মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আশ্রমবাসিকপর্ব/পুত্রদর্শনপর্বাধ্যায়

॥ পুত্রদর্শনপর্বাধ্যায়॥

৮। মৃত যোদ্ধৃগণের সমাগম

 পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে সুখে বাস করতে লাগলেন। এক মাস পরে ব্যাসদেব পুনর্বার এলেন, সেই সময়ে মহর্ষি নারদ পর্বত ও দেবল, এবং গন্ধর্ব বিশ্বাবসু তুম্বুরু ও চিত্রসেনও উপস্থিত হলেন। নানাপ্রকার ধর্মকথার পর ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, রাজেন্দ্র, তোমার মনোভাব আমি জানি, তুমি এবং গান্ধারী কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা প্রভৃতি পুত্রবিয়োগের তীব্র শোক ভোগ করছ। তোমার কি কামনা বল, তপস্যার প্রভাবে আমি তা পূর্ণ করব।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আপনার ও এই সাধুগণের সমাগমে আমি ধন্য হয়েছি, আমার জীবন সফল হয়েছে। আমার আর পরলোকের ভয় নেই, কিন্তু যার দুর্নীতির ফলে পাণ্ডবগণ নির্যাতিত এবং বহু নরপতি বিনাশিত হয়েছেন সেই দুর্বুদ্ধি হতভাগ্য দুর্যোধনের জন্য আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। পিতা, আমি শান্তি পাচ্ছি না। গান্ধারী কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর শ্বশুর ব্যাসকে বললেন, মুনিপুংগব, ষোড়শ বৎসর গত হয়েছে তথাপি কুরুরাজের পুত্রশোক শান্ত হচ্ছে না। আপনি তপোবলে নানা লোক সৃষ্টি করতে পারেন, আমাদের পরলোকগত পুত্রগণকে কি দেখাতে পারেন না? আমাদের এই প্রিয়তমা পুত্রবধূ, দ্রৌপদী, কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা, ভূরিশ্রবার এই ভার্যা, আপনার যে শত পৌত্র যুদ্ধে নিহত হয়েছে তাদের পত্নীগণ—এঁদের শোকের জন্য অন্ধরাজ ও আমার শোক বার বার বর্ধিত হচ্ছে। এমন উপায় করুন যাতে আমরা এবং আপনার এই পত্রবধূ কুন্তী শোকশূন্য হ’তে পারি।

 গান্ধারী এইরূপ বললে কুন্তী তাঁর প্রচ্ছন্নজাত পুত্র কর্ণকে স্মরণ করলেন। তাঁর ভাবান্তর দেখে ব্যাস বললেন, তোমার মনে যা আছে তা বল। কুন্তী লজ্জিতভাবে বললেন, ভগবান, আপনি আমার শ্বশুর, দেবতার দেবতা; আমি সত্য কথা বলছি শুনুন। তার পর কুন্তী কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত বিবৃত ক’রে বললেন, আমি মূঢ়তার বশে সজ্ঞানে সেই পুত্রকে উপেক্ষা করেছি, তার ফলে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। আমার কর্ম পাপজনক বা পাপশূন্য যাই হ’ক আপনাকে জানালাম। সেই পুত্রকে আমি দেখতে ইচ্ছা করি; মুনিশ্রেষ্ঠ, আমার হৃদয়ের কামনা আজ পূর্ণ করুন।

 ব্যাস বললেন, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। তোমার অপরাধ হয় নি; দেবতারা ঐশ্বর্যবান, তাঁরা সংকল্প বাক্য দৃষ্টি স্পর্শ বা সংগম—এই পাঁচ প্রকারে পুত্র উৎপাদন করতে পারেন। তোমার মনস্তাপ দূর হ’ক। যাঁরা বলশালী তাঁদের পক্ষে সমস্তই হিতকর পবিত্র ধর্মসংগত ও স্বকীয়। তোমরা সকলেই সুপ্তোত্থিতের ন্যায় নিজ নিজ প্রিয়জনকে দেখতে পাবে। সেই বীরগণ ক্ষত্রধর্ম অনুসারে নিহত হয়েছেন, তাঁরা দেবকার্য সাধনের নিমিত্ত অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রই কুরুরাজ রূপে জন্মেছেন। পাণ্ডু মরূদ্‌গণ হ’তে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির ধর্মের অংশে জন্মেছেন। দুর্যোধন কলি, শকুনি দ্বাপর, দুঃশাসনাদি রাক্ষস, ভীমসেন বায়ু অর্জুন নর-ঋষি, কৃষ্ণ নারায়ণ, নকুল-সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অভিমন্যু চন্দ্র, কর্ণ সূর্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নি, শিখণ্ডী রাক্ষস, দ্রোণ বৃহস্পতি, অশ্বত্থামা রুদ্র, এবং ভীষ্ম বসু হ’তে উৎপন্ন। দেবগণই মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে এসে নিজ নিজ কার্য সম্পন্ন ক’রে স্বর্গে ফিরে গেছেন। তোমরা সকলে ভাগীরথীতীরে চল, নিহত আত্মীয়গণকে সেখানে দেখতে পাবে।

 ব্যাস এইরূপ বললে সমাগত জনগণ সিংহনাদ ক’রে গঙ্গার অভিমুখে যাত্রা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র, পঞ্চপাণ্ডব, অমাত্যগণ, নারীগণ, ঋষি ও গন্ধর্বগণ, অনুচরবর্গ, সকলেই গঙ্গাতীরে এসে অধীরভাবে রাত্রির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত হ’লে তাঁরা পবিত্রভাবে একাগ্রমনে গঙ্গাতীরে উপবেশন করলেন। অনন্তর মহাতেজা ব্যাসদেব ভাগীরথীর পুণ্যজলে অবগাহন ক’রে মৃত কৌরব ও পাণ্ডব যোদ্ধা ও নরপতিগণকে আহ্বান করলেন। তখন জলমধ্যে কুরুপাণ্ডবসেনার তুমুল নিনাদ উঠল; ভীষ্ম দ্রোণ, পুত্রসহ বিরাট ও দ্রুপদ, অভিমন্যু ঘটোৎকচ কর্ণ, দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি, শকুনি, জরাসন্ধপুত্র সহদেব, ভগদত্ত ভূরিশ্রবা শল্য বৃষসেন, দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ, সানুজ ধৃষ্টকেতু, বাহ্নীক সোমদত্ত চেকিতান প্রভৃতি বীরগণ দিব্য দেহ ধারণ ক’রে গঙ্গাগর্ভ থেকে সসৈন্যে উত্থিত হলেন। জীবদ্দশায় যাঁর যেপ্রকার বেশ ধ্বজ ও বাহন ছিল এখনও সেইপ্রকার দেখা গেল। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ স্তবগান করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্য চক্ষু দান করলেন। সকলে রোমাঞ্চিত হয়ে চিত্রপটে অঙ্কিতের ন্যায় এই আশ্চর্য উৎসব দেখতে লাগলেন।

 কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের বীরগণ ক্রোধ ও দ্বেষ ত্যাগ ক’রে নিষ্পাপ হয়ে একত্র সমাগত হলেন। পুত্র পিতামাতার সহিত, ভার্যা পতির সহিত, ভ্রাতা ভ্রাতার সহিত এবং মিত্র মিত্রের সহিত সহর্ষে মিলিত হলেন। পাণ্ডবগণ কর্ণ অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্রের কাছে এলেন। মুনিবর ব্যাসের প্রসাদে সকলে আত্মীর ও বান্ধবের সহিত মিলিত হয়ে সেই রাত্রিতে স্বর্গবাসের সুখ অনুভব করলেন, তাঁদের শোক ভয় দুঃখ অযশ কিছুই রইল না। তাঁরা নিজ নিজ পত্নীর সহিত এক রাত্রি সুখে যাপন করলেন।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে ব্যাসদেব সেই মৃতোত্থিত যোদ্ধৃগণকে প্রস্থানের অনুমতি দিলেন। ক্ষণমধ্যে তাঁরা রথ ও ধ্বজ সহ গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ ক’রে নিজ নিজ লোকে ফিরে গেলেন। পতিহীনা ক্ষত্রিয় নারীগণকে ব্যাস বললেন, যাঁরা পতিলোকে যেতে চান তাঁরা শীঘ্র জাহ্নবীর জলে অবগাহন করুন। তখন সাধ্বী বরাঙ্গনাগণ ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন এবং দেহ ত্যাগ ক’রে পতির সহিত মিলিত হলেন।

 যিনি এই প্রিয়সমাগমের বিবরণ শোনেন তিনি ইহলোকে ও পরলোকে প্রিয় বিষয় লাভ করেন। যিনি অপরকে শোনান তিনি ইহলোকে যশ এবং পরলোকে শুভগতি লাভ করেন। যে বেদজ্ঞ সাধু মানব শুচিভাবে শ্রদ্ধাসহকারে এই আশ্চর্য পর্ব শোনেন তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন।

৯। জনমেজয়ের যজ্ঞে পরীক্ষিৎ—পাণ্ডবগণের প্রস্থান

 জনমেজয় তাঁর পূর্বপুরুষদের এই পুনরাগমনের বিবরণ শুনে বললেন, যাঁরা দেহ ত্যাগ করেছেন তাঁদের দর্শনলাভ কি করে সম্ভবপর হ’ল? ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন উত্তর দিলেন, মহারাজ, মানুষের কর্ম থেকেই শরীর উৎপন্ন হয়। শরীরের উপাদান মহাভূতসমূহ, ভূতাধিপতি মহেশ্বরের অধিষ্ঠানের ফলে দেহ নষ্ট হ’লেও মহাভূত নষ্ট হয় না, জীবাত্মা মহাভূতকে ত্যাগ করেন না, মহাভূত আশ্রয় ক’রে তিনি পূর্বরূপে প্রকাশিত হ’তে পারেন।

 তার পর বৈশম্পায়ন বললেন, জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র পূর্বে তাঁর পুত্রদের কখনও দেখেন নি, ব্যাসদেবের প্রসাদেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। জনমেজয় বললেন, বরদাতা ব্যাসদেব যদি আমার পিতাকে দেখান তবে আপনার বাক্যে আমার শ্রদ্ধা হবে, আমি প্রীত ও কৃতার্থ হব। ব্যাসের প্রসাদে আমার অভিলাষ পূর্ণ হ’ক। জনমেজয় এইরূপ বললে ব্যাসের তপস্যার প্রভাবে পরীক্ষিৎ তাঁর পূর্বের বয়সে ও রূপে অমাত্যগণ সহ আবির্ভূত হলেন, তাঁর সঙ্গে মহাত্মা শমীক[] ও শৃঙ্গীও এলেন।

 জনমেজয় অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং যজ্ঞসমাপন ও যজ্ঞান্তস্নানের পর জরৎকারুপুত্র আস্তীককে বললেন, আমার এই যজ্ঞ অতি আশ্চর্য; আমি পিতার দর্শন পেয়েছি, তাঁর আগমনে আমার শোক দূর হয়েছে। আস্তীক বললেন, মহারাজ, যাঁর যজ্ঞে মহর্ষি দ্বৈপায়ন উপস্থিত থাকেন তিনি ইহলোক ও পরলোক জয় করেছেন। পাণ্ডুর বংশধর, তুমি বিচিত্র আখ্যান শুনেছ, পিতাকে দেখেছ, সর্পসকল ভস্মসাৎ হয়েছে, তোমার সত্যবাক্যের ফলে তক্ষকও মুক্তিলাভ করেছেন। তুমি ঋষিদের পূজা করেছ, সাধুজনের সহিত মিলিত হয়েছ, এবং পাপনাশক মহাভারত শুনেছ; এর ফলে তোমার বিপুল ধর্ম লাভ হয়েছে।

 বৈশম্পায়ন বলতে লাগলেন।—সকলে গঙ্গাতীর হ’তে আশ্রমে ফিরে এলে ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, তুমি ধর্মজ্ঞ ঋষিদের মুখে বিবিধ উপদেশ শুনেছ, শুভগতিপ্রাপ্ত পুত্রগণকেও দেখেছ। এখন শোক ত্যাগ কর, যুধিষ্ঠিরকে ভ্রাতাদের সঙ্গে রাজ্যে ফিরে যেতে বল; এঁরা মাসাধিক কাল এখানে রয়েছেন। ব্যাসের বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, অজাতশত্রু, তোমার মঙ্গল হ’ক, তোমরা এখন হস্তিনাপুরে ফিরে যাও, তোমরা এখানে থাকায় স্নেহের জন্য আমার তপস্যার ব্যাঘাত হচ্ছে। তুমি আমার পুত্রের কার্য করেছ, আমাদের পিণ্ড কীর্তি ও কুল তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে। আর আমার শোক নেই, জীবনেরও প্রয়োজন নেই, এখন কঠোর তপস্যা করব। তুমি আজ বা কাল চ’লে যাও।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমি এই আশ্রমে থেকে আপনার সেবা করব। সহদেব বললেন, আমি মাতা কুন্তীকে ছেড়ে যেতে পারব না। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তী বহু প্রবোধ দিয়ে তাঁদের নিরস্ত করলেন। তখন পাণ্ডবগণ বিদায় নিয়ে ভার্যা বান্ধব ও সৈন্য সহ হস্তিনাপুরে প্রস্থান করলেন।

  1. আদিপর্ব ৮-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।