মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/অর্জুনবনবাসপর্বাধ্যায়

॥অর্জুনবনবাসপর্বাধ্যায়॥

৩৮। অর্জুনের বনরাস—উলূপী, চিত্রাঙ্গদা ও বর্গা—বভ্রুবাহন

 একদিন কয়েক জন ব্রাহ্মণ ইন্দ্রপ্রস্থে এসে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, নীচাশয় নৃশংস লোকে আমাদের গোধন হরণ করছে। যে রাজা শস্যাদির ষষ্ঠ ভাগ কর নেন অথচ প্রজাদের রক্ষা করেন না তাঁকে লোকে পাপাচারী বলে। ব্রাহ্মণের ধন চোরে নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিকার কর। অর্জুন ব্রাহ্মণদের আশ্বাস দিয়ে অস্ত্র আনতে গেলেন, কিন্তু যে গৃহে অস্ত্র ছিল সেই গৃহেই তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির বাস করছিলেন। অর্জুন সমস্যায় প’ড়ে ভাবলেন, যদি ব্রাহ্মণের ধনরক্ষা না করি তবে রাজা যুধিষ্ঠিরের মহা অধর্ম হবে, আর যদি নিয়মভঙ্গ ক’রে তাঁর ঘরে যাই তবে আমাকে বনবাসে যেতে হবে। যাই হ’ক আমি ধর্ম পালন করব। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঘরে গেলেন এবং তাঁর সম্মতিক্রমে ধনুর্বাণ নিয়ে ব্রাহ্মণদের কাছে এসে বললেন, শীঘ্র চলুন, চোরেরা দূরে যাবার আগেই তাদের ধরতে হবে।

 অর্জুন রথারোহণে যাত্রা ক’রে চোরদের শাস্তি দিয়ে গোধন উদ্ধার ক’রে ব্রাহ্মণদের দিলেন এবং ফিরে এসে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, আজ্ঞা দিন, প্রায়শ্চিত্তের জন্য বনে যাব। যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে বললেন, তুমি আমার ঘরে এসেছিলে সেজন্য আমি অসন্তুষ্ট হই নি, জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠ এলে দোষ হয় না, তার বিপরীত হ’লেই দোষ হয়। অর্জুন বললেন, আপনার মুখেই শুনেছি —ধর্মাচরণে ছল করবে না। আমি আয়ুধ স্পর্শ ক’রে বলছি, সত্য থেকে বিচলিত হব না। তার পর যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিয়ে অর্জুন বার বৎসরের জন্য বনে গেলেন, অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভিক্ষু পুরাণপাঠক প্রভৃতিও তাঁর অনুগমন করলেন।

 বহু দেশ ভ্রমণ ক’রে অর্জুন গঙ্গাদ্বারে এসে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তিনি স্নানের জন্য গঙ্গায় নামলে নাগরাজকন্যা উলূপী তাঁকে টেনে নিয়ে গেলেন। অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে উলূপী বললেন, আমি ঐরাবতকুলজাত কৌরব্য নামক নাগের কন্যা, আপনি আমাকে ভজনা করুন। আপনার ব্রহ্মচর্যের যে নিয়ম আছে তা কেবল দ্রৌপদীর সম্বন্ধে। আমার অনুরোধ রাখলে আপনার ধর্ম নষ্ট হবে না, কিন্তু আমার প্রাণরক্ষা হবে। অর্জুন উলূপীর প্রার্থনা পূরণ করলেন। উলূপী তাঁকে বর দিলেন, আপনি জলে অজেয় হবেন, সকল জলচর আপনার বশ হবে।[]

 উলূপীর কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নানা তীর্থ পর্যটন করলেন, তার পর মহেন্দ্র পর্বত দেখে সমুদ্রতীর দিয়ে মণিপুরে এলেন। সেখানকার রাজা চিত্রবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন তাঁর পাণিপ্রার্থী হলেন। রাজা অর্জুনের পরিচয় নিয়ে বললেন, আমাদের বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পুত্রের জন্য তপস্যা করলে মহাদেব তাঁকে বর দিলেন, তোমার বংশে প্রতি পুরুষের একটিমাত্র সন্তান হবে। আমার পূর্বপুরুষদের পুত্রই হয়েছিল, কিন্তু আমার কন্যা হয়েছে, তাকেই আমি পুত্র গণ্য করি। তার গর্ভজাত পুত্র আমার বংশধর হবে—এই প্রতিজ্ঞা যদি কর তবে আমার কন্যাকে বিবাহ করতে পার। অর্জুন সেইরূপ প্রতিজ্ঞা ক’রে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন এবং মণিপুরে তিন বৎসর বাস করলেন। তার পর পুত্র হ’লে চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন ক’রে পুনর্বার ভ্রমণ করতে গেলেন।

 অর্জুন দেখলেন, অগস্ত্য সৌভদ্র পৌলম কারন্ধম ও ভারদ্বাজ এই পঞ্চতীর্থ তপস্বিগণ বর্জন করেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করে তিনি জানলেন যে এইসকল তীর্থে পাঁচটি কুম্ভীর আছে, তারা মানুষকে টেনে নেয়। তপস্বীদের বারণ না শুনে অর্জুন সৌভদ্র তীর্থে স্নান করতে নামলেন। এক বৃহৎ জলজতু তাঁর পা ধরলে। অর্জুন তাকে সবলে উপরে তুলে আনলে সেই প্রাণী সালংকারা সুন্দরী নারী হয়ে গেল। সে বললে, আমি অপ্সরা বর্গা, কুবেরের প্রিয়া। আমি চার সখীর সঙ্গে ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলাম, ফেরবার সময় আমরা দেখলাম এক রূপবান ব্রাহ্মণ নির্জন স্থানে বেদাধ্যয়ন করছেন। আমরা তাঁকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করলে তিনি শাপ দিলেন, তোমরা কুম্ভীর হয়ে শতবর্ষ জলে বাস করবে। আমরা অনুনয় করলে তিনি বললেন, কোনও পুরুষশ্রেষ্ঠ যদি তোমাদের জল থেকে তোলেন তবে নিজ রূপ ফিরে পাবে। পরে নারদ আমাদের দুঃখের কথা শুনে বললেন, তোমরা দক্ষিণ সাগরের তীরে পঞ্চতীর্থে যাও, অর্জুন তোমাদের উদ্ধার করবেন। সেই অবধি আমরা এখানে আছি। আমাকে যেমন মুক্ত করেছেন সেইরূপ আমার সখীদেরও করুন। অর্জুন অন্য চার অপ্সরাকে শাপমুক্ত করলেন।

 সেখান থেকে অর্জুন পুনর্বার মণিপুরে গেলেন এবং রাজা চিত্রবাহনকে বললেন, আমার পুত্র বজ্রবাহনকে আপনি নিন। তিনি চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, তুমি এখানে থেকে পুত্রকে পালন কর, পরে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে আমার মাতা ভ্রাতা প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দলাভ করবে। যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করবেন তখন তোমার পিতার সঙ্গে যেয়ো। সুন্দরী, আমার বিরহে দুঃখ ক’রো না।

 তার পর অর্জুন পশ্চিম সমুদ্রের তীরবর্তী সকল তীর্থ দেখে প্রভাসে এলেন। সেই সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ সেখানে এসে অর্জুনকে রৈবতক পর্বতে নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণের আদেশে সেই স্থান পূর্বেই সুসজ্জিত করা হয়েছিল এবং সেখানে বিবিধ খাদ্য ও নৃত্যগীতাদির আয়োজন ছিল। অর্জুন সেখানে সুখে বিশ্রাম ক’রে স্বর্ণময় রথে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। শত সহস্র দ্বারকাবাসী স্ত্রী পুরুষ তাঁকে দেখবার জন্য রাজপথে এল। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক[] বংশীয় কুমারগণ মহা সমাদরে তাঁর সংবর্ধনা করলেন।

  1. ভীষ্মপর্ব ১৪-পরিচ্ছেদে ইরাবান সম্বন্ধে পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
  2. যদুবংশের বিভিন্ন শাখা।