বিদ্যাসাগর/একাদশ অধ্যায়
১৮৪৭ খৃষ্টাব্দে বা ১২৫৪ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় মার্সেল্ সাহেবের অনুরোধে হিন্দী “বৈতাল পঁচ্চিসী” নামক গ্রন্থের বাঙ্গালা অনুবাদ করেন। “বেতাল-পঞ্চবিংশকা” নামক একখানি সংস্কৃত গ্রন্থও আছে।[১]
বিদ্যাসাগর মহাশয়, স্বয়ং সুগভীর সংস্কৃতজ্ঞ হইয়াও, মূল সংস্কৃতপ্রসঙ্গের অনুবাদ না করিয়া, অনুবাদিত হিন্দী গ্রন্থ অবলম্বন করিলেন কেন, এ প্রশ্ন উত্থাপিত হইতে পারে। এই সময় তিনি হিন্দী ভাষায় যথেষ্ট অধিকারলাভ করিয়াছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার পরিচয়-স্বরূপই বোধ হয় হিন্দী গ্রন্থের অনুবাদ। বস্তুতই অনুদিত “বেতালে” তাঁহার নবার্জ্জিত হিন্দী-ভাষাভিজ্ঞতার প্রকৃষ্ট পরিচয়।
হিন্দী “বৈতাল পঁচ্চিসী"র যে যে স্থান অশ্লীল বলিয়া মনে হইয়াছে, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা পরিত্যাগ করিয়াছেন। বেতালের ভাষা প্রাঞ্জল, ললিত, মধুর ও বিশুদ্ধ। তবে প্রথম সংস্করণে দীর্ঘ দীর্ঘ সমাসসমন্বিত রচনা হেতু “বেতাল” বড় শ্রুতিকঠোর হইয়াছিল। প্রথম সংস্করণে এইরূপ শ্রুতিকঠোর সমাসসমন্বিত বাক্যের প্রয়োগ ছিল, - “উত্তাল তরঙ্গমালাসঙ্কুল উৎফুল্ল ফেননিচয়চুম্বিত ভয়ঙ্কর তিমি মকর নক্র চক্র ভীষণ স্রোতস্বতীপতি প্রবাহমধ্য হইতে সহসা এক দিব্য তরু উদ্ভূত হইল।” এরূপ ভাষা বাঙ্গালার উপযোগী নয় বলিযা পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এই জন্য আধুনিক সংস্করণে ইহা পরিত্যক্ত হইয়াছে। মনস্বী ও বিচক্ষণ লেখকেরা সহজেই আপনাদের ভ্রম বুঝিয়া তাহা সংশোধন করিয়া লয়েন। জনসনের “রাম্বালা"র বাক্যাড়ম্বরে অনেকটা শ্রুতিকটু হইয়াছিল। ইহা তিনি বুঝিতে পারিয়া “কবিদিগের জীবনী”তে এ দোষ পরিত্যাগ করিতে সাধ্যানুসারে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। “রাম্বালা”র অপেক্ষা “কবি-জীবনী”র ভাষা অধিকতর সরল ও সহজ হইয়াছে। “বেতালে’র প্রথম সংস্করণের বাক্যাড়ম্বর প্রমাণ জন্য যে স্থল উপরে উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার পরিবর্ত্তে এখনকার সংস্করণে এইরূপ আছে,—“কল্লোলিনীবল্লভের প্রবাহমধ্য হইতে, অকস্মাৎ এক স্বর্ণময় ভূরুহ বিনির্গত হইল।”
বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক স্থলেই ঠিক অনুবাদ করেন নাই। যে স্থান উদ্ধৃত হইল, তাহার মূলেই ইহার প্রমাণ। হিন্দী মূলে এইরূপ আছে,—
“सागरमेंसे एक सोनेका तरवर निकला। वह जमुरुदके पात, पुखराजके फल, मुझेके फलॉसे ऐसा खुब लदा हुश्रा था, कि जिसका बयान नहीं हो सकता और उसपर मङ्गा सुन्दरी बीन हाथमें लिये मोठे मीठे सुरोंसे गाती थी।”
মূলে সাগরের বাক্যাড়ম্বরময় বিশেষণ নাই; কিন্তু বুক্ষের পাতা, মূল ও ফলের প্রকার আছে। অনুবাদে বিশেষণ আছে; কিন্তু ফলাদির প্রকার নাই।
“বাসুদেব-চরিতে"র ভাষা অপেক্ষা বেতালের ভাষা অধিকতর সংযমিত ও মার্জ্জিত। ভাষার একটু নমুনা এই -
“উজ্জয়িনী নগরে গন্ধর্ব্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে নৃপতির লোকান্তর প্রাপ্তি হইলে, সর্ব্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কু সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ, নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন্ন; তথাপি, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহারপূর্ব্বক স্বয়ং রাজেশ্বর হইলেন; এবং ক্রমে ক্রমে নিজ বাহুবলে, লক্ষযোজনবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া, আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন।”
মাইকেলের অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রথমে যেমন সমাদৃত হয় নাই, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “বেতাল"ও প্রথমে সেরূপ সমাদর পায় নাই। কেহ কেহ বলেন, শ্রীরামপুরের মিশনরীরা ইহার আদর প্রথম বাড়াইয়া দেন। অসম্ভবই বা কি? স্কটের “ওয়েভার্লি” প্রকাশিত হইবামাত্র সমাদৃত হয় নাই। তাহার সমাদর হইতে অনেক সময় লাগিয়াছিল। সেক্স্পিয়রের আদর তদীয় জীবিতকালে হয় নাই। জর্ম্মণ পণ্ডিতের গুণগ্রাহিতাগুণে তাঁহার প্রতিভার পরিচয় পাই; নহিলে সে প্রতিপত্তি প্রস্ফুটিত হইতে হয় তো আরও অনেক সময় লাগিত। মিল্টনের জীবদবস্থায় “প্যারাডাইস্ লস্টে"র প্রতিপত্তি ছিল না। এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যাহাই হউক, “বেতালে"র আদর প্রথমে হউক বা না হউক, যখন ইহা আদরণীয় হইয়া উঠে, তখন অনেকে বেতালের অনেক অংশ মুখস্থ করিয়া রাখিতেন।
“বেতালে"র প্রথম কয়েক সংস্করণে বিরাম-চিহ্ন অর্থাৎ কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি ব্যবহৃত হয় নাই; পরে সাধারণের সুবিধার্থ ব্যবহৃত হয়। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের জন্য কর্ত্তৃপক্ষ তিন শত টাকা দিয়া একশত খণ্ড বেতাল ক্রয় করিয়াছিলেন।
কয়েক বৎসর পূর্ব্বে ৺ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা ৺ যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এম্ এ, তর্কালঙ্কার মহাশয়ের জীবনচরিত লেখেন। এই জীবন-চরিতের ৪২ পৃষ্ঠায় “বেতাল"-সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কয়েক ছত্র লিখিত হয়,—
“বিদ্যাসাগর-প্রণীত 'বেতাল-পঞ্চবিংশতি'তে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা এতদূর সংশোধিত ও পরিমার্জ্জিত হইয়াছিল যে, রোমাল্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থ গুলির ন্যায় উহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।”
বিদ্যাসাগর মহাশয় এ কথা স্বীকার করেন নাই। তিনি বলেন, শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে “বেতাল” পড়াইয়া শুনান হইয়াছিল মাত্র। তাঁহাদের কথামতে দুই একটী শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল, ইহার প্রমাণার্থ তিনি ৺ গিরিশ চন্দ্র বিদ্যারত্নকে এই পত্র লেখেন,—
অশেষগুণাশ্রয়
শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভ্রাতৃপ্রেমাস্পদেষু
সাদরসম্ভাষণমাবেদনম্
তুমি জান কি না বলিতে পারি না, কিছু দিন হইল, সংস্কৃত কলেজের ভূতপূর্ব্ব ছাত্র শ্রীযুক্ত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম, এ, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ২৪ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে, “বিদ্যাসাগর প্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কারের দ্বারা এতদূর সংশোধিত ও পরিমার্জ্জিত হইয়াছিল যে, রোমাল্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।” বেতালপঞ্চবিংশতি সম্প্রতি পুনরায় মুদ্রিত হইতেছে। যোগেন্দ্র বাবুর উক্ত বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক বোধ হওয়াতে এই সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তাহা ব্যক্ত করিব, স্থির করিয়াছি। বেতাল পঞ্চবিংশতির সংশোধন বিষয়ে তর্কালঙ্কারের কত দূর সংস্রব ও সাহায্য ছিল, তাহা তুমি সবিশেষ জান। যাহা জান, লিপি দ্বারা আমায় জানাইলে, অতিশয় উপকৃত হইব। তোমার পত্রখানি, আমার বক্তব্যের সহিত, প্রচারিত করিবার অভিপ্রায় আছে, জানিবে ইতি।
বিদ্যারত্ন মহাশয় তদুত্তরে যে পত্র লেখেন, তাহা এইখানে সন্নিবেশিত হইল—
পরমশ্রদ্ধাস্পদ
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়
জ্যেষ্ঠভ্রাতৃপ্রতিমেষু
শ্রীযুক্ত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম, এ, প্রণীত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত গ্রন্থে বেতালপঞ্চবিংশতি সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলাম। তিনি লিখিয়াছেন, “বিদ্যাসাগর প্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এতদূর সংশোধিত ও পরিমার্জ্জিত হইয়াছিল যে, বোমাল্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।' এই কথা নিতান্ত অলীক ও অঙ্গত; আমার বিবেচনায় এরূপ অলীক ও অসঙ্গত কথা লিখিয়া প্রচার করা যোগেন্দ্রনাথ বাবুর নিতান্ত অন্যায় কার্য্য হইয়াছে।
এতদ্বিষয়ের প্রকৃত বৃত্তান্ত এই— আপনি, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করিয়া, আমাকে ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলেন। শ্রবণকালে আমরা মধ্যে মধ্যে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতাম। তদনুসারে স্থানে স্থানে দুই একটী শব্দপরিবর্ত্তিত হইত। বেতালপঞ্চবিংশতি বিষয়ে, আমার অথবা তর্কালঙ্কারের এতদতিরিক্ত কোন সংস্রব বা সাহায্য ছিল না।
আমার এই পত্রখানি মুদ্রিত করা যদি আবশ্যক বোধ হয় করিবেন, তদ্বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি ইতি।
|
কলিকাতা। |
সোদরাভিমানিনঃ |
পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ নাকি পণ্ডিতপ্রবর তারানাথতর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিকট উহা শুনিয়াছিলেন। যখন এই পত্র লেখালিখি হয়, তখন বাচস্পতি মহাশয় জীবিত ছিলেন না। প্রথমাবস্থায় সকলকেই যে একটুকু অধিক সতর্ক, কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত থাকিতে হয়, এই ঘটনায় তাহা সপ্রমাণ হইতেছে।
এই সময়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় “সংস্কৃত-যন্ত্র” প্রতিষ্ঠিত করেন। ৬০০\[২]ছয়শত টাকা ঋণ করিয়া একটী প্রেস ক্রয় করা হয়। এই প্রেসে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম ভারতচন্দ্রের গ্রন্থ মুদ্রিত করেন। গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কৃষ্ণনগরের মহারাজার বাড়ী হইতে আনীত হয়। মার্সেল সাহেব ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের জন্য ৬০০\ছয় শত টাকায় এক শত খণ্ড ভারতচন্দ্র ক্রয় করেন। এই টাকায় দেনা শোধ হয়। এই প্রেসে সাহিত্য, ন্যায়, দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। ক্রমে “প্রেসটী” লাভবান্ হইতে থাকে।
ভারতচন্দ্রের গ্রন্থ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বড় প্রিয় ছিল। ভারতচন্দ্রকে তিনি ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতেন। তাঁহার বিশ্বাস, কালিদাস যেমন সংস্কৃতে; ভারতচন্দ্র তেমনই বাঙ্গালায়; কালিদাসের গ্রন্থে যেমন সংস্কৃতের; ভারতচন্দ্রের গ্রন্থে তেমনই বাঙ্গালার পরিপাটী। অন্নদামঙ্গলের পরিমার্জ্জিত ভাষা, বাঙ্গালা ভাষার আদর্শ বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল। তিনি ভাবিতেন, বাঙ্গালার ভারতচন্দ্র খাঁটি বাঙ্গালী কবি। ভারতচন্দ্রের পর দাশরথি রায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও রসিকচন্দ্র রায় খাঁটি বাঙ্গালী কবি বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রীতি-ভাজন ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে তাঁহার কোন কোন বিষয়ে, বিশেষতঃ বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে মতের মিল না থাকিলেও, তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রকৃত বাঙ্গালা কবি বলিয়া শ্রদ্ধা করিতেন; পরন্তু তাঁহার রচনা প্রকৃত বাঙ্গালা কবিতার আদর্শ ভাবিয়া তাঁহার কবিতাকে আদর করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় ইংরেজি ভাব বা ছায়া থাকিত না, অথচ তাঁহার রচনার ভাষা তাঁহার নিজস্ব - বাঙ্গালা-ভাষার নিজস্ব। বাঙ্গালা ভাষার - বাঙ্গালী জাতির ইহা গৌরবের বিষয় বলিয়াই, বিদ্যাসাগর মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতার খ্যাতি প্রচার করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় কবি রসিকচন্দ্রের কবিতায়ও তিনি পরম প্রীতি প্রদর্শন করিতেন। রসিকচন্দ্র প্রকৃত বাঙ্গালী-কবিশ্রেণীর শেষ কবি। রসিকচন্দ্রের দেহান্তরে খাঁটি বাঙ্গালী কবিশ্রেণীর অবসান হইবে বলিয়াও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিশ্বাস ছিল। রসিকচন্দ্রের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের, যথেষ্ট বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল। রসিকচন্দ্রের কোন কোন কবিতা পুস্তক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে পাঠ্য-পুস্তকরূপে পরিগণিত হইয়াছিল। রসিকচন্দ্রের কবিতা তিনি এত ভাল বাসিতেন যে, আপনার দৌহিত্রদিগকেও তদ্রচিত অনেক কবিতা মুখস্থ করাইতেন। রসিকচন্দ্র আধুনিক সাহিত্য-সেবকদিগের মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট যেরূপ উৎসাহ পাইতেন, তেমন আর কাহারও নিকট পাইতেন না। শ্রীরামপুর বড়া গ্রামে রসিকচন্দ্রের নিবাস ছিল। কলিকাতায় আসিলে তিনি সর্ব্বাগ্রে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁহার যথেষ্ট আদর করিতেন। রসিকচন্দ্রের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইলে, তিনি শতমুখে বিদ্যাসাগরের সহৃদয়তা ও বদান্যতার কীর্ত্তন করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর পর রসিকচন্দ্র একবার কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। অন্যান্য অনেক বার বৃদ্ধ রসিকচন্দ্রের মুখে অনেক রস-ভাষা শুনিয়াছিলাম। তাঁহার বার্দ্ধক্য-জরা বদনমণ্ডলেও যৌবনসুলভ হাস্য-কৌতুকের লহরী দেখিয়াছি; এবার কিন্তু আর তাঁহার সে ভাব দেখি নাই, বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে বৃদ্ধের দেহ-যষ্টি ভগ্ন হইয়াছিল। পরম সুহৃদ্ বিদ্যাসাগরের গুণগরিমা ও বান্ধববাৎসল্য স্মরণ করিয়া তিনি কেবলমাত্র অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়াছিলেন। রসিকচন্দ্র বলিয়াছিলেন,“যখন বিদ্যাসাগর নাই, তখন আমিও আর নাই। আমি জীবন্মৃত হইয়া রহিলাম।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর বৎসর দুই পর রসিকচন্দ্র মানবলীলা সংবরণ করেন। সহৃদয় সুহৃদের সুদারুণ শোক অনেকটা রসিকচন্দ্রের মৃত্যুর কারণ হইয়াছিল।
- ↑ এই গ্রন্থ শিবদাস ভট্ট কর্ত্তৃক রচিত। সংবৎ ১৮৯৬ কৃষ্ণ-অষ্টমীতে বৃহস্পতিবার এই পুস্তকের রচনা সমাপ্ত হয়।
- ↑ বিদ্যাসাগর মহাশয় ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় উভয়েই এই মুদ্রাযন্ত্রের সমান অংশীদার ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতান্তর হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় কোন কারণে তর্কালঙ্কার মহাশয়ের উপর বিরক্ত হইয়া, তাঁহার সহিত সম্পর্ক পরিত্যাগ করিতে প্রয়াসী হন ৺ শ্যামাচরণ বিশ্বাস ও ৺ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সালিসি হইয়া গোল মিটাইয়া দেন। প্রেস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্পত্তি হয়।