ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা/ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও স্বরূপ

ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মূলনীতি ও স্বরূপ

 ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রকৃত স্বরূপ বুঝিতে হইলে, এটিকে স্বতন্ত্রভাবে, জাতির চিন্তাধারা ও জীবনের অন্যান্য অংশ হইতে পৃথকভাবে দেখিলে চলিবে না, সমাজ-জীবনের একটি অঙ্গরূপেই রাষ্ট্রকে দেখিতে হইবে।

 একটি জাতি, একটি মহান্ মানবসমষ্টি বস্তুতঃ একটি জীবন্ত সত্তার ন্যায় (An organic living being), তাহার এক সমষ্টিগত বা সাধারণ আত্মা আছে, মন আছে, শরীর আছে। ব্যক্তির দৈহিক জীবনের ন্যায় সমাজ-জীবনকেও জন্ম, বিকাশ, পরিণতাবস্থা, অবনতি, এই সব অবস্থান্তরের ভিতর দিয়াই যাইতে হয়। যদি এই শেষ অবস্থা অধিক দূর অগ্রসর হয়, অবনতি ও ক্ষয়ের গতিকে রুদ্ধ করা না যায়, তাহা হইলে যেমন মানুষ বার্দ্ধক্যের পর মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তেমনই জাতিকেও মৃত্যুমুখে পতিত হইতে হয়। এই ভাবেই ভারত ও চীন ব্যতীত জগতের আর সব পুরাতন জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে। কিন্তু সমষ্টিগত সত্তার এমন শক্তিও আছে যে, সে নিজেকে পুনর্জ্জীবিত করিতে পারে, ধ্বংসমুখ হইতে রক্ষা পাইয়া আবার নূতন জীবন আরম্ভ করিতে পারে। কারণ, প্রত্যেক জাতির মধ্যেই একটি মূলভাব ও আদর্শ ক্রিয়া করিতেছে, জাতির দেহের ন্যায় সেটি সহজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না; এই আদর্শ যদি যথেষ্ট শক্তিশালী, উদার ও প্রেরণাময় হয় এবং লোকের মনে ও প্রকৃতিতে যদি তেজ থাকে, প্রাণ থাকে, নমনীয়তা থাকে, যাহার দ্বারা রক্ষণশীলতার সহিত সর্ব্বদা বিকাশ ও বৃদ্ধির সামঞ্জস্য করিতে পারে, জাতীয় আদর্শকে নূতন অবস্থার মধ্যে নূতনভাবে জীবন্ত করিয়া তুলিতে পারে, তাহা হইলে সে জাতি চরম ধ্বংসে পৌঁছিবার পূর্ব্বে বহুবার পতন অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়া যাইতে পারে; তাহা ছাড়া ঐ যে জাতীয় ভাব ও আদর্শ, উহা জাতির সমষ্টিগত সত্তারই আত্মপ্রকাশের ধারা; আবার প্রত্যেক সমষ্টিগত আত্মা এক মহত্তর নিত্য সনাতন আত্মার অভিব্যক্তি ও প্রকাশের কেন্দ্র, সেই সনাতন আত্মা যুগে যুগে নিজেকে প্রকাশ করিতেছে এবং মানবজাতির পতন ও অভ্যুদয়ের ভিতর দিয়া মানব-সমাজের মধ্যে নিজেকে পূর্ণভাবে প্রকট করিতে চাহিতেছে। অতএব যে-জাতি কেবল বাহিরের স্থূল জীবনের মধ্যেই বাস করে না, এমন কি, যে-মূল জাতীয় ভাব তাহার বিকাশকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং জাতিকে বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ব, বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রদান করে, কেবল সেই মূল ভাবটিকেই ধরিয়া থাকে না, কিন্তু ইহাদের পশ্চাতে যে আত্মা রহিয়াছে, অধ্যাত্মসত্তা রহিয়াছে—তাহার সন্ধান পায় এবং সেই নিগূঢ় আত্মসত্তার মধ্যে সজ্ঞানে বাস করিতে শিখে, সে জাতিকে ধ্বংস পাইতে হয় না, অপরের সহিত মিশিয়া নিজেকে হারাইয়া ফেলিতে অথবা এক নূতন জাতির জন্য স্থান ছাড়িয়া দিয়া সম্পূর্ণভাবে লয় পাইতে হয় না, পরন্তু সে নিজেই বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোকসমাজকে অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইয়া নিজের উচ্চতম স্বাভাবিক বিকাশসাধন করিতে পারে এবং মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া পুনঃ পুনঃ নবজীবন লাভ করিতে পারে। যদিই বা কোন সময়ে মনে হয়, এইবার বুঝি তাহার পূর্ণ ধ্বংস আসন্ন, তখনও সে আত্মার শক্তিতে পুনরুজ্জীবিত হইয়া উঠিতে পারে এবং হয় ত আরও এক অধিকতর গৌরবের যুগ আরম্ভ করিতে পারে। ভারতের ইতিহাস এইরূপই একটি জাতির ইতিহাস।

 যে মূল ভাব ভারতবাসীর জীবন, শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক আদর্শসমূহকে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে, তাহা হইতেছে—মানুষের প্রকৃত সত্তার, আত্মার সন্ধান করা এবং জীবনকে এমনভাবে কাজে লাগান, যেন জীবনের ভিতর দিয়াই মানুষ আত্মাকে লাভ করিতে পারে, অজ্ঞান প্রাকৃত জীবন হইতে উঠিয়া দিব্য অধ্যাত্মজীবনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে; অবশ্য দেহ, প্রাণ, মনের যে নীচের প্রাকৃত জীবন, তাহার স্ফূর্ত্তি ও বিকাশসাধন করিয়াই মানুষের অধ্যাত্মজীবন লাভ করা সম্ভব। সকলের উপর এই যে অধ্যাত্ম আদর্শ, ভারত ইহা কখনও বিস্মৃত হয় নাই, যদিও রাষ্ট্র ও সমাজের গঠনে অনেক সময়েই বহু বাহ্য পরিবর্ত্তন করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে। কিন্তু সমাজ-জীবনকে মানুষের প্রকৃত আত্মার অভিব্যক্তি করিয়া তোলা, মানুষের মধ্যে যে অধ্যাত্মসত্তা রহিয়াছে সমাজের বাহ্যজীবনে তাহার কোন শ্রেষ্ঠ বিকাশসাধন করা সাতিশয় কঠিন; ধর্ম্ম, চিন্তাসম্পদ, শিল্পকলা, সাহিত্য প্রভৃতি মনের ব্যাপারে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ করা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী সহজ এবং যদিও এই সকল বিষয়ে ভারত অতি উচ্চ স্তরে উঠিতে পারিয়াছিল, বাহ্য সামাজিক জীবনে আত্মার নিতান্ত আংশিক প্রকাশ করা এবং নিতান্ত অসম্পূর্ণ পরীক্ষা করা ছাড়া আর বেশী কিছু করা সম্ভব হয় নাই। নানা রূপকের (Symbolism) ভিতর দিয়া আধ্যাত্মিকতার সাধারণ প্রভাব, জীবনের সকল স্তরে অধ্যাত্ম লক্ষ্যের স্পর্শ, সমাজ-জীবনের একটি বিশিষ্ট ছাঁচ, অধ্যাত্ম আদর্শের অনুকূল অনুষ্ঠানসমূহের সৃষ্টি—কেবলমাত্র এইগুলিই কার্য্যে পরিণত করা সম্ভব হইয়াছিল। ভারতীয় শিক্ষা-দীক্ষায় অর্থ ও কাম মানব-জীবন ও কর্ম্মের দুইটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিল এবং রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ঐ দুইটি উদ্দেশ্যসাধনের স্বাভাবিক ক্ষেত্র। জীবনের এই বাহ্য দিকে উচ্চতর নীতি বা ধর্ম্মকে কেবল আংশিকভাবে আনা ছাড়া আর বেশী কিছু কোথাও সম্ভব হয় নাই এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম্মের স্থান খুবই অল্প ছিল। কারণ, নীতিধর্ম্মের অনুসরণ করিয়া রাজনীতিক কার্য্যপরিচালনের চেষ্টা সাধারণতঃ একটা ছল ভিন্ন আর বেশী কিছু নহে। মানবজাতির অতীত ইতিহাসে এ পর্য্যন্ত সমষ্টিগত বাহ্য জীবনের সহিত মোক্ষ বা মুক্ত অধ্যাত্মজীবনের প্রকৃত সংযোগ বা সমন্বয় সাধন করা আদর্শ হিসাবেও কোথাও গৃহীত বা অনুসৃত হইয়াছে কি না সন্দেহ, এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হওয়া ত দূরের কথা। মানুষ এখনও তদুপোযোগী পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় নাই। তাই আমরা দেখিতে পাই যে, ভারতে মোক্ষলাভের সাধনা ব্যক্তিগত জীবনেরই উচ্চতম সাধনা বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে, কিন্তু সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক[১] জীবন-ধারাকে ধর্ম্মের[২] দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত করিবার চেষ্টা হইয়াছে, আধ্যাত্মিক সার্থকতাকে কেবল ছায়ার মত পশ্চাতে রাখা হইয়াছে; ভারতের প্রাচীন সমাজ ইহার অধিক আর অগ্রসর হইতে পারে নাই। তবে এই চেষ্টাটুকু সে ছাড়ে নাই, ধৈর্য্যের সহিত ইহাতে লাগিয়াছিল এবং ইহা হইতেই ভারতের সমাজব্যবস্থা নিজের এক বিশিষ্ট ধরণ লাভ করিয়াছে। ভারতের যে পুরাতন আদর্শ, আধ্যাত্মিকতার সহিত জীবনের সমন্বয় করা, গভীরতর অধ্যাত্ম সত্যের উপরে মানুষের সমষ্টিগত সত্তার জীবন ও কর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করা, আমাদের জীবনের যে সকল অধ্যাত্ম সম্ভাবনা এখনও এখনও প্রকট হয় নাই, তাহাদের উপরে সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এই ভাবে জাতির জীবনকে অধ্যাত্মভাবে গড়িয়া তোলা, যেন তাহা হয় সমগ্র মানব জাতির মহত্তর আত্মার লীলা, বিরাট বিশ্বপুরুষের একটি সচেতন সমষ্টিগত সত্তা ও শরীর—এই আদর্শ ও লক্ষ্য হয় ত ভবিষ্যৎ ভারতকেই সফল করিয়া তুলিতে হইবে, লক্ষ্যকে আরও পূর্ণ ও প্রসারিত করিয়া, পূর্ণতর অভিজ্ঞতা, আরও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করিয়া ভবিষ্যৎ ভারতই এই ভাবে অধ্যাত্ম সত্যের উপর সমষ্টিগত সমাজ-জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে।

 আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করিতে হইবে, যাহাতে ভারতের প্রাচীন রাষ্ট্রব্যবস্থার সহিত য়ুরোপের পার্থক্য হইয়াছে এবং যাহার জন্য ভারতের আভ্যন্তরীণ শিক্ষা-দীক্ষার ন্যায় রাষ্ট্রজীবনকেও পাশ্চাত্য আদর্শ (Standards) অনুসারে বিচার করা চলে না। মানব-সমাজকে পূর্ণতম বিকাশের অবস্থায় পৌঁছিতে হইলে ক্রমবিকাশের তিনটি স্তরের ভিতর দিয়া যাইতে হয়। প্রথমটি হইতেছে সেই অবস্থা, যখন সমাজের অনুষ্ঠান ও কর্ম্মসমূহ তাহার স্বাভাবিক জীবনলীলা হইতে স্বতঃস্ফূর্ত্ত হইতেছে। তখন সমাজের সকল বিকাশ, সকল গঠন, রীতিনীতি, অনুষ্ঠান জীবনের স্বাভাবিক বিন্যাসে সংবৃদ্ধ হইয়া উঠিতেছে, সে সকলের প্রেরণা আসিতেছে প্রধানতঃ সমাজ-জীবনের মগ্নচৈতন্যের স্তর হইতে; সজ্ঞানে ইচ্ছা করিয়া করা না হইলেও আপনা হইতেই সে সকলের ভিতর দিয়া জাতির সমষ্টিগত মনস্তত্ত্ব, প্রকৃতি, শরীর ও প্রাণের প্রয়োজন প্রকাশিত হইতেছে, সে সব টিকিয়া থাকিতেছে বা পরিবর্ত্তিত হইতেছে কতকটা ভিতরের প্রেরণার চাপে, কতক সমষ্টিগত মন ও প্রকৃতির উপরে পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে। এই স্তরে এখনও লোকে সজ্ঞান বিচার-বুদ্ধি পরিচালনা করিবার মত সচেতন (Self-Conscious) হইয়া উঠে নাই, সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করিতে শিখে নাই এবং সমষ্টিজীবনকে বিচার বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিতে চেষ্টা করে না, পরন্তু প্রাণের সহজোপলব্ধি অনুসারে জীবন যাপন করে। অন্যান্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের জনসঙ্ঘের (communities) ন্যায় ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথম কাঠামো এইরূপ অবস্থাতেই গড়িয়া উঠিয়াছিল; পরে যখন সামাজিক আত্মচেতনা জাগিয়া উঠিতে থাকে, তখনও সেই প্রাথমিক কাঠামো বর্জ্জিত হয় নাই, কেবল আরও সুগঠিত, পরিবর্দ্ধিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হইয়াছিল, অতএব তাহা রাজনীতিক আইনকর্ত্তা বা সমাজনেতৃগণের দ্বারা সৃষ্ট হয় নাই। সকল সময়েই তাহা ছিল দৃঢ়ভাবে স্থিতিশীল প্রাণবান্ সমাজতন্ত্র, ভারতবাসীর মন, সহজাত সংস্কার ও প্রাণের সহজোপলব্ধির পক্ষে স্বাভাবিক।

 সমাজবিকাশের দ্বিতীয় স্তর আসে তখন, যখন জাতির সমষ্টিগত মন ক্রমশঃ অধিকতর বুদ্ধিতে সচেতন হয় প্রথমতঃ অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে, পরে আরও সাধারণভাবে, প্রথমতঃ স্থূলভাবে, ক্রমশঃ অধিকতর সূক্ষ্মভাবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রেই। তখন জাতি সমষ্টিগতভাবে নিজের জীবন, সামাজিক ধ্যানধারণা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিকশিত চিন্তাশক্তির আলোকে পর্য্যালোচনা করে এবং শেষে বিশ্লেষণমূলক ও গঠনমূলক বুদ্ধির দ্বারা সকল বিষয়কে বিচার করিয়া দেখে ও নিয়ন্ত্রিত করে। এই অবস্থায় অনেক কিছু মহান্ হইবার সম্ভাবনা, আবার এই অবস্থার বিশিষ্ট বিপদ্‌গুলিও কম নহে। স্বচ্ছ বোধশক্তি এবং অবশেষে সঠিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বৃদ্ধিতে যে সব সুবিধা সকল সময়েই আসে, সমাজের এই অবস্থায় প্রথমতঃ সেই সুবিধাগুলি লাভ করা যায়; ইহার চরম পরিণতি হইতেছে নিয়মনিষ্ঠ, শৈথিল্যহীন ও সুরক্ষিত দক্ষতা (efficiency); সমালোচনামূলক ও গঠনমূলক বুদ্ধির, বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির পূর্ণ প্রয়োগের পুরস্কার ও ফলস্বরূপ এই দক্ষতা লাভ করা যায়। সমাজ-বিকাশের এই স্তরে আরও একটি মহত্তর পরিণাম হইতেছে মহান্ ও উজ্জ্বল ভাব ও আদর্শসমূহের আবির্ভাব। এই সব আদর্শ মানুষকে প্রাণের খেলার গণ্ডী হইতে, তাহার আদিম সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা সমুদয় হইতে উপরে তুলিতে চাহে, গতানুগতিক আচার অনুষ্ঠানের উপরে তুলিতে চাহে, সমষ্টির জীবন লইয়া কল্পনার তেজোব্যঞ্জক নানা নির্ভীক পরীক্ষার প্রেরণা আনিয়া দেয় এবং এইভাবে আরও উচ্চতর সমাজ-জীবনের সম্ভাবনার ক্ষেত্র খুলিয়া দেয়। জীবনের উপর এইরূপ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির প্রয়োগ এবং ইহার উচ্চতম ফলস্বরূপ নিয়মনিষ্ঠ, সুসম্পন্ন, সুরক্ষিত দক্ষতা, এইরূপ সজ্ঞানে মহান্ সামাজিক ও অর্থনীতিক আদর্শ সমূহের অনুসরণ, এবং এই চেষ্টার সাফল্যের পরিমাণস্বরূপ ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের প্রগতি—এই সবই হইয়াছে য়ুরোপের সামাজিক ও রাজনীতিক প্রচেষ্টার বিশিষ্ট সুবিধা, তাহাতে অন্য যতই অসুবিধা বা অপূর্ণতা থাকুক।

 অন্যপক্ষে, বুদ্ধি যখন এইভাবে জীবনের উপাদানের উপরে একমাত্র নিয়ন্তা হইবার দাবী করে, তখন সে দেখিতে চাহে না যে, সমাজ একটা জীবন্ত জিনিষ, জীবন্তভাবে ইহার বিকাশ হইতেছে। পরন্তু দেখে, উহা যেন একটা জড় যন্ত্র,—তাহাকে ইচ্ছামত পরিচালিত করিতে পারা যায়, ইট, কাঠ বা লোহার ন্যায় প্রাণহীন জড়পদার্থের মত বুদ্ধির খেয়াল অনুসারে গড়িয়া তোলা যায়। বুদ্ধি বেশী কূটতর্ক ও কল্পনাজাল রচনা করিতে গিয়া, যন্ত্রবৎ দক্ষতা খুঁজিতে গিয়া, জাতির জীবনের সহজ সূত্রগুলি হারাইয়া ফেলে; জাতির জীবনীশক্তির যে নিগূঢ় উৎস, তাহার সহিত যোগসূত্র ছিন্ন করিয়া ফেলে। ইহার ফল হয় এই যে, বাহ্য অনুষ্ঠান ও পদ্ধতির উপরে, আইনকানুন ও শাসনপ্রণালীর উপরেই অত্যধিকভাবে নির্ভর করা হয় এবং জীবন্ত জাতির পরিবর্ত্তে এক যন্ত্রবৎ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার দিকেই মারাত্মক ঝোঁক আসে। যাহা সমাজ-জীবনের একটি সহায় বা যন্ত্রমাত্র, তাহাই ঐ জীবনের স্থান গ্রহণ করিতে চেষ্টা করে এবং এইভাবে একটি শক্তিশালী কিন্তু যন্ত্রবৎ ও কৃত্রিম সংগঠন (organisation) সৃষ্ট হয়; কিন্তু বাহিরের দিকে এই যে লাভ হয়, তাহার মূল্যস্বরূপ মুক্ত ও সজীব জাতির শরীরে নিগূঢ়ভাবে আত্মবিকাশশীল সমষ্টি-আত্মার যে জীবন তাহা বিনষ্ট হয়। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির এই যে ভুল, যান্ত্রিক পদ্ধতির গুরু চাপে প্রাণের ও আত্মার সহজোপলব্ধির ক্রিয়াকে নিগ্রহ করা, এইটিই য়ুরোপের দুর্ব্বলতা, ইহাই য়ুরোপের আশাকে প্রতারিত করিয়াছে এবং য়ুরোপকে তাহার নিজেরই উচ্চতর আদর্শসমূহের প্রকৃত সিদ্ধিতে উপনীত হইতে দেয় নাই।

 যেমন ব্যষ্টিগত মানবজীবনে, তেমনই সমষ্টিগত সামাজিক জীবনে তৃতীয়স্তরে উপনীত হইয়াই, মানুষের চিন্তা যে সব আদর্শকে প্রথমে ধরিয়াছে ও পোষণ করিয়াছে তাহাদের প্রকৃত মূল কোথায় এবং সত্যস্বরূপ কি তাহা জানিতে পারা যায় এবং সেগুলিকে বস্তুতঃ কিরূপে কার্য্যে পরিণত করা যাইতে পারে তাহারও উপায় ও সর্ত্তসকল জানিতে পারা যায়, সর্ব্বাঙ্গসুন্দর সিদ্ধ সমাজ কেবল সুদূর কল্পনা বা স্বপ্নমাত্র থাকে না। যত দিন না সেই তৃতীয় স্তরে পৌঁছান যাইতেছে, তত দিন আদর্শ সমাজ ভাস্বর মেঘের ন্যায় কেবল দূর হইতে দূরেই সরিয়া যাইবে, মানুষ তাহার দিকে ধাবিত হইয়া সর্ব্বদা বৃত্তাকারে ঘুরিবে; সর্ব্বদা তাহা মানুষের আশাকে বঞ্চিত করিবে, মানুষ ধরি আশাকে ধরি ধরি করিয়াও তাহাকে ধরিতে পারিবে না। সেই তৃতীয় অবস্থা আসিবে তখনই, যখন মানুষ সমষ্টিগত সত্তায় আরও গভীরভাবে জীবনযাপন করিতে আরম্ভ করিবে এবং সমষ্টিগত জীবনকে মূলতঃ প্রাণের প্রয়োজন, প্রেরণা, সহজোপলব্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিবে না, আবার তর্কবুদ্ধির রচনা অনুসারেও নিয়ন্ত্রিত করিবে না, পরন্তু তাহার মহত্তর সত্তা ও আত্মার সন্ধান পাইবে এবং প্রথমতঃ, প্রধানতঃ ও সর্ব্বদা সেই আত্মার ঐক্য, সহানুভূতি, স্বতঃস্ফূর্ত্ত স্বাধীনতা এবং সাবলীল ও সজীব নিয়ম অনুসারে সমষ্টির জীবনকে পরিচালিত করিতে আরম্ভ করিবে; ঐ আত্মার মধ্যেই ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত জীবনের স্বাধীনতা, পূর্ণতা ও ঐক্যের সূত্র নিহিত আছে। কিন্তু এইরূপ চেষ্টা আরম্ভ করিবারও মত উপযোগী অবস্থা এ পর্য্যন্ত কোথাও মিলে নাই। কারণ, এই অবস্থা তখনই আসিতে পারে, যখন অধ্যাত্মজীবনে পৌঁছান ও প্রতিষ্ঠিত হইবার চেষ্টা কেবল কতকগুলি অসাধারণ ব্যক্তিরই সাধনা থাকিবে না, কিম্বা সাধারণের মধ্যে লৌকিক গতানুগতিক ধর্ম্মাচরণেই পর্য্যবসিত হইবে না, কিন্তু এইটিই যে মানব-জীবনের অবশ্যপালনীয় প্রয়োজন এবং এইটিকে ঠিকভাবে, যথার্থভাবে লাভ করিয়াই মানবজাতি ক্রমবিকাশের পর্য্যায়ে আর এক পদ অগ্রসর হইতে পারে, লোক তাহা উপলব্ধি করিবে এবং সেই অনুসারে জীবনকে চালিত করিবে।

 তেজীয়ান্ স্বতঃস্ফূর্ত্ত প্রাণশক্তির যে প্রথম স্তর তাহার ভিতর দিয়াই অন্যান্য দেশের ন্যায় ভারতেরও প্রথম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনসমষ্টি (Communities) গড়িয়া উঠিয়াছিল, প্রাণশক্তি সহজ ও স্বচ্ছন্দভাবে নিজের বিকাশের পথ ও আদর্শ ঠিক করিয়া লইয়াছিল, সমষ্টিগত প্রাণের সহজোপলব্ধি ও প্রকৃতি হইতেই জীবনের কাঠামো, সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক অনুষ্ঠান বিকসিত হইয়া উঠিয়াছিল। ঐ জনসমষ্টিগুলি পরস্পরের সহিত সংমিশ্রিত হইয়া শিক্ষা-দীক্ষাগত ও সামাজিক ঐক্যে যেমন বাড়িয়া উঠিল এবং বৃহৎ হইতে বৃহত্তর রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিল, তেমনই তাহাদের মধ্যে বিকশিত হইল এক সাধারণ আত্মা এবং এক সাধারণ ভিত্তি ও সাধারণ গঠন। তাহার মধ্যে ছোট ছোট ব্যাপারে স্বাধীন বৈচিত্র্যের যথেষ্ট স্থান ছিল। কঠোর একরূপতার (a rigid unifomity) কোনও প্রয়োজন ছিল না; সাধারণ আত্মা ও সাধারণ প্রাণের গতি ঐ বৈচিত্র্যবিকাশের স্বাধীনতার উপরে এক সাধারণ ঐক্যের সূত্র স্থাপন করিবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এমন কি, যখন বিশাল রাজ্য ও সাম্রাজ্যসকল গড়িয়া উঠিতেছিল, তখনও ঐ সব স্বভাবসিদ্ধ ছোট ছোট রাজ্য, গণতন্ত্র, জাতিগুলিকে যথাসম্ভব বজায় রাখিয়া অঙ্গীভূত করিয়া লওয়া হইয়াছিল, নূতন সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে সেগুলিকে একবারে ধ্বংস বা বর্জ্জন করা হয় নাই। জাতির স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে যাহা টিকিয়া থাকিতে পারে নাই বা যাহার আর কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় নাই, তাহা আপনা হইতেই খসিয়া পড়িয়াছিল এবং অতীতের গর্ভে বিলীন হইয়াছিল; যাহা নূতন অবস্থা ও পরিবেষ্টনের অনুযায়ী আপনাকে স্বতঃই পরিবর্ত্তিত করিয়া লইয়া টিকিতে পারিয়াছিল, তাহাকে টিকিতে দেওয়া হইয়াছিল। ভারতবাসীর বিশিষ্ট প্রকৃতি ও জীবনবিকাশের ধারার সহিত যাহার নিগূঢ় সামঞ্জস্য ছিল, সে সবই ভারতের স্থায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের মধ্যে স্থান পাইয়াছিল।

 পরে যখন চিন্তাশীলতা ও বুদ্ধির উৎকর্ষসাধনের যুগ আসে, তখনও এই স্বতঃস্ফূর্ত্ত জীবনের নীতি সম্মানিত হইয়াছিল। সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে, ধর্ম্মশাস্ত্রে ও অর্থশাস্ত্রে, ভারতের মনীষিগণ অব্যবহারিক তর্কবুদ্ধির (abstract intelligence) সহায়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন আদর্শ রচনা করাকে নিজেদের কাজ বলিয়া মনে করিতেন না, সমষ্টিগত মন ও প্রাণের দ্বারা সমাজ-জীবনের যে সব অনুষ্ঠান ও ধারা পূর্ব্বেই গঠিত হইয়াছে, সেই সবকেই তাঁহারা ব্যবহারিক বুদ্ধির (Practical reason) সহায়ে বুঝিতে ও সুপরিচালিত করিতে চাহিতেন, আদিম অবয়বগুলিকে ধ্বংস না করিয়া তাহাদের বিকাশ, দৃঢ়তা ও সামঞ্জস্যসাধন করিতে চাহিতেন, যাহা কিছু নূতন অবয়ব, নূতন ভাব গ্রহণ করা প্রয়োজন হইত, তাহা অবয়ব-বৃদ্ধি বা আবশ্যক পরিবর্ত্তন হিসাবেই গ্রহণ করা হইত, প্রাচীনের ধ্বংস বা বিপ্লবসাধন করিয়া নহে। এই ভাবেই পূর্ব্বপ্রচলিত রাষ্ট্রতন্ত্রগুলিকে পূর্ণ বিকসিত রাজতন্ত্রে পরিণত করা হইয়াছিল; রাজা বা সম্রাটের একাধিপত্যে বিদ্যমান অনুষ্ঠানগুলিকে অঙ্গীভূত করিয়া লইয়াই এই পরিবর্ত্তন সংসাধিত হইয়াছিল। উপরে রাজতন্ত্র বা সাম্রাজ্যতন্ত্র চাপিয়া বসায় তাহাদের অনেকেরই পদমর্য্যাদা ও স্বরূপের পরিবর্ত্তন হইয়াছিল বটে, কিন্তু যতদূর সম্ভব সেগুলি লুপ্ত হইয়া যায় নাই। ইহার ফলে আমরা ভারতে য়ুরোপের ন্যায় বুদ্ধি কর্ত্তৃক উদ্ভাবিত আদর্শের অনুসরণে রাজনীতিক প্রগতি (Progress) অথবা বিপ্লবমূলক পরীক্ষা দেখিতে পাই না; এইরূপ বুদ্ধির দ্বারা আদর্শ বা থিওরি রচনা করিয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপ্লবের ভিতর দিয়া প্রগতি ও পরীক্ষা প্রাচীন ও আধুনিক য়ুরোপের বিশিষ্ট লক্ষণ। অপর পক্ষে, প্রাচীন সৃষ্টিগুলির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভারতীয় মনোভাবে সমধিক শক্তিশালী; কারণ, ঐ সৃষ্টিগুলি ভারতীয় মন ও প্রাণের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি, ভারতের স্বধর্ম্মের সুষ্ঠু প্রকাশ; এই যে রক্ষণশীল প্রবৃত্তি, পরবর্ত্তী মহান্ বুদ্ধিবিকাশের যুগেও ইহা ক্ষুণ্ণ হয় নাই, বরং আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলাকে নষ্ট না করিয়া, সমাজে ও রাষ্ট্রে অতীত দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিয়া, ধীরে ধীরে আচার-ব্যবহার ও অনুষ্ঠানের পরিবর্ত্তন ও ক্রমবিকাশ—ইহাই ছিল প্রগতির একমাত্র পথ, অন্য কোন পন্থা সম্ভব ছিল না, স্বীকৃতও হইত না। পক্ষান্তরে, জাতির জীবনের স্বাভাবিক বিন্যাসের পরিবর্ত্তে যান্ত্রিক বিন্যাস যে য়ুরোপীয় সভ্যতার ব্যাধিস্বরূপ হইয়াছে, ভারতীয় রাষ্ট্রনীতি কখনও সেই দুরবস্থায় পৌঁছায় নাই; য়ুরোপের যান্ত্রিক বিন্যাসের (mechanical order) এখন পরিণতি হইতেছে, বিকট কৃত্রিম আমলাতন্ত্র ও শিল্পতন্ত্র ষ্টেট (the Bureaucratic and Industrial State)। আদর্শরচনাকারী বুদ্ধির যে সব সুবিধা, ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিতে সে সব ছিল না, কিন্তু তেমনই বুদ্ধি যান্ত্রিকতার সৃষ্টি করায় যে সব অসুবিধা হয়, সে সব অসুবিধাও ছিল না।

 সহজোপলব্ধির (Intuition) অনুসরণ করাই ভারতীয় মনের চিরন্তন সুগভীর অভ্যাস, এমন কি, যখন ভারতবাসী যৌক্তিক বুদ্ধির (reasoning intelligence) অনুশীলন করিতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত তখনও সেই অভ্যাস অক্ষুণ্ণ ছিল। অতএব ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ও সামাজিক চিন্তাধারা সকল সময়েই চেষ্টা করিয়াছে আত্মার সহজোপলব্ধিগুলির সহিত প্রাণের সহজোপলব্ধিগুলিকে মিলাইয়া লইতে, বুদ্ধির আলোককে আনিয়াছে কেবল ইহাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করিতে, শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্থ্য স্থাপন করিতে। জীবনের নিশ্চিত ও স্থায়ী বাস্তব তথ্যের উপরেই তাহা নিজেকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছে, আদর্শবাদের জন্য বুদ্ধির উপরে নির্ভর না করিয়া আত্মার আলোক, প্রেরণা ও উচ্চতর অনুভূতি উপলব্ধির উপরে নির্ভর করিয়াছে, কোনও পদক্ষেপ ঠিক হইতেছে কি না, বুদ্ধির বিচারের দ্বারা পরীক্ষা নিশ্চয় করিয়া লইয়াছে, বুদ্ধি প্রাণ ও আত্মার স্থান গ্রহণ না করিয়া তাহাদিগকে কেবল সাহায্য করিয়াছে;—সকল সময়ে প্রাণ ও আত্মাই সত্য ও নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করিতে পারে। ভারতের অধ্যাত্মভাবাপন্ন মন জীবনকে আত্মার অভিব্যক্তি বলিয়াই ধারণা করিয়াছে; সমাজ সৃষ্টিকর্ত্তা ব্রহ্মার দেহ, জনগণ সমষ্টিগত ব্রহ্মার প্রাণ-শরীর, সমষ্টি-নারায়ণ, সেইরূপ প্রত্যেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত ব্রহ্মা, স্বতন্ত্র জীব, ব্যষ্টি-নারায়ণ; রাজা ভগবানের জীবন্ত প্রতিনিধি এবং সমাজের অন্যান্য অংশ ও শ্রেণী সমষ্টিগত আত্মার বিভিন্ন স্বাভাবিক শক্তি, প্রকৃতয়ঃ। অতএব, স্বীকৃত রীতিনীতি, অনুষ্ঠান, আচার-ব্যবহার, সকল অংশসমেত সমাজ ও রাষ্ট্র-শরীরের গঠন, এ সবের আধিপত্য স্বীকার করিতে সকলেই যে বাধ্য ছিল শুধু তাহাই নহে, এ সব কতকটা পবিত্র ও পূজার্হ বলিয়াই পরিগণিত হইত।

 প্রাচীন ভারতীয়গণ বুঝিয়াছিলেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যদি যথাযথভাবে স্বধর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, নিজের প্রকৃতির এবং নিজের শ্রেণীর বা জাতির প্রকৃতির সত্যধারা ও আদর্শ অনুসরণ করে এবং সেইরূপ প্রত্যেক শ্রেণী, প্রত্যেক সঙ্ঘবদ্ধ সমষ্টি-জীবনও যদি স্বধর্ম্মের, স্বীয় প্রকৃতির অনুসরণ করে, তাহা হইলেই বিশ্বজগতের যেমন সুশৃঙ্খলা রক্ষিত হয়, মানব-জীবনেও সেইরূপ শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়। পরিবার, কুল, জাতি (caste), শ্রেণী, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, শ্রমিক ও অন্যবিধ সঙ্ঘ, নেশন (nation), জনসমূহ (people), এই সবই হইতেছে জীবন্ত সমষ্টিসত্তা, ইহারা নিজ নিজ ধর্ম্মের বিকাশ করে এবং সেই ধর্ম্মের অনুসরণ করিলেই তাহারা রক্ষা পায়, সুস্থভাবে টিকিয়া থাকিতে এবং সুচারুভাবে কর্ম্ম করিতে পারে। আবার পদমর্য্যাদাজনিত ও অন্যের সহিত সম্বন্ধজনিত কর্ত্তব্যধর্ম্ম আছে, দেশকালের অবস্থা অনুযায়ী যুগধর্ম্ম আছে, সার্ববজনীন রিলিজন্[৩] ও নৈতিক ধর্ম্ম আছে— এই সকল প্রকারের ধর্ম্ম স্বধর্ম্মের (স্বভাব অনুসারে কর্ম্মই স্বধর্ম্ম) উপরে ক্রিয়া করিয়া শাস্ত্রবিধান সমূহ সৃষ্টি করে। প্রাচীন ধারণা এই ছিল যে, ব্যক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে মানুষের অবস্থা যখন সম্পূর্ণ অবিকৃত ও নির্দ্দোষ (ইহাই কাল্পনিক সত্য-যুগ বা স্বর্ণ-যুগ), তখন আর কোন রাজনীতিক শাসনতন্ত্রের, ষ্টেটের বা সমাজের কৃত্রিম অনুষ্ঠান প্রয়োজন হয় না। কারণ, তখন সকলে আপন আপন প্রবুদ্ধ আত্মা ভাগবত-অধিষ্ঠিত সত্তার সত্য অনুসারে স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করে এবং সেই জন্য আপনা হইতেই আভ্যন্তরীণ দিব্যধর্ম্মের অনুসরণ করে। অতএব আত্মনিয়ন্ত্রণশীল ব্যক্তি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণশীল সমাজ আপন আপন সত্তার যথার্থ ও স্বচ্ছন্দ ধর্ম্ম অনুসারে জীবন যাপন করিবে, ইহাই আদর্শ। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে মানুষের যে অবস্থা, তাহাতে তাহার প্রকৃতি ব্যক্তিগত ও সামাজিক ধর্ম্মের বিকৃতি ও বিচ্যুতির অধীন, অজ্ঞান ও ব্যভিচারী। এরূপ অবস্থায় সমাজের স্বাভাবিক জীবনের উপর ষ্টেট, রাজশক্তি, বা শাসনতন্ত্র চাপাইয়া দেওয়া প্রয়োজন; এই রাজশক্তি অযথাভাবে সমাজের জীবনে হস্তক্ষেপ করিবে না, সমাজ-জীবনকে প্রধানতঃ স্বাভাবিক নিয়ম ও রীতিনীতি অনুসারে স্বচ্ছন্দভাবে বিকশিত হইতে দিতে হইবে; রাজশক্তি শুধু দেখিবে, সমাজ ঠিক পথে চলিতেছে কি না, ধর্ম্ম সতেজ আছে কি না, পালিত হইতেছে কি না। ধর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণকে শাস্তি দিবে, দমন করিবে, যথাসম্ভব অধর্ম্মাচরণ নিবারণ করিবে এবং এইভাবে সমাজকে আপনার পথেই ঠিকমত চলিতে সাহায্য করিবে। ধর্ম্ম যখন আরও অধিক বিকৃত অবস্থায় উপস্থিত হয়, তখন সমগ্র সমাজজীবনকে বাহ্য বা লিখিত বিধিনিষেধের শাস্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন হয়, শাস্ত্রকর্ত্তা, আইনকর্ত্তার প্রয়োজন হয়; কিন্তু আইন বা শাস্ত্র প্রণয়ন করা রাজা বা রাজশক্তির কার্য্য ছিল না, রাজশক্তি ছিল কেবল প্রয়োগকর্ত্তা (administrator); সমাজ ও ধর্ম্মসম্বন্ধীয় বিধিবিধান নির্দ্ধারণ করিতেন ঋষি এবং সে সবের রক্ষা ও ব্যাখ্যা করিতেন ব্রাহ্মণ। আবার ঐ বিধিবিধান (লিখিতই হউক বা অলিখিতই হউক) রাজশক্তি বা ব্যবস্থাপক কর্ত্তৃক সৃষ্ট বা উদ্ভাবিত হইবার জিনিষ ছিল না, উহা পূর্ব্ব হইতেই রহিয়াছে, কেবল উহার স্বরূপ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করিয়া দেওয়া হইত অথবা সমাজের জীবন ও চেতনায় প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি হইতেই উহা কেমন স্বাভাবিকভাবে উঠিয়াছে, তাহা দেখাইয়া দেওয়া হইত। এইভাবে কৃত্রিমতা ও গতানুগতিকতা বৃদ্ধি পাইতে পাইতে অবশেষে এমন অধম অবস্থা আসিবেই, যখন সমাজ দ্বন্দ্ব, অনাচার ও বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ হইয়া উঠিবে, ধর্ম্ম লয়প্রাপ্ত হইবে (ইহাই কলিযুগ)। এইরূপ চরম গ্লানির অবস্থা উপস্থিত হইলে তখন বিপ্লবের রক্তরেখার ভিতর দিয়া মানবাত্মা আবার নিজেকে ফিরিয়া পায়, আবার অভিনবভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে অগ্রসর হয়।

 অতএব রাজশক্তির, রাজা ও রাজ-পরিষদ রাষ্ট্রের অন্যান্য শাসক বিভাগের, প্রধান কাজ ছিল সমাজ-জীবনের স্বাভাবিক বিকাশকে অক্ষুণ্ণ রাখিতে সাহায্য করা; রাজশক্তি ছিল ধর্ম্মের পালক ও প্রয়োগকর্ত্তা। সমাজেরই কার্য্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল মানুষের জীবনধারণ ও বিকাশের প্রয়োজনগুলি সিদ্ধ করা, ভোগসুখে মানুষের যে স্বাভাবিক দাবী আছে, সেই দাবী যথাযথভাবে পূর্ণ করা। তবে এই সকল প্রয়োজন ও ভোগের নিয়মিত মাত্রা ছিল এবং সে সব নৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ধর্ম্মের অনুবর্ত্তী ছিল। সমাজ-রাষ্ট্র শরীরের (Socio-political body) সকল অবয়ব ও সকল সঙ্ঘের আপন আপন ধর্ম্ম ছিল, সে ধর্ম্ম তাহাদের স্বভাব, তাহাদের স্থান, এবং সমগ্র সমাজ-শরীরের সহিত তাহাদের সম্বন্ধের দ্বারা নির্ণীত হইত। প্রত্যেকে যাহাতে স্বাধীন ও যথাযথভাবে আপন আপন ধর্ম্ম অনুসরণ করিতে পারে, সে সুযোগ ও সুবিধা করিয়া দিতে হইত, নিজেদের সীমার মধ্যে আপন আপন স্বভাব অনুসারে কর্ম্ম করিতে সকলকে স্বাধীনতা দিতে হইত; কিন্তু আবার সেই সঙ্গে ইহাও দেখিতে হইত, যেন তাহারা নিজেদের, গণ্ডী অতিক্রম না করে, অপরের সীমানায় অনধিকারপ্রবেশ না করে, নিজেদের সত্য পন্থা হইতে বিচ্যুত হইয়া না পড়ে, যথোচিত মাত্রা ছাড়িয়া না যায়। ইহাই ছিল সর্ব্বোচ্চ রাজশক্তির কার্য্য, সভার সাহায্যে সপরিষদ রাজার কার্য্য। জাতি, ধর্ম্মসম্প্রদায়, শ্রমিকসঙ্ঘ, গ্রাম, নগর প্রভৃতির স্বাধীন ক্রিয়ার উপর হস্তক্ষেপ করা বা দেশের জীবনের সহিত নিগূঢ়ভাবে সংশ্লিষ্ট আচার-ব্যবহারের ব্যতিক্রম করা বা তাহাদের স্বাধিকারসকল লুপ্ত করা রাজশক্তির কার্য্য ছিল না। কারণ, যথাযথভাবে সমাজধর্ম্মপালন করিবার নিমিত্ত এইগুলি অপরিহার্য্য বলিয়া এ সবের উপরে সকলের জন্মগত অধিকার স্বীকৃত হইত। রাজশক্তিকে যাহা করিতে হইত তাহা কেবল এই—সকলের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে হইত, সকলের উপরে সাধারণভাবে শাসন রাখিতে হইত, বাহিরের আক্রমণ বা ভিতরের বিপ্লব হইতে সমাজ-জীবনকে রক্ষা করিতে হইত, দুষ্কর্ম্ম ও অশান্তি দমন করিতে হইত, সমাজের অর্থনীতিক ও শিল্পবিষয়ক কল্যাণের পথ পরিষ্কার করিতে সাধারণভাবে সাহায্য ও দেখাশুনা করিতে হইত, সকল বিষয়ে সুবিধা আছে কি না দেখিতে হইত এবং এই সকল করিবার জন্য অপরের যে শক্তি নাই, রাজাকে সেই সকল শক্তি ব্যবহার করিতে হইত।

 অতএব আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল, সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাবিধায়ক এক জটিল অনুষ্ঠান। সমাজের অন্তর্গত প্রত্যেক সঙ্ঘ বা সম্প্রদায়ের ছিল নিজস্ব স্বাভাবিক জীবন, প্রত্যেকে নিজের জীবন ও কর্ম্ম নিজে পরিচালনা করিত, আপন আপন ক্ষেত্রের স্বাভাবিক গণ্ডীর দ্বারা প্রত্যেকে অপর হইতে পৃথক্ ছিল, কিন্তু সমগ্রের সহিত সকলে সুপরিজ্ঞাত সম্বন্ধে আবদ্ধ ছিল। সাধারণ সমাজ-জীবনের কর্ত্তব্য অধিকারসমূহে প্রত্যেকে ছিল আর সকলের সঙ্গে অংশীদার। প্রত্যেকে নিজের নিয়মকানুন প্রয়োগ করিত, নিজের ক্ষেত্রে নিজের কার্য্য নিজে পরিচালিত করিত, কিন্তু সর্ব্বসাধারণের স্বার্থের ব্যাপার অপরের সহিত মিলিত হইয়া আলোচনা করিত, পরিচালনা করিত এবং রাজা বা সম্রাটের সাধারণ সভায় সকলেরই আপন আপন যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী প্রতিনিধি থাকিত। ষ্টেট, রাজা বা সর্বোচ্চ রাজশক্তি ছিল সামঞ্জ্যসাধনের, সাধারণ নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতা-সাধনের যন্ত্র। তাহার প্রভুত্ব ছিল প্রভুত্ব ছিল সকলের উপরে, কিন্তু তাহাই একমাত্র সর্ব্বেসর্ব্বা কর্ত্তা ছিল না; কারণ তাহার সকল অধিকার ও ক্ষমতায় সে ছিল ধর্ম্ম বা আইনের দ্বারা বাধ্য এবং জনগণের ইচ্ছার অধীন; এবং ভিতরের সমস্ত ব্যাপার পরিচালনায় সে ছিল সমাজ-রাষ্ট্র-শরীরের অন্যান্য অংশের সহিত একটি অংশীদার মাত্র।

 ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ইহাই ছিল থিওরি এবং বাস্তবিক গঠনভঙ্গি,—সাম্প্রদায়িক (Communal) স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের জটিল অনুষ্ঠান, সকলের উপরে সামঞ্জস্য-সাধনের এক কর্ত্তা, রাজপুরুষ ও রাজশক্তি, তাহার যথেষ্ট কার্য্যকরী ক্ষমতা, পদমর্য্যাদা, কিন্তু সে সব যথাযোগ্য ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাহা একই সঙ্গে অপরকে শাসন করিতেছে, আবার অপরের দ্বারা শাসিত হইতেছে, সকল বিভাগেই তাহাদিগকে সক্রিয় অংশীদাররূপে স্বীকার করিতেছে, সমাজ-জীবনের নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা কার্য্য তাহাদিগকেও ভাগ দিতেছে; এবং রাজা, জনসাধারণ এবং ইহার অন্তর্গত সমুদয় সম্প্রদায় সঙ্ঘ সকলেই সমানভাবে ধর্ম্মকে রক্ষা করিতে বাধ্য, ধর্ম্মের শৃঙ্খলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতদ্ব্যতীত সমাজ-জীবনের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির দিক ছিল ধর্ম্মের কেবল একটা অংশমাত্র, এবং সে অংশ ছিল অন্যান্য অংশের সহিত, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সমাজের উচ্চতর শিক্ষা-দীক্ষার পরিচায়ক আদর্শের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। রাজনীতি ও অর্থনীতি নৈতিক আদর্শের (ethical law) দ্বারা প্রভাবিত ছিল; রাজা এবং তাঁহার মন্ত্রিগণ, মন্ত্রণাপরিষদ ও সাধারণ রাজসভা, প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজের অন্তর্গত প্রত্যেক স্বতন্ত্র সঙ্ঘ, সকলকেই প্রত্যেক কর্ম্মে নীতির বিধান মানিয়া চলিতে হইত। প্রতিনিধি-নির্ব্বাচনে কাহাকে ভোট দেওয়া হইবে, কোন্ ব্যক্তি মন্ত্রী বা রাজকর্ম্মচারী হইবার যোগ্য, এই সব নির্দ্ধারণ করিতে নৈতিক চরিত্র ও উচ্চ-শিক্ষা-দীক্ষার হিসাব লওয়া হইত আর্য্যজাতির কার্য্যপরিচালনায় যাহারা প্রভুত্ব করিবে, তাহাদিগকে চরিত্রে ও শিক্ষা-দীক্ষায় খুব উচ্চ হইতে হইত। রাজা ও জনসাধারণের সমগ্র জীবনের পশ্চাতে ও শীর্ষে ছিল ধর্ম্মভাব (religious spirit) ও ধর্ম্মপ্রচারকগণ। যদিও সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ ও অংশের বিশিষ্ট বিকাশের উপর প্রয়োজনীয় ঝোঁক দেওয়া হইত, তথাপি সমাজজীবনটাই চরম লক্ষ্য বলিয়া ততটা গরিগণিত হইত না পরন্তু সকল অংশসমেত সমগ্র সমাজ-প্রতিষ্ঠানটিকেই দেখা হইত যেন মানুষের মন ও আত্মার শিক্ষা ও বিকাশের মহান্ ক্ষেত্র—এই ক্ষেত্রে প্রাকৃত জীবনের বিকাশ করিয়া মানুষ ক্রমশঃ অধ্যাত্ম জীবনলাভ করিবে।


  1. জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র অপেক্ষা রাজনীতিকে ধর্ম্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিবার চেষ্টা শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল।
  2. ধর্ম্ম ও আধ্যাত্মিকতা এক জিনিষ নহে, সাধারণতঃ এই দুইটিকে গোলমাল করিয়া একই মনে করা হয়।
  3. ইংরাজীতে রিলিজন্ (religion) বলিতে যাহা বুঝায়, ভারতে “ধর্ম্ম” তাহা অপেক্ষা ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।—রিলিজন্ ধর্ম্মের একটা দিক বা অঙ্গমাত্র। সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক সকল প্রকার নীতি ও আদর্শের সাধারণ নাম ধর্ম্ম।