মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/চৈত্ররথপর্বাধ্যায়

॥ চৈত্ররথপর্বাধ্যায়॥

২৯। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত—গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ

 কিছুকাল পরে পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে অন্য এক ব্রাহ্মণ অতিথি রূপে উপস্থিত হলেন। ইনি বিবিধ উপাখ্যান এবং নানাদেশের আশ্চর্য বিবরণের প্রসঙ্গে বললেন, পাঞ্চালরাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর হবে। পাণ্ডবগণ সবিশেষ জানতে চাইলে তিনি এই ইতিহাস বললেন।—

 দ্রোণাচার্যের নিকট পরাজয়ের পর দ্রুপদ প্রতিশোধ ও পুত্রলাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হলেন। তিনি গঙ্গা ও যমুনার তীরে বিচরণ করতে করতে একটি ব্রাহ্মণবসতিতে এলেন। সেখানে যাজ ও উপযাজ নামক দুই ব্রহ্মর্ষি বাস করতেন। পাদসেবায় উপযাজকে তুষ্ট করে দ্রুপদ বললেন, আমি আপনাকে দশ কোটি গো দান করব, আপনি আমাকে এমন পুত্র পাইয়ে দিন যে দ্রোণকে বধ করবে। উপযাজ সম্মত হলেন না, তথাপি দ্রুপদ তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে উপযাজ বললেন, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যাজ শুচি অশুচি বিচার করেন না, আমি তাঁকে ভূমিতে পতিত ফল তুলে নিতে দেখেছি। ইনি গুরুগৃহে বাসকালে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করতেন। আমার মনে হয় ইনি ধন চান, আপনার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন। যাজের প্রতি অশ্রদ্ধা হ’লেও দ্রুপদ তাঁর কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন। যাজ সম্মত হলেন এবং উপযাজকে সহায়রূপে নিযুক্ত করলেন।

 যজ্ঞ শেষ হ’লে যাজ দ্রুপদমহিষীকে ডেকে বললেন, রাজ্ঞী, আসুন, আপনার দুই সন্তান উপস্থিত হয়েছে। মহিষী বললেন, আমার মুখপ্রক্ষালন আর স্নান হয় নি, আপনি অপেক্ষা করুন। যাজ বললেন, যজ্ঞাগ্নিতে আমি আহুতি দিচ্ছি, উপযাজ মন্ত্রপাঠ করছেন, এখন তা থেকে অভীষ্টলাভ হবেই, আপনি আসুন বা না আসুন। যাজ আহুতি দিলে যজ্ঞাগ্নি থেকে এক অগ্নিবর্ণ বর্মমুকুটভূষিত খড়্‌গধনুর্বাণধারী কুমার সগর্জনে উত্থিত হলেন। পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে সাধু সাধু বলতে লাগল, আকাশবাণী হ’ল—এই রাজপুত্র দ্রোণবধ ক’রে রাজার শোক দূর করবেন। তারপর যজ্ঞবেদী থেকে কুমারী পাঞ্চালী উঠলেন, তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিতকৃষ্ণকেশী, পীনপয়োধরা, তাঁর নীলোৎপলতুল্য সৌরভ এক ক্রোশ দূরেও অনুভূত হয়। আকাশবাণী হ’ল—সর্ব নারীর শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা হ’তে ক্ষত্রিয়ক্ষয় এবং কুরুবংশের মহাভয় উপস্থিত হবে। দ্রুপদ ও তাঁর মহিষী এই কুমার-কুমারীকে পুত্রকন্যা রূপে লাভ ক’রে অতিশয় সন্তুষ্ট হলেন। ধৃষ্ট (প্রগল্‌ভ) ও দ্যুম্ন (দ্যুতি, যশ, বীর্য, ধন) সমন্বিত এই কারণে কুমারের নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন হ’ল। শ্যাম বর্ণের জন্য এবং আকাশবাণী অনুসারে কুমারীর নাম কৃষ্ণা হ’ল। দৈব অনিবার্য এই জেনে এবং নিজ কীর্তি রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে স্বগৃহে এনে অস্ত্রশিক্ষা দিলেন।

 এই বৃত্তান্ত শুনে পাণ্ডবগণ বিষণ্ণ হলেন। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমরা এই ব্রাহ্মণের গৃহে বহুকাল বাস করেছি, এদেশে যে রমণীয় বন-উপবন আছে তাও দেখা হয়েছে, এখন ভিক্ষাও পূর্বের ন্যায় যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তোমরা ভাল মনে কর তবে পাঞ্চাল দেশে চল। পাণ্ডবগণ সম্মত হলেন। সময়ে ব্যাস পুনর্বার তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। নানা বিচিত্র কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, কোনও এক ঋষির একটি পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল, পূর্বজন্মের কর্মদোষে তার পতিলাভ হয় নি। তার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব এসে বললেন, অভীষ্ট বর চাও। কন্যা বার বার বললেন, সর্বগুণান্বিত পতি কামনা করি। মহাদেব বললেন, তুমি পাঁচ বার পতি চেয়েছ, এজন্য পরজন্মে তোমার পাঁচটি ভরতবংশীয় পতি হবে। সেই দেবরূপিণী কন্যা কৃষ্ণা নামে দ্রুপদের বংশে জন্মেছে, সেই তোমাদের পত্নী হবে। তোমরা পাঞ্চালনগরে যাও, দ্রুপদকন্যাকে পেয়ে তোমরা সুখী হবে।

 পাণ্ডবরা পাঞ্চালদেশে যাত্রা করলেন। এক অহোরাত্র পরে তাঁরা সোমাশ্রয়ণ তীর্থে গঙ্গাতীরে এলেন। অন্ধকারে পথ দেখবার জন্য অর্জুন একটি জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আগে আগে চললেন। সেই সময়ে গন্ধর্বরাজ স্ত্রীদের নিয়ে গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে এসেছিলেন। পাণ্ডবদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, প্রাতঃসন্ধ্যার পূর্বকাল পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি যক্ষ-গন্ধর্ব-রাক্ষসদের, অবশিষ্ট কাল মানুষের। রাত্রিতে কোনও মানুষ, এমন কি সসৈন্য নৃপতিও, যদি জলের কাছে আসে তবে ব্রহ্মজ্ঞগণ নিন্দা করেন। আমি কুবেরের সখা গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ, এই বন আমার, তোমরা দূরে যাও। অর্জুন বললেন, সমুদ্রে, হিমালয়ের পার্শ্বে, এবং এই গঙ্গায় দিনে রাত্রিতে বা সন্ধ্যায় কারও আসতে বাধা নেই। তোমার কথায় কেন আমরা গঙ্গার পবিত্র জল স্পর্শ করব না? তখন অঙ্গারপর্ণ পাণ্ডবদের প্রতি অনেকগুলি বাণ ছড়লেন। অর্জুন তাঁর মশাল আর ঢাল ঘুরিয়ে সমস্ত বাণ নিরস্ত ক’রে দ্রোণের নিকট লব্ধ প্রদীপ্ত আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্বরাজের রথ দগ্ধ হয়ে গেল, তিনি অচেতন হয়ে অধোমুখে প’ড়ে গেলেন, অর্জুন তাঁর মাল্যভূষিত কেশ ধ’রে টানতে লাগলেন। গন্ধর্বের ভার্যা কুম্ভীনসী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহাভাগ, আমি আপনার শরণাগতা, রক্ষা করুন, আমার স্বামীকে মুক্তি দিন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন গন্ধর্বকে ছেড়ে দিলেন।

 গন্ধর্ব বললেন, আমি পরাজিত হয়েছি, নিজেকে আর অঙ্গারপর্ণ[] বলব না। আমার বিচিত্র রথ দগ্ধ হয়েছে, আমার এক নাম চিত্ররথ হলেও আমি দগ্ধরথ হয়েছি। যে মহাত্মা আমাকে প্রাণদান করেছেন সেই অর্জুনকে আমার চাক্ষুষী বিদ্যা দান করছি। রাজকুমার, তুমি ত্রিলোকের যা কিছু দেখতে ইচ্ছা করবে এই বিদ্যাবলে তা দেখতে পাবে। আমি তোমাকে আর তোমার প্রত্যেক ভ্রাতাকে একশত দিব্যবর্ণ বেগবান গন্ধর্বদেশীয় অশ্ব দিচ্ছি, এরা প্রভুর ইচ্ছানুসারে উপস্থিত হয়। অর্জুন বললেন, গন্ধর্ব, তুমি প্রাণসংশয়ে যা আমাকে দিচ্ছ তা নিতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। গন্ধর্ব বললেন, তুমি জীবন দিয়েছ, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। তোমার আগ্নেয় অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দাও।

 অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুষী বিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান ক’রে সখ্যে আবদ্ধ হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, আমরা বেদজ্ঞ ও শত্রুদমনে সমর্থ, তথাপি রাত্রিকালে আমাদের ধর্ষণ করলে কেন? গন্ধব বললেন, তোমাদের অগ্নিহোত্র নেই, ব্রাহ্মণকে অগ্রবর্তী ক’রেও চল না, সেজন্য আমি তোমাদের ধর্ষণ করেছি। হে তাপত্য, শ্রেয়োলাভের জন্য পুরোহিত নিয়োগ করা কর্তব্য। পুরোহিত না থাকলে কোনও রাজা কেবল বীরত্ব বা আভিজাত্যের প্রভাবে রাজ্য জয় করতে পারেন না। ব্রাহ্মণকে পুরোভাগে রাখলেই চিরকাল রাজ্যপালন করা যায়।

৩০। তপতী ও সংবরণ

 অর্জুন প্রশ্ন করলেন, তুমি আমাকে তাপত্য বললে কেন? তপতী কে? আমরা তো কৌন্তেয়। গন্ধর্বরাজ এই ত্রিলোকবিশ্রুত উপাখ্যান বললেন।—

 যিনি নিজ তেজে সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করেন সেই সূর্যের এক কন্যার নাম তপতী, ইনি সাবিত্রীর কনিষ্ঠা। রূপে গুণে তিনি অতুলনা ছিলেন। সূর্যদেব এমন কোনও পাত্র খুঁজে পেলেন না যিনি তপতীর উপযুক্ত। সেই সময়ে কুরুবংশীয় ঋক্ষপুত্র সংবরণ রাজা প্রত্যহ উদয়কালে সূর্যের আরাধনা করতে লাগলেন। তিনি ধার্মিক, রূপবান ও বিখ্যাত বংশের নৃপতি, সেজন্য সূর্য তাঁকেই কন্যা দিতে ইচ্ছা করলেন। একদিন সংবরণ পর্বতের নিকটস্থ বনে মৃগয়া করতে গেলে তাঁর অশ্ব ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িত হয়ে ম’রে গেল। সংবরণ পদব্রজে বিচরণ করতে করতে এক অতুলনীর রূপবতী কন্যা দেখতে পেলেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু সেই কন্যা মেঘমধ্যে সৌদামিনীর ন্যায় অন্তর্হিত হলেন। রাজা কামমোহিত হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেলেন, তখন তপতী আবার দেখা দিয়ে বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, উঠুন, মোহগ্রস্ত হবেন না। সংবরণ অস্পষ্ট বাক্যে অনুনয় ক’রে বললেন, সুন্দরী, তুমি আমাকে ভজনা কর নতুবা আমার প্রাণবিয়োগ হবে। তুমি প্রসন্ন হও, আমি তোমার বশংগত ভক্ত। তপতী বললেন, আপনিও আমার প্রাণ হরণ করেছেন। আমি স্বাধীন নই, আমার পিতা আছেন। আপনি তপস্যায় তাঁকে প্রীত ক’রে আমাকে প্রার্থনা করুন। এই ব’লে তপতী চলে গেলেন।

 সংবরণ পুনর্বার মূর্ছিত হয়ে প’ড়ে গেলেন। অমাত্য ও অনুচরগণ অন্বেষণ ক’রে রাজাকে দেখতে পেলেন এবং তাঁর মাথায় পদ্মসুরভিত শীতল জল সেচন করলেন। রাজা সংজ্ঞালাভ ক’রে মন্ত্রী ভিন্ন সকলকেই বিদায় দিলেন এবং সেই পর্বতেই ঊর্ধ্বমুখে কৃতাঞ্জলি হয়ে পুরোহিত বশিষ্ঠ ঋষিকে স্মরণ করতে লাগলেন। স্বাদশ দিন অতীত হ’লে বশিষ্ঠ সেখানে এলেন। তিনি যোগবলে সমস্ত জেনে কিছুক্ষণ সংবরণের সঙ্গে আলাপ করে ঊর্ধ্বে চ’লে গেলেন। সূর্যের কাছে এসে বশিষ্ঠ প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, বিভাবসু, আপনার তপতী নামে যে কন্যা আছে তাঁকে আমি মহারাজ সংবরণের জন্য প্রার্থনা করছি। সূর্য সম্মত হয়ে তপতীকে দান করলেন, বশিষ্ঠ তাঁকে নিয়ে সংবরণের কাছে এলেন। সংবরণ তপতীকে বিবাহ করলেন এবং মন্ত্রীর উপর রাজ্যচালনার ভার দিয়ে সেই পর্বতের বনে উপবনে পত্নীর সঙ্গে বার বৎসর সুখে বাস করলেন।

 সেই বার বৎসরে তাঁর রাজ্যে একবিন্দু বৃষ্টিপাত হ’ল না, স্থাবর জঙ্গম এবং সমস্ত প্রজা ক্ষয় পেতে লাগল, লোকে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পুত্রকলত্র ছেড়ে দিকে দিকে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে বিচরণ করতে লাগল। বশিষ্ঠ মুনি সংবরণ ও তপতীকে রাজপুরীতে ফিরিয়ে আনলেন, তখন ইদ্র আবার বর্ষণ করলেন, শস্য উৎপন্ন হ’ল। অর্জুন, সেই তপতীর গর্ভে কুরু নানক পুত্র হয়। তুমি তাঁরই বংশে জন্মেছ সেজন্য তুমি তাপত্য।

৩১। বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, শক্ত্রি ও কল্মাষপাদ—ঔর্ব—ধৌম্য

 অর্জুন বশিষ্ঠের ইতিহাস জানতে চাইলে গন্ধর্বরাজ বললেন।—বশিষ্ঠ ব্রহ্মার মানস পুত্র, অরুন্ধতির পতি এবং ইক্ষ্বাকু কুলের পুরোহিত। কান্যকুব্জরাজ কুশিকের পুত্র গাধি, তাঁর পুত্র বিশ্বামিত্র। একদা বিশ্বামিত্র সসৈন্যে মৃগয়ায় গিয়ে পিপাসিত হয়ে বশিষ্ঠের আশ্রমে এলেন। রাজার সৎকারের নিমিত্ত বশিষ্ঠ তাঁর কামধেনু নন্দিনীকে বললেন, আমার যা প্রয়োজন তা দাও। নন্দিনী ধূমায়মান অন্নরাশি, সূপ (দাল), দধি, ঘৃত, মিষ্টান্ন, মদ্য প্রভৃতি ভক্ষ্য ও পেয় এবং বিবিধ রত্ন ও বসন উৎপন্ন করলে, বশিষ্ঠ তা দিয়ে বিশ্বামিত্রের সৎকার করলেন। নন্দিনীর মনোহর আকৃতি দেখে বিস্মিত হয়ে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে বললেন, আপনি দশ কোটি ধেনু বা আমার রাজ্য নিয়ে আপনার কামধেনু আমাকে দান করুন। বশিষ্ঠ সম্মত হলেন না, তখন বিশ্বামিত্র সবলে নন্দিনীকে হরণ ক’রে কশাঘাতে তাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। নন্দিনী বললে, ভগবান, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের কশাঘাতে আমি অনাথার ন্যায় বিলাপ করছি, আপনি তা উপেক্ষা করছেন কেন? বশিষ্ঠ বললেন, ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। কল্যাণী, আমি তোমাকে ত্যাগ করি নি, যদি তোমার শক্তি থাকে তবে আমার কাছেই থাক।

 তখন সেই পয়স্বিনী কামধেনু ভয়ংকর রূপ ধারণ ক’রে হম্বা রবে সৈন্যদের বিতাড়িত করলে। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে পহ্ণব দ্রবিড় শক যবন শবর পৌণ্ড্র কিরাত সিংহল বর্বর খশ পুলিন্দ চীন হূন কেরল ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সৈন্য উৎপন্ন হয়ে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদলকে বধ না ক’রেও পরাজিত করলে। বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হয়ে বশিষ্ঠের প্রতি বিবিধ শর বর্ষণ করলেন, কিন্তু বশিষ্ঠ একটি বংশদণ্ড দিয়ে সমস্ত নিরস্ত করলেন। বিশ্বামিত্র নানাপ্রকার দিব্যাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করলেন কিন্তু বশিষ্ঠের ব্রহ্মশক্তিযুক্ত যষ্টিতে সমস্ত ভস্মীভূত হ’ল। বিশ্বামিত্রের আত্মগ্লানি হ’ল, তিনি বললেন,

ধিগ্‌বলং ক্ষত্রিয়বলং ব্রহ্মতেজোবলং বলম্।
বলাবলং বিনিশ্চিত্য তপ এব পরং বলম্॥

―ক্ষত্রিয় বলকে ধিক, ব্রহ্মতেজই বল। বলাবল দেখে আমি নিশ্চিত জেনেছি যে, তপস্যাই পরম বল।

 তার পর বিশ্বামিত্র রাজ্য ত্যাগ ক’রে তপস্যায় নিরত হলেন।


 কল্মাষপাদ নামে এক ইক্ষাকুবংশীয় রাজা ছিলেন। একদিন তিনি মৃগয়ায় শ্রান্ত তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে চলছিলেন। সেই পথে বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ পুত্র শক্ত্রিকে আসতে দেখে রাজা বললেন, আমার পথ থেকে স’রে যাও। শক্ত্রি বললেন, ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেওয়াই রাজার সনাতন ধর্ম। শক্ত্রি কিছুতেই স’রে গেলেন না দেখে রাজা তাঁকে কশাঘাত করলেন। শক্ত্রি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, তুমি নরমাংসভোজী রাক্ষস হও। কল্মাষপাদকে যজমান রূপে পাবার জন্য বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। অভিশপ্ত কল্মাষপাদ যখন শক্ত্রিকে প্রসন্ন করবার চেষ্টা করছিলেন সেই সময়ে বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামে এক রাক্ষস রাজার শরীরে প্রবিষ্ট হ’ল।

 এক ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ বনমধ্যে রাজাকে দেখে তাঁর কাছে মাংস ও অন্ন চাইলেন। রাজা তাঁকে অপেক্ষা করতে ব’লে স্বভবনে গেলেন এবং অর্ধরাত্রে তাঁর প্রতিশ্রুতি স্মরণ ক’রে পাচককে সমাংস অন্ন নিয়ে যেতে আজ্ঞা দিলেন। পাচক জানালে যে মাংস নেই। রাক্ষসাবিষ্ট রাজা বললেন, তবে নরমাংস নিয়ে যাও। পাচক বধ্যভূমিতে গিয়ে নরমাংস নিলে এবং পাক ক’রে অন্নের সহিত ব্রাহ্মণকে নিবেদন করলে। দিব্যদৃষ্টিশালী ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে নৃপাধম এই অভোজ্য পাঠিয়েছে সে নরমাংসভোজী হবে।

 শক্ত্রি এবং অরণ্যচারী ব্রাহ্মণ এই দুজনের শাপের ফলে রাক্ষসাবিষ্ট কল্মাষপাদ কর্তব্যজ্ঞানশূন্য বিকৃতেন্দ্রিয় হলেন। একদিন তিনি শক্ত্রিকে দেখে বললেন, তুমি যে শাপ দিয়েছ তার জন্য প্রথমেই তোমাকে খাব। এই ব’লে তিনি শক্ত্রিকে বধ ক’রে ভক্ষণ করলেন। বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় কল্মাষপাদ বশিষ্ঠের শতপুত্রের সকলকেই খেয়ে ফেললেন। পুত্রশোকাতুর বশিষ্ঠ বহু প্রকারে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যু হ’ল না। তিনি নানা দেশ ভ্রমণ ক’রে আশ্রমে ফিরে আসছিলেন এমন সময় পিছন থেকে বেদপাঠের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বশিষ্ঠ বললেন, কে আমার অনুসরণ করছে? এক নারী উত্তর দিলেন, আমি অদৃশ্যন্তী, শক্ত্রির বিধবা পত্নী। আমার গর্ভে যে পুত্র আছে তার বার বৎসর বয়স হয়েছে, সেই বেদপাঠ করছে। তাঁর বংশের সন্তান জীবিত আছে জেনে বশিষ্ঠ আনন্দিত হয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন।

 পথিমধ্যে কল্মাষপাদ বশিষ্ঠকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে খেতে গেলেন। বশিষ্ঠ তাঁর ভীতা পুত্রবধূকে বললেন, ভয় নেই, ইনি কল্মাষপাদ রাজা। এই ব’লে তিনি হুংকার ক’রে কল্মাষপাদকে থামিয়ে তাঁর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাঁকে শাপমুক্ত করলেন এবং বললেন, রাজা, তুমি ফিরে গিয়ে রাজ্যশাসন কর, কিন্তু আর কখনও ব্রাহ্মণের অপমান ক’রো না। কল্মাষপাদ বললেন, আমি আপনার আজ্ঞাধীন হয়ে দ্বিজগণকে পূজা করব। এখন যাতে পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্ত হ’তে পারি তার উপায় করুন, আমাকে একটি পুত্র দিন। বশিষ্ঠ বললেন, তাই দেব। তার পর তাঁরা লোকবিখ্যাত অযোধ্যাপুরীতে ফিরে এলেন। বশিষ্ঠের সহিত সংগমের ফলে রাজমহিষী গর্ভবতী হলেন, বশিষ্ঠ তাঁর আশ্রমে ফিরে গেলেন। দ্বাদশ বৎসরেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হ’ল না দেখে মহিষী পাষাণখণ্ড দিয়ে তাঁর উদর বিদীর্ণ ক’রে পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্রের নাম অশ্মক, ইনি পৌদন্য নগর স্থাপন করেছিলেন।

 বশিষ্ঠের পুত্রবধূ অদৃশ্যন্তীও একটি পুত্র প্রসব করলেন, তাঁর নাম পরাশর। একদিন পরাশর বশিষ্ঠকে পিতা ব’লে সম্বোধন করলে অদৃশ্যন্তী সাশ্রুনয়নে বললেন, বৎস, পিতামহকে পিতা ব’লে ডেকো না, তোমার পিতাকে রাক্ষসে খেয়েছে। পরাশর ক্রুদ্ধ হয়ে সর্বলোক বিনাশের সংকল্প করলেন। তখন পৌত্রকে নিরস্ত করবার জন্য বশিষ্ঠ এই উপাখ্যান বললেন।—

 পুরাকালে কৃতবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি তাঁর পুরোহিত ভৃগুবংশীয়গণকে প্রচুর ধনধান্য দান করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধর ক্ষত্রিয়দের অর্থাভাব হ’ল, তাঁরা ভার্গবদের কাছে প্রার্থী হয়ে এলেন। ভার্গবদের কেউ ভূগর্ভে ধন লুকিয়ে রাখলেন, কেউ ব্রাহ্মণদের দান করলেন, কেউ ক্ষত্রিয়গণকে দিলেন। একজন ক্ষত্রিয় ভার্গবদের গৃহ খনন ক’রে ধন দেখতে পেলেন, তাতে সকলে ক্রুদ্ধ হয়ে ভার্গবগণকে বধ করলেন। ভার্গবনারীগণ ভয়ে হিমালয়ে আশ্রয় নিলেন, তাঁদের মধ্যে এক ব্রাহ্মণী তাঁর ঊরুদেশে গর্ভ গোপন ক’রে রাখলেন। ক্ষত্রিয়রা জানতে পেরে সেই গর্ভ নষ্ট করতে এলেন, তখন সেই ব্রাহ্মণীর ঊরু ভেদ ক’রে মধ্যাহ্ণসূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান পুত্র প্রসূত হ’ল, তার তেজে ক্ষত্রিয়গণ অন্ধ হয়ে গেলেন। তাঁরা অনুগ্রহ ভিক্ষা করলে ব্রাহ্মণী বললেন, তোমরা আমার ঊরুজাত পুত্র ঔর্বকে প্রসন্ন কর। ক্ষত্রিয়গণের প্রার্থনায় ঔর্ব তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। তার পর পিতৃগণের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ঘোর তপস্যা করতে লাগলেন। ঔর্বকে সর্বলোকবিনাশে উদ্যত দেখে পিতৃগণ এসে বললেন, বৎস, ক্রোধ সংবরণ কর। আমরা স্বর্গারোহণের জন্য উৎসুক ছিলাম, কিন্তু আত্মহত্যায় স্বর্গলাভ হয় না, সেজন্য স্বেচ্ছায় ক্ষত্রিয়দের হাতে মরেছি। আমরা ইচ্ছা করলেই ক্ষত্রিয়সংহার করতে পারতাম। তার পর পিতৃগণের অনুরোধে ঔর্ব তাঁর ক্রোধাগ্নি সমুদ্রজলে নিক্ষেপ করলেন। সেই ক্রোধ ঘোটকীর[] মস্তকরূপে অগ্নি উদ্‌গার করে সমুদ্রজল পান করে।

 বশিষ্ঠের কাছে এই উপাখ্যান শুনে পরাশর তাঁর ক্রোধ সংবরণ করলেন, কিন্তু তিনি রাক্ষসসত্র যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, তাতে আবালবৃদ্ধ সকল রাক্ষস দগ্ধ হ’তে লাগল। অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও মহাক্রতু রাক্ষসদের প্রাণরক্ষার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন। পুলস্ত্য[] বললেন, বৎস, যারা তোমার পিতার মৃত্যুর বিষয় কিছুই জানে না সেই নির্দোষ রাক্ষসদের মেরে তোমার কি আনন্দ হচ্ছে? তুমি আমার বংশনাশ করো না। শক্ত্রি শাপ দিয়েই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন। এখন তিনি তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে দেবলোকে সাথে আছেন। পুলস্ত্যের কথায় পরাশর তাঁর যজ্ঞ শেষ করলেন।


 অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, কল্মাষপাদ কি কারণে তাঁর মহিষীকে বশিষ্ঠের নিকট পত্রোৎপাদনের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন? গন্ধর্বরাজ বললেন, রাজা কল্মাষপাদ যখন রাক্ষসরূপে বনে বিচরণ করছিলেন তখন এক ব্রাহ্মণ ও তাঁর পত্নীকে দেখতে পান। রাজা সেই ব্রাহ্মণকে খেয়ে ফেলেন, তাতে ব্রাহ্মণী শাপ দেন, স্ত্রীসংগম করলেই তোমার মৃত্যু হবে। যাঁকে তুমি পুত্রহীন করেছ সেই বশিষ্ঠই তোমার পত্নীতে সন্তান উৎপাদন করবেন। এই কারণেই কল্মাষপাদ তাঁর মহিষীকে বশিষ্ঠের কাছে পাঠিয়েছিলেন।

 অর্জুন বললেন, গন্ধর্ব, তোমার সবই জানা আছে, এখন আমাদের উপযুক্ত পুরোহিত কে আছেন তা বল। গন্ধর্বরাজ বললেন, দেবলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধৌম্য উৎকোচক তীর্থে তপস্যা করছেন, তাঁকেই পৌরোহিত্যে বরণ করতে পার। অর্জুন প্রীতমনে গন্ধর্বরাজকে আগ্নেয় অস্ত্র দান ক’রে বসলেন, অশ্বগুলি এখন তোমার কাছে থাকুক, আমরা প্রয়োজন হ’লেই নেব। তার পর তাঁরা পরস্পরকে সম্মান দেখিয়ে নিজ নিজ অভীষ্ট স্থানে প্রস্থান করলেন। পাণ্ডবগণ ধৌম্যের আশ্রমে গিয়ে তাঁকে পৌরোহিত্যে বরণ করলেন এবং তাঁর সঙ্গে পাঞ্চালীর স্বয়ংবরে যাবার ইচ্ছা করলেন।

  1. যাঁর পর্ণ বা বাহন জ্বলন্ত অঙ্গার তুল্য।
  2. বড়বা।
  3. ইনি রাবণ প্রভৃতির পূর্বপুরুষ।