মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/পৌলোমপর্বাধ্যায়
॥ পৌলোমপর্বাধ্যায়॥
৪। ভৃগু-পুলোমা—চ্যবন—অগ্নির শাপমোচন
মহর্ষি শৌনক সৌতিকে বললেন, বৎস, আমি ভৃগবংশের বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি, তুমি তা বল।
সৌতি বললেন।—ব্রহ্মা যখন বরুণের যজ্ঞ করছিলেন তখন সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে মহর্ষি ভৃগুর জন্ম হয়েছিল। ভৃগুর ভার্যার নাম পুলোমা। তিনি গর্ভবতী হ’লে একদিন যখন ভৃগু স্নান করতে যান তখন এক রাক্ষস আশ্রমে এসে ভৃগুপত্নীকে দেখে মুগ্ধ হল। এই রাক্ষসেরও নাম পুলোমা। পূর্বে সে ভৃগুপত্নী পুলোমাকে বিবাহ করতে চেয়েছিল কিন্তু কন্যার পিতা ভৃগুকেই কন্যাদান করেন। সেই দুঃখ সর্বদাই রাক্ষসের মনে ছিল। ভৃগুর হোমগৃহে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দেখে রাক্ষস বললে, অগ্নি, তুমি দেবগণের মুখ, সত্য বল এই পুলোমা কার ভার্যা। এই সন্দরীকে পূর্বে আমি ভার্যারূপে বরণ করেছিলাম কিন্তু ভৃগু অন্যায়ভাবে একে গ্রহণ করেছেন। এখন আমি এঁকে আশ্রম থেকে হরণ করতে চাই। তুমি সত্য কথা বল।
অগ্নি ভীত হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, দানবনন্দন, তুমি পূর্বে এই পুলোমাকে বরণ করেছিলে কিন্তু যথাবিধি মন্ত্রপাঠ ক’রে বিবাহ কর নি। পুলোমার পিতা বরলাভের আশায় ভৃগুকেই কন্যাদান করেছিলেন। ভৃগু আমার সম্মুখেই এঁকে বিবাহ করেছেন। যাঁকে তুমি পূর্বে বরণ করেছিলে ইনিই সেই পুলোমা। আমি মিথ্যা বলতে পারব না।
তখন রাক্ষস বরাহের রূপ ধারণ ক’রে পুলোমাকে হরণ ক’রে মহাবেগে নিয়ে চলল। পুলোমার শিশু গর্ভচ্যুত হ’ল, সেজন্য তার নাম চ্যবন। সূর্য তুল্য তেজোময় সেই শিশুকে দেখে রাক্ষস ভস্ম হয়ে ভূতলে পড়ল, পুলোমা পুত্রকে নিয়ে দুঃখিত মনে আশ্রমের দিকে চললেন। ব্রহ্মা তাঁর এই রোরুদ্যমানা পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিলেন এবং পুলোমার অশ্রুজাত নদীর নাম বধূসরা রাখলেন। ভৃগু তাঁর পত্নীকে বললেন, তোমার পরিচয় রাক্ষসকে কে দিয়েছিল? পুলোমা উত্তর দিলেন, অগ্নি আমার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন ভৃগু সরোষে অগ্নিকে শাপ দিলেন, তুমি সর্বভুক হবে। অগ্নি বললেন, তুমি কেন এরূপ শাপ দিলে? আমি ধর্মানুসারে রাক্ষসকে সত্য কথাই বলেছি। তুমি ব্রাহ্মণ, আমার মাননীয়, সেজন্য আমি প্রত্যভিশাপ দিলাম না। আমি যোগবলে বহু মূর্তিতে অধিষ্ঠান করি, আমাকে যে আহুতি দেওয়া হয় তাতেই দেবগণ ও পিতৃগণ তৃপ্ত হন, অতএব আমি সর্বভুক কি ক’রে হব?
অগ্নি দ্বিজগণের অগ্নিহোত্র ও যজ্ঞাদি ক্রিয়া থেকে অন্তর্হিত হলেন। তাঁর অভাবে সকলে অতিশয় কষ্টে পড়ল, ঋষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে শাপের বিষয় জানালেন এবং বললেন, অগ্নির অন্তর্ধানে আমাদের ক্রিয়ালোপ হয়েছে; যিনি দেবগণের মুখ এবং যজ্ঞের অগ্রভাগ ভোজন করেন তিনি কি ক’রে সর্বভুক হ’তে পারেন? ব্রহ্মা মিষ্টবাক্যে অগ্নিকে বললেন, হুতাশন, তুমি ত্রিলোকের ধারয়িতা এবং ক্রিয়াকলাপের প্রবর্তক, ক্রিয়ালোপ করা তোমার উচিত নয়। তুমি সদা পবিত্র, সর্বশরীর দিয়ে তুমি সর্বভুক হবে না, তোমার গুহ্যদেশে যে শিখা আছে এবং তোমার যে ক্রব্যাদ (মাংসভক্ষক) শরীর আছে তাই সর্বভুক হবে। তুমি তেজঃস্বরূপ, মহর্ষি ভৃগু যে শাপ দিয়েছেন তা সত্য কর এবং তোমার মুখে যে আহুতি দেওয়া হবে তাই দেবগণের ও নিজের ভাগরূপে গ্রহণ কর। অগ্নি বললেন, তাই হবে। তখন সকলে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ নিজ স্থানে চ’লে গেলেন।
৫। রুরু-প্রমদ্বরা--ডুণ্ডুভ
ভৃগুপুত্র চ্যবনের পত্নীর নাম সুকন্যা, তাঁর গর্ভে প্রমতি জন্মগ্রহণ করেন। প্রমতির ঔরসে ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামক পুত্র উৎপন্ন হন। এই বুরুর কথা এখন বলব।
স্থূলকেশ নামে খ্যাত সর্বভূতহিতে রত এক মহর্ষি ছিলেন। গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর সহিত সহবাসে মেনকা গর্ভবতী হন। সেই নির্দয়া নির্লজ্জা অপ্সরা নদীতীরে তাঁর কন্যাসন্তানকে পরিত্যাগ করেন। মহর্ষি স্থূলকেশ দেবকন্যার ন্যায় কান্তিমতী সেই কন্যাটিকে দেখতে পেয়ে তাকে নিজের আশ্রমে এনে পালন করতে লাগলেন। এই কন্যা স্বভাবে রূপে গুণে সকল প্রমদার শ্রেষ্ঠ সেজন্য মহর্ষি তার নাম রাখলেন—প্রমদ্বরা। রুরু সেই কন্যাকে দেখে মোহিত হলেন। তাঁর পিতা প্রমতির অনুরোধে স্থূলকেশও কন্যাদান করতে সম্মত হলেন।
কিছুদিন পরে বিবাহকাল আসন্ন হ’ল। প্রমদ্বরা তাঁর সখীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে দুর্দৈবক্রমে একটি সুপ্ত সর্পের দেহে পা দিয়ে ফেললেন। সর্পের দংশনে প্রমদ্বরা বিবর্ণ বিগতশ্রী ও হতচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। স্থূলকেশ এবং অন্যান্য ঋষিরা দেখলেন পদ্মকান্তি সেই বালা নিস্পন্দ হয়ে প’ড়ে আছেন। প্রমতি ও বনবাসী অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ সেখানে এসে কাঁদতে লাগলেন। শোকার্ত রুরু গহন বনে গিয়ে করুণস্বরে বিলাপ করতে করতে বললেন, যদি আমি দান তপস্যা ও গুরুজনের সেবা ক’রে থাকি, যদি জন্মাবধি ব্রতপালন করে থাকি, কৃষ্ণ বিষ্ণু হষীকেশে যদি আমার অচলা ভক্তি থাকে, তবে আমার প্রিয়া এখনই জীবনলাভ করুন।
রুরুর বিলাপ শানে দেবতারা কৃপান্বিত হয়ে একজন দূত পাঠালেন। এই দেবদূত রুরুকে বললেন, বৎস, এই কন্যার আয়ু শেষ হয়েছে, তুমি বৃথা শোক ক’রো না। তবে দেরতারা একটি উপায় নির্দিষ্ট করেছেন, তা যদি করতে পার তবে প্রমদ্বরাকে ফিরে পাবে। রুরু বললেন, হে আকাশচারী, বলুন সেই উপায় কি, আমি তাই করব। দেবদূত বললেন, এই কন্যাকে তোমার আয়ুর অর্ধ দান কর, তা হলেই সে জীবিত হবে। রুরু বললেন, আমি অর্ধ আয়ু দিলাম, আমার প্রিয়া সৌন্দর্যময়ী ও সালংকারা হয়ে উত্থান করুন।
প্রমদ্বরার পিতা গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু দেবদূতের সঙ্গে যমের কাছে গিয়ে বললেন, ধর্মরাজ, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে মৃতা প্রমদ্বরা রুরুর অর্ধ আয়ু নিয়ে বেঁচে উঠুক। যম বললেন, তাই হ’ক। তখন বরবর্ণিনী প্রমদ্বরা যেন নিদ্রা থেকে গাত্রোত্থান করলেন। প্রমতি ও স্থূলকেশ মহানন্দে বরকন্যার বিবাহ দিলেন।
রুরু অত্যন্ত কোপান্বিত হয়ে সর্পকুল বিনষ্ট করবার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং যথাশক্তি সকলপ্রকার সর্পই বধ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ ডুণ্ডুভ (ঢোঁড়া সাপ) শুয়ে আছে। রুরু তখনই তাকে দণ্ডাঘাতে মারতে গেলেন। ডুণ্ডুভ বললে, তপোধন, আমি কোনও অপরাধ করি নি, তবে কেন আমাকে মারতে চান? রুরু বললেন, আমার প্রাণসমা ভার্যাকে সাপে কামড়েছিল, সেজন্য প্রতিজ্ঞা করেছি সাপ দেখলেই মারব। ডুণ্ডুভ বললে, যারা মানুষকে দংশন করে তারা অন্যজাতীয়, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে ডুণ্ডুভ বধ করতে পারেন না। রুরু জিজ্ঞাসা করলেন, ডুণ্ডুভ, তুমি কে? ডুণ্ডুভ উত্তর দিলে, পূর্বে আমি সহস্রপাৎ নামে ঋষি ছিলাম। খগম নামে এক ব্রাহ্মণ আমার সখা ছিলেন, তাঁর বাক্য অব্যর্থ। একদিন তিনি অগ্নিহোত্রে নিযুক্ত ছিলেন সেই সময়ে আমি বালসুলভ খেলার ছলে একটি তৃণনির্মিত সর্প নিয়ে ভয় দেখিয়েছিলাম, তাতে তিনি মূর্ছিত হন। সংজ্ঞালাভ করে তিনি সক্রোধে বললেন, আমাকে ভয় দেখাবার জন্য তুমি যেমন নির্বিষ সপ নির্মাণ করেছ, আমার শাপে তুমিও সেইরূপ হবে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে সখা জ্ঞান ক’রে এই পরিহাস করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন, শাপ প্রত্যাহার করুন। খগম বললেন, যা বলেছি তা মিথ্যা হবে না, তবে আমার এই কথা শুনে রাখ—প্রমতির পুত্র রুরুর দর্শন পেলে তুমি শাপমুক্ত হবে। তুমি সেই রুরু, আজ আমি পূর্বরূপ ফিরে পাব।
ঋষি সহস্রপাৎ ডুণ্ডুভরূপ ত্যাগ করলেন এবং তেজোময় পূর্বরূপ লাভ ক’রে রুরুকে বললেন,
অহিংসা পরমোধর্মঃ সর্বপ্রাণভৃতাং স্মৃতঃ॥
তস্মাৎ প্রাণভৃতঃ সর্বান্ ন হিংস্যাদ্ ব্রাহ্মণঃ ক্বচিৎ।
ব্রাহ্মণঃ সৌম্য এবেহ ভবতীতি পরা শ্রুতিঃ॥
বেদবেদাঙ্গবিৎ তাত সর্বভূতাভয়প্রদঃ।
অহিংসা সত্যবচনং ক্ষমা চেতি বিনিশ্চিতম্॥
ব্রাহণস্য পরো ধর্মো বেদানাং ধারণাপি চ।
ক্ষত্রিয়স্য হি যো ধর্মঃ সহি নেষ্যেত বৈ তব॥
—সর্ব প্রাণীর অহিংসাই পরম ধর্ম; অতএব ব্রাহ্মণ কখনও কোনও প্রাণীর হিংসা করবেন না। বৎস, এইরূপ শ্রুতিবাক্য আছে যে ব্রাহ্মণ শান্তমূর্তি বেদবেদাঙ্গবিৎ এবং সর্ব প্রাণীর অভয়দাতা হবেন, তাঁর পক্ষে অহিংসা, সত্যকথন, ক্ষমা ও বেদের ধারণাই পরম ধর্ম। ক্ষত্রিমের যে ধর্ম তা তোমার গ্রহণীয় নয়।
তার পর সহস্রপাৎ বললেন, দণ্ডদান, উগ্রতা ও প্রজাপালন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। পূর্বকালে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে সর্পসমূহ বিনষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তপোবলসম্পন্ন বেদবেদাঙ্গবিৎ দ্বিজশ্রেষ্ঠ আস্তীক ভীত সর্পগণকে পরিত্রাণ করেছিলেন।
রুরু সেই ইতিহাস জানতে চাইলে সহস্রপাৎ বললেন, আমি এখন যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছি, তুমি ব্রাহ্মণদের কাছে সব শুনতে পাবে। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রুরু তাঁকে চতুর্দিকে অন্বেষণ ক’রে পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লেন, তারপর আশ্রমে ফিরে এসে পিতার নিকট সর্পযজ্ঞের বৃত্তান্ত শুনলেন।