মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্যোগপর্ব/অম্বোপাখ্যানপর্বাধ্যায়
॥ অম্বোপাখ্যানপর্বাধ্যায়॥
২৭। অম্বা-শিখণ্ডীর ইতিহাস
দুর্যোধন প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, আপনি পূর্বে বলেছিলেন যে পাঞ্চাল ও সেমিকদের বধ করবেন, তবে শিখণ্ডীকে ছেড়ে দেবেন কেন? ভীষ্ম বললেন, তাকে কেন বধ করব না তার ইতিহাস বলছি শোন।—
আমার ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্যকে আমি রাজপদে অভিষিক্ত করি এবং তাঁর বিবাহের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবর সভা থেকে সবলে হরণ ক’রে আনি।[১] বিবাহকালে জ্যেষ্ঠকন্যা অম্বা লজ্জিতভাবে আমাকে জানালেন যে তাঁর পিতা কাশীরাজের অজ্ঞাতসারে তিনি ও শাল্বরাজ পরস্পরকে বরণ করেছেন। তখন আমি কয়েকজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও একজন ধাত্রীর সঙ্গে অম্বাকে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দিলাম এবং তাঁর দুই ভগিনী অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলাম। অম্বাকে দেখে শাল্ব বললেন, আমি তোমাকে ভার্যা করতে পারি না, তুমি অন্যপূর্বা, ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শে তুমি প্রীত হয়েছিলে, অতএব তাঁর কাছেই যাও। অম্বা বহু অনুনয় করলেও শাল্ব শুনলেন না। সেখান থেকে চ’লে এসে অম্বা এই ব’লে বিলাপ করতে লাগলেন—ভীষ্মকে ধিক, আমার মূঢ় পিতাকে ধিক যিনি পণ্যস্ত্রীর ন্যায় আমাকে বীর্যশুল্কে দান করতে চেয়েছিলেন, শাম্বরাজকে ধিক, বিধাতাকেও ধিক। ভীষ্মই আমার বিপদের মধ্যে কারণ, তাঁর উপর আমি প্রতিশোধ নেব। অম্বা নগরের বাইরে তপস্বীদের আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নিজের ইতিহাস জানিয়ে বললেন, আমি এখানে তপস্যা করতে ইচ্ছা করি। তপস্বীরা বললেন, তুমি তোমার পিতার গৃহে ফিরে যাও। অম্বা তাতে সম্মত হলেন না।
এই সময়ে অম্বার মাতামহ রাজর্ষি হোত্রবাহন সেই তপোবনে উপস্থিত হলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি আমার কাছে থাক, তোমার অনুরোধে জামদগ্ন্য পরশুরাম ভীষ্মকে বধ করবেন, তিনি আমার সখা। এমন সময়ে পরশুরামের প্রিয় অনুচর অকৃতব্রণ সেখানে এলেন। সব কথা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি কিরূপ প্রতিকার চাও? যদি ইচ্ছা কর তবে পরশুরামের আদেশে শাল্বরাজ তোমাকে বিবাহ করবেন; অথবা যদি ভীষ্মকে নির্জিত দেখতে চাও তবে পরশুরাম তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করবেন। অম্বা বললেন, ভগবান, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ না জেনেই ভীষ্ম আমাকে হরণ করেছিলেন, এই বিবেচনা ক’রে আপনিই ন্যায় অনুসারে বিধান দিন। অকৃতব্রণ বললেন, ভীষ্ম যদি তোমাকে হস্তিনাপুরে না নিয়ে যেতেন তবে পরশুরামের আজ্ঞায় শাল্ব তোমাকে মাথায় তুলে নিতেন; অতএব ভীষ্মেরই শাস্তি হওয়া উচিত।
পরদিন অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরশুরাম শিষ্যগণে পরিবেষ্টিত হয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। রূপবতী সুকুমারী অম্বার কথা শুনে পরশুরাম দয়ার্দ্র হয়ে বললেন, ভাবিনী, আমি ভীষ্মকে সংবাদ পাঠাব, তিনি আমার কথা রাখবেন[২]; যদি অন্যথা করেন তবে তাঁকে আর তাঁর অমাত্যগণকে যুদ্ধে বিনষ্ট করব। আর তা যদি না চাও তবে আমি শাল্বকেই আজ্ঞা করব। অম্বা বললেন, ভৃগুনন্দন, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ জেনেই ভীষ্ম আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু শাল্ব আমার চরিত্রদোষের আশঙ্কায় আমাকে নেন নি। আপনি বিচার করে দেখুন কি করা উচিত। আমার মনে হয় ভীষ্মই আমার বিপদের মল, তাঁকেই আপনি বধ করুন। পরশুরাম সম্মত হলেন এবং অম্বা ও ঋষিগণের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর তীরে এলেন।
তার পর ভীষ্ম বললেন, তৃতীয় দিনে পরশুরাম দূত পাঠিয়ে আমাকে আহ্বান করলেন। আমি ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণের সঙ্গে সত্বর তাঁর কাছে গেলাম এবং একটি ধেনু উপহার দিলাম। তিনি আমার পূজা গ্রহণ ক’রে বললেন, ভীষ্ম, তুমি অম্বাকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে এসে আবার কেন তাঁকে পরিত্যাগ করলে? তোমার স্পর্শের জন্যই শাল্ব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, অতএব আমার আদেশে তুমি এঁকে গ্রহণ কর। আমি পরশুরামকে বললাম, ভগবান, আমার ভ্রাতা বিচিত্র বীর্যের সঙ্গে এঁর বিবাহ দিতে পারি না, কারণ পূর্বেই শাল্বের প্রতি এর অনুরাগ হয়েছিল এবং আমি মুক্তি দিলে ইনি শাল্বের কাছেই গিয়েছিলেন। ভৃগুনন্দন, আপনি আমাকে বাল্যকালে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন, আমি আপনার শিষ্য, তবে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান কেন? পরশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি আমাকে গুরু ব’লে মানছ অথচ আমার প্রিয়কার্য করছ না। তুমিই এঁকে গ্রহণ করে বংশরক্ষা কর।
তাঁর আজ্ঞাপালনে আমাকে অসম্মত দেখে পরশুরাম বললেন, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এস, আমার বাণে তুমি নিহত হবে, গৃধ্র কঙ্ক ও কাক তোমাকে ভক্ষণ করবে, তোমার মাতা জাহ্নবী তা দেখবেন। তার পর কুরুক্ষেত্রে পরশুরামের সঙ্গে আমার ঘোর যুদ্ধে আরম্ভ হ’ল, ঋষি ও দেবতারা সেই আশ্চর্য যুদ্ধ দেখতে এলেন। আমার জননী গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে আমাকে ও পরশুরামকে নিরস্ত করতে এলেন, কিন্তু তাঁর অনুরোধ বিফল হ’ল। আমি পরশুরামকে বললাম, ভগবান, আপনি ভূমিতে আছেন, আমি রথে চ’ড়ে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না। আপনি কবচ ধাবণ ক’রে রথারোহী হয়ে যুদ্ধ করুন। পরশুরাম সহাস্যে বললেন, মেদিনী আমার রথ, বেদ সকল আমার বাহন, বায়ু আমার সারথি, বেদমাতারা আমার কবচ। এই ব’লে তিনি বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন আমি দেখলাম, নগরের ন্যায় বিশাল দিব্যাশ্বযুক্ত বিচিত্র রথে তিনি আরূঢ় রয়েছেন, তাঁর অঙ্গে চন্দ্রসূর্যচিহ্নিত কবচ, অকৃতব্রণ তাঁর সারথি।
বহুদিন ধ’রে পরশুরামের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হ’ল। তিনি আমার সারথিকে বধ করলেন, আমাকেও শরাঘাতে ভূপাতিত করলেন। তখন আমি দেখলাম, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে বাহুদ্বারা বেষ্টন ক’রে আছেন, আমার জননী গঙ্গা রথে রয়েছেন। আমি তাঁর চরণ ধরে এবং পিতৃগণকে নমস্কার ক’রে আমার রথে উঠলাম। গঙ্গা অন্তর্হিত হলেন। আমি এক হৃদয়বিদারক বাণ নিক্ষেপ করলাম, পরশুরাম মূর্ছিত হয়ে জানুতে ভর দিয়ে প’ড়ে গেলেন। কিছু ক্ষণ পরে তিনি প্রকৃতিস্থ হয়ে আমাকে মারবার জন্য তাঁর চতুর্হস্ত ধনুতে শরযোজন করলেন, কিন্তু মহর্ষিগণ তাঁকে নিবারণ করলেন।
রাত্রিকালে আমি স্বপ্ন দেখলাম, পূর্বদষ্ট আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে বলছেন, গঙ্গানন্দন, পরশুরাম তোমাকে জয় করতে পারবেন না, তুমিই জয়ী হবে। তুমি প্রস্বাপন অস্ত্র প্রয়োগ কর, তাতে পরশুরাম নিহত হবেন না, কিন্তু নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পরাস্ত হবেন। পরদিন কিছু কাল প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আমি প্রস্বাপন অস্ত্র নিক্ষেপের উদ্যোগ করলাম। তখন আকাশ থেকে নারদ আমাকে বললেন, তুমি এই অস্ত্র প্রয়োগ ক’রো না, দেবগণ বারণ করছেন; পরশুরাম তপস্বী ব্রাহ্মণ এবং তোমার গুরু। এমন সময়ে পরশুরামের পিতৃগণ আবির্ভূত হয়ে তাঁকে বললেন, বৎস, ভীষ্মের সঙ্গে আর যদ্ধ ক’রো না, ইনি মহাযশা বসু, এঁকে তুমি জয় করতে পারবে না। তার পর নারদাদি মুনিগণ এবং আমার মাতা ভাগীরথী যুদ্ধস্থানে এলেন। মুনিগণ বললেন, ভার্গব, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীতের ন্যায়, তুমি যুদ্ধে নিরস্ত হও, তোমরা পরস্পরের অবধ্য। উদিত গ্রহের ন্যায় দীপ্যমান আট জন ব্রাহ্মণ আবার আবির্ভূত হয়ে আমাকে বললেন, মহাবাহু, তুমি তোমার গুরুর কাছে যাও, জগতের মঙ্গল কর। আমি পরশুরামকে প্রণাম করলাম। তিনি সস্নেহে বললেন, ভীষ্ম, তোমার সমান ক্ষত্রিয় বীর পৃথিবীতে নেই, আমি তুষ্ট হয়েছি, এখন যাও।
পরশুরাম অম্বাকে ডেকে বললেন, ভাবিনী, আমি সর্ব শক্তি প্রয়োগ করেও ভীষ্মকে জয় করতে পারি নি, এখন তুমি তাঁর শরণ নাও, তোমার অন্য উপায় নেই। অম্বা বললেন, ভগবান, আপনি যথাসাধ্য করেছেন, অস্ত্রদ্বারা ভীষ্মকে জয় করা অসম্ভব। আমি স্বয়ং তাঁকে যুদ্ধে নিপাতিত করব।
পরশ রাম মহেন্দ্র পর্বতে চ’লে গেলেন। অম্বা যমুনাতীরের আশ্রমে কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। তার পর তিনি দুঃসাধ্য ব্রত গ্রহণ করে নানা তীর্থে অবগাহন করতে লাগলেন। বৃদ্ধ তপস্বীরা তাঁকে নিরস্ত করতে গেলে অম্বা বললেন, আমি ভীষ্মের বধের নিমিত্ত তপস্যা করছি, স্বর্গকামনায় নয়। তাঁর জন্য আমি পতিলাভে বঞ্চিত হয়েছি, আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই। আমার স্ত্রীত্ব ব্যর্থ হয়েছে সেজন্য পুরুষত্বলাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছি, আপনারা আমাকে বারণ করবেন না।
শূলপাণি মহাদেব অম্বাকে বর দিতে এলেন। অম্বা বললেন, আমি যেন ভীষ্মকে বধ করতে পারি। মহাদেব বললেন, তুমি অন্য দেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করবে, বর্তমান দেহের সব ঘটনাও তোমার মনে থাকবে। তুমি দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কিছু কাল পরে পুরুষ হবে। মহাদেব অন্তর্হিত হলেন, অম্বা নবজন্মকামনায় চিতারোহণে দেহত্যাগ করলেন।
সেই সময়ে দ্রুপদ রাজা অপত্যকামনায় মহাদেবের আরাধনা করছিলেন। মহাদেব বর দিলেন, তোমার একটি স্ত্রীপুরুষ সন্তান হবে। যথাকালে দ্রুপদমহিষী একটি পরমরূপবতী কন্যা প্রসব করলেন, কিন্তু তিনি প্রচার করলেন যে তাঁর পুত্র হয়েছে। এই কন্যাকে দ্রুপদ পুত্রের ন্যায় পালন করতে লাগলেন এবং নাম দিলেন—শিখণ্ডী। গুপ্তচরের সংবাদে, নারদ ও মহাদেবের বাক্যে, এবং অম্বার তপস্যার বিষয় জ্ঞাত থাকায় আমি বুঝেছিলাম যে শিখণ্ডীই অম্বা।
কন্যার যৌবনকাল উপস্থিত হ’লে দ্রুপদকে তাঁর মহিষী বললেন, মহাদেবের বাক্য মিথ্যা হবে না, শিখণ্ডী পুরুষ হবেই, অতএব কোনও কন্যার সঙ্গে এর বিবাহ দাও। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে শিখণ্ডীর বিবাহ হ’ল। কিছু কাল পরে এই কন্যা কয়েক জন দাসীকে তাঁর পিতার কাছে পাঠিয়ে জানালেন যে দ্রুপদকন্যা শিখণ্ডিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছে। হিরণ্যকর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দূত দ্বারা দ্রুপদকে ব’লে পাঠালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ, আমি শীঘ্রই তোমাকে অমাত্যপরিজন সহ বিনষ্ট করব।
দ্রুপদ ভীত হয়ে তাঁর মহিষীর সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। মহিষী বললেন, মহারাজ, আমার পুত্র হয় নি, সপত্নীদের ভয়ে আমি শিখণ্ডিনীকে পুরুষ ব’লে প্রচার করেছি, মহাদেবও বলেছিলেন যে আমাদের সন্তান প্রথমে স্ত্রী তার পর পুরুষ হবে। তুমি এখন মন্ত্রীদের পরামর্শ নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত কর এবং প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে দেবপূজা ও হোম কর। পিতামাতার এই কথা শুনে শিখণ্ডিনী ভাবলেন, আমার জন্য এঁরা দুঃখ পাচ্ছেন, আমার মরাই ভাল।
শিখণ্ডিনী গৃহ ত্যাগ ক’রে গহন বনে এলেন। সেই বনে স্থূণাকর্ণ নামে এক যক্ষের ভবন ছিল। শিখণ্ডিনী তাতে প্রবেশ ক’রে বহু দিন অনাহারে থেকে শরীর শুষ্ক করলেন। একদিন যক্ষ দয়ার্দ্র হয়ে দর্শন দিয়ে শিখণ্ডিনীকে বললেন, তোমার অভীষ্ট কি তা বল, আমি পূর্ণ করব। আমি কুবেরের অনুচর, অদেয় বস্তুও দিতে পারি। শিখণ্ডিনী তাঁর ইতিহাস জানিয়ে বললেন, যক্ষ, আমাকে পুরুষ করে দিন। যক্ষ বললেন, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কিছুকালের জন্য তোমাকে দেব, তাতে তুমি তোমার পিতার রাজধানী ও বন্ধুগণকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তুমি আবার এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দিও। দ্রুপদকন্যা সম্মত হয়ে যক্ষের সঙ্গে লিঙ্গবিনিময় করলেন। স্থূণাকর্ণ স্ত্রীরূপ পেলেন, শিখণ্ডী পুরুষ হয়ে পিতার কাছে গেলেন।
দ্রুপদ আনন্দিত হয়ে দশার্ণরাজকে ব’লে পাঠালেন, বিশ্বাস করুন, আমার পুত্র পরুষই। আপনি পরীক্ষা করুন, লোকে আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছে। রাজা হিরণ্যবর্মা কয়েকজন চতুরা সুন্দরী যুবতীকে পাঠালেন। তারা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা ক’রে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। তাদের কাছে সংবাদ পেয়ে দশার্ণরাজ আনন্দিত হয়ে বৈবাহিক দ্রুপদের ভবনে এলেন এবং কয়েকদিন থেকে কন্যাকে ভর্ৎসনা ক’রে চ’লে গেলেন।
কিছু কাল পরে কুবের স্থূণাকর্ণের ভবনে এলেন। তিনি তাঁর অনুচরগণকে বললেন, এই ভবন উত্তমরূপে সজ্জিত দেখছি, কিন্তু মন্দবুদ্ধি স্থূণাকর্ণ আমার কাছে আসছে না কেন? যক্ষরা বললে, মহারাজ, দ্রুপদের শিখণ্ডিনী নামে একটি কন্যা আছেন, কোনও কারণে স্থূণাকর্ণ তাঁকে নিজের পুরষলক্ষণ দিয়ে তাঁর স্ত্রীলক্ষণ নিয়েছেন। তিনি এখন স্ত্রী হয়ে গৃহমধ্যে রয়েছেন, লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারছেন না। কুবেরের আজ্ঞায় তাঁর অনুচরগণ স্থূণাকর্ণকে নিয়ে এল। কুবের ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, পাপবুদ্ধি, তুমি যক্ষগণের অপমান করেছ, অতএব স্ত্রী হয়েই থাক, আর দ্রুপদকন্যা পুরুষ হয়ে থাকুক। শিখণ্ডীর মৃত্যুর পর তুমি পূর্বরূপে ফিরে পাবে। এই বলে কুবের সদলে চ’লে গেলেন।
পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুসারে শিখণ্ডী এসে স্থূণাকর্ণকে বললেন, আমি ফিরে এসেছি। স্থূণাকর্ণ বহু বার বললেন, আমি প্রীত হয়েছি। তার পর তিনি কুবেরের শাপের কথা জানিয়ে বললেন, রাজপুত্র, এখন তুমি যেখানে ইচ্ছা বিচরণ কর, দৈবকে অতিক্রম করা আমাদের সাধ্য নয়। শিখণ্ডী আনন্দিত হয়ে রাজভবনে ফিরে গেলেন। দ্রুপদ রাজা তাঁকে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য পাঠালেন। কালক্রমে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে শিখণ্ডীও চতুষ্পাদ ধনুর্বেদ শিক্ষা করলেন।
অবার ইতিহাস শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, দুর্যোধন, আমি গুপ্তচরদের জড় অন্ধ ও বধির সাজিয়ে দ্রুপদের কাছে পাঠাতাম, তারাই আমাকে সকল বৃত্তান্ত জানিয়েছিল। শিখণ্ডী স্ত্রী ছিল, পরে পুরুষত্ব পেয়ে রথিশ্রেষ্ঠ হয়েছে, কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বাই শিখণ্ডী। আমার এই প্রতিজ্ঞা সকলেই জানে যে স্ত্রীলোককে, স্ত্রী থেকে পুরুষ হয়েছে এমন লোককে, এবং স্ত্রীনামধারী ও স্ত্রীরূপধারী পুরুষকে আমি শরাঘাত করি না।
২৮। যুদ্ধযাত্রা
পরদিন প্রভাতকালে দুর্যোধন ভীষ্ম প্রভৃতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীমার্জুন-ধৃষ্টদ্যুম্নাদি কর্তৃক রক্ষিত এই বিশাল পাণ্ডবাহিনী আপনারা কত কালে বিনষ্ট করতে পারেন?
ভীষ্ম বললেন, আমি প্রতিদিন দশ সহস্র সৈন্য এবং এক সহস্র রথীকে বধ করব, তাতে এক মাসে সমস্ত বিনষ্ট হবে। দ্রোণ বললেন, আমি স্থবির হয়েছি, শক্তি কমে গেছে, তথাপি আমিও ভীষ্মের ন্যায় এক মাসে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারি। কৃপ বললেন, আমি দুই মাসে পারি। অশ্বত্থামা বললেন, আমি দশ দিনে পারি। কর্ণ বললেন, আমি পাঁচ দিনে পারি।
কর্ণের কথায় ভীষ্ম উচ্চ হাস্য ক’রে বললেন, রাধেয়, এখন পর্যন্ত তুমি শঙ্খধনুর্বাণধারী বাসুদেবসহিত রথারোহী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হও নি তাই এমন মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছা হয় তাই বলতে পার।
যুধিষ্ঠির তাঁর গুপ্তচরদের কাছে কৌরবগণের এই আলোচনার সংবাদ পেলেন। তিনি তাঁর ভ্রাতাদের জানালে অর্জুন বললেন, কৌরবপক্ষের অস্ত্রবিশারদ যোদ্ধারা নিজেদের সামর্থ্য সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সত্য। কিন্তু আপনি মনস্তাপ দূর করুন, আমি বাসুদেবের সহায়তায় একাকীই নিমেষমধ্যে ত্রিলোক সংহার করতে পারি, কারণ কিরাতরূপী পশুপতির প্রদত্ত মহাস্ত্র আমার কাছে আছে। কিন্তু এই দিব্য অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধে লোকহত্যা অনুচিত, অতএব আমরা সরল উপায়েই শত্রু জয় করব, পরাক্রান্ত মহারথগণ আমাদের সহায় আছেন।
প্রভাতকালে কৌরবপক্ষীয় রাজগণ স্নানের পর মাল্য ও শুভ্র বসন ধারণ করলেন, তার পর হোম ও স্বস্তিবাচন করে দুর্যোধনের আদেশে পাণ্ডবগণের অভিমুখে যাত্রা করলেন। দ্রোণাচার্য প্রথম দলের, ভীষ্ম দ্বিতীয় দলের, এবং দুর্যোধন তৃতীয় দলের অগ্রণী হয়ে চললেন। কৌরববীরগণ সকলে কুরুক্ষেত্রের পশ্চিম দিকে সমবেত হলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণও সুসজ্জিত হয়ে যাত্রা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রথম সৈন্যদলের, ভীম সাত্যকি ও অজুর্ন দ্বিতীয় দলের, এবং বিরাট দ্রুপদ প্রভৃতির সঙ্গে যুধিষ্ঠির তৃতীয় দলের অগ্রবর্তী হলেন। সহস্র সহস্র অদ্ভুত অদ্ভুত সৈন্য সিংহনাদ এবং ভেরী ও শঙ্খের ধ্বনি করতে করতে পাণ্ডবদের পশ্চাতে গেল।