মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/খাণ্ডবদাহপর্বাধ্যায়
॥খাণ্ডবদাহপর্বাধ্যায়॥
৪০। অগ্নির অগ্নিমান্দ্য—খাণ্ডবদাহ—ময় দানব
একদিন কৃষ্ণ ও অর্জুন তাঁদের সুহৃদ্বর্গ ও নারীগণকে নিয়ে যমুনায় জলবিহার করতে গেলেন। তাঁরা যমনার তীরবর্তী বহু প্রাণিসমাকুল মনোহর খাণ্ডব বন দেখে বিহারস্থানে এলেন এবং সেখানে সকলে পান ভোজন নৃত্য গীত ও বিবিধ ক্রীড়ায় রত হলেন। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন নিকটস্থ এক মনোরম স্থানে গিয়ে মহার্ঘ আসনে ব’সে নানা বিষয় আলোচনা করতে লাগলেন। এমন সময়ে সেখানে এক ব্রাহ্মণ এলেন, তাঁর দেহ বিশাল, বর্ণ তপ্তকাঞ্চনতুলা, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ, মস্তকে জটা, পরিধানে চীরবাস। তিনি বললেন, আমি বহুভোজী ব্রাহ্মণ; কৃষ্ণার্জুন, তোমরা একবার আমাকে প্রচুর ভোজন করিয়ে তৃপ্ত কর। আমি অগ্নি, অন্ন চাই না, এই খাণ্ডব বন দগ্ধ করতে ইচ্ছা করি। তক্ষক নাগ সপরিবারে এখানে থাকে, তার সখা ইন্দ্র এই বন রক্ষা করেন সেজন্য আমি দগ্ধ করতে পারি না। তোমরা উত্তম অস্ত্রবিৎ, তোমরা সহায় হ’লে আমি খাণ্ডবদাহ করব, এই ভোজনই আমি চাই।
এই সময়ে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে এই পূর্ব-ইতিবৃত্ত বললেন।—শ্বেতকি নামে এক রাজা নিরন্তর যজ্ঞ করতেন। তাঁর পুরোহিতদের চক্ষু ধূমে পীড়িত হওয়ায় তাঁরা আর যজ্ঞ করতে চাইলেন না। তখন রাজা মহাদেবের তপস্যা করতে লাগলেন। মহাদেব বর দিতে এলে শ্বেতকি বললেন, আপনি আমার যজ্ঞে পৌরোহিত্য করুন। মহাদেব হাস্য ক’রে বললেন, আমি তা পারি না। পরিশেষে মহাদেবের আজ্ঞায় দুর্বাসা শ্বেতকির যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। সেই যজ্ঞে অগ্নিদেব বার বৎসর ঘৃতপান করেছিলেন, তার ফলে তাঁর অরুচি রোগ হল। তিনি প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার কাছে গেলে ব্রহ্মা সহাস্যে বললেন, তুমি খাণ্ডববন দগ্ধ ক’রে সেখানকার প্রাণীদের মেদ ভক্ষণ কর, তা হ’লেই প্রকৃতিস্থ হবে। অগ্নি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে গেলেন, কিন্তু শতসহস্র হস্তী শুণ্ড দ্বারা এবং বহুশীর্ষ নাগগণ মস্তক দ্বারা জলসেচন ক’রে অগ্নি নির্বাপিত করলে। সাত বার চেষ্টা ক’রে বিফল হয়ে অগ্নিদেব আবার ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, নর ও নারায়ণ ঋষি অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মেছেন এবং এখন খাণ্ডববনেই আছেন, তাঁরা তোমার সহায় হ’লে দেবতারাও বাধা দিতে পারবেন না।
অর্জুন অগ্নিকে বললেন, ভগবান, আমার কাছে দিব্য বাণ অনেক আছে কিন্তু তার উপযুক্ত ধনু এখন সঙ্গে নেই, কৃষ্ণও নিরস্ত্র। আপনি এমন উপায় বলুন যাতে ইন্দ্র বর্ষণ করলে আমি তাঁকে নিবারণ করতে পারি। তখন অগ্নিদেব লোকপাল বরুণকে স্মরণ করলেন এবং বরুণ উপস্থিত হ’লে তাঁর কাছ থেকে চন্দ্রপ্রদত্ত গাণ্ডীব[১] ধনু, দুই অক্ষয় তূণীর, এবং কপিধ্বজ রথ চেয়ে নিয়ে অর্জুনকে দিলেন এবং কৃষ্ণকে একটি চক্র ও কৌমোদকী নামক গদা দিলেন। কৃষ্ণার্জুন দুই রথে আরোহণ করলে অগ্নি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে লাগলেন। পশু পক্ষী চিৎকার ক’রে পালাতে গেল, কিন্তু অর্জুনের বাণে বিদ্ধ হয়ে অগ্নিতে পড়ল, কোনও প্রাণী নিস্তার পেলে না। অগ্নির আকাশস্পর্শী শিখা দেখে দেবতারা উদ্বিগ্ন হলেন। ইন্দ্রের আদেশে মেঘ থেকে সহস্রধারায় জলবর্ষণ হ’তে লাগল, কিন্তু অগ্নির তেজে তা আকাশেই শুখিয়ে গেল। এই সময়ে নাগরাজ তক্ষক কুরুক্ষেত্রে ছিলেন। তক্ষকপত্নী তাঁর পুত্র অশ্বসেনকে গিলে ফেলে বাইরে আসবার চেষ্টা করলে অর্জুন তাঁর শিরশ্ছেদন করলেন। তখন ইন্দ্র বায়ু বর্ষণ ক’রে অর্জুনকে মোহগ্রস্ত করলেন, সেই সুযোগে অশ্বসেন মক্ত হ’ল। অগ্নি কৃষ্ণ ও অর্জুন তাকে শাপ দিলেন, তুমি নিরাশ্রয় হবে। ইন্দ্র তাঁকে বঞ্চিত করেছেন এই কারণে অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শরজালে আকাশ আচ্ছন্ন করলেন। ইন্দ্র অর্জুনের তুমল যুদ্ধ হ’তে লাগল। অসুর গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষস কৃষ্ণার্জুনকে হারাবার জন্য উপস্থিত হ’ল, কিন্তু অর্জুনের শরাঘাতে এবং কৃষ্ণের চক্রে আহত হয়ে সকলেই বিতাড়িত হ’ল। ইন্দ্র বজ্র নিয়ে এবং দেবগণ নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণার্জুনের অস্ত্রাঘাতে তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হ’ল। অবশেষে ইন্দ্র মন্দর পর্বতের একটি বিশাল শৃঙ্গ উৎপাটিত ক’রে অর্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনের বাণে পর্বতশৃঙ্গ সহস্রখণ্ড হয়ে খাণ্ডববনে পড়ল, অসংখ্য প্রাণী নিহত হ’ল।
দেবগণের পরাজয় দেখে ইন্দ্র আনন্দিত হয়ে কৃষ্ণার্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন মহাগম্ভীরশব্দে এই অশরীরিণী দৈববাণী হ’ল—বাসব, তোমার সখা তক্ষক দগ্ধ হন নি, তিনি কুরুক্ষেত্রে আছেন। অর্জুন আর বাসুদেবকে কেউ যুদ্ধে জয় করতে পারে না, তাঁরা পূর্বে নর-নারায়ণ নামক দেবতা ছিলেন। দৈববাণী শুনে ইন্দ্রাদি দেবগণ সুরলোকে চলে গেলেন, অগ্নি অবাধে খাণ্ডববন দগ্ধ ক’রে প্রাণিগণের মাংস রুধির বসা খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। এই সময়ে ময় নামক এক অসুর তক্ষকের আবাস থেকে বেগে পালাচ্ছে দেখে অগ্নি তাকে খেতে চাইলেন। কৃষ্ণ তাকে মারবার জন্য চক্র উদ্যত করলেন, কিন্তু ময়ের কাতর প্রার্থনায় এবং অর্জুনের অনুরোধে নিরস্ত হলেন। অগ্নি পনর দিন ধ’রে খাণ্ডববন দগ্ধ করলেন। তক্ষকপুত্র অশ্বসেন, নমুচির ভ্রাতা ময় দানব এবং চারটি শার্ঙ্গক পক্ষী, এই ছটি প্রাণী ছাড়া কেউ জীবিত রইল না।
মন্দপাল নামে এক তপস্বীর সন্তান ছিল না। তিনি মৃত্যুর পর পিতৃলোকে স্থান পেলেন না, দেবগণ তাঁকে বললেন, আপনার পিতৃ-ঋণ শোধ হয় নি, আপনি পুত্র উৎপাদন করে তবে এখানে আসুন। শীঘ্র বহু সন্তান লাভের জন্য মন্দপাল শার্ঙ্গক পক্ষী হয়ে জারিতা নাম্নী শার্ঙ্গিকার সঙ্গে সংগত হলেন। জারিতার গর্ভে চারটি ব্রহ্মবাদী পুত্র উৎপন্ন হ’ল। খাণ্ডবদাহের সময় তারা ডিম্বের মধ্যেই ছিল, মন্দপালের প্রার্থনায় অগ্নি তাদের মারলেন না। মন্দপাল তাঁর চার পুত্রকে নিয়ে জারিতার সঙ্গে অন্যত্র চ’লে গেলেন।
অনন্তর ইন্দ্র দেবগণের সঙ্গে এসে কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, তোমাদের আশ্চর্য কর্ম দেখে আমি প্রীত হয়েছি, বর চাও। অর্জুন ইন্দ্রের সমস্ত অস্ত্র চাইলেন। ইন্দ্র বললেন, মহাদেব যখন তোমার উপর প্রসন্ন হবেন তখন তোমাকে সকল অস্ত্র দেব। কৃষ্ণ বর চাইলেন, অর্জুনের সঙ্গে যেন তাঁর চিরস্থায়ী প্রীতি হয়। ইন্দ্র বর দিয়ে সদলে চ’লে গেলেন। অগ্নি কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি এখন তোমরা যেখানে ইচ্ছা যেতে পার। তখন কৃষ্ণ, অর্জুন ও ময় দানব তিনজনে রমণীয় নদীকূলে গিয়ে উপবেশন করলেন।
- ↑ টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেন, গাণ্ডী বা গণ্ডারের পৃষ্ঠবংশ (মেরূদণ্ড) দিয়ে প্রস্তুত সেজন্য গাণ্ডীব নাম।