মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আশ্বমেধিকপর্ব/আশ্বমেধিকপর্বাধ্যায়
আশ্বমেধিকপর্ব
॥ আশ্বমেধিকপর্বাধ্যায়॥
১। যুধিষ্ঠিরের পুনর্বার মনস্তাপ
ভীষ্মের উদ্দেশে তর্পণের পর ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী ক’রে যুধিষ্ঠির গঙ্গার তীরে উঠলেন এবং ব্যাকুল হয়ে অশ্রুপূর্ণনয়নে ভূপতিত হলেন। ভীম তাঁকে তুলে ধরলে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, এমন করবেন না। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, ওঠ, তোমার কর্তব্য পালন কর; তুমি ক্ষত্রধর্মানুসারে পৃথিবী জয় করেছ, এখন ভ্রাতা ও সুহৃদ্বর্গের সঙ্গে ভোগ কর। তোমার শোকের কারণ নেই, গান্ধারী ও আমারই শোক করা উচিত, আমাদের শতপুত্র স্বপ্নলব্ধ ধনের ন্যায় বিনষ্ট হয়েছে। দিব্যদর্শী বিদুর আমাকে বলেছিলেন—মহারাজ, দুর্যোধনের অপরাধে আপনার কুলক্ষয় হবে: তাকে ত্যাগ করুন, কর্ণ আর শকুনির সঙ্গে তাকে মিশতে দেবেন না, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন; আর তা যদি ইচ্ছা না করেন তবে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করুন। দীর্ঘদর্শী বিদুরের এই উপদেশ আমি শুনি নি সেজন্যই শোকসাগরে নিমগ্ন হয়েছি। এখন তুমি এই দুঃখার্ত বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি দৃষ্টিপাত কর।
যুধিষ্ঠির নীরব হয়ে আছেন দেখে কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, মহারাজ, অত্যন্ত শোক করলে পরলোকগত আত্মীয়গণ সন্তপ্ত হন। আপনি এখন প্রকৃতিস্থ হয়ে বিবিধ যজ্ঞ করুন, দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত করুন, অন্নাদি দান ক’রে অতিথি ও দরিদ্রগণকে তুষ্ট করুন। যাঁরা যুদ্ধে মরেছেন তাঁদের আর আপনি দেখতে পাবেন না, অতএব শোক করা বৃথা। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, গোবিন্দ, আমার উপর তোমার প্রীতি ও অনুকম্পা আছে তা জানি; তুমি সন্তুষ্টচিত্তে আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও, পিতামহ ভীষ্ম ও পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণের মৃত্যুর জন্য আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
ব্যাসদেব বললেন, বৎস, তোমার বুদ্ধি পরিপক্ক নয়, তাই বালকের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছ, আমরা বার বার বৃথাই তোমাকে প্রবোধ দিয়েছি। তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম জান, মোক্ষধর্ম রাজধর্ম দানধর্ম এবং প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে উপদেশও সবিস্তারে শুনেছ; তথাপি তোমার সংশয় দূর হয় নি, তাতে মনে হয় আমাদের উপদেশে তোমার শ্রদ্ধা নেই, তোমার স্মরণশক্তিও নেই। সর্বধর্মের তত্ত্ব জেনেও কেন তুমি অজ্ঞের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছ? যদি নিজেকে পাপী মনে কর তবে আমি পাপনাশের উপায় বলছি শোন। তপস্যা যজ্ঞ ও দান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়, অতএব তুমি দশরথপুত্র রাম এবং তোমার পূর্ব পুরুষ দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরতের ন্যায় অশ্বমেধ যজ্ঞ ক’রে প্রচুর দান কর।
যুধিষ্ঠির বললেন, দ্বিজোত্তম, অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজারা নিশ্চয় পাপমুক্ত হন; কিন্তু আমার এমন বিত্ত নেই যা দান ক’রে জ্ঞাতিবধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি। এখন যে অল্পবয়স্ক নির্ধন রাজারা আছেন তাঁদের কাছেও আমি কিছু চাইতে পারব না। ব্যাসদেব ক্ষণকাল চিন্তা ক’রে বললেন, কুন্তীপুত্র, তোমার শূন্য কোষ আবার পূর্ণ হবে। মরুত্ত রাজা তাঁর যজ্ঞে যে বিপুল ধন ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন তা হিমালয় পর্বতে রয়েছে; সেই ধন নিয়ে এস। যুধিষ্ঠির বললেন, মরুত্ত রাজার যজ্ঞে কি ক’রে ধন সঞ্চিত হয়েছিল? তিনি কোন্ সময়ে বর্তমান ছিলেন?
২। মরুত্ত ও সংবর্ত
ব্যাসদেব বললেন, সত্যযুগে মনু দণ্ডধর রাজা ছিলেন, তাঁর প্রপৌত্র ইক্ষাকু। ইক্ষাকুর শত পুত্র হয়েছিল, সকলকেই তিনি রাজপদে অভিষিক্ত করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র বিংশের পৌত্র খনীনেত্র সকলকে উৎপীড়িত করতেন সেজন্য প্রজারা তাঁকে অপসারিত ক’রে তাঁর পুত্র সুবর্চাকে রাজা করেছিল। সুবর্চা পরম ধার্মিক ও প্রজারঞ্জক ছিলেন, কিন্তু কালক্রমে তাঁর কোষ ও অশ্বগজাদি ক্ষয় পাওয়ায় সামন্তরাজগণ তাঁকে নির্যাতিত করতে লাগলেন। তখন তিনি তাঁর হস্তে ফুৎকার দিয়ে সৈন্যদল সৃষ্টি ক’রে বিপক্ষ রাজগণকে পরাস্ত করলেন। এই কারণে তিনি করন্ধম[১] নামে খ্যাত হন। ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে তাঁর অবিক্ষিৎ নামে একটি সর্বগুণান্বিত পুত্র হয়েছিল। অবিক্ষিতের পুত্র মহাবলশালী দ্বিতীয় বিষ্ণু স্বরূপ রাজচক্রবর্তী মরুত্ত। ধর্মাত্মা মরুত্ত হিমালয়ের উত্তরস্থ মেরু পর্বতে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাঁর আজ্ঞায় স্বর্ণকারগণ স্বর্ণময় কুণ্ড পাত্র স্থালী ও আসন এত প্রস্তুত করেছিল যে তার সংখ্যা হয় না।
বৃহস্পতি ও সংবর্ত দুজনেই মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র, কিন্তু তাঁরা পৃথক থাকতেন এবং পরস্পর স্পর্ধা করতেন। বৃহস্পতির উৎপীড়নে সংবর্ত সর্বস্ব ত্যাগ করে দিগম্বর হয়ে বনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এই সময়ে অসুরবিজয়ী ইন্দ্র বৃহস্পতিকে নিজের পুরোহিত করলেন। মহর্ষি অঙ্গিরা করন্ধমের কুলপুরোহিত ছিলেন। করন্ধমের পৌত্র মহারাজ মরুত্তের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ইন্দ্র বৃহস্পতিকে বললেন, আমি ত্রিলোকের অধীশ্বর, আর মরুত্ত কেবল পৃথিবীর রাজা; আপনি আমাদের দুজনের পৌরোহিত্য করতে পাবেন না। বৃহস্পতি বললেন, দেবরাজ, আশ্বস্ত হও, আমি প্রতিজ্ঞা করছি মর্ত্যবাসী মরুত্তের পৌরোহিত্য করব না।
মরুত্ত তাঁর যজ্ঞের আয়োজন ক’রে বৃহস্পতির কাছে এসে বললেন, ভগবান, আপনি পূর্বে আমাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তদনুসারে আমি ষজ্ঞের সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছি; আমি আপনার যজমান, আপনি আমার যজ্ঞ সম্পাদন করুন। বৃহস্পতি বললেন, মহারাজ, আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে মনুষ্যের যাজন করব না, অতএব তুমি অন্য কাকেও পৌরোহিত্যে বরণ কর। মরুত্ত লজ্জিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে গেলেন এবং পথে দেবর্ষি নারদকে দেখতে পেলেন। নারদ তাঁকে বললেন, মহারাজ, অঙ্গিরার কনিষ্ঠ পত্র ধর্মাত্মা সংবর্ত দিগম্বর হয়ে উম্মত্তের ন্যায় বিচরণ করছেন, মহেশ্বরের দর্শন কামনায় তিনি এখন বারাণসীতে আছেন। তুমি সেই পুরীর দ্বারদেশে একটি মৃতদেহ রাখ; সংবর্ত সেই মৃতদেহ দেখে যেখানেই যান তুমি তাঁর অনুগমন করবে এবং কোনও নির্জন স্থানে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁর শরণ নেবে। তিনি জিজ্ঞাসা করলে বলবে—নারদ আপনার সন্ধান বলেছেন। যদি তিনি আমাকে অন্বেষণ করতে চান তবে বলবে যে নারদ অগ্নিপ্রবেশ করেছেন।
নারদের উপদেশ অনুসারে মরুত্ত বারাণসীতে গেলেন এবং পুরীর দ্বারদেশে একটি শব রাখলেন। সেই সময়ে সংবর্ত সেখানে এলেন এবং শব দেখেই ফিরলেন। মরুত্ত কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁর অনুসরণ ক’রে এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। রাজাকে দেখে সংবর্ত তাঁর গাত্রে ধূলি কর্দম শ্লেষ্মা ও নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করতে লাগলেন, তথাপি রাজা নিরস্ত হলেন না। পরিশেষে সংবর্ত বললেন, সত্য বল কে তোমাকে আমার সন্ধান দিয়েছে। মরুত্ত বললেন, আপনি আমার গুরুপত্র, আমি আপনার পরম ভক্ত; দেবর্ষি নারদ আপনার সন্ধান দিয়েছেন। সংবর্ত বললেন, নারদ জানেন যে আমি যাজ্ঞিক; তিনি এখন কোথায়? মরুত্ত বললেন, তিনি অগ্নিপ্রবেশ করেছেন। সংবর্ত তুষ্ট হয়ে বললেন, আমি তোমার যজ্ঞ করতে পারি। তার পর তিনি কঠোর বাক্যে ভর্ৎসনা ক’রে বললেন, আমি বায়ুরোগগ্রস্ত বিকৃতবেশধারী অস্থিরমতি; আমাকে দিয়ে যজ্ঞ করাতে চাও কেন? আমার অগ্রজ বৃহস্পতির কাছে যাও, তিনি আমার সমস্ত যজমান দেবতা ও গৃহস্থিত সামগ্রী নিয়েছেন, এখন আমার শরীর ভিন্ন নিজের কিছু নেই। তিনি আমার পূজনীয়, তাঁর অনুমতি বিনা আমি তোমার যজ্ঞ করতে পারব না।
মরুত্ত জানালেন যে বৃহস্পতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তখন সংবর্ত বললেন, আমি তোমার যজ্ঞ সম্পাদন করব, কিন্তু তাতে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি তোমার উপর ক্রুদ্ধ হবেন। তুমি প্রতিজ্ঞা কর যে আমাকে পরিত্যাগ করবে না। মরুত্ত শপথ করলে সংবর্ত বললেন, হিমালয়ের পৃষ্ঠে মুঞ্জবান নামে একটি পর্বত আছে, শূলপাণি মহেশ্বর উমার সহিত সেখানে বিহার করেন; রুদ্র সাধ্য প্রভৃতি গণদেব এবং ভূত পিশাচ গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষসাদি তাঁকে উপাসনা করেন। সেই পর্বতের চতুষ্পার্শ্বে সূর্যরশ্মির ন্যায় দীপ্যমান সুবর্ণের আকর আছে। তুমি সেখানে গিয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হও, তিনি প্রসন্ন হ’লে তুমি সেই সুবর্ণ লাভ করবে।
সংবর্তের উপদেশ অনুসারে মরুত্ত মুঞ্জবান পর্বতে গেলেন এবং মহাদেবকে তুষ্ট ক’রে সেই সুবর্ণরাশি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। তাঁর আদেশে শিল্পিগণ বহু সুবর্ণময় আধার নির্মাণ করলে। মরুত্তের সমৃদ্ধির সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতি সন্তপ্ত হলেন, তাঁর শরীর কৃশ ও বিবর্ণ হ’তে লাগল। তিনি ইন্দ্রকে বললেন, যে উপায়ে হ’ক সংবর্ত ও মরুত্তকে দমন কর। ইন্দ্রের আদেশে বৃহস্পতিকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞস্থলে এসে মরুত্তকে বললেন, মহারাজ, ইন্দ্র তোমার প্রতি তুষ্ট হয়েছেন, তাঁর আদেশে আমি বৃহস্পতিকে এনেছি, ইনিই যজ্ঞ সম্পাদন ক’রে তোমাকে অমরত্ব দেবেন। মরুত্ত বললেন, সংবর্তই আমার যাজন করবেন; আমি কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করছি, বৃহস্পতি দেবরাজের পুরোহিত, আমার ন্যায় মানুষের যাজন করা তাঁর শোভা পায় না। অগ্নি মরুত্তকে প্রলোভিত করবার বহু চেষ্টা করলেন; তখন সংবর্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অগ্নি, তুমি চ’লে যাও, আবার যদি বৃহস্পতিকে নিয়ে এখানে আস তবে তোমাকে ভস্ম করব।
অগ্নি ফিরে এলে ইন্দ্র তাঁর কথা শুনে বললেন, তুমিই তো সকলকে দগ্ধ কর, তোমাকে সংবর্ত কি ক’রে ভস্ম করবেন? তোমার কথা অশ্রদ্ধেয়। তার পর ইন্দ্র গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে মরুত্তের কাছে পাঠালেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজের পরিচয় দিয়ে মরুত্তকে বললেন, মহারাজ, তুমি যদি বৃহস্পতিকে পরোহিত না কর তবে ইন্দ্র তোমাকে বজ্রপ্রহার করবেন; ওই শোন, তিনি আকাশে সিংহনাদ করছেন। সংবর্ত মরুত্তকে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমি সংস্তম্ভনী বিদ্যা দ্বারা তোমার ভয় নিবারণ করব। এই ব’লে সংবর্ত মন্ত্রপাঠ ক’রে ইন্দ্রাদি দেবগণকে আহ্বান করলেন।
অনন্তর ইন্দ্র প্রভৃতি যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন, মরুত্ত ও সংবর্ত তাঁদের যথোচিত সংবর্ধনা করলেন। মরুত্ত বললেন, দেবরাজ, আপনাকে নমস্কার করছি, আপনার আগমনে আমার জীবন সফল হ’ল। ইন্দ্র বললেন, মহারাজ, তোমার গুরু মহাতেজা সংবর্তকে আমি জানি, এঁর আহ্বানেই আমি ক্রোধ ত্যাগ ক’রে এখানে এসেছি। সংবর্ত বললেন, দেবরাজ, যদি প্রীত হয়ে থাকেন তবে আপনিই এই যজ্ঞের বিধান দিন এবং যজ্ঞভাগ নির্দেশ করুন। তখন ইন্দ্রের আদেশে দেবগণ অতি বিচিত্র ও সমৃদ্ধ যজ্ঞশালা নির্মাণ করলেন; মহাসমারোহে মরুত্তের যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হ’ল। ইন্দ্র বললেন, মরুত্ত, আমরা তোমার পূজায় তুষ্ট হয়েছি; এখন ব্রাহ্মণগণ অগ্নির জন্য লোহিতবর্ণ, বিশ্বদেবগণের জন্য বিবিধবর্ণ, এবং অন্যান্য দেবগণের জন্য উচ্ছিশ্ন (উৎ-শিশ্ন) নীলবর্ণ (কৃষ্ণবর্ণ) পবিত্র বৃষ বধ করুন। যজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে মরুত্ত ব্রাহ্মণগণকে রাশি রাশি সুবর্ণ দান করলেন। তার পর তিনি প্রভূত বিত্ত কোষমধ্যে রক্ষা ক’রে গুরুর আদেশে স্বভবনে ফিরে এলেন এবং সসাগরা পৃথিবী শাসন করতে লাগলেন।
এই ইতিহাস শেষ করে ব্যাস বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি মরুত্তের সঞ্চিত সুবর্ণরাশি নিয়ে এসে যজ্ঞ ক’রে দেবগণকে তৃপ্ত কর।
৩। কামগীতা
কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, সর্বপ্রকার কুটিলতাই মৃত্যুজনক এবং সরলতাই ব্রহ্মলাভের পন্থা;—জ্ঞাতব্য বিষয় শুধু এই, অন্য আলোচনা প্রলাপ মাত্র। মহারাজ, আপনার কার্য শেষ হয় নি, সকল শত্রুকেও আপনি জয় করেন নি, কারণ নিজের অভ্যন্তরস্থ অহংবুদ্ধি রূপ শত্রুকে আপনি জানতে পারছেন না। বোধ হয় দুঃখাদির দ্বারা আকৃষ্ট হওয়াই আপনার স্বভাব। আপনি যেসকল কষ্ট ভোগ করছেন তা স্মরণ না ক’রে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। এই যুদ্ধ একাকী করতে হয়, এতে অস্ত্র অনুচর বা বন্ধুর প্রয়োজন নেই। যদি নিজের মনকে জয় করতে না পারেন তবে আপনার অতি দুরবস্থা হবে। অতএব আপনি শোক ত্যাগ ক’রে পিতৃপিতামহের অনুবর্তী হয়ে রাজ্যশাসন করুন। আমি পুরাবিৎ পণ্ডিতগণের কথিত কামগীতা বলছি শুনুন।—
কামনা বলেছেন, অনুপযুক্ত উপায়ে কেউ আমাকে বিনষ্ট করতে পারে না; যে অস্ত্র দ্বারা লোকে আমাকে জয় করতে চেষ্টা করে সেই অস্ত্রই আমার প্রভাবে বিফল হয়। যজ্ঞ দ্বারা যে আমাকে জয় করতে চায় তার মনে আমি জঙ্গমস্থ ব্যক্ত জীবাত্মা রূপে প্রকাশ পাই। বেদ-বেদাঙ্গ সাধন ক’রে যে আমাকে জয় করতে চায় তার মনে স্থাবরস্থ অব্যক্ত জীবাত্মা রূপে আমি অধিষ্ঠান করি। ধৈর্য দ্বারা যে আমাকে পরাস্ত করতে চায় তার মনে আমি ভাব রূপে অবস্থান করি, সে আমার অস্তিত্ব জানতে পারে না। যে তপস্যা করে, তার মনে আমি তপ রূপেই থাকি। যে মোক্ষমার্গ অবলম্বন করে তাকে উদ্দেশ ক’রে আমি হাস্য ও নৃত্য করি। আমি সনাতন এবং সর্বপ্রাণীর অবধ্য।
তার পর কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনি শোক সংবরণ করুন, নিহত বন্ধুগণকে বার বার স্মরণ ক’রে বৃথা দুঃখভোগ করবেন না; কামনা ত্যাগ করে বিবিধদক্ষিণাযুক্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, তার ফলে ইহলোকে কীর্তি এবং পরলোকে উত্তম গতি লাভ করবেন।
কৃষ্ণ ব্যাস দেবস্থান নারদ প্রভৃতির উপদেশ শুনে যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হ’ল। তিনি বললেন, আমি মরুত্তের সুবর্ণ রাশি সংগ্রহ ক’রে অশ্বমেধ যজ্ঞ করব। আপনাদের বাক্যে আমি আশ্বাসিত হয়েছি, ভাগ্যহীন পুরুষ আপনাদের ন্যায় উপদেষ্টা লাভ করতে পারে না।
- ↑ যিনি হাতে ফুঁ দেন।