মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আশ্রমবাসিকপর্ব/আশ্রমবাসপর্বাধ্যায়
আশ্রমবাসিকপর্ব
॥ আশ্রমবাসপর্বাধ্যায়॥
১। যুধিষ্ঠিরের উদারতা
যুদ্ধজয়ের পর পাণ্ডবগণ ছত্রিশ বৎসর রাজ্যপালন করেছিলেন। প্রথম পনর বৎসর তাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতি নিয়ে সকল কার্য করতেন। বিদুর সঞ্জয় যুযুৎসু ও কৃপাচার্য ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে থাকতেন, ব্যাসদেব সর্বদা বৃদ্ধ কুরুরাজকে দেবতা ঋষি পিতৃগণ ও রাক্ষস প্রভৃতির কথা শোনাতেন। বিদুর ধর্ম ও ব্যবহার (আইন) বিষয়ক কার্য দেখতে লাগলেন। তাঁর সুনীতির ফলে সামন্ত রাজাদের কাছ থেকে অল্প ব্যয়ে নানাবিধ অভীষ্ট কার্য আদায় হ’ত। তিনি কারারুদ্ধ বা বধদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে মুক্তি দিলে যধিষ্ঠির কোনও আপত্তি করতেন না। কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা উলূপী চিত্রাঙ্গদা, ধৃষ্টকেতুর ভগিনী[১], জরাসন্ধের কন্যা[২] প্রভৃতি সর্বদা গান্ধারীর সেবা করতেন। ধর্মরাজ তাঁর ভ্রাতাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, পুত্রহীন ধৃতরাষ্ট্র যেন কোনও দুঃখ না পান। সকলেই এই আজ্ঞা পালন করতেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বদ্ধির ফলে পূর্বে যা ঘটেছিল ভীম তা ভুলতে পারলেন না।
যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতা ও অমাত্যগণকে বললেন, বৃদ্ধ কুরুরাজ আমাদের সকলেরই মাননীয়; যিনি তাঁর আজ্ঞা পালন করবেন তিনি আমার সুহৃৎ, যিনি করবেন না তিনি আমার শত্রু। ইনি আমাদের জন্যই পুত্রপৌত্রাদির শোকে কাতর হয়ে আছেন, অতএব এঁর সকল অভিলাষ পূর্ণ করা আমাদের কর্তব্য। মৃত আত্মীয়সুহৃদ্গণের শ্রাদ্ধাদির জন্য এঁর যা আবশ্যক সবই যেন ইনি পান।
যুধিষ্ঠিরের আচরণে ধৃতরাষ্ট্র অতিশয় তুষ্ট হলেন, গান্ধারীও পুত্রশোক ত্যাগ ক’রে পাণ্ডবগণকে নিজপুত্রতুল্য মনে করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রাতঃকালে পাণ্ডবগণের মঙ্গলের নিমিত্ত স্বস্ত্যয়ন ও হোম করাতে লাগলেন। তিনি পাণ্ডুপাত্রদের সেবায় যে আনন্দ পেলেন তা পূর্বে নিজের পুত্রদের কাছে পান নি।
২। ভীমের আক্রোশ—ধৃতরাষ্ট্রের সংকল্প
এইরূপে পনর বৎসর কেটে গেল। ভীম অপ্রকাশ্যভাবে ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কার্য করতেন এবং অনুচর দ্বারা তাঁর আজ্ঞা লঙ্ঘন করাতেন। একদিন ভীম তাঁর বন্ধুদের কাছে তাল ঠুকে বললেন, আমার এই চন্দনচর্চিত পরিঘতুল্য বাহুর প্রতাপেই মূঢ় দুর্যোধনাদি পুত্র ও বান্ধব সহ নিহত হয়েছে। এই নিষ্ঠুর বাক্য শুনতে পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ব্যথিত হলেন, বুদ্ধিমতী গান্ধারী কালধর্ম বুঝে নীরবে রইলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুন নকুল সহদেব কুন্তী ও দ্রৌপদী এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেন নি। ধৃতরাষ্ট্র বাষ্পাকুলকণ্ঠে তাঁর সুহৃদ্গণকে বললেন, আমার দুর্বদ্ধির ফলেই কুরুকুল ক্ষয় পেয়েছে। পুত্রস্নেহের বশে আমি ব্যাসদেব কৃষ্ণ ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুর সঞ্জয় ও গান্ধারীর উপদেশ শুনি নি, পাণ্ডবগণকে তাদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিই নি। এই অপরাধ সহস্র শল্যের ন্যায় আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে আছে। এখন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য আমি দিনের চতুর্থ ভাগে বা অষ্টম ভাগে যৎকিঞ্চিৎ আহার করি, গান্ধারী ভিন্ন আর কেউ তা জানেন না। আমি ও গান্ধারী মৃগচম প’রে কুশশয্যায় শুয়ে নিত্য জপ করি। যুধিষ্ঠির শুনলে অনুতপ্ত হবেন সেজন্য এ কথা আমি কাকেও জানাই নি।
তার পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বৎস, তোমার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হয়ে আমি সুখে আছি, দান ও শ্রাদ্ধকর্মাদি ক’রে পুণ্যসঞ্চয়ও করেছি; পুত্রহীনা গান্ধারীও আমাকে দেখে ধৈর্যধারণ করেছেন। যে নৃশংসগণ দ্রৌপদীর অপমান ও তোমাদের ঐশ্বর্ষহরণ করেছিল তারা ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে হত হয়ে স্বর্গে গেছে। এখন আমার ও গান্ধারীর পক্ষে যা শ্রেয় তাই আমার করা উচিত। তুমি ধর্মনিষ্ঠ সেজন্য তোমাকে বলছি, গান্ধারী ও আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও। বৃদ্ধ বয়সে পুত্রকে রাজ্য দিয়ে বনে বাস করাই আমাদের কুলোচিত ধর্ম। আমি গান্ধারীর সঙ্গে বনবাসী হয়ে তোমাকে আশীর্বাদ করব, চীরবল্কল ধারণ ক’রে উপবাসী হয়ে তপস্যা করব। সেই তপস্যার ফল তুমিও পাবে, কারণ, রাজার অধিকারে শুভাশুভ যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয় রাজাও তার ফলভোগী হন।
যুধিষ্ঠির বললেন, কুরুরাজ, আপনি দুঃখভোগ করলে এই রাজ্য আমার প্রীতিকর হবে না। আমাকে ধিক, আমি অতি দুর্বুদ্ধি রাজ্যাসক্ত ও প্রমাদগ্রস্ত। আপনি অসুখী হ’লে আমার রাজ্যভোগে কি প্রয়োজন? আপনি আমাদের পিতা ও পরম গুরু, আপনি চ’লে গেলে আমরা কোথায় থাকব? আপনার ঔরসপুত্র যুযুৎসু বা আপনার মনোনীত অন্য কেউ এই রাজ্য গ্রহণ করুন, আমিই বনে যাব। অথবা আপনি স্বয়ং রাজ্যশাসন করুন, অযশ দ্বারা আমাকে দগ্ধ করবেন না। আমি রাজা নই, আপনিই রাজা। দুর্যোধনাদির কার্যের জন্য আমার মনে কিছুমাত্র ক্রোধ নেই, দৈববশেই আমরা সকলে মোহগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমরাও আপনার পুত্র, গান্ধারী ও কুন্তীকে সমান জ্ঞান করি। আমি নতশিরে প্রার্থনা করছি, আপনি মনের দুঃখ দূর করুন।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বৎস, আমি বনে গিয়ে তপস্যা করতে ইচ্ছা করি। তুমি আমার যথোচিত সেবা করেছ, এখন বনগমনের অনুমতি দাও। ধৃতরাষ্ট্র সহসা কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, বার্ধক্য ও অধিক কথা বলার ফলে আমার মন অবসন্ন ও মুখ শুষ্ক হচ্ছে, আমি সঞ্জয় আর কৃপাচার্যকে বলছি, এঁরা আমার হয়ে ধর্মরাজকে অনুনয় করুন। এই ব’লে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর দেহে ভর দিয়ে সংজ্ঞাহীন হলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, হায়, যিনি শত সহস্র হস্তীর ন্যায় বলশালী, যিনি লৌহভীম চূর্ণ করেছিলেন, তিনি এখন অচেতন হয়ে অবলা স্ত্রীকে অবলম্বন করলেন! এইরূপ বিলাপ ক’রে যুধিষ্ঠির জলার্দ্র হস্ত দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মুখ ও বক্ষ মুছিয়ে দিলেন। সংজ্ঞালাভ ক’রে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বৎস, আমাকে আলিঙ্গন কর, তোমার স্পর্শে আমি পুনর্জীবিত হয়েছি। আজ আমি দিবসের অষ্টম ভাগে আহার করব এই স্থির করেছিলাম, এখন তার সময় হয়েছে; দুর্বলতার ফলে আমার চেতনা লুপ্ত হয়েছিল। বার বার কথা বললে আমার ক্লান্তি হয়; তুমি আর কষ্ট দিও না, আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও।
যুধিষ্ঠির বললেন, কুরুরাজ, আপনাকে প্রীত করার জন্য আমি রাজ্য বা জীবনও ত্যাগ করতে পারি। আপনি এখন আহার করুন, বনগমনের কথা পরে হবে।
৩। ধৃতরাষ্ট্রের প্রজাসম্ভাষণ
ব্যাসদের এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কুরুনন্দন ধৃতরাষ্ট্র যা বলছেন তাতে তুমি সম্মত হও, আর বিচারের প্রয়োজন নেই। ইনি বৃদ্ধ ও পুত্রশোকাতুর, গান্ধারীও অতি কষ্টে ধৈর্য ধ’রে আছেন; এঁদের বনে যেতে দাও, যেন এখানে এঁদের মৃত্যু না হয়। অন্তকালে রাজাদের অরণ্যবাসই শ্রেয়। যুদ্ধে অথবা যথাবিধি অরণ্যে প্রাণত্যাগ করাই রাজর্ষিদের পরম ধর্ম। ধৃতরাষ্ট্রের তপস্যা করবার সময় হয়েছে, তোমার উপর এখন এঁর কিছুমাত্র ক্রোধ নেই।
ব্যাসদেব চ’লে গেলে যুধিষ্ঠির বিনীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, আপনার যা অভিলাষ ব্যাসদেব তাতে সম্মতি দিয়েছেন। কুরুরাজ, আমি নতমস্তকে অনুনয় করছি, এখন আহার করুন, পরে অরণ্যাশ্রমে যাবেন। জরাজীর্ণ গজপতির ন্যায় ধৃতরাষ্ট্র ধীরে ধীরে নিজ গৃহে গেলেন এবং আহ্নিকাদির পর আহার করলেন। গান্ধারী কুন্তী ও বধূগণ তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। ভোজনের পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের পিঠে হাত রেখে রাজ্যপালন সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিলেন, তার পর শ্রান্ত হয়ে গান্ধারীর গৃহে গেলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে যুধিষ্ঠির কুরুজাঙ্গলের প্রজাগণকে ডেকে আনালেন। পুরবাসী ও জনপদবাসী ব্রাহ্মণাদি এবং নানা দেশ হ’তে আগত নরপতিগণ সমবেত হ’লে ধৃতরাষ্ট্র সকলকে সম্বোধন ক’রে বললেন, আপনারা বহুকাল কুরু কুলের সঙ্গে একত্র বাস করেছেন, আমরা পরস্পরের সুহৃৎ ও হিতৈষী। ব্যাসদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে আমি গান্ধারীর সঙ্গে বনে যেতে ইচ্ছা করেছি, আপনারাও বিনা দ্বিধায় আমাকে অনুমতি দিন। আমি মনে করি, আমাদের সঙ্গে আপনাদের যে প্রীতির সম্বন্ধ আছে, অন্য দেশের রাজাদের সঙ্গে সে প্রকার নেই। গান্ধারী ও আমি পুত্রবিরহে কাতর হয়ে আছি, বয়স এবং উপবাসের জন্য দুর্বলও হয়েছি। যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে আমরা প্রচুর সুখভোগ করেছি। এখন এই পুত্রহীন অন্ধ বৃদ্ধের বনগমন ভিন্ন আর কি গতি আছে? বৎসগণ, শান্তনুর পরে ভীষ্মপরিপালিত বিচিত্রবীর্য এবং পাণ্ডু এই রাজ্য পালন করেছিলেন; তার পর আমিও আপনাদের সেবা করেছি। যদি আমার ত্রুটি হয়ে থাকে তবে আপনারা ক্ষমা করবেন। মন্দবুদ্ধি দুর্যোধনও এই নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছে, কিন্তু আপনাদের কাছে সে কোনও অপরাধ করে নি। তার দুর্নীতির ফলে এবং আমার দোষে অসংখ্য মহীপাল যুদ্ধে প্রাণ হারিছেন। আমার কার্য ভাল বা মন্দ যাই হ’ক, আমি কৃতাঞ্জলি হয়ে বলছি— আপনারা তা মনে রাখবেন না। এই পুত্রহীন শোকাতুর অন্ধ বৃদ্ধকে পূর্বতন কুরুরাজগণের বংশধর ব’লে ক্ষমা করবেন। আমি ও দুঃখিনী গান্ধারী আপনাদের কাছে প্রার্থনা করছি— আমাদের বনগমনের অনুমতি দিন। সম্পদে ও বিপদে কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি আপনারা সমদৃষ্টি রাখবেন। লোকপাল তুল্য চার ভ্রাতা যাঁর সচিব সেই ব্রহ্মার ন্যায় মহাতেজা যুধিষ্ঠির আপনাদের পালন করবেন। ন্যস্ত ধনের ন্যায় আমি যুধিষ্ঠিরকে আপনাদের হস্তে দিচ্ছি, আপনাদের সকলকেও যুধিষ্ঠিরের হস্তে দিচ্ছি। আপনারা কখনও আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হন নি, এখন আমি ও গান্ধারী কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রার্থনা করছি আমার অস্থিরমতি লোভী স্বেচ্ছাচারী পুত্রদের অপরাধ ক্ষমা করুন।
ধৃতরাষ্ট্রের অনুনয় শুনে নগরবাসী ও গ্রামবাসী প্রজাবৃন্দ বাষ্পাকুলনয়নে পরস্পরের দিকে চাইতে লাগলেন এবং দুঃখে অচেতনপ্রায় হলেন। পরিশেষে শাম্ব নামে এক বাগ্মী ব্রাহ্মণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, প্রজাদের প্রতিনিধিরূপে আমি আপনাকে বলছি আপনার কথা যথার্থ, আপনি ও আমরা পরস্পরের সুহৃৎ। আপনি ও আপনার পূর্বপুরুষগণ পিতা ও ভ্রাতার ন্যায় আমাদের পালন করেছেন, রাজা দুর্যোধনও আমাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেন নি। আমরা তাঁকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করে সাথে ছিলাম তা আপনি জানেন। এখন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির সহস্র বৎসর আমাদের পালন করুন। আমরা অনুনয় করছি, জ্ঞাতিবধের জন্য আর দুর্যোধনের দোষ দেবেন না। কুরুকুলনাশের জন্য আপনি দুর্যোধন কর্ণ বা শকুনি দায়ী নন, দৈবই এর কারণ। মহারাজ, আমরা অনুমতি দিচ্ছি, আপনি বনে গিয়ে পূণ্যকর্ম করুন, আপনার পুত্রগণও স্বর্গলোক লাভ করন, যধিষ্ঠির হ’তে আপনি যে মানসিক দুঃখ পেয়েছেন তা অপনীত হ’ক। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনাকে নমস্কার।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে সকলে সাধু সাধু বললেন, ধৃতরাষ্ট্রও প্রীত হলেন। প্রজারা অভিবাদন ক’রে ধীরে ধীরে চলে গেল, ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সঙ্গে নিজ ভবনে গেলেন।
৪। ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির বনযাত্রা
পরদিন প্রভাতকালে বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্র স্থির করেছেন যে আগামী কার্তিক পূর্ণিমায় বনে যাবেন। ভীষ্ম দ্রোণ সোমদত্ত বাহ্নীক দুর্যোধনাদি জয়দ্রথ এবং মৃত সুহৃদ্গণের শ্রাদ্ধের জন্য তিনি কিঞ্চিং অর্থ প্রার্থনা করছেন। যুধিষ্ঠির সানন্দে অর্থ দিতে স্বীকৃত হলেন, অর্জুনও অনুমোদন করলেন, কিন্তু ক্রোধী ভীম সম্মতি দিলেন না। অর্জুন তাঁকে নম্রভাবে বললেন, আমাদের বৃদ্ধ পিতা (জ্যেষ্ঠতাত) বনে যাবার পূর্বে ভীষ্ম প্রভৃতির শ্রাদ্ধ করতে চান; আপনার বাহুবলে যে ধন অর্জিত হয়েছে তারই কিঞ্চিৎ তিনি চাচ্ছেন। কালের কি বিপর্যয় দেখুন, পূর্বে যাঁর কাছে আমরা প্রার্থী হয়ে গেছি এখন অদৃষ্টবশে তিনিই আমাদের কাছে প্রার্থনা করছেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি আপত্তি করবেন না, তাঁকে অর্থ না দিলে আমাদের অধর্ম ও অপযশ হবে।
ভীমসেন সক্রোধে বললেন, ভীষ্মদ্রোণাদি এবং সুহৃদ্গণের শ্রাদ্ধ আমরাই করব, কর্ণের শ্রাদ্ধ কুন্তী করবেন। শ্রাদ্ধের জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে অর্থ দেওয়া উচিত নয়, তাঁর কুলাঙ্গার পুত্রগণ পরলোকে কষ্টভোগ করুক। অর্জুন, পর্বের কথা কি তুমি ভুলে গেছ? আমাদের বনবাসকালে তোমার এই জ্যেষ্ঠতাতের স্নেহ কোথায় ছিল? দ্রোণ ভীষ্ম ও সোমদত্ত তখন কি করেছিলেন? দ্যূতসভায় এই দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রই বিদুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—আমরা কোন বস্তু জিতলাম? এসব কি তোমার মনে নেই?
যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, তুমি ক্ষান্ত হও। তার পর তিনি বিদুরকে বললেন, আপনি কুরুরাজকে জানান যে তাঁর প্রয়োজনীয় অর্থ আমি নিজের কোষ থেকে দেব, তাতে ভীম অসন্তুষ্ট হবেন না। বনবাসকালে ভীম অনেক কষ্ট ভোগ করছেন, তাঁর কর্কশ আচরণে কুরুরাজ যেন রুষ্ট না হন। আমার ও অর্জুনের সমস্ত ধনের তিনিই প্রভু।
বিদুরের মুখে যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র প্রীত হলেন এবং আত্মীয় ও বান্ধবগণের শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত ধন দান করলেন। তার পর তিনি কার্তিক-পূর্ণিমায় যজ্ঞ ক’রে অগ্নিহোত্র সম্মুখে রেখে বনযাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠির শোকে অভিভূত হয়ে ভূপতিত হলেন, অর্জুন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। পাণ্ডবগণ বিদুর সঞ্জয় যুযুৎসু কৃপাচার্য ও ধৌম্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ সজলনয়নে কুরুরাজের অনুগমন করলেন। বন্ধনেত্রা গান্ধারী কুন্তীর স্কন্ধে এবং অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর স্কন্ধে দুই হস্ত রেখে চলতে লাগলেন। দ্রৌপদী সুভদ্রা উত্তরা উলূপী চিত্রাঙ্গদা প্রভৃতিও সরোদনে অনুগমন করলেন। পাণ্ডবদের বনগমনকালে হস্তিনাপুরের প্রজারা যেমন দুঃখিত হয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্রের যাত্রাকালেও সেইরূপ হল। বিদুর ও সঞ্জয় সংকল্প করলেন যে তাঁরাও বনবাসী হবেন। কিছুদূর যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরাদিকে ফিরে যেতে বললেন। গান্ধারীকে দৃঢ়ভাবে ধরে কুন্তী বললেন, আমি বনে বাস করব, তপস্বিনী গান্ধারীর ও কুরুরাজের পদসেবা করব। যুধিষ্ঠির, তুমি সহদেবের উপর কখনও অপ্রসন্ন হয়ো না, সে তোমার ও আমার অনুরক্ত। কর্ণকে সর্বদা স্মরণ ক’রো, তাঁর উদ্দেশে দান ক’রো, সর্বদা সকলে দ্রৌপদীর প্রিয়সাধন ক’রো। কুরুকুলের ভার তোমার উপরেই পড়েছে।
যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে কুন্তীকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন। ভীম বললেন, আমাদের ত্যাগ ক’রে বনে যাওয়াই যদি আপনার ইচ্ছা ছিল তবে আমাদের দিয়ে লোকক্ষয় করালেন কেন? কুন্তী পুত্রদের অনুনয় শুনলেন না, অশ্রুরোধ করে বললেন, তোমরা পাণ্ডুর পুত্র এবং দেবতুল্য পরাক্রমশালী; জ্ঞাতির হস্তে নির্জিত হয়ে যাতে তোমাদের দুঃখভোগ করতে না হয় সেজন্যই আমি তোমাদের যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলাম, তোমাদের তেজোবৃদ্ধির নিমিত্ত বাসুদেবের নিকট বিদুলার উপাখ্যান বলেছিলাম। স্বামীর রাজত্বকালে আমি বহু সুখ ভোগ করেছি, এখন পুত্রের বিজিত রাজ্য ভোগ করতে চাই না। আমার পতি যেখানে আছেন সেই পূণ্যলোকে আমি যেতে ইচ্ছা করি; ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সেবা এবং তপস্যা ক’রে শরীর শুষ্ক করব। কুরুশ্রেষ্ঠ, ভীমসেন প্রভৃতির সহিত গৃহে ফিরে যাও, তোমার ধর্মে মতি থাকুক, মন মহৎ হ’ক।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠিরের জননী ফিরে যান, পুত্র ও ঐশ্বর্য ত্যাগ ক’রে ইনি কেন দুর্গম বনে যাবেন? রাজ্যে থেকেই ইনি দান ব্রত ও তপস্যা করুন। গান্ধারী, তুমি এঁকে নিবৃত্ত হ’তে বল। ধর্মপরায়ণা সতী কুন্তী বনগমনের সংকল্প ত্যাগ করলেন না; তখন দ্রৌপদী প্রভৃতি বধূগণ সরোদনে পাণ্ডবদের সঙ্গে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।
৫। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে নারদাদি
বহু দূরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র ভাগীরথীতীরে উপস্থিত হলেন। সন্ধ্যাকালে সূর্যের আরাধনার পর বিদুর ও সঞ্জয় কুশশয্যা প্রস্তুত ক’রে দিলেন; ধৃতরাষ্ট্র এক শয্যায় এবং কুন্তীর সহিত গান্ধারী অন্য শয্যায় রাত্রিযাপন করলেন। প্রাতঃকালে যথাবিধি আহ্যিক ও হোমের পর তাঁরা উত্তর দিকে যাত্রা করলেন এবং কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে রাজর্ষি শতযূপকে দেখতে পেলেন। ইনি কেকয় দেশের রাজা ছিলেন, বৃদ্ধাবস্থায় জ্যেষ্ঠপুত্রকে রাজ্য দিয়ে বনবাসী হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র ব্যাসের আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিলেন এবং জটা অজিন ও বল্কল ধারণ ক’রে শতযূপের আশ্রমে বিদুর সঞ্জয় গান্ধারী ও কুন্তীর সহিত কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন।
একদিন নারদ পর্বত ব্যাস প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রকে দেখতে এলেন। কথাপ্রসঙ্গে নারদ বললেন, শতযূপের পিতামহ সহস্রচিত্য তপস্যার ফলে ইন্দ্রলোক লাভ করেছেন। আরও অনেক রাজা এই বনে তপঃসিদ্ধ হয়ে স্বর্গে গেছেন। ধৃতরাষ্ট্র, আপনিও ব্যাসের অনুগ্রহে গান্ধারীর সহিত উত্তম গতি লাভ করবেন। রাজা পাণ্ডু ইন্দ্রলোকে বাস ক’রে নিত্য আপনাকে স্মরণ করেন; আমরা দিব্যনেত্রে দেখছি, সৎকর্মের ফলে কুন্তীও তাঁর কাছে যাবেন। বিদুর যুধিষ্ঠিরে প্রবেশ করবেন, সঞ্জয় স্বর্গে যাবেন।
রাজর্ষি শতযূপ বললেন, দেবর্ষি, ধৃতরাষ্ট্র কোন্ লোকে যাবেন তা তো আপনি বললেন না। নারদ বললেন, আমি ইন্দ্রের কাছে শুনেছি রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তিন বৎসর জীবিত থাকবেন, তার পর গান্ধারীর সহিত দিব্য বিমানে কুবেরভবনে গিয়ে ইচ্ছানুসারে দেব গন্ধর্ব ও রাক্ষসলোকে বিচরণ করবেন। ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপে আশ্বাসিত ক’রে নারদাদি প্রস্থান করলেন।
৬। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে যুধিষ্ঠিরাদি
ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি বনে গেলে পুরবাসিগণ শোকার্ত হয়ে বলতে লাগলেন, পুত্রহীন বৃদ্ধ কুরুরাজ এবং মহাভাগা গান্ধারী ও কুন্তী নির্জন বনে কি ক’রে বাস করছেন? পুত্রগণ ও রাজশ্রী ত্যাগ ক’রে কুন্তী কেন দুষ্কর তপস্যা করতে গেলেন?
কুন্তীর বিরহে পাণ্ডবগণ কাতর হয়ে কালযাপন করতে লাগলেন, কোনও বিষয়ে তাঁরা মন দিতে পারলেন না। কয়েক দিন পরে তাঁরা স্থির করলেন যে বনে গিয়ে সকলকে দেখে আসবেন, দ্রৌপদীও গমনের জন্য উৎসুক হলেন। যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় রথ হস্তী অশ্ব ও সৈন্য সজ্জিত হ’ল, বহু পুরবাসী তাঁর সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হ’ল। পাঁচ দিন নগরের বহির্ভাগে বাস ক’রে ষষ্ঠ দিনে যুধিষ্ঠির সদলে যাত্রা করলেন। কৃপাচার্য সৈন্যদলের নেতা হয়ে চললেন; যুধিষ্ঠির ও অর্জুন রথে, ভীম হস্তীতে, নকুল-সহদেব অশ্বে, এবং দ্রৌপদী প্রভৃতি নারীগণ শিবিকায় যাত্রা করলেন। নগর ও গ্রামবাসী প্রজাগণ বিবিধ যানে যুধিষ্ঠিরের অননুগমন করলেন। যুযুৎসু ও ধৌম্য পউররক্ষার জন্য হস্তিনাপুরে রইলেন।
পাণ্ডবগণ যমুনা পার হয়ে কুরুক্ষেত্রে এসে শতযূপ ও ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রম দেখতে পেলেন এবং যান থেকে নেমে বিনীতভাবে পদব্রজে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির সজলনয়নে তাপসগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের জ্যেষ্ঠতাত কুরুবংশপতি কোথায়? তাঁরা বললেন, মহারাজ, তিনি পুষ্প ও জল আনতে এবং যমুনায় স্নান করতে গেছেন। পাণ্ডবগণ সত্বর যমুনার দিকে চললেন এবং কিছুদূর গিয়ে দেখলেন, গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে কুন্তী আগে আগে আসছেন। সহদেব উচ্চস্বরে রোদন ক’রে কুন্তীর পায়ে পড়লেন। তার পর পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রাদিকে প্রণাম ক’রে তাঁদের জলপূর্ণ কলস বয়ে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন।
নানা স্থান থেকে তাপসগণ পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী প্রভৃতিকে দেখতে এলেন। সঞ্জয় এইপ্রকারে তাঁদের পরিচয় দিলেন।—যাঁর দেহ বিশুদ্ধ স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ, মহাসিংহের ন্যায় সবল, যাঁর নাসিকা উন্নত এবং চক্ষু দীর্ঘ ও তাম্রবর্ণ, ইনি কুরুরাজ যুধিষ্ঠির। এই মত্তগজেন্দ্রগামী তপ্তকাঞ্চনবর্ণ দীর্ঘবাহু স্থূলস্কন্ধ পুরুষ বৃকোদর। এঁর পার্শ্বে যে মহাধনুর্ধর শ্যামবর্ণ আয়তলোচন হস্তিযূথপতিতুল্য যুবা রয়েছেন, ইনি অর্জুন। কুন্তীর নিকটে বিষ্ণু ও মহেন্দ্রের ন্যায় অনুপম রূপবান ও বলবান যে দুজন রয়েছেন, এঁরা নকুল-সহদেব। এই নীলোৎপলবর্ণা মধ্যবয়স্কা পদ্মপলাশাক্ষী মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় নারী কৃষ্ণা। এঁর পার্শ্বে যে কনকবর্ণা চন্দ্রপ্রভার ন্যায় রূপবতী রমণী রয়েছেন ইনি চক্রপাণি কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রা; এই সুবর্ণগৌরাঙ্গী নাগকন্যা উলূপী, এবং আর্দ্র মধূক পুষ্পের ন্যায় যাঁর কান্তি, ইনি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা; এঁরা অর্জুনের ভার্যা। যিনি কৃষ্ণের সহিত স্পর্ধা করতেন সেই রাজসেনাপতি শল্যের ভগিনী এই নীলোৎপলবর্ণা রমণী ভীমসেনের পত্নী (কালী)। এই চম্পকগৌরী জরাসন্ধকন্যা সহদেবের পত্নী। এঁর নিকটে যে ইন্দীবরশ্যামবর্ণা রমণী ভূমিতে ব’সে আছেন, ইনি নকুলের পত্নী (ধৃষ্টকেতুর ভগিনী করেণুমতী)। এই প্রতপ্তকাঞ্চনবর্ণা সুন্দরী যিনি পুত্রকে কোলে নিয়ে আছেন, ইনি বিরাটকন্যা উত্তরা; দ্রোণ প্রভৃতি এঁর পতি অভিমন্যুকে রথহীন অবস্থায় বধ করেছিলেন। এই এক শত নারী, যাঁরা শুক্ল উত্তরীয় ধারণ ক’রে আছেন, যাঁদের সীমন্তে অলংকার নেই, এঁরা ধৃতরাষ্ট্রের অনাথা পুত্রবধূ।
৭। বিদুরের তিরোধান
তাপসগণ চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরাদির কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, বিদুর কোথায়? তাঁকে দেখছি না। সঞ্জয় তপস্যায় নিরত থেকে কুশলে আছেন তো? ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্র, বিদুর কেবল বায়ু ভক্ষণ ক’রে ঘোর তপস্যা করছেন, তাঁর শীর্ণ দেহ শিরায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। এই বনের নির্জন প্রদেশে ব্রাহ্মণরা কখনও কখনও তাঁকে দেখতে পান।
এই সময়ে যুধিষ্ঠির দূর থেকে শীর্ণদেহ দিগম্বর বিদুরকে দেখতে পেলেন, তাঁর মস্তকে জটা, মুখে বীটা[৩], দেহ মললিপ্ত ও ধূলিধূসর। বিদুর আশ্রমের দিকে দৃষ্টিপাত ক’রেই চ’লে যাচ্ছিলেন, যুধিষ্ঠির বেগে তাঁর পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, ভো ভো বিদুর, আমি আপনার প্রিয় যুধিষ্ঠির, আপনাকে দেখতে এসেছি। বিদুর এক বৃক্ষে ঠেস দিয়ে অনিমেষনয়নে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে লাগলেন, এবং তাঁর দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি, গাত্রে গাত্র, প্রাণে প্রাণ এবং ইন্দ্রিয়গ্রামে ইন্দ্রিয়সকল সংযোজিত ক’রে যোগবলে যুধিষ্ঠিরের দেহে প্রবিষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠিরের বোধ হ’ল তাঁর বল পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদুরের বৃক্ষাশ্রিত স্তব্ধলোচন প্রাণহীন দেহ দেখে তিনি ব্যাসের বাক্য[৪] স্মরণ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ইচ্ছা করলেন। এমন সময়ে তিনি দৈববাণী শুনলেন—রাজা, বিদুরের দেহ দগ্ধ ক’রো না, এঁর কলেবর যেখানে আছে সেখানেই থাকুক; ইনি যতিধর্ম প্রাপ্ত হয়ে সান্তানিক লোক লাভ করেছেন, এঁর জন্য শোক ক’রো না। তখন যুধিষ্ঠির আশ্রমে ফিরে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।
পরদিন প্রভাতকালে ব্যাসদেব শতযূপ প্রভৃতির সঙ্গে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কুশলপ্রশ্নের পর ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, কুরুরাজ, তুমি বিদুরের পরিণাম শুনেছ। ধর্মই মাণ্ডব্যের শাপে বিদুর রূপে জন্মেছিলেন[৫]। ব্রহ্মার আদেশে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে তোমার এই ভ্রাতাকে আমি উৎপাদন করেছিলাম। এই তপস্বী সত্যনিষ্ঠা ইন্দ্রিয়দমন শমগুণ অহিংসা ও দানের ফলে বিখ্যাত হয়েছেন। যুধিষ্ঠিরও ধর্ম থেকে উৎপন্ন হয়েছেন, যিনি ধর্ম তিনিই বিদুর, যিনি বিদুর তিনিই যুধিষ্ঠির। এই পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, যিনি তোমার আজ্ঞাবহ হয়ে আছেন, এঁর শরীরেই বিদুর যোগবলে প্রবিষ্ট হয়েছেন। পুত্র, আমি তোমার সংশয় ছেদনের জন্যই এখানে এসেছি। তোমার যদি কিছু প্রার্থনা থাকে, যদি কিছু দেখতে বা জানতে চাও, তো আমাকে ব’লো, আমি তোমার অভীষ্ট পূরণ করব।