মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্যোগপর্ব/রথ্যতিরথসংখ্যানপর্বাধ্যায়
॥ রথ্যতিরথসংখ্যানপর্বাধ্যায়॥
২৬। রথী-মহারথ-অতিরথ-গণনা ― ভীষ্ম-কর্ণের বিবাদ
সেনাপতির পদে নিযুক্ত হয়ে ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, শক্তিধর কুমার কার্তিকেয়কে নমস্কার ক’রে আমি সেনাপতিত্বের ভার নিলাম। তুমি দুশ্চিন্তা দূর কর, আমি শাস্ত্রানুসারে যথাবিধি যুদ্ধ এবং তোমার সৈন্যরক্ষা করব।
দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আপনি গণনায় দক্ষ, উভয় পক্ষে রথী[১] ও অতিরথ[১] কে কে আছেন আমরা শুনতে ইচ্ছা করি।
ভীষ্ম বললেন, তুমি ও তোমার ভ্রাতারা সকলেই শ্রেষ্ঠ রথী। ভোজবংশীয় কৃতবর্মা, মদ্ররাজ শল্য যিনি নিজের ভাগিনেয়দের ছেড়ে তোমার পক্ষে এসেছেন, সোমদত্তের পুত্র ভুরিশ্রবা—এঁরা অতিরথ। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ দুই রথীর সমকক্ষ। কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, মাহিষ্মতীর রাজা নীল, অবন্তিদেশের বিন্দ ও অনুবিন্দ, ত্রিগর্তদেশীয় সত্যরথ প্রভৃতি পঞ্চ ভ্রাতা, তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, দুঃশাসনের পুত্র, কৌশলরাজ বৃহদ্বল, তোমার মাতুল শকুনি, রাজা পৌরব, কর্ণপুত্র বৃষসেন, মধুবংশীয় জলসন্ধ, গান্ধারবাসী অচল ও বৃষক—এঁরা রথী। কৃপাচার্য অতিরথ। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মহারথ[১], কিন্তু একটি মহাদোষের জন্য আমি তাঁকে রথী বা অতিরথ মনে করতে পারি না,—ইনি নিজের জীবন অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করেন, নতুবা ইনি অদ্বিতীয় বীর হতেন। দ্রোণাচার্য একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ, ইনি দেব গন্ধর্ব মনুষ্য সকলকেই বিনষ্ট করতে পারেন, কিন্তু স্নেহবশে অর্জুনকে বধ করবেন না। বাহ্নীক অতিরথ। তোমার সেনাপতি সত্যবান, মহাবল মায়াবী রাক্ষস অলম্বুষ, প্রাগ্জ্যোতিষরাজ ভগদত্ত—এঁরা মহারথ। তোমার প্রিয় সখা ও মন্ত্রণাদাতা নীচপ্রকৃতি অত্যন্ত গর্বিত এই কর্ণ অতিরথ নয়, পূর্ণরথীও নয়। এ সর্বদাই পরনিন্দা করে, এর সহজাত কবচকুণ্ডল এখন নেই, পরশুরামের শাপে এর শক্তিরও ক্ষয় হয়েছে। আমার মতে কর্ণ অর্ধরথ, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করলে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না।
দ্রোণ বললেন, ভীষ্মের কথা সত্য, কর্ণের অভিমান আছে, অথচ এঁকে যুদ্ধ থেকে পালাতেও দেখা যায়। কর্ণ দয়ালু ও অসাবধান, সেজন্য আমিও এঁকে অর্ধরথ মনে করি।
ক্রোধে চক্ষু বিস্ফারিত ক’রে কর্ণ বললেন, পিতামহ, আপনি বিনা অপরাধে আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, দূর্যোধনের জন্যই আমি তা সহ্য করি। আমার মতে আপনিই অর্ধরথ। লোকে আবার বলে ভীষ্ম মিথ্যা কথা বলেন না! আপনি ইচ্ছামত রথী আর অতিরথ ব’লে যোদ্ধাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করছেন। ভীষ্ম সর্বদাই কৌরবগণের অহিতাচরণ করেন, কিন্তু আমাদের রাজা তা বোঝেন না। দুর্যোধন, ভীষ্মের অভিসন্ধি ভাল নয়, তুমি এঁকে ত্যাগ কর। ইনি সকলের সঙ্গেই স্পর্ধা করেন, কাকেও পুরুষ ব’লে গণ্য করেন না, অথচ এঁকে দেখলে সব পণ্ড হয়।[২] বৃদ্ধের বচন শোনা উচিত, কিন্তু অতিবৃদ্ধের নয়, তাঁরা বালকের সমান। ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করব না, এঁর মৃত্যুর পর আমি বিপক্ষের সকল মহারথের সঙ্গেই যুদ্ধ করব।
ভীষ্ম বললেন, সূতপুত্র, যুদ্ধ আসন্ন, এ সময়ে আমাদের মধ্যে ভেদ হওয়া অনুচিত, সেই কারণেই তুমি জীবিত রইলে। স্বয়ং জামদগ্ন্য পরশুরাম আমাকে অস্ত্রাঘাতে পীড়িত করতে পারেন নি, তুমি আমার কি করবে?
দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমার কিসে শুভ হবে সেই চিন্তা করুন, আপনাদের দুজনকেই মহৎ কর্ম করতে হবে। এখন বলুন পাণ্ডবপক্ষে রথী মহারথ ও অতিরথ কে কে আছেন।
ভীষ্ম বললেন, যধিষ্ঠির নকুল সহদেব প্রত্যেকেই রথী। ভীম আট রথীর সমান। স্বয়ং নারায়ণ যাঁর সহায় সেই অর্জুনের সমান বীর ও রথী উভয় সৈন্যের মধ্যে নেই, কেবল আমি আর দ্রোণাচার্য তাঁর সম্মুখীন হ’তে পারি। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র সকলেই মহারথ। বিরাটপুত্র উত্তর, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, এবং দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী এঁরা উত্তম রথী। অভিমন্যু, সাত্যকি ও দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন— এঁরা অতিরথ। বৃদ্ধ হ’লেও দ্রুপদ ও বিরাটকে আমি মহারথ মনে করি। ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্রধর্মা এখনও বালক সেজন্য অর্ধরথ। শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, জয়ন্ত অমিতৌজা, সত্যজিৎ, অজ, ভোজ ও রোচমান—এঁরা মহারথ। কেকয়দেশীয় পঞ্চ ভ্রাতা, কাশীরাজ কুমার, নীল, সূর্যদত্ত, শঙ্খ, মদিরাশ্ব, ব্যাঘ্রসেন, চন্দ্রদত্ত, সেনাবিন্দু, ক্রোধহন্তা, কাশ্য—এঁরা সকলেই রথী। দ্রুপদপুত্র সত্যজিৎ, শ্রেণিমান ও বসুদান রাজা, কুন্তিভোজদেশীয় পাণ্ডবমাতুল পুরুজিৎ, এবং ভীম-হিড়িম্বার পুত্র মায়াবী ঘটোৎকচ—এঁরা সকলেই অতিরথ।
তার পর ভীষ্ম বললেন, আমি তোমার জন্য যথাসাধ্য যুদ্ধ করব, কিন্তু শিখণ্ডী শরক্ষেপে উদ্যত হ’লেও তাঁকে বধ করব না, কারণ সে পূর্বে স্ত্রী ছিল, পরে পুরুষ হয়েছে। পাণ্ডবগণকেও আমি বধ করব না।