মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/সুভদ্রাহরণপর্বাধ্যায়
॥সুভদ্রাহরণপর্বাধ্যায়॥
৩৯। রৈবতক—সুভদ্রাহরণ—অভিমন্যু—দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র
কিছুদিন পরে রৈবতক পর্বতে বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়দের মহোৎসব আরম্ভ হ’ল। বহু সহস্র নগরবাসী পত্নী ও অনুচরদের সঙ্গে পদব্রজে ও বিবিধ যানে সেখানে এল। হলধর মত্ত হয়ে তাঁর পত্নী রেবতীর সঙ্গে বিচরণ করতে লাগলেন। প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, অক্রুর, সারণ, সাত্যকি প্রভৃতিও স্ত্রীদের নিয়ে এলেন। বাসুদেবের সঙ্গে অর্জুন নানাপ্রকার বিচিত্র কৌতুক দেখে বেড়াতে লাগলেন।
একদিন অর্জুন বসুদেবকন্যা সালংকারা সুদর্শনা সুভদ্রাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য ক’রে সহাস্যে বললেন, বনবাসীর মন কামে আলোড়িত হ’ল কেন? ইনি আমার ভগিনী সুভদ্রা, সারণের সহোদরা, আমার পিতার প্রিয়কন্যা। যদি চাও তো আমি নিজেই পিতাকে বলব। অর্জুন বললেন, তোমার এই ভগিনী যদি আমার ভার্যা হন তবে আমি কৃতার্থ হব; কিন্তু এঁকে পাবার উপায় কি? কৃষ্ণ বললেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বয়ংবর বিহিত, কিন্তু স্ত্রীস্বভাব অনিশ্চিত, কাকে বরণ করবে কে জানে। তুমি আমার ভগিনীকে সবলে হরণ কর, ধর্মজ্ঞগণ বলেন এরূপ বিবাহ বীরগণের পক্ষে প্রশস্ত। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের সম্মতি আনালেন।
অর্জন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে কাঞ্চনময় রথে মৃগয়াচ্ছলে যাত্রা করলেন। সুভদ্রা পূজা শেষ ক’রে রৈবতক পর্বত প্রদক্ষিণ ক’রে দ্বারকায় ফিরছিলেন, অর্জুন তাঁকে সবলে রথে তুলে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে চললেন। কয়েকজন সৈনিক এই ব্যাপার দেখে কোলাহল করতে করতে সুধর্মা নামক মন্ত্রণাসভায় এসে সভাপালকে জানালে, সভাপাল যুদ্ধসজ্জার জন্য মহাভেরী বাজাতে লাগলেন। সেই শব্দ শুনে যাদবগণ পানভোজন ত্যাগ ক’রে সভায় এসে মন্ত্রণা করলেন এবং অর্জুনের আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য উদ্গ্রীব হলেন।
সুরাপানে মত্ত বলরাম সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর পরিধানে নীল বসন, কণ্ঠে বনমালা। তিনি বললেন, ওহে নির্বোধগণ, কৃষ্ণের মত না জেনেই তোমরা গর্জন করছ কেন? তিনি কি বলেন আগে শোন তার পর যা হয় ক’রো। তার পর তিনি কৃষ্ণকে বললেন, তুমি নির্বাক হয়ে রয়েছ কেন? তোমার জন্যই আমরা অর্জুনকে সম্মান করেছি, কিন্তু সেই কুলাঙ্গার তার যোগ্য নয়। যার সৎকুলে জন্ম সে অন্নগ্রহণ ক’রে ভোজনপাত্র ভাঙে না। সুভদ্রাকে হরণ ক’রে সে আমাদের মাথায় পা দিয়েছে, এই অন্যায় আমি সইব না, আমি একাই পৃথিবী থেকে কুরুকুল লুপ্ত করব। সভাস্থ সকলেই বলরামের কথার অনুমোদন করলেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন যা করেছেন তাতে আমাদের বংশের অপমান হয় নি, বরং মানবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা ধনের লোভে কন্যা বিক্রয় করব এমন কথা তিনি ভাবেন নি, স্বয়ংবরেও তিনি সম্মত নন, এই কারণেই তিনি ক্ষত্রধর্ম অনুসারে কন্যা হরণ করেছেন। অর্জুন ভরত-শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছেন, তিনি যুদ্ধে অজেয়, এমন সৎপাত্র কে না চায়? আপনারা শীঘ্র গিয়ে মিষ্টবাক্যে তাঁকে ফিরিয়ে আনউন, এই আমার মত। তিনি যদি আপনাদের পরাজিত ক’রে স্বভবনে চ’লে যান তবে আপনাদের যশ নষ্ট হবে, কিন্তু মিষ্ট কথায় ফিরিয়ে আনলে তা হবে না। আমাদের পিতৃষ্বসার পুত্র হয়ে তিনি শত্রুতা করবেন না।
যাদবগণ কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনলেন, তিনি সুভদ্রাকে বিবাহ ক’রে এক বৎসর দ্বারকায় রইলেন, তার পর বনবাসের অবশিষ্ট কাল পুষ্করতীর্থে যাপন করলেন। বার বৎসর পূর্ণ হ’লে অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন। দ্রৌপদী তাঁকে বললেন, কৌন্তেয়, তুমি সুভদ্রার কাছেই যাও, পুনর্বার বন্ধন করলে পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। অর্জুন বার বার ক্ষমা চেয়ে দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিলেন এবং সুভদ্রাকে রক্ত কৌষেয় বসন পরিয়ে গোপবধূর বেশে কুন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কুন্তী পরম প্রীতির সহিত তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। সুভদ্রা দ্রৌপদীকে প্রণাম ক’রে বললেন, আমি আপনার দাসী। দ্রৌপদী তাঁকে আলিঙ্গন ক’রে বললেন, তোমার স্বামীর যেন শত্রু না থাকে।
সৈন্যদলে বেষ্টিত হয়ে যদুবীরগণের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরাম নানাবিধ মহার্ঘ যৌতুক নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। অনেক দিন আনন্দে যাপন করে সকলে ফিরে গেলেন, কেবল কৃষ্ণ রইলেন। তিনি যমুনাতীরে অর্জুনের সঙ্গে মৃগয়া ক’রে মৃগ-বরাহ মারতে লাগলেন।
কিছুকাল পরে সুভদ্রা একটি পুত্র প্রসব করলেন। নির্ভিক ও মন্যুমান (ক্রোধী বা তেজস্বী) সেজন্য তাঁর নাম অভিমন্যু, হ’ল। জন্মকাল থেকেই কৃষ্ণ এই বালকের সমস্ত শুভকার্য সম্পন্ন করলেন। অর্জুন দেখলেন, অভিমন্যু শৌর্ষে বীর্যে কৃষ্ণেরই তুল্য। দ্রৌপদীও যুধিষ্ঠির ভীমাদির ঔরসে পাঁচটি বীর পুত্র লাভ করলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন।