মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/অনুক্রমণিকা- ও পর্বসংগ্রহ-পর্বাধ্যায়
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত
আদিপর্ব
॥ অনুক্রমণিকা- ও পর্বসংগ্রহ-পর্বাধ্যায়॥
১। শৌনকের আশ্রমে সৌতি
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সবস্বতীঞ্চৈব ততো জয়দীবয়েৎ॥
—নারায়ণ, নরোত্তম নর[১] ও দেবী সবস্বতীকে নমস্কার কবে তার পর জয় উচ্চারণ করবে[২]।
কুলপতি মহর্ষি শৌনক নৈমিষারণ্যে দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞ করছিলেন। একদিন লোমহর্ষণের পুত্র পুরাণকথক সৌতি[৩] সেখানে বিনীতভাবে উপস্থিত হলেন। আশ্রমেব মুনিরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, সৌতি, তুমি এখন কোথা থেকে আসছ, এতকাল কোথায় ছিলে? সৌতি উত্তর দিলেন, আমি রাজর্ষি জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে ছিলাম, সেখানে কৃষ্ণদ্বৈপায়নরচিত বিচিত্র মহাভারকথা বৈশম্পায়নের মুখে শুনেছি। তাব পর বহু তীর্থে ভ্রমণ ক’রে সমন্তপঞ্চক দেশে যাই, যেখানে কুরপাণ্ডবের যুদ্ধ হযেছিল। এখন আপনাদের দর্শন করতে এখানে এসেছি। দ্বিজগণ, আপনারা যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শুচি হয়ে সুখে উপবিষ্ট রয়েছেন, আমার কাছে কি শুনতে ইচ্ছা করেন আদেশ করুন—পবিত্র পুরাণকথা, না মহাত্মা নরপতি ও ঋষিগণের ইতিহাস? ঋষিরা বললেন, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে বৈশম্পায়ন যে ব্যাসরচিত মহাভারতকথা বলেছিলেন আমরা তাই শুনতে ইচ্ছা করি।
সৌতি বললেন, চরাচরগুরু হষীকেশ হরিকে নমস্কার ক’রে আমি ব্যাসপ্রোক্ত মহাভারতকথা আরম্ভ করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে ব’লে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। ব্যাসদেব এই মহাভারত সংক্ষেপে বলেছেন আবার সবিস্তারেও বলেছেন। কোনও কোনও ব্রাহ্মণ এই গ্রন্থ আদি থেকে, কেউ আস্তীকের উপাখ্যান থেকে, কেউ বা উপরিচরের উপাখ্যান থেকে পাঠ করেন।
মহাভারত রচনার পর ব্যাসদেব ভেবেছিলেন, কোন্ উপায়ে এই ইতিহাস শিষ্যদের অধ্যয়ন করাব? তখন ভগবান ব্রহ্মা তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেন, তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনি তোমার গ্রন্থের লিপিকার হবেন। ব্যাস গণেশকে অনুরোধ করলে তিনি বললেন, আমি সম্মত আছি, কিন্তু আমার লেখনী ক্ষণমাত্র থামবে না। ব্যাস ভাবলেন, আমার রচনায় আট হাজার আট শ এমন কূটশ্লোক আছে যার অর্থ কেবল আমি আর আমার পুত্র শুক বুঝতে পারি, সঞ্জয় পারেন কিনা সন্দেহ। ব্যাস গণেশকে বললেন, আমি যা ব’লে যাব আপনি তার অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। গণেশ বললেন, তাই হবে। গণেশ সর্বজ্ঞ হ’লেও কূটশ্লোক লেখবার সময় তাঁকে ভাবতে হত, সেই অবসরে ব্যাস অন্য বহু শ্লোক রচনা করতেন।[৪]
রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন। ভগবান ব্যাস এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। উপাখ্যান সহিত এই মহাভারতে লক্ষ শ্লোক আছে। উপাখ্যানভাগ বর্জন ক’রে ব্যাস চব্বিশ হাজার শ্লোকে এক সংহিতা রচনা করেছেন, পণ্ডিতগণের মতে তাই প্রকৃত মহাভারত। তা ছাড়া ব্যাস দেড় শ শ্লোকে সমস্ত পর্বের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত অনুক্রমণিকা-অধ্যায়ে দিয়েছেন। ব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনর লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন, আমি তাই বলব। পূর্বকালে দেবতারা তুলাদণ্ডে ওজন ক’রে দেখেছিলেন যে উপনিষৎসহ চার বেদের তুলনায় একখানি এই গ্রন্থ মহত্ত্বে ও ভারবত্তায় অধিক, সেজন্যই এর নাম মহাভারত।
অনন্তর সৌতি অতি সংক্ষেপে মহাভারতের মূল আখ্যান এবং পর্বসংগ্রহ (অর্থাৎ প্রত্যেক পর্বের বিষয়সমূহ) বর্ণনা করলেন।