বিদ্যাসাগর/দ্বাদশ অধ্যায়
দ্বাদশ অধ্যায়।
বাঙ্গালা-ইতিহাস, দুর্গাচরণের পরিচয়, ফোর্র্ট উইলিয়ম্
কলেজে পুনঃ প্রবেশ, ইংরেজি লিপি-পটুতা,
শুভঙ্করী, জুনিয়র সিনিয়র পরীক্ষা,
গুণবানের পুরস্কার, পুত্রের
জন্ম ও ভ্রাতৃবিয়োগ।
১২৫৬ সালে বা ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয় মার্শমান্ সাহেব কৃত হিষ্টরি অব্ বেঙ্গল (History of Bengal) অর্থাৎ ইংরেজিতে লিখিত বঙ্গদেশের ইতিহাস নামক পুস্তকের বঙ্গানুবাদ করেন। সর্ব্বত্র ইহার আদর হইয়াছিল। ভাষা মনোহর, প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ।
এই ইতিহাসে নবাব সিরাজুদ্দৌলার রাজত্বকাল হইতে বড় লাট লর্ড বেণ্টিকের রাজত্ব কাল পর্য্যন্ত শাসনবিবরণ বিবৃত হইয়াছে। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের মার্সেল-সাহেবের অনুরোধে ইহা রচিত হইয়াছিল। রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় সিরাজুদ্দৌলার পূর্ব্ববর্ত্তী ঘটনা লইয়া একখানি ইতিহাস লিখিয়াছিলেন। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় এই ইতিহাসকে দ্বিতীয় ভাগ বলিয়াছিলেন।
প্রথম সংস্করণে, এই ইতিহাস “মার্সেল সাহেবের অনুমত্যানুসারে লিখিত” এইরূপ দেখা যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইংরেজি পুস্তক হইতে এই প্রথম অনুবাদ করিলেন। সংস্কৃত ও হিন্দী হইতে বাঙ্গলা অনুবাদে বিদ্যাসাগর মহাশয় যে কৃতিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, এই ইতিহাসেও সেই কৃতিত্বের পরিচয় পাই। ইংরেজি হইতে হউক, হিন্দী হইতে হউক, আর সংস্কৃত হইতে হউক, অনুবাদ-কৃতিত্বে বিদ্যাসাগর অতুলনীয়। তবে ইতিহাসে অনুবাদের কৃতিত্ব প্রমাণ যেরূপ, গবেষণা ও প্রকৃত তথ্যনির্ণয়ের কৃতিত্বপ্রমাণ সেরূপ নহে। মার্শমান্ সাহেব, সিরাজুদ্দৌলাকে যেরূপ নিষ্ঠুর, নৃশংস ও অরাজনীতিজ্ঞ বলিয়া প্রমাণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন, গবেষণাকলে তাহার বিপরীত প্রমাণ করা যাইতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লাইব্রেরীতে যে সব ইতিহাস সংগ্রহ দেখিতে পাই, একটু মনোযোগ সহকারে তাহার আলোচনা করিলে, সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রের তাহাতেই বিপরীত প্রমাণ হইতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লাইব্রেরীতে সংগৃহীত ইতিহাসসমূহের সাহায্যে, আমি জন্মভূমিতে সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রের কলঙ্ক-প্রক্ষালনে প্রয়াস পাইয়াছিলাম। মনে হয়, তাহাতে কতকটা কৃতকার্য্য হইয়াছি। এই সব ইতিহাসের পর্যালোচনায়, অন্ধকুপের অস্তিত্ব-সম্বন্ধেও সন্দেহ উপস্থিত হইয়ছে।[১] ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস লিখিবেন বলিয়াই, বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রাচীনতম ও অধুনাতম ইতিহাস গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করিয়াছিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি মনষ্কামনা সিদ্ধ করিতে পারেন নাই। মনষ্কমনা সিদ্ধ হইল না বলিয়া, এক দিন আলমারিবদ্ধ এই সমুদয় ইতিহাস পুস্তক দেখিতে দেখিতে অকিরল-ধারায় অশ্রু বর্ষণ করিয়াছিলেন।
১২৫৬ সালে বা ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের “হেড রাইটার” এবং “ট্রেজারের” পদ শূন্য হয়। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই কাজ করিতেন। এই পদে নিযুক্ত থাকিয়াই দুর্গাচরণ বাবু মেডিকেল কলেজে পড়িতেন। ইনিই পরে প্রসিদ্ধ ডাক্তার হন। ইনি মেডিকেল কলেজের “আউট স্টুডেণ্ট” ছিলেন; অর্থাৎ বিনা বেতনে পড়িতে পাইতেন; পরীক্ষা দিয়া উপাধি পাইবার অধিকারী ছিলেন না। কেবল মার্সেল্ সাহেবের অনুগ্রহে তাঁহার পড়া-শুনা চলিত। চাকুরী করিতে করিতে একবার মার্সেল্ সাহেব, ছুটি লইয়া বিলাত গিয়াছিলেন। সেই সময় কর্ণেল রাইলি সাহেব তাঁহার স্থানে কাজ করিতেছিলেন। দুর্গাচরণ কাজ করিতে করিতে পড়া শুনা করেন, রাইলি সাহেবের এমন ইচ্ছা ছিল না। এই জন্য দুর্গাচরণকে বড়ই বেগ পাইতে হইয়াছিল। যাহা হউক, মার্সেল্ সাহেব ফিরিয়া আসিলে, দুর্গাচরণের আবার একটু সুবিধা হইয়াছিল। পরে ১২৫৬ সালে বা ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে তিনি “হেড রাইটারী” পদ পরিত্যাগ করেন। দুর্গাচরণের জীবনেও অনেক অলৌকিক ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত তাহার যে সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্ক-সংঘটিত ঘটনাবলী একে একে বিবৃত করিলে, একখানি অতি বৃহৎ পুস্তক হইতে পারে। দুর্গাচরণ বাবুর একখানি সম্পূর্ণ জীবনী বাঙ্গালা ভাষায় রচিত ও প্রকাশিত হওয়া উচিত। তাঁহার একখানি ইংরেজী জীবন-চরিত দেখিয়াছি। তাহাও সম্পূর্ণ নহে।
মার্সেল সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে দুর্গাচরণ বাবুর পদ গ্রহণ করেন।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের “হেড রাইটারের” বেতন ছিলহস্তলিপি
হস্তলিপি
১৮৫১ সালের ২১ অক্টোবর তারিখে রেবিনিউ বাের্ডের অফিসিয়েটিং সক্রেটারি সাহেবের লিখিত ৫১৮ নম্বরের পত্র।
৮০৲ আশী টাকা। এইবার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাংসারিক অবস্থা কতক সচ্ছল হইল। তিনি এ সময়ে স্বকীয় ইংরেজি বিদ্যার উন্নতিসাধনে অধিকতর যত্নশীল হইয়াছিলেন। যত্নে সিদ্ধি নিশ্চিতই। তাঁহার ইংরেজি লেখার লিপি-নিপুণ্য দেখিয়া সিবিলিয়ন্ সাহেবগণও সন্তুষ্ট হইতেন। বাঙ্গালা হস্তাক্ষরের ন্যায় তাঁহার ইংরেজি হস্তাক্ষরও সুন্দর হইয়াছিল। ইংরেজি হস্তাক্ষরের ছত্রগুলিও মুক্তাপঙ্ক্তিবৎ প্রতীয়মান হইত। তাঁহার বাঙ্গালা ও ইংরেজি হস্তাক্ষরের নমুনা স্থানান্তরে প্রকাশিত হইল। লিপি-নৈপুণ্যেরও পরিচয় যথাস্থানে পাইবেন।
১২৫৬ সালে বা ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে হিন্দু-কলেজের কয়েকজন ছাত্র “শুভকরী” নামে এক পত্রিকার প্রচার করেন।[২] বিদ্যাসাগর মহাশয় কতককগুলি লোকের অনুরোধ-পরবশ হইয়া এই কাগজে বাল্যবিবাহের দোষ উল্লেখ করিয়া একটী প্রবন্ধ লিখেন। কাহারও কাহারও মতে “চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে লোকে যে জিহ্বা বিদ্ধ করে, পিঠ ফুঁড়িয়া চড়ক করিয়া থাকে এবং মৃত্যুর পূর্ব্বে যে গঙ্গায় অন্তর্জ্জলি করে, এই দ্বিবিধ প্রথার নিবারণার্থে প্রবন্ধ লিখিবার জন্য দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের সুলেখক মাধবচন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত গোস্বামীর প্রতি বিদ্যাসাগর ভার দিয়াছিলেন।” রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখার গুণে “শুভকরী” কতকটা প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল। পণ্ডিত মাধবচন্দ্র গোস্বামীর লিপি কৌশলেও উহার সুনাম হওয়া যে ঠিক সংবাদ, তাহা আমরা অক্ষয়কুমার দত্তের ন্যায় শ্রদ্ধেয় ও বিশ্বস্ত লোকমুখে অবগত হইয়াছি। শুভকরীর অস্তিত্ব কিন্তু অল্প দিন মাত্র ছিল। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়, হিন্দু কলেজ, হুগলী কলেজ এবং ঢাকা কলেজের সিনিয়ার ছাত্রদিগের বাঙ্গালা পাঠ্যের পরীক্ষক হন। রচনার প্রশ্ন ছিল, স্ত্রী-শিক্ষা হওয়া উচিত কি না। এই সূত্রে কলিকাতার বর্ত্তমান বালিকা বা মহিলা বিদ্যালয় বীটন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ড্রিঙ্ক ওয়াটার বীটন্ সাহেবের সহিত তাঁহার সদ্ভাব সংস্থাপিত হয়।[৩]
যে সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের “হেড্ রাইটার,” সেই সময় তিনি সংস্কৃত কলেজের “জুনিয়র” ও “সিনিয়র” বিভাগের বাৎসরিক পরীক্ষা গ্রহণ করিবার ভার প্রাপ্ত হন। এ কাজেও তাঁহাকে সাহেবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিতে হইয়াছিল। তিনি এবং জর্ম্মাণ-পণ্ডিত ডাক্তার রোয়ার সাহেব উপরি-উক্ত দুই পরীক্ষার প্রশ্ন প্রস্তুত করিতেন। রোয়ার সাহেব[৪] সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন বটে; কিন্তু, সংস্কৃত প্রশ্নপ্রণয়নে তাঁহাকে বিদ্যাসাগরএই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
শ্ৰীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন
রামকমল ভট্টাচার্যাকে বিদ্যাসাগর মহাশয় যে পুরস্কার দিয়াছিলেন, তাহার জন্য তাঁহাকে তদানীন্তন শিক্ষা-বিভাগের (এডুকেশন কৌন্সিলের) কর্তৃপক্ষের সম্মতি লইতে হইয়াছিল। ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর মহাশয় অনুমতি পাইবার জন্য কৌন্সিলে পত্র লিথিয়ছিলেন। কৌন্সিল ১২ই ডিসেম্বর পত্র লিখিয়া সম্মতি প্রদান করেন। কৌন্সিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই কাজটকে তাঁহার বদান্ততার উপযোগী বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।
১২৫৬ সালে ৩০শে কার্ত্তিক বা ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে ১৪ই নবেম্বর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ইহার কিছুদিন পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবার ভ্রাতৃবিয়োগ ঘটে। তাঁহার পঞ্চম সহোদর হরিশ্চন্দ্র কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। বয়স তাহার আট বৎসর মাত্র। কলিকাতায় আসিবার কিয়দ্দিন পরে তাঁহার ওলাউঠা রোগে মৃত্যু হয়। বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগর মহাশয় ভ্রাতৃশোকে বড়ই কাতর হইয়া পড়েন। এই সময়ে তিনি শোকাতুরা জননীকে সান্ত্বনা করিবার জন্য তাঁহাকে কলিকাতায় লইয়া আসেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী কলিকাতায় আসিয়া রাজকৃষ্ণ বাবুর বাড়ীতে ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, রাজকৃষ্ণ বাবুর মাকে 'মা' বলিয়া ডাকিতেন। রাজকৃষ্ণ বাবুর মাতাও তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন। শোক কিছু শান্ত হইলে ৫।৬ পাঁচ ছয় মাস পরে বিদ্যাসাগর মহাশয জননীকে বীরসিংহে পঠাইয় দেন। তিনি নিজে কিন্তু সহজে ও শীঘ্র ভ্রাতৃশোক ভুলিতে পারেন নাই। বাদ্যধ্বনি শ্রুতিগোচর হইলে তিনি চক্ষের জলে ভাসিয়া যাইতেন। এই সময় তাঁহার মৃত ভ্রাতার কথা হৃদয়ে জাগরূক হইত। হরিশ্চন্দ্র এক দিন কোন বিবাহের বাজনা শুনিয়া বলিয়ছিলেন, “দাদা! আমার বিয়ের সময তোমায় এমনই বাজনা করতে হবে।” কনিষ্ঠের সেই সুধাবর্ষিণী সুমিষ্ট কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়েব হৃদয়ে শক্তিশেল সম বিদ্ধ হইয়াছিল।
- ↑ ইহার বিশেষ বিবরণ আমার রচিত “ইংরেজের জয়” নামক গ্রন্থে স্রষ্টব্য।
- ↑ পুরাতন শুভকরী পাইবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলাম। চেষ্টা বিফল হইয়াছে। “উত্তরপাড়া” লাইব্রেরীতে “ফাইল” ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ফাইল নষ্ট হইয়া গিয়াছে। রাজা প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে ১৩০১ সালের ১২ই অগ্রহায়ণ এই সংবাদ দেন।
- ↑ ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে বা ১২৫৬ সালে বীটন্ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার নাম প্রথমে ছিল হিন্দু-বালিকা বিদ্যালয়। প্রথমে ২৫ পঁচিশটী বালিকা লইয়া এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ↑ ইনি সাহিত্যদর্পণ নামক অলঙ্কার-গ্রন্থ ও ভাষা-পরিচ্ছেদ নামক ন্যায়শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থের ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়াছেন।