musnad of Murshidabad (পৃঃ ১৩৩) পুস্তক পঠে অবগত হই, ১৮১২ খৃঃ অব্দের এপ্রিল মাসে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন, কিন্তু পুনরায় এই পুস্তকেরই পরিশিষ্টে (পৃঃ ৩২০) উক্ত হইয়াছে যে, ১৮১৩ খৃঃ অব্দের ১০ই জানুয়ারী তারিখে বেগম সাহেবার মৃত্যু হয়। সম্ভবতঃ মুদ্রাকর প্রমাদবশতঃ নিখিলবাবুর পুস্তকে ১৮১৩ স্থলে ১৮০২ লিখিত হইয়াছে।
  8. ঐতিহাসিক নিখিলবাবু তাঁহার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনীর’ ২৬৩ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন— “মণিবেগমের বৃত্তি হইতে অনেক টাকা সঞ্চিত হইয়াছিল। গবর্মেণ্ট তাহা নবাব নাজিমকে প্রদান করেন নাই।”
  9. Mutaqherin-iii-147.
  10. “Musnad of Murshidabad.” P.-132
  11. রেসিডেণ্ট স্যামুয়েল মিড্‌ল্‌টনের ১৭৭২ খৃঃ অব্দের ১৮ই নবেম্বরের লিখিত নবাবী বৃত্তিবিভাগের হিসাবে লেখা আছে যে, মণিবেগম মাসিক ৮৩৩৩—৫—৩, বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা পাইতেন। (Nizamat Records, Book No. 3)