মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/পৌষ্যপর্বাধ্যায়

॥ পৌষ্যপর্বাধ্যায়॥

২। জনমেজয়ের শাপ - আরশি, উপমন ও বেদ

 সৌতি বললেন।— পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয় তাঁর তিন ভ্রাতার সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে এক যজ্ঞ করছিলেন এমন সময় সেখানে একটি কুকুর এল। জনমেজয়ের ভ্রাতারা তাকে প্রহার করলেন, সে কাঁদতে কাঁদতে তার মাতার কাছে গেল। কুক্কুরী কুদ্ধ হয়ে যজ্ঞস্থলে এসে বললে, আমার পুত্রকে বিনা দোষে মারলে কেন? জনমেজয় প্রভৃতি কোনও উত্তর দিলেন না। কুক্কুরী বললে, এ কোনও অপরাধ করে নি তথাপি প্রহত হয়েছে; তোমার উপরেও অতর্কিত বিপদ এসে পড়বে।

 দেবশুনী সরমার এই অভিশাপ শুনে জনমেজয় অত্যন্ত চিন্তাকুল হলেন। যজ্ঞ শেষ হলে তিনি হস্তিনাপুরে ফিরে এসে শাপমোচনের জন্য উপযুক্ত পুরোহিতের সন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে শ্রুতশ্রবা ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নমস্কার করে বললেন, ভগবান, আপনার পুত্র সোমশ্রবাকে দিন, তিনি আমার পুরোহিত হবেন। শ্রুতশ্রবা বললেন, আমার এই পুত্র সর্পীর গর্ভজাত, এ মহাতপস্বী ও বেদজ্ঞ, মহাদেবের শাপ ভিন্ন অন্য সমস্ত শাপ নিবারণ করতে পারে। কিন্তু এর একটি গূঢ় ব্রত আছে, কোনও ব্রাহ্মণ কিছু প্রার্থনা করলে এ তা অবশ্যই পূরণ করবে। যদি তুমি তাতে সম্মত হও তবে একে নিয়ে যাও। জনমেজয় ঋষিপুত্রকে নিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের বললেন, আমি একে উপাধ্যায়রূপে বরণ করেছি, ইনি যা বলবেন তোমরা তা নির্বিচারে করবে। এই আদেশ দিয়ে জনমেজয় তক্ষশিলা দেশ জয় করতে গেলেন।[১]

 এই সময়ে আয়োদ ধৌম্য[২] নামে এক ঋষি ছিলেন, তার তিন শিষ্য— উপমন্যু, আরুণি ও বেদ। তিনি তাঁর পাঞ্চালদেশীয় শিষ্য আরুণিকে আজ্ঞা দিলেন, যাও, তুমি আমার ক্ষেত্রের আল বাঁধ। আরুণি গুরুর আজ্ঞা পালন করতে গেলেন, কিন্তু আল বাঁধতে না পেরে অবশেষে শুয়ে পড়ে জলরোধ করলেন। আরুণি ফিরে এলেন না দেখে ধৌম্য তার অপর দুই শিষ্যের সঙ্গে ক্ষেত্রে গিয়ে ডাকলেন, বৎস আরুণি, কোথায় আছ, এস। আরুণি উঠে এসে বললেন, আমি জলপ্রবাহ রোধ করতে না পেরে সেখানে শুয়ে ছিলাম, এখন আপনি ডাকতে উঠে এসেছি, আজ্ঞা করুন কি করতে হবে। ধৌম্য বললেন, তুমি কেদারখণ্ড (ক্ষেত্রের আল) বিদারণ করে উঠেছ সেজন্য তোমার নাম উদ্দালক হবে। আমার আজ্ঞা পালন করেছ সেজন্য তুমি শ্রেয়োলাভ করবে এবং সমস্ত বেদ ও ধর্মশাস্ত্র তোমার অন্তরে প্রকাশিত থাকবে।

 আয়োদ ধৌম্য আর এক শিষ্য উপমন্যুকে আদেশ দিলেন, বৎস, তুমি আমার গো রক্ষা কর। উপমন্যু প্রত্যহ গরু চরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এসে গুরুকে প্রণাম করতে লাগলেন। একদিন গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, বৎস, তুমি কি খাও? তোমাকে বেশ স্থূল দেখছি। উপমন্যু বললেন, আমি ভিক্ষা ক’রে জীবিকানির্বাহ করি। গুরু বললেন, আমাকে নিবেদন না ক’রে ভিক্ষান্ন ভোজন উচিত নয়। তার পর থেকে উপমন্যু ভিক্ষাদ্রব্য এনে গুরুকে দিতেন। তথাপি তাঁকে পুষ্ট দেখে গুরু বললেন, তুমি যা ভিক্ষা পাও সবই তো আমি নিই, তুমি এখন কি খাও? উপমন্দা বললেন, প্রথমবার ভিক্ষা ক’রে আপনাকে দিই, তারপর আবার ভিক্ষা করি, তাতেই আমার জীবিকানির্বাহ হয়। গুরু বললেন, এ তোমার অন্যায়, এতে অন্য ভিক্ষাজীবীদের হানি হয়, তুমিও লোভী হয়ে পড়। তারপর উপমন্যু একবার মাত্র ভিক্ষা ক’রে গুরুকে দিতে লাগলেন। গুরু আবার তাঁকে প্রশ্ন করলেন, বৎস, তোমাকে তো অতিশয় স্থূল দেখছি, এখন কি খাও? উপমন্যু বললেন, আমি এইসব গরুর দুধে খাই। গুরু বললেন, আমার অনুমতি বিনা দুধ খাওয়া তোমার অন্যায়। উপমন্যু তার পরেও স্থূলকায় রয়েছেন দেখে গুরু বললেন, এখন কি খাও? উপমন্যু বললেন স্তন্যপানের পর বাছুররা যে ফেন উদ্‌গার করে তাই খাই। গুরু বললেন, এই বাছররা দয়া ক’রে তোমার জন্য প্রচুর ফেন উদ্‌গার করে, তাতে এদের পুষ্টির ব্যাঘাত হয়; ফেন খাওয়াও তোমার উচিত নয়। গুরুর সকল নিষেধ মেনে নিয়ে উপমন্যু গরু চরাতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে অর্কপত্র (আকন্দপাতা) খেলেন। সেই ক্ষার তিক্ত কট, রুক্ষ তীক্ষ বস্তু খেয়ে তিনি অন্ধ হলেন এবং চলতে চলতে কূপের মধ্যে প’ড়ে গেলেন। সসূর্যাস্তের পর উপমন্যু ফিরে এলেন না দেখে আয়োদ ধৌম্য বললেন, আমি তার সকল প্রকার ভোজনই নিষেধ করেছি, সে নিশ্চয় রাগ করেছে, তাকে খোঁজা উচিত। এই ব’লে তিনি শিষ্যদের সঙ্গে অরণ্যে গিয়ে ডাকলেন, বৎস উপমন্যু, কোথায় আছ, এস। উপমন্যু কূপের ভিতর থেকে উত্তর দিলেন, আমি অর্কপত্র ভক্ষণের ফলে অন্ধ হয়ে এখানে প’ড়ে গেছি। ধৌম্য বললেন, তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের স্তব কর, তাঁরা তোমাকে চক্ষুষ্মান করবেন। উপমন্যু স্তব করলেন। অশ্বিদ্বয় তাঁর নিকট আবির্ভূত হয়ে বললেন, আমরা প্রীত হয়েছি, তুমি এই পূপ (পিষ্টক) ভক্ষণ কর। উপমন্যু বললেন, গুরুকে নিবেদন না ক’রে আমি খেতে পারি না। অশ্বিদ্বয় বললেন, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে আমাদের স্তব ক’রে পূপ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা গুরুকে নিবেদন না ক’রেই খেয়েছিলেন। উপমন্যূ বললেন, আমি আপনাদের নিকট অনুনয় করছি, গুরুকে নিবেদন না করে আমি খেতে পারব না। অশ্বিদ্বয় বললেন, তোমার গুরুভক্তিতে আমরা প্রীত হয়েছি; তোমার উপাধ্যায়ের দন্ত কৃষ্ণ লৌহময় হবে, তোমার দন্ত হিরণ্ময় হবে, তুমি চক্ষুষ্মান হবে এবং শ্রেয়োলাভ করবে। উপমন্য চক্ষ, লাভ ক’রে গুরুর কাছে এলেন এবং অভিবাদন ক’রে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। গুরু প্রীত হয়ে বললেন, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বরে তোমার মঙ্গল হবে, সকল বেদ এবং ধর্মশাস্ত্রও তুমি আয়ত্ত করবে। উপমন্যুর পরীক্ষা এইরূপে শেষ হ’ল।

 আয়োদ ধৌম্য তাঁর তৃতীয় শিষ্য বেদকে আদেশ দিলেন, তুমি আমার গৃহে কিছুকাল বাস ক’রে আমার সেবা কর, তোমার মঙ্গল হবে। বেদ দীর্ঘকাল গুরু গৃহে থেকে তাঁর আজ্ঞায় বলদের ন্যায় ভারবহন এবং শীত গ্রীষ্ম ক্ষুধা তৃষ্ণাদি কষ্ট সইতে লাগলেন। অবশেষে তিনি গরুকে পরিতুষ্ট ক’রে শ্রেয় ও সর্বজ্ঞতা লাভ করলেন। এইরূপে তাঁর পরীক্ষা শেষ হ’ল৷

৩। উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক

 উপাধ্যায়ের আজ্ঞা নিয়ে বেদ গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করলেন, তাঁরও তিনটি শিষ্য হ’ল। তিনি শিষ্যদের বলতেন না যে এই কর্ম কর, বা আমার শুশ্রূষা কর। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানতেন সেজন্য শিষ্যদের কষ্ট দিতে চাইতেন না। কিছুকাল পরে জনমেজয় এবং পৌষ্য নামে আর এক রাজা বেদকে উপাধ্যায়ের পদে বরণ করলেন। একদা বেদ যাজন কার্যের জন্য বিদেশে যাবার সময় উতঙ্ক[৩] নামক শিষ্যকে ব’লে গেলেন, আমার প্রবাসকালে গৃহে যে বিষয়ের অভাব হবে তুমি তা পূরণ করবে। উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। একদিন আশ্রমের নারীরা তাঁকে বললে, তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু উপাধ্যায় এখানে নেই; ঋতু যাতে নিষ্ফল না হয় তুমি তা কর। উতঙ্ক উত্তর দিলেন, আমি স্ত্রীলোকের কথায় এমন অকার্য করতে পারি না, উপাধ্যায় আমাকে অকার্য করবার আদেশ দেন নি। কিছুকাল পরে বেদ ফিরে এলেন এবং সকল বৃত্তান্ত শানে প্রীত হয়ে বললেন, বৎস উতঙ্ক, আমি তোমার কি প্রিয়সাধন করব বল। তুমি ধর্মানুসারে আমার সেবা করেছ, আমাদের পরস্পরের প্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তোমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। এখন তুমি স্বগৃহে যেতে পার।

 উতঙ্ক বললেন, আমিই বা আপনার কি প্রিয়সাধন করব বলুন, আমি আপনার অভীষ্ট দক্ষিণা দিতে ইচ্ছা করি। বেদ বললেন, বৎস, এখন থাকুক না। কিছুকাল পরে উতঙ্ক পুনর্বার গুরুকে দক্ষিণার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বেদ বললেন, তুমি বহুবার আমাকে দক্ষিণার কথা বলেছ; গৃহমধ্যে গিয়ে উপাধ্যায়ানীকে জিজ্ঞাসা কর কি দিতে হবে। তখন উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে গিয়ে বললেন, ভগবতী, উপাধ্যায় আমাকে গৃহগমনের অনুমতি দিয়েছেন, আমি গুরুদক্ষিণা দিয়ে ঋণমুক্ত হ’তে চাই, আপনি বলুন কি দক্ষিণা দেব। উপাধ্যায়পত্নী বললেন, তুমি রাজা পৌষ্যের কাছে যাও, তাঁর ক্ষত্রিয়া পত্নী যে দুই কুণ্ডল পরেন তাই চেয়ে আন। চার দিন পরে পুণ্যক ব্রত হবে, তাতে আমি ওই কুণ্ডলে শোভিত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করতে ইচ্ছা করি। তুমি আমার এই অভীষ্ট পূর্ণ কর, তাতে তোমার মঙ্গল হবে, কিন্তু যদি না কর তবে অনিষ্ট হবে।

 উতঙ্ক কুণ্ডল আনবার জন্য যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি প্রকাণ্ড বৃষে আরূঢ় এক মহাকায় পুরুষকে দেখতে পেলেন। সেই পুরুষ বললেন, উতঙ্ক, তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর। উতঙ্ককে অনিচ্ছুক দেখে তিনি আবার বললেন, উতঙ্ক, খাও, বিচার ক’রো না, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে খেয়েছেন। তখন উতঙ্ক বৃষের মলমূত্র খেলেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে সত্বর আচমন ক’রে পৌষ্যের নিকট যাত্রা করলেন। পৌষ্য তাঁকে বললেন, ভগবান, কি আজ্ঞা বলুন। উতঙ্ক কুণ্ডল প্রার্থনা করলে রাজা বললেন, আপনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীর কাছে চেয়ে নিন। উতঙ্ক মহিষীকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে পৌষ্যকে বললেন, আমাকে মিথ্যা কথা বলা আপনার উচিত হয় নি, অন্তঃপুরে মহিষী নেই। পৌষ্য ক্ষণকাল চিন্তা করে বললেন, নিশ্চয় আপনি উচ্ছিষ্ট (এঁটো মুখে) আছেন, অশুচি ব্যক্তি আমার পতিব্রতা ভার্যাকে দেখতে পায় না। উতঙ্ক স্মরণ ক’রে বললেন, আমি এখানে শীঘ্র আসবার জন্য দাঁড়িয়ে আচমন করেছিলাম সেজন্য এই দোষ হয়েছে। উতঙ্ক তখন পূর্বমুখে ব’সে হাত পা মুখ ধুলেন এবং তিনবার নিঃশব্দে ফেনশূন্য অনুষ্ণ হৃদ্য জল পান ক’রে দুবার মুখাদি ইন্দ্রিয় মুছলেন। তারপর তিনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীকে দেখতে পেলেন। উতঙ্কের প্রার্থনা শুনে মহিষী প্রীত হয়ে তাঁকে কুণ্ডল দিলেন এবং বললেন, নাগরাজ তক্ষক এই কুণ্ডল দুটির প্রার্থী, অতএব সাবধানে নিয়ে যাবেন।

 উতঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে পৌষ্যের কাছে এলেন। পৌষ্য বললেন, ভগবান, সৎপাত্র সহজে পাওয়া যায় না, আপনি গুণবান অতিথি, আপনার সৎকার করতে ইচ্ছা করি। উতঙ্ক বললেন, গৃহে যে অন্ন আছে তাই শীঘ্র নিয়ে আসুন। অন্ন আনা হ’লে উতঙ্ক দেখলেন তা ঠাণ্ডা এবং তাতে চুল রয়েছে। তিনি বললেন, আমাকে অশুচি অন্ন দিয়েছেন অতএব আপনি অন্ধ হবেন। পৌষ্য বললেন, আপনি নির্দোষ অন্নের দোষ দিচ্ছেন এজন্য আপনি নিঃসন্তান হবেন। উতঙ্ক বললেন, অশুচি অন্ন দিয়ে আবার অভিশাপ দেওয়া আপনার অনুচিত, দেখুন না অন্ন অশুচি কি না। রাজা অন্ন দেখে অনুমান করলেন এই শীতল অন্ন কোনও মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তারই কেশ এতে পড়েছে। তিনি ক্ষমা চাইলে উতঙ্ক বললেন, আমার বাক্য মিথ্যা হয় না, আপনি অন্ধ হবেন, কিন্তু শীঘ্রই আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আমাকে যে শাপ দিয়েছেন তাও যেন না ফলে। রাজা বললেন, আমার ক্রোধ এখনও শান্ত হয়নি, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীততুল্য কিন্তু বাক্যে তীক্ষ্ণধার ক্ষুর থাকে, ক্ষত্রিয়ের এর বিপরীত। আমি শাপ প্রত্যাহার করতে পারি না, আপনি চ’লে যান। উতঙ্ক বললেন, আপনি অন্নের দোষ স্বীকার করেছেন অতএব আপনার শাপ ফলবে না। এই ব’লে তিনি কুণ্ডল নিয়ে চলে গেলেন।

 উতঙ্ক যেতে যেতে পথে এক নগ্ন ক্ষপণক[৪] দেখতে পেলেন, সে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হচ্ছে। তিনি কুণ্ডল দুটি ভূমিতে রেখে স্নানাদির জন্য জলাশয়ে গেলেন, সেই অবসরে ক্ষপণক কুণ্ডল নিয়ে পালিয়ে গেল। স্নান শেষ ক’রে উতঙ্ক দৌড়ে গিয়ে ক্ষপণককে ধ’রে ফেললেন। সে তখনই তক্ষকের রূপ ধারণ করলে এবং সহসা আবির্ভূত এক গর্তে প্রবেশ ক’রে নাগলোকে চলে গেল। উতঙ্ক সেই গর্ত দণ্ডকাণ্ঠ (ব্রহচারীর যষ্টি) দিয়ে খুঁড়ে বড় করবার চেষ্টা করলেন। তাঁকে ক্লান্ত ও অকৃতকার্য দেখে ইন্দ্র তাঁর বজ্রকে বললেন, যাও, ওই ব্রাহ্মণকে সাহায্য কর। বজ্র দণ্ডকাষ্ঠে অধিষ্ঠান ক’রে গর্তটি বড় ক’রে দিলে। উতঙ্ক সেই গর্ত দিয়ে নাগলোকে গেলেন এবং নানাবিধ প্রাসাদ হর্ম্য ক্রীড়াস্থানাদি দেখতে পেলেন। কুণ্ডল ফিরে পাবার জন্য তিনি নাগগণের স্তব করতে লাগলেন। তার পর দেখলেন, দুই স্ত্রী তাঁতে কাপড় বুনছে, তার কতক সুতো কাল কতক সাদা; ছয় কুমার দ্বাদশ অর (পাখি) যুক্ত একটি চক্র ঘোরাচ্ছে; একজন সুদর্শন পুরুষ এবং একটি অশ্বও সেখানে রয়েছে। উতঙ্ক এই সকলেরও স্তব করলেন। সেই পুরুষ উতঙ্ককে বললেন, তোমার স্তবে প্রীত হয়েছি, কি অভীষ্ট সাধন করব বল। উতঙ্ক বললেন, নাগগণ আমার বশীভূত হ’ক। পুরুষ বললেন, তুমি এই অশ্বের গুহ্যদেশে ফুৎকার দাও। উতঙ্ক ফুৎকার দিলে অশ্বের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে সধূম অগ্নিশিখা নির্গত হয়ে নাগলোকে ব্যাপ্ত হ’ল। তখন ভীত হয়ে তক্ষক তাঁর বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই নিন আপনার কুণ্ডল। কুণ্ডল পেয়ে উতঙ্ক ভাবলেন, আজ উপাধ্যায়ানীর পুণ্যক ব্রত, আমি বহু দূরে এসে পড়েছি, কি ক’রে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করব? সেই পুরুষ তাঁকে বললেন, তুমি এই অশ্বে আরূঢ় হয়ে যাও, ক্ষণমধ্যে তোমার উপাধ্যায়ের গৃহে পৌঁছবে।

 উপাধ্যায়ানী স্নান করে কেশসংস্কার করছিলেন এবং উতঙ্ক এলেন না দেখে তাঁকে শাপ দেবার উপক্রম করছিলেন, এমন সময় উতঙ্ক এসে প্রণাম ক’রে কুণ্ডল দিলেন। তার পর তিনি উপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। উপাধ্যায় বললেন, তুমি যে দুই স্ত্রীকে বস্ত্র বয়ন করতে দেখেছ তাঁরা ধাতা ও বিধাতা, কৃষ্ণ ও শ্বেত সূত্র রাত্রি ও দিন, ছয় কুমার ছয় ঋতু, চক্রটি সংবৎসর, তার দ্বাদশ অর দ্বাদশ মাস, যিনি পুরুষ তিনি স্বয়ং ইন্দ্র, এবং অশ্ব অগ্নি। তুমি যাবার সময পথে যে বৃষ দেখেছিলে সে ঐরাবত, তার আরোহী ইন্দ্র। তুমি যে পুরীষ খেয়েছ তা অমৃত। নাগলোকে তোমার বিপদ হয় নি, কারণ ইন্দ্র আমার সখা, তাঁর অনুগ্রহে তুমি কুণ্ডল আনতে পেরেছ। সৌম্য, তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি স্বগৃহে যাও, তোমার মঙ্গল হবে।

 উতঙ্ক তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেবার সংকল্প ক’রে হস্তিনাপুরে রাজা জনমেজয়ের কাছে গেলেন। জনমেজয় তখন তক্ষশিলা জয় ক’রে ফিরে এসেছেন, মন্ত্রীরা তাঁকে ঘিরে আছেন। উতঙ্ক যথাবিধি আশীর্বাদ ক’রে বললেন, মহারাজ, যে কার্য করা উচিত ছিল তা না ক’রে আপনি বালকের ন্যায় অন্য কার্য করছেন। জনমেজয় তাঁকে সংবর্ধনা ক’রে বললেন, আমি ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করে থাকি, আমাকে আপনি কি করতে বলেন? উতঙ্ক বললেন, আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যে প্রাণহরণ করেছে সেই দুরাত্মা তক্ষকের উপর আপনি প্রতিশোধ নিন। সেই নৃপতির চিকিৎসার জন্য কাশ্যপ আসছিলেন, কিন্তু তক্ষক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আপনি শীঘ্র সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করুন এবং জ্বলিত অগ্নিতে সেই পাপীকে আহুতি দিন। তাতে আপনার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ হবে, আমিও প্রীত হব, কারণ সেই দুরাত্মা আমার বিঘ্ন করেছিল।

 উতঙ্কের কথা শুনে জনমেজয় তক্ষকের উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন এবং শোকার্তমনে মন্ত্রিগণকে পরীক্ষিতের মৃত্যুর বিষয় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।

  1. এই বৃত্তান্তের সঙ্গে পরবর্তী আখ্যানের যােগসূত্র স্পষ্ট নয়।
  2. পাঠান্তর—আপােদ ধৌম্য।
  3. আশ্বমেধিকপর্বে ৬-পরিচ্ছেদে উতঙ্কের উপাখ্যান কিছু, অন্যপ্রকার।
  4. দিগম্বর সন্ন্যাসী বিশেষ।