ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা/ভারতে রাষ্ট্রবিকাশের ধারা

ভারতীয় রাষ্ট্রবিকাশের ধারা

 প্রাপ্য প্রমাণপত্রাদি হইতে যত দূর জানিতে পারা যায়, ভারতীয় সভ্যতার সমাজ-রাষ্ট্রীয় বিকাশ চারিটী ঐতিহাসিক অবস্থার ভিতর দিয়া হইয়া আসিয়াছে। প্রথমে ছিল সরল আর্য্য সমাজ, তাহার পর একটি দীর্ঘ পরিবর্ত্তনের যুগে রাষ্ট্রগঠন ও সমন্বয়ের পরীক্ষামূলক বহু বিচিত্র অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়া জাতীয় জীবন অগ্রসর হইয়াছে। তৃতীয়তঃ, রাজতন্ত্র সুনিশ্চিতভাবে গঠিত হইয়া সমষ্টিগত (communal) জীবনের বহুমুখী অংশকে পরস্পরের সহিত সুসম্বন্ধ ও সঙ্গত করিয়া দেশগত ও সাম্রাজ্যগত ঐক্যের বিধান করিয়াছে। অবশেষে আসিয়াছে অধঃপতনের অবস্থা, ভিতর হইতে উন্নতির গতি স্তব্ধ হইয়াছে, জাতীয় জীবনপ্রবাহ অচল হইয়া উঠিয়াছে, এবং পশ্চিম-এসিয়া ও য়ুরোপ হইতে নূতন কাল্‌চার, নূতন তন্ত্র আসিয়া দেশের উপরে চাপিয়া পড়িয়াছে। প্রথম তিনটি যুগের বিশিষ্ট লক্ষণ হইতেছে, জাতীয় অনুষ্ঠানগুলির আশ্চর্য্যজনক দৃঢ়তা ও স্থায়ী মজবুত গঠন; মূলগত এই স্থিতিশীলতার ফলে জাতীয় জীবনের যথাযথ প্রাণময় ও শক্তিমান বিকাশ ধীরে-সুস্থে সংঘটিত হইয়াছিল, কিন্তু আবার সেই জন্যই উহা নিশ্চিতভাবে গড়িয়া উঠিতে এবং সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রাণময় ও পরিপূর্ণ হইতে পারিয়াছিল। এমন কি, অধঃপতনের যুগেও এই দৃঢ়প্রতিষ্ঠতা ধ্বংসের গতিকে বিশেষভাবে বাধা দিতে সমর্থ হইয়াছিল। সংস্থানটি বিদেশী চাপে উপরে ভাঙ্গিয়া পড়ে, কিন্তু বহুকাল পর্য্যন্ত তাহার ভিত্তিটিকে রক্ষা করিতে পারিয়াছিল, এবং যেখানেই আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল, সেইখানেই নিজের বিশিষ্ট ব্যবস্থার অনেকখানি বজায় রাখিয়াছিল, এমন কি, শেষের দিকেও নিজস্ব আদর্শ ও অনুষ্ঠানগুলির পুনরুদ্ধারসাধনের প্রয়াস করিতে পুনঃ পুনঃ সমর্থ হইয়াছিল। আর এখন যদিও সে রাষ্ট্রনীতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবেই লোপ পাইয়াছে এবং তাহার অবশিষ্ট অংশগুলিকে জোর করিয়াই ধ্বংস করা হইয়াছে, তথাপি যে বিশিষ্ট সামাজিক মনীষা ও প্রকৃতি উহার সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা লুপ্ত হয় নাই, সমাজের বর্ত্তমান স্রোতোহীন, দুর্ব্বল, বিকৃত ও ধ্বংসোন্মুখ অবস্থার মধ্যেও তাহা টিকিয়া আছে, এবং যদিও উপস্থিত বিপরীত রকমের প্রবৃত্তিসকল দেখা যাইতেছে, একবার নিজের ইচ্ছামত নিজের ভাবে কার্য্য করিবার স্বাধীনতা পাইলেই তাহা পাশ্চাত্য বিকাশের গতি অনুসরণ না করিয়া নিজের সত্তা হইতেই নূতন সৃষ্টি করিতে অগ্রসর হইতে পারে। জাতির শ্রেষ্ঠ চিন্তা এখন অস্পষ্টভাবে যে ইঙ্গিত দিতেছে, তখন হয়ত তাহারই অনুগামী হইয়া কমিউন্যাল বা সমষ্টিগত জীবনের তৃতীয় স্তর ও মানবসমাজের অধ্যাত্মভিত্তি আরম্ভ করিবার দিকেই অগ্রসর হইতে পারে। যাহাই হউক, অনুষ্ঠানগুলির সুদীর্ঘ স্থায়িত্ব, এবং তাহারা যে জীবনের আধার ছিল তাহার মহত্ত্ব, নিশ্চয়ই অক্ষমতার পরিচায়ক নহে, বরং তাহা ভারতীয় মণীষার অসাধারণ রাজনীতিক সহজদৃষ্টি ও শক্তিরই পরিচয় দেয়।

 একটি নীতি বরাবর ভারতীয় রাষ্ট্রতন্ত্রের সমুদয় গঠন, বিস্তার ও পুনর্গঠনের মূলে স্থায়িভাবে বিদ্যমান ছিল। সেটি হইতেছে, ভিতর হইতে স্ব-নিয়ন্ত্রিত কমিউন্যাল বা সমষ্টিগত সঙ্ঘবদ্ধ জীবনপ্রণালী:—কেবল মোটের উপর স্ব-নিয়ন্ত্রণ নহে, ভোটের দ্বারা একটা বাহ্য প্রতিনিধিমূলক সভা গঠন করিয়া স্ব-নিয়ন্ত্রণ নহে; এরূপ সভা জাতির কেবল একটা অংশের, রাজনীতিক চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিগণেরই, প্রতিনিধি হইতে পারে, এবং আধুনিক প্রণালী ইহা অপেক্ষা আর বেশী কিছু করিতে পারে নাই: কিন্তু তাহা ছিল জাতির জীবনের প্রত্যেক স্পন্দনে এবং প্রত্যেক স্বতন্ত্র অঙ্গে স্ব-নিয়ন্ত্রণ (Self-determination)। স্বাধীন সমন্বয়শীল কমিউন্যাল বিধান, ইহাই ছিল তাহার স্বরূপ, এবং তাহার লক্ষ্য ছিল ততটা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নহে, যতটা সমষ্টিগত, সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা। প্রথম প্রথম সমস্যাটি খুবই সরল ছিল। কারণ, তখন কেবল দুই প্রকার কমিউন্যাল মূল অনুষ্ঠানের হিসাব লইতে হইত,—গ্রাম এবং কুল। প্রথমটির স্বাধীন স্বাভাবিক জীবন স্ব-নিয়ন্ত্রণশীল পল্লীসমাজের ভিত্তির উপরে স্থাপন করা হইয়াছিল, এবং তাহা এমনই পূর্ণতার সহিত ও মজবুতভাবে করা হইয়াছিল যে, সেটি কালের সমস্ত অত্যাচার এবং অন্যান্য তন্ত্রের আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইয়া প্রায় আমাদের সমকাল পর্য্যন্ত বিদ্যমান ছিল। কেবল সে দিন তাহা ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের নির্ম্মম ও প্রাণহীন যান্ত্রিকতার নিদারুণ চাপে পিষ্ট হইয়া লোপ পাইয়াছে। গ্রামের লোক ছিল প্রধানতঃ কৃষিজীবী, এবং সকলে মোটের উপর একটি সঙ্ঘে মিলিত হইয়া ছিল; সেই একই সঙ্ঘ ছিল ধার্ম্মিক, সামাজিক, সামরিক ও রাষ্ট্রনীতিক সঙ্ঘ; নিজেদের সমিতির ভিতর দিয়া তাহারা নিজেদের শাসনকার্য্য নির্ব্বাহ করিত, তাহাদের উপর নেতাস্বরূপ ছিলেন রাজা, এবং তখনও সামাজিক কর্ম্মের স্পষ্ট কোন ভাগাভাগি হয় নাই এবং কর্ম্ম অনুসারে শ্রেণীবিভাগও হয় নাই।

 কিন্তু এই যে প্রণালী, ইহা কেবল সরলতম কৃষিজীবন, এবং অত্যল্পপরিসর স্থানের মধ্যে আবদ্ধ ক্ষুদ্র জনসমষ্টি ভিন্ন আর কিছুরই পক্ষে উপযোগী নহে, এই কারণেই অধিকতর জটিল কম্যুন্যাল অনুষ্ঠানের বিকাশ করা এবং ভারতীয় মূল নীতিটির প্রয়োগ কিছু পরিবর্ত্তিত ও অপেক্ষাকৃত জটিল করার সমস্যা বাধ্য হইয়াই উঠিয়াছিল। আর্য্যজাতির সকল শাখারই প্রথমতঃ যে কৃষি ও পশুপালনের জীবন ছিল, তাহাই বরাবর প্রশস্ত ভিত্তিস্বরূপ রহিল, কিন্তু এই ভিত্তির উপরে ক্রমশঃ বেশী বেশী সমৃদ্ধ বাণিজ্য, শিল্প ও অন্যান্য অসংখ্য বৃত্তির একটা ঊর্দ্ধস্তর গড়িয়া উঠিল। সামরিক, রাষ্ট্রনীতিক, ধার্ম্মিক ও শিক্ষাদীক্ষাবিষয়ক বৃত্তিগুলি লইয়া একটা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ঊর্দ্ধস্তর গড়িয়া উঠিল। বরাবর পল্লী-সমাজই রহিল স্থায়ী মূল অনুষ্ঠান, সমাজ-শরীরের জমাট ও অবিধ্বংসী পরমাণু, কিন্তু দশ দশটি ও শত শতটি গ্রাম লইয়া এক রকমের সমষ্টিজীবন গড়িয়া উঠিল। এইরূপ প্রত্যেক সমষ্টির রহিল এক জন করিয়া মাথা, এবং প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজন হইল নিজস্ব শাসনতন্ত্র; আবার যেমন যুদ্ধজয় বা অন্যের সহিত মিশ্রণের দ্বারা কুল ও বংশগুলি বৃহদাকার জাতিতে পরিণত হইতে লাগিল, তেমনই ঐ সমষ্টিগুলিকে লইয়া এক একটা রাজতন্ত্র বা সম্মিলিত গণতন্ত্র গড়িয়া উঠিল, আবার এই রাজ্য বা গণতন্ত্রগুলিকে মণ্ডলস্বরূপে গ্রহণ করিয়া বৃহত্তর রাজ্য গঠিত হইল এবং শেষ পর্য্যন্ত এই ভাবেই এক বা একাধিক মহাসাম্রাজ্য গড়িয়া উঠিল। এই যে ক্রমবর্দ্ধমান বিকাশ এবং অবস্থান্তরের আবির্ভাব, ইহার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া ভারতের কম্যুন্যাল স্ব-নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মূলনীতিটি কতদূর কৃতকার্য্যতার সহিত প্রয়োগ করা হইয়াছিল, তাহাতেই ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভার প্রকৃত পরীক্ষা।

 এই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার জন্যই ভারতের মনীষা সুদৃঢ় চাতুর্ব্বর্ণ্যের বিকাশ করিয়াছিল; ঐ ব্যবস্থা ছিল একই সঙ্গে ধার্ম্মিক ও সামাজিক। বাহ্যতঃ দেখিলে মনে হইতে পারে বটে যে, এক সময়ে না এক সময়ে অধিকাংশ মানবসমাজই যে সুপরিচিত সমাজবিভাগের বিকাশ করিয়াছিল—পুরোহিত-সম্প্রদায়, যোদ্ধা ও রাষ্ট্রনীতিক অভিজাত-সম্প্রদায়, শিল্পী, স্বাধীন কৃষক ও বৈশ্য-সম্প্রদায় এবং দাস ও শ্রমিক-সম্প্রদায়—ভারতের চাতুর্ব্বর্ণ্য সেই রকমই একটা অপেক্ষাকৃত কড়াকড়ি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। কিন্তু এই সাদৃশ্যটি শুধু বাহিরের, ভারতের যে চাতুর্ব্বর্ণ্য ব্যবস্থা, তাহার মূলগত সত্যটি ছিল বিভিন্ন। বৈদিক যুগের শেষভাগে এবং পরবর্ত্তী রামায়ণ-মহাভারতের যুগে চাতুর্ব্বর্ণ্য বিভাগটি ছিল একই সঙ্গে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে সমাজের ধার্ম্মিক, সামাজিক, রাষ্ট্রনীতিক ও অর্থনীতিক কাঠামো। সেই কাঠামোর মধ্যে প্রত্যেক বর্ণের একটা নিজস্ব স্বাভাবিক স্থান ছিল, এবং সমাজের কোনও মূল প্রয়োজনীয় ব্যাপার ও কর্ম্মে কোন বর্ণেরই একচেটিয়া অধিকার ছিল না। এই বিশিষ্টতাটি মনে না রাখিলে প্রাচীন চাতুর্ব্বর্ণ্য ব্যবস্থা বুঝা যায় না; কিন্তু পরবর্ত্তী কালের পরিণাম দর্শন করিয়া এবং প্রধানতঃ অধঃপতনের যুগের অবস্থা হইতে যে সব ভুল ধারণার উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে ঐ বিশিষ্টতাটিই ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, ধর্ম্মশাস্ত্রের চর্চ্চা কিম্বা উচ্চতম অধ্যাত্মজ্ঞান ও সাধনার সুযোগ কোনটিই ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল না। প্রথম প্রথম আমরা দেখিতে পাই, অধ্যাত্মবিষয়ে নেতৃত্ব লইয়া ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্ত্রিয়গণের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলিতেছে এবং ক্ষত্ত্রিয়রা বহুকাল ধরিয়াই পণ্ডিত ও যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। তবে ব্রাহ্মণেরা স্মার্ত্ত, শিক্ষক, পুরোহিতরূপে তাহাদের সমস্ত সময় ও শক্তি দর্শনচর্চ্চা, বিদ্যাচর্চ্চা, শাস্ত্রচর্চ্চাতে দিতে পারিত বলিয়া শেষ পর্য্যন্ত তাহারাই জয়ী হয় এবং নিজেদের প্রাধান্য জাঁকাইয়া তোলে। এইরূপে পুরোহিত ও ও পণ্ডিত-সম্প্রদায়ই হয় ধর্ম্মবিষয়ে প্রামাণিক ব্যক্তি, শাস্ত্র ও ঐতিহ্যের রক্ষক, বিধিবিধান ও শাস্ত্রের র‍্যাখ্যাতা, সকল বিদ্যার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং সাধারণতঃ অন্যান্য শ্রেণীর ধর্ম্মগুরু; তাহাদের মধ্য হইতেই দেশের অধিকাংশ (যদিও কখনও সব নহে) দার্শনিক, মনীষী, সাহিত্যিক ও বিদ্বান্ ব্যক্তির আবির্ভাব হয়। ব্দে ও উপনিষদের অধ্যয়ন প্রধানতঃ তাহাদের হস্তেই চলিয়া যায়, যদিও উচ্চ তিন বর্ণের পক্ষেই সকল সময়ে উহা খোলা ছিল, শূদ্রগণের পক্ষে উহা নিয়মমত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে পর্যয়ায়ক্রমে বহু ধর্ম্মান্দোলনের ফলে পরবর্ত্তী কাল পর্য্যন্তও প্রাচীন যুগের সেই স্বাধীনতা মূলতঃ বজায় ছিল, সেই সব ধর্ম্মান্দোলন উচ্চতম অধ্যাত্মজ্ঞান ও সাধনার সুযোগ লোকের দ্বারে দ্বারে আনিয়া দিয়াছিল, এবং যেমন আদিকালে আমরা দেখিতে পাই যে, বৈদিক ও বৈদান্তিক ঋষিগণের উদ্ভব সকল শ্রেণী হইতেই হইয়াছে, তেমনই শেষ পর্য্যন্ত সমাজের সকল স্তর হইতে, নিম্নতম শূদ্রদের মধ্য হইতে, এমন কি, ঘৃণিত ও পদদলিত অস্পৃশ্যদের মধ্য হইতেও যোগী, ঋষি অধ্যাত্মচিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তি, ধর্ম্মসংস্কারক, ধার্ম্মিক, কবি ও গায়কের আবির্ভাব হইয়াছে, এবং তাহারা গতানুগতিক শাস্ত্র ও বিদ্যার অধিকারী না হইলেও তাহারাই যে জীবন্ত আধ্যাত্মিকতা ও জ্ঞানের প্রকৃত উৎস, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

 চারি বর্ণ হইতে কালক্রমে দৃঢ়বদ্ধ উচ্চ-নীচ সামাজিক শ্রেণীবিভাগের আবির্ভাব হয়, কিন্তু পতিতদিগকে বাদ দিলে, প্রত্যেক শ্রেণীরই ছিল এক বিশেষপ্রকারের অধ্যাত্মজীবন ও উপযোগিতা, বিশেষপ্রকারের সামাজিক মর্য্যাদা, বিশিষ্ট শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক ও নৈতিক ধর্ম্মের বিশিষ্ট আদর্শ এবং সমাজমধ্যে নির্দ্দিষ্ট স্থান, কর্ত্তব্য ও অধিকার। আবার এই ব্যবস্থার দ্বারা আপনা হইতেই হইয়াছিল সুনির্দ্দিষ্ট কর্ম্মবিভাগ এবং নিশ্চিত অর্থনীতিক সংস্থিতি; প্রথম প্রথম বংশানুক্রম নীতিই অনুসৃত হইত, যদিও এ ক্ষেত্রেও নিয়মে যত কড়াকড়ি, কার্য্যতঃ তত কড়াকড়ি ছিল না; কিন্তু প্রভূত ধন অর্জ্জন করিবার এবং আপন আপন শ্রেণীতে প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে সমাজ, শাসনবিভাগ ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জ্জন করিবার সুযোগ ও অধিকার হইতে কেহই বঞ্চিত ছিল না। কারণ, আরও লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, সমাজের এই উচ্চ-নীচ শ্রেণীবিভাগ ছিল বলিয়া সেই সঙ্গে রাজনীতির ক্ষেত্রেও সে বিভাগ ছিল না। দেশবাসীর রাজনীতিক অধিকারে চারিবর্ণেরই নিজ নিজ অংশ ছিল এবং সাধারণ সমিতি ও শাসনবিভাগে তাহাদের নিজ স্থান, নিজ নিজ প্রভাব ছিল। আরও একটা কথা এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে, আইনের চক্ষুতে এবং অন্ততঃ থিওরি (theory) বা মতবাদে প্রাচীন ভারতের নারীগণ অন্যান্য প্রাচীন জাতির ন্যায় রাজনীতিক অধিকারে বঞ্চিত ছিল না, যদিও নারীগণ সমাজে পুরুষের অধীন থাকায় এবং গৃহকর্ম্মেই সম্পূর্ণ ব্যাপৃত থাকায় এই সাম্য কেবলমাত্র কতকগুলি ব্যক্তি ব্যতীত আর সকলের পক্ষে কার্য্যতঃ ব্যর্থ হইয়াছিল। তথাপি এখনও যে সব প্রমাণপত্র পাওয়া যায়, তাহাতে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই যে, নারীগণ কেবলই যে রাণী ও শাসনকর্ত্রীরূপে, এমন কি, যুদ্ধক্ষেত্রেও (ভারতের ইতিহাসে এটি সাধারণ ঘটনা) খ্যাতি অর্জ্জন করিয়াছিল, শুধু তাহাই নহে, তাহারা রাজনীতিক সভাসমিতিতেও নির্ব্বাচিত প্রতিনিধিরূপে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 ভারতের সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাটির ভিত্তিতে ছিল সকল শ্রেণীরই সাধারণ জাতীয় জীবনে অন্তরঙ্গভাবে অংশগ্রহণ; প্রত্যেক শ্রেণী আপন আপন ক্ষেত্রে প্রাধান্য করিত, ধর্ম্ম ও বিদ্যার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, যুদ্ধ, রাজকার্য্য ও অন্যান্য রাজ্যের সহিত রাষ্ট্রনীতিক কার্য্যের ক্ষেত্রে ক্ষত্ত্রিয়, ধনোপার্জ্জন ও অর্থনীতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈশ্য, কিন্তু কেহই, এমন কি, শূদ্ররাও রাজনীতিক জীবনে নিজ নিজ অধিকার হইতে বঞ্চিত ছিল না। রাষ্ট্রনীতি, শাসন ও বিচারকার্য্যে সকলেরই কথা চলিত, সকলেরই স্থান ছিল, প্রভাব ছিল। ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, অন্যান্য দেশে যেরূপ শ্রেণীবিশেষ দীর্ঘকাল ধরিয়া প্রবলভাবে অন্যান্য শ্রেণীর উপর একাধিপত্য করিয়াছে, ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ব্যবস্থায় সেরূপ কোন এক বিশেষ শ্রেণীর একাধিপত্য, অন্ততঃ বেশী দিনের জন্য, দাঁড়াইতে পারে নাই। তিব্বতের ন্যায় যাজকসম্প্রদায় কর্ত্তৃক রাষ্ট্রশাসন, অথবা ফ্রান্স, ইংলণ্ড ও য়ুরোপের অন্যান্য দেশে ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাতশ্রেণী কর্ত্তৃক যে শাসন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া চলিয়াছে, অথবা প্রাচীন কার্থেজ ও ভিনিসে স্বল্পসংখ্যক বৈশ্যসম্প্রদায় কর্ত্তৃক যে শাসন প্রচলিত ছিল, এ প্রকারের শাসনতন্ত্র ভারতীয় প্রকৃতির বিরুদ্ধ। গোষ্ঠী, কুল ও বংশগুলি যখন বৃহত্তর জাতি ও রাজ্যে গড়িয়া উঠিতেছিল, এবং আধিপত্যের জন্য পরস্পরের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত ছিল, সেই দেশব্যাপী যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও আত্মবিস্তারের সময়ে বড় বড় ক্ষত্ত্রিয়-বংশগুলি রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে যে কতকটা প্রাধান্য লাভ করিত—মহাভারতে বর্ণিত ইতিহাস হইতে তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়; মধ্যযুগে রাজপুতনায় আবার কুলপ্রথার আবির্ভাব হইলে কতকটা সেইরূপ ক্ষত্ত্রিয়-প্রাধান্যের পুনরভিনয় হয়; কিন্তু প্রাচীন ভারতে এটা ছিল কেবল একটা সাময়িক অবস্থামাত্র, আর ঐরূপ ক্ষত্ত্রিয়-প্রাধান্যের দরুন রাষ্ট্রনীতিক ও নাগরিক ব্যাপারে অন্যান্য শ্রেণীর প্রভাব দূর হইত না, অথবা বিভিন্ন কম্যুন্যাল মূল অনুষ্ঠানের স্বাধীন জীবনে কোনপ্রকার দমনমূলক অত্যাচার বা হস্তক্ষেপ করা হইত না।

 দেশের সমুদয় লোকই সাধারণ সমিতিগুলিতে কার্য্যতঃ যোগ দিবে, এই যে প্রাচীন নীতি, মধ্যবর্ত্তী সময়ের সাধারণতান্ত্রিক রিপাব্‌লিকগুলিতেও এই নীতিটি অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করা হইত বলিয়া মনে হয়। সেগুলি প্রাচীন গ্রীস্‌দেশীয় সাধারণতন্ত্রের ন্যায় ছিল না। গ্রীক্ সাধারণতন্ত্রগুলি ছিল মুখ্যতন্ত্র রিপাবলিক (Oligarchical republics); সাধারণ সমিতিতে সকলে যোগদান করিতে পারিত না, সকল শ্রেণীর মুখ্য ও মান্য ব্যক্তিগণকে লইয়া গঠিত ক্ষুদ্র সিনেটই (Senate) দেশশাসন করিত; ভারতে পরবর্ত্তী কালের রাজকীয় পরিষদ ও পৌরসমিতিগুলি এইরূপই ছিল। যাহাই হউক, শেষ পর্য্যন্ত যে রাষ্ট্ররূপের বিকাশ হইয়াছিল, তাহা ছিল মিশ্রধরণের, তাহাতে কোন কোন শ্রেণীকেই অযথা প্রাধান্য দেওয়া হইত না। এই জন্যই প্রাচীন গ্রীস ও রোম বা পরবর্ত্তী য়ুরোপের ন্যায় শ্রেণীর সহিত শ্রেণীর দ্বন্দ্ব ভারতের ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় না। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর সহিত সাধারণের, মুখ্যতন্ত্র আদর্শের সহিত সাধারণতন্ত্র আদর্শের দ্বন্দ্বের ফলে শেষ পর্য্যন্ত একাধিপত্যশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্ত্তী য়ুরোপের ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়, শ্রেণীদ্বন্দ্বের ফলে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন রকমের শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে। প্রথমে অভিজাতশ্রেণী আধিপত্য করিয়াছে; পরে কোথাও ধীরে ধীরে, কোথাও বা বিপ্লবের দ্বারা, ধনী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, এই বুর্জ্জোয়া শাসন সমাজকে শিল্পতান্ত্রিক (industrialised) করিয়া তুলিয়াছে এবং জনসাধারণের নামে দেশকে শাসন ও শোষণ করিয়াছে; অবশেষে এখন দেখা যাইতেছে, শ্রমিকশ্রেণী আধিপত্যলাভ করিবার উদ্যোগ করিতেছে। এইরূপ শ্রেণীর সহিত শ্রেণীর দ্বন্দ্ব ভারতের ইতিহাসে ঘটিতে পায় নাই। ভারতের মনোবৃত্তি ও প্রকৃতি পাশ্চাত্যের তুলনায় অধিকতর সমন্বয়শীল ও নমনীয়, পাশ্চাত্যের ন্যায় তর্কবুদ্ধিকে ধরিয়া না থাকিয়া বা শুধু প্রাণের আবেগে কাজ না করিয়া, তাহা সহজবোধ ও সহজানুভূতিরই বেশী অনুসরণ করিয়াছে; সেই জন্য, যদিও অবশ্য তাহা সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শ ব্যবস্থা করিতে পারে নাই, তথাপি অন্ততঃপক্ষে তাহা দেশের সকল স্বাভাবিক শক্তি ও শ্রেণীর মধ্যে এমন একটা সুনিপুণ ও স্থায়ী সমন্বয়ে উপনীত হইতে পারিয়াছিল, যাহা সতত শঙ্কাজনকভাবে দোদুল্যমান সাম্য বা একটা সাময়িক আপোষমাত্র ছিল না। সেই প্রাণবান্ ও সুব্যবস্থিত যথাক্রম সন্নিবেশে সমাজ-শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ স্বাধীনভাবে আপন আপন কর্ম্ম করিতে পাইত এবং এই জন্যই তাহা, মানুষের সকল সৃষ্টিরই কালক্রমে যে অবনতি অবশ্যম্ভাবী তাহা রোধ করিতে না পারিলেও, অন্ততঃ ভিতর হইতে বিপ্লব ও বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা নিবারণ করিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 রাষ্ট্রের শীর্ষদেশ অধিকার করিয়া ছিল তিনটি শাসনবিষয়ক সংস্থান,—মন্ত্রণাপরিষদসহ রাজা, পৌর-সমিতি ও সাধারণ জানপদসমিতি। দেশের সকল শ্রেণীর লোক হইতেই পরিষদের সভ্য ও মন্ত্রিগণকে লওয়া হইত। পরিষদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র প্রতিনিধিগণের নির্দ্দিষ্ট সংখ্যা ছিল। সংখ্যা হিসাবে বৈশ্যদেরই খুব প্রাধান্য ছিল, কিন্তু ইহাই ছিল ন্যায্য ব্যবহার, কারণ দেশের অধিবাসিগণের মধ্যে তাহারাই ছিল সংখ্যায় বেশী; কারণ, আর্য্যসমাজের প্রথমাবস্থায় বৈশ্য শ্রেণীর মধ্যে শুধু যে বণিক ও ব্যবসায়িগণই গণ্য হইত তাহা নহে, কারিকর, শিল্পী ও কৃষকরাও বৈশ্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, অতএব তাহারাই ছিল জনসাধারণের অধিকাংশ; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও শূদ্র শ্রেণীর বিকাশ অপেক্ষাকৃত পরে হইয়াছিল, এবং উপরের দুইটি শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব যতই বেশী থাকুক, সংখ্যায় এই তিনটি শ্রেণীই খুব ন্যূন ছিল। পরে যখন বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রাদুর্ভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং কাল্‌চারের অবনতির যুগে ব্রাহ্মণগণ সমাজকে পুনর্গঠিত করেন, তখন ভারতের অধিকাংশ স্থানে কৃষক, শিল্পী ও ক্ষুদ্র ব্যবসাদারগণ বেশীর ভাগই শূদ্র পর্য্যায়ে আসিয়া পড়িল, শীর্ষদেশে রহিল অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণের দল এবং মধ্যস্থলে কতকগুলি ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ছড়াইয়া রহিল।

 পরিষদ এই ভাবে সমগ্র সমাজের প্রতিনিধি হইয়া রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কার্য্যনির্ব্বাহক ও শাসন-সংস্থান ছিল; শাসনকার্য্য, অর্থনীতি, কূটনীতি এই সকল বিষয়ে অপেক্ষাকৃত প্রয়োজনীয় ব্যাপারে, সমাজের সমুদয় স্বার্থব্যাপারে, রাজা যে-কার্য্য বা আদেশ প্রচার করিতেন, সে জন্য তাঁহাকে পরিষদের সম্মতি ও সহযোগিতা গ্রহণ করিতে হইত। রাজা, মন্ত্রিগণ ও পরিষদ ইঁহারাই বিভিন্ন কার্য্যনির্বাহক বোর্ডের সাহায্যে ষ্টেটের কার্য্যের বিভিন্ন বিভাগ পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ করিতেন। কালক্রমে রাজার শক্তি যে বাড়িয়া উঠে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, এবং সময়ে সময়ে তাঁহার নিজের স্বাধীন ইচ্ছা প্রেরণা অনুসারে কাজ করিবার খুবই প্রলোভন হইত, কিন্তু তাহা হইলেও, যত দিন ঐ রাষ্ট্রব্যবস্থা সতেজ ছিল, তত দিন রাজা পরিষদ ও মন্ত্রিগণের মত ও ইচ্ছাকে অমান্য বা অগ্রাহ্য করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন না। এমন কি, মহাসম্রাট অশোকের ন্যায় শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাজাকেও পরিষদের সহিত দ্বন্দ্বে পরাজিত হইতে হইয়াছিল এবং কার্য্যতঃ তিনি তাঁহার ক্ষমতা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন বলিয়াই মনে হয়। পরিষদসহ মন্ত্রিগণ অবাধ্য বা অযোগ্য নৃপতিকে সরাইয়া তাঁহার স্থলে তাঁহার বংশের অথবা নূতন কোন বংশের অন্য লোককে রাজসিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিতেন, এবং বস্তুতঃ বার বার এরূপ করিয়াছেন। এই ভাবেই কয়েকটি ইতিহাসবিখ্যাত পরিবর্ত্তন সংঘটিত হইয়াছিল, যথা—মৌর্য্যবংশের স্থানে সুঙ্গ-বংশের প্রতিষ্ঠা, পুনশ্চ কানোয়া সম্রাটবংশের সূচনা। রাষ্ট্রনীতিক মতবাদ অনুসারে এবং সচরাচর ব্যবহারেও রাজার সমস্ত কর্ম্মই ছিল মন্ত্রিগণের সাহায্যে সপারিষদ রাজার কর্ম্ম; তাহাদের মতানুযায়ী হইলে, এবং ধর্ম্মানুসারে যে কার্য্যের ভার রাজার উপর অর্পিত হইয়াছে সেই সব কার্য্যের সহায়ক হইলে, তবেই রাজার ব্যক্তিগত কর্ম্মসকল বৈধ বলিয়া সাব্যস্ত হইত। আবার যেমন পরিষদ ছিল যেন একটি ঘনীভূত শক্তিরূপ ও কর্ম্মকেন্দ্র, সুবিধামত পরিসরের মধ্যে চারি বর্ণের প্রতিনিধি, সমাজশরীরের সকল প্রধান অংশের সারসংগ্রহ, তেমনই রাজাও ছিলেন ঐ শক্তিকেন্দ্রেরই সক্রিয় মস্তকস্বরূপ, তাহা ছাড়া আর কিছুই নহে; স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের ন্যায় তিনিই ষ্টেট বা তিনিই দেশের মালিক বা অনুগত প্রজাগণের উপর দায়িত্বহীন শাসনকর্ত্তা হইতে পারিতেন না। প্রজাদের আনুগত্য ছিল আইনের প্রতি, ধর্ম্মের প্রতি, তাহারা সপারিষদ রাজার আদেশসকল কেবল এই জন্যই পালন করিত যে, সেইগুলি ছিল ধর্ম্মের প্রয়োগ ও সংরক্ষণের উপায়স্বরূপ।

 তবে পরিষদের ন্যায় ক্ষুদ্র সংস্থানই যদি শাসনবিষয়ক একমাত্র অনুষ্ঠান হইত, তাহা হইলে সর্ব্বদা রাজা ও তাঁহার মন্ত্রিগণের অতি নিকট প্রভাবের অধীন থাকায় তাহা ক্রমে স্বেচ্ছাচারী শাসনের যন্ত্রে পর্য্যবসিত হইতে পারিত। কিন্তু ষ্টেটের মধ্যে আরও দুইটি শক্তিশালী অনুষ্ঠান ছিল। সেগুলি ছিল আরও বিস্তৃতভাবে সমাজ-জীবনের প্রতিনিধি। সাক্ষাৎ রাজকীয় প্রভাব হইতে মুক্ত থাকিয়া তাহারা আরও নিকট ও অন্তরঙ্গভাবে সমাজের মন প্রাণ ও ইচ্ছাকে প্রকাশ করিত, সর্ব্বদা বহুল পরিমাণে শাসনকার্য্য পরিচালন ও শাসনবিষয়ক আইনকানুন প্রণয়ন করিত, এবং সকল সময়েই রাজশক্তিকে সংযত করিয়া রাখিতে সমর্থ হইত। কারণ, তাহারা অসন্তুষ্ট হইলে অপ্রিয় বা অত্যাচারী রাজাকে দূর করিয়া দিতে পারিত, অথবা যতক্ষণ সে প্রজাগণের ইচ্ছার সম্মুখে মাথা নত না করিতেছে, ততক্ষণ তাহার শাসনকার্য্য অসম্ভব করিয়া তুলিতে পারিত। এই দুইটি মহৎ অনুষ্ঠান হইতেছে পৌরসমিতি ও জানপদ-সমিতি; ইহারা আপন আপন স্বতন্ত্র কার্য্যের জন্য স্বতন্ত্রভাবে বসিত, আবার সর্ব্বসাধারণের স্বার্থবিষয়ক ব্যাপারে উভয়ে একত্র বসিত।[১] পৌর-সমিতি রাজ্য বা সাম্রাজ্যের রাজধানীতে সর্ব্বদাই বসিত,—সাম্রাজ্য-ব্যবস্থার অধীনে প্রদেশগুলির প্রধান নগরীতেও ঐরূপ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সমিতির অধিবেশন হইত বলিয়া আভাস পাওয়া যায়; নগরের মধ্যস্থিত শিল্প ও ব্যবসাসম্বন্ধীয় সঙ্ঘ বা গিল্ডগুলির (City Guilds) এবং সমাজের সকল শ্রেণীর—অন্ততঃ নীচের তিনটি শ্রেণীর অন্তর্গত বিভিন্ন জাতি-সঙ্ঘের (Caste bodies) নির্ব্বাচিত প্রতিনিধিগণকে লইয়া ঐরূপ পৌর-সমিতি গঠিত হইত। হইত। নগরে ও দেশে সর্ব্বত্র বৃত্তিসঙ্ঘ (guilds) ও জাতিসঙ্ঘগুলি ছিল সমাজ-শরীরের জীবন্ত স্বায়ত্তশাসনশীল অঙ্গ; আর নাগরিকগণের যে শ্রেষ্ঠ সমিতি, সেটি কৃত্রিমভাবে প্রতিনিধিমূলক ছিল না, পরন্তু তাহা ছিল নগরের চতুঃসীমার অন্তর্গত সমগ্র জীবনধারার বাস্তবিক প্রতিনিধি। উহা নগরের সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করিত, কখনও সাক্ষাৎ ভাবে নিজেই কার্য্য করিত, কখনও বা নিজের অধীনে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র নানা সমিতি বা কার্য্যনির্ব্বাহক বোর্ড পাঁচ, দশ বা অধিকসংখ্যক সভ্যের দ্বারা গঠন করিয়া তাহাদের ভিতর দিয়া কার্য্য করিত; উহার আইন ও অনুশাসন সকল বৃত্তিসঙ্ঘকেই মানিয়া চলিতে হইত, আবার সাক্ষাৎভাবেও উহা নাগরিক সমাজের ব্যবসা, শিল্প, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক ব্যাপার-সমূহ পরিচালিত করিত। ইহা ছাড়া ঐ সমিতি এমন শক্তিশালী ছিল যে, রাজ্যের বৃহত্তর ব্যাপারেও উহার পরামর্শ গ্রহণ করিতে হইত, এবং এই সকল ব্যাপারে উহা কখনও জানপদ সমিতির সহযোগে, কখনও বা পৃথকভাবে নিজেই কর্ম্মপন্থা অবলম্বন করিতে পারিত; আর, উহা সর্ব্বদা রাজধানীতে বর্ত্তমান থাকিয়া কার্য্য করিত বলিয়া এমন ক্ষমতাপন্ন হইয়া উঠিয়াছিল যে, রাজা, তাঁহার মন্ত্রিগণ ও তাঁহাদের পরিষদকে সর্ব্বদাই উহাকে মান্য করিয়া চলিতে হইত। রাজার মন্ত্রী ও শাসনকর্ত্তাদের সহিত দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইলে দূরবর্ত্তী প্রাদেশিক পৌরসমিতিগুলিও নিজেদের অসন্তোষ কার্য্যকরীভাবে প্রকাশ করিতে পারিত, তাহাদের মর্য্যাদা বা অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হইলে সমুচিত উত্তর দিতে পারিত, এবং অপরাধী কর্ম্মচারীকে সরাইয়া লইতে বাধ্য করিতে পারিত।

 জানপদ সমিতিও এই ভাবেই রাজধানীর বাহিরে সমস্ত দেশের মন ও ইচ্ছার বাস্তবিক প্রতিনিধি ছিল, কারণ, উহা নগর ও গ্রামের নির্ব্বাচিত নেতা বা মুখ্যগণকে লইয়া গঠিত ছিল। মনে হয়, ইহার গঠনে ধনিক সম্প্রদায়ের কতকটা প্রভাবাধিক্য হইয়া পড়িয়াছিল, কারণ, অধীনস্থ সম্প্রদায়সকলের প্রধানতঃ অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিরাই ইহাতে প্রতিনিধি হইয়া আসিত, অতএব এই জানপদ সমিতি সম্পূর্ণভাবে সাধারণতান্ত্রিক ছিল না (যদিও অতি আধুনিক সমিতিগুলি ব্যতীত সর্ব্বত্রই ক্ষত্ত্রিয়বৈশ্যের ন্যায় শূদ্ররাও স্থান পাইত), তথাপি উহা যথেষ্টভাবেই জনসাধারণের প্রকৃত জীবন ও মনোভাব প্রকাশ করিত। যাহাই হউক, এইটি একটি শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সমিতি ছিল না, কারণ, রাজা, রাজপরিষদ ও পৌর সমিতির মতই এইটিরও মূল আইন প্রণয়ন করিবার কোন ক্ষমতা ছিল না, ইহা কেবল ব্যবহারিক বিধান ও মীমাংসা করিতে পারিত। ইহার কার্য্য ছিল জাতীয় জীবনের বিভিন্ন কর্ম্ম-পরম্পরার মধ্যে সামঞ্জস্যসাধনে দেশবাসীর ইচ্ছার সাক্ষাৎ যন্ত্র হওয়া, এই সব যাহাতে যথাযথ ভাবে পরিচালিত হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখা, দেশের বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে সাধারণভাবে শৃঙ্খলা ও কল্যাণবিধান করা, এবং সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহারিক বিধান ও অনুশাসন প্রচার করা, রাজা ও তাঁহার পরিষদের নিকট হইতে সুবিধা ও অধিকারসকল আদায় করা, রাজার কার্য্যে প্রজাদের অনুমতি প্রকাশ করা বা প্রত্যাহার করা এবং প্রয়োজন হইলে রাজাকে কার্য্যতঃ বাধা প্রদান করা, কুশাসন নিবারণ করা, অথবা দেশের প্রতিনিধিদের পক্ষে যে সব পথ খোলা আছে সেই সবের দ্বারা ঐরূপ শাসনের শেষ করা। কাহার পর কে রাজা হইবে সে বিষয়ে পৌর জানপদের সংযুক্ত অধিবেশনের পরামর্শ লওয়া হইত, ঐরূপ সংযুক্ত অধিবেশন রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করিতে পারিত, যে বংশ রাজত্ব করিতেছিল তাহার বাহিরে অন্য ব্যক্তিকে সিংহাসন অর্পণ করিতে পারিত, রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট মকদ্দমায়, দেশদ্রোহিতায় বা বিচারবিভ্রাটে কখন কখনও দেশের উচ্চতম বিচারালয়রূপে বিচারকার্য্য করিতে পারিত। রাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজকীয় মন্তব্য এই সমিতিগুলিতে পেশ করা হইত, এবং বিশেষ টেক্সনির্দ্ধারণ, যুদ্ধ, যজ্ঞ, জলসেচনের বৃহৎ ব্যাপার এবং দেশের অন্যান্য অত্যাবশ্যক ব্যাপারে তাহাদের সম্মতি গ্রহণ করিতে হইত। এই দুই সমিতির অধিবেশন অনবরতই হইত বলিয়া মনে হয়। কারণ, প্রত্যহ রাজার নিকট হইতে নানা বিষয় তাহাদের সমীপে উপস্থিত হইত, তাহাদের কার্য্য রাজা রেজেষ্ট্রী করিয়া লইতেন, অমনই সেগুলি আইনরূপে বলবৎ হইত। বস্তুতঃ তাহাদের অধিকারসকল ও কার্য্যপরম্পরা সমগ্রভাবে দেখিলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, রাজাধিপত্যে তাহারা ছিল অংশীদার, শাসন-ব্যাপারে তাহাদের অধিকার ছিল স্বতঃসিদ্ধ, এবং যে সব শক্তিপ্রয়োগ সাধারণতঃ তাহাদের কার্য্যের অন্তর্গত ছিল না, অসাধারণ প্রয়োজনের সময়ে তাহারা সে সবও ব্যবহার করিতে পারিত। ইহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, সম্রাট অশোক যখন দেশের ধর্ম্ম-পরিবর্ত্তনের চেষ্টা করিয়াছিলেন, তখন তিনি কেবল রাজানুশাসনের দ্বারাই তাহা করিতে প্রবৃত্ত হন নাই, পরন্তু তিনি সমিতির সহিত পরামর্শ করিয়াছিলেন। অতএব প্রাচীন কালে এই দুইটি সমিতিকে যে রাজ্যের কার্য্য-নির্ব্বাহক বলিয়া এবং প্রয়োজনমত রাজশাসনে বাধা দিবার যন্ত্র বলিয়া বর্ণনা করা হইত, তাহা সম্পূর্ণভাবেই ঠিক বলিয়া মনে হয়।

 এই মহান্ অনুষ্ঠানগুলি কখন বিলুপ্ত হয়? মুসলমান আক্রমণের পূর্বেব, না বিদেশী শাসনের ফলে, তাহা ঠিক জানা যায় না। ভারতীয় রাষ্ট্রের যেরূপ গঠন তাহাতে যদি ইহা এমন কোন ভাবে উপর দিকে শিথিল হইয়া পড়িত, যাহার ফলে রাজার শাসন ও সমাজ-রাষ্ট্র-শরীরের অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইত, এবং রাজা এইরূপ বিচ্ছিন্ন হইয়া ও জাতির বৃহত্তর ব্যাপারগুলিতে অবাধ আধিপত্য লাভ করিয়া ক্রমশঃ বেশী বেশী স্বেচ্ছাচারী হইয়া পড়িতেন, এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলি কেবল নিজেদের ভিতরকার ব্যাপার লইয়াই ব্যাপৃত থাকিত (যেমন শেষ পর্য্যন্ত গ্রামসঙ্ঘগুলি হইয়া পড়িয়াছিল), কিন্তু রাষ্ট্রের বৃহত্তর ব্যাপারগুলির সহিত কোনরূপ জীবন্ত সম্বন্ধ না রাখিত, তাহা হইলে রাষ্ট্র খুবই দুর্ব্বল হইয়া পড়িত, কারণ, এই মিশ্র কম্যুন্যাল স্বায়ত্তশাসনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সকল অংশের সংযোগ ও সমন্বয় একান্ত আবশ্যক। যাহাই হউক, মধ্য-এসিয়া হইতে যে-আক্রমণ ভারতের উপর আসিয়া পড়িল, এবং সঙ্গে করিয়া আনিল এমন ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতামূলক শাসনের রীতি যাহা কোনরূপ বাধা মানিতে মোটেই অভ্যস্ত ছিল না, তাহা যে এই স্বাধীনকর্ত্তৃত্বশীল অনুষ্ঠান সকলকে বা তাহাদের অবশেষকে সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস করিয়া ফেলিবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই; বস্তুতঃ সমগ্র উত্তর-ভারতে ইহাই ঘটিয়াছিল। তাহার পর বহু শতাব্দী ধরিয়া দক্ষিণ দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষিত হইয়াছিল, কিন্তু সেখানে যে সাধারণ সমিতিগুলি বর্ত্তমান রহিল, প্রাচীন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলির ন্যায় তাহাদের গঠন ছিল বলিয়া বোধ হয় না, পরন্তু প্রাচীন অনুষ্ঠানগুলি যে সব কম্যুন্যাল সঙ্ঘ ও সমিতিকে পরস্পরের সহিত সঙ্গতিবিশিষ্ট করিয়া উপরিতন শক্তিরূপে সেইগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করিত, দক্ষিণ দেশের সাধারণ সমিতিগুলি ছিল সেই সব নিম্নতন অনুষ্ঠানের ন্যায়। এই নিম্নতন অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ছিল কুল ও গণ, পূর্ব্বে এইগুলির রাজনীতিক স্বরূপ ছিল, প্রাচীন কুলপ্রথামূলক জাতির এইগুলিই ছিল উচ্চতম শাসন-সমিতি। নূতন ব্যবস্থায় তাহারা বর্ত্তমান রহিল, কিন্তু তাহাদের উচ্চতম অধিকার সকল হারাইল, তাহারা কেবল নিম্নতন শক্তিরূপে সীমাবদ্ধভাবে তাহাদের অন্তর্গত সম্প্রদায়গুলির কার্য্যপরম্পরা নির্ব্বাহ করিতে পারিত। কুল তাহার রাজনীতিক ক্ষমতা হারাইবার পরেও বর্ত্তমান রহিল ধর্ম্ম ও সমাজবিষয়ক অনুষ্ঠানরূপে, বিশেষতঃ ক্ষত্ত্রিয়দের মধ্যে নিজের কুলধর্ম্ম (সামাজিক ও ধার্ম্মিক রীতিনীতির ঐতিহ্য) এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কুলসঙ্ঘও (সাম্প্রদায়িক সমিতি) বজায় রাখিল। দক্ষিণ-ভারতে যে-সব সাধারণ সমিতি সে-দিন পর্য্যন্ত প্রাচীন সাধারণ সমিতির স্থান অধিকার করিয়াছিল, কতকগুলি পাশাপাশি থাকিয়া কখনও একত্র কখনও বা স্বতন্ত্রভাবে কার্য্য করিত, সেইগুলি ছিল এইরূপ অনুষ্ঠানেরই প্রকারভেদ। রাজপুতনাতেও কুল তাহার রাজনীতিক স্বরূপ ও শক্তি পুনরুদ্ধার করিয়াছিল, কিন্তু অন্য ধরণে; প্রাচীন অনুষ্ঠানগুলি এবং তাহাদের সুমার্জ্জিত ব্যবহার আর ফিরিয়া আসে নাই, যদিও তাহা ক্ষত্রিয়ধর্ম্মোচিত সাহস, সৌজন্য, উদারতা ও মর্য্যাদাজ্ঞান অনেক পরিমাণে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 ভারতীয় কমুন্যাল ব্যবস্থায় আর একটি অধিকতর স্থিতিশক্তিসম্পন্ন জিনিষ ছিল, সেটি প্রাচীন চাতুর্ব্বর্ণ্যের কাঠামোতে গড়িয়া উঠিয়াছিল, এমন কি শেষ পর্য্যন্ত চাতুর্ব্বর্ণ্যেরই স্থান অধিকার করিয়া অসাধারণ জীবনীশক্তি ও প্রভাবশীল প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। সেইটি হইতেছে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জাতিভেদ প্রথা। আজ সেইটির ম্রিয়মাণ অবস্থা হইলেও, সেটি এখনও নড়িতে চাহিতেছে না। নানা শক্তির চাপে প্রাচীন চারি বর্ণের মধ্যে নানা বিভাগ উৎপন্ন হয়, আদিতে সেই সব বিভাগ হইতেই জাতিভেদের উদ্ভব। ব্রাহ্মণগণের মধ্যে যে নানা বিভাগের উদ্ভব হয়, তাহার প্রধান কারণ ছিল ধর্ম্ম, সমাজ ও আচার-অনুষ্ঠান-সম্বন্ধীয় বিভিন্ন রীতি-নীতি, কিন্তু স্থানভেদ ও দেশভেদের ফলেও নানা শ্রেণীভেদ হইয়াছিল। ক্ষত্ত্রিয়রা অধিকাংশ এক শ্রেণীই ছিল, যদিও তাহারা বিভিন্ন কুলে বিভক্ত ছিল। অন্যপক্ষে বৈশ্য ও শূদ্রগণ, অর্থনীতিক কর্ম্মবিভাগের প্রয়োজনবশে বংশানুক্রমনীতি অনুসারে অসংখ্য জাতিতে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ভারতে ক্রমশঃ বেশী বেশী কড়াকড়ির সহিত বংশানুক্রমনীতি অনুসৃত হইয়াছিল, নতুবা এইরূপ স্থায়িভাবে অর্থনীতিক কর্ম্মবিভাগ অন্যান্য দেশের ন্যায় গিল্ড্ বা বৃত্তিসঙ্ঘ গঠন করিয়া সম্পন্ন হইতে পারিত। বস্তুতঃ নগরসকলে আমরা শক্তিশালী ও দক্ষ গিল্ড্ প্রথার[২] অস্তিত্ব দেখিতে পাই। কিন্তু কালক্রমে এই প্রথা অব্যবহার্য্য হইয়া পড়ে এবং অধিকতর ব্যাপক জাতিভেদপ্রথাই সর্ব্বত্র অর্থনীতিক কর্ম্মবিভাগের একমাত্র ভিত্তি হইয়া দাঁড়ায়। নগরে ও গ্রামে জাতি ছিল স্বতন্ত্র কম্যুন্যাল মূল অনুষ্ঠান, উহা ছিল একই সঙ্গে ধর্ম্ম, সমাজ ও অর্থনীতিবিষয়ক সঙ্ঘ, নিজের ধার্ম্মিক, সামাজিক ও অন্যান্য প্রশ্নের মীমাংসা নিজেই করিত, এবং নিজের অন্তর্গত লোকসকলের আধিপত্য করিত, তাহাতে বাহিরের কেহ কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিতে পারিত না। কেবল ধর্ম্মের মূলতত্ত্ব-সম্বন্ধীয় প্রশ্নসকল সমাধানে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ব্যাখ্যা ও বিধানই প্রামাণ্য বলিয়া স্বীকার করা হইত। যেমন কুলের তেমনই প্রত্যেক জাতিরও জাতিধর্ম্ম অর্থাৎ জীবনযাত্রা ও আচারব্যবহার সম্বন্ধে নিজ নিজ বিশিষ্ট রীতি-নীতি ছিল, এবং জাতির কম্যুন্যাল বা সমষ্টিগত জীবনের মুখপাত্রস্বরূপ জাতীয় সমিতি বা জাতিসঙ্ঘ ছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তাহার সকল অনুষ্ঠানেই কম্যুন্যাল বা সমষ্টিগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, ব্যষ্টিগত ভিত্তির উপর নহে। সেই হেতু রাজ্যের রাষ্ট্রনীতিক ও শাসনসম্বন্ধীয় ব্যাপারে জাতিকেও গণ্য করা হইত। গিল্ডগুলিও ব্যবসা ও শিল্পবিষয়ক মূল কম্যুন্যাল অনুষ্ঠানরূপে সেই রকমই স্বাধীনভাবে কার্য্য করিত, তাহাদের কার্য্য নির্ব্বাহ ও আলোচনার জন্য সভায় সমবেত হইত; আবার তাহাদের মিলিত সভাও ছিল, বোধ হয় সেই মিলিত সভাগুলিই এককালে নগরের শাসকসমিতিরূপে কার্য্য করিত। শাসনকার্য্য-নির্ব্বাহক এই গিল্ডগুলি (সেগুলি কেবলমাত্র মিউনিসিপ্যালিটী ছিল না) কালক্রমে অধিকতর ব্যাপক নাগরিক সমিতিতে পর্যবসিত হয়। এই শেষোক্ত সমিতি নগরের সমস্ত গিল্ড ও সমস্ত বর্ণের অন্তর্গত জাতিসঙ্ঘগুলির মিলিত প্রতিনিধি ছিল। জাতিগুলি জাতি হিসাবে রাজ্যের সাধারণ সমিতিতে সাক্ষাৎ-ভাবে প্রতিনিধি পাঠাইতে পারিত না বটে, কিন্তু স্থানীয় ব্যাপারের কার্য্য নির্ব্বাহে তাহাদের নিজস্ব অধিকার ছিল।

 গ্রামসঙ্ঘ ও নগরসঙ্ঘ, এই দুইটি ছিল সমগ্র রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠানের সর্ব্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট স্থায়ী ভিত্তি; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, এইগুলি কেবল স্থানভাগ মাত্র ছিল না, অথবা প্রতিনিধি নির্ব্বাচন, শাসনকার্য্য নির্ব্বাহ বা অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক উদ্দেশ্যসাধনের সুবিধাজনক যন্ত্রমাত্র ছিল না, পরন্তু সেগুলি সকল সময়ে, সত্য সত্যই মূল কমুন্যাল অনুষ্ঠান বা সমষ্টিজীবনের জীবন্ত সঙ্ঘ ছিল। তাহাদের ছিল নিজের ভিতরের নিজস্ব স্বতন্ত্র সুনিয়ন্ত্রিত জীবন, তাহা প্রেরণায়, নিজের শক্তিতে কার্য্য করিত, কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা নিম্নতন অংশরূপেই কার্য্য করিত না। গ্রামসঙ্ঘকে ক্ষুদ্র গ্রাম্য রিপাবলিক বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে, এবং এই বর্ণনায় কিছুমাত্র অত্যুক্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। কারণ, প্রত্যেক গ্রাম ছিল আপন সীমার মধ্যে স্বাধীন ও স্বনির্ভরশীল, নিজের নির্ব্বাচিত পঞ্চায়েত ও নির্ব্বাচিত বা বংশানুক্রমিক কর্ম্মচারীর দ্বারা শাসিত হইত, নিজের শিক্ষা, শান্তিরক্ষা, বিচার এবং সমস্ত অর্থনীতিক প্রয়োজনসাধনের ব্যবস্থা করিত, স্বাধীন স্বায়ত্তশাসনমূলক মৌলিক অনুষ্ঠানরূপে নিজের জীবন নিজেই নিয়ন্ত্রিত করিত। গ্রামগুলির পরস্পরের সহিত কার্য্যও তাহারা নানাভাবে সম্মিলিত হইয়া সম্পাদন করিত; কতকগুলি গ্রাম মিলিয়া এক এক জন নির্ব্বাচিত বা বংশানুক্রমিক নেতার অধীনে সমষ্টিবদ্ধ হইত এবং এইরূপ গ্রামসমষ্টিরও একটা স্বাভাবিক সমষ্টিগত জীবন ছিল, যদিও তাহা অপেক্ষাকৃত শিথিলভাবেই সঙ্ঘবদ্ধ ছিল।

 কিন্তু, ভারতের নগরসঙ্ঘগুলিও কম স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসনশীল অনুষ্ঠান ছিল বলিয়া মনে হয় না, সেগুলি নিজেদের সভা ও সমিতির দ্বারা শাসিত হইত, তাহাদের নির্ব্বাচনপ্রথা ছিল, ভোটের ব্যবহার ছিল। নিজেদের স্বাধিকারে তাহারা নিজেদের ব্যাপার পরিচালনা করিত এবং গ্রামগুলির ন্যায়ই রাজ্যের সাধারণ সমিতি জানপদে প্রতিনিধি প্রেরণ করিত। নাগরিক শাসনপ্রণালীর অন্তর্গত ছিল সে সমুদয় কর্ম্ম, যাহা নগরবাসীর আর্থিক বা অন্যান্য কল্যাণের অনুকূল, যথা, শান্তিরক্ষা, বিচার, রাস্তাঘাট আদি নির্ম্মাণ ও মেরামত, ধর্ম্মস্থান প্রভৃতি সংরক্ষণ, রেজিষ্ট্রেশন, মিউনিসিপ্যাল টেক্স নির্দ্ধারণ এবং ব্যবসা, শিল্প-বাণিজ্যবিষয়ক ব্যাপার সকলের ব্যবস্থা। যদি গ্রামসঙ্ঘকে ক্ষুদ্র রিপাবলিক বলিয়া বর্ণনা করা চলে, তাহা হইলে নগরসঙ্ঘগুলিকেও সেইরকম বৃহত্তর নাগরিক রিপাবলিক বলিয়া বর্ণনা করা যাইতে করা যাইতে পারে। ইহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, নৈগম ও পৌর সমিতিগুলি নিজেদের মুদ্রা প্রস্তুত করিতে পারিত, অন্যথা এ ক্ষমতা কেবল রাজা বা রাজশক্তির হস্তেই ছিল।

 আর একপ্রকার সমষ্টি-জীবনের উল্লেখ করা আবশ্যক। তাহাদের কোনরূপ রাজনীতিক অস্তিত্ব ছিল না, তথাপি সেগুলি আপন আপনভাবে স্বায়ত্তশাসনমূলক অনুষ্ঠান ছিল; এইগুলি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ভারতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ক্ষেত্রেই প্রবল ঝোঁক হইতেছে নিবিড়ভাবে কম্যুন্যাল বা সমষ্টিগত রূপের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ। একটি উদাহরণ, যৌথ পরিবার; ভারতের সর্ব্বত্রই ইহা প্রচলিত এবং কেবল আধুনিক অবস্থার চাপে ইহা এখন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; এই যৌথপরিবারের দুইটি মূলসূত্র হইতেছে, প্রথমতঃ এক বংশে যাহারা জন্মিয়াছে এবং তাহাদের পরিবারবর্গ সকলে মিলিয়া সমষ্টিগতভাবে সম্পত্তি ভোগ করা, ও পরিবারের যিনি প্রধান ব্যক্তি তাঁহার অধীনে যতদূর সম্ভব অবিভক্ত কম্যুন্যাল জীবন যাপন করা, দ্বিতীয়তঃ, প্রত্যেক পুরুষের পক্ষে পিতার সম্পত্তিতে সমান অংশে স্বত্ববান্ হওয়া, সম্পত্তির বিভাগ হইলেই সে এই অংশ দাবী করিতে পারে। এই কম্যুন্যাল ঐক্য অথচ সেই সঙ্গেই ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্থায়ী স্বত্বাধিকার, ইহা হইতেই বেশ বুঝা যায়, ভারতীয় জীবনধারা ও মনোভাব কেমন সমন্বয়ের পক্ষপাতী, জীবনের মূল সত্যগুলিকে কেমন ইহা স্বীকার করিয়া চলে এবং সাধারণ ব্যবহারে সেগুলি পরস্পরের বিরোধী প্রতীয়মান হইলেও কেমন করিয়া তাহাদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করে। সমন্বয়ের দিকে এইরূপ প্রবৃত্তিই ভারতীয় সমাজ-রাষ্ট্রের সকল অংশে বিভিন্ন ভাবে যাজক, রাজকীয়, আভিজাতিক, ধনিক ও সাধারণতান্ত্রিক ধারা সকলের সামঞ্জস্যসাধন করিয়া এমন এক সমগ্রতার বিকাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছে, যাহার উপরে ইহাদের কোন একটিরই বিশিষ্ট ছাপ পড়িবে না, তাহা কতকগুলা ঠেক-ঠাক দিয়া কিম্বা কোন মনগড়া থিওরি বা মতবাদ অনুসরণ করিয়া কেবল একটা বাহ্য মিটমাট বা মিশ্রণমাত্র হইবে না, পরন্তু তাহা হইবে জটিল বহুমুখী সমাজ-মন ও প্রকৃতির সহজাত সংস্কার ও স্বরূপের স্বাভাবিক বাহ্য প্রকাশ।

 আর একদিকে, ভারতীয় জীবনের বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার সীমায় আমরা দেখিতে পাই, ধর্ম্মবিষয়ক সমাজ। আবার ইহাও কম্যুন্যাল রূপ গ্রহণ করিয়াছিল। আদি বৈদিক সমাজে চার্চ্চ বা ধর্ম্মসঙ্ঘ বা যাজক সম্প্রদায়ের কোনও স্থান ছিল না। কারণ, সে ব্যবস্থায় সমুদয় লোক ধর্ম্ম ও রাষ্ট্রবিষয়ে একীভূত সমগ্র জীবনে সংবদ্ধ ছিল, ঐহিক ও ধার্ম্মিক, যাজক ও সাধারণ ব্যক্তি, এরূপ কোনও ভেদ ছিল না এবং পরে নানামুখী বিকাশ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম্ম মোটের উপর, অন্ততঃ ভিত্তিরূপে, এই নীতিটিকেই ধরিয়া রাখিয়াছে। অন্য পক্ষে ক্রমশঃ সন্ন্যাসের দিকে বেশী বেশী ঝোঁক হওয়ার ফলে ধর্ম্মজীবনের সহিত ঐহিক জীবনের ভেদ করা হয়, এবং স্বতন্ত্র ধর্ম্মসঙ্ঘ গঠনের প্রবৃত্তি জন্মায়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম্মের অভ্যুত্থানে সেই প্রবৃত্তি স্থায়ী ভাব গ্রহণ করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুসম্প্রদায়েই সুসম্বদ্ধ ধর্ম্মসঙ্ঘের পূর্ণ মূর্ত্তি প্রথম বিকসিত হয়। এখানে আমরা দেখিতে পাই যে, বুদ্ধ ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের সুবিদিত নীতিগুলিই সন্ন্যাসজীবনগঠনে প্রয়োগ করিয়াছিলেন। তিনি যে সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে সম্প্রদায় হইবে ধর্ম্মসঙ্ঘ, প্রত্যেক মঠ হইবে এক একটি ধর্ম্মমূলক কমিউন্ (Religious commune), তাহা সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠীর জীবন যাপন করিবে। বৌদ্ধগণ কর্ততৃক প্রচারিত ধর্ম্মপালনই হইবে তাহার সকল নিয়ম, লক্ষণ ও জীবনযাপন-প্রণালীর ভিত্তি ও আদর্শ। ইহা বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে, ঠিক এইটিই ছিল সমগ্র হিন্দু সমাজের মূল নীতি ও আদর্শ। তবে এখানে আধ্যাত্মিক ও কেবল ধর্ম্ম-জীবনের ক্ষেত্র বলিয়া সেটিকে উচ্চতর প্রগাঢ়তা দেওয়া সম্ভব হইয়াছিল। এই সঙ্ঘ ভারতের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কম্যুন্যাল অনুষ্ঠানগুলির ন্যায়ই নিজের কার্য্যাদি পরিচালন করিত। ভিক্ষুমণ্ডলী সমিতিতে সমবেত হইয়া ধর্ম্ম সম্বন্ধে বিচার্য্য প্রশ্নের আলোচনা করিত, এবং রিপাবলিকের সভাগৃহগুলির ন্যায় এখানেও ভোটের দ্বারা মীমাংসা করা হইত, তবে যাহাতে অতিমাত্রায় ডেমক্রেটিক প্রণালীর আনুষঙ্গিক দোষগুলি ঘটিতে না পারে, তাহারও প্রতিবিধান করিবার ব্যবস্থা ছিল। এই মঠপ্রথা এইরূপে একবার সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে, পরে বৌদ্ধদের নিকট হইতে গোঁড়া হিন্দুগণ সেটি গ্রহণ করে, তবে সেরূপ সবিস্তার ব্যবস্থা নহে। এইরূপে গঠিত ধর্ম্মসম্প্রদায়গুলি যেখানেই প্রাচীন ব্রাহ্মণতন্ত্র অপেক্ষা প্রভাবশালী হইতে পারিয়াছিল—যেমন শঙ্করাচার্য্য কর্ত্তৃক সৃষ্ট সম্প্রদায়—সেইখানেই সেগুলি সমাজের সাধারণ অধিবাসিগণের ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় নেতা হইয়া উঠিয়াছিল, তবে তাহারা কখনই রাজনীতিক শক্তি অধিকার করিবার স্পর্দ্ধা করে নাই, এবং চার্চ্চ ও ষ্টেটের মধ্যে সংগ্রাম ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ইতিহাসে কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না।

 অতএব স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, প্রাচীন ভারতের সমগ্র জীবন, বৃহৎ রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলির সময়েও, তাহার প্রাথমিক নীতি ও মূল কর্ম্মধারা বজায় রাখিয়াছিল, এবং তাহার সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা মূলতঃ ছিল স্ব-নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসনশীল সঙ্ঘসকল লইয়া গঠিত বহুমুখী জটিল সংস্থান। এই সংস্থানের উপরে সুসম্বদ্ধ ষ্টেট্-আধিপত্যের বিকাশ অন্যান্য স্থানের ন্যায় ভারতেও প্রয়োজন হইয়াছিল দুই কারণে; অংশতঃ এই কারণে যে, সমাজে স্বভাবতঃ যে শিথিল শৃঙ্খলা ও সঙ্গতি বিকশিত হয়, তাহা অল্পপরিসর জীবনের পক্ষে যথেষ্ট হইলেও, সমাজের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কার্য্যকরী বুদ্ধি তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া আরও সুচিন্তিত ও সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা ও সঙ্গতিবিধান করিতে চাহিয়াছিল; কিন্তু আরও বিশেষ কারণ হইয়াছিল এই যে, যুদ্ধ, আক্রমণ, আত্মরক্ষা প্রভৃতি সামরিক ব্যাপারের সুব্যবস্থা এবং অন্যান্য দেশের সহিত কার্য্য-নির্ব্বাহের ভার এক কেন্দ্রীভূত শক্তির হস্তে ন্যস্ত করা অপরিহার্য্য হইয়া পড়িয়াছিল। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ষ্টেটের বিস্তারের দ্বারা হয় ত প্রথম প্রয়োজনটি সিদ্ধ হইতে পারিত, কারণ, ইহার মধ্যে সে সম্ভাবনা এবং তদুপযোগী নানা অনুষ্ঠানও ছিল, কিন্তু রাজতন্ত্রের প্রণালী অধিকতর সঙ্কুচিত ও সহজ কেন্দ্রানুগতার জন্য অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক ও দক্ষতর অনুষ্ঠান বলিয়াই প্রতীত হইয়াছিল। আর বাহিরের কাজটির জন্য গণতন্ত্র ভারতের উপযোগী হয় নাই। কারণ, প্রাচীনকালে ভারতকে একটা দেশ না বলিয়া মহাদেশ বলাই ঠিক হইত, এবং এই বিরাট মহাদেশকে রাষ্ট্রনীতিক ঐক্যে বদ্ধ করা প্রথম হইতেই এক যুগযুগব্যাপী কঠিন সমস্যারূপে দেখা দিয়াছিল। এরূপ অবস্থায় গণতন্ত্র তাহার সুদক্ষ সামরিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষে অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছিল। কারণ, উহা আক্রমণ অপেক্ষা আত্মরক্ষা করিতেই অধিকতর শক্তিশালী ছিল। এইজন্য অন্যান্য দেশের ন্যায় ভারতেও রাজতন্ত্রের শক্তিশালী অনুষ্ঠানই শেষ পর্য্যন্ত জয়ী হইয়াছিল এবং অন্য সমুদয়কে গ্রাস করিয়া লইয়াছিল। কিন্তু সেই সঙ্গেই ভারতের মনীষা নিজ মূল স্বানুভূতি ও আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠাবশতঃ ভারতবাসীর প্রকৃতি অনুযায়ী কম্যুন্যাল স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি বজায় রাখিয়াছিল, রাজতন্ত্রকে স্বেচ্ছাচারমূলক হইয়া উঠিতে বা তাহার নির্দ্দিষ্ট কার্য্যের গণ্ডী অতিক্রম করিতে দেয় নাই, এবং যাহাতে উহা সমাজ-জীবনকে প্রাণহীন যন্ত্রবৎ করিয়া না তোলে সে বিষয়ে বাধা দিতে কৃতকার্য্য হইয়াছিল। কেবল সুদীর্ঘ অবনতির যুগেই আমরা দেখিতে পাই যে, রাজকীয় প্রভুত্ব এবং জনসাধারণের স্ব-নিয়ন্ত্রণশীল কম্যুন্যাল জীবন এতদুভয়ের মধ্যস্থস্বরূপ যে-সব স্বাধীন অনুষ্ঠান ছিল সেগুলি হয় ক্রমশঃ লোপের দিকে অগ্রসর হইয়াছে অথবা তাহাদের পূর্ব্বতন শক্তি ও তেজস্বিতা অনেকখানি হারাইয়া ফেলিয়াছে, এবং আমলাতন্ত্রমূলক ব্যক্তিগত শাসনের ও কেন্দ্রীয় গবর্ণমেণ্টের অত্যধিক আধিপত্যের দোষগুলি একে একে দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছে। যত দিন ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রাচীন রীতিনীতিগুলির স্মৃতি বজায় ছিল এবং যে-পরিমাণে সেগুলি সজীব ও কার্য্যকরী ছিল, তত দিন এই সব দোষ এখানে-সেখানে ক্ষণস্থায়িভাবে দেখিতে পাওয়া যাইত, অথবা সেগুলি অতিমাত্রায় বাড়িয়া উঠিতে পারে নাই। পরে যখন একদিকে বিদেশীর আক্রমণ ও পরাধীনতা, অন্যদিকে ভারতের প্রাচীন কাল্‌চারের মন্থর অবনতি এবং শেষ পর্য্যন্ত পতন, এই দুইটি একসঙ্গে মিলিত হইল, তখনই প্রাচীন অনুষ্ঠানটি বহু অংশে ভাঙ্গিয়া পড়িল, দেশের সমাজ-রাষ্ট্রজীবন অধঃপতিত ও ছন্নছাড়া হইয়া গেল। পুনরভ্যুত্থান বা নূতন সৃষ্টির আর কোন যথেষ্ট উপায় বজায় রহিল না।

 ভারতীয় সভ্যতার উচ্চতম বিকাশ ও গৌরবের দিনে আমরা দেখিতে পাই, এক অপূর্ব্ব রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি। তাহা ছিল উৎকৃষ্টরূপে কার্য্যক্ষম এবং তাহা কম্যুন্যাল স্বায়ত্তশাসনের সহিত দৃঢ়প্রতিষ্ঠতা ও সুশৃঙ্খলার পূর্ণ সমন্বয়সাধন করিয়াছিল। ষ্টেট্ নিজের শাসন, বিচার, অর্থনীতি ও দেশরক্ষাবিষয়ক কার্য্য নির্ব্বাহ করিত, কিন্তু ঐ সকল বিভাগে জনসাধারণের এবং তাহাদিগকে লইয়া গঠিত অনুষ্ঠানসকলের অধিকার ও স্বাধীন কার্য্যে বিঘ্ন বা হস্তক্ষেপ করিত না। রাজধানীতে ও দেশের মধ্যে রাজকীয় আদালতগুলি ছিল শ্রেষ্ঠ বিচারালয়, সেগুলি সমস্ত রাজ্যের বিচারকার্য্যের মধ্যে সঙ্গতিবিধান করিত; কিন্তু গ্রামসঙ্ঘ ও নগরসঙ্ঘগুলি নিজেদের আদালতে যে শাসনক্ষমতা অর্পণ করিয়াছিল, তাহার উপর রাজকীয় বিচারালয়গুলি অযথাভাবে হস্তক্ষেপ করিত না। এমন কি, রাজকীয় বিচারালয় গিল্ড্‌, জাতি ও পরিবারের নিজস্ব আদালতগুলির সহিত সহযোগিতা করিত, এগুলির দ্বারা প্রচুর পরিমাণে সালিশ নিষ্পত্তি হইত, এবং রাজকীয় আদালত কেবল বড় বড় অপরাধগুলিরই বিচারের ভার নিজেদের হস্তে রাখিতে চাহিত। যেমন বিচারকার্য্য, তেমনই রাষ্ট্রকার্য্য নির্ব্বাহ ও অর্থনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগে গ্রামসঙ্ঘ ও নগরসঙ্ঘগুলির অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হইত। নগরে ও দেশে রাজার শাসনকর্ত্তা ও কর্ম্মচারিগণ জনসাধারণ ও তাহাদের সমিতি কর্ত্তৃক নিয়োজিত শাসনকর্ত্তা, কর্ম্মচারী ও সাম্প্রদায়িক মুখ্যগণের পাশাপাশি থাকিয়াই কার্য্য করিত। ষ্টেট্ দেশবাসীর ধর্ম্ম-বিষয়ে স্বাধীনতায় অথবা প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনীতিক জীবনপ্রণালীতে, হস্তক্ষেপ করিত না; ষ্টেটের কাজ ছিল কেবল সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, এবং যাহাতে জাতীয় জীবনের সমস্ত কার্য্য জোরের সহিত নির্ব্বাহিত হয় সেই জন্য প্রয়োজনীয় পরিদর্শন করা, সাহায্য করা, সঙ্গতিবিধান করা, সকলরূপ সুবিধা ও সুযোগ করিয়া দেওয়া। ভারতের জাতীয় প্রতিভা যে স্থাপত্য, আর্ট, কালচার, শিক্ষা, সাহিত্য পূর্ব্বেই সৃষ্টি করিয়াছিল, সে-সবের উন্নতি করিতে উৎসাহ দেওয়া ও সাহায্য করা বিষয়ে ষ্টেটের যে পরম সুযোগ আছে, ষ্টেট তাহা খুবই বুঝিত এবং সর্ব্বদা উদারতার সহিত সে কর্ত্তব্য সম্পাদন করিত। রাজা ছিলেন এক স্বাধীন জীবন্ত জাতির মহান্ সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার সম্মানার্হ ও শক্তিশালী মস্তকস্বরূপ, এবং রাজার শাসনপদ্ধতি ছিল উহার শ্রেষ্ঠ কার্য্য-নির্ব্বাহক অনুষ্ঠানস্বরূপ, তাহা স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র বা আমলাতন্ত্র ছিল না বা জাতীয় জীবনকে পেষণ করিবার যন্ত্র ছিল না।


  1. এই অনুষ্ঠানগুলি সম্বন্ধে তথ্য মিঃ জয়াসোয়ালের (Mr. Jayaswal) জ্ঞানগর্ভ ও বিশেষ সতর্কতার সহিত প্রমাণযুক্ত গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে; আমার বর্ত্তমান আলোচনায় যেগুলি প্রাসঙ্গিক কেবল সেই কথাগুলিই আমি এখানে বাছিয়া লইয়াছি।
  2. গিল্ড্ (Guild) বলিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্ঘ বুঝায়। প্রাচীন ভারতে ইহাদিগকে “শ্রেণী” বা “পুগ” বলা হইত। নগরের গিল্ড্ সমূহকে সাধারণভাবে “নৈগম” বলা হইত। —অনুবাদক।