মহাভারত (রাজশেখর বসু)/অনুশাসনপর্ব
অনুশাসনপর্ব
১। গৌতমী, ব্যাধ, সর্প, মৃত্যু ও কাল
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি বহু প্রকার শান্তিবিষয়ক কথা বলেছেন, কিন্তু জ্ঞাতিবধজনিত পাপের ফলে আমার মন শান্ত হচ্ছে না। আপনাকে শরে আবৃত ক্ষতবিক্ষত ও রুধিরাক্ত দেখে আমি অবসন্ন হচ্ছি। আমরা যে নিন্দিত কর্ম করেছি তার ফলে আমাদের গতি কিপ্রকার হবে? দুর্যোধনকে ভাগ্যবান মনে করি, তিনি আপনাকে এই অবস্থায় দেখছেন না। বিধাতা পাপকর্মের জন্যই নিশ্চয় আমাদের সৃষ্টি করেছেন। যদি আমাদের প্রিয়কামনা করেন তবে এমন উপদেশ দিন যাতে পরলোকে পাপমুক্ত হতে পারি। ভীষ্ম বললেন, মানুষের আত্মা বিধাতার অধীন, তাকে পাপপুণ্যের কারণ মনে করছ কেন? আমরা যে কর্ম করি তার হেতু অতি সূক্ষ্ম এবং ইন্দ্রিয়ের অগোচর। আমি এক প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।—
গৌতমী নামে এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী ছিলেন, তাঁর পুত্র সর্পের দংশনে হতচেতন হয়। অর্জুনক নামে এক ব্যাধ ক্রুদ্ধ হয়ে সর্পকে পাশবদ্ধ ক’রে গৌতমীর কাছে এনে বললে, এই সর্পাধম আপনার পুত্রহন্তা, বলুন একে কি ক’রে বধ করব; একে অগ্নিতে ফেলব, না খণ্ড খণ্ড ক’রে কাটব? গৌতমী বললেন, অর্জুনক, তুমি নির্বোধ, এই সর্পকে মেরো না, ছেড়ে দাও। একে মারলে আমার পুত্র বেঁচে উঠবে না, একে ছেড়ে দিলে তোমারও কোনও অপকার হবে না। এই প্রাণবান জীবকে হত্যা ক’রে কে অনন্ত নরকে যাবে?
ব্যাধ বললে, আপনি যে উপদেশ দিলেন তা প্রকৃতিস্থ মানুষের উপযুক্ত, কিন্তু তাতে শোকার্তের সান্ত্বনা হয় না। যারা শান্তিকামী তারা কালবশে এমন হয়েছে এই ভেবে শোক দমন করে, যারা প্রতিশোধ বোঝে তারা শত্রুনাশ ক’রেই শোকমুক্ত হয়, এবং অন্য লোকে মোহবশে সর্বদাই বিলাপ করে। অতএব এই সর্ম্পকে বধ ক’রে আপনি শোকমুক্ত হ’ন। গৌতমী বললেন, যারা আমার ন্যায় ধর্মনিষ্ঠ তাদের শোক হয় না; এই বালক নিয়তির বশেই প্রাণত্যাগ করেছে, সেজন্য আমি সর্পকে বধ করতে পারি না। ব্রাহ্মণের পক্ষে কোপ অকর্তব্য, তাতে কেবল যাতনা হয়। তুমি এই সর্পকে ক্ষমা ক’রে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, একে মারলে বহু লোকের প্রাণরক্ষা হবে, অপরাধীকে বিনষ্ট করাই উচিত।
ব্যাধ বার বার অনুরোধ করলেও গৌতমী সপর্বধে সম্মত হলেন না। তখন সেই সর্প মৃদুস্বরে মনুষ্যভাষায় ব্যাধকে বললে, মূর্খ অর্জুনক, আমার কি দোষ? আমি পরাধীন, ইচ্ছা ক’রে এই বালককে দংশন করি নি, মৃত্যু কর্তৃক প্রেরিত হয়ে করেছি; যদি পাপ হয়ে থাকে তবে মৃত্যুরই হয়েছে। ব্যাধ বললে, অন্যের বশবর্তী হলেও তুমি এই পাপকার্যের কারণ, সেজন্য বধযোগ্য। সর্প বললে, কেবল আমিই কারণ নই, বহু কারণের সংযোগে এই কার্য হয়েছে। ব্যাধ বললে, তুমিই এই বালকের প্রাণনাশের প্রধান কারণ, অতএব বধযোগ্য।
সর্প ও ব্যাধ যখন এইরূপ বাদানুবাদ করছিল তখন স্বয়ং মৃত্যু সেখানে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ওহে সর্প, আমি কাল কর্তৃক প্রেরিত হয়ে তোমাকে প্রেরণ করেছি, অতএব তুমি বা আমি এই বালকের বিনাশের কারণ নই। জগতে স্থাবর জঙ্গম সূর্য চন্দ্র বিষ্ণু ইন্দ্র জল বায়ু অগ্নি প্রভৃতি সমস্তই কালের অধীন, অতএব তুমি আমার উপর দোষারোপ করতে পার না। সর্প বললে, আপনাকে আমি দোষী বা নির্দোষী বলছি না, আমি আপনার প্রেরণায় দংশন করেছি—এই কথাই বলেছি; দোষ নির্ধারণ আমার কার্য নয়। ব্যাধ, তুমি মৃত্যুর কথা শুনলে, এখন আমাকে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, তুমি যে নির্দোষ তার প্রমাণ হ’ল না, তুমি ও মৃত্যু উভয়েই এই বালকের বিনাশের কারণ, তোমাদের ধিক।
এমন সময় স্বয়ং কাল আবির্ভূত হয়ে ব্যাধকে বললেন, আমি বা মৃত্যু বা এই সর্প কেউ অপরাধী নই, এই শিশু নিজ কর্মফলেই বিনষ্ট হয়েছে। কুম্ভকার যেমন মৃৎপিণ্ড থেকে ইচ্ছানুসারে বস্তু উৎপাদন করে, মানুষও সেইরূপ আত্মকৃত কর্মের ফল পায়। এই শিশু নিজেই তার বিনাশের কারণ।
গৌতমী বললেন, কাল বা সর্প বা মৃত্যু কেউ এই বালকের বিনাশের কারণ নয়, নিজ কর্মফলেই এ বিনষ্ট হয়েছে, আমিও নিজ কর্মফলে পুত্রহীনা হয়েছি। অতএব কাল ও মৃত্যু এখন প্রস্থান করুন, তুমিও সর্পকে মুক্তি দাও। গৌতমী এইরূপ বললে কাল ও মৃত্যু চ’লে গেলেন, ব্যাধ সর্পকে ছেড়ে দিলে, গৌতমীও শোকশূন্য হলেন।
উপাখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, যুদ্ধে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা সকলেই কালের প্রভাবে নিজ কর্মের ফল পেয়েছেন, তোমার বা দুর্যোধনের কর্মের জন্য তাঁদের মরণ হয় নি। অতএব তুমি শোক ত্যাগ কর।
২। সুদর্শন-ওঘবতীর অতিথিসৎকার
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, গৃহস্থ ধর্মপরায়ণ হয়ে কি ক’রে মৃত্যুকে জয় করতে পারে তা বলুন। ভীষ্ম বললেন, আমি এক ইতিহাস বলছি শোন।—মাহিষ্মতী নগরীতে ইক্ষ্বাকুবংশীয় দুর্যোধন নামে এক ধর্মাত্মা রাজা ছিলেন। তাঁর ঔরসে দেবনদী নর্মদার গর্ভে সুদর্শনা নামে এক পরমরূপবতী কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। ভগবান অগ্নিদেবের অভিলাষ জেনে রাজা তাঁকে কন্যাদান করলেন এবং শুল্কস্বরূপ এই বর পেলেন যে অগ্নি সর্বদা মাহিষ্মতীতে অধিষ্ঠিত থাকবেন। সহদেব যখন দক্ষিণ দিক জয় করতে গিয়েছিলেন তখন তিনি সেই অগ্নি দেখেছিলেন[১]। অগ্নিদেবের ঔরসে সুদর্শনার এক পুত্র হ’ল, তাঁর নাম সুদর্শন। সুদর্শনের সঙ্গে নৃগ রাজার পিতামহ ওঘবানের কন্যা ওঘবতীর বিবাহ হ’ল।
সুদর্শন পত্নীর সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে বাস করতে লাগলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে গৃহস্থাশ্রমে থেকেই মৃত্যুকে জয় করবেন। তিনি ওঘবতীকে বললেন, তুমি অতিথিকে সর্বপ্রকারে তুষ্ট রাখবে, এমন কি প্রয়োজন হ’লে নির্বিচারে নিজেকেও দান করবে। আমি গৃহে থাকি বা না থাকি তুমি কখনও অতিথিসেবায় অবহেলা করবে না। কল্যাণী, অতিথি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। ওঘবতী তাঁর মস্তকে অঞ্জলি রেখে বললেন, তোমার আদেশ অবশ্যই পালন করব।
একদিন সুদর্শন কাষ্ঠ সংগ্রহ করতে গেলে স্বয়ং ধর্ম ব্রাহ্মণের বেশে ওঘবতীর কাছে এসে বললেন, আমি তোমার অতিথি, যদি গার্হস্থ্যধর্মে তোমার আস্থা থাকে তবে আমার সৎকার কর। ওঘবতী আসন ও পাদ্য দিয়ে বললেন, বিপ্র, আপনার কি প্রয়োজন? ব্রাহ্মণরূপী ধর্ম বললেন, তোমাকেই আমার প্রয়োজন। ওঘবতী অন্যান্য অভীষ্ট বস্তুর প্রলোভন দেখালেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ তাতে সম্মত হলেন না। তখন তিনি পতির আজ্ঞা স্মরণ করে সলজ্জভাবে বললেন, তাই হ’ক, এবং ব্রাহ্মণের সঙ্গে সহাস্যে অন্য গৃহে গেলেন।
সুদর্শন ফিরে এসে পত্নীকে দেখতে না পেয়ে বার বার ডাকতে লাগলেন। ওঘবতী তখন ব্রাহ্মণের বাহুপাশে বদ্ধ ছিলেন এবং নিজেকে উচ্ছিষ্ট মনে ক’রে পতির আহ্বানের উত্তর দিলেন না। সুদর্শন আবার বললেন, আমার সাধ্বী পতিব্রতা সরলা পত্নী কোথায় গেল, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার কিছুই নেই। তখন কুটীরের ভিতর থেকে ব্রাহ্মণ বললেন, অগ্নিপুত্র সুদর্শন, আমি অতিথি ব্রাহ্মণ তোমার গৃহে এসেছি, তোমার ভার্যা আমার প্রার্থনা পূরণ করছেন; তোমার যা উচিত মনে হয় কর।
সুদর্শনের পশ্চাতে লৌহমুদ্গরধারী মৃত্যু অদৃশ্যভাবে অপেক্ষা করছিলেন; তিনি স্থির করেছিলেন, সুদর্শন যদি অতিথিসৎকারব্রত পালন না করেন তবে তাঁকে বধ করবেন। অতিথির কথা শুনে সুদর্শন বিস্মিত হলেন, এবং ঈর্ষা ও ক্রোধ ত্যাগ ক’রে বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনার সুরত সম্পন্ন হ’ক, আমার প্রাণ পত্নী এবং আর যা কিছু আছে সবই আমি অতিথিকে দান করতে পারি। আমি সত্য কথা বলেছি, এই সত্যদ্বারা দেবতারা আমাকে পালন করুন অথবা দহন করুন। তখন সেই অতিথি ব্রাহ্মণ কুটীর থেকে বেরিয়ে এসে ত্রিলোক অনুনাদিত ক’রে বললেন, আমি ধর্ম, তোমাকে পরীক্ষা করবার জন্য এসেছি। মৃত্যু সর্বদা তোমার রন্ধ্র অনুসন্ধান করছিলেন, তাঁকে তুমি জয় করেছ। নরশ্রেষ্ঠ, ত্রিলোকে এমন কেউ নেই যে তোমার পতিব্রতা সাধ্বী পত্নীর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারে। ইনি তোমার এবং নিজের গুণে রক্ষিতা, ইনি যা বলবেন তার অন্যথা হবে না। এই ব্রহ্মবাদিনী নিজ তপস্যার প্রভাবে অর্ধশরীর দ্বারা ওঘবতী নদী হয়ে লোকপাবন করবেন এবং অর্ধশরীরে তোমার অনুগমন করবেন। তুমিও সশরীরে এঁর সঙ্গে শাশ্বত সনাতন লোক লাভ করবে। তুমি মৃত্যুকে পরাজিত করেছ, বীর্যবলে পঞ্চভূতকে অতিক্রম করেছ, গৃহস্থ ধর্ম দ্বারা কাম ক্রোধ জয় করেছ। অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র শুক্লবর্ণ সহস্র অশ্ব যোজিত রথে সুদর্শন ও ওঘবতীকে তুলে নিয়ে প্রস্থান করলেন।
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, গৃহস্থের পক্ষে অতিথিই পরমদেবতা, অতিথি পূজিত হ’লে যে শুভচিন্তা করেন তার ফল শত যজ্ঞেরও অধিক। সাধুস্বভাব অতিথি যদি সমাদর না পান তবে তিনি নিজের পাপ গৃহস্থকে দিয়ে এবং তার পুণ্য নিয়ে প্রস্থান করেন। বৎস, গৃহস্থ সুদর্শন যে প্রকারে মৃত্যুকে পরাস্ত করেছিলেন তার পুণ্যময় আখ্যান তোমাকে বললাম।
৩। কৃতজ্ঞ শুক—দৈব ও পুরুষকার—ভঙ্গাস্বনের স্ত্রীভাব
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি অনুকম্পা-ধর্মের ও ভক্তজনের গুণবর্ণনা করুন। ভীষ্ম বললেন, আমি একটি উপাখ্যান বলছি শোন।—কাশীরাজ্যের অরণ্যে এক ব্যাধ মৃগবধের জন্য বিষলিপ্ত বাণ নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেই বাণ একটি বিশাল বৃক্ষে বিদ্ধ হ’ল। সেই বৃক্ষের কোটরে একটি শুকপক্ষী বহু কাল থেকে বাস করত। বিষের প্রভাবে বৃক্ষ ফলপত্রহীন ও শুষ্ক হয়ে গেল, কিন্তু আশ্রয়দাতার প্রতি ভক্তির জন্য শুক সেই বনম্পতিকে ত্যাগ করলে না, অনাহারে ক্ষীণদেহে সেখানেই রইল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই উদারস্বভাব কৃতজ্ঞ সমব্যথী শুকের আচরণে আশ্চর্য হলেন এবং ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হয়ে বললেন, পক্ষিশ্রেষ্ঠ শুক, তুমি এই ফলপত্রহীন শুষ্ক তরু ত্যাগ করে অন্যত্র যাচ্ছ না কেন? এই মহারণ্যে আশ্রয়যোগ্য আরও তো অনেক বৃক্ষ আছে। শুক বললে, দেবরাজ, আমি এখানেই জন্মেছি এবং নিরাপদে প্রতিপালিত হয়েছি। আমি এই বৃক্ষের ভক্ত, এর দুঃখে দুঃখিত এবং অনন্যগতি। আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে কেন আমাকে অন্যত্র যেতে বলছেন? এই বৃক্ষ যখন সুস্থ ছিল তখন আমি এর আশ্রয়ে ছিলাম, আজ আমি কি ক’রে একে ছেড়ে যেতে পারি? শুকের কথা শুনে ইন্দ্র অতিশয় প্রীত হলেন এবং তার প্রার্থনায় অমৃত সেচন ক’রে বৃক্ষকে পুনর্জীবিত করলেন।
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, বৃক্ষ যেমন শুককে আশ্রয় দিয়ে উপকৃত হয়েছিল, লোকেও সেইরূপ ভক্তজনকে আশ্রয় দিয়ে সর্ব বিষয়ে সিদ্ধিলাভ করে।
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, দৈব ও পুরুষকার এই দুইএর মধ্যে কোন্টি শ্রেষ্ঠ? ভীষ্ম বললেন, এ সম্বন্ধে লোকপিতামহ ব্রহ্মা বশিষ্ঠকে যা বলেছিলেন শোন।—কৃষক তার ক্ষেত্রে যেরূপ বীজ বপন করে সেইরূপ ফল উৎপন্ন হয়; মানুষও তার সৎকর্ম ও অসৎকর্ম অনুসারে বিভিন্ন ফল লাভ করে। ক্ষেত্র ব্যতীত ফল উৎপন্ন হয় না, পুরুষকার ব্যতীত দৈবও সিদ্ধ হয় না। পণ্ডিতগণ পুরুষকারকে ক্ষেত্রের সহিত এবং দৈবকে বীজের সহিত তুলনা করেন। যেমন ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে, সেইরূপ পুরুষকার ও দৈবের সংযোগে ফল উৎপন্ন হয়। ক্লীব পতির সহিত স্ত্রীর সহবাস যেমন নিষ্ফল, কর্ম ত্যাগ করে দৈবের উপর নির্ভরও সেইরূপ। পুরুষকার দ্বারাই লোকে স্বর্গ, ভোগ্য বিষয় ও পাণ্ডিত্য লাভ করে। কৃপণ ক্লীব নিষ্ক্রিয় অকর্মকারী দুর্বল ও যত্নহীন লোকের অর্থলাভ হয় না। পুরুষকার অবলম্বন ক’রে কর্ম করলে দৈব তার সহায়ক হয়, কিন্তু কেবল দৈবে কিছুই পাওয়া যায় না। পুণ্যই দেবগণের আশ্রয়, পুণ্যকর্ম দ্বারা সমস্তই পাওয়া যায়, পুণ্যশীল লোকে দৈবকেও অতিক্রম করেন। দৈবের প্রভুত্ব নেই, শিষ্য যেমন গুরুর অনুসরণ করে দৈব সেইরূপে পুরুষকারের অনুসরণ করে।
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, স্ত্রীপুরুষের মিলনকালে কার স্পর্শসুখ অধিক হয়? ভীষ্ম বললেন, আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন। ভঙ্গাস্বন নামে এক ধার্মিক রাজর্ষি পুত্রকামনায় অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ ক’রে শত পুত্র লাভ করেছিলেন। এই যজ্ঞে কেবল অগ্নিরই স্তুতি হয় এজন্য ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে রাজর্ষির ছিদ্র অন্বেষণ করতে লাগলেন। একদিন ভঙ্গাস্বন মৃগয়া করতে গেলে ইন্দ্র তাঁকে বিমোহিত করলেন। রাজা দিগ্ভ্রান্ত শ্রান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটি সরোবর দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর অশ্বকে জল খাইয়ে নিজে সরোবরে অবগাহন করলেন এবং তৎক্ষণাৎ স্ত্রীরূপ পেলেন। নিজের রূপান্তর দেখে রাজা অতিশয় লজ্জিত ও চিন্তাকুল হলেন এবং কোনও প্রকারে অশ্বের পৃষ্ঠে উঠে রাজপুরীতে ফিরে গেলেন। তাঁর পত্নী পুত্রগণ ও অন্যান্য সকলে তাঁকে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে এবং সকল ঘটনা বিবৃত ক’রে রাজা তাঁর পুত্রদের বললেন, আমি বনে যাব, তোমরা সদ্ভাবে থেকে একত্র রাজ্য ভোগ কর।
স্ত্রীরূপী ভঙ্গাস্বন বনে এসে এক তাপসের আশ্রয়ে বাস করতে লাগলেন। সেই তাপসের ঔরসে রাজার গর্ভে এক শ পুত্র হ’ল। তিনি এই পুত্রদের নিয়ে পূর্বজাত পুত্রদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমরা আমার পুরুষ অবস্থার পুত্র, আমি স্ত্রী হবার পর এরা জন্মেছে। তোমরা এই ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজ্য ভোগ কর। ভঙ্গাস্বনের উপদেশ অনুসারে তাঁর দুই শত পুত্র একত্র রাজ্য ভোগ করতে লাগল। ইন্দ্র ভাবলেন, আমি এই রাজর্ষির অপকার করতে গিয়ে উপকারই করেছি। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে রাজপুত্রদের কাছে গিয়ে বললেন, যারা এক পিতার পুত্র তাদের মধ্যেও সৌভ্রাত্র থাকে না; কশ্যপের পুত্র সুর ও অসুরগণের মধ্যে বিবাদ হয়েছিল। তোমরা রাজর্ষি ভঙ্গাস্বনের পুত্র, আর এরা একজন তপস্বীর পত্র; এরা তোমাদের পৈতৃক রাজ্য ভোগ করছে কেন? ইন্দ্রের কথা শুনে রাজপুত্রেদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি হ’ল, তাঁরা যুদ্ধ করে পরস্পরকে বিনষ্ট করলেন।
পুত্রদের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভঙ্গাস্বন কাঁদতে লাগলেন। তখন ইন্দ্র তাঁর কাছে এসে বললেন, তুমি আমাকে আহ্বান না ক’রে আমার অপ্রিয় অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করেছিলে সেজন্য আমি তোমাকে নির্যাতিত করেছি। ভঙ্গাস্বন পদানত হয়ে ক্ষমা চেয়ে ইন্দ্রকে প্রসন্ন করলেন। ইন্দ্র বললেন, আমি তুষ্ট হয়েছি: বল, তোমার কোন্ পুত্রদের পুনর্জীবন চাও—তোমার ঔরস পুত্রদের, না গর্ভজাত পুত্রদের? তাপসীবেশী ভঙ্গাস্বন কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আমার স্ত্রীত্ব লাভের পর যারা জন্মেছিল তাদেরই জীবিত করুন। ইন্দ্র বিস্মিত হয়ে বললেন, এই পুত্রেরা তোমার পুরুষ অবস্থার পুত্রদের চেয়ে প্রিয় হ’ল কেন? ভঙ্গাস্বন বললেন, দেবরাজ, পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর স্নেহই অধিক। ইন্দ্র প্রীত হয়ে বললেন, সত্যবাদিনী, আমার বরে তোমার সকল পুত্রই জীবিত হ’ক। এখন তুমি পুরুষত্ব বা স্ত্রীত্ব কি চাও বল। রাজা বললেন, আমি স্ত্রীরূপেই থাকতে চাই। ইন্দ্র কারণ জিজ্ঞাসা করলে রাজা বললেন দেবরাজ, স্ত্রীপুরুষের সংযোগকালে স্ত্রীরই অধিক সুখ হয়, আমি স্ত্রীভাবেই তুষ্ট আছি। ইন্দ্র ‘তাই হ’ক’ ব’লে চলে গেলেন।
৪। হরপার্বতীর নিকট কৃষ্ণের বরলাভ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি জগৎপতি মহেশ্বর শম্ভুর নামসকল বলন। ভীষ্ম বললেন, তাঁর নামকীর্তন আমার সাধ্য নয়। এই মহাবাহু কৃষ্ণ বদরিকাশ্রমে তপস্যা ক’রে মহাদেবকে তুষ্ট করেছিলেন, ইনিই তাঁর নাম ও গুণাবলী কীর্তন করুন।
ভীষ্মের অনুরোধ শুনে বাসুদেব বললেন, ব্রহ্মা ইন্দ্রাদি দেবগণ এবং মহর্ষিগণও মহাদেবের সকল তত্ত্ব জানেন না, মানুষ কি করে জানবে? আমি তাঁর কথা কিঞ্চিৎ বলছি শুনুন। অনন্তর কৃষ্ণ জলস্পর্শ করে শুচি হয়ে বলতে লাগলেন।—একদা জাম্ববতী আমাকে বললেন, তুমি পূর্বে মহাদেবের আরাধনা করেছিলে, তার ফলে রুক্মিণীর গর্ভে চারুদেষ্ণ সুচারু চারুবেশ যশোধর চারুশ্রবা চারুযশা প্রদ্যুম্ন ও শম্ভু এই আট জন পুত্র জন্মেছে; তাদের তুল্য একটি পুত্র আমাকেও দাও। জাম্ববতীর অনুরোধ শুনে আমি পিতা মাতা, রাজা আহুক[২] ও বলরাম প্রভৃতির অনুমতি নিয়ে গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ ক’রে হিমালয় পর্বতে গেলাম। সেখানে মহর্ষি ব্যাঘ্রপাদের পুত্র উপমন্যুর আশ্রমে গিয়ে তাঁকে আমার অভিলাষ জানালে তিনি বললেন, তুমি যাঁকে চাচ্ছ সেই ভগবান মহেশ্বর সপত্নীক এখানেই থাকেন। বাল্যকালে আমি ক্ষীরান্ন খেতে চাইলে জননী আমাকে বলেছিলেন, বৎস, আমরা বনবাসী তাপস, আমাদের গাভী নেই, ক্ষীরান্ন কোথায় পাব? যদি শংকরকে প্রসন্ন করতে পার তবেই তোমার কামনা পূর্ণ হবে। তার পর আমি বহু কাল তপস্যা ক’রে মহাদেবকে তুষ্ট করলাম। তাঁর প্রসাদে আমি অজর অমর সর্বজ্ঞ ও সুদর্শন হয়েছি এবং বন্ধুগণের সহিত অমৃততুল্য ক্ষীরান্ন ভোজন করতে পাচ্ছি। মহাদেব সর্বদা আমার আশ্রমের নিকটে অবস্থান করেন। মাধব, আমি দিব্যনেত্রে দেখছি তুমি ছ মাস পরে তাঁর দর্শন পাবে এবং হরপার্বতীর নিকট চব্বিশটি বর লাভ করবে।
তার পর কৃষ্ণ বললেন, মুনিবর উপমন্যুর ইতিহাস শুনে আমি তাঁর কাছে দীক্ষা নিলাম এবং মস্তকমুণ্ডন ক’রে ঘৃতাক্তদেহে দণ্ড-কুশ-চীর-মেখলা ধারণ ক’রে কঠোর তপস্যা করতে লাগলাম। ছ মাস পরে মহাদেব পার্বতীর সহিত আবির্ভূত হলেন। আমি চরণে পতিত হয়ে স্তব করলে মহাদেব প্রসন্ন হলেন এবং আমার প্রার্থনা শুনে আটটি বর দিলেন—ধর্মে দৃঢ়নিষ্ঠা, যুদ্ধে শত্রুনাশের শক্তি, শ্রেষ্ঠ যশ, পরম বল, যোগসিদ্ধি, লোকপ্রিয়তা, মহাদেবের নৈকট্য, এবং শত শত পুত্র। তার পর জগন্মাতা ভবানীও প্রীত হয়ে আমার প্রার্থনায় আটটি বর দিলেন—দ্বিজগণের প্রতি অক্রোধ, পিতার অনুগ্রহ, শত পুত্র, পরম ভোগ, কুলে প্রীতি, মাতার প্রসাদ, শান্তিলাভ, এবং দক্ষতা। তিনি আমাকে আরও বললেন, তুমি মহাপ্রভাবান্বিত হবে, মিথ্যা বলবে না, তোমার এক হাজার ষোল ভার্যা হবে, তোমার প্রতি তাদের প্রীতি থাকবে, তোমার ধনধান্যাদি অক্ষয় হবে, তুমি বন্ধুদের অতিশয় প্রিয় হবে, তোমার শরীর কমনীয় হবে, এবং তোমার গৃহে প্রত্যহ সাত হাজার অতিথি ভোজন করবে। তার পর আমি উপমন্যুর কাছে ফিরে এসে তাঁকে বরপ্রাপ্তির সংবাদ দিলাম, তিনি প্রীত হয়ে মহাদেবের মাহাত্ম্য এবং স্থির, স্থাণু, প্রভু, প্রবর, বরদ, বর, সর্বাত্মা প্রভৃতি অষ্টোত্তর শত নাম কীর্তন করলেন। হর-পার্বতীর আরাধনা করেই আমি জাম্ববতীর পুত্র শাম্বকে পেয়েছিলাম।
৫। অষ্টাবক্রের পরীক্ষা
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, পাণিগ্রহণকালে যে ‘সহধর্ম’ বলা হয় তার উদ্দেশ্য কি? পতিপত্নীর এক সঙ্গে ঋষিপ্রোক্ত যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান, না প্রজাপতিবিহিত সন্তানোৎপাদন, না অসুরধর্মানুযায়ী কেবল-ইন্দ্রিয়সেবা? ভীষ্ম বললেন, আমি এক প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।—বদান্য নামক ঋষির কন্যা সুপ্রভার রূপগণে মুগ্ধ হয়ে অষ্টাবক্র তাঁর পাণি প্রার্থনা করেছিলেন। বদান্য বললেন, আমি তোমাকে কন্যা দান করব, কিন্তু প্রথমে তুমি উত্তর দিকে যাত্রা করবে এবং হিমালয় পর্বত ও কুবেরভবন অতিক্রম ক’রে ভগবান রুদ্রের আবাস দেখে এক রমণীয় বনে উপস্থিত হবে। সেখানে এক বৃদ্ধা তপস্বিনী আছেন; তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা ক’রে ফিরে এলে আমার কন্যাকে পাবে।
অষ্টাবক্র উত্তর দিকে যাত্রা করলেন এবং হিমালয় পার হয়ে এক হ্রদের নিকটে এসে রুদ্র ও রুদ্রাণীর পূজা করলেন। তার পর এক দৈব বৎসর (মানুষের ৩৬০ বৎসর) কুবেরের আতিথ্য ভোগ ক’রে কৈলাস মন্দর ও সুমেরু পর্বত অতিক্রম করলেন এবং রমণীয় বনের মধ্যে একটি দিব্য আশ্রমে উপস্থিত হলেন। সেই আশ্রমে কুবেরালয় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ একটি কাঞ্চনময় ভবন ছিল। অষ্টাবক্র সেই ভবনের দ্বারে এসে বললেন, আমি অতিথি এসেছি। তখন সাতটি রূপবতী মনোহারিণী কন্যা এসে তাঁকে বললে, ভগবান, ভিতরে আসুন। অষ্টাবক্র মুগ্ধ হয়ে ভবনের অভ্যন্তরে গেলেন এবং দেখলেন সেখানে এক বৃদ্ধা রমণী শুভ্র বসন প’রে সর্বাভরণে ভূষিত হয়ে পর্যঙ্কে ব’সে আছেন। পরস্পর অভিবাদনের পর বৃদ্ধা অষ্টাবক্রকে বললেন, আপনি বসুন। অষ্টাবক্র বললেন, এইসকল নারীদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবতী ও শান্তপ্রকৃতি তিনি এখানে থাকুন, আর সকলে নিজ নিজ গৃহে চলে যান। কন্যারা অষ্টাবক্রকে প্রদক্ষিণ ক’রে চ’লে গেল, কেবল বৃদ্ধা রইলেন।
অষ্টাবক্র শয্যায় শুয়ে বৃদ্ধাকে বললেন, রাত্রি গভীর হয়েছে, তুমিও শোও। বৃদ্ধা অন্য এক শয্যায় শুলেন, কিন্তু কিছু কাল পরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে মহর্ষির শয্যায় এসে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। অষ্টাবক্র কাষ্ঠপ্রাচীরের ন্যায় নির্বিকার হয়ে আছেন দেখে বৃদ্ধা দুঃখিত হয়ে বললেন, বিপ্রর্ষি, প্রফুল্ল হও, আমার মনোরথ পূর্ণ কর। তোমার তপস্যা সফল হয়েছে, তুমি আমার এবং এই সমস্ত ধনের প্রভু। অষ্টাবক্র বললেন, আমি পরদারগমন করি না। আমি বিষয়ভোগে অনভিজ্ঞ, ধর্ম পালনের জন্যই সন্তান কামনা করি, পুত্রলাভ হ’লে আমার সদ্গতি হবে। তুমি ধর্ম স্মরণ কর, অন্যায় উপরোধ ক’রো না; যদি তোমার অন্য প্রার্থনা কিছু থাকে তো বল। বৃদ্ধা বললেন, তুমি এখানে বাস কর, ক্রমশ দেশ কাল বুঝে মতি স্থির করতে পারবে এবং কৃতকৃত্য হবে। অষ্টাবক্র সম্মত হয়ে সেখানেই রইলেন, কিন্তু সেই বৃদ্ধার জীর্ণ দেহ দেখে তাঁর কিছুমাত্র অনুরাগ হ’ল না। তিনি ভাবতে লাগলেন, ইনিই কি এই গৃহের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, শাপের ফলে বিরূপা হয়েছেন?
পরদিন বৃদ্ধা অষ্টাবক্রের সর্বদেহে তৈল মর্দন করে তাঁকে সযত্নে স্নান করিয়ে দিলেন এবং অমৃততুল্য স্বাদু অন্ন খেতে দিলেন। রাত্রিকালে তাঁরা পূর্বের ন্যায় পৃথক শয্যায় শলেন এবং অর্ধরাত্রে বৃদ্ধা পুনর্বার মহর্ষির শয্যায় এলেন। মহর্ষি বললেন, পরদারে আমার আসক্তি নেই, তুমি নিজের শয্যায় যাও, তোমার মঙ্গল হ’ক। বৃদ্ধা বললেন, আমি স্বতন্ত্রা, কারও পত্নী নই; যদি অন্য স্ত্রীর সংসর্গে আপত্তি থাকে তবে আমাকে বিবাহ কর। মহর্ষি বললেন, নারীর স্বাতন্ত্র্য কোনও কালে নেই; কৌমারে পিতা, যৌবনে পতি এবং বার্ধক্যে পুত্র তাকে রক্ষা করে। বদ্ধা বললেন, আমি কন্যা, ব্রহ্মচর্য পালন করি, আমাকে বিবাহ কর, প্রত্যাখ্যান ক’রো না।
সহসা বৃদ্ধার রূপান্তর হ’ল, তিনি সর্বাভরণভূষিতা পরমরূপবতী কন্যার আকৃতি ধারণ করলেন। অষ্টাবক্র আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, মহর্ষি বদান্য আমাকে পরীক্ষার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন; তাঁর দুহিতাকে ত্যাগ ক’রে কি এই পরমসুন্দরী কন্যাকেই গ্রহণ করব? আমার কামদমনের শক্তি ও ধৈর্য আছে, আমি সত্য থেকে চ্যুত হব না। তিনি সেই কন্যাকে বললেন, তুমি কিজন্য নিজের রূপ পরিবর্তন করলে সত্য বল। কন্যা বললেন, সত্যবিক্রম ব্রাহ্মণ, আমি উত্তর দিকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, মহর্ষি বদান্যের অনুরোধে তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম, তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। জেনে রাখ যে স্ত্রীজাতি চপলা, স্থবিরা স্ত্রীরও কামজ্বর হয়। দেবতারা তোমার উপর প্রসন্ন হয়েছেন, তুমি নির্বিঘ্নে গৃহে ফিরে যাও এবং বাঞ্ছিতা কন্যাকে বিবাহ ক’রে পুত্রলাভ কর।
তার পর অষ্টাবক্র বদান্যের কাছে এসে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন, বদান্য তুষ্ট হয়ে তাঁর কন্যাকে দান করলেন। অষ্টাবক্র শুভনক্ষত্রযোগে সুপ্রভাকে বিবাহ ক’রে নিজ আশ্রমে সুখে বাস করতে লাগলেন।[৩]
৬। ব্রহ্মহত্যাতুল্য পাপ— গঙ্গামাহাত্ম্য—মতঙ্গ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ব্রহ্মহত্যা না করলেও কোন কর্মে ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়? ভীষ্ম বললেন, ব্যাসদেবের কাছে আমি যা শুনেছি তাই বলছি।—যে লোক ভিক্ষা দেব ব’লে ব্রাহ্মণকে ডেকে এনে প্রত্যাখ্যান করে, যে দুর্বদ্ধি বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের বৃত্তি হরণ করে, পিপাসার্ত গোসমূহের জলপানে যে বাধা দেয়, শ্রুতি বা মুনিপ্রণীত শাস্ত্র যে অনভিজ্ঞতার জন্য দূষিত করে, রূপবতী দুহিতাকে যে উপযুক্ত পাত্রে সম্প্রদান না করে, দ্বিজাতিকে যে অধার্মিক মূঢ় অকারণে মর্মান্তিক দুঃখ দেয়, যে লোক চক্ষুহীন পঙ্গু বা জড়ের সর্বস্ব হরণ ক’রে, যে মূঢ় আশ্রমে বনে গ্রামে বা নগরে অগ্নিপ্রদান করে—তারা সকলেই ব্রহ্মহত্যাকারীর সমান।
যুধিষ্ঠির বললেন, কোন্ দেশ জনপদ আশ্রম ও পর্বত শ্রেষ্ঠ গণ্য হয়? কোন্ নদী পুণ্যতমা? ভীষ্ম বললেন, এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণ এক শিলবৃত্তি (উঞ্ছবৃত্তি) ব্রাহ্মণকে যা বলেছিলেন শোন।—সেই দেশ জনপদ আশ্রম ও পর্বতই শ্রেষ্ঠ যার মধ্য দিয়ে সরিদ্বরা গঙ্গা প্রবাহিত হন। তপস্যা ব্রহ্মচর্য যজ্ঞ ও দানের যে ফল, গঙ্গার আরাধনাতেও সেই ফল। যারা প্রথম বয়সে পাপকর্ম ক’রে পরে গঙ্গার সেবা করে তারাও উত্তম গতি পায়। হংসাদি বহুবিধ বিহঙ্গে সমাকীর্ণ গোষ্ঠসমন্বিত গঙ্গাকে দেখলে লোকে স্বর্গও বিস্মৃত হয়। গঙ্গাদর্শন গঙ্গাজলস্পর্শ ও গঙ্গায় অবগাহন করলে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সাত পুরুষের সদ্গতি হয়।
যুধিষ্ঠির বললেন, ক্ষত্রিয় বৈশ্য বা শূদ্র কোন উপায়ে ব্রাহ্মণত্ব পেতে পারে? ভীষ্ম বললেন, ব্রাহ্মণ্য অতি দুর্লভ, বহুবার জন্মগ্রহণের পর লোকে ব্রাহ্মণ হ’তে পারে। আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন। কোনও ব্রাহ্মণের মতঙ্গ নামে একটি গুণবান পুত্র ছিল। একদিন ব্রাহ্মণ তাঁর পুত্রকে যজ্ঞের নিমিত্ত উপকরণ সংগ্রহ ক’রে আনতে বললেন। মতঙ্গ একটি গর্দভযোজিত রথে যাত্রা করলেন, কিন্তু অল্পবয়স্ক গর্দভ নিজের জননীর কাছে রথ নিয়ে চলল। মতঙ্গ রুষ্ট হয়ে গর্দভের নাসিকায় বার বার কষাঘাত করতে লাগলেন। গর্দভ যখন তার মাতার কাছে উপস্থিত হ’ল তখন পুত্রের নাসিকায় ক্ষত দেখে গর্দভী বললে, বৎস, দুঃখিত হ’য়ো না, এক চণ্ডাল তোমাকে চালিত করছে, ব্রাহ্মণ এমন নিষ্ঠুর হয় না। এই পাপী নিজ জাতির স্বভাব পেয়েছ, শিশুর উপর এর দয়া নেই। মতঙ্গ রথ থেকে নেমে গর্দভীকে বললেন, কল্যাণী, আমাকে চণ্ডাল বলছ কেন, আমার মাতা কি ক’রে দূষিত হয়েছেন সত্য বল। গর্দভী বললে, তুমি কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে শূদ্র নাপিতের ঔরসে জন্মেছ, এজন্য তুমি ব্রাহ্মণ নও, চণ্ডাল।
মতঙ্গ তখনই গৃহে ফিরে এসে পিতাকে গর্দভীর বাক্য জানালেন এবং ব্রাহ্মণত্ব লাভের উদ্দেশ্যে অরণ্যে তপস্যা করতে গেলেন। তিনি সহস্রাধিক বৎসর কঠোর তপস্যা করলেন। ইন্দ্র বার বার এসে তাঁকে বললেন, তুমি চণ্ডাল হয়ে জন্মেছ, ব্রাহ্মণত্ব পেতে পার না, অন্য বর চাও। অবশেষে মতঙ্গ যখন বুঝলেন যে ব্রাহ্মণত্বলাভ অসম্ভব তখন তিনি ইন্দ্রকে বললেন, আপনার বরে আমি যেন কামচারী কামরূপী বিহঙ্গ হই, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি সকলেই যেন আমার পূজা করে, আমার কীর্তি যেন অক্ষয় হয়। ইন্দ্র বললেন, বৎস, তুমি ছন্দোদেব নামে খ্যাত এবং কামিনীগণের পূজনীয় হবে, ত্রিলোকে অতুল কীর্তি লাভ করবে।
৭। দিবোদাসের পুত্র প্রতর্দন—বীতহব্যের ব্রাহ্মণত্বলাভ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, শুনেছি রাজা বীতহব্য ক্ষত্রিয় হয়েও বিশ্বামিত্রের ন্যায় ব্রাহ্মণত্ব পেয়েছিলেন। আপনি তাঁর ইতিহাস বলুন। ভীষ্ম বললেন, মনুর পুত্র শর্যাতির বংশে রাজা বৎস জন্মগ্রহণ করেন; বৎসের দুই পুত্র, হৈহয় বা বীতহব্য, এবং তালজঙ্ঘ। বীতহব্যের দশ পত্নীর গর্ভে এক শ বেদজ্ঞ ও অস্ত্রবিশারদ পুত্র জন্মেছিলেন; তাঁরা কাশীরাজ হর্যশ্বকে এবং পরে তাঁর পুত্র সুদেবকে যুদ্ধে বধ করেন। তার পর সুদেবের পুত্র দিবোদাস বারাণসীর রাজা হলেন এবং গঙ্গার উত্তর ও গোমতী নদীর দক্ষিণ তীরে অমরাবতীর ন্যায় সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত রাজধানী স্থাপন করলেন। বীতহব্যের পুত্রগণ আবার আক্রমণ করলে মহারাজ দিবোদাস তাঁদের সঙ্গে সহস্র দিন ঘোর যুদ্ধ করলেন, কিন্তু অবশেষে পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন এবং বৃহস্পতিপুত্র ভরদ্বাজের শরণাপন্ন হলেন। ভরদ্বাজ তাঁকে আশ্বাস দিয়ে এক যজ্ঞ করলেন, তার ফলে দিবোদাসের প্রতর্দন নামে একটি পুত্র হ’ল।
প্রতর্দন জন্মগ্রহণ ক’রেই ত্রয়োদশবর্ষীয়ের ন্যায় বৃদ্ধি পেতে লাগলেন। তিনি সমস্ত বেদ ও ধনুর্বেদে শিক্ষিত হ’লে ভরদ্বাজ যোগবলে তাঁর দেহে প্রবিষ্ট হয়ে সর্বলোকের তেজ সমাবিষ্ট করলেন। দিবোদাস তাঁর পরাক্রান্ত পুত্রকে দেখে হৃষ্ট হয়ে তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তার পর পিতার আজ্ঞায় প্রতর্দন গঙ্গা পার হয়ে বীতহব্যের নগর আক্রমণ করলেন। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে বীতহব্যের পুত্রগণ ছিন্নমস্তক হয়ে পতিত হলেন। তখন বীতহব্য পলায়ন ক’রে মহর্ষি ভৃগুর শরণ নিলেন। প্রতর্দন বীতহব্যের অনুসরণ ক’রে ভৃগর আশ্রমে এলেন। যথাবিধি সৎকার ক’রে ভৃগু বললেন, মহারাজ, কি প্রয়োজন বল। প্রতর্দন বললেন, মহর্ষি, এখানে বীতহব্য আশ্রয় নিয়েছেন, আপনি তাঁকে ত্যাগ করুন; তাঁর শত পুত্র আমার পিতৃকুল ও কাশীরাজ্য ধ্বংস করেছে। আমি তাদের বিনষ্ট করেছি, এখন বীতহব্যকে বধ করলেই পিতৃগণের নিকট ঋণমুক্ত হব। ধর্মাত্মা ভৃগু শরণাগত বীতহব্যের প্রতি কৃপাবিষ্ট হয়ে বললেন, এখানে কোনও ক্ষত্রিয় নেই, সকলেই ব্রাহ্মণ। প্রতর্দন হৃষ্ট হয়ে ভৃগুর পাদস্পর্শ ক’রে বললেন, ভগবান, তাই হ’ক, তাতেই আমি কৃতকৃত্য হয়েছি, বীর্যবান বীতহব্যকে জাতিত্যাগে বাধ্য করেছি। আপনি প্রসন্ন হয়ে অনুমতি দিন, আমি এখন ফিরে যাই।
সর্প যেমন বিষ উদ্গার করে সেইরূপ বীতহব্যের উদ্দেশে এই কঠোর বাক্য ব’লে প্রতর্দন প্রস্থান করলেন। ভৃগুর বাক্যপ্রভাবে বীতহব্য ব্রহ্মর্ষি ও ব্রহ্মবাদী হয়ে গেলেন। গৃৎসমদ নামে তাঁর এক রূপবান পত্র হয়েছিল, অসুররা তাঁকে ইন্দ্র মনে ক’রে নিপীড়িত করেছিল। ঋগ্বেদে গৃৎসমদের কথা আছে। তাঁর অধস্তন দ্বাদশ পুরুষ প্রমতি, তাঁর পুত্র রুরু, যিনি প্রমদ্বরাকে বিবাহ করেছিলেন। রুরুর পুত্র শুনক, তাঁর পত্র মহাত্মা শৌনক। ভৃগুর অনুগ্রহে বীতহব্য ও তাঁর বংশধরগণ সকলেই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন।
৮। ব্রাহ্মণসেবা—সৎপাত্র ও অসৎপাত্র
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, রাজাদের পক্ষে কোন, কার্য সর্বাপেক্ষা ফলপ্রদ? ভীষ্ম বললেন, ব্রাহ্মণসেবাই রাজার শ্রেষ্ঠ কার্য। একদিন ইন্দ্র জটাধারী ও ভস্মলিপ্ত হয়ে ছদ্মবেশে অসুররাজ শম্বরের কাছে এসে বললেন, তুমি কিরূপ আচরণের ফলে স্বজাতীয়গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছ? শম্বর বললেন, আমি ব্রাহ্মণদের ঈর্ষা করি না, তাঁদের শাস্ত্রীয় কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি, তাঁদের মতেই চলি। আমি ব্রাহ্মণদের নিকট অপরাধী হই না, সর্বদা তাঁদের পূজা করি। মধুমক্ষিকা যেমন চক্রমধ্যে মধুনিষেক করে, তাঁরা সেইরূপ আমাকে সদুপদেশে তৃপ্ত করেন। তাঁরা যা বলেন সমস্তই আমি মেধা দ্বারা গ্রহণ করি। এই কারণেই আমি তারাগণের মধ্যে চন্দ্রের ন্যায় অসুরগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গণ্য হই।
যুধিষ্ঠির বললেন, অপরিচিত, দীর্ঘকাল আশ্রিত এবং দূরদেশ হ’তে অভ্যাগত, এই বিবিধ মনুষ্যের মধ্যে কাকে সৎপাত্র মনে করা উচিত? কাকে দান করলে উত্তম ফল হয়? ভীষ্ম বললেন, তুমি যে ত্রিবিধ মনুষ্যের কথা বললে তাঁরা সকলেই সৎপাত্র, তাঁদের কেউ গৃহস্থ, কেউ সন্ন্যাসী। তাঁদের সকলেরই প্রার্থনা পূরণ করা কর্তব্য, কিন্তু ভৃত্যদের পীড়ন ক’রে দান করা অনুচিত। ঋত্বিক পুরোহিত আচার্য শিষ্য কুটুম্ব বান্ধব যদি শাস্ত্রজ্ঞ ও অসূয়াশূন্য হন তবে সকলেই দানের যোগ্য পাত্র। সাবধানে পরীক্ষার পর দান করা উচিত। যাঁর অক্রোধ সত্যনিষ্ঠা অহিংসা তপস্যা সরলতা অনভিমান লজ্জা সহিষ্ণুতা জিতেন্দ্রিয়তা ও মনঃসংযম আছে এবং যিনি অকার্য করেন না তিনিই সম্মানের পাত্র। যে বেদ ও শাস্ত্র মানে না এবং সর্ববিষয়ে নিয়মহীন সে অসৎপাত্র। যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতাভিমানী ও বেদনিন্দক, নিরর্থক তর্কবিদ্যার অনুরক্ত, সভায় হেতুবাদ দ্বারা জয়ী হ’তে চায়, যে কটূভাষী বহুবক্তা ও মূঢ়, তাকে কুক্কুরের ন্যায় অস্পৃশ্য জ্ঞান করা উচিত।
৯। স্ত্রীজাতির কুৎসা—বিপুলের গুরুপত্নীরক্ষা
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, শোনা যায় স্ত্রীজাতি লঘুচিত্ত এবং সকল দোষের মূল। আপনি তাদের স্বভাব সম্বন্ধে বলুন। ভীষ্ম বললেন, আমি তোমাকে নারদ ও পুংশ্চলী (বেশ্যা) পঞ্চচূড়ার কথা বলছি শোন।—একদিন নারদ বিচরণ করতে করতে ব্রহ্মলোকবাসিনী অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দেখতে পেলেন। নারদ বললেন, সুন্দরী, স্ত্রীজাতির স্বভাব কিপ্রকার তা আমি তোমার কাছে শুনতে ইচ্ছা করি। পঞ্চচূড়া বললেন, আমি স্ত্রী হয়ে স্ত্রীজাতির নিন্দা করতে পারব না, এমন অনুরোধ করা আপনার উচিত নয়। নারদ বললেন, তোমার কথা যথার্থ, কিন্তু মিথ্যা বললেই দোষ হয়, সত্য কথায় দোষ নেই। তখন চারুহাসিনী পঞ্চচূড়া বললেন, দেবর্ষি, নারীদের এই দোষ যে তারা সদ্বংশীয়া রূপবতী ও সধবা হ’লেও সদাচার লঙ্ঘন করে। তাদের চেয়ে পাপিষ্ঠ কেউ নেই, তারা সকল দোষের মূল। ধনবান রূপবান ও বশীভূত পতির জন্যও তারা প্রতীক্ষা করতে পারে না, যে পুরুষ কাছে গিয়ে কিঞ্চিৎ চাটুবাক্য বলে তাকেই কামনা করে। উপযাচক পুরুষের অভাবে এবং পরিজনদের ভয়েই নারীরা পতির বশে থাকে। তাদের অগম্য কেউ নেই, পরুষের বয়স বা রূপ তারা বিচার করে না। রূপযৌবনবতী সুবেশা স্বৈরিণীকে দেখলে কুলস্ত্রীরাও সেইরূপ হ’তে ইচ্ছা করে। পুরুষ না পেলে তারা পরস্পরের সাহায্যে কামনা পূরণ করে। সুরূপ পুরুষ দেখলেই তাদের ইন্দ্রিয়বিকার হয়। যম পবন মৃত্যু পাতাল বড়বানল ক্ষুরধারা বিষ সর্প ও অগ্নি—এই সমস্তই একাধারে নারীতে বর্তমান।
প্রসঙ্গক্রমে ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে বিপুল যেপ্রকারে তাঁর গুরু পত্নীকে রক্ষা করেছিলেন তা বলছি শোন।—দেবশর্মা নামে এক ঋষি ছিলেন, তাঁর পত্নীর নাম রুচি। অতুলনীয়া সুন্দরী রুচির উপর ইন্দ্রের লোভ ছিল। দেবশর্মা স্ত্রীচরিত্র ও ইন্দ্রের পরস্ত্রীলালসা জানতেন সেজন্য রুচিকে সাবধানে রক্ষা করতেন। একদিন তিনি তাঁর প্রিয়শিষ্য বিপুলকে বললেন, আমি যজ্ঞ করতে যাচ্ছি, তুমি তোমার গুরুপত্নীকে সাবধানে রক্ষা করবে। সুরেশ্বর ইন্দ্র রুচিকে সর্বদা কামনা করেন; তিনি বহুপ্রকার মায়া জানেন, বজ্রধারী কিরীটী, চণ্ডাল, জটাচীরধারী, কুরূপ, রূপবান, যুবা, বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ বা অন্য বর্ণ, পশুপক্ষী বা মক্ষিকামশকাদির রূপ ধারণ করতে পারেন। তিনি বায়ুরূপেও এখানে আসতে পারেন। দুষ্ট কুক্কুর যেমন যজ্ঞের ঘৃত লেহন করে, সেইরূপ দেবরাজ যেন রুচিকে উচ্ছিষ্ট না করেন।
দেবশর্মা চ’লে গেলে বিপুল ভাবলেন, মায়াবী ইন্দ্রকে নিবারণ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, আমি পৌরুষ দ্বারা গুরুপত্নীকে রক্ষা করতে পারব না। অতএব আমি যোগবলে এঁর শরীরে প্রবেশ করে পদ্মপত্রে জলবিন্দুর ন্যায় নির্লিপ্ত হয়ে অবস্থান করব, তাতে আমার অপরাধ হবে না। এইরূপ চিন্তা ক’রে মহাতপা বিপুল রুচির নিকটে বসলেন এবং নিজের নেত্ররশ্মি রুচির নেত্রে সংযোজিত করে বায়ু যেমন আকাশে যায় সেইরূপ গুরুপত্নীর দেহে প্রবেশ করলেন। রুচি স্তম্ভিত হয়ে রইলেন, তাঁর দেহমধ্যে বিপুল ছায়ার ন্যায় অবস্থান করতে লাগলেন।
এমন সময় ইন্দ্র লোভনীয় রূপ ধারণ ক’রে সেখানে এসে দেখলেন, আলেখ্যে চিত্রিত মূর্তির ন্যায় বিপুল স্তব্ধনেত্রে ব’সে আছেন, তাঁর নিকটে পূর্ণচন্দ্রনিভাননা পদ্মপলাশাক্ষী রুচিও রয়েছেন। ইন্দ্রের রূপ দেখে বিস্মিত হয়ে রুচি দাঁড়িয়ে উঠে বলবার চেষ্টা করলেন, “তুমি কে?” কিন্তু পারলেন না। ইন্দ্র মধুরবাক্যে বললেন, সুন্দরী, আমি ইন্দ্র, কামার্ত হযে তোমার কাছে এসেছি, আমার অভিলাষ পূর্ণ কর। রুচিকে নিশ্চেষ্ট ও নির্বিকার দেখে ইন্দ্র আবার তাঁকে আহ্বান করলেন, রুচিও উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন। তখন বিপুল গুরু পত্নীর মুখ দিয়ে বললেন, কিজন্য এসেছ? এই বাক্য নির্গত হওয়ায় রুচি লজ্জিত হলেন, ইন্দ্রও উদ্বিগ্ন হলেন। তার পর দেবরাজ দিব্যদৃষ্টি দ্বারা দেখলেন, মহাতপা বিপুল দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রুচির দেহমধ্যে রয়েছেন। ইন্দ্র শাপের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে লাগলেন। বিপুল তখন নিজের দেহে প্রবেশ ক’রে বললেন, অজিতেন্দ্রিয় দুর্বুদ্ধি পাপাত্মা পুরন্দর, তুমি দেবতা আর মানুষের পূজা অধিক দিন ভোগ করবে না; গৌতমের শাপে তোমার সর্বদেহে যোনিচিহ হয়েছিল তা কি ভুলে গেছ? আমি গুরু পত্নীকে রক্ষা করছি, তুমি দূর হও, আমার গুরু তোমাকে দেখলে এখনই দগ্ধ ক’রে ফেলবেন। তুমি নিজেকে অমব ভেবে আমাকে অবজ্ঞা ক’রো না, তপস্যার অসাধ্য কিছু নেই।
ইন্দ্র কোনও উত্তর দিলেন না, লজ্জিত হয়ে তখনই অন্তর্হিত হলেন। ক্ষণকাল পরে দেবশর্মা যজ্ঞ সমাপ্ত ক’রে ফিরে এলেন এবং সকল বৃত্তান্ত শুনে প্রীত হয়ে বিপুলকে এই বর দিলেন যে তাঁর ধর্মে একান্ত নিষ্ঠা হবে। তার পর গুরুর অনুমতি নিয়ে বিপুল কঠোর তপস্যায় রত হলেন এবং কীর্তি ও সিদ্ধি লাভ ক’রে স্পর্ধিত হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন।
কিছুকাল পরে অঙ্গরাজ চিত্ররথের পত্নী প্রভাবতী এক মহোৎসবে তাঁর ভগিনী রুচিকে নিমন্ত্রণ করলেন। এই সময়ে আকাশগামিনী এক দিব্যাঙ্গনার অঙ্গ থেকে কতকগুলি পুষ্প ভূপতিত হ’ল। রুচি সেই পুষ্পে তাঁর কেশকলাপ ভূষিত ক’রে ভগিনী প্রভাবতীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। প্রভাবতী রুচিকে বললেন, আমাকে এইরূপ পুষ্প আনিয়ে দাও। দেবশর্মার আদেশে বিপুল সেই ভূপতিত অম্লান পুষ্প সংগ্রহ ক’রে অঙ্গরাজধানী চম্পানগরীতে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে তিনি বনমধ্যে দেখলেন, এক নরমিথুন (নরনারী) পরস্পরের হাত ধ’রে ঘুরছে এবং একজন অন্যজনের চেয়ে শীঘ্র চলছে ব’লে কলহ করছে। অবশেষে তারা এই শপথ করলে—আমাদের মধ্যে যে মিথ্যা বলছে সে যেন পরলোকে বিপুলের ন্যায় দুর্গতি পায়। এই কথা শুনে বিপুল চিন্তিত হলেন এবং আরও কিছুদূর গিয়ে দেখলেন, ছ জন লোক স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত পাশা নিয়ে খেলছে। তারাও শপথ করলে—আমাদের মধ্যে যে অন্যায় করবে সে যেন বিপুলের গতি পায়। তখন বিপুলের মনে পড়ল, তিনি যে গুরুপত্নীর দেহে প্রবেশ করেছিলেন তা গুরুকে জানান নি। বিপুল পুষ্প নিয়ে চম্পানগরীতে এলে দেবশর্মা বললেন, তুমি পথে যাঁদের দেখেছ তাঁরা তোমার কার্য জানেন, আমি আর রুচিও জানি। সেই মিথুন যাঁরা চক্রবৎ আবর্তন করেন তাঁরা অহোরাত্র, এবং পাশক্রীড়ারত ছয় পুরুষ ছয় ঋতু। এঁরা সকলেই তোমার দুষ্কৃত জানেন। মানুষ নির্জনে দুষ্কর্ম করলেও দিবারাত্র ও ছয় ঋতু তা দেখেন। তুমি রুচিকে রক্ষা ক’রে হৃষ্ট ও গর্বিত হয়েছিলে, কিন্তু ব্যভিচার আশঙ্কা ক’রে আমাকে সব কথা জানাও নি, এই অপরাধ তোমাকে তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তুমি অন্য উপায়ে দুর্বত্তা রুচিকে রক্ষা করতে পারবে না বুঝে তাঁর শরীরে প্রবেশ করেছিলে, কিন্তু তাতে তোমার কোনও পাপ হয় নি। বৎস, আমি প্রীত হয়েছি, তুমি স্বর্গলোক লাভ ক’রে সুখী হবে।
আখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, স্ত্রীলোককে সর্বদা রক্ষা করা উচিত। সাধ্বী ও অসাধ্বী দুইপ্রকার স্ত্রী আছে, লোকমাতা সাধ্বী স্ত্রীগণ এই পৃথিবী ধারণ করেন। দুশ্চরিত্রা কুলনাশিনী অসাধ্বী স্ত্রীদের গাত্রলক্ষণ দেখলেই চেনা যায়, তাদের সাবধানে রক্ষা করতে হয়, নতুবা তারা ব্যভিচারিণী হয় এবং প্রাণহানি করে।
১০। বিবাহভেদ—দুহিতার অধিকার—বর্ণসংকর—পুত্রভেদ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কিরূপ পাত্রে কন্যাদান কর্তব্য? ভীষ্ম বললেন, স্বভাব চরিত্র বিদ্যা কুল ও কার্য দেখে গুণবান পাত্রে কন্যাদান করা উচিত। এইরূপ বিবাহের নাম ব্রাহ্মবিবাহ, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে এই বিবাহই প্রশস্ত। বরকন্যার পরস্পরের ইচ্ছায় বিবাহকে গান্ধর্ব বলা হয়। ধন দিয়ে কন্যা ক্রয় করে যে বিবাহ হয় তার নাম আসুর। আত্মীয়বর্গকে হত্যা ক’রে রোরুদ্যমানা কন্যার সহিত বিবাহের নাম রাক্ষস। শেষোক্ত দুই বিবাহ নিন্দনীয়। ব্রাহ্মণাদি প্রত্যেক বর্ণের পুরুষ তার সবর্ণের বা নিম্নবর্তী অন্যান্য বর্ণের স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা পত্নীই শ্রেষ্ঠ। ত্রিশ বৎসরের পাত্র দশ বৎসরের কন্যাকে এবং একুশ বৎসরের পাত্র সাত বৎসরের কন্যাকে বিবাহ করবে।[৪] ঋতুমতী হ’লে কন্যা তিন বৎসর বিবাহের জন্য অপেক্ষা করবে, তার পর সে স্বয়ং পতি অন্বেষণ ক’রে নেবে। মন্ত্রপাঠ ও হোম করে কন্যা সম্প্রদান করলে বিবাহ সিদ্ধ হয়, কেবল বাগ্দান করলে বা পণ নিলে হয় না। সপ্তপদীগমনের পর পাণিগ্রহণমন্ত্র সম্পূর্ণ হয়।
যুধিষ্ঠির বললেন, যদি কন্যা থাকে তবে অপুত্রক ব্যক্তির ধন আর কেউ পেতে পারে কি? ভীষ্ম বললেন, দুহিতা পুত্রের সমান, তার পৈতৃক ধন আর কেউ নিতে পারে না। পুত্র থাক বা না থাক, মাতার যৌতুকধনে কেবল দুহিতারই অধিকার। অপুত্রক ব্যক্তির দৌহিত্রও পুত্রের সমান অধিকারী।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি বর্ণসংকরের উৎপত্তি ও কর্মের বিষয় বলুন। ভীষ্ম বললেন, পিতা যদি ব্রাহ্মণ হয়, তবে ব্রাহ্মণীর পুত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র মূর্ধাভিষিক্ত, বৈশ্যার পুত্র অম্বষ্ঠ, এবং শূদ্রার পুত্র পারশব নামে উক্ত হয়। পিতা যদি ক্ষত্রিয় হয় তবে ক্ষত্রিয়ার পুত্র ক্ষত্রিয়, বৈশ্যার পুত্র মাহিষ্য, এবং শূদ্রার পুত্র উগ্র নামে কথিত হয়। পিতা বৈশ্য হ’লে বৈশ্যার পুত্রকে বৈশ্য এবং শূদ্রার পুত্রকে করণ বলা হয়। শূদ্র-শূদ্রার পুত্র শূদ্রই হয়। নিম্নবর্ণের পিতা ও উচ্চবর্ণের মাতার সন্তান নিন্দনীয় হয়। ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণীর পুত্র সূত, তাদের কর্ম রাজাদের স্তুতিপাঠ। বৈশ্য-ব্রাহ্মণীর পুত্র বৈদেহক বা মৌদ্গল্য, তাদের কর্ম অন্তঃপুররক্ষা, তাদের উপনয়নাদি সংস্কার নেই। শূদ্র-ব্রাহ্মণীর পুত্র চণ্ডাল, তারা কুলের কলঙ্ক, গ্রামের বহির্দেশে বাস করে এবং ঘাতক (জল্লাদ)এর কর্ম করে। বৈশ্য-ক্ষত্রিয়ার পুত্র বাক্যজীবী বন্দী বা মাগধ। শূদ্র-ক্ষত্রিয়ার পুত্র মৎসজীবী নিষাদ। শূদ্র-বৈশ্যার পত্র আয়োগব (সূত্রধর)। শাস্ত্রে কেবল চতুর্বর্ণের ধর্ম নির্দিষ্ট আছে, বর্ণসংকর জাতির ধর্মের বিধান নেই, তাদের সংখ্যারও ইয়ত্তা নেই।
তার পর ভীষ্ম বললেন, ঔরসজাত পুত্র আত্মস্বরূপ। পতির অনুমতিতে অন্য কর্তৃক উৎপাদিত সন্তানের নাম নিরুক্তজ, বিনা অনুমতিতে সন্তান হ’লে তার নাম প্রসূতিজ। বিনামূল্যে প্রাপ্ত অপরের পুত্র দত্তকপুত্র, মূল্য দ্বারা প্রাপ্ত কৃতকপত্র। গর্ভবতী স্ত্রীর বিবাহের পর যে পুত্র হয় তার নাম অধ্যোঢ়। অবিবাহিত কুমারীর পুত্র কানীন।
১১। চ্যবন ও নহুষ
যুধিষ্ঠির ললেন, পিতামহ, যাদের সঙ্গে একত্র বাস করা যায় তাদের উপর কিরূপে স্নেহ হয়? ভীষ্ম বললেন, আমি এক ইতিহাস বলছি শোন।—পুরাকালে ভৃগুবংশজাত মহর্ষি চ্যবন ব্রতধারী হয়ে দ্বাদশ বৎসর গঙ্গাযমুনার জলমধ্যে বাস করেছিলেন। তিনি সর্বভূতের বিশ্বাসভাজন ছিলেন, মৎস্যাদি জলচর নির্ভয়ে তাঁর ওষ্ঠ আঘ্রাণ করত। একদিন ধীবরগণ জাল ফেলে বহু মৎস্য ধরলে, সেই সঙ্গে চ্যবনকেও তারা জালবদ্ধ করে তীরে তুলল। তাঁর পিঙ্গলবর্ণ শ্মশ্রু, মস্তকের জটা এবং শৈবাল-শঙ্খ-শম্বুক-মণ্ডিত দেহ দেখে ধীবরগণ কৃতাঞ্জলিপুটে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে। মৎস্যদের মরণাপন্ন দেখে চ্যবন কৃপাবিষ্ট হয়ে বার বার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ধীবরগণ বললে, মহামুনি, আমাদের অজ্ঞানকৃত পাপ ক্ষমা করুন, আদেশ করুন আমরা আপনার কি প্রিয়কার্য করব। চ্যবন বললেন, আমি এই মৎস্যদের সঙ্গে একত্র বাস করেছি, এদের ত্যাগ করতে পারি না; আমি মৎস্যদের সঙ্গেই প্রাণত্যাগ করব বা বিক্রীত হব।
ধীবরগণ অত্যন্ত ভীত হয়ে রাজা নহুষের কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালে। অমাত্য ও পুরোহিতের সঙ্গে নহুষ সত্বর এসে চ্যবনকে বললেন, দ্বিজোত্তম, আপনার কি প্রিয়কার্য করব বলুন। চ্যবন বললেন, এই মৎস্যজীবীরা অত্যন্ত শ্রান্ত হয়েছে, তুমি এদের মৎস্যের মূল্য এবং আমারও মূল্য দাও। নহুষ সহস্র মুদ্রা দিতে চাইলে চ্যবন বললেন, আমার মূল্য সহস্র মুদ্রা নয়, তুমি বিবেচনা ক’রে উপযুক্ত মূল্য দাও। নহুষ ক্রমে ক্রমে লক্ষ মুদ্রা, কোটি মুদ্রা, অর্ধ রাজ্য ও সমগ্র রাজ্য দিতে চাইলেন, কিন্তু চ্যবন তাতেও সম্মত হলেন না। নহুষ দুঃখিত ও চিন্তাকুল হলেন। এমন সময়ে এক গোগর্ভজাত ফলমূলাশী তপস্বী এসে নহুষকে বললেন, মহারাজ, ব্রাহ্মণ আর গো অমূল্য, আপনি এই ব্রাহ্মণের মূল্যস্বরূপ একটি গাভী দিন। নহুষ তখন হৃষ্ট হয়ে চ্যবনকে বললেন, ব্রহ্মর্ষি, গাত্রোত্থান করুন, আপনাকে আমি গাভী দ্বারা ক্রয় করলাম। চ্যবন তুষ্ট হয়ে বললেন, এখন তুমি যথার্থই আমাকে ক্রয় করেছ। গোধন তুল্য কোনও ধন নেই; গোমাহাত্ম্য কীর্তন ও শ্রবণ, গোদান এবং গোদর্শন করলে সর্বপাপনাশ ও কল্যাণ হয়। গাভী লক্ষ্মীর মূল এবং স্বর্গের সোপান স্বরূপ। গাভী থেকেই যজ্ঞীয় হবি উৎপন্ন হয়। সমগ্র গোমাহাত্ম্য বলা আমার সাধ্য নয়।
ধীবরগণ চ্যবনকে বললে, ভগবান, আপনি প্রসন্ন হয়ে এই গাভী গ্রহণ করুন। চ্যবন বললেন, ধীবরগণ, আমি এই গাভী নিলাম, তোমরা পাপমুক্ত হয়ে এই মৎস্যদের সঙ্গে স্বর্গে যাও। তার পর চ্যবন নহুষকে আশীর্বাদ করে নিজ আশ্রমে চ’লে গেলেন।
১২। চ্যবন ও কুশিক
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, পরশুরাম ব্রহ্মর্ষির বংশে জন্মে ক্ষত্রধর্মা হলেন কেন? আবার, ক্ষত্রিয় কুশিকের বংশে জন্মে বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ কি ক’রে হলেন? ভীষ্ম বললেন, ভৃগুনন্দন চ্যবন জানতেন যে কুশিকবংশ থেকে তাঁর বংশে ক্ষত্রাচার সংক্রামিত হবে, সেজন্য তিনি কুশিকবংশ দগ্ধ করতে ইচ্ছা করলেন। চ্যবন কুশিকের কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে চাই। কুশিক তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ ক’রে বললেন, আমার রাজ্য ধন ধেনু সমস্তই আপনার। চ্যবন বললেন, আমি ওসব চাই না, আমি এক ব্রতের অনুষ্ঠান করব, তুমি ও তোমার মহিষী অকুণ্ঠিত হয়ে আমার পরিচর্যা কর। কুশিক সানন্দে সম্মত হয়ে তাঁকে একটি উত্তম শয়নগৃহে নিয়ে গেলেন। সূর্যাস্ত হ’লে চ্যবন আহারের পর শয্যায় শুয়ে বললেন, তোমরা আমাকে জাগিও না, নিরন্তর পদসেবা কর। কুশিক ও তাঁর মহিষী আহারনিদ্রা ত্যাগ করে চ্যবনের পদসেবা করতে লাগলেন। একুশ দিন পরে চ্যবন শয্যা থেকে উঠে শয়নগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন, কুশিক ও তাঁর মহিষী অত্যন্ত শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হ’লেও পিছনে পিছনে গেলেন। ক্ষণকাল পরে চ্যবন অন্তর্হিত হলেন।
সস্ত্রীক কুশিক অন্বেষণ ক’রে কোথাও চ্যবনকে পেলেন না, তখন তাঁরা শয়নগৃহে এসে দেখলেন, মহর্ষি শয্যায় শুয়ে আছেন। কুশিক ও তাঁর মহিষী বিস্মিত হয়ে পুনর্বার পদসেবায় রত হলেন। আরও একুশ দিন পরে চ্যবন উঠে বললেন, আমি স্নান করব, আমার দেহে তৈলমর্দন কর। সপত্নীক কুশিক চ্যবনের দেহে মহামূল্য শতপাক তৈল মর্দন করতে লাগলেন। তার পর চ্যবন স্নানশালায় গিয়ে স্নান ক’রে আবার অন্তর্হিত হলেন। পুনর্বার আবির্ভূত হয়ে তিনি সিংহাসনে বসলেন এবং অন্ন আনবার আদেশ দিলেন। অন্ন মাংস শাক পিষ্টক ফল প্রভৃতি আনা হ’লে চ্যবন তাঁর শয্যা-আসনাদির সঙ্গে সমস্ত ভোজ্যদ্রব্যে অগ্নিদান ক’রে আবার অন্তর্হিত হলেন এবং পরদিন দেখা দিলেন।
এইরূপে অনেক দিন গেল, চ্যবন কুশিকের কোনও রন্ধ্র (ত্রুটি) দেখতে পেলেন না। একদিন তিনি বললেন, তুমি ও তোমার মহিষী আমাকে রথে বহন ক’রে নিয়ে চল; পথে যারা প্রার্থী হয়ে আসবে তাদের আমি প্রচুর ধনরত্ন দিতে ইচ্ছা করি, তুমি তার আয়োজন কর। রাজা ও মহিষী রথ টানতে লাগলেন, রাজভৃত্যগণ ধনরত্ন নিয়ে পশ্চাতে চলল। চাবনের কষাঘাতে সস্ত্রীক কুশিক ক্ষতবিক্ষত হলেন, পুরবাসিগণ শোকাকুল হয়েও শাপভয়ে নীরব রইল। অজস্র ধন দান করার পর চ্যবন রথ থেকে নেমে বললেন, মহারাজ, তোমাদের উপর আমি প্রীত হয়েছি, বর চাও। এই ব’লে তিনি রাজা ও মহিষীর দেহ হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। কুশিক বললেন, মহর্ষি, আপনার প্রসাদে আমাদের শ্রান্তি ও বেদনা দূর হয়েছে। চ্যবন বললেন, এখন তোমরা গৃহে যাও, আমি কিছুকাল এই গঙ্গাতীরে বাস করব, তোমরা কাল আবার এসো। দুঃখিত হয়ো না, শীঘ্রই তোমাদের সকল কামনা পূর্ণ হবে।
পরদিন প্রভাতে কুশিক ও তাঁর মহিষী গঙ্গাতীরে এসে দেখলেন, সেখানে গন্ধবনগর তুল্য কাঞ্চনময় প্রাসাদ, রমণীয় পর্বত, পদ্মশোভিত সরোবর, চিত্রশালা, তোরণ, বহুবৃক্ষসমন্বিত উদ্যান প্রভৃতি সৃষ্ট হয়েছে। কুশিক ভাবলেন, আমি কি স্বপ্ন দেখছি, না সশরীরে পরমলোক লাভ করেছি, না উত্তরকুরু বা অমরাবতীতে এসেছি? কিছুকাল পরে সেই কানন প্রাসাদ প্রভৃতি অদৃশ্য হয়ে গেল, গঙ্গাতীর পূর্বের ন্যায় নীরব হ’ল। কুশিক তাঁর মহিষীকে বললেন, তপোবলেই এইসকল হ’তে পারে, ত্রিলোকের রাজ্য অপেক্ষা তপস্যা শ্রেষ্ঠ। মহর্ষি চ্যবনেব কি আশ্চর্য শক্তি! ব্রাহ্মণরা সর্ববিষয়ে পবিত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন; রাজ্য সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু ব্রাহ্মণত্ব অতি দুর্লভ।
কুশিক ও তাঁর মহিষীকে ডেকে চ্যবন বললেন, মহারাজ, তুমি ইন্দ্রিয় ও মন জয় করেছ, এখন কঠোর পরীক্ষা থেকে মুক্ত হ’লে। আমি প্রীত হয়েছি, বর চাও। কুশিক বললেন, ভৃগুশ্রেষ্ঠ, আপনার নিকটে থেকে অগ্নিমধ্যবর্তী ব্যক্তির ন্যায় আমরা যে দগ্ধ হই নি এই যথেষ্ট। যদি প্রীত হয়ে থাকেন তো বলুন, আপনি যেসকল অদ্ভুত কার্য করেছেন তার উদ্দেশ্য কি? চ্যবন বললেন, মহারাজ, আমি ব্রহ্মার নিকট শুনেছিলাম যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিবোধের ফলে কুলসংকর হবে, তোমার এক তেজস্বী বলবান পুত্র জন্মাবে। তোমার বংশ দগ্ধ করবার জন্যই আমি এখানে এসেছিলাম, কিন্তু বহু উৎপীড়ন ক’রেও তোমাকে ক্রুদ্ধ করতে পারি নি, অভিশাপ দেবার কোনও ছিদ্রও পাই নি। তোমাদের প্রীতির জন্যই এই কানন সৃষ্টি করেছিলাম তাতে তোমরা ক্ষণকাল সশরীরে স্বর্গসুখ অনুভব করেছ। বাজা, তুমি ব্রাহ্মণত্ব ও তপশ্চর্যার আকাঙ্ক্ষা করেছ তাও আমি জানি। ব্রাহ্মণত্ব অতি দুর্লভ, ঋষিত্ব ও তপস্বিত্ব আবও দুর্লভ। তথাপি তোমার কামনা সিদ্ধ হবে, তোমার অধস্তন তৃতীয় পুরুষ (বিশ্বামিত্র) ব্রাহ্মণত্ব লাভ করবেন। ক্ষত্রিয়গণ ভৃগুবংশীয়দের যজমান, তথাপি তারা দৈববশে ভৃগু বংশীয়গণকে বধ করবে। তার পর আমাদের ভৃগুবংশে ঊর্ব (ঔর্ব)[৫] নামে এক মহাতেজস্বী পুরুষ জন্মাবেন, তাঁর পুত্র ঋচীক সমস্ত ধনুর্বেদ আয়ত্ত করবেন এবং পুত্র জমদগ্নিকে তা দান করবেন। জমদগ্নির সহিত তোমার পুত্র গাধির কন্যার বিবাহ হবে, তাঁদের পুত্র মহাতেজা পরশুরাম[৫] ক্ষত্রাচারী হবেন। গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী ক’রে চ্যবন তীর্থযাত্রায় গেলেন।
১৩। দানধর্ম—অপালক রাজা—কপিলা—লক্ষ্মী ও গোময়
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম তপস্যা ও বিবিধ ব্রতাচরণের ফল এবং ধেনু ভূমি জল সুবর্ণ অন্ন মৃগমাংস ঘৃত দুগ্ধ তিল বস্ত্র শয্যা পাদুকা প্রভৃতি দানের ফল সবিস্তারে বিবৃত ক’রে বললেন, যাচক অপেক্ষা অযাচক ব্রাহ্মণকে দান করা শ্রেয়, যাচকরা দস্যুর ন্যায় দাতাকে উদ্বিগ্ন করে। যুধিষ্ঠির, তোমার রাজ্যে যদি অযাচক দরিদ্র ব্রাহ্মণ থাকেন তবে তুমি তাঁদের ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায় জ্ঞান করবে; তাঁদের সেবা অবশ্য কর্তব্য।
তার পর ভীষ্ম বললেন, রাজাদের যজ্ঞানুষ্ঠান করা উচিত, কিন্তু প্রজাপীড়ন ক’রে নয়। যে রাজ্যে বালকেরা স্বাদু খাদ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু খেতে পায় না, ব্রাহ্মণাদি প্রজারা ক্ষুধায় অবসন্ন হয়, পতিপুত্রদের মধ্য থেকে রোরুদ্যমানা রমণী সবলে অপহৃত হয়, সে রাজার জীবনে ধিক। যিনি প্রজা রক্ষা করতে পারেন না, সবলে ধন হরণ করেন, সেই নির্দয় কলিতুল্য রাজাকে প্রজাগণ মিলিত হয়ে বধ করবে। যিনি প্রজারক্ষার আশ্বাস দিয়ে রক্ষা করেন না সেই রাজাকে ক্ষিপ্ত কুক্কুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত। মনুস্মৃতি অনুসারে প্রজার পাপ ও পণ্যের চতুর্থাংশ রাজাতে সংক্রামিত হয়।
তার পর ভীষ্ম গোদানের ফল সবিশেষ কীর্তন ক’রে বললেন, গোসমূহের মধ্যে কপিলাই শ্রেষ্ঠ। প্রজাসৃষ্টির পর প্রজাপতি দক্ষ অমৃত পান করেছিলেন, তাঁর উদ্গার থেকে কামধেনু সুরভী উৎপন্ন হন। সরভীই সুবর্ণবর্ণা কপিলা গাভীদের জন্ম দিয়েছিলেন। একদা কপিলাদের দুগ্ধফেন মহাদেবের মস্তকে পতিত হওয়ায় তিনি ক্রুদ্ধ হন, তাঁর দৃষ্টিপাতের ফলে কপিলাদের গাত্র বিবিধবর্ণ হয়েছে। প্রজাপতি দক্ষ তাঁকে বলেছিলেন, আপনি অমৃতে অভিষিক্ত হয়েছেন। দক্ষ মহাদেবকে একটি বৃষভ ও কতকগুলি গাভী দিয়েছিলাম, সেই বৃষভ মহাদেবের বাহন ও লাঞ্ছন হ’ল।
যুধিষ্ঠির, আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।—একদিন লক্ষ্মী মনোহরবেশে গাভীদের নিকটে এলে তারা জিজ্ঞাসা করলে, দেবী, তুমি কে? তোমার রূপের তুলনা নেই। লক্ষ্মী বললেন, আমি লোককান্তা শ্রী; আমি দৈত্যদের ত্যাগ করেছি সেজন্য তারা বিনষ্ট হয়েছে, আমার আশ্রয়ে দেবতারা চিরকাল সুখভোগ করছেন। গোগণ, আমি তোমাদের দেহে নিত্য বাস করতে ইচ্ছা করি, তোমরা শ্রীযুক্তা হও। গাভীরা বললে, তুমি অস্থিরা চপলা, বহুলোকের অনুরক্তা, আমরা তোমাকে চাই না। আমরা সকলেই কান্তিমতী, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। লক্ষ্মী বললেন, অনাহূত হয়ে যে আসে তার অপমান লাভ হয়—এই প্রবাদ সত্য। মনুষ্য দেব দানব গন্ধর্বাদি উগ্র তপস্যা দ্বারা আমার সেবা করেন; অতএব তোমরাও আমাকে গ্রহণ কর, ত্রিলোকে কেউ আমার অপমান করে না। তোমরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি সকলের নিকট অবজ্ঞাত হব, অতএব তোমরা প্রসন্ন হও, আমি তোমাদের শরণাগত। তোমাদের দেহের কোনও স্থান কুৎসিত নয়, আমি তোমাদের অধোদেশেও বাস করতে সম্মত আছি। তখন গাভীরা মন্ত্রণা ক’রে বললে, কল্যাণী যশস্বিনী, তোমার সম্মানরক্ষা আমাদের অবশ্য কর্তব্য; তুমি আমাদের পবিত্র পুরীষ ও মূত্রে অবস্থান কর। লক্ষ্মী তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি সম্মানিত হয়েছি।
১৪। দানের অপাত্র—বশিষ্ঠাদির লোভসংবরণ
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে ভীষ্ম শ্রাদ্ধকর্মের বিধি সবিস্তারে বর্ণনা ক’রে বললেন, দৈব ও পিতৃকার্যে দানের পূর্বে ব্রাহ্মণদের কুল শীল বিদ্যা ইত্যাদি বিচার করা উচিত। যে ব্রাহ্মণ ধূর্ত ভ্রূণহত্যাকারী যক্ষারোগী পশুপালক বিদ্যাহীন কুসীদজীবী বা রাজভৃত্য, যে পিতার সহিত বিবাদ করে, যার গৃহে উপপতি আছে, যে চোর পারদারিক শূদ্রযাজক বা শস্ত্রজীবী, যে কুকুর নিয়ে মৃগয়া করে, যাকে কুকুর দংশন করেছে, যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পূর্বে বিবাহ করেছে, যে কুশীলব (নট) বা কৃষিজীবী, যে কররেখা ও নক্ষত্রাদি দেখে শুভাশুভ নির্ণয় করে, এমন ব্রাহ্মণ অপাঙ্ক্তেয়, এদের দান করা উচিত নয়। দানগ্রহণও দোষজনক; যে ব্রাহ্মণ গুণবানের দান গ্রহণ করেন তিনি অল্পদোষী হন, যিনি নির্গুণের দান নেন তিনি পাপে নিমগ্ন হন। আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।—
কশ্যপ অত্রি বশিষ্ঠ ভরদ্বাজ গৌতম বিশ্বামিত্র জমদগ্নি এবং বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতী ব্রহ্মলোক লাভের নিমিত্ত কঠোর তপস্যা ক’রে পৃথিবী পর্যটন করছিলেন। গণ্ডা নামে এক কিংকরী এবং তার স্বামী পশুসখ নামক শূদ্র ঋষিদের পরিচর্যা করত। এই সময়ে অনাবৃষ্টির ফলে খাদ্যাভাবে লোকে অত্যন্ত দুর্বল হযে গিয়েছিল। শিবিপুত্র শৈব্য-বৃষাদর্ভি এক যজ্ঞ ক’রে ঋত্বিগ্গণকে নিজ পুত্র দক্ষিণাস্বরূপ দিয়েছিলেন; সেই পুত্র অকালে প্রাণত্যাগ করলে মহর্ষিগণ নিজের জীবনরক্ষার জন্য তাঁর দেহ স্থালীতে পাক করতে লাগলেন। তা দেখতে পেয়ে শৈব্য বললেন, আপনারা এই অভক্ষ্য বস্তু ত্যাগ করুন, আপনাদের পুষ্টির জন্য যা চান তাই আমি দেব। ঋষিরা বললেন, রাজাদের দান গ্রহণ করলে আপাতত সুখ হয় বটে, কিন্তু পরিণামে তা বিষতুল্য, দানপ্রতিগ্রহের ফলে সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়। যারা যাচক তাদেরই তুমি দান কর। এই ব’লে ঋষিরা অন্যত্র চলে গেলেন, তাঁরা যা পাক করছিলেন তা প’ড়ে রইল।
রাজা শৈব্যের আদেশে তাঁর মন্ত্রীরা বন থেকে উড়ুম্বর (ডুমর) ফল সংগ্রহ ক’রে ঋষিদের দিতে লাগলেন। কিছুদিন পরে রাজা ফলের মধ্যে সুবর্ণ পুরে পাঠিয়ে দিলেন। মহর্ষি অত্রি সেই ফল গুরুভার দেখে বললেন, আমরা নির্বোধ নই, এই সুবর্ণময় ফল নিতে পারি না। ঋষিরা সেই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চ’লে গেলেন। দান প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় শৈব্য ক্রুদ্ধ হয়ে এক যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞাগ্নি থেকে যাতুধানী নামে এক ভয়ংকরী কৃত্যা উত্থিত হ’ল। রাজা সেই কৃত্যাকে বললেন, তুমি অত্রি প্রভৃতি সাত জন ঋষি, অরুন্ধতী, তাঁদের দাস পশুসখ এবং দাসী গণ্ডার কাছে যাও; তাদের নাম জেনে নিয়ে সকলকে বিনষ্ট কর।
ঋষিরা এক বনে ফলমূল খেয়ে বিচরণ করছিলেন। একদিন তাঁরা দেখলেন, এক স্থূলকায় পরিব্রাজক কুকুর নিয়ে তাঁদের দিকে আসছেন। অরুন্ধতী ঋষিদের বললেন, আপনাদের দেহ এমন পুষ্ট নয়। ঋষিরা বললেন, আমরা খাদ্যাভাবে কৃশ হয়েছি, আমাদের নিত্যকর্মও করতে পারি না; এই পরিব্রাজকের অভাব নেই সেজন্য সে ও তার কুকুর স্থূলদেহ। তার পর সেই পরিব্রাজক নিকটে এসে ঋষিদের করস্পর্শ ক’রে বললেন, আমি আপনাদের পরিচর্যা করব। একদিন সকলে এক মনোহর সরোবরের নিকট উপস্থিত হলেন, যাতুধানী তা রক্ষা করছিল। ঋষিরা মৃণাল নিতে গেলে যাতুধানী বললে, আগে তোমরা নিজেদের নাম ও তার অর্থ বল তার পর মৃণাল নিও। ঋষিগণ অরুন্ধতী গণ্ডা ও পশুসখ নিজ নিজ নাম ও তার অর্থ জানালে যাতুধানী প্রত্যেককে বললে, তোমার নামের অর্থ বুঝলাম না, যা হ’ক, তুমি সরোবরে নামতে পার। অবশেষে পরিব্রাজক বললেন, এঁরা সকলে যেপ্রকারে নিজ নিজ নাম জানালেন আমি তেমন পারব না; আমার নাম শুনঃসখসখ (যম বা ধর্মের সখা)। যাতুধানী বললে, তোমার বাক্য সন্দিগ্ধ, পুনর্বার নাম বল। পরিব্রাজক বললেন, আমি একবার নাম বলেছি তথাপি তুমি বুঝতে পারলে না, অতএব এই ত্রিদণ্ডের আঘাতে তোমাকে বধ করব। এই ব’লে তিনি যাতুধানীর মস্তকে আঘাত করলেন, সে ভূপতিত হয়ে ভস্মসাৎ হ’ল।
ঋষিরা তখন মৃণাল তুলে তীরে রাখলেন এবং পুনর্বার জলে নেমে তর্পণ করতে লাগলেন। জল থেকে উঠে তাঁরা মৃণাল দেখতে পেলেন না। তখন তাঁরা প্রত্যেকে শপথ ক’রে অপহরণকারীর উদ্দেশে অভিশাপ দিলেন। পরিশেষে শুনঃসখ এই শপথ করলেন—যে চুরি করেছে সে বেদজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্যসম্পন্ন ব্রাহ্মণকে কন্যাদান করুক এবং অথর্ববেদ অধ্যয়ন ক’রে স্নান করুক। ঋষিরা বললেন, তুমি যে শপথ করলে তা সকল ব্রাহ্মণেরই অভীষ্ট, তুমিই আমাদের মৃণাল চুরি করেছ। শুনঃসখ বললেন, আপনাদের কথা সত্য, আপনাদের পরীক্ষার জন্যই এমন করেছি। এই যাতুধানী রাজা শৈব্য-বৃষাদর্ভির আজ্ঞায় আপনাদের বধ করতে এসেছিল; আমি ইন্দ্র, আপনাদের রক্ষা করেছি। আপনারা সর্ববিধ প্রলোভন প্রত্যাখ্যান ক’রে ক্ষুধা সহ্য করেছেন, সেজন্য সর্বকামপ্রদ অক্ষয় লোক লাভ করবেন। তখন সকলে আনন্দিত হয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে স্বর্গে গেলেন।
১৫। ছত্র ও পাদুকা—পুষ্প ধুপ ও দীপ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, শ্রাদ্ধাদিতে যে ছত্র ও পাদুকা দেওয়া হয় তার প্রবর্তন কি প্রকারে হ’ল? ভীষ্ম বললেন, একদা জ্যৈষ্ঠ মাসে মধ্যাহ্নকালে মহর্ষি জমদগ্নি ধনু দ্বারা শর নিক্ষেপ ক’রে ক্রীড়া করছিলেন, তাঁর পত্নী রেণুকা সেই শর তুলে এনে দিচ্ছিলেন। প্রখর রৌদ্রে রেণুকার কষ্ট হ’তে লাগল। তাঁর বিলম্ব দেখে জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তোমার শর আনতে বিলম্ব হ’ল কেন? রেণুকা বললেন, সূর্যকিরণে আমার মস্তক ও চরণ সন্তপ্ত হয়েছিল, আমি বৃক্ষের ছায়ায আশ্রয় নিয়েছিলাম। জমদগ্নি দিব্য ধনু ও বহু শর নিয়ে সূর্যকে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন। তখন দিবাকর ব্রাহ্মণের বেশে এসে বললেন, ব্রহ্মর্ষি, সূর্য আকাশে থেকে কিরণ দ্বারা রস আকর্ষণ করেন এবং বর্ষায় সেই রস বর্ষণ করেন, তা থেকে অন্ন উৎপন্ন হয়। সূর্যকে নিপাতিত ক’রে তোমার কি লাভ হবে? সূর্য, আকাশে স্থির থাকেন না, তাঁকে তুমি কি ক’রে বিদ্ধ করবে? জমদগ্নি বললেন, আমি জ্ঞাননেত্র দ্বারা তোমাকে জানি, মধ্যাহ্নে তুমি অর্ধ নিমেষ কাল স্থির থাক, সেই সময়ে তোমাকে বিদ্ধ করব। সূর্য বললেন, আমি তোমার শরণ নিলাম। জমদগ্নি সহাস্যে বললেন, তবে তোমার ভয় নেই; কিন্তু এমন উপায় কর যাতে লোকে রৌদ্রতাপিত পথ দিয়ে বিনা কষ্টে যেতে পারে। তখন সূর্য জমদগ্নিকে ছত্র ও পাদুকা দিয়ে বললেন, মহর্ষি, এই দুইএর দ্বারা আমার তাপ থেকে মস্তক ও চরণ রক্ষিত হবে।
আখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, সূর্যই ছত্র ও পাদুকার প্রবর্তক, ব্রাহ্মণদের দান করলে মহান ধর্ম হয়। তার পর ভীষ্ম দেবার্চনায় পুষ্প ধূপ ও দীপের উপযোগিতা প্রসঙ্গে বললেন, পুষ্প মনকে আহ্লাদিত করে সেজন্য তার নাম সুমনাঃ। কণ্টকহীন বৃক্ষের শ্বেতবর্ণ পুষ্পই দেবতাদের প্রীতিকর। পদ্মাদি জলজ পুষ্প গন্ধর্ব নাগ ও যক্ষগণকে প্রদেয়। কটু ও কণ্টকময় ওষধি এবং রক্তবর্ণ পুষ্প শত্রুদের অভিচারের জন্য অথর্ববেদে নির্দিষ্ট হয়েছে। ধূপ তিন প্রকার; গুগ্গুল, প্রভৃতিকে নির্যাস, কাষ্ঠময় ধূপকে সারী, এবং মিশ্রিত উপাদান থেকে প্রস্তুত ধূপকে কৃত্রিম বলে। নির্যাসের মধ্যে গুগ্গুল, শ্রেষ্ঠ, সারী ধূপের মধ্যে অগুরু শ্রেষ্ঠ। শল্লকী[৬] ও তজ্জাতীয় নির্যাসের ধূপ দৈত্যদের প্রিয়। সর্জরস (ধুনা) ও গন্ধকাষ্ঠ প্রভৃতির সংযোগে যে কৃত্রিম ধূপ হয় তা দেব দানব মানব সকলেরই প্রীতিকর। দীপ দান করলে মাননুষের তেজ বৃদ্ধি পায়, উত্তরায়ণের রাত্রিতে দীপদান কর্তব্য।
১৬। সদাচার—ভ্রাতার কর্তব্য
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, মানুষকে শতায়ু ও শতবীর্য বলা হয়, তবে অকালমৃত্যু হয় কেন? কি করলে মানুষ আয়ু কীর্তি ও শ্রী লাভ করতে পারে? ভীষ্ম বললেন, যারা দুরাচার তারা দীর্ঘ আয়ু পায় না, যে নিজের হিত চায় তাকে সদাচার পালন করতে হবে। প্রত্যহ ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে ধর্মার্থচিন্তা ও আচমন ক’রে কৃতাঞ্জলি ও পূর্বমুখ হয়ে পূর্বসন্ধ্যার উপাসনা করবে। উদীয়মান ও অস্তগামী সূর্য দেখবে না; রাহুগ্রস্ত, জলে প্রতিফলিত এবং আকাশমধ্যগত সূর্যের দিকেও দৃষ্টিপাত করবে না। মূত্র-পুরীষ দেখবে না, স্পর্শও করবে না। একাকী অথবা অজ্ঞাত বা নীচজাতীয় লোকের সঙ্গে চলবে না। ব্রাহ্মণ গো রাজা বৃদ্ধ ভারবাহী গর্ভিণী ও দুর্বলকে পথ ছেড়ে দেবে। অন্যের ব্যবহৃত পাদুকা ও বস্ত্র পরবে না। বৃথা মাংস এবং পৃষ্ঠদেশের মাংস খাবে না। সশব্দে ভোজন করবে না। মর্মভেদী বাক্য বলবে না; মুখ থেকে যে বাক্যবাণ নির্গত হয় তা কেবল মর্মস্থলেই বিদ্ধ হয়, তার আঘাতে লোকে দিবারাত্র দুঃখ পায়। কুঠার প্রভৃতিতে ছিন্ন বন আবার অঙ্কুরিত হয়, কিন্তু দুর্বাক্যজনিত হৃদয়ের ক্ষত সারে না। বাণ নারাচ প্রভৃতি অস্ত্র দেহ থেকে উদ্ধার করা যায়, কিন্তু বাক্শল্য হৃদয় থেকে তুলে ফেলা যায় না। হীনাঙ্গ অতিরিক্তাঙ্গ বিদ্যাহীন রূপহীন নির্ধন বা দুর্বল লোককে উপহাস করবে না। পিষ্টক মাংস পায়স প্রভৃতি উত্তম খাদ্য দেবতার উদ্দেশেই প্রস্তুত করবে, কেবল নিজের জন্য নয়। গর্ভিণী স্ত্রীতে গমন করবে না। পূর্ব বা দক্ষিণ দিকে মস্তক রেখে শয়ন করবে। ক্ষেত্রে বা গ্রামের নিকটে মলত্যাগ করবে না। ভোজনের পর কিঞ্চিৎ খাদ্য অবশিষ্ট রাখবে। আর্দ্রচরণে ভোজন করবে, কিন্তু শয়ন করবে না। বৃদ্ধকে অভিবাদন করবে এবং স্বয়ং আসন দেবে। বিবস্ত্র হয়ে স্নান বা শয়ন করবে না। উচ্ছিষ্ট হয়ে (এঁটো মুখে) অধ্যয়ন বা অধ্যাপনা করবে না। গুরুর সঙ্গে বিতণ্ডা বা গুরুনিন্দা করবে না। সৎকূলজাতা সুলক্ষণা বয়স্থা কন্যাকেই বিবাহ করা বিজ্ঞ লোকের উচিত। নিমন্ত্রিত না হয়ে কোথাও যাবে না। মাতা পিতা প্রভৃতি গুরুজনের আজ্ঞা পালন করবে, তাঁদের উপদেশ বিচার করবে না। বেদ অস্ত্রবিদ্যা অশ্ব-হস্তী-আরোহণ ও রথচালন শিক্ষা করবে। ঋতুর পঞ্চম দিনে গর্ভাধান হ’লে কন্যা এবং ষষ্ঠ দিনে পুত্র হয় এই বুঝে পত্নীর সহবাস করবে। যথাশক্তি যজ্ঞ দ্বারা দেবতাদের আরাধনা করবে। যুধিষ্ঠির, তুমি সদাচার সম্বন্ধে আর যা জানতে চাও তা বেদজ্ঞ বৃদ্ধদের জিজ্ঞাসা ক’রো। সদাচারই ঐশ্বর্য কীর্তি আয়ু ও ধর্মের মূল।
তার পর ভীষ্ম ভ্রাতার কর্তব্য সম্বন্ধে এই উপদেশ দিলেন।—গুরু যেমন শিষ্যের প্রতি সেইরূপ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কনিষ্ঠের প্রতি ব্যবহার করবেন। শত্রুরা যাতে ভ্রাতাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সতর্ক থাকবেন। তিনি পৈতৃক অংশ থেকে কনিষ্ঠগণকে বঞ্চিত করবেন না। কনিষ্ঠ যদি দুষ্কর্ম করে তবে তার যাতে মঙ্গল হয় এমন চেষ্টা করবেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সৎ বা অসৎ যাই হ’ন, কনিষ্ঠের তাঁকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই পিতৃস্থানীয় হন, অতএব তাঁর আশ্রয়েই বাস করা কর্তব্য। জ্যেষ্ঠা ভগিনী ও জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃজায়া স্তন্যদায়িনী মাতার সমান।
১৭। মানসতীর্থ—বৃহস্পতির উপদেশ
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম উপবাসের গুণবর্ণনার পর তীর্থ সম্বন্ধে বললেন, পৃথিবীর সকল তীর্থই ফলপ্রদ, কিন্তু মানসতীর্থই পবিত্রতম। ধৈর্য তার হ্রদ, বিমল সত্য তার অগাধ জল; এই তীর্থে স্নান করলে অনর্থিত্ব ঋজুতা মৃদুতা অহিংসা অনিষ্ঠুরতা শান্তি ও ইন্দ্রিয়দমনশক্তি লাভ হয়। জল দিয়ে দেহ ধৌত করলেই স্নান হয় না, যিনি ইন্দ্রিয় দমন করেছেন তাঁকেই যথার্থ স্নাত বলা যায়, তাঁর বাহ্য ও অভ্যন্তর শুচি হয়। মানসতীর্থে ব্রহ্মজ্ঞান রূপ সলিল দ্বারা স্নানই তত্ত্বদর্শীদের মতে শ্রেষ্ঠ।
যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, মানুষ কি জন্য বার বার জন্মগ্রহণ করে, কিরূপ কার্যের ফলে স্বর্গে বা নরকে যায়? ভীষ্ম বললেন, ওই ভগবান বৃহস্পতি আসছেন, ইনিই তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। বৃহস্পতি উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন শুনে বললেন, মহারাজ, মানুষ একাকীই জন্মায়, মরে, দুর্গতি থেকে উদ্ধার পায়, এবং দুর্গতি ভোগ করে; পিতা মাতা আত্মীয় বন্ধু কেউ তার সহায় নয়। আত্মীয়স্বজন ক্ষণকাল রোদন ক’রে মৃতব্যক্তির দেহ কাষ্ঠ-লোষ্ট্রের ন্যায় ত্যাগ ক’রে চ’লে যায়, কেবল ধর্মই অনুগমন করেন। মৃত্যুর পর জীব অন্য দেহ গ্রহণ করে, পঞ্চভূতস্থ দেবতারা তার শুভাশভ কর্মসকল দর্শন করেন। মানুষ যে অন্ন ভোজন করে তাতে পঞ্চভূত পরিতৃপ্ত হ’লে রেতঃ উৎপন্ন হয়, জীব তা আশ্রয় করে স্ত্রীগর্ভে প্রবিষ্ট হয় এবং যথাকালে প্রসূত হয়ে সংসারচক্রে ক্লেশ ভোগ করে। যে ব্যক্তি জন্মাবধি যথাশক্তি ধর্মাচরণ করে সে নিত্য সুখী হয়; যে অধার্মিক সে যমালয়ে যায় এবং তির্যগ্যোনি লাভ করে; যে ধর্ম ও অধর্ম দুইপ্রকার আচরণ করে সে সখের পর দুঃখ ভোগ করে। যে ব্যক্তি মোহবশে অধর্ম ক’রে পরে অনুতপ্ত হয় তাকে দুষ্কৃতের ফল ভোগ করতে হয় না। যার মনে যত অনুতাপ হয় তার তত পাপক্ষয় হয়। ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণের নিকট নিজের কর্ম ব্যক্ত করলে অধর্মর্জনিত অপবাদ শীঘ্র দূর হয়। অহিংসাই ধর্ম সাধনের শ্রেষ্ঠ উপায়। যিনি সকল প্রাণীকে নিজের তুল্য জ্ঞান করেন, যিনি ক্রোধ ও আঘাতের প্রবৃত্তি জয় করেছেন, তিনি পরলোকে সুখলাভ করেন।
১৮। মাংসাহার
বৃহস্পতি চ’লে গেলে যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি বহু বার বলেছেন যে অহিংসা পরম ধর্ম; আপনার কাছে এও শুনেছি যে পিতৃগণ আমিষ ইচ্ছা করেন সেজন্য শ্রাদ্ধে বহুবিধ মাংস দেওয়া হয়। হিংসা না করলে মাংস কোথায় পাওয়া যাবে? ভীষ্ম বললেন, যাঁরা সৌন্দর্য স্বাস্থ্য আয়ু বুদ্ধি বল ও স্মরণশক্তি চান তাঁরা হিংসা ত্যাগ করেন। স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন, যিনি মাংসাহার ও পশুহত্যা করেন না তিনি সর্ব জীবের মিত্র ও বিশ্বাসের পাত্র। নারদ বলেছেন, যে পরের মাংস দ্বারা নিজের মাংস বৃদ্ধি করতে চায় সে কষ্ট ভোগ করে। মাংসাশী লোক যদি মাংসাহার ত্যাগ করে তবে যে ফল পায়, বেদাধ্যয়ন ও সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠান ক’রেও সেরূপ ফল পেতে পারে না। মাংসভোজনে আসক্তি জন্মালে তা ত্যাগ করা কঠিন; মাংসবর্জন-ব্রত আচরণ করলে সকল প্রাণী অভয় লাভ করে। যদি মাংসভোজী না থাকে তবে কেউ পশুহনন করে না. মাংসখাদকের জন্যই পশুঘাতক হয়েছে। মনু বলেছেন, যজ্ঞাদি কর্মে এবং শ্রাদ্ধে পিতৃগণের উদ্দেশে যে মন্ত্রপূত সংস্কৃত মাংস নিবেদিত হয় তা পবিত্র হবি স্বরূপ, তা ভিন্ন অন্য মাংস বৃথা মাংস এবং অভক্ষ্য।
যুধিষ্ঠির বললেন, মাংসাশী লোকে পিষ্টক শাক প্রভৃতি স্বাদু খাদ্য অপেক্ষা মাংসই ইচ্ছা করে; আমিও মনে করি মাংসের তুল্য সরস খাদ্য কিছুই নেই। অতএব আপনি মাংসাহার ও মাংসবর্জনের দোষগুণ বলুন। ভীষ্ম বললেন, তোমার কথা সত্য, মাংস অপেক্ষা স্বাদু কিছু নেই। কৃশ দুর্বল ইন্দ্রিয়সেবী ও পথশ্রান্ত লোকের পক্ষে মাংসই শ্রেষ্ঠ খাদ্য, তাতে সদ্য বলবৃদ্ধি ও পুষ্টি হয়। কিন্তু যে লোক পরমাংস দ্বারা নিজ মাংস বৃদ্ধি করতে চায় তার অপেক্ষা ক্ষুদ্র ও নৃশংসতর কেউ নেই। বেদে আছে, পশুগণ যজ্ঞের নিমিত্ত সৃষ্ট হয়েছে, অতএব যজ্ঞ ভিন্ন অন্য কারণে পশুহত্যা রাক্ষসের কার্য। পুরাকালে অগস্ত্য অরণ্যের পশুগণকে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন, সেজন্য ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মৃগয়া প্রশংসনীয়। লোকে মরণ পণ ক’রে মগয়ায় প্রবৃত্ত হয়, হয় পশু মরে নতুবা মৃগয়াকারী মরে; দুইএরই সমান বিপদের সম্ভাবনা, এজন্য মৃগয়ায় দোষ হয় না। কিন্তু সর্বভূতে দয়ার তুল্য ধর্ম নেই, দয়ালু তপস্বীদের ইহলোকে ও পরলোকে জয় হয়। প্রাণদানই শ্রেষ্ঠ দান; আত্মা অপেক্ষা প্রিয়তর কিছু নেই, অতএব আত্মবান মানবের সকল প্রাণীকেই দয়া করা উচিত। যারা পশুমাংস খায়, পরজন্মে তারা সেই পশু কর্তৃক ভক্ষিত হয়। আমাকে (মাং) সে (সঃ) পূর্বজন্মে খেয়েছে, অতএব আমি তাকে খাব—‘মাংস’ শব্দের এই তাৎপর্য।
১৯। ব্রাহ্মণ-রাক্ষস-সংবাদ
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, সাম (তোষণ) ও দান এই দুইএর মধ্যে কোন্ উপায় শ্রেষ্ঠ? ভীষ্ম বললেন, কেউ সাম দ্বারা কেউ দান দ্বারা প্রসাদিত হয়, লোকের প্রকৃতি বুঝে সাম বা দান অবলম্বন করতে হয়। সাম দ্বারা দুরন্ত প্রাণীকেও বশ করা যায়। একটি উপাখ্যান বলছি শোন।—এক সুবক্তা ব্রাহ্মণ জনহীন বনে এক ক্ষুধার্ত রাক্ষসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ হতবুদ্ধি ও ত্রস্ত না হয়ে রাক্ষসকে মিষ্টবাক্যে সম্বোধন করলেন। রাক্ষস বললে, তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পার তবে তোমাকে ছেড়ে দেব; আমি কিজন্য পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে যাচ্ছি তা বল। ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চিন্তা ক’রে বললেন, রাক্ষস, তুমি বিদেশে বন্ধুহীন হয়ে বিষয় ভোগ করছ এজন্য পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হচ্ছ। তোমার মিত্রগণ তোমার নিকট সদ্ব্যবহার পেয়েও তোমার প্রতি বিমুখ হয়েছে। তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট লোকেও ধনবান হয়ে তোমাকে অবজ্ঞা করছে। তুমি যাদের উপকার করেছিলে তারা এখন তোমাকে গ্রাহ্য করে না। তুমি গুণবান বিনয়সম্পন্ন ও প্রাজ্ঞ, কিন্তু দেখছ যে গুণহীন অজ্ঞ লোকে সম্মানিত হচ্ছে। কোনও শত্রু মিত্ররূপে এসে তোমাকে বঞ্চনা করেছে। নিজের গুণ প্রকাশ ক’রেও তুমি অসৎ লোকের কাছে মর্যাদা পাও নি। তোমার ধন বৃদ্ধি ও শাস্ত্রজ্ঞান নেই, কেবল তেজস্বিতার প্রভাবে তুমি মহান হ’তে চাচ্ছ। তুমি বনবাসী হয়ে তপস্যা করতে ইচ্ছা কর, কিন্তু তোমার বান্ধবদের তাতে সম্মতি নেই। এক ধনী সুরূপ যুবা তোমার প্রতিবেশী, সে তোমার প্রিয়া পত্নীকে কামনা করে। তুমি লজ্জার বশে নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করতে পার না। কোনও চিরাভিলষিত ফল তুমি লাভ করতে পার নি। অপরাধ না ক’রেও তুমি অকারণে অন্যের অভিশাপ পেয়েছ। পাপীদের উন্নতি এবং সাধুদের দুর্দশা দেখে তোমার দুঃখ হয়। সুহৃদ্গণের অনুরোধে তুমি পরস্পরবিরোধী লোকদের তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছ। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের কুকর্ম এবং জ্ঞানী লোকের ইন্দ্রিয়সংযমের অভাব দেখে তুমি ক্ষুব্ধ হয়েছ। রাক্ষস, এইসকল কারণে তুমি পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে যাচ্ছ।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে রাক্ষস তুষ্ট হ’ল এবং তাঁকে বহু অর্থ দিয়ে ছেড়ে দিলে।
২০। ত্রিবিধ প্রমাণ—ভীষ্মোপদেশের সমাপ্তি
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, প্রত্যক্ষ ও আগম (শ্রুতি) এই দুই প্রমাণের কোন্টি শ্রেষ্ঠ? ভীষ্ম বললেন, পণ্ডিতাভিমানী হেতুবাদীরা প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য প্রমাণ মানে না; তাদের এই সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত। আগমই প্রধান প্রমাণ, কিন্তু অনলস ও অভিনিবিষ্ট না হ’লে তা স্থির করা দুঃসাধ্য। যারা শিষ্টাচারহীন, বেদ ও ধর্মের বিদ্বেষী, তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যাঁরা সাধু, শাস্ত্রচর্চায় যাঁদের বুদ্ধি বিশুদ্ধ হয়েছে, তাঁদের কাছেই সংশয়ভঞ্জনের জন্য যাওয়া উচিত। বেদ, প্রত্যক্ষ ও শিষ্টাচার— এই তিনটিই প্রমাণ। যুধিষ্ঠির বললেন, তবে ধর্মও কি তিনপ্রকার? ভীষ্ম বললেন, ধর্ম একই, তার প্রমাণ তিনপ্রকার হ’তে পারে। তর্কদ্বারা ধর্ম জানতে চেষ্টা ক’রো না, প্রমাণের যে নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে তার দ্বারাই নিজের সংশয় দূর করতে পারবে। অহিংসা সত্য অক্রোধ ও দান—এই চারটিই সনাতন ধর্ম, তুমি এই ধর্মের অনুষ্ঠান করবে। পিতৃপিতামহের অনুসরণ ক’রে ব্রাহমণদের সেবা কর, তাঁরাই তোমাকে ধর্মের উপদেশ দেবেন।
ভীষ্ম এইরূপে যুধিষ্ঠিরকে নানাবিষয়ক উপদেশ দিয়ে নীরব হলেন। যে ক্ষত্রবীরগণ তাঁর নিকটে সমবেত হয়েছিলেন তাঁরা ক্ষণকাল চিত্রার্পিতের ন্যায় নিশ্চল হয়ে রইলেন। তার পর মহর্ষি ব্যাস শরশয্যাশায়ী ভীষ্মকে বললেন, গঙ্গানন্দন, কুরুরাজ যুধিষ্ঠির এখন প্রকৃতিস্থ হয়েছেন; তুমি অনুমতি দাও, তিনি তাঁর ভ্রাতৃগণ, কৃষ্ণ ও উপস্থিত রাজগণের সঙ্গে হস্তিনাপুরে ফিরে যাবেন। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে মধুরবাক্যে বললেন, মহারাজ, তুমি এখন অমাত্যগণের সঙ্গে নগরে যাও, তোমার মনস্তাপ দূর হ’ক। তুমি শ্রদ্ধাসহকারে যযাতির ন্যায় বহু যজ্ঞ ক’রে প্রচুর দক্ষিণা দাও, দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত কর, প্রজাগণের মনোরঞ্জন এবং সুহৃদ্গণের সম্মান কর। পক্ষীরা যেমন ফলবান বৃক্ষ আশ্রয় করে, তোমার সুহৃদ্গণ সেইরূপ তোমাকে আশ্রয় করুন। সূর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভ হ’লে আমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হবে, তখন তুমি আবার এসো। যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন এবং ভীষ্মকে অভিবাদনের পর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে অগ্রবর্তী ক’রে সকলের সঙ্গে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।
২১। ভীষ্মের স্বর্গারোহণ
যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরে এসে পুরবাসী ও জনপদবাসীদের যথোচিত সম্মান ক’রে গৃহগমনের অনুমতি দিলেন এবং পতিপুত্রহীনা নারীদের প্রচুর অর্থ দিয়ে সান্ত্বনা করলেন। পঞ্চাশ দিন পরে তিনি স্মরণ করলেন যে ভীষ্মের কাছে তাঁর যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে। তখন তিনি অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার জন্য ঘৃত মাল্য ক্ষৌমবস্ত্র চন্দন অগুরু প্রভৃতি এবং বিবিধ মহার্ঘ রত্ন পাঠিয়ে দিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী ও ভ্রাতৃগণকে অগ্রবর্তী করে যাজকগণের সঙ্গে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণ বিদুর যুযুৎসু ও সাত্যকি তাঁর অনুসরণ করলেন। তাঁরা কুরুক্ষেত্রে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ব্যাসদেব নারদ ও অসিতদেবল তাঁর কাছে ব’সে আছেন এবং নানা দেশ হ’তে আগত রাজা ও রক্ষিগণ তাঁকে রক্ষা করছেন। সকলকে অভিবাদন ক’রে যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন, জাহ্নবীনন্দন, আমি যুধিষ্ঠির, আপনাকে প্রণাম করছি। মহাবাহু, আপনি শুনতে পাচ্ছেন? বলুন এখন আমি আপনার কি করব। আমি অগ্নি নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছি; আচার্য ঋত্বিক ও ব্রাহ্মণগণ, আমার ভ্রাতৃগণ, আপনার পুত্র জনেশ্বর ধৃতরাষ্ট্র, এবং অমাত্যসহ বাসুদেবও এসেছেন। কুরশ্রেষ্ঠ, আপনি চক্ষু উম্মীলন ক’রে সকলকে দেখুন। আপনার অন্ত্যেষ্টির জন্য যা আবশ্যক সমস্তই আমি আয়োজন করেছি। ভীষ্ম সকলের দিকে চেয়ে দেখলেন, তার পর যুধিষ্ঠিরের হাত ধ’রে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, কুন্তীপুত্র, তুমি উপযুক্ত কালে এসেছ। আমি আটান্ন দিন এই তীক্ষা শরশয্যায় শুয়ে আছি, বোধ হচ্ছে যেন শত বর্ষ গত হয়েছে। এখন চান্দ্র মাঘ মাসের তিন ভাগ অবশিষ্ট আছে, শুক্লপক্ষ চলছে। তার পর ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, রাজা, তুমি ধর্মজ্ঞ, শাস্ত্রবিৎ বহু ব্রাহ্মণের সেবা করেছ, বেদ ও ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তুমি জান; তোমার শোক করা উচিত নয়, যা ভবিতব্য তাই ঘটেছে। পাণ্ডুর পত্রেরা ধর্মত তোমার পত্রতুল্য, তুমি ধর্মানুসারে এঁদের পালন কর। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শুদ্ধস্বভাব গুরুবৎসল ও অহিংস, ইনি তোমার আজ্ঞানুবর্তী হয়ে চলবেন। তোমার পুত্রেরা দুরাত্মা ক্রোধী মূঢ় ঈর্ষান্বিত ও দুর্বৃত্ত ছিল, তাদের জন্য শোক ক’রো না।
অনন্তর ভীষ্ম কৃষ্ণকে বললেন, হে দেবদেবেশ সুরাসুরবন্দিত শঙ্খচক্রগদাধর ত্রিবিক্রম ভগবান, তোমাকে নমস্কার। তুমি সনাতন পরমাত্মা, আমি তোমার একান্ত ভক্ত; পুরুষোত্তম, তুমি আমাকে ত্রাণ কর, তোমার অনুগত পাণ্ডবগণকে রক্ষা কর। আমি দুর্বদ্ধি দুর্যোধনকে বলেছিলাম—
যতঃ কৃষ্ণস্ততো ধর্মো যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ।
— যে পক্ষে কৃষ্ণ সেই পক্ষে ধর্ম, যেখানে ধর্ম সেখানে জয়॥ আমি বার বার তাকে সন্ধি করতে বলেছিলাম, কিন্তু সেই মূঢ় আমার কথা শোনে নি, পৃথিবীর সমস্ত রাজাকে নিহত করিয়ে নিজে নিহত হয়েছে। কৃষ্ণ, এখন আমি কলেবর ত্যাগ করব, তুমি আজ্ঞা কর যেন আমি পরমগতি পাই।
কৃষ্ণ বললেন, ভীষ্ম, আমি আজ্ঞা দিচ্ছি আপনি বসুগণের লোকে যান রাজর্ষি, আপনি নিষ্পাপ, পিতৃভক্ত, দ্বিতীয় মার্কণ্ডেয় তুল্য; মৃত্যু ভৃত্যের ন্যায় আপনার বশবর্তী হয়ে আছে। তার পর ভীষ্ম সকলকে সম্ভাষণ ও আলিঙ্গন ক’রে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, ব্রাহ্মণগণ—বিশেষত আচার্য ও ঋত্বিগ্গণ, তোমার পূজনীয়।
শান্তনুপুত্র ভীষ্ম সমবেত কুরগণকে এইরূপ বলে নীরব হলেন, তার পর যথাক্রমে মূলাধারাদিতে তাঁর চিত্ত নিবেশিত করলেন। তাঁর প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হয়ে যেমন ঊর্ধ্বগামী হ’তে লাগল সেই সঙ্গে তাঁর শরীর ক্রমশ বাণমুক্ত ও ব্যথাহীন হ’ল। তার পর তাঁর প্রাণ ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ ক’রে মহা উল্কার ন্যায় আকাশে উঠে অন্তর্হিত হ’ল। পুষ্পবৃষ্টি ও দেবদুন্দুভির ধ্বনি হতে লাগল, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ সাধু সাধু বলতে লাগলেন। ভীষ্ম এইরূপে স্বর্গারোহণ করলে পাণ্ডবগণ বিদুর ও যুযুৎসু চিতা রচনা করলেন, যুধিষ্ঠির ও বিদুর তাঁকে ক্ষৌম বস্ত্র পরিয়ে দিলেন, যুযুৎসু তাঁর উপরে ছত্র ধারণ করলেন, ভীমার্জুন শুভ্র চামর বীজন করতে লাগলেন, নকুল-সহদেব উষ্ণীষ পরিয়ে দিলেন, ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠির তাঁর পাদদেশে রইলেন। কৌরবনারীগণ ভীষ্মের আপাদমস্তক তালপত্র (পাখা) দিয়ে বীজন করতে লাগলেন। হোম ও সামগানের পর ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি ভীষ্মের দেহ চন্দনকাষ্ঠ অগুরু প্রভৃতি দ্বারা আচ্ছাদিত ক’রে অগ্নিদান করলেন। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শেষ হ’লে সকলে ভাগীরথীতীরে গিয়ে যথাবিধি তর্পণ করলেন।
সেই সময়ে দেবী ভাগীরথী জল থেকে উঠে সরোদনে বললেন, কৌরবগণ, আমার পুত্র রাজোচিত গুণসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ও মহাকুলজাত ছিলেন; পরশুরামের নিকট যিনি পরাজিত হন নি, তিনি শিখণ্ডীর দিব্য অস্ত্রে নিহত হয়েছেন। আমার হৃদয় লৌহময়, তাই প্রিয়পুত্রের মরণে বিদীর্ণ হয় নি। ভাগীরথীর এইরূপ বিলাপ শুনে কৃষ্ণ বললেন, দেবী, শোক ত্যাগ কর, তোমার পুত্র পরমলোকে গেছেন। শিখণ্ডী তাঁকে বধ করেন নি, তিনি ক্ষত্রধর্মানসারে যুদ্ধ করে অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে বসুলোকে গেছেন।
- ↑ সভাপর্ব ৬-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
- ↑ উগ্রসেনের পিতা, অথবা উগ্রসেন।
- ↑ যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের সঙ্গে এই উপাখ্যানের কি সম্বন্ধ তা স্পষ্ট নয়। বোধ হয় প্রতিপাদ্য এই, যে প্রজাপতিবিহিত সন্তানোৎপাদনের জন্যই সহধর্মিণীর প্রয়োজন।
- ↑ ১৬-পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে বয়স্থা কন্যাকেই বিবাহ করা বিজ্ঞ লোকের উচিত।
- ↑ ৫.০ ৫.১ আদিপর্ব ৩১- এবং বনপর্ব ২৫-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
- ↑ শলই, লবান বা শিলারস জাতীয়।