মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আশ্বমেধিকপর্ব/অনুগীতাপর্বাধ্যায়

॥ অনুগীতাপর্বাধ্যায়॥

৪। অনুগীতা

 একদা এক রমণীয় স্থানে বিচরণ করতে করতে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, কেশব, সংগ্রামের সময় আমি তোমার মাহাত্ম্য জেনেছিলাম, তোমার দিব্য রূপ ও ঐশ্বর্যও দেখেছিলাম। তুমি সুহৃদ্‌ভাবে আমাকে পূর্বে যে সকল উপদেশ দিয়েছিলে আমি বুদ্ধির দোষে তা ভুলে গেছি। তুমি শীঘ্রই দ্বারকায় ফিরে যাবে, সেজন্য এখন আবার সেই উপদেশ শুনতে ইচ্ছা করি। অর্জুনকে আলিঙ্গন ক’রে কৃষ্ণ বললেন, আমি তোমাকে নিগূঢ় সনাতন ধর্মতত্ত্ব এবং শাশ্বত লোক সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু বুদ্ধির দোষে তুমি তা গ্রহণ করতে পার নি, এতে আমি দুঃখিত হয়েছি। আমি যোগযুক্ত হয়ে পূর্বে যে ব্রহ্মতত্ত্ব বিবৃত করেছিলাম এখন আর তা বলতে পারব না। যাই হক, এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণ ধর্মাত্মা কশ্যপকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই আমি বলছি শোন।—

 মানুষ পণ্যেকর্মের ফলে উত্তম গতি পায় এবং দেবলোকে সুখভোগ করে, কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। অতি কষ্টে উত্তম লোক লাভ হ’লেও তা থেকে বার বার পতন হয়। দেহধারী জীব বিপরীত বুদ্ধির বশে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়; সে অতিভোজন করে বা অনাহারে থাকে, পরস্পরবিরোধী বস্তু ভোজন ও পান করে, ভুক্ত খাদ্য জীর্ণ না হতেই আবার খায়, দিবসে নিদ্রা যায়, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা স্ত্রীসংসর্গের ফলে দুর্বল হয়। এইরূপে সে বায়ুপিত্তাদি প্রকোপিত করে এবং পরিশেষে প্রাণান্তকর রোগের কবলে পড়ে। কেউ কেউ উদ্‌বন্ধনাদির দ্বারা আত্মহত্যা করে।

 দেহত্যাগের সময় শরীরস্থ উষ্মা বায়ু দ্বারা প্রকোপিত হয়ে মর্মস্থান ভেদ করে, তখন জীবাত্মা বেদনাগ্রস্ত হয়ে দেহ থেকে নির্গত হন। সকল জীবই বার বার জন্মমৃত্যু ভোগ করে; মৃত্যুকালে যেমন জন্মকালেও তেমন ক্লেশ পায়। সনাতন জীবাত্মাই দেহের মধ্যে থেকে সকল কার্য সম্পাদন করেন। মৃত্যু হ’লেও তাঁর কৃত কর্মসকল তাঁকে ত্যাগ করে না, সেই কর্মবন্ধনের ফলে জীবের আবার জন্ম হয়। চক্ষুষ্মান লোকে দেখে অন্ধকারে খদ্যোত কখনও প্রকাশিত হচ্ছে কখনও লীন হচ্ছে, সেইরূপ সিদ্ধ পুরুষ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা জীবের জন্ম মরণ ও পুনর্বার গর্ভপ্রবেশ দেখতে পান। সংসার রূপ কর্মভূমিতে শুভাশুভ কর্ম ক’রে কেউ এখানেই ফলভোগ করে, কেউ পুণ্যবলে স্বর্গে যায়, কেউ অসৎ কর্মের ফলে নরকে পতিত হয়; সেই নরক থেকে মুক্তিলাভ অতি দুরূহ। মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা চন্দ্র সূর্যে অথবা নক্ষত্রলোকে যান, কর্মক্ষয় হ’লে আবার তাঁরা মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন; এইরূপ যাতায়াত বার বার ঘটে। স্বর্গেও উচ্চ মধ্যম ও নীচ স্থান আছে।

 শুক্র ও শোণিত সংযুক্ত হয়ে স্ত্রীজাতির গর্ভাশয়ে প্রবেশ ক’রে জীবের কর্মানুসারে দেহে পরিণত হয়। দেহের অধিষ্ঠাতা জীবাত্মা অতি সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য, ইনি কোনও বিষয়ে লিপ্ত হন না। ইনিই শাশ্বত ব্রহ্ম এবং সর্বপ্রাণীর বীজস্বরূপ; এঁর প্রভাবেই প্রাণীরা জীবিত থাকে। বহ্নি যেমন অনুপ্রবিষ্ট হয়ে লৌহপিণ্ডকে তাপিত করে, সেইরূপ জীবাত্মা দেহকে সচেতন করেন। দীপ যেমন গৃহকে প্রকাশিত করে, সেইরূপ চেতনা শরীরকে সংবেদনশীল করে।

 যত কাল মোক্ষধর্মের উপলব্ধি না হয় তত কাল জীব জন্মজন্মান্তরে শুভাশুভ কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে তার ফলভোগ করে। দান ব্রত ব্রহ্মচর্য বেদাভ্যাস প্রশান্ততা অনুকম্পা সংযম অহিংসা, পরধনে অলোভ, মনে মনেও প্রাণিগণের অহিত না করা, পিতামাতার সেবা, গুরু দেবতা ও অতিথির পূজা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম, এবং শুভজনক কর্মের অনুষ্ঠান— সাধুদের এইসকল স্বভাবসিদ্ধ। এইরূপ সদাচারেই ধর্ম বর্ধিত হয় এবং প্রজা চিরকাল পালিত হয়। সদাচারপরায়ণ সাধু অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ, তিনি শীঘ্র মুক্তিলাভ করেন। যিনি বুঝেছেন যে সুখদুঃখ অনিত্য, শরীর অপবিত্র বস্তুর সমষ্টি, বিনাশ কর্মেরই ফল, এবং সকল সুখই দুঃখ, তিনি এই ঘোর সংসারসাগর উত্তীর্ণ হ’তে পারেন। জন্মমরণশীল রোগসংকুল প্রাণিসমূহের দেহে যিনি একই চৈতন্যময় সত্ত্ব দেখেন তিনি পরম পদের অন্বেষণ করলে সিদ্ধিলাভ করেন।

 যিনি সকলের মিত্র, সর্ব বিষয়ে সহিষ্ণু শান্ত ও জিতেন্দ্রিয়, যাঁর ভয় ক্রোধ অভিমান নেই, যিনি পবিত্রস্বভাব এবং সর্বভূতের প্রতি আত্মবৎ আচরণ করেন, জন্ম-মৃত্যু সুখ-দুঃখ লাভ-অলাভ প্রিয়-অপ্রিয় সমান জ্ঞান করেন, যিনি অপরের দ্রব্য কামনা করেন না, কাকেও অবজ্ঞা করেন না, যাঁর শত্রু-মিত্র নেই, সন্তানে আসক্তি নেই, যিনি আকাঙ্ক্ষাশূন্য এবং ধর্ম-অর্থ-কাম পরিহার করেছেন, যিনি ধার্মিক নন অধার্মিকও নন, যাঁর চিত্ত প্রশান্ত হয়েছে, তিনি আত্মাকে উপলব্ধি ক’রে মুক্তিলাভ করেন। যিনি বৈরাগ্যযুক্ত, সতত আত্মদোষদর্শী, আত্মাকে নির্গুণ অথচ গুণভোক্তা রূপে দেখেন, শারীরিক ও মানসিক সকল সংকল্প ত্যাগ করেছেন, তিনিই ইন্ধনহীন অনলের ন্যায় ক্রমশ নির্বাণ লাভ করেন। যিনি সর্বসংস্কারমুক্ত নির্দ্বন্দ্ব, এবং কিছুই নিজের বলে মনে করেন না, তিনিই সনাতন অক্ষর ব্রহ্ম লাভ করেন। তপস্যা দ্বারা ইন্দ্রিয়সকলকে বিষয় থেকে নিবৃত্ত ক’রে একান্তমনে যোগরত হ’লে হৃদয়মধ্যে পরমাত্মার দর্শন পাওয়া যায়। যেমন স্বপ্নে কিছু দেখলে জাগরণের পরেও তার জ্ঞান থাকে, সেইরূপ যোগাবস্থায় পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ করলে যোগভঙ্গের পরেও সেই উপলব্ধি থাকে।

 তার পর কৃষ্ণ বিবিধ উপাখ্যানের প্রসঙ্গে, সবিস্তারে অধ্যাত্মতত্ত্ব বিবৃত করলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ধনঞ্জয়, তোমার প্রীতির জন্য এইসকল নিগূঢ় বিষয় বললাম; তুমি আমার উপদিষ্ট ধর্ম আচরণ কর, তা হ’লে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করবে। ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি বহু কাল আমার পিতাকে দেখি নি, এখন তাঁর কাছে যেতে ইচ্ছা করি। অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এখন হস্তিনাপুরে চল, রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে তুমি দ্বারকায় যেয়ো।

৫। কৃষ্ণের দ্বারকাযাত্রা—মরুবাসী উতঙ্ক

 কৃষ্ণ দ্বারকায় যেতে চান শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, তোমার মঙ্গল হ’ক; তুমি বহু দিন পিতামাতাকে দেখ নি, এখন তাঁদের কাছে যাওয়া তোমার কর্তব্য। দ্বারবতী পুরীতে গিয়ে তুমি আমার মাতুল বসুদেব, দেবী দেবকী, এবং বলদেবকে আমাদের অভিবাদন জানিও, আমাকে ও আমার ভ্রাতৃগণকে নিত্য স্মরণে রেখো, আমার অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় আবার এখানে এসো।

 ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, পিতৃষ্বসা কুন্তী ও বিদুর প্রভৃতির নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ তাঁর ভগিনী সুভদ্রার সঙ্গে রথারোহণে যাত্রা করলেন। বিদুর ভীমার্জুনাদি ও সাত্যকি তাঁর পশ্চাতে গেলেন। কিছু দূর গিয়ে তিনি বিদুর প্রভৃতিকে নিবর্তিত ক’রে দারুক ও সাত্যকিকে বললেন, বেগে রথ চালাও। কৃষ্ণ ও অর্জুন বহুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তার পর রথ দৃষ্টিপথের বাহিরে গেলে অর্জুনাদি হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।

 কৃষ্ণের যাত্রাপথে বহু প্রকার শুভ লক্ষণ দেখা গেল। বায়ু সবেগে প্রবাহিত হয়ে রথের সম্মুখস্থ পথের ধূলি কঙ্কর ও কণ্টক দূর করলেন, ইন্দ্র সুগন্ধ বারি ও দিব্য পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন। কিছু দূর যাবার পর কৃষ্ণ মরু প্রদেশে উপস্থিত হয়ে মুনিশ্রেষ্ঠ উতঙ্কের দর্শন পেলেন। পরস্পর অভিবাদন ও কুশলজিজ্ঞাসার পর উতঙ্ক বললেন, শৌরি, তোমার যত্নে কুরু পাণ্ডবদের মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপিত হয়েছে তো? কৃষ্ণ বললেন, আমি সন্ধির জন্য বহু চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তা সফল হয় নি। বুদ্ধি বা বল দ্বারা দৈবকে অতিক্রম করা যায় না; ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সবান্ধবে যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করেছেন, কেবল পঞ্চপাণ্ডব জীবিত আছেন, তাঁদেরও পুত্রমিত্র নিহত হয়েছেন। উতঙ্ক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তুমি সমর্থ হয়েও কুরুপুংগবগণকে রক্ষা কর নি, তোমার মিথ্যাচারের জন্যই কুরুকুল বিনষ্ট হয়েছে, আমি তোমাকে শাপ দেব। বাসুদেব বললেন, আমি অনুনয় করছি, শাপ দেবেন না। অল্প তপস্যার প্রভাবে আমাকে কেউ পরাভূত করতে পারেন না। আমি জানি যে আপনি কৌমার ও ব্রহ্মচর্য পালন ক’রে তপঃসিদ্ধ হয়েছেন, গুরুকেও তুষ্ট করেছেন; আপনার তপস্যা আমি নষ্ট করতে ইচ্ছা করি না।

 তার পর কৃষ্ণ তাঁর দিব্য ঐশ্বর্য সকল বিবৃত করলেন এবং উতঙ্কের অনুরোধে বিশ্বরূপ দেখালেন। উতঙ্ক বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললেন, হে বিশ্বকর্মা বিশ্বাত্মা বিশ্বসম্ভব, তোমাকে নমস্কার করি, তুমি পদদ্বয় দ্বারা পৃথিবী, মস্তক দ্বারা গগন, জঠর দ্বারা দ্যুলোক-ভূলোকের মধ্যদেশ, এবং ভুজ দ্বারা দিকসমূহ ব্যাপ্ত ক’রে আছ; দেব, তোমার এই মহৎ রূপ সংবরণ ক’রে পূর্বরূপ ধারণ কর। কৃষ্ণ পূর্বরূপ গ্রহণ ক’রে প্রসন্ন হয়ে বললেন, মহর্ষি, আপনি অভীষ্ট বর প্রার্থনা করুন। উতঙ্ক বললেন, পুরুষোত্তম, তোমার যে রূপ দেখেছি তাই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত বর। যদি নিতান্তই বর দেওয়া কর্তব্য মনে কর তবে এই বর দাও যেন এই মরুভূমিতে ইচ্ছানুসারে জল পেতে পারি। কৃষ্ণ বললেন, জলের প্রয়োজন হ’লেই আমাকে স্মরণ করবেন। এই ব’লে কৃষ্ণ প্রস্থান করলেন।

 কিছু কাল পরে একদিন উতঙ্ক মরুভূমিতে চলতে চলতে তৃষিত হয়ে কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। তখন এক দিগম্বর মলিনদেহ চণ্ডাল তাঁর কাছে উপস্থিত হ’ল, তার সঙ্গে কুকুরের দল, হাতে খড়্‌গ ও ধনুর্বাণ; তার অধোদেশে জলস্রোত (প্রস্রাব) প্রবাহিত হচ্ছে। চণ্ডাল সহাস্যে বললে, ভৃগুবংশজাত উতঙ্ক, তুমি আমার এই জল পান কর। উতঙ্ক পিপাসার্ত হয়েও সেই জল নিলেন না, ক্রুদ্ধ হয়ে তিরস্কার করলেন। চণ্ডাল অন্তর্হিত হ’ল। তার পর শঙ্খচক্রগদাধর কৃষ্ণকে দেখে উতঙ্ক বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, ব্রাহ্মণকে চণ্ডালের প্রস্রাব দেওয়া তোমার উচিত নয়। কৃষ্ণ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনাকে অমৃত দেবার জন্য আমি ইন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, মানুষকে অমরত্ব দেওয়া অকর্তব্য; যদি উতঙ্ককে অমৃত দিতেই হয় তবে আমি চণ্ডালের রূপে দিতে যাব, যদি তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে অমৃত পাবেন না। মহর্ষি, আপনি চণ্ডালরূপী ইন্দ্রকে ফিরিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছেন। যাই হ’ক, আমি বর দিচ্ছি, আপনার পিপাসা পেলেই মেঘ উদিত হয়ে এই মরুভূমিতে জলবর্ষণ করবে, সেই মেঘ উতঙ্কমেঘ নামে খ্যাত হবে। বর পেয়ে উতঙ্ক প্রীত হয়ে সেখানে বাস করতে লাগলেন। এখনও উতঙ্কমেঘ সেই মরুভূমিতে জলবর্ষণ করে।

৬। উতঙ্কের পূর্ববৃত্তান্ত

 জনমেজয় প্রশ্ন করলেন, উতঙ্ক এমন কি তপস্যা করেছিলেন যে তিনি জগৎপ্রভু বিষ্ণুকে শাপ দিতে উদ্যত হয়েছিলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, উতঙ্ক[] অতিশয় গুরুভক্ত ও তপোনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর গুরু গৌতমও তাঁকে অন্যান্য শিষ্য অপেক্ষা অধিক স্নেহ করতেন। একদিন উতঙ্ক কাষ্ঠভার এনে ভূমিতে ফেলবার সময় দেখলেন, রৌপ্যের ন্যায় তাঁর একগাছি জটা কাষ্ঠে লগ্ন হয়ে আছে। পরিশ্রান্ত ক্ষুধাতুর উতঙ্ক তাঁর বার্ধক্যের এই লক্ষণ দেখে কাঁদতে লাগলেন। গৌতমের কন্যা দ্রুতবেগে এসে উতঙ্কের অশ্রু অঞ্জলিতে ধারণ করলেন, তাতে তাঁর হস্ত দগ্ধ হ’ল। গৌতম জিজ্ঞাসা করলেন, বৎস, তুমি শোকার্ত হ’লে কেন? উতঙ্ক বললেন, আমি শতবর্ষ আপনার প্রিয়সাধন করেছি; এতদিন আমার বার্ধক্য জানতে পারি নি, সুখভোগও করি নি। আমার চেয়ে যারা ছোট এমন শত সহস্র শিষ্য কৃতকার্য হয়ে আপনার আদেশে গৃহে ফিরে গেছে। গৌতম বললেন, তোমার শুশ্রূষায় প্রীত হয়ে আমি জানতে পারি নি যে এত দীর্ঘকাল আমার কাছে আছ; এখন আজ্ঞা দিচ্ছি তুমি গৃহে যাও।

 উতঙ্ক বললেন, ভগবান, আপনাকে গুরুদক্ষিণা কি দেব? গৌতম বললেন, তুমি আমাকে পরিতুষ্ট করেছ, তাই গুরুদক্ষিণা। তুমি যদি ষোড়শবর্ষীয় যুবা হও তবে তোমাকে আমার কন্যা দান করব, সে ভিন্ন আর কেউ তোমার তেজ ধারণ করতে পারবে না। উতঙ্ক তখনই যুবা হয়ে গুরুকন্যার পাণিগ্রহণ করলেন এবং গৌতমের আদেশ নিয়ে গুরুপত্নীকে বললেন, আপনাকে কি দক্ষিণা দেব বলুন। বার বার অনুরোধের পর অহল্যা বললেন, সৌদাস রাজার মহিষী যে দিব্য মণিময় কুণ্ডল ধারণ করেন তাই এনে দাও। উতঙ্ক কুণ্ডল আনতে গেছেন শুনে গৌতম দুঃখিত হয়ে অহল্যাকে বললেন, সৌদাস বশিষ্ঠের শাপে রাক্ষস হয়েছেন, তাঁর কাছে উতঙ্ককে পাঠানো উচিত হয় নি। অহল্যা বললেন, আমি তা জানতাম না; তোমার আশীর্বাদে উতঙ্কের কোনও অমঙ্গল হবে না।

 দীর্ঘশ্মশ্রুধারী শোণিতাক্তদেহ ঘোরদর্শন সৌদাসকে দেখে উতঙ্ক ভীত হলেন না। সৌদাস বললেন, ব্রাহ্মণ, আমি আহার অন্বেষণ করছিলাম, তুমি উপযুক্ত কালে এসেছ। উতঙ্ক বললেন, মহারাজ, আমি গুরু পত্নীর জন্য আপনার মহিষীর কুণ্ডল ভিক্ষা করতে এসেছি; আমি প্রতিজ্ঞা করছি, গুরুপত্নীকে কুণ্ডল দিয়ে আপনার কাছে ফিরে আসব। সৌদাস সম্মত হয়ে বললেন, বনমধ্যে নির্ঝরের নিকট আমার পত্নীকে দেখতে পাবে।

 সৌদাসমহিষী মদয়ন্তীর নিকট উপস্থিত হয়ে উতঙ্ক তাঁর প্রার্থনা জানালেন। মদয়ন্তী বললেন, দেবতা যক্ষ ও মহর্ষিগণ আমার কুণ্ডল হরণ করবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করেন। এই কুণ্ডল ভূমিতে রাখলে সর্পগণ, উচ্ছিষ্ট অবস্থায় ধারণ করলে যক্ষগণ, এবং নিদ্রাকালে ধারণ করলে দেবগণ অপহরণ করেন। এই কুণ্ডল সর্বদা সুবর্ণ ক্ষরণ করে, রাত্রিকালে নক্ষত্র ও তারাগণের প্রভা আকর্ষণ করে, ধারণ করলে ক্ষুধা পিপাসা এবং অগ্নি বিষ প্রভৃতির ভয় দূর হয়। ব্রাহ্মণ, তুমি মহারাজের অভিজ্ঞান নিয়ে এস তবে কুণ্ডল পাবে।

 উতঙ্ক অভিজ্ঞান চাইলে সৌদাস বললেন, তুমি মহিষীকে এই কথা ব’লো— আমার এই দুর্গতি থেকে মুক্তি পাবার অন্য উপায় নেই; তুমি তোমার কুণ্ডলদ্বয় দান কর। উতঙ্ক সৌদাসের এই বাক্য জানালে মদয়ন্তী তাঁকে কুণ্ডল দিলেন। উতঙ্ক সৌদাসের কাছে এসে বললেন, মহারাজ, মহিষী কুণ্ডল দিয়েছেন, আমি প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করব না, কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আমার মিত্রতা হয়েছে, আমাকে বধ করলে আপনার মিত্রহত্যার পাপ হবে। আপনিই বলুন, আপনার কাছে আবার আসা আমার উচিত কিনা। সৌদাস বললেন, আমার কাছে ফিরে এলে নিশ্চয তোমাকে মরতে হবে, অতএব আর এসো না।

 মৃগচর্মের উত্তরীয়ে কুণ্ডল বেঁধে উতঙ্ক দ্রুতবেগে গৌতমের আশ্রমে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে ক্ষুধিত হয়ে তিনি একটি বিল্ব বৃক্ষে উঠে ফল পাড়তে লাগলেন, সেই সময়ে কুণ্ডলসহ তাঁর উত্তরীয় ভূমিতে পড়ে গেল। ঐরাবতবংশজাত এক সর্প কুণ্ডলদ্বয় মুখে নিয়ে বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করলে। বৃক্ষ থেকে নেমে উতঙ্ক তাঁর দণ্ডকাষ্ঠ (ব্রহ্মচারীর যষ্টি) দিয়ে বল্মকি খুঁড়তে লাগলেন, কিন্তু পঁয়ত্রিশ দিন খুঁড়েও তিনি ভিতরে যাবার পথ পেলেন না। তখন ব্রাহ্মণবেশে ইন্দ্র এসে বললেন, নাগলোক এখান থেকে সহস্র যোজন, তুমি কেবল দণ্ডকাষ্ঠ দিয়ে পথ প্রস্তুত করতে পারবে না। এই বলে ইন্দ্র দণ্ডকাষ্ঠে তাঁর বজ্র সংযুক্ত করে দিলেন। তখন উতঙ্ক ভূমি বিদীর্ণ ক’রে সুবিশাল নাগলোকে উপস্থিত হলেন। তার দ্বারদেশে একটি কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব ছিল, তার পুচ্ছ শ্বেত, মুখ ও চক্ষু তাম্রবর্ণ। অশ্ব উতঙ্ককে বললে, বৎস, তুমি আমার গুহ্যদ্বারে ফুৎকার দাও: ঘৃণা করো না, আমি অগ্নি, তোমার গুরুর গুরু। উতঙ্ক ফুৎকার দিলে অশ্বের রোমকূপ থেকে ভয়ংকর ধূম নির্গত হয়ে নাগলোকে ব্যাপ্ত হ’ল। বাসুকি প্রভৃতি নাগগণ ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন এবং উতঙ্ককে পূজা ক’রে কুণ্ডল সমর্পণ করলেন। তার পর উতঙ্ক অগ্নিকে প্রদক্ষিণ ক’রে গুরুগৃহে ফিরে গেলেন এবং অহল্যাকে কুণ্ডল দিলেন।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন, মহাত্মা উতঙ্ক এই প্রকারে ত্রিলোক ভ্রমণ ক’রে কুণ্ডল এনেছিলেন; তপস্যার ফলে তাঁর অসাধারণ প্রভাব হয়েছিল।

৭। কৃষ্ণের দ্বারকায় আগমন—যুধিষ্ঠিরের সুবর্ণসংগ্রহ

 দ্বারকায় এসে কৃষ্ণ তাঁর পিতা বসুদেবকে সবিস্তারে কুরুপাণ্ডবযুদ্ধের বিবরণ দিলেন, কিন্তু দৌহিত্র অভিমন্যুর মৃত্যুসংবাদে বসুদেব অত্যন্ত কাতর হবেন এই আশঙ্কায় তা জানালেন না। সুভদ্রা বললেন, তুমি আমার পুত্রের নিধনের কথা গোপন করলে কেন? এই বলে সুভদ্রা ভূপতিত হলেন। বসুদেব শোকার্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কৃষ্ণ অভিমন্যুর মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। দৌহিত্রের আশ্চর্য বীরত্বের বিবরণ শুনে বসুদেব শোক সংবরণ ক’রে যথাবিধি শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করলেন।

 হস্তিনাপুরে পাণ্ডবগণও অভিমন্যুর জন্য কাতর হয়ে কালযাপন করছিলেন। বিরাটকন্যা উত্তরা পতির শোকে দীর্ঘকাল অনাহারে ছিলেন, তার ফলে তাঁর গর্ভস্থ সন্তান ক্ষীণ হ’তে লাগল। ব্যাসদেব উত্তরাকে বললেন, যশস্বিনী, শোক ত্যাগ কর, তোমার মহাতেজা পুত্র হবে, বাসুদেবের প্রভাবে এবং আমার বাক্য অনুসারে সে পাণ্ডবগণের পরে পৃথিবী শাসন করবে।

 তার পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য উদ্‌যোগী হলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসুকে রাজ্যরক্ষার ভার দিলেন এবং মরুত্ত রাজার সুবর্ণরাশি আনবার জন্য শুভদিনে পুরোহিত ধৌম্য ও ভ্রাতাদের সঙ্গে সসৈন্যে হিমালয়ের অভিমুখে যাত্রা করলেন। যথাস্থানে এসে যুধিষ্ঠির শিবির স্থাপনের আজ্ঞা দিলেন এবং পুষ্প মোদক পায়স মাংস প্রভৃতি উপহার দিয়ে মহেশ্বরের পূজা করলেন। যক্ষরাজ কুবের এবং তাঁর অনুচরগণের জন্যও কৃশর মাংস তিল ও অন্নাদি নিবেদিত হ’ল। তার পর যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণের অনুমতি নিয়ে ভূমি খননের আদেশ দিলেন। সুবর্ণময় ক্ষুদ্র বৃহৎ বহুবিধ ভাণ্ড ভৃঙ্গার কটাহ এবং শত সহস্র বিচিত্র আধার সেই খনি থেকে উদ্ধৃত হ’ল। তার পর যুধিষ্ঠির পুনর্বার মহাদেবের পূজা করলেন এবং বহু সহস্র উষ্ট্র অশ্ব হস্তী গর্দভ ও শকটের উপর সেই স্বর্ণরাশি বন্ধন ক’রে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। গুরুভারপীড়িত বাহনগণ দুই ক্রোশ অন্তর বিশ্রাম ক’রে চলতে লাগল!

৮। পরীক্ষিতের জন্ম

 যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের কাল আগত হ’লে কৃষ্ণ তাঁর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করলেন এবং বলরামকে অগ্রবর্তী ক’রে কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদ, ভগিনী সুভদ্রা, পুত্র প্রদ্যুম্ন চারুদেষ্ণ ও শাম্ব, এবং সাত্যকি কৃতবর্মা প্রভৃতি বীরগণের সঙ্গে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন।

 সেই সময়ে পরীক্ষিৎ নিশ্চেষ্ট শব রূপে প্রসূত হলেন। পুরবাসিগণের হর্ষধ্বনি উত্থিত হয়েই নিবৃত্ত হ’ল। কৃষ্ণ ব্যথিত হয়ে সাত্যকির সঙ্গে অন্তঃপুরে গেলেন, কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা ও অন্যান্য কুরুনারীগণ সরোদনে তাঁকে বেষ্টন করলেন। কুন্তী বললেন, বাসুদেব, তুমিই আমাদের একমাত্র গতি, এই কুরুকুল তোমারই আশ্রিত। তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র অশ্বত্থামার অস্ত্রপ্রভাবে মৃত হয়ে জন্মেছে, তুমি তাকে জীবিত ক’রে উত্তরা সুভদ্রা দ্রৌপদী ও আমাকে রক্ষা কর। এই বালক পাণ্ডবগণের প্রাণ স্বরূপ, এবং আমার পতি শ্বশুর ও অভিমন্যুর পিণ্ডদাতা। তুমি পূর্বে বলেছিলে যে একে পুনর্জীবিত করবে, এখন সেই প্রতিজ্ঞা পালন কর। অভিমন্যু উত্তরাকে বলেছিল—তোমার পুত্র আমার মাতুলগৃহে ধনুর্বেদ ও নীতিশাস্ত্র শিখবে। মধুসূদন, আমরা বিনীত হয়ে প্রার্থনা করছি, তুমি কুরুকুলের কল্যাণ কর।

 সুভদ্রা আর্তকণ্ঠে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, এই দেখ, পার্থের পৌত্রও অন্যান্য কুরুবংশীয়ের ন্যায় গতাসু হয়েছে। পাণ্ডবগণ ফিরে এসে এই সংবাদ শুনে কি বলবেন? তুমি থাকতে এই বালক যদি জীবিত না হয় তবে তোমাকে দিয়ে আমাদের কোন্ উপকার হবে? তুমি ধর্মাত্মা সত্যবাদী সত্যবিক্রম, তোমার শক্তি আমি জানি। মেঘ যেমন জলবর্ষণ ক’রে শস্যকে সঞ্জীবিত করে সেইরূপ তুমি অভিমন্যুর মৃত পুত্রকে জীবিত কর। আমি তোমার ভগিনী, পুত্রহীনা; শরণাপন্ন হয়ে বলছি, দয়া কর।

 সুভদ্রা প্রভৃতিকে আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণ সূতিকাগৃহে প্রবেশ ক’রে দেখলেন, সেই গৃহ শুভ্র পুষ্পমালায় সজ্জিত, চতুর্দিকে পূর্ণকলস রয়েছে, ঘৃত, তিন্দুক (গাব) কাষ্ঠের অঙ্গার, সর্ষপ, পরিষ্কৃত অস্ত্র, অগ্নি ও অন্যান্য রাক্ষসভয়বারক দ্রব্য যথাস্থানে রাখা আছে, বৃদ্ধা নারী ও দক্ষ ভিষগ্‌গণ উপস্থিত রয়েছেন। এইসকল দেখে কৃষ্ণ প্রীত হয়ে সাধু সাধু বললেন। তখন দ্রৌপদী উত্তরাকে বললেন, কল্যাণী, তোমার শ্বশুর অচিন্ত্যাত্মা মধুসূদন এসেছেন। উত্তরা অশ্রু সংবরণ ও দেহ আচ্ছাদন ক’রে করুণস্বরে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, দেখুন, আমি পুত্রহীনা হয়েছি, অভিমন্যুর ন্যায় আমিও নিহত হয়েছি। দ্রোণপুত্রের ব্রহ্মাস্ত্রে বিনষ্ট আমার পুত্রকে আপনি জীবিত করুন। অত্থামার অস্ত্রমোচনকালে যদি আপনারা বলতেন—এই ঈষীকা প্রসূতির প্রাণনাশ করুক, তবে ভাল হ’ত। গোবিন্দ, আমি নতশিরে প্রার্থনা করছি, এই বালককে সঞ্জীবিত করুন, নতুবা আমি প্রাণত্যাগ করব। দ্রোণপুত্র আমার সকল মনোরথ নষ্ট করেছে, আমার জীবনে কি প্রয়োজন? আমার আশা ছিল পুত্রকে কোলে নিয়ে আপনাকে প্রণাম করব, তা বিফল হ’ল। আমার চঞ্চলনয়ন স্বামী আপনার প্রিয় ছিলেন, তাঁর মৃত পুত্রকে আপনি দেখুন। এর পিতা যেমন কৃতঘ্ন ও নিষ্ঠুর এও সেইরূপ, তাই পাণ্ডবগণের সম্পদ ত্যাগ ক’রে যমসদনে গেছে।

 এইপ্রকার বিলাপ ক’রে উত্তরা মূর্ছিত হয়ে ভূপতিত হলেন, কুন্তী প্রভৃতি তাঁকে তুলে কাঁদতে লাগলেন। সংজ্ঞালাভ ক’রে উত্তরা মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে বললেন, তুমি ধর্মজ্ঞের পুত্র হয়ে বৃষ্ণিপ্রবীর কৃষ্ণকে প্রণাম করছ না কেন? তুমি তোমার পিতার কাছে গিয়ে আমার হয়ে ব’লো—বীর, কাল পূর্ণ না হ’লে কেউ মরে না, তাই আমি পতিপুত্রহীনা হয়েও জীবিত আছি। আমি ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে ঘোর বিষ খাব বা অগ্নিপ্রবেশ করব। পুত্র, ওঠ, তোমার শোকার্তা প্রপিতামহী কুন্তী এবং আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত কর; তোমার চঞ্চলনয়ন পিতার তুল্য যাঁর মুখ সেই লোকনাথ পুণ্ডরীকাক্ষ কৃষ্ণকে দেখ।

 কৃষ্ণ বললেন, উত্তরা, আমার কথা মিথ্যা হবে না: দেখ, সকলের সমক্ষেই এই বালককে পুনর্জীবিত করব। যদি আমি কখনও মিথ্যা না ব’লে থাকি, যুদ্ধে বিমুখ না হয়ে থাকি, যদি ধর্ম ও ব্রাহ্মণগণ আমার প্রিয় হন, তবে অভিমন্যুর এই পুত্র জীবনলাভ করুক। যদি অর্জুনের সহিত কদাচ আমার বিরোধ না হয়ে থাকে, যদি সত্য ও ধর্ম নিত্য আমাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, যদি কংস ও কেশীকে আমি ধর্মানুসারে বধ ক’রে থাকি, তবে এই বালক জীবিত হ’ক। বাসুদেব এইরূপ বললে শিশু ধীরে ধীরে চেতনা পেয়ে স্পন্দিত হ’তে লাগল।

 অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্থ কৃষ্ণ কর্তৃক নিবর্তিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে চ’লে গেল। তখন বালকের তেজঃপ্রভাবে সূতিকাগৃহ আলোকিত হ’ল, রাক্ষসরা পালিয়ে গেল, আকাশবাণী হ’ল— সাধু কেশব, সাধু। বালকের অঙ্গসঞ্চালন দেখে কুরুকুলের নারীগণ হৃষ্ট হলেন, ব্রাহ্মণেরা স্বস্তিবাচন করলেন, মল্ল নট দৈবজ্ঞ সূত মাগধ প্রভৃতি কৃষ্ণের স্তব করতে লাগল। উত্তরা পুত্রকে কোলে নিয়ে সহর্ষে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ বহু রত্ন উপহার দিলেন এবং ভরতবংশ পরিক্ষীণ হ’লে অভিমন্যুর এই পুত্র জন্মেছে এজন্য তার নাম রাখলেন—পরীক্ষিৎ। পরীক্ষিতের বয়স এক মাস হ’লে পাণ্ডবগণ ফিরে এলেন, তখন সুসজ্জিত হস্তিনাপুরে নানাপ্রকার উৎসব হতে লাগল।

৯। যজ্ঞাশ্বের সহিত অর্জুনের যাত্রা

 কিছুদিন পরে ব্যাসদেব হস্তিনাপুরে এলে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, ভগবান, আপনার প্রসাদে আমি যজ্ঞের জন্য ধনরত্ন সংগ্রহ করেছি, এখন আপনি যজ্ঞের অনুমতি দিন। ব্যাস বললেন, আমি অনুমতি দিলাম, তুমি অশ্বমেধ যজ্ঞ ক’রে বহু দক্ষিণা দাও, তার ফলে নিশ্চয় পাপমুক্ত হবে।

 যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, যদুনন্দন, তোমাকে জন্ম দিয়ে দেবকী সুপুত্রবতী হয়েছেন, তোমার প্রভাবে আমরা ভোগ্য বিষয় অর্জন করেছি, তোমার পরাক্রম ও বুদ্ধিতে পৃথিবী জয় করেছি। তুমি আমাদের পরম গুরু, তুমিই যজ্ঞ, তুমিই ধর্ম, তুমিই প্রজাপতি; অতএব তুমিই দীক্ষিত হয়ে আমার যজ্ঞ সম্পাদন কর। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনি কুরুবীরগণের অগ্রণী হয়ে ধর্ম পালন করছেন, আপনি আমাদের রাজা ও গুরু। অতএব আপনিই দীক্ষিত হয়ে যজ্ঞ করুন এবং আপনার অভীষ্ট কার্যে আমাদের নিয়োজিত করুন।

 যুধিষ্ঠির সম্মত হ’লে ব্যাসদেব তাঁকে বললেন, পৈল যাজ্ঞবল্ক্য ও আমি, আমরা তিন জনে যজ্ঞের সকল কর্ম সম্পাদন করব। চৈত্রপূর্ণিমায় তুমি যজ্ঞের জন্য দীক্ষিত হবে। অশ্ববিদ্যাবিশারদ সূত ও ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞীয় অশ্ব নির্বাচন করুন, তার পর সেই অশ্ব মুক্ত হয়ে তোমার যশোরাশি প্রদর্শন ক’রে সাগরাম্বরা পৃথিবী পরিভ্রমণ করুক। দিব্যধনুর্বাণধারী ধনঞ্জয় সেই অশ্বকে রক্ষ করবেন। ভীমসেন ও নকুল রাজ্যপালন এবং সহদেব কুটুম্বগণের তত্ত্বাবধান করবেন। ব্যাসের উপদেশ অনুসারে সকল ব্যবস্থা ক’রে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, মহাবাহু, কোনও রাজা যদি তোমাকে বাধা দেন তবে তুমি চেষ্টা করবে যাতে যুদ্ধ না হয়, এবং তাঁকে আমার এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করবে।

 যথাকালে যুধিষ্ঠির দীক্ষিত হয়ে স্বর্ণমালা কৃষ্ণাজিন দণ্ড ও ক্ষৌমবাস ধারণ করলেন। যজ্ঞের অশ্ব ছেড়ে দেওয়া হ’ল; অর্জুন শ্বেত অশ্বে আরোহণ ক’রে সেই কৃষ্ণসার (শ্বেতকৃষ্ণ মিশ্রিতবর্ণ) যজ্ঞাশ্বের অনুগমন করলেন। বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় বীর অর্জুনের সঙ্গে যাত্রা করলেন। সকলে বললেন, অর্জুন, তোমার মঙ্গল হ’ক, তুমি নির্বিঘ্নে ফিরে এসো।

১০। অর্জুনের নানা দেশে যুদ্ধ—বভ্রুবাহন উলূপী ও চিত্রাঙ্গদা

 ত্রিগর্তদেশের যেসকল বীর কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে হত হয়েছিলেন তাঁদের পুত্রপৌত্রগণ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাশ্ব নেবার জন্য যুদ্ধ করতে এলেন। অর্জুন বিনয়বাক্যে তাঁদের নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁরা শুনলেন না, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁরা পরাজিত হয়ে বললেন, পার্থ, আমরা সকলে আপনার কিংকর, আদেশ করুন কি করব। অর্জুন বললেন, আমি আপনাদের প্রাণরক্ষা করলাম, আপনারা আমার শাসনে থাকবেন।

 তার পর যজ্ঞীয় অশ্ব প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরে উপস্থিত হ’ল, ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্ত তাকে হরণ করতে এলেন। তিন দিন ঘোর যুদ্ধের পর বজ্রদত্ত তাঁর মহাহস্তী অর্জুনের দিকে ধাবিত করলেন। অর্জুন নারাচের আঘাতে সেই হস্তীকে বধ ক’রে বজ্রদত্তকে বললেন, মহারাজ, ভয় নেই, তোমার প্রাণ হরণ করব না। আগামী চৈত্রপূর্ণিমায় ধর্মরাজের অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে, তাঁর আদেশে আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করছি, তুমি সেই যজ্ঞে যেয়ো। পরাজিত বজ্রদত্ত সম্মত হলেন।

 অশ্ব সিন্ধুদেশে এলে সেখানকার রাজারা জয়দ্রথের নিধন স্মরণ ক’রে ক্রুদ্ধ হয়ে বিপুল সৈন্য নিয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু যুদ্ধে পরাভূত হলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা জয়দ্রথপত্নী দুঃশলা তাঁর বালক পৌত্রের সঙ্গে রথারোহণে অর্জুনের কাছে এলেন। ধনু ত্যাগ ক’রে অর্জুন বললেন, ভগিনী, আমি কি করব বল। দুঃশলা বললেন, তোমার ভাগিনেয় সুরথের এই পুত্র তোমাকে প্রণাম করছে, তুমি একে কৃপাদৃষ্টিতে দেখ। অর্জুন বললেন, এর পিতা কোথায়? দুঃশলা বললেন, তুমি যুদ্ধার্থী হয়ে এখানে এসেছ শুনে আমার পুত্র সুরথ অকস্মাৎ প্রাণত্যাগ করেছে। দুর্যোধন ও মন্দবুদ্ধি জয়দ্রথকে তুমি ভুলে যাও, তোমার ভগিনী ও তার পৌত্রের প্রতি দয়া কর। পরীক্ষিৎ যেমন অভিমন্যুর পুত্র, এই বালক তেমন সুরথের পাত্র। অর্জুন অতিশয় দুঃখিত হলেন এবং দুঃশলাকে সান্ত্বনা দিয়ে গৃহে পাঠিয়ে দিলেন।

 যজ্ঞাশ্ব বিচরণ করতে করতে মণিপরে এল। পিতা ধনঞ্জয় এসেছেন শুনে মণিপুরপতি বভ্রুবাহন ব্রাহ্মণগণকে অগ্রবর্তী ক’রে সবিনয়ে উপস্থিত হলেন। অর্জুন রুষ্ট হয়ে তাঁর পুত্রকে বললেন, তোমার আচরণ ক্ষত্রিয় ধর্মের বহির্ভূত; আমি যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাশ্বের সঙ্গে তোমার রাজ্যে এসেছি, তুমি যুদ্ধ করছ না কেন? অর্জুনের তিরস্কার শুনে নাগকন্যা উলূপী পৃথিবী ভেদ ক’রে উপস্থিত হয়ে বভ্রুবাহনকে বললেন, পুত্র, আমি তোমার মাতা (বিমাতা) উলূপী; তুমি তোমার মহাবীর পিতার সঙ্গে যুদ্ধ কর, তা হ’লেই ইনি প্রীত হবেন। তখন বভ্রুবাহন স্বর্ণময় বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ধারণ ক’রে রথে উঠলেন এবং অনুচরদের সঙ্গে গিয়ে অশ্ব হরণ করলেন। অর্জুন প্রীত হয়ে পত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তুমূল যুদ্ধের পর অর্জুন শরবিদ্ধ ও অচেতন হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেলেন। পিতার এই অবস্থা দেখে বভ্রুবাহনও মোহগ্রস্ত হয়ে ভূপতিত হলেন।

 মণিপুররাজমাতা চিত্রাঙ্গদা রণস্থলে এসে পতিপুত্রকে দেখে শোকার্ত হয়ে তাঁর সপত্নীকে বললেন, উলূপী, তোমার জন্যই আমার বালক পুত্রের হস্তে মহাবীর অর্জুন নিহত হয়েছেন। তুমি ধর্মশীলা, কিন্তু পুত্রকে দিয়ে পতিকে বিনষ্ট ক’রে তোমার অনুতাপ হচ্ছে না কেন? আমার পুত্রও মরেছে, কিন্তু আমি তার জন্য শোক না ক’রে পতির জন্যই শোকাকুল হয়েছি। আমি অনুনয় করছি, অর্জুন যদি কিছ অপরাধ ক’রে থাকেন তো ক্ষমা ক’রে এঁকে জীবিত কর। ইনি বহু ভার্যা গ্রহণ করেছেন, কিন্তু পুরুষের পক্ষে তা অপরাধ নয়। এইরূপ বিলাপ ক’রে চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের চরণ গ্রহণ ক’রে প্রায়োপবেশন করলেন।

 এই সময়ে বভ্রুবাহনের চেতনা ফিরে এল। তিনি ভূপতিত পিতা ও জননীকে দেখে শোকার্ত হয়ে বললেন, আমি নৃশংস পিতৃহন্তা, ব্রাহ্মণরা আদেশ দিন আমি কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার উচিত মৃত পিতার চর্মে আবৃত হয়ে এবং এঁর মস্তক ধারণ ক’রে দ্বাদশ বর্ষ যাপন করা। নাগকন্যা, এই দেখুন, আমি অর্জুনকে বধ ক’রে আপনার প্রিয়সাধন করেছি, এখন আমিও পিতার অনুগমন করব। এই ব’লে বভ্রুবাহন আচমন ক’রে তাঁর মাতার সহিত প্রায়োপবিষ্ট হলেন।

 তখন উলূপী সঞ্জীবন মণি স্মরণ করলেন; তৎক্ষণাৎ সেই মণি নাগলোক থেকে চ’লে এল। উলূপী তা হাতে নিয়ে বভ্রুবাহনকে বললেন, পুত্র, শোক ক’রো না, ওঠ; অর্জুন দেবগণেরও অজেয়। ইনি তোমার বল পরীক্ষার ইচ্ছায় যুদ্ধে করতে এসেছেন, তাঁর প্রীতির নিমিত্ত আমি এই মোহিনী মায়া দেখিয়েছি। এই দিব্য মণির স্পর্শে মৃত নাগগণ জীবিত হয়, তুমি পার্থের বক্ষে এই মণি রাখ। বভ্রুবাহন তাঁর পিতার বক্ষে সেই সঞ্জীবন মণি রাখলেন। তখন অর্জুন যেন দীর্ঘনিদ্রা থেকে জাগরিত হলেন এবং মস্তক আঘ্রাণ ক’রে পুত্রকে আলিঙ্গন করলেন।

 অর্জুন উলূপীকে বললেন, নাগরাজনন্দিনী, তুমি ও মণিপুরপতির মাতা চিত্রাঙ্গদা কেন এখানে এসেছ? আমার বা বভ্রুবাহনের বা তোমার সপত্নী চিত্রাঙ্গদার কোনও অপরাধ হয় নি তো? উলূপী সহাস্যে বললেন, তোমরা কেউ আমার কাছে অপরাধী নও। মহাবাহু ধনঞ্জয়, তুমি মহাভারতযুদ্ধে অধর্মাচরণ ক’রে শান্তনপুত্র ভীষ্মকে শিখণ্ডীর সাহায্যে নিপাতিত করেছিলে। আজ পুত্র কর্তৃক নিপাতিত হয়ে তুমি সেই পাপ থেকে মুক্তি পেলে। এই প্রায়শ্চিত্ত না হলে তুমি মরণের পর নরকে যেতে। ভাগীরথী ও বসুগণ তোমার পাপশান্তির এই উপায় বলেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও তোমাকে জয় করতে পারেন না; পুত্র আত্মস্বরূপ, তাই তুমি পুত্রকর্তৃক পরাজিত হয়েছ।

 অর্জুন বললেন, দেবী, তুমি উপযুক্ত কার্য করেছ। তার পর তিনি বভ্রুবাহনকে বললেন, চৈত্রপূর্ণিমায় যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন, তুমি তোমার দুই মাতা এবং অমাত্যগণের সঙ্গে সেখানে যেয়ো। বভ্রুবাহন বললেন, ধর্মজ্ঞ, আমি সেই যজ্ঞে দ্বিজগণের পরিবেশক হব। আজ রাত্রিতে আপনি দুই ভার্যার সঙ্গে আপনার এই ভবনে বিশ্রাম করুন, কাল আবার অশ্বের অনুগমন করবেন। অর্জুন বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার ভবনে যেতে পারব না; এই অশ্ব যেখানে যাবে আমাকে সেখানেই যেতে হবে। তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি আর এখানে থাকতে পারব না। এই ব’লে পুত্র ও দুই পত্নীর নিকট বিদায় নিয়ে অর্জুন প্রস্থান করলেন।


 যজ্ঞাশ্ব মগধে এলে সহদেবপুত্র (জরাসন্ধের পৌত্র) রাজা মেঘসন্ধি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন, কিন্তু পরাস্ত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন। অর্জুন তাঁকে যজ্ঞে উপস্থিত হবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। তার পর অর্জুন অশ্বের অনুসরণে সমুদ্রতীর দিয়ে বঙ্গ পুণ্ড্র কোশল প্রভৃতি দেশে গিয়ে সেখানকার ম্লেচ্ছগণকে পরাস্ত করলেন। দক্ষিণে নানা দেশে বিচরণ করে অশ্ব চেদিরাজ্যে এল। শিশুপালপুত্র শরভ পরাজয় স্বীকার করলেন। কাশী অঙ্গ কোশল কিরাত ও তঙ্গন দেশের রাজারা অর্জুনের সংবর্ধনা করলেন, এবং দশার্ণরাজ চিত্রাঙ্গদ ও নিষাদরাজ একলব্যের পুত্র যুদ্ধে পরাস্ত হলেন। অর্জুন পুনর্বার দক্ষিণ সমুদ্রের তীর দিয়ে চললেন এবং দ্রাবিড় অন্ধ্র মাহিষক ও কোল্বগিরিবাসী বীরগণকে জয় ক’রে সুরাষ্ট্র গোকর্ণ ও প্রভাস অতিক্রম ক’রে দ্বারকায় এলেন। যাদব কুমারগণ অর্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু বৃষ্ণি ও অন্ধকগণের অধিপতি উগ্রসেন এবং অর্জনের মাতুল বসুদেব তাঁদের নিবারিত ক’রে অর্জুনের সংবর্ধনা করলেন।

 তার পর পশ্চিম সমুদ্রের উপকুল এবং সমৃদ্ধ পঞ্চনদ প্রদেশ অতিক্রম ক’রে অশ্ব গান্ধার রাজ্যে এল। গান্ধারপতি শকুনিপুত্র বহু সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করতে এলেন, অর্জুনের অনুরোধেও নিবৃত্ত হলেন না। অর্জুন শরাঘাতে গান্ধারপতির শিরস্ত্রাণ বিচ্যুত করলেন। গান্ধারপতি ভীত হয়ে সসৈন্যে পলায়ন করলেন, তাঁর বহু সৈন্য অর্জুনের অস্ত্রাঘাতে বিনষ্ট হ’ল। তখন গান্ধাররাজমাতা বৃদ্ধমন্ত্রীর সঙ্গে অর্ঘ্যহস্তে অর্জুনের কাছে এসে তাঁকে প্রসন্ন করলেন। শকুনিপুত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে অর্জুন বললেন, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে স্মরণ ক’রে আমি তোমার প্রাণহরণ করি নি, কিন্তু তোমার বুদ্ধির দোষে তোমার অনুচরগণ নিহত হ’ল। তার পর অর্জুন শকুনিপুত্রকে যজ্ঞে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ ক’রে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।

১১। অশ্বমেধ যজ্ঞ

 মাঘ মাসের দ্বাদশী তিথিতে শুভনক্ষত্রযোগে যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের ডেকে এনে ভীমসেনকে বললেন, সংবাদ পেয়েছি অর্জুন শীঘ্র ফিরে আসবেন। তুমি যজ্ঞস্থান নিরূপণের জন্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের পাঠাও। যুধিষ্ঠিরের আদেশ অনুসারে স্থান নিরূপিত হ’লে স্থপতিগণ শত শত প্রাসাদ গৃহ স্তম্ভ তোরণ ও পথ সমন্বিত যজ্ঞায়তন নির্মাণ করলেন। আমন্ত্রিত নরপতিগণ বহু রত্ন স্ত্রী অশ্ব ও আয়ুধ নিয়ে উপস্থিত হলেন, তাঁদের শিবিরে সাগরগর্জনের ন্যায় কোলাহল হ’তে লাগল। যজ্ঞসভায় হেতুবাদী বাগ্মী ব্রাহ্মণগণ পরস্পরকে পরাস্ত করবার জন্য তর্ক করতে লাগলেন। আমন্ত্রিত রাজারা ইচ্ছানুসারে বিচরণ ক’রে যজ্ঞের আয়োজন দেখতে লাগলেন। স্থানে স্থানে স্বর্ণভূষিত যূপকাষ্ঠ, স্থলচর জলচর পার্বত ও আরণ্য বিবিধ পশু পক্ষী ও উদ্ভিদ, অন্নের স্তূপ, দধি ও ঘৃতের হ্রদ প্রভৃতি দেখে তাঁরা বিস্মিত হলেন। এক এক লক্ষ ব্রাহ্মণভোজনের পর দুন্দুভি বাজতে লাগল; প্রতিদিন এইরূপে বহু বার দন্দুভিধ্বনি শোনা গেল।

 কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, দ্বারকাবাসী একজন দূত দ্বারা অর্জুন আমাকে এই কথা ব’লে পাঠিয়েছেন।—কৃষ্ণ, তুমি রাজা যষ্ঠিরকে ব’লো যেন সমাগত রাজগণের সমুচিত সৎকার হয়, এবং অর্ঘ্যদানকালে এমন কিছু না করা হয় যাতে রাজাদের বিদ্বেষের ফলে প্রজানাশ হ’তে পারে[]। যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তোমার কথা শুনে আমি আনন্দিত হয়েছি। আমি শুনেছি অর্জুন যেখানে গেছেন সেখানেই রাজাদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছে। তিনি সর্বদাই দুঃখভোগ করেন, কিন্তু আমি তাঁর দেহে কোনও অনিষ্টসূচক লক্ষণ দেখি নি। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, পুরুষসিংহ ধনঞ্জয়ের পিণ্ডিকা (পায়ের গুলি) অধিক স্থূল; এই লক্ষণের ফলে তাঁকে সর্বদা ভ্রমণ করতে হয়; এ ভিন্ন তাঁর দেহে অশুভসূচক আর কিছু আমি দেখি না। যুধিষ্ঠির বললেন, তোমার কথা ঠিক। দ্রৌপদী কৃষ্ণের দিকে অসূয়াসূচক[] বক্র দৃষ্টিপাত করলেন, কৃষ্ণও সস্নেহে তাঁর সখীর দিকে ফিরে চাইলেন। ভীমসেন প্রভৃতি সকৌতুকে অর্জুনের ওই কথা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

 পরদিন অর্জুন যজ্ঞাশ্বসহ হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে অভিবাদন ক’রে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন। এই সময়ে মণিপুররাজ বভ্রুবাহনও তাঁর মাতৃদ্বয়ের সহিত উপস্থিত হলেন এবং অর্জুনকে বন্দনার পর পিতামহী কুন্তীর উত্তম ভবনে গেলেন। চিত্রাঙ্গদা ও উলূপী বিনীতভাবে কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা প্রভৃতির সহিত মিলিত হলেন। বভ্রুবাহনকে কৃষ্ণ দিব্যাশ্বযুক্ত স্বর্ণভূষিত মহামূল্য রথ উপহার দিলেন; যুধিষ্ঠিরাদিও তাঁকে বিপুল অর্থ দিলেন।

 তৃতীয় দিবসে ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যজ্ঞের মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে, আজ থেকে তুমি যজ্ঞ আরম্ভ কর। মহারাজ, এই যজ্ঞে তুমি ব্রাহ্মণগণকে তিন গুণ দক্ষিণা দাও, তাতে তিন অশ্বমেধের ফল পাবে এবং জ্ঞাতিবধের পাপ থেকে মুক্ত হবে। অনন্তর বেদজ্ঞ যাজকগণ যথাবিধি সকল কার্য করতে লাগলেন। বিল্ব খদির পলাশ এই তিন প্রকার কাষ্ঠের প্রত্যেকের ছয়, দেবদারুর দুই, এবং শ্লেষ্মাতক[] কাষ্ঠের একটি যূপ নির্মিত হ’ল। তা ছাড়া ধর্মরাজের আদেশে ভীম স্বর্ণভূষিত বহু যূপ শোভার জন্য প্রস্তুত করালেন। চারটি অগ্নিস্থান যুক্ত আঠার হাত যজ্ঞবেদী ত্রিকোণ গরুড়াকারে নির্মিত হ’ল। ঋত্বিগ্‌গণ নানা দেবতার উদ্দেশে বহু পশু পক্ষী বৃষ ও জলচর আহরণ করলেন। তিন শত পশুর সঙ্গে যজ্ঞীর অশ্বও যূপবদ্ধ হ’ল।

 অগ্নিতে অন্যান্য পশু যথাবিধি উৎসর্গের পর ব্রাহ্মণগণ শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞীয় অশ্ব বধ ক’রে দ্রুপদনন্দিনীকে তার নিকটে বসালেন। তার পর তাঁরা অশ্বের বসা অগ্নিতে দিলেন, যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা সেই সর্বপাপনাশক বসার ধূম আঘ্রাণ করলেন। ষোল জন ঋত্বিক অশ্বের অঙ্গসকল অগ্নিতে আহতি দিলেন। এইরূপে যজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে সশিষ্য ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরের সংবর্ধনা করলেন। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে সহস্র কোটি নিষ্ক এবং ব্যাসদেবকে বসুন্ধরা দক্ষিণা দিলেন। ব্যাস বললেন, মহারাজ, ব্রাহ্মণেরা ধনার্থী, তুমি বসুন্ধরার পরিবর্তে আমাকে ধন দাও। যুধিষ্ঠির বললেন, অশ্বমেধ মহাযজ্ঞে পৃথিবী-দক্ষিণাই বিহিত; অর্জুন যা জয় করেছেন সেই পৃথিবী আমি দান করেছি, আপনারা তা ভাগ ক’রে নিন। এই পৃথিবী এখন ব্রহ্মস্ব, আমি আর তা নিতে পারি না, আমি বনপ্রবেশ করব।

 দ্রৌপদী ও ভীমাদি বললেন, মহারাজ যথার্থ বলেছেন। তখন সভাস্থ সকলে রোমাঞ্চিত হলেন, অন্তরীক্ষ থেকে সাধু সাধু ধ্বনি শোনা গেল, ব্রাহ্মণগণ হৃষ্ট হয়ে প্রশংসা করতে লাগলেন। ব্যাসদেব পুনর্বার বললেন, মহারাজ, আমি তোমাকে পৃথিবী প্রত্যর্পণ করছি, তুমি তার পরিবর্তে স্বর্ণ দাও। কৃষ্ণ বললেন, ধর্মরাজ, আপনি ভগবান ব্যাসের আদেশ পালন করুন। তখন যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা ত্রিগুণ দক্ষিণার কোটি কোটি গুণ দান করলেন, ব্যাস তা চার ভাগ ক’রে ঋত্বিকদের মধ্যে বিতরণ করলেন। যজ্ঞায়তনে যে সমস্ত স্বর্ণময় অলংকার তোরণ যূপ ঘট স্থালী ইষ্টক প্রভৃতি ছিল, যুধিষ্ঠিরের আদেশে ব্রাহ্মণগণ ভাগ ক’রে নিলেন। অবশিষ্ট দ্রব্য ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও ম্লেচ্ছগণকে দেওয়া হ’ল।

 যজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে ব্রাহ্মণরা প্রভূত ধন নিয়ে চলে গেলেন। ব্যাসদেব তাঁর অংশ কুন্তীকে দিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের সহিত যজ্ঞান্তস্নান ক’রে সমাগত রাজগণকে বহু রত্ন হস্তী অশ্ব স্ত্রী বস্ত্র ও সুবর্ণ উপহার দিলেন এবং বভ্রুবাহনকেও বিপুল ধন দিলেন। রাজারা বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন। দুঃশলার বালক পৌত্রকে যুধিষ্ঠির সিন্ধুরাজ্যে অধিষ্ঠিত করলেন। কৃষ্ণ বলরাম প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ যথোচিত সৎকার লাভ ক’রে ধর্মরাজের আজ্ঞা নিয়ে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন।

১২। শক্তুদাতা ব্রাহ্মণ—নকুলরূপী ধর্ম

 বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন, মহারাজ, সেই মহাযজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছিল। মহাদানের ফলে যখন ধর্মরাজের যশ সর্ব দিকে ঘোষিত হ’ল এবং আকাশ থেকে তাঁর উপর পুষ্পবৃষ্টি হ’তে লাগল তখন এক বৃহৎ নকুল যজ্ঞসভায় এল। তার চক্ষু নীল এবং পার্শ্বদেশ[] স্বর্ণবর্ণ। সে ধৃষ্টভাবে বজ্রকণ্ঠে বললে, ওহে নরপতিগণ, কুরুক্ষেত্রবাসী এক উঞ্ছজীবী বদান্য ব্রাহ্মণ যে শক্তুদান করেছিলেন তার সঙ্গে আপনাদের এই যজ্ঞের তুলনা হয় না। নকুলের এই কথা শুনে ব্রাহ্মণরা বললেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? কেন এই যজ্ঞের নিন্দা করছ?

 নকুল হাস্য ক’রে বললে, দ্বিজগণ, আমি মিথ্যা বলি নি, দর্প ক’রেও বলি নি। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে এক ব্রাহ্মণ কপোতের ন্যায় উঞ্ছবৃত্তি[] দ্বারা জীবিকানির্বাহ করতেন। একদা দারুণ দুর্ভিক্ষের ফলে তাঁর সঞ্চয় শূন্য হয়ে গেলে তিনি অতি কষ্টে কিঞ্চিৎ যব সংগ্রহ ক’রে তা থেকে শক্তু প্রস্তুত করলেন। জপ আহ্নিক ও হোমের পর ব্রাহ্মণ সপরিবারে ভোজনের উপক্রম করছেন এমন সময়ে এক ক্ষুধার্ত অতিথি ব্রাহ্মণ এসে আহার চাইলেন। গৃহস্থ ব্রাহ্মণ অতিথিকে সাদরে পাদ্য অর্ঘ্য ও আসন দিয়ে নিজের শক্তুর ভাগ নিবেদন করলেন। অতিথি তা খেলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষুধানিবৃত্তি হ’ল না। তখন ব্রাহ্মণের পত্নী বললেন, তুমি এঁকে আমার ভাগ দাও।

 ব্রাহ্মণ তাঁর ক্ষুধার্ত শ্রান্ত শীর্ণ বৃদ্ধা পত্নীকে বললেন, তোমার ভাগ আমি নিতে পারি না; কীট-পতঙ্গ-মৃগাদিও নিজের স্ত্রীকে পোষণ করে। ধর্ম অর্থ কাম সংসারকার্য সেবা সন্তানপালন সবই ভার্যার সাহায্যে হয়, ভার্যাকে পালন না করলে লোকে নরকে যায়। ব্রাহ্মণী শুনলেন না, নিজের শক্তু অতিথিকে দিলেন। অতিথি তা খেলেন, কিন্তু তথাপি তাঁর তৃপ্তি হ’ল না। তখন ব্রাহ্মণের পুত্র তাঁর অংশ দিতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, পুত্র, তোমার বয়স যদি সহস্র বৎসরও হয় তথাপি তুমি আমার দৃষ্টিতে বালক, তোমার অংশ আমি অতিথিকে দিতে পারব না। ব্রাহ্মণপুত্র আপত্তি শুনলেন না, নিজ অংশ অতিথিকে দিলেন। তথাপি তাঁর ক্ষুধা দূর হ’ল না। তখন ব্রাহ্মণের সাধ্বী পুত্রবধূ নিজ অংশ দিতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, কল্যাণী, তোমার দেহ শীর্ণ ও বিবর্ণ, তুমি ক্ষুধার্ত হয়ে আছ, তুমি অনাহারে থাকবে এ আমি কি ক’রে দেখব? পুত্রবধূ শুনলেন না, অগত্যা ব্রাহ্মণ তাঁর অংশও অতিথিকে দিলেন।

 তখন অতিথিরূপী ধর্ম বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, তোমার শুদ্ধ দান পেয়ে আমি প্রীত হয়েছি; ওই দেখ, আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, দেব গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি তোমার দান দেখে বিস্মিত হয়ে স্তব করছেন। ক্ষুধায় প্রজ্ঞা ধৈর্য ও ধর্মজ্ঞান নষ্ট হয়, কিন্তু তুমি ক্ষুধা দমন এবং স্ত্রীপুত্রাদির স্নেহ অতিক্রম ক’রে নিজ কর্ম দ্বারা স্বর্গলোক জয় করেছ। শক্তুদান ক’রে তুমি যে ফল পেয়েছ বহু শত অশ্বমেধেও তা হয় না। দিব্য যান উপস্থিত হয়েছে, তুমি এতে আরোহণ ক’রে পত্নী পুত্র ও পুত্রবধূর সহিত ব্রহ্মলোকে যাও।

 অতিথিরাপী ধর্ম এইরূপ বললে ব্রাহ্মণ সপরিবারে স্বর্গে গেলেন। তখন আমি গর্ত থেকে নির্গত হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলাম। সিক্ত শক্তুকণার গন্ধে, দিব্য পুষ্পের মর্দনে এবং সেই সাধু ব্রাহ্মণের দান ও তপস্যার প্রভাবে আমার মস্তক কাঞ্চনময় হ’ল। আমার অবশিষ্ট দেহও ওইরূপ হবে এই আকাঙ্ক্ষায় আমি তপোবন ও যজ্ঞস্থলে সর্বদা ভ্রমণ করছি। আমি আশান্বিত হয়ে কুরুরাজের এই যজ্ঞে এসেছি, কিন্তু আমার দেহ কাঞ্চনময় হ’ল না। এই কারণেই আমি হাস্য ক’রে বলেছিলাম যে সেই উঞ্ছজীবী ব্রাহ্মণের শক্তুদানের সঙ্গে আপনাদের এই যজ্ঞের তুলনা হয় না। নকুল এই কথা বলে চ’লে গেল। সে অদৃশ্য হ’লে দ্বিজগণ নিজ নিজ গৃহে প্রস্থান করলেন।


 জনমেজয় বললেন, মহর্ষি, আমি মনে করি যজ্ঞের তুল্য পুণ্যফলদায়ক কিছুই নেই; নকুল ইন্দ্রতুল্য রাজা যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করলে কেন? বৈশম্পায়ন বললেন, একদা মহর্ষি জমদগ্নি শ্রাদ্ধের জন্য হোমধেনু দোহন ক’রে একটি পবিত্র নূতন ভাণ্ডে দুগ্ধ রেখেছিলেন। সেই সময়ে মহর্ষিকে পরীক্ষা করবার ইচ্ছায় ধর্ম ক্রোধ রূপে সেই ভাণ্ডে প্রবেশ ক’রে দুগ্ধ নষ্ট করলেন। জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হলেন না দেখে ধর্ম ব্রাহ্মণরূপে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ভৃগুশ্রেষ্ঠ, আমি পরাজিত হয়েছি; ভৃগুবংশীয়গণ অত্যন্ত ক্রোধী এই অপবাদ মিথ্যা। আমি ভীত হয়েছি, আপনি প্রসন্ন হ’ন। জমদগ্নি বললেন, ক্রোধ, তুমি আমার কাছে কোনও অপরাধ কর নি। আমি পিতৃগণের উদ্দেশে এই দুগ্ধ রেখেছিলাম, তুমি তাঁদের প্রসন্ন কর। তখন ক্রোধরূপী ধর্ম পিতৃগণের নিকটে গেলেন এবং তাঁদের শাপে নকুলের রূপ পেলেন। শাপমুক্তির জন্য ধর্ম অনুনয় করলে পিতৃগণ বললেন, তুমি ধর্মের নিন্দা কর, তা হ’লে শাপমুক্ত হবে। নকুল তপোবন ও যজ্ঞস্থানে গিয়ে ধর্মের নিন্দা করতে লাগল। যুধিষ্ঠির সাক্ষাৎ ধর্ম স্বরূপ, সেজন্য তাঁর যজ্ঞের নিন্দা ক’রে নকুল পাপমুক্ত হয়েছিল।

  1. আদিপর্ব ৩-পরিচ্ছেদে উতঙ্কের উপাখ্যান কিছু অন্যপ্রকার, তিনি জনমেজয়ের সমকালীন।
  2. অর্থাৎ রাজসূয় যজ্ঞের সময় যা ঘটেছিল তেমন যেন না হয়।
  3. বোধ হয় এর অর্থ— কৃত্রিম কোপসূচক।
  4. বহুবার বা বহুয়ারি।
  5. পরে আছে—মস্তক।
  6. শান্তিপর্ব ২৪-পরিচ্ছেদ পাদটীকা দ্রষ্টব্য।