মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/রাজ্যলাভপর্বাধ্যায়

॥ রাজ্যলাভপর্বাধ্যায়॥

৩৭। খাণ্ডবপ্রস্থ—সুন্দ-উপসুন্দ ও তিলোত্তমা

 বিদুরের কথা শুনে দ্রুপদ বললেন, আপনার প্রস্তাব অতি সংগত, কিন্তু আমার কিছু বলা উচিত নয়। যদি যুধিষ্ঠিরাদি ইচ্ছা করেন এবং বলরাম ও কৃষ্ণ তাতে মত দেন তবে পাণ্ডবগণ অবশ্যই যাবেন। কৃষ্ণ বললেন, এঁদের যাওয়াই উচিত মনে করি, এখন ধর্মজ্ঞ দ্রুপদ যেমন আজ্ঞা করেন। দ্রুপদ বললেন, পুরুষোত্তম কৃষ্ণ যা কালোচিত মনে করেন আমিও তাই কর্তব্য মনে করি।

 অনন্তর পাণ্ডবগণ দ্রোণ, কৃপ, বিকর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে সুসজ্জিত হস্তিনাপুরে মহা আনন্দে প্রবেশ করলেন। দুর্যোধনের মহিষী এবং অন্যান্য বধূগণ লক্ষীরূপিণী দ্রৌপদীকে অতি আদরের সহিত গ্রহণ করলেন। গান্ধারী তাঁকে আলিঙ্গন ক’রেই মনে করলেন, এই পাঞ্চালীর জন্য আমার পুত্রদের মৃত্যু হবে। তাঁর আদেশে বিদুর শুভনক্ষত্রযোগে কুন্তী ও দ্রৌপদীকে পাণ্ডুর ভবনে নিয়ে গেলেন এবং সর্ব বিষয়ে তাঁদের সাহায্য করতে লাগলেন। কিছুকাল পরে ভীষ্মের সমক্ষে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তোমরা অর্ধ রাজ্য নাও এবং খাণ্ডবপ্রস্থে বাস কর, তা হলে আমাদের মধ্যে আর বিবাদ হবে না।

 পাণ্ডবগণ সম্মত হলেন। তাঁরা কৃষ্ণকে অগ্রবর্তী ক’রে ঘোর বনপথ দিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে গেলেন এবং সেখানে বহু সৌধসমন্বিত পরিখা-প্রাকার-বেষ্টিত উপবন-সরোবরাদি-শোভিত স্বর্গধামতুল্য এক নগর[] স্থাপন করলেন। পাণ্ডবদের সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত ক’রে বলরাম ও কৃষ্ণ দ্বারবতী[] তে ফিরে গেলেন।


 ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে বাস করতে লাগলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ তাঁদের কাছে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে নিজের রমণীয় আসনে বসিয়ে যথাবিধি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। তাঁর আদেশে দ্রৌপদী বসনে দেহ আবৃত ক’রে এলেন এবং নারদকে প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নারদ তাঁকে আশীর্বাদ ক’রে বললেন, এখন যেতে পার। দ্রৌপদী চ’লে গেলে নারদ পাণ্ডবগণকে নিভৃতে বললেন, পাঞ্চালী একাই তোমাদের সকলের ধর্মপত্নী, এমন নিয়ম কর যাতে তোমাদের মধ্যে ভেদ না হয়। তার পর নারদ এই উপাখ্যান বললেন।—

 পুরাকালে মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশজাত দৈত্যরাজ নিকুম্ভের সুন্দ উপসুন্দ নামে দুই পরাক্রান্ত পুত্র জন্মেছিল। তারা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল এবং একযোগে সকল কার্য করত। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে ত্রিলোকবিজয়ের কামনায় তারা বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলে। দেবতারা ভয় পেয়ে নানাপ্রকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের তপোভঙ্গ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুন্দ-উপসুন্দ বিচলিত হ’ল না। তার পর ব্রহ্মা বর দিতে এলে তারা বললে, আমরা যেন মায়াবিৎ অস্ত্রবিৎ বলবান কামরূপী এবং অমর হই। ব্রহ্মা বললেন, তোমরা ত্রিলোকবিজয়ের জন্য তপস্যা করছ, সে কারণে অমরত্বের বর দিতে পারি না। তখন তারা বললে, তবে এই বর দিন যে ত্রিলোকের স্থাবরজঙ্গম থেকে আমাদের কোনও ভয় থাকবে না, মৃত্যু যদি হয় তো পরস্পরের হাতেই হবে। ব্রহ্মা তাদের প্রার্থিত বর দিলেন। তারা দৈত্যপুরীতে গিয়ে বন্ধুবর্গের সঙ্গে ভোগবিলাসে মগ্ন হ’ল এবং বহু বৎসর ধ’রে নানাপ্রকার উৎসব করতে লাগল। তার পর তারা বিপুল সৈন্যদল নিয়ে দেবলোক জয় করতে গেল। দেবগণ ব্রহ্মার বরের বিষয় জানতেন, সেজন্য স্বর্গ ত্যাগ ক’রে ব্রহ্মলোকে পালিয়ে গেলেন। সুন্দ-উপসুন্দ ইন্দ্রলোক এবং যক্ষ, রক্ষ, খেচর, পাতালবাসী নাগ, সমুদ্রতীরবাসী ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সকলকেই জয় করলে এবং আশ্রমবাসী তপস্বীদের উপরেও অত্যাচার করতে লাগল।

 দেবগণ ও মহর্ষিগণের প্রার্থনায় ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিলেন, তুমি এমন এক প্রমদা সৃষ্টি কর যাকে সকলেই কামনা করে। বিশ্বকর্মা ত্রিলোকের স্থাবরজঙ্গম থেকে সর্বপ্রকার মনোহর উপাদান আহরণ ক’রে এক অতুলনীয়া রূপবতী নারী সৃষ্টি করলেন। জগতের উত্তম বস্তু তিল তিল পরিমাণে মিলিত ক’রে সৃষ্ট এজন্য ব্রহ্মা তার নাম দিলেন তিলোত্তমা। তিনি আদেশ দিলেন, তুমি সুন্দ-উপসুন্দকে প্রলুব্ধ কর। তিলোত্তমা যাবার পূর্বে দেবগণকে প্রদক্ষিণ করলে। ঘুরতে ঘুরতে তিলোত্তমা যে দিকে যায়, তাকে দেখবার জন্য সেই দিকেই ব্রহ্মার একটি মুখ নির্গত হ’ল, এইরূপে তিনি চতুর্মুখ হলেন। ইন্দ্রেরও সহস্র নয়ন হ’ল। শিব স্থির হয়ে ছিলেন সেজন্য তাঁর নাম স্থাণু।

 সুন্দ-উপসুন্দ বিন্ধ্যপর্বতের নিকট পুষ্পিত শালবনে সুরাপানে মত্ত হয়ে বিহার করছিল এমন সময় মনোহর রক্তবসন প’রে তিলোত্তমা সেখানে গেল। সুন্দ তার ডান হাত এবং উপসন্দ বাঁ হাত ধরলে। ভ্রুকুটি ক’রে সুন্দ বললে, এ আমার ভার্যা, তোমার গুরুস্থানীয়া। উপসুন্দ বললে, এ আমার ভার্যা, তোমার বধূস্থানীয়া। তার পর তারা গদা নিয়ে যুদ্ধ ক’রে দুজনেই নিহত হ’ল। দেবগণ ও মহর্ষিগণের সঙ্গে ব্রহ্মা সেখানে এসে তিলোত্তমাকে বললেন, সুন্দরী, তুমি আদিত্যলোকে বিচরণ করবে, তোমার তেজের জন্য কেউ তোমাকে ভাল ক’রে দেখতে পারবে না।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে নারদ বললেন, সর্ববিষয়ে মিলিত ও একমত হয়েও তিলোত্তমার জন্য দুই অসুর পরস্পরকে বধ করেছিল, অতএব তোমরা এমন উপায় কর যাতে দ্রৌপদীর জন্য তোমাদের বিচ্ছেদ না হয়। তখন পাণ্ডবগণ এই নিয়ম করলেন যে দ্রৌপদী এক একজনের গৃহে এক এক বৎসর বাস করবেন, সেই সময়ে অন্য কোনও ভ্রাতা যদি তাঁদের দেখেন তবে তাঁকে ব্রহ্মচারী হয়ে বার বৎসর বনবাসে যেতে হবে।

  1. এই নগরকেই পরে ইন্দ্রপ্রস্থ বলা হয়েছে।
  2. দ্বারকা।