ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা/প্রাচীন ভারতে সমাজ ও রাষ্ট্র
প্রাচীন ভারতে সমাজ ও রাষ্ট্র
মনুষ্যত্বের উচ্চতম বিকাশের জন্য যে সকল জিনিষ প্রয়োজন, আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম্ম, চিন্তাশীলতা, নৈতিকতা, কলাবিদ্যা,—এই সকল বিষয়ে প্রাচীন ভারত যে সভ্যতার অতি উচ্চ শিখরে উঠিয়াছিল, সে সম্বন্ধে আর কোন তর্কের স্থান নাই, ভারতের বিরুদ্ধ সমালোচকরাও তাহা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন। সেই গৌরবময় ভারতীয় জীবনের যে সকল প্রমাণ ও নিদর্শন আজও বর্ত্তমান রহিয়াছে, তাহা হইতে নিঃসন্দেহেই জানা যায়, ভারতের সভ্যতা যে কেবল উচ্চ ছিল তাহা নহে, জগতে যে পাঁচ ছয়টি উচ্চতম সভ্যতার ইতিহাস আজও পাওয়া যায়, ভারতীয় সভ্যতা তাহাদেরই অন্যতম। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন, যাঁহারা আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিষয় সমূহে ভারতের উচ্চ কৃতিত্ব স্বীকার করেন, তথাপি তাঁহারা মন্তব্য প্রকাশ করিতে চাহেন যে, পার্থিব জীবনকে য়ুরোপ যেমন শক্ত, সমর্থ, উন্নতিশীলভাবে সঙ্ঘবদ্ধ ও সুগঠিত করিতে পারিয়াছে, ভারত তাহা করিতে সমর্থ হয় নাই, এবং শেষ পর্য্যন্ত ভারতের মনীষিগণ সংসারত্যাগ, কর্ম্মত্যাগ ও ব্যক্তিগত মুক্তির সাধনার দিকেই ঝুঁকিয়াছিলেন। অন্ততঃ পক্ষে ভারতের সভ্যতা কতকদূর বিকশিত হইয়া থামিয়া গিয়াছে, আর অগ্রসর হইতে পারে নাই, তাহার মধ্যে নানা ত্রুটি ও গ্লানি আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে।
ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটা আজ বড়ই বেশী করিয়া বাজিতেছে; কারণ, বর্ত্তমান যুগের মানুষ, এমন কি, বর্ত্তমান যুগের শিক্ষিত মানুষও রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিকেই জীবনের মধ্যে প্রধান স্থান দিতেছে। আধ্যাত্মিক ও মানসিক উৎকর্ষতার কেবল ততটুকুই আদর আছে, যতখানি তাহারা রাষ্ট্রনীতিক ও অর্থনীতিক জীবনের সাফল্যে সহায়তা করিতে পারে। প্রাচীন যুগের মানুষরা আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম্ম, সাহিত্য, শিল্পকে যেমন একটা নিজস্ব মূল্য দিত এবং সেইগুলিকেই মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিষ বলিয়া গণ্য করিত, বর্ত্তমান মানুষ তাহা করিতে চাহে না। যদিও এই বর্ত্তমান বৈষয়িক মনোভাব মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে নীচ ভোগপরায়ণ স্বার্থপর দ্বন্দ্বপ্রবণ করিয়া তুলিয়া সংসারে নানা দুঃখ ও অনর্থের সৃষ্টি করিতেছে এবং মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের পরিপন্থী হইতেছে, তথাপি ইহার মধ্যে এই সত্যটুকু রহিয়াছে যে, যদিও কোন সভ্যতার গুণ বিচার করিতে হইলে প্রথমেই দেখিতে হয় যে, মানুষের ভিতরটিকে উন্নত করিতে, তাহার মন ও আত্মাকে উন্নত করিতে তাহার ক্ষমতা কতদূর, তথাপি সে সভ্যতা পূর্ণ হয় না, যদি সে বাহ্য জীবনকেও সুষ্ঠুভাবে গঠিত করিয়া ভিতরে ও বাহিরে সামঞ্জস্য রাখিতে না পারে। উন্নতি বলিতে ইহাই বুঝায়, শুধু উপরের জিনিষেরই উৎকর্ষসাধন করিলে চলিবে না, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজনীতিকেও এমন ভাবে শক্ত-সমর্থ করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে জাতি জীবন-সংগ্রামে টিকিতে পারে, কেবল ব্যক্তিগতভাবে নহে, কিন্তু জাতিগত ভাবে পূর্ণতার দিকে নিশ্চিতভাবে অগ্রসর হইতে পারে, এবং বাহিরের জীবনে এমন সজীবতা ও সবলতা থাকে, যেন তাহার মধ্যে আত্মা ও মনের ক্রিয়া ক্রমশঃ উন্নতভাবে প্রকাশিত হইতে পারে। যে সভ্যতা এই সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে পারে না, তাহার আদর্শ বা কার্য্য-কারিতার দোষ ও ত্রুটি রহিয়াছে, সে সভ্যতাকে পূর্ণাঙ্গ বলা চলে না।
ভারতীয় সমাজের ভিতর ও বাহির যে সকল আদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইত, তাহা ছিল অতি উচ্চ, সমাজ-শৃঙ্খলার ভিত্তি ছিল অতি সুদৃঢ়, ইহার মধ্যে যে তেজীয়ান্ প্রাণশক্তি ক্রিয়া করিত, তাহাতে ছিল অসাধারণ সৃষ্টিশক্তি ও ঐশ্বর্য্য; ভারত বাহিরের জীবনকে যে ভাবে গঠিত করিরাছিল, তাহাতে হইয়াছিল প্রাচুর্য্য, বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য, সৌন্দর্য্য, উৎপাদনশীলতা, গতি। ভারতের ইতিহাস, শিল্প ও সাহিত্যের যে সকল নিদর্শন বর্ত্তমান রহিয়াছে, তাহা হইতে বুঝা যায় যে, ইহাই ভারতীয় সভ্যতার প্রকৃত স্বরূপ এবং ইহার অবনতির যুগেও সেই অতীত মহত্ত্বের সমস্ত চিহ্ন একেবারে লুপ্ত হইয়া যায় নাই। তাহা হইলে ভারতীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়, ইহা বাহিরের জীবনকে খর্ব্ব করিয়াছে, তাহার কারণ কি? এই অভিযোগকে যাঁহারা বাড়াইয়া দেখান, তাঁহারা ভারতীয় সভ্যতার অবনতি ও ধ্বংস দেখিয়াই বিচার করেন এবং অবনতির যুগের লক্ষণগুলিই ভারতীয় সভ্যতার প্রকৃত স্বরূপ বলিয়া ঘোষণা করেন। তাঁহাদের অভিযোগের প্রধান কথা এই যে, ভারত কখনই স্বাধীন সমর্থ রাষ্ট্র গঠন করিতে পারে নাই; চিরকাল ভারত শতধা বিচ্ছিন্ন এবং তাহার সুদীর্ঘ ইতিহাসের বহুকালই ভারত পরাধীন; অতীতে তাহার অর্থনীতিক ব্যবস্থার যাহাই গুণ থাকুক, তাহা অচলায়তন হইয়া পড়ে, সময়ের প্রয়োজনের সহিত তাহা পরিবর্ত্তিত ও বিকশিত হইতে পারে নাই, ফলে বর্ত্তমান যুগে আসিয়াছে—দারিদ্র্য ও নিষ্ফলতা; বংশমর্য্যাদানুযায়ী শ্রেণীবদ্ধ ভারতীয় সমাজ উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে নাই, তাহা জাতি-ভেদজর্জ্জরিত, নিষ্ঠুর অমানুষিক প্রথাসমূহে পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, অতীতের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ইহাকে নিক্ষেপ করা ছাড়া আর উপায় নাই, ইহার স্থানে য়ুরোপীয় সমাজ-ব্যবস্থার স্বাধীনতা, দক্ষতা ও পূর্ণতার আমদানী করিতে হইবে। এই সব ব্যাপারের প্রকৃত সত্য কি তাহা পূর্ব্বে জানা প্রয়োজন, তাহার পর ভারতীয় সভ্যতার রাষ্ট্রনীতিক, অর্থনীতিক ও সামাজিক দিকের গুণাগুণ বিচার করিলেই চলিবে।
ভারতের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা হইতে এবং তাহার প্রাচীন অতীত সম্বন্ধে অসম্পূর্ণ জ্ঞান হইতেই এই প্রবাদের উৎপত্তি হইয়াছে যে, ভারত রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারে অক্ষমতা দেখাইয়াছে। বহুকাল এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ভারত আদিম আর্য্য ও বৈদিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাধীন ব্যবস্থা হইতে একেবারে ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব ও অত্যাচার-পীড়িত সমাজব্যবস্থায় এবং স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের অধীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় উপনীত হইয়াছিল এবং তাহার পর হইতে ভারতে এ-যাবৎ এই দুইটি ব্যবস্থাই বাহাল আছে। ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে এই ধারণা বর্ত্তমান ঐতিহাসিক গবেষণার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসে যাহা বৈশ্য যুগ বলিয়া উক্ত, কলকারখানার বিস্তারে ধনের জন্য কাড়াকাড়ি এবং শ্রমিকের শোষণ চলিয়াছে এবং সাধারণতন্ত্রের নামে পার্লামেণ্টারি গবর্ণমেণ্ট চলিয়াছে, ভারতের ইতিহাসে এই industrialism ও parliamentarismএর আবির্ভাব কখনও হয় নাই, এ কথা সত্য। কিন্তু যখন লোকে কিছু ভাবিয়া চিন্তিয়া না দেখিয়াই য়ুরোপের এই দুইটি আদর্শের প্রসংশা করিত, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চরম উৎকর্ষ বলিয়া মনে করিত, সে দিন আর নাই। ইহাদের দোষ-ত্রুটি এখন লোকলোচনে ধরা পড়িতেছে এবং ইহাদের মাপকাঠিতে কোন প্রাচ্য সভ্যতাকে পরিমাপ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। য়ুরোপে প্রচলিত সাধারণতন্ত্র ও পার্লামেণ্টারি গবর্ণমেণ্টের শাসনতন্ত্র প্রাচীন ভারতেও ছিল, আমাদের অনুরূপ দেশের কেহ কেহ ইহা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু এরূপ চেষ্টা ভ্রান্ত। প্রাচীন ভারতে সাধারণতন্ত্রের একটা ভাব খুবই প্রবল ছিল, তাহা কতকটা পার্লামেণ্টারি অনুষ্ঠানের মতই মনে হয় বটে, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা ভারতের নিজস্ব এবং তাহা আদৌ বর্ত্তমান পার্লামেণ্টারিজ্ম্ বা সাধারণতন্ত্রের সদৃশ নহে। আর এই ভাবে যদি আমরা দেখি, তাহা হইলে প্রাচীন ভারতবাসী সমাজের মানসিক ও দৈহিক অবস্থার সহিত মিলাইয়া যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করিয়াছিল, তাহাতে তাহাদের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভার পরিচয় পাইয়া চমৎকৃত হইতে হয়, কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষায় সম্পূর্ণ বিভিন্ন য়ুরোপের সহিত তুলনা করিয়া সে ব্যবস্থার প্রকৃত মর্য্যাদা বুঝা যায় না।
প্রাচীন আর্য্যজাতির মধ্যে যে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রচলিত ছিল, এবং যাহা মানব-সমাজবিকাশের এক অবস্থায় সকল দেশের মানুষের মধ্যেই সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়, সেই রাষ্ট্রতন্ত্রেরই একটা বিশেষ রূপ লইয়া ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ইতিহাস আরম্ভ হয়। কুল বা গোষ্ঠী লইয়াই এই তন্ত্র গঠিত ছিল এবং ইহার মূল ছিল কুল বা গোষ্ঠীর অন্তর্গত সকল মনুষ্যের মধ্যে সাম্য। প্রথমাবস্থায় কোন বিশেষ স্থানে এই কুল আবদ্ধ থাকিত না, তখনও স্থান হইতে স্থানান্তরে সরিয়া যাইবার প্রবল আগ্রহ ছিল, এবং কোন স্থানে যে কুল বাস করিত, সেই কুলের নাম অনুসারেই সেই স্থানের নাম হইত, যেমন ‘কুরুদেশ’ বা শুধু ‘কুরু’, মালব দেশ বা শুধু মালব। যখন আর্য্যদের যাযাবর প্রবৃত্তি লোপ পায় এবং তাহারা নির্দ্দিষ্ট স্থানে স্থায়িভাবে বাস করিতে আরম্ভ করে, তখনও কুল বা গোষ্ঠীপ্রথা অক্ষুণ্ণ থাকে; কিন্তু তখন পল্লী-সমাজই হয় সেই রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল আকার বা কেন্দ্র। জনসাধারণ সাম্প্রদায়িক বিষয়ের আলোচনা করিবার নিমিত্ত অথবা যজ্ঞ ও ধর্ম্মানুষ্ঠানের নিমিত্ত অথবা যুদ্ধায়োজনের নিমিত্ত সভায় সমবেত হইত, সেই সভার নাম ছিল “বিশা।” এই সভাই ছিল জনসাধারণের সমবেত শক্তির প্রতীক এবং বহুকাল এই সভার ভিতর দিয়াই সম্প্রদায়ের সাধারণ জীবন পরিচালিত হইত। এই সভার শীর্ষস্থানীয় এবং জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে ছিলেন রাজা। যখন এই রাজার পদ পুরুষানুক্রমিক হয়, তখনও বহুকাল রাজার অভিষেকে জনসাধারণ কর্ত্তৃক তাঁহাকে অনুমোদিত ও নির্ব্বাচিত হইতে হইত। যজ্ঞরূপ ধর্ম্মানুষ্ঠানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতশ্রেণীর উদ্ভব হয়, তাঁহারা যজ্ঞের অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত ছিলেন এবং বাহ্যানুষ্ঠানের পশ্চাতে যে নিগূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব রহিয়াছে, সে সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ছিলেন, এই ভাবেই মহান্ ব্রাহ্মণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। প্রথম প্রথম এই সকল পুরোহিত পুরুষানুক্রমিক ছিলেন না, তাঁহারা অন্যান্য বৃত্তিও অনুসরণ করিতেন এবং তাঁহারা সাধারণ জীবনে জনসাধারণেরই অনুরূপ ছিলেন। এই যে সহজ স্বাধীন স্বাভাবিক সমাজতন্ত্র, ইহাই সমগ্র আর্য্য ভারতে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়।
এই আদিম সমাজতন্ত্রের পরবর্ত্তী বিকাশ কতক দূর পর্য্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের ন্যায়ই হইয়াছে, কিন্তু সেই সঙ্গে এখানে এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হইয়াছে, যাহাতে ভারতীয় সভ্যতার রাষ্ট্রনীতিক, অর্থনীতিক ও সামাজিক ধারা অন্যান্য দেশ হইতে বিভিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। বংশানুক্রমনীতি অতি প্রাচীনকালেই ভারতে স্পষ্ট হইয়া উঠে এবং ক্রমশঃ উহা এমন প্রাধান্য লাভ করে যে, সর্ব্বত্র সকল সঙ্ঘ ও অনুষ্ঠানের উহাই ভিত্তি হইয়া দাঁড়ায়। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, এক শক্তিশালী শাসক ও যোদ্ধৃশ্রেণীর আবির্ভাব হয়, সমাজের অবশিষ্ট লোক ব্যবসায়ী, শিল্পী ও কৃষক-শ্রেণীতে বিভক্ত হয় এবং এক দাস বা সেবকশ্রেণীর সৃষ্টি হয়। সম্ভবতঃ আর্য্যগণ যাহাদিগকে যুদ্ধে পরাজিত করিতেন, তাহারা ভৃত্য ও শ্রমিক হইত, তাহাদিগকে লইয়াই এই দাস-শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। ভারতবাসীর মনের উপর বহু প্রাচীনকাল হইতেই ধর্ম্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রাধান্য আছে। এই জন্যই সমাজের শীর্ষভাগে ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়; তাঁহারা পুরোহিত, পণ্ডিত, আইন-কর্ত্তা, বেদবিৎ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। অন্যান্য দেশেও এইরূপ শ্রেণীর আবির্ভাব হইয়াছে বটে, কিন্তু ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণসম্প্রদায় যেমন স্থায়ী, সুনির্দ্দিষ্ট, সমুচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে, এমনটি আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। ভারতবাসীর ন্যায় যে সকল দেশের লোকের মানসিক ভাব জটিল নানামুখী নহে, সেখানে এরূপ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইলে, তাহারাই সমাজে সর্বেসর্ব্বা হইয়া পড়িত। কিন্তু যদিও ব্রাহ্মণদের প্রভাব ক্রমশঃই বর্দ্ধিত হইতেছিল এবং শেষ পর্য্যন্ত তাহারাই প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, তথাপি ভারতে ব্রাহ্মণসম্প্রদায় কোন দিনই রাজশক্তিকে অধিকার করে নাই বা করিতে পারে নাই। রাজার ও জনসাধারণের পুরোহিত, গুরু, বিধিকর্ত্তৃরূপে ব্রাহ্মণরা আশ্চর্য্য ক্ষমতা বিস্তার করিতেন বটে, কিন্তু প্রকৃত রাষ্ট্রশাসনের ভার কার্য্যতঃ রাজা, ক্ষত্ত্রিয় অভিজাতসম্প্রদায় এবং জনসাধারণের হস্তেই ন্যস্ত ছিল।
কিছু কাল এক বিশেষ স্থান অধিকার করিয়াছিলেন ঋষি। উচ্চ অধ্যাত্ম-উপলব্ধি ও জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিই ঋষি, যে কোন শ্রেণী হইতে তাঁহার আবির্ভাব হইত, কিন্তু তিনি তাঁহার আধ্যাত্মিক চরিত্রের গুণে সকলের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতেন, রাজা তাঁহাকে সম্মান করিতেন, তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন এবং সমাজের সেই অগঠিত অবস্থায় তিনি একাই সমাজের নূতন বিধি-ব্যবস্থার পরিবর্ত্তন ও বিকাশ করিতে সমর্থ হইতেন। ভারতীয় মনোবৃত্তির ইহা একটি বিশিষ্ট লক্ষণ যে, সকল কার্য্যে, এমন কি বাহ্যতম সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারেও ভারতবাসী আধ্যাত্মিক সার্থকতার দিকে, ধর্ম্মের প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রাখিয়াছে, প্রত্যেক শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের ধর্ম্ম কি, কর্ত্তব্য কি, অধ্যাত্ম-জীবনবিকাশে উপযোগিতা কি, তাহা স্পষ্টভাবে নির্দ্দিষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছে। জাতির মনের উপর এই স্থায়ী ছাপ ঋষিগণই দিয়া গিয়াছিলেন; ভারতীয় সভ্যতা, ভারতবাসীর শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনের ধারা যে ধর্ম্ম ও আধ্যাত্মিকতার উপরে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এবং জীবনের সকল কার্য্য, সকল চেষ্টার ভিতর দিয়া দিব্য অধ্যাত্মজীবনের বিকাশ করাই যে ভারতীয় জীবনের মূল বৈশিষ্ট্য হইয়াছে, তাহার মূলই এই ঋষিরা। পরবর্ত্তী কালে আমরা দেখিতে পাই, স্মার্ত্ত ব্রাহ্মণরা সমাজে তৎকালে প্রচলিত রীতি-নীতি সংগ্রহ করিয়া সেই সকলকে সেই প্রাচীন ঋষিদের নামে চালাইয়া দিয়াছেন এবং এই ভাবে মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা প্রভৃতির উদ্ভব হইয়াছে। কিন্তু ভারতের সমাজে ও রাষ্ট্রে পরে যে পরিবর্ত্তনই হউক, এই যে মূল বৈশিষ্ট্য ধর্ম্ম ও আধ্যাত্মিকতা, ইহা চিরদিনই ভারতবাসীর জীবনে ইহার প্রভাব বিস্তার করিয়াছে এবং অবশেষে যখন উহা প্রাণহীন বিধিনিষেধ ও আচার-ব্যবহারে পরিণত হয়, তখনও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সর্ব্বদাই জীবন্তভাবে পরিস্ফুট হইবার চেষ্টা করিয়াছে।
রাষ্ট্রনীতির দিক দিয়া সেই আদিম ব্যবস্থার বিকাশ ভারতের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হইয়াছে। অন্যান্য দেশের ন্যায় এই বিকাশের সাধারণ গতি হইয়াছে রাজতন্ত্রের দিকে, রাষ্ট্রের শাসন ও পরিচালনকার্য্য ক্রমশঃ জটিল হইয়াছে এবং কেন্দ্ররূপে রাজাই এই শাসনতন্ত্রের অধিপতি হইয়াছেন; রাষ্ট্রের এই রাজতন্ত্র রূপ কালক্রমে প্রচলিত এবং সর্ব্বত্র প্রবর্ত্তিত হয়। কিন্তু এক বিপরীত প্রচেষ্টা এই রাজতন্ত্রের বিস্তারকে বহু দিন বাধা দিয়া আটক করিয়া রাখিয়া ছিল, এবং এই প্রচেষ্টার ফলে নানাস্থানে নাগরিক বা প্রাদেশিক গণতন্ত্রের (Republics) আবির্ভাব হইয়াছিল। এই সকল ক্ষেত্রে রাজা বংশানুক্রমিক বা নির্ব্বাচিত প্রেসিডেণ্টরূপে পরিণত হন অথবা কোথাও রাজার অস্তিত্বই একেবারে উঠাইয়া দেওয়া হয়। জনসাধারণের সভার স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের ফলেই কোথাও কোথাও এই সব গণতন্ত্রের আবির্ভাব হইয়াছিল, আবার কোথাও বা প্রজাগণ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া গণতন্ত্রের স্থাপনা করিয়াছিল, রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ক্রমাগত ভাগ্য-বিপর্য্যয়ও হইয়াছিল। ভারতের কোন কোন জাতির মধ্যে গণতন্ত্রই শেষ পর্য্যন্ত জয়লাভ করে এবং বিশেষ দক্ষতার সহিত রাষ্ট্রশাসন পরিচালিত করিয়া শত শত বৎসর অক্ষুন্ন থাকে। সেগুলি কোথাও লোকতান্ত্রিক সভার দ্বারা আবার কোথাও মুখ্যতান্ত্রিক পরিষদের দ্বারা শাসিত হইত। দুঃখের বিষয় এই সকল ভারতীয় গণতন্ত্রের সংগঠন প্রণালী আমরা খুব কমই জানি এবং তাহাদের অভ্যন্তরীন ইতিহাস আমরা কিছুই অবগত নহি। তবে তাহাদের শাসন প্রণালীর উৎকর্ষতা এবং তাহাদের সামরিক ব্যবস্থার দুর্ব্বার দক্ষতার খুবই সুখ্যাতি যে সমগ্র ভারতে ব্যাপ্ত ছিল সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ প্রমাণ পাওয়া যায়। বুদ্ধের একটি কথা প্রচলিত আছে, তিনি বলিয়াছিলেন, যত দিন গণতন্ত্রের অনুষ্ঠানগুলি ঠিকভাবে পরিচালিত হইবে, তত দিন এরূপ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও মগধ-রাজবংশের উদ্ধত সামরিক শক্তিকে প্রতিহত করিতে পারিবে। এই মতের আরও সমর্থন পাওয়া যায় ভারতের প্রাচীন রাষ্ট্রনীতিক গ্রন্থকারদের রচনায়, তাঁহাদের মতে,—গণতন্ত্র রাষ্ট্রের সহিত সখ্য স্থাপন করিলে রাজারা রাজনীতিক ও সামরিক ব্যাপারে যেমন সাহায্য পাইবেন, এমন আর অন্য কোথাও পাইবেন না; গণতন্ত্রকে দমন করিবার উপায় যুদ্ধ নহে, তাহাদের সহিত যুদ্ধে কৃতকার্যয় হওয়ার আশা অতি অল্প। তাহাদিগকে দমন করিতে হইলে কূট রাজনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে, তাহাদের রাষ্ট্রতন্ত্রের ঐক্য ও দক্ষতা ভিতর হইতে নষ্ট করিয়া দিতে হইবে, নতুবা তাহাদিগকে দমন করা সহজ ব্যাপার নহে।
ভারতের এই সকল গণতন্ত্র (Republics) বহু প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং খৃষ্টের জন্মের ছয় শত বৎসর পূর্ব্বে তেজের সহিত পরিচালিত হইতেছিল। অতএব, গ্রীস্ দেশে যখন ক্ষণস্থায়ী বিব্রত গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয়, তখন ভারতবর্ষে এই সকল গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল, এবং গ্রীসের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা লুপ্ত হইবার বহুকাল পর পর্য্যন্ত ভারতে বর্ত্তমান ছিল। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্ত্তী চপল অস্থিরমতি জাতিসকল অপেক্ষা প্রাচীন ভারতীয়গণ যে সুদৃঢ় ও স্থায়ী রাষ্ট্রগঠন-ব্যাপারে উন্নত ছিল, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। ভারতের কোন কোন গণতন্ত্র প্রাচীন রোম অপেক্ষা দীর্ঘকাল তেজের সহিত আপনাদের স্বাধীনতা ভোগ ও রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল; কারণ, তাহারা চন্দ্রগুপ্ত ও অশোকের প্রবল-প্রতাপান্বিত সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও আপনাদের অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিল এবং খৃষ্টের মৃত্যুর পরে কয়েক শতাব্দী পর্য্যন্ত বর্ত্তমান ছিল। কিন্তু তাহারা কেহই গণতন্ত্র রোমের ন্যায় অপরকে আক্রমণ ও জয় করিবার শক্তির এবং বিস্তৃতভাবে সঙ্ঘগঠনের শক্তির অনুশীলন করে নাই; তাহারা নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া, স্বাধীনভাবে আপনাদের জীবন-বিকাশ করিয়াই সন্তুষ্ট ছিল। আলেজান্দারের আক্রমণের পর ভারত সঙ্ঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিল এবং তখন ঐ গণতন্ত্রগুলি মিলনের পরিপন্থী হইয়া দাঁড়াইল। আপনাদের মধ্যে তাহারা শক্তিমান ছিল, কিন্তু সমস্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করিবার জন্য তাহারা কিছু করিতে পারে নাই। ছোট ছোট রাষ্ট্র মিলিয়া সমস্ত ভারতকে সঙ্ঘবদ্ধ করা বড় সহজ-ব্যাপার নহে,—বস্তুতঃ প্রাচীনকালে জগতের কোথাও এরূপ চেষ্টা সফল হয় নাই, কতক দূর পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়া এইরূপ সঙ্ঘবদ্ধতা সর্ব্বত্রই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং কেন্দ্রীভূত গবর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে শেষ পর্য্যন্ত কিছুই দাঁড়াইতে পারে নাই। জগতের অন্যান্য স্থানের ন্যায় ভারতবর্ষেও রাজতন্ত্রই ক্রমশঃ শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং অবশেষে অন্যান্য প্রকারের রাষ্ট্রতন্ত্রকে স্থানচ্যুত করিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের ইতিহাস হইতে গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়, তাহাদের কথা আমরা এখন জানিতে পারি কেবল প্রাচীন মুদ্রার প্রমাণ হইতে, গ্রীস্দেশীয় পর্য্যটকদের বর্ণনা হইতে এবং সেই সকল সমসাময়িক গ্রন্থকারদের লেখা হইতে, যাঁহারা ভারতের সর্ব্বত্র রাজতন্ত্রস্থাপনে সহায়তা করিয়াছিলেন।
যদিও ভারতে রাজা ভগবানের প্রতিনিধি এবং ধর্ম্মের রক্ষকরূপে পরিগণিত হইতেন, রাজার পদ, সম্মান, শক্তি উচ্চশিখরে অবস্থিত ছিল, তথাপি মুসলমানদের ভারতে আসিবার পূর্ব্বে, ভারতে কোনরূপ স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র ছিল না, রাজা ইচ্ছামত যাহা তাহা করিতে পারিতেন না। প্রাচীন পারস্যদেশে, মধ্য ও পশ্চিম এসিয়ায়, অথবা রোমক সাম্রাজ্যে বা পরবর্ত্তী য়ুরোপে যে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল, ভারতের রাজতন্ত্র ছিল তাহা হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন; পাঠান ও মোগলসম্রাটগণ ভারতে যে রাজতন্ত্র প্রবর্ত্তন করেন, ভারতীয় রাজতন্ত্রের সহিত তাহার কোনই সাদৃশ্য ছিল না। ভারতের রাজা দেশশাসন ও বিচারকার্য্যে সকলের উপরে ছিলেন, দেশের সমস্ত সামরিক শক্তি তাঁহার হস্তে ছিল, এবং তাঁহার মন্ত্রণাপরিষদের সহযোগিতায় তিনিই যুদ্ধ বা শান্তিস্থাপনের সর্ব্বময় কর্ত্তা ছিলেন, তিনি সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করিতেন, সমাজের কল্যাণ সম্বন্ধেও তিনি সাধারণভাবে দেখাশুনা করিতেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁহার কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাহা ছাড়া তিনি যাহাতে তাঁহার ক্ষমতার কোনরূপ অপব্যবহার করিতে না পারেন, তাহারও নানা ব্যবস্থা ছিল এবং দেশের অন্যান্য সাধারণ অনুষ্ঠানও আপন আপন ভাবে রাজকার্য্য পরিচালনা করিত, রাজ্যশাসনব্যাপারে তাহাদেরও অনেক ক্ষমতা ছিল, তাহারা একরূপ রাজার সহিত সহযোগেই রাজকার্য্য, দেশশাসনকার্য্য পরিচালনা করিত। ইংরাজীতে যাহাকে বলে A limited or constitutional monarch,— আইনের অধীন সীমাবদ্ধ-শক্তিসম্পন্ন রাজা, ভারতের রাজা বস্তুতঃ তাহাই ছিলেন; তবে ভারতে যে ভাবে constitution আইনানুমোদিত শাসনতন্ত্র রক্ষিত হইত এবং রাজার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হইত, য়ুরোপের ইতিহাসে সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না; এবং ভারতের রাজাকে রাজত্ব চালাইতে হইলে প্রজাগণের ইচ্ছা ও সম্মতির উপর যতখানি নির্ভর করিতে হইত, মধ্যযুগে য়ুরোপীয় নৃপতিগণকে ততখানি নির্ভর করিতে হইত না।
রাজার উপরেও রাজা ছিল ধর্ম্ম। যে সব আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনীতিক, বিচারগত, আচারগত রীতি-নীতি আইন-কানুন জাতির জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচালিত করে, তাহাদের সমষ্টিকেই ভারতে সাধারণভাবে ধর্ম্ম বলা হয়। রাজা ছিলেন এই ধর্ম্মের সম্পূর্ণ অধীন। এই ধর্ম্মকে লোক অতি পবিত্র দৃষ্টিতে দেখিত এবং ইহার আধিপত্য নিত্য, সনাতন বলিয়া পরিগণিত হইত। মূলতঃ এই ধর্ম্মের কোনই পরিবর্ত্তন হইতে পারে না, তবে সমাজের ক্রমবিকাশে ইহার রূপের, বাহ্য আকারের যে পরিবর্ত্তন হয়, তাহাও স্বতঃই ভিতর হইতে স্বাভাবিকভাবেই হইয়া থাকে। দেশভেদে, কুলভেদে যে বিভিন্ন আচার-ব্যবহার, তাহাও এই মূল ধর্ম্মেরই অন্তর্গত। এই ধর্ম্মের উপর ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার কাহারও ছিল না। ব্রাহ্মণরাও ছিলেন এই ধর্ম্মের শিক্ষক, প্রচারক। ধর্ম্মকে তাঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেন মাত্র, কিন্তু তাঁহারা ধর্ম্মকে সৃষ্টি করিতে পারিতেন না। ইচ্ছামত ধর্ম্মের কোনরূপ পরিবর্ত্তন করিবার অধিকার তাঁহাদেরও ছিল না। তবে অবশ্য ইহাও স্বীকার্য্য যে, ধর্ম্মের ব্যাখ্যা করিবার অধিকার যখন তাঁহাদের ছিল, তখন তাঁহারা নিজস্ব ব্যাখ্যার দ্বারাই সমাজের নানা নূতন ভাব, নূতন চেষ্টার সমর্থন বা বিরোধিতা করিতে পারিতেন। রাজা ছিলেন ধর্ম্মের কেবল রক্ষক, পরিচালক, ভৃত্য। তাঁহার উপর ভার ছিল, যেন লোক ধর্ম্ম মানিয়া চলে, কেহ কোনও অপরাধ না করে, যেন বিষম বিশৃঙ্খলা বা ধর্ম্মভঙ্গ না হয়। প্রথমে রাজাকে নিজেই সেই ধর্ম্ম মানিতে হইত, রাজা ব্যক্তিগতভাবে কিরূপ জীবন যাপন করিবেন এবং রাজপদ, রাজকার্য্যও কিরূপে পরিচালনা করিবেন, সে সম্বন্ধে ধর্ম্মের যাহা নির্দ্দেশ, রাজাকে কড়াকড়িভাবেই তাহা পালন করিতে হইত।
রাজশক্তির পক্ষে এই যে ধর্ম্মের আনুগত্য, ইহা কেবল একটা বাস্তববর্জ্জিত কাল্পনিক আদর্শমাত্র ছিল না, কেবল কথার কথা ছিল না। কারণ, সমস্ত সমাজ-জীবন বস্তুতঃ ধর্ম্মের নির্দ্দেশ অনুসারেই পরিচালিত হইত। অতএব উহা ছিল জীবন্ত সত্য এবং সেই জন্যই রাজনীতিক ক্ষেত্রেও ইহার প্রভাব ছিল সমধিক। প্রথমতঃ, আইন প্রণয়ন করিবার কোন শক্তি রাজার ছিল না; দেশশাসনকার্য্যে রাজা যে সব আদেশ ও অনুশাসন প্রচার করিতেন, সে সব দেশের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনীতিক রীতিনীতিরই অনুযায়ী হইত,—এমন কি, এই সব আদেশপ্রচারকার্য্যও রাজা একাকী করিতেন না। দেশের মধ্যে অন্যান্য এমন শক্তি ও অনুষ্ঠান ছিল, যাহারা রাজ্যশাসনব্যাপারে আদেশাদি প্রচার করিবার ক্ষমতায় রাজার সহিত অংশীদার ছিল—তাহা ছাড়া রাজা যে ভাবে দেশ শাসন করিতেন, ফলতঃ তাহা দেশবাসীর প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত ইচ্ছা কর্ত্তৃক অনুমোদিত কি না, সব সময়েই রাজাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই চলিতে হইত।
আধ্যাত্মিক সাধনা পূজা উপাসনা প্রভৃতি ব্যাপারে সাধারণকে স্বাধীনতা দেওয়া ছিল; সাধারণতঃ এ সব ব্যাপারে রাজা কোন ব্যতিক্রম করিতে পারিতেন না। প্রত্যেক ধর্ম্ম-সঙ্ঘ, প্রত্যেক নূতন বা বহুকালব্যাপী ধর্ম্মসম্প্রদায়—আপনার জীবন, আপনার অনুষ্ঠান আপনার মত করিয়া স্বাধীনভাবে গড়িয়া তুলিতে পারিত। তাহাদের নিজ নিজ গুরু ছিল, অধিপতি ছিল, আপন আপন ক্ষেত্রে তাহারা পূর্ণ স্বাধীনতার সহিত চলিতে পারিত। State religion, রাষ্ট্রীয় ধর্ম্ম বলিয়া কোন বিশেষ ধর্ম্মমত পরিগণিত হইত না। ধর্ম্মব্যাপারে রাজা জাতির অধিপতি ছিলেন না। এই বিষয়ে দেখা যায় যে, অশোক দেশের ধর্ম্মের উপরে রাজশক্তির প্রভাব বিস্তার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, অন্যান্য শক্তিশালী নরপতিগণও মাঝে মাঝে এইরূপ প্রবৃত্তি কিছু কিছু দেখাইয়াছেন। কিন্তু, ধর্ম্মসম্বন্ধে অশোকের edicts বা ঘোষণাপত্র বলিয়া যেগুলি পরিচিত, সেগুলি ঠিক রাজাজ্ঞা নহে, কেবল রাজার মতপ্রকাশ মাত্র, লোককে তাহা যে গ্রহণ করিতেই হইবে, এরূপ আদেশ ছিল না। যদি কোন রাজা ধর্ম্মমতের বা ধর্ম্মানুষ্ঠানের পরিবর্ত্তন করিতে চাহিতেন, তবে তাঁহাকে তৎপূর্ব্বে এ বিষয়ে প্রধান ব্যক্তিগণের সহিত পরামর্শ করিয়া তাঁহাদের মত গ্রহণ করিতে হইত, অথবা পরামর্শের জন্য বিচার-সভা আহ্বান করিতে হইত [বৌদ্ধগণের প্রসিদ্ধ বিচারসভাসমূহ ইহার দৃষ্টান্ত], অথবা বিভিন্ন ধর্ম্মের ব্যাখ্যাতৃগণের মধ্যে তর্ক ও বিচারের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হইত এবং যাহা সিদ্ধান্ত হইত, তাহাই গ্রহণ করা হইত। রাজা ব্যক্তিগতভাবে কোনও বিশেষ মতবাদের পক্ষপাতী হইলে ঐ মতবাদের প্রচারে খুবই সুবিধা হইত বটে, কিন্তু রাজা হিসাবে তাঁহাকে সকল প্রচলিত ধর্ম্মমত ও ধর্ম্মসম্প্রদায়কেই সম্মান ও সমর্থন করিতে হইত এবং এ বিষয়ে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থাকিতে হইত। এই জন্যই দেখিতে পাওয়া যায় যে, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ সম্রাট্গণ দুইটি বিরোধী ধর্ম্ম-সম্প্রদায়কেই সমর্থন করিয়াছিলেন। কখনও কখনও, বিশেষতঃ দক্ষিণদেশে, রাজা কর্ত্তৃক ধর্ম্মব্যাপারে কম-বেশী অত্যাচার সাধিত হইয়াছে, কিন্তু ইহা অধর্ম্মের লক্ষণ, ব্যাভিচার, সাময়িক তীব্র উত্তেজনার ফল, ইহা কখনই বহুদূরব্যাপী বা বহুকালস্থায়ী হয় নাই। সাধারণতঃ ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রথায় ধর্ম্ম সম্বন্ধে অসহনীয়তা বা অত্যাচারের স্থান ছিল না, এবং কোনও রাজা বা রাষ্ট্র যে ইহা নীতিস্বরূপ অনুসরণ করিবে, ইহা ছিল কল্পনারও অতীত।
যেমন ধর্ম্মব্যাপারে, তেমনই সামাজিক ব্যাপারেও লোকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হইত না। রাজা আইন করিয়া সমাজের বিধি-ব্যবস্থা পরিবর্ত্তন করিয়াছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত প্রায়ই দেখা যায় না। যখন এরূপ হইয়াছে, তখন যাহাদের জন্য পরিবর্ত্তন— তাহাদের সহিত পরামর্শ করিয়া, তাহাদের মত লইয়াই করা হইয়াছে। বহুকাল বৌদ্ধ-প্রভাবে বাঙ্গালা দেশে জাতিভেদ বিশৃঙ্খল হইয়া যাইবার পর সেনরাজগণ যখন পুনরায় জাতিভেদের প্রবর্ত্তন করেন, তখন এই ভাবে লোকের সহিত পরামর্শ করিয়াই করিয়াছিলেন। সমাজের সংস্কার বা পরিবর্ত্তন ইচ্ছামত উপর হইতে করা হইত না, কিন্তু ভিতর হইতে স্বভাবতঃ পরিবর্ত্তন ও বিকাশ হইত; কুল বা বংশকে অথবা বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়কে আপন আপন আচারের পরিবর্ত্তন ও বিকাশ করিতে যে স্বাধীনতা দেওয়া ছিল, প্রধানতঃ সেই স্বাধীনতার ফলে ভিতর হইতেই স্বাভাবিকভাবে সমাজের পরিবর্ত্তন ও বিকাশ হইত।
রাজ্যশাসন-ব্যাপারেও এইরূপেই রাজার শক্তি জাতির সনাতন আদর্শের দ্বারা, ধর্ম্মের দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধান প্রধান রাজস্ব ব্যাপারে রাজা এক নির্দ্দিষ্ট অংশের বেশী কর ধার্য্য করিতে পারিতেন না; অন্যান্য ব্যাপারে জনসাধারণের প্রতিনিধিমূলক অনুষ্ঠানের মত লইয়াই রাজাকে কর নির্দ্ধারণ করিতে হইত এবং সকল সময়েই ইহা সাধারণ নীতি ছিল যে, রাজার যে দেশ শাসন করিবার অধিকার, তাহার ভিত্তি হইতেছে জনসাধারণের সন্তোষ ও সম্মতি। আমরা দেখিব যে, এটি কেবলমাত্র একটি সদিচ্ছা বা ধর্ম্মবেত্তা ব্রাহ্মণগণের মত মাত্র ছিল না। রাজা নিজে ছিলেন প্রধান বিচারপতি, দেশের দেওয়ানী বা ফৌজদারী আইন অনুসারে দণ্ডাদি দিবার ব্যাপারে সকলের উপরে রাজারই আধিপত্য ছিল। তাঁহার বিচারপতিরা বা আইনে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণরা আইনের যে স্বরূপ নির্দ্ধারণ করিয়া দিতেন, সেই নির্দ্ধারণ যথাযথভাবে কার্য্যে পরিণত করিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। মন্ত্রণাপরিষদে কেবল বিদেশীদের সহিত সম্পর্কে, সামরিক নীতি এবং যুদ্ধ ও শান্তিস্থাপন ব্যবস্থায় এবং বহু পরিচালন-মূলক্ কর্ম্মে রাজাই ছিলেন সর্ব্বেসর্ব্বা—সকলের উপরে। যে সব শাসনকর্য্যের দ্বারা সমাজের সাধারণ কল্যাণ হয়,—যেমন শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন ও রক্ষণ এবং সামাজিক দুর্নীতি-নিবারণ,—এবং এইরূপ যে সব ব্যাপার রাজার দ্বারাই সুচারুভাবে পরিচালিত হইতে পারে, সেই সব ব্যাপারে ইচ্ছামত সুব্যবস্থা করিবার তাঁহার পূর্ণ অধিকার ছিল। ধর্ম্মের বিরুদ্ধে না যাইয়া তিনি কাহাকেও অনুগ্রহ, কাহাকেও নিগ্রহ করিতে পারিতেন, তবে যাহাতে জনসাধারণের সাধারণ কল্যাণ ও উন্নতি সাধিত হয়, একান্তভাবে সেই দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই তাঁহাকে এই সব করিতে হইত।
অতএব, প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রতন্ত্রে স্বেচ্ছাচারী রাজার খেয়াল বা অত্যাচারের কোন স্থান ছিল না; অন্যান্য অনেক দেশের ইতিহাসে রাজাদের যে পাশবিক নিষ্ঠুরতা, নৃশংস অত্যাচার সাধারণ ব্যাপার, ভারতের রাষ্ট্রতন্ত্রে তাহার সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। তথাপি রাজার পক্ষে ধর্ম্মের অবমাননা করিয়া এবং রাজ্যশাসন ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া অত্যাচারী হইয়া উঠা অসম্ভব ছিল না। তাই আইন-কর্ত্তৃগণ এই অত্যাচারের প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন। রাজপদের পবিত্রতা ও মর্য্যাদা সত্ত্বেও বিহিত হইয়াছিল যে, রাজা যখন যথাযথভাবে ধর্ম্মের অনুসরণ না করিবে, তখন তাহাকে মান্য করিতে প্রজারা বাধ্য নহে। মনু এমন পর্য্যন্ত ব্যবস্থা দিয়াছেন যে, ন্যায়-পরায়ণ অত্যাচারী রাজাকে পাগ্লা কুকুরের ন্যায়ই হত্যা করা প্রজাগণের কর্ত্তব্য। চরমক্ষেত্রে এই যে রাজদ্রোহ—এমন কি, রাজহত্যারও বিধান মনুর ন্যায় শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য গ্রন্থে বিহিত হইয়াছে, ইহা হইতেই বুঝা যায় যে, রাজাকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া এবং সকল অবস্থাতেই রাজার ভগবদ্দত্ত অধিকার স্বীকার করা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় নীতির কোন বিধান নহে। এইরূপ বিদ্রোহের অধিকার প্রজারা যে কার্য্যে পরিণত করিয়াছিল, তাহার দৃষ্টান্ত আমরা সাহিত্যে এবং ইতিহাসেও দেখিতে পাই। আর একপ্রকার অধিকতর নিরুপদ্রব এবং আরও অধিক প্রচলিত পন্থা ছিল,—রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার ভয়প্রদর্শন করা। অনেক ক্ষেত্রে ইহার দ্বারাই অত্যাচারী রাজার সদ্বুদ্ধি ফিরিয়া আসিত। সপ্তদশ শতাব্দীওে দক্ষিণদেশে এক জন অপ্রিয় রাজাকে সাধারণে এইরূপ রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার ভয় দেখাইয়াছিল; জনসাধারণের সভায় ঘোষিত হইয়াছিল যে, রাজাকে কেহ কোনরূপ সাহায্য করিলে বিশ্বাসঘাতকতা হইবে। তবে আরও একটি প্রচলিত প্রতীকার ছিল,—মন্ত্রিগণের পরিষদ্ অথবা জনসাধারণের পরিষদ্ কর্ত্তৃক রাজাকে রাজ্যচ্যুত করা। এইরূপে ভারতে যে রাজতন্ত্র গঠিত হইয়াছিল, তাহা কার্য্যতঃ ছিল সংযত, কার্য্যকুশল এবং কল্যাণকর। যে কার্য্যের ভার ইহার উপর অর্পিত ছিল, তাহা সুচারুভাবেই সম্পাদিত হইত এবং স্থায়ীভাবে ইহা জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। যাহাই হউক, রাজতন্ত্র ছিল কেবল এক প্রকারের রাষ্ট্রতন্ত্র। ইহা লোকানুমোদিত ও প্রভাবসম্পন্ন ছিল বটে, কিন্তু প্রাচীন ভারতে গণতন্ত্রেরও অস্তিত্ব হইতে আমরা বুঝিতে পারি যে, ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজগঠনের রাজতন্ত্রই অপরিহার্য্য অঙ্গ নহে। আমরা যদি রাজতন্ত্রের আলোচনা করিয়াই ক্ষান্ত হই, তাহা হইলে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার যাহা মূলনীতি, তাহা ধরিতে পারিব না। রাজতন্ত্রের পশ্চাতে ভিত্তিস্বরূপ কি ছিল, তাহার সন্ধান করিলেই ভারতের রাষ্ট্রগঠনের মূলস্বরূপ আমাদের গোচর হইবে।