মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/আস্তীকপর্বাধ্যায়
॥আস্তীকপর্বাধ্যায়॥
৬। জরৎকারু মুনি—কদ্রু ও বিনতা—সমুদ্রমন্থন
শৌনক বললেন, তুমি জনমেজয়ের সম্পযজ্ঞ ও আস্তীকের ইতিহাস বল।
সৌতি বললেন।—আস্তীকের পিতার নাম জরৎকারু, তিনি মহাতপা ব্রহ্মচারী ঊর্দ্ধরেতা পরিব্রাজক ছিলেন। একদিন তিনি পর্যটন করতে করতে দেখলেন, কতকগুলি মানুষ উশীর (বেনা) তৃণ অবলম্বন ক’রে ঊর্ধ্বপাদ অধোমুখ হয়ে গর্তের উপর ঝুলছেন। জরৎকারুর প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা যাযাবর নামক ঋষি ছিলাম। জরৎকারু নামে আমাদের একটি পুত্র আছে, সেই মূঢ় কেবল তপস্যা করে, বিবাহ এবং সন্তান উৎপাদনের চেষ্টা তার নেই। আমরা অনাথ হয়ে বংশলোপের আশঙ্কায় পাপীর ন্যায় এই গর্তে লম্বমান রয়েছি। জরৎকারু বললেন, আপনারা আমারই পিতৃপুরুষ, বলুন কি করব। পিতৃগণ বললেন, বৎস, দারগ্রহণ ও সন্তান উৎপাদন কর, তাতেই আমাদের পরম মঙ্গল হবে। জরৎকারু বললেন, আমি নিজের জন্য বিবাহ বা ধনোপার্জন করব না, আপনাদের হিতের জন্যই দারগ্রহণ করব। যে কন্যার নাম আমার নামের সমান, যাকে তার আত্মীয়রা স্বেচ্ছায় দান করবে, তাকেই আমি ভিক্ষাস্বরূপ নেব।
জরৎকারউ বিবাহার্থী হয়ে ভ্রমণ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে ধীর ও উচ্চ কণ্ঠে তিনবার কন্যা ভিক্ষা করলেন। তখন বাসুকি তাঁর ভগিনীকে নিয়ে এসে বললেন, দ্বিজোত্তম, আপনি একে গ্রহণ করুন। কন্যার নাম আর নিজের নাম এক জেনে জরৎকারু তাঁকে বিবাহ করলেন। আস্তীক নামে তাঁদের এক পুত্র হ’ল, তিনিই সর্পগণকে ত্রাণ করেন এবং পিতৃগণকেও উদ্ধার করেন।
শৌনক বললেন, বৎস সৌতি, তোমার কথা অতি মধুর, আমরা আরও শুনতে ইচ্ছা করি। সৌতি বলতে লাগলেন।—
পুরাকালে সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতির কদ্রু ও বিনতা নামে দুই সলক্ষণা রূপবতী কন্যা ছিলেন, তাঁরা কশ্যপের ধর্মপত্নী। কশ্যপ তাঁদের বর দিতে ইচ্ছা করলে কদ্রু বললেন, তুল্যবলশালী সহস্র নাগ আমার পত্র হ’ক; বিনতা বললেন, আমাকে দুই পুত্র দিন যারা কদ্রুর পুত্রের চেয়েও বলবান ও তেজস্বী। কশ্যপ দুই পত্নীকেই অভীষ্ট বর দিলেন। যথাকালে কদ্রু এক সহস্র এবং বিনতা দুই ডিম্ব প্রসব করলেন। পাঁচ শ বৎসর পরে কদ্রুর প্রত্যেক ডিম্ব থেকে পুত্র নির্গত হ’ল। নিজের দুই ডিম্ব থেকে কিছুই বার হ’ল না দেখে বিনতা একটি ডিম্ব ভেঙে দেখলেন, তার মধ্যস্থ সন্তানের দেহের ঊর্ধ্বভাগ আছে কিন্তু নিম্নভাগ অপরিণত। সেই পুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে মাতাকে শাপ দিলেন, তোমার লোভের ফলে আমার দেহ অসম্পূর্ণ হয়েছে, তুমি পাঁচ শ বৎসর কদ্রুর দাসী হয়ে থাকবে। অন্য ডিম্বটিকে অসময়ে ভেঙো না, যথাকালে তা থেকে পুত্র নির্গত হয়ে তোমার দাসীত্ব মোচন করবে। এই কথা ব’লে তিনি আকাশে উঠলেন এবং অরুণরূপে সূর্যের সারথি হলেন। গরুড়ও যথাকালে জন্মগ্রহণ করলেন এবং জননী বিনতাকে ত্যাগ ক’রে ক্ষুধার্ত হয়ে আকাশে উড়লেন।
একদিন কদ্রু ও বিনতা দেখলেন, তাঁদের নিকট দিয়ে উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যাচ্ছে।[১] অমৃতমন্থনে উৎপন্ন এই অশ্বরত্নের প্রশংসা সকল দেবতাই করতেন।
শৌনক অমৃতমন্থনের বিবরণ শুনতে চাইলে সৌতি বললেন।—একদা দেবগণ সুমেরু পর্বতের শিখরে বসে অমৃতপ্রাপ্তির জন্য মন্ত্রণা করছিলেন। নারায়ণ ব্রহ্মাকে বললেন, দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হয়ে সমুদ্রমন্থন করুন, তা হ’লে অমৃত পাবেন। ব্রহ্মা ও নারায়ণের আদেশে নাগরাজ অনন্ত মন্দর পর্বত উৎপাটন করলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দেবতারা সমুদ্রতীরে গিয়ে বললেন, অমৃতের জন্য আমরা আপনাকে মন্থন করব। সমুদ্র বললেন, আমাকে অনেক মর্দন সইতে হবে, অমৃতের অংশ যেন আমি পাই।
দেবাসুরের অনুরোধে সাগরস্থ কূর্মরাজ মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করলেন, ইন্দ্র বজ্র দ্বারা পর্বতের নিম্নদেশ সমান করে দিলেন। তারপর মন্দরকে মন্থনদণ্ড এবং নাগরাজ বাসুকি (অনন্ত)কে রজ্জু ক’রে দেবাসুর সমুদ্র মন্থন করতে লাগলেন। অসুরগণ নাগরাজের শীর্ষদেশ এবং দেবগণ পুচ্ছ ধারণ করলেন। বাসুকির মুখ থেকে ধূম ও অগ্নিশিখার সহিত যে নিঃশ্বাসবায়ু নির্গত হ’ল তা মেঘে পরিণত হয়ে পরিশ্রান্ত দেবাসুরের উপর জলবর্ষণ করতে লাগল। সমুদ্র থেকে মেঘগর্জনের ন্যায় শব্দ উঠল, মন্দরের ঘর্ষণে বহু জলজন্তু নিষ্পিষ্ট হ’ল, পর্বতের বৃক্ষসকল পক্ষিসমেত নিপতিত হ’ল, বৃক্ষের ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে হস্তী সিংহ প্রভৃতি জন্তুকে দগ্ধ ক’রে ফেললে। নানাপ্রকার বৃক্ষের নির্যাস, ওষধির রস এবং কাঞ্চনদ্রব সমুদ্রজলে পড়ল। সেই সকল রসমিশ্রিত জল থেকে দুগ্ধ ও ঘৃত উৎপন্ন হ’ল।
তারপর মথ্যমান সাগর থেকে চন্দ্র উঠলেন এবং ঘৃত থেকে লক্ষ্মী, সুরা দেবী, শ্বেতবর্ণ—উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও নারায়ণের বক্ষের ভূষণ কৌস্তুভ মণির উদ্ভব হ’ল। সর্বকামনাপূরক পারিজাত এবং সুরভি ধেনুও উত্থিত হ’ল। লক্ষ্মী, সুরা দেবী, চন্দ্র ও উচ্চৈঃশ্রবা দেবগণের নিকট গেলেন। অনন্তর ধন্বন্তরি দেব অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ ‘আমার আমার’ ব’লে কোলাহল করতে লাগল। তারপর শ্বেতবর্ণ চতুর্দন্ত মহাকায় ঐরাবত উত্থিত হ’লে ইন্দ্র তাকে ধরলেন। অতিশয় মন্থনের ফলে কালকূট উঠল, সধূম অগ্নির ন্যায় সেই বিষে জগৎ ব্যাপ্ত হ’ল। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান মহেশ্বর সেই বিষ কণ্ঠে গ্রহণ করলেন, সেই থেকে তাঁর নাম নীলকণ্ঠ।
দানবগণ অমৃত ও লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতাদের সঙ্গে কলহ করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনী মায়ায় স্ত্রীরূপ ধারণ ক’রে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগণকে শ্রেণীবদ্ধ ক’রে বসিয়ে কমণ্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগণের প্রতি ধাবিত হ’ল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রূপ ধারণ ক’রে অমৃত পান করলে। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে সেই দানবের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুণ্ড আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগল, তার কবন্ধ (ধড়) ভূমিতে পড়ল, সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হ’ল। সেই অবধি চন্দ্রসূর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হ’ল।
বিষ্ণু স্ত্রীরূপ ত্যাগ ক’রে দেবগণের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘোর যুদ্ধ করলেন। দানবগণ পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল।
৭। কদ্রু-বিনতার পণ—গরুড়—গজকচ্ছপ—অমৃতহরণ
একদিন উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখে কদ্রু ও বিনতা তর্ক করলেন, এই অশ্বের বর্ণ কি। বিনতা বললেন, শ্বেত; কদ্রু বললেন, এর পুচ্ছলোম কৃষ্ণ। অবশেষে এই পণ স্থির হ’ল যে কাল তাঁরা অশ্বটিকে ভাল ক’রে দেখবেন এবং যাঁর কথা মিথ্যা হবে তিনি সপত্নীর দাসী হবেন।
কদ্রু তাঁর সর্প পুত্রদের ডেকে বললেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে ওই অশ্বের পুচ্ছে লগ্ন হও, যাতে তা কজ্জলবর্ণ দেখায়। যে সর্পরা সম্মত হ’ল না কদ্রু তাদের শাপ দিলেন, তোমরা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হবে। পরদিন প্রভাতে কদ্রু ও বিনতা আকাশপথে সমূদ্রের পরপারে গেলেন। উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ লোম দেখে বিনতা বিষণ্ণ হলেন এবং কদ্রু তাঁকে দাসীত্বে নিযুক্ত করলেন।
এই সময়ে বিনতার দ্বিতীয় ডিম্ব বিদীর্ণ ক’রে মহাবল গরুড় বহির্গত হলেন এবং অগ্নিরাশির ন্যায় তেজোময় বিশাল দেহ ধারণ ক’রে আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগলেন। তারপর তিনি সমুদ্রের পরপারে মাতার নিকট গেলেন। কদ্রু বিনতাকে বললেন, সমুদ্রের মধ্যে এক সুরম্য নাগালয় আছে, সেখানে আমাকে নিয়ে চল। বিনতা কদ্রুকে এবং গরুড় তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা সর্পগণকে বহন ক’রে নিয়ে চললেন। সূর্যতাপে পুত্ররা কষ্ট পাচ্ছে দেখে কদ্রু ইন্দ্রের স্তব করলেন, ইন্দ্রের আদেশে মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হ’ল। সর্প সকল হৃষ্ট হয়ে গরুড়ের পিঠে চ’ড়ে এক রমণীয় দ্বীপে এল। তারা গরুড়কে বললে, আমাদের অন্য এক দ্বীপে নিয়ে চল যেখানে নির্মল জল আছে। গরুড় বিনতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদের আজ্ঞানসারে আমাকে চলতে হবে কেন? বিনতা জানালেন যে কদ্রু কপট উপায়ে তাঁকে পণে পরাজিত ক’রে দাসীত্বে নিযুক্ত করেছেন। গরুড় দুঃখিত হয়ে সর্পদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলে আমরা দাসত্ব থেকে মুক্ত হ’তে পারি? সর্পরা বললে, যদি নিজ বীর্যবলে অমৃত আনতে পার তবে মুক্তি পাবে।
গরুড় বিনতাকে বললেন, আমি অমৃত আনতে যাচ্ছি, পথে কি খাব? বিনতা বললেন, সমুদ্রের এক প্রান্তে বহু সহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি সেই নির্দয় দুরাত্মাদের খেয়ো কিন্তু ব্রাহ্মণদের কখনও হিংসা ক’রো না। গরুড় আকাশমার্গে যাত্রা ক’রে নিষাদালয়ে উপস্থিত হলেন এবং মুখব্যাদান ক’রে নিষাদগণকে গ্রাস করতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীর সঙ্গে গরুড়ের কণ্ঠে প্রবেশ করেছিলেন। দীপ্ত অঙ্গারের ন্যায় দাহ বোধ হওয়ায় গরুড় বললেন, দ্বিজোত্তম, তুমি শীঘ্র নির্গত হও, ব্রাহ্মণ পাপী হ’লেও আমার ভক্ষ্য নয়। ব্রাহ্মণ বললেন, তবে আমার নিষাদী ভার্যাকেও ছেড়ে দাও। গরুড় বললেন, আপনি তাঁকে নিয়ে শীঘ্র বেরিয়ে আসুন, যেন আমার জঠরানলে জীর্ণ না হন। ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক নির্গত হয়ে গরুড়কে আশীর্বাদ ক’রে প্রস্থান করলেন।
তারপর গরুড় তাঁর পিতা মহর্ষি কশ্যপের কাছে গেলেন। কশ্যপ কুশল প্রশ্ন করলে গরুড় বললেন, আমি মাতার দাসীত্ব মোচনের জন্য অমৃত আনতে যাচ্ছি, কিন্তু আমি প্রচুর খাদ্য পাই না, আপনি আমার ক্ষৎপিপাসানিবৃত্তির উপায় বলুন।
কশ্যপ বললেন, বিভাবসু নামে এক কোপনস্বভাব মহর্ষি ছিলেন, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুপ্রতীক ধনবিভাগের জন্য বার বার অনুরোধ করতেন। একদিন বিভাবসু বললেন, যে ভ্রাতারা গুরু ও শাস্ত্র মানে না তারাই পরস্পরকে শত্রু ভেবে শঙ্কিত হয়; সাধুলোকে ধনবিভাগের প্রশংসা করেন না। তুমি আমার নিষেধ শুনবে না, ভিন্ন হয়ে ধনশালী হতে চাও, অতএব আমার শাপে তুমি হস্তী হও। সুপ্রতীকও জ্যেষ্ঠকে শাপ দিলেন, তুমি কচ্ছপ হও। বৎস গরুড়, ওই যে সরোবর দেখছ ওখানে দুই ভ্রাতা গজকচ্ছপ রূপে পরস্পরকে আক্রমণ করছে। তুমি ওই মহাগিরিতুল্য গজ এবং মহামেঘতুল্য কচ্ছপ ভোজন কর।
এক নখে গজ আর এক নখে কচ্ছপকে তুলে নিয়ে গরুড় অলম্ব তীর্থে গেলেন। সেখানকার বৃক্ষসকল শাখাভঙ্গের ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটি বিশাল দিব্য বটবৃক্ষ গরুড়কে বললে, আমার শতযোজন আয়ত মহাশাখায় বসে তুমি গজকচ্ছপ ভোজন কর। গরুড় বসবামাত্র মহাশাখা ভেঙে গেল। বালখিল্য মুনিগণ সেই শাখা থেকে অধোমুখে ঝুলছেন দেখে গরুড় সন্ত্রস্ত হয়ে চঞ্চুদ্বারা শাখাটি ধ’রে ফেললেন এবং বহু দেশে বিচরণ ক’রে অবশেষে গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন। কশ্যপ সেখানে তপস্যা করছিলেন। তিনি পুত্রের অনিষ্টবারণের জন্য বালখিল্যগণকে বললেন, তপোধনগণ, লোকের হিতের নিমিত্ত গরুড় মহৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছে, আপনারা তাকে অনুমতি দিন। তখন বালখিল্যগণ শাখা ত্যাগ ক’রে হিমালয়ে তপস্যা করতে গেলেন। গরুড় শাখা মুখে ক’রে বিকৃতস্বরে পিতাকে বললেন, ভগবান, মানুষবর্জিত এমন স্থান বলুন যেখানে এই শাখা ফেলতে পারি। কশ্যপ একটি তুষারময় জনশূন্য পর্বতের কথা বললেন। গরুড় সেখানে গিয়ে শাখা ত্যাগ করলেন এবং পর্বতশৃঙ্গে ব’সে গজকচ্ছপ ভোজন করলেন।
ভোজন শেষ ক’রে গরুড় মহাবেগে উড়ে চললেন। অশুভসূচক নানাপ্রকার প্রাকৃতিক উপদ্রব দেখে ইন্দ্রাদি দেবগণ ভীত হলেন। বৃহস্পতি বললেন, কশ্যপ-বিনতার পত্র কামরূপী গরুড় অমৃত হরণ করতে আসছে। তখন দেবতারা নানাবিধ অস্ত্র ধারণ ক’রে অমৃতরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। গরুড়কে দেখে দেবগণ ভয়ে কম্পিত হয়ে পরস্পরকে অস্ত্রাঘাত করতে লাগলেন। বিশ্বকর্মা অমৃতের রক্ষক ছিলেন, তিনি গরুড়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ ক’রে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভূপতিত হলেন। গরুড়ের পক্ষের আন্দোলনে ধূলি উড়ে দেবলোক অন্ধকারাচ্ছন্ন হলে, বায়ু সেই ধূলি অপসারিত করলেন। ইন্দ্রাদি দেবতাদের সঙ্গে গরুড়ের তুমুল যুদ্ধ হ’তে লাগল। পরিশেষে গরুড় জয়ী হলেন এবং স্বর্ণময় ক্ষুদ্র দেহ ধারণ ক’রে অমৃতরক্ষাগারে প্রবেশ করলেন।
গরুড় দেখলেন, অমৃতের চতুর্দিকে অগ্নিশিখা জ্বলছে, তার নিকটে একটি ক্ষুরধার লৌহচক্র নিরন্তর ঘুরছে। তিনি তাঁর দেহ সংকুচিত ক’রে চক্রের অরের অন্তরাল দিয়ে প্রবেশ ক’রে দেখলেন, অমৃত রক্ষার জন্য দুই ভয়ংকর সর্প চক্রের নিম্নদেশে রয়েছে। গরুড় তাদের বধ ক’রে অমৃত নিয়ে আকাশে এসে বিষ্ণুর দর্শন পেলেন। গরুড় অমৃতপানের লোভ সংবরণ করেছেন দেখে বিষ্ণু প্রীত হয়ে বললেন, তোমাকে বর দেব। গরুড় বললেন, আমি তোমার উপরে থাকতে এবং অমৃতপান না ক’রেই অজর অমর হ’তে ইচ্ছা করি। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। তখন গরুড় বললেন, ভগবান, তুমিও আমার কাছে বর চাও। বিষ্ণু বললেন, তুমি আমার বাহন হও, আমার রথধ্বজের উপরেও থেকো। গরুড় তাই হবে ব’লে মহাবেগে প্রস্থান করলেন।
তখন ইন্দ্র তাঁকে বজ্রাঘাত করলেন। গরুড় সহাস্যে বললেন, শতক্রতু, দধীচি মুনি, তাঁর অস্থিজাত বজ্র, এবং তোমার সম্মানের নিমিত্ত আমি একটি পালক ফেলে দিলাম, তোমার বজ্রপাতে আমার কোনও ব্যথা হয় নি। গরুড়ের নিক্ষিপ্ত সেই সুন্দর পালক দেখে সকলে আনন্দিত হয়ে তাঁর নাম দিলেন ‘সুপর্ণ’। ইন্দ্র তাঁর সঙ্গে সখ্য স্থাপন ক’রে বললেন, যদি তোমার অমৃতে প্রয়োজন না থাকে তবে আমাকে ফিরিয়ে দাও, কারণ তুমি যাদের দেবে তারাই আমাদের উপর উপদ্রব করবে। গরুড় বললেন, কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে আমি অমৃত নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমি রাখব সেখান থেকে তুমি হরণ ক’রো। ইন্দ্র তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে গরুড় বললেন, মহাবল সর্পগণ আমার ভক্ষ্য হ’ক। ইন্দ্র বললেন, তাই হবে।
তার পর গরুড় বিনতার কাছে এলেন এবং সর্পভ্রাতাদের বললেন, আমি অমৃত এনেছি, এই কুশের উপর রাখছি, তোমরা স্নান ক’রে এসে খেয়ো। এখন তোমাদের কথা রাখ, আমার মাতাকে দাসীত্ব থেকে মুক্ত কর। তাই হ’ক বলে সর্পরা স্নান করতে গেল, সেই অবসরে ইন্দ্র অমৃত হরণ করলেন। সর্পের দল ফিরে এসে ‘আমি আগে, আমি আগে’ ব’লে অমৃত খেতে গেল, কিন্তু না পেয়ে কুশ চাটতে লাগল, তার ফলে তাদের জিহ্বা দ্বিধা বিভক্ত হ’ল।
৮। আস্তীকের জন্ম—পরীক্ষিতের মৃত্যুবিবরণ
শৌনক বললেন, কদ্রুর অভিশাপ[২] শুনে তাঁর পুত্রেরা কি করেছিল বল।
সৌতি বললেন।—ভগবান শেষ নাগ (অনন্ত, বাসুকি) কদ্রুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি মাতার অভিশাপের পর নানা পবিত্র তীর্থে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁর কাছে এসে বললেন, তোমার কি কামনা তা বল। শেষ উত্তর দিলেন, আমার সহোদরগণ অতি মন্দমতি, তারা আমার বৈমাত্র ভ্রাতা গরুড়কে দ্বেষ করে। আমি পরলোকেও সহোদরদের সংসর্গ চাই না, সেজন্য তপস্যায় প্রাণ বিসর্জন দেব। ব্রহ্মা বললেন, আমি তোমার ভ্রাতাদের আচরণ জানি। ভাগ্যক্রমে তোমার ধর্মবুদ্ধি হয়েছে, তুমি আমার আদেশে এই শৈল-বন-সাগর-জনপদাদি-সমন্বিত চঞ্চল পৃথিবীকে নিশ্চল ক’রে ধারণ কর। শেষ নাগ পাতালে গিয়ে মস্তক দ্বারা পৃথিবা ধারণ করলেন, ব্রহ্মার ইচ্ছায় গরুড় তাঁর সহায় হলেন। পাতালবাসী নাগগণ তাঁকে বাসুকিরূপে নাগরাজপদে অভিষিক্ত করলেন।
মাতৃপ্রদত্ত শাপ খণ্ড করবার জন্য বাসুকি তাঁর ধার্মিক ভ্রাতাদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। নাগগণ অনেক প্রকার উপায় নির্দেশ করলেন কিন্তু বাসুকি কোনওটিতে সম্মত হলেন না। তখন এলাপত্র নামে এক নাগ বললেন, আমাদের মাতা যখন অভিশাপ দেন তখন আমি তাঁর ক্রোড়ে ব’সে শুনেছিলাম—ব্রহ্মা দেবগণকে বলছেন, তপস্বী পরিব্রাজক জরৎকারুর ঔরসে বাসুকির ভগিনী[৩] জরৎকারুর গর্ভে আস্তীক নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তিনিই ধার্মিক সর্পগণকে রক্ষা করবেন।
তারপর বাসুকি বহু অন্বেষণের পর মহর্ষি জরৎকারুকে পেয়ে তাঁকে ভগিনী সম্প্রদান করলেন। সেই ধার্মিক তপস্বী বাসুকির প্রদত্ত রমণীয় গৃহে সস্ত্রীক বাস করতে লাগলেন। তিনি ভার্যাকে বললেন, তুমি কদাচ আমার অপ্রিয় কিছু করবে না, যদি কর তবে এই বাসগৃহ আর তোমাকে ত্যাগ করব। বাসুকির ভগিনী তাতেই সম্মত হলেন এবং শ্বেতকাকী[৪]র ন্যায় পতির সেবা করে যথাকালে গর্ভবতী হলেন। একদিন মহর্ষি তাঁর ক্রোড়ে মস্তক রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন এমন সময় সূর্যাস্তকাল উপস্থিত হ’ল। পাছে সন্ধ্যাকৃত্যের কাল উত্তীর্ণ হয় এই আশঙ্কায় তিনি মৃদুস্বরে স্বামীকে জাগালেন। মহর্ষি বললেন, নিদ্রাভঙ্গ করে তুমি আমার অবমাননা করেছ, তোমার কাছে আর আমি থাকব না। আমি যতক্ষণ সুপ্ত থাকি ততক্ষণ সূর্যের অস্ত যাবার ক্ষমতা নেই। অনেক অনুনয় করলেও তিনি তাঁর বাক্য প্রত্যাহার করলেন না, যাবার সময় পত্নীকে ব’লে গেলেন, ভাগ্যবতী, তোমার গর্ভে অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরম ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আছেন।
যথাকালে বাসুকিভগিনীর দেবকুমার তুল্য এক পুত্র হ’ল। এই পুত্র চ্যবনতনয় প্রমতির কাছে বেদাধ্যয়ন করলেন। মহর্ষি জরৎকারু চ’লে যাবার সময় তাঁর পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানকে লক্ষ্য ক’রে ‘অস্তি’ (আছে) বলেছিলেন সেজন্য তাঁর পুত্র আস্তীক নামে খ্যাত হলেন।
শৌনক জিজ্ঞাসা করলেন, জনমেজয় তাঁর পিতার মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানতে চাইলে মন্ত্রীরা তাঁকে কি বলেছিলেন?
সৌতি বললেন, জনমেজয়ের মন্ত্রীরা এই ইতিহাস বলেছিলেন।—অভিমন্যু-উত্তরার পুত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ কৃপাচার্যের শিষ্য এবং গোবিন্দের প্রিয় ছিলেন। ষাট বৎসর বয়স পর্যন্ত রাজত্ব করার পর দুরদৃষ্টক্রমে তাঁর প্রাণনাশ হয়। তিনি প্রপিতামহ পাণ্ডুর ন্যায় মহাবীর ও ধনুর্ধর ছিলেন। একদা পরীক্ষিৎ মৃগয়া করতে গিয়ে একটি মৃগকে বাণবিদ্ধ ক’রে তার অনুসরণ করলেন এবং পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে গহন বনে শমীক নামক এক মুনিকে দেখতে পেলেন। রাজা মৃগ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে মুনি উত্তর দিলেন না, কারণ তিনি তখন মৌনব্রতধারী ছিলেন। পরীক্ষিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে একটা মৃত সর্প ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে তুলে মুনির স্কন্ধে পরিয়ে দিলেন। মনি কিছুই বললেন না, ক্রোধও প্রকাশ করলেন না। রাজা তখন নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।
শমীক মুনির শৃঙ্গী নামে এক তেজস্বী ক্রোধী পুত্র ছিলেন, তিনি তাঁর আচার্যের গৃহ থেকে ফেরবার সময় কৃশ নামক এক বন্ধুর কাছে শুনলেন, রাজা পরীক্ষিৎ তাঁর তপোরত পিতাকে কিরূপে অপমান করেছেন। শৃঙ্গী ক্রোধে যেন প্রদীপ্ত হয়ে এই অভিশাপ দিলেন, আমার নিরপরাধ পিতার স্কন্ধে যে মৃত সর্প দিয়েছে সেই পাপীকে সপ্ত রাত্রির মধ্যে মহাবিষধর তক্ষক নাগ দগ্ধ করবে। শৃঙ্গী তাঁর পিতার নিকট গিয়ে শাপের কথা জানালেন। শমীক বললেন, বৎস, আমরা পরীক্ষিতের রাজ্যে বাস করি, তিনি আমাদের রক্ষক, তাঁর অনিষ্ট আমি চাই না। তিনি ক্ষুধিত ও শ্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, আমার মৌনব্রত না জেনেই এই কর্ম করেছেন। পউত্র, তাঁকে অভিশাপ দেওয়া উচিত হয়নি। শৃঙ্গী বললেন, পিতা, আমি যদি অন্যায়ও ক’রে থাকি তথাপি আমার শাপ মিথ্যা হবে না।
গৌরমুখ নামক এক শিষ্যকে শমীক পরীক্ষিতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। গুরুর উপদেশ অনুসারে গৌরমুখ বললেন, মহারাজ, মৌনব্রতী শমীকের স্কন্ধে আপনি মৃত সর্প রেখেছিলেন, তিনি সেই অপরাধ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তাঁর পুত্র ক্ষমা করেন নি, তাঁর শাপে সপ্ত রাত্রির মধ্যে তক্ষক আপনার প্রাণহরণ করবে। শমীক বার বার ব’লে দিয়েছেন আপনি যেন আত্মরক্ষায় যত্নবান হন।
পরীক্ষিৎ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি একটিমাত্র স্তম্ভের উপর সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করালেন এবং বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণকে নিযুক্ত করলেন। তিনি সেখানে থেকেই মন্ত্রীদের সাহায্যে রাজকার্য করতে লাগলেন, অন্য কেউ তাঁর কাছে আসতে পারত না। সপ্তম দিনে কাশ্যপ নামে এক ব্রাহ্মণ বিষচিকিৎসার জন্য রাজার কাছে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে তক্ষক তাঁকে বললে, আপনি এত দ্রুত কোথায় যাচ্ছেন? কাশ্যপ বললেন, আজ তক্ষক নাগ পরীক্ষিৎকে দংশন করবে, আমি গুরুর কৃপায় বিষ নষ্ট করতে পারি, রাজাকে সদ্য সদ্য নিরাময় করব। তক্ষক বললে, আমিই তক্ষক, এই বটবৃক্ষে দংশন করছি, আপনার মন্ত্রবল দেখান।
তক্ষকের দংশনে বটবৃক্ষ জ্ব’লে গেল। কাশ্যপের মন্ত্রশক্তিতে ভস্মরাশি থেকে প্রথমে অঙ্কুর, তারপর দুটি পল্লব, তারপর বহু পত্র ও শাখাপ্রশাখা উদ্ভূত হ’ল। তক্ষক বললে, তপোধন, আপনি কিসের প্রার্থী হয়ে রাজার কাছে যাচ্ছেন? ব্রাহ্মণের শাপে তাঁর আয়ু ক্ষয় পেয়েছে, আপনি তাঁর চিকিৎসায় কৃতকার্য হবেন কিনা সন্দেহ। রাজার কাছে আপনি যত ধন আশা করেন তার চেয়ে বেশী আমি দেব, আপনি ফিরে যান। কাশ্যপ ধ্যান ক’রে জানলেন যে পরীক্ষিতের আয়ু শেষ হয়েছে, তিনি তক্ষকের কাছে অভীষ্ট ধন নিয়ে চলে গেলেন।
তক্ষকের উপদেশে কয়েকজন নাগ তপস্বী সেজে ফল কুশ আর জল নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে গেল। রাজা সেই সকল উপহার নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন এবং অমাত্য-সুহৃদ্গণের সঙ্গে ফল খাবার উপক্রম করলেন। তাঁর ফলে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট দেখে রাজা তা হাতে ধ’রে সচিবদের বললেন, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার দুঃখ বা ভয় নেই, শৃঙ্গীর বাক্য সত্য হ’ক, এই কীট তক্ষক হয়ে আমাকে দংশন করুক। এই ব’লে তিনি নিজের কণ্ঠদেশে সেই কীট রেখে হাসতে লাগলেন। তখন কীটরূপী তক্ষক নিজ মূর্তি ধ’রে রাজাকে বেষ্টন করলে এবং সগর্জনে তাঁকে দংশন করলে। মন্ত্রীরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তার পর তাঁরা দেখলেন, পদ্মবর্ণ তক্ষক আকাশে যেন সীমন্তরেখা বিস্তার ক’রে চলেছে। বিষের অনলে রাজার গৃহ আলোকিত হ’ল, তিনি বজ্রাহতের ন্যায় প’ড়ে গেলেন।
পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর রাজপুরোহিত এবং মন্ত্রীরা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাঁর শিশুপুত্র জনমেজয়কে রাজা করলেন। যথাকালে কাশীরাজ সুবর্ণবর্মার কন্যা বপুষ্টমার সঙ্গে জনমেজয়ের বিবাহ হ’ল। তিনি অন্য নারীর প্রতি মন দিতেন না, পতিব্রতা রূপবতী বপুষ্টমার সঙ্গে মহানন্দে কালযাপন করতে লাগলেন।
৯। জনমেজয়ের সর্পসত্র
মন্ত্রীদের কাছে পিতার মৃত্যুবিবরণ শুনে জনমেজয় অত্যন্ত দুঃখে অশ্রু মোচন করতে লাগলেন, তার পর জলম্পর্শ ক’রে বললেন, যে দুরাত্মা তক্ষক আমার পিতার প্রাণহিংসা করেছে তার উপর আমি প্রতিশোধ নেব। তিনি পুরোহিতদের প্রশ্ন করলেন, আপনারা এমন ক্রিয়া জানেন কি যাতে তক্ষককে সবান্ধবে প্রদীপ্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা যায়? পরোহিতরা বললেন, মহারাজ, সর্পসত্র নামে এক মহাযজ্ঞ আছে, আমরা তার পদ্ধতি জানি।
রাজার আজ্ঞায় যজ্ঞের আয়োজন হ’তে লাগল। যজ্ঞস্থান মাপবার সময় একজন পুরাণকথক সূত বললে, কোনও ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞের ব্যাঘাত করবেন। জনমেজয় দ্বারপালকে বললেন, আমার অজ্ঞাতসারে কেউ যেন এখানে না আসে। অনন্তর যথাবিধি সর্পসত্র আরম্ভ হ’ল। কৃষ্ণবসনধারী যাজকগণ ধূমে রক্তলোচন হয়ে সর্পগণকে আহ্বান ক’রে অগ্নিতে আহুতি দিতে লাগলেন। নানাজাতীয় নানাবর্ণ অসংখ্য সর্প অগ্নিতে প’ড়ে বিনষ্ট হ’ল।
তক্ষক নাগ আশ্রয়ের জন্য ইন্দ্রের কাছে গেল। ইন্দ্র বললেন, তোমার ভয় নেই, এখানেই থাক। স্বজনবর্গের মৃত্যুতে কাতর হয়ে বাসুকি তাঁর ভগিনীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি তোমার পুত্রকে বল যেন আমাদের সকলকে রক্ষা করে। তখন জরৎকারু আস্তীককে পূর্ব ইতিহাস জানিয়ে বললেন, হে অমরতুল্য পত্র, তুমি আমার ভ্রাতা ও আত্মীয়বর্গকে যজ্ঞাগ্নি থেকে রক্ষা কর। আস্তীক বললেন, তাই হবে, আমি নাগরাজ বাসুকিকে তাঁর মাতৃদত্ত শাপ থেকে রক্ষা করব।
আস্তীক যজ্ঞস্থানে গেলেন, কিন্তু দ্বারপাল তাঁকে প্রবেশ করতে দিলে না। তখন তিনি স্তুতি করতে লাগলেন—পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয়, তুমি ভরতবংশের প্রধান, তোমার এই যজ্ঞ প্রয়াগে অনুষ্ঠিত চন্দ্র, বরুণ ও প্রজাপতির যজ্ঞের তুল্য; আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়। ইন্দ্রের শত যজ্ঞ, যম রন্তিদেব কুবের ও দাশরথি রামের যজ্ঞ, এবং যুধিষ্ঠির কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রভৃতির যজ্ঞ যেরূপ, তোমার এই যজ্ঞও সেইরূপ; আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়। তোমার তুল্য প্রজাপালক রাজা জীবলোকে নেই, তুমি বরুণ ও ধর্মরাজের তুল্য। তুমি যমের ন্যায় ধর্মজ্ঞ, কৃষ্ণের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন।
আস্তীকের স্তুতি শুনে জনমেজয় বললেন, ইনি অল্পবয়স্ক হ’লেও বৃদ্ধের ন্যায় কথা বলছেন, এঁকে বর দিতে চাই। রাজার সদস্যগণ বললেন, এই ব্রাহ্মণ সম্মান ও বরলাভের যোগ্য, কিন্তু যাতে তক্ষক শীঘ্র আসে আগে সেই চেষ্টা করুন। আগন্তুক ব্রাহ্মণকে রাজা বর দিতে চান দেখে সর্পসত্রের হোতা চণ্ডভার্গবও প্রীত হলেন না। তিনি বললেন, এই যজ্ঞে এখনও তক্ষক আসে নি। ঋত্বিগ্গণ বললেন, আমরা বুঝতে পারছি তক্ষক ভয় পেয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তখন রাজার অনুরোধে হোতৃগণ ইন্দ্রকে আহ্বান করলেন। ইন্দ্র বিমানে চ’ড়ে যজ্ঞস্থানে যাত্রা করলেন, তক্ষক তাঁর উত্তরীয়ে লুকিয়ে রইল। জনমেজয় ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তক্ষক যদি ইন্দ্রের কাছে থাকে তবে ইন্দ্রের সঙ্গেই তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করুন।
ইন্দ্র যজ্ঞস্থানের নিকটে এসে ভয় পেলেন এবং তক্ষককে ত্যাগ ক’রে পালিয়ে গেলেন। তক্ষক মন্ত্রপ্রভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে আকাশপথে যজ্ঞাগ্নির অভিমুখে আসতে লাগল। ঋত্বিগ্গণ বললেন, মহারাজ, ওই তক্ষক ঘুরতে ঘুরতে আাসছে, তার মহাগর্জন শোনা যাচ্ছে। আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, এখন ওই ব্রাহ্মণকে বর দিতে পারেন। রাজা আস্তীককে বললেন, বালক, তুমি সুপণ্ডিত, তোমার অভিপ্রেত বর চাও। আস্তীক তক্ষকের উদ্দেশে বললেন, তিষ্ঠ তিষ্ঠ তিষ্ঠ; তক্ষক আকাশে স্থির হয়ে রইল। তখন আম্ভীক রাজাকে বললেন, জনমেজয়, এই যজ্ঞ এখনই নিবৃত্ত হ’ক, অগ্নিতে আর যেন সর্প না পড়ে। জনমেজয় অপ্রীত হয়ে বললেন, ব্রাহ্মণ, সুবর্ণ রজত ধেনু যা চাও দেব, কিন্তু আমার যজ্ঞ যেন নিবৃত্ত না হয়। রাজা এইরূপে বার বার অনুরোধ করলেও আস্তীক বললেন, আমি আর কিছুই চাই না, আপনার যজ্ঞ নিবৃত্ত হ’ক, আমার মাতৃকুলের মঙ্গল হ’ক। তখন সদস্যগণ সকলে রাজাকে বললেন, এই ব্রাহ্মণকে বর দিন।
আস্তীক তাঁর অভীষ্ট বর পেলেন, যজ্ঞ সমাপ্ত হ’ল, রাজাও প্রীতিলাভ ক’রে ব্রাহ্মণগণকে বহু অর্থ দান করলেন। তিনি আস্তীককে বললেন, তুমি আমার অশ্বমেধ যজ্ঞে সদস্যরূপে আাবার এসো। আস্তীক সম্মত হয়ে মাতুলালয়ে ফিরে গেলেন। সর্পগণ আনন্দিত হয়ে বর দিতে চাইলে আস্তীক বললেন, প্রসন্নচিত্ত ব্রাহ্মণ বা অন্য ব্যক্তি যদি রাত্রিতে বা দিবসে এই ধর্মাখ্যান পাঠ করে তবে তোমাদের কাছ থেকে তার যেন কোনও বিপদ না হয়। সর্পগণ প্রীত হয়ে বললে, ভাগিনেয়, আমরা তোমার কামনা পূর্ণ করব।
আস্তীকঃ সর্পসত্রে বঃ পন্নগান্ যোঽভ্যরক্ষত।
তং স্মরন্তং মহাভাগাঃ ন মাং হিংসিতুমহর্থ॥
সর্পাপসর্প ভদ্রং তে গচ্ছ সর্প মহাবিষ।
জনমেজয়স্য যজ্ঞান্তে আস্তীকবচনং স্মর॥
আস্তীকস্য বচঃ শ্রুত্বা যঃ সর্পো ন নিবর্ততে।
শতধা ভিদ্যতে মূর্ধা শিংশবৃক্ষফলং যথা॥[৫]
—হে মহাভাগ সর্পগণ, যিনি সর্পসরে তোমাদের রক্ষা করেছিলেন সেই আস্তীককে স্মরণ করছি, আমার হিংসা ক’রো না। সর্প, স’রে যাও, তোমার ভাল হ’ক; মহাবিষ সর্প, চ’লে যাও, জনমেজয়ের যজ্ঞের পর আস্তীকের বাক্য স্মরণ কর। আম্ভীকের কথায় যে সর্প নিবৃত্ত হয় না তার মস্তক শিমূল[৬] ফলের ন্যায় শতধা বিদীর্ণ হয়।