মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্যোগপর্ব/ভগবদ্যানপর্বাধ্যায়
॥ ভগবদ্যানপর্বাধ্যায়॥
১০। কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদি ও দ্রৌপদীর অভিমত
সঞ্জয় হস্তিনাপরে চ’লে গেলে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ নেই যিনি আমাদের বিপদ থেকে ত্রাণ করতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধনের অভিপ্রায় কি তা তুমি সঞ্জয়ের কথায় জেনেছ। লুব্ধ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের রাজ্য ফিরিয়ে না দিয়েই শান্তি কামনা করছেন, তিনি স্বধর্ম দেখছেন না, স্নেহের বশে মূর্খ পুত্রের মতে চলছেন। জনার্দন, আমি আমার মাতা ও মিত্রগণকে পালন করতে পারছি না এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? দ্রুপদ বিরাট প্রভৃতি রাজগণ এবং তুমি সহায় থাকতেও আমি শুধু পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলাম, কিন্তু দুরাত্মা দুর্যোধন তাও দেবে না। ধনশালী লোক ধনহীন হ'লে যত দুঃখ পায়, স্বভাবত নির্ধন লোক তত দুঃখ পায় না। আমরা কিছুতেই পৈতৃক সম্পত্তি ত্যাগ করতে পারি না, উদ্ধারের চেষ্টায় যদি আমাদের মৃত্যু হয় তাও ভাল। যুদ্ধ পাপজনক, তাতে দুই পক্ষেরই ক্ষতি হয়; যাঁরা সজ্জন ধীর ও দয়ালু, তাঁরাই যুদ্ধে মরেন, নিকৃষ্ট লোকেই বেঁচে থাকে। বৈর দ্বারা বৈরের নিবৃত্তি হয় না, বরং বৃদ্ধি হয়, যেমন ঘৃতযোগে অগ্নির হয়। আমরা রাজ্য ত্যাগ করতে চাই না, কুলক্ষয়ও চাই না। আমরা সর্বতোভাবে সন্ধির চেষ্টা করব, তা যদি বিফল হয় তবেই যুদ্ধ করব। কুকুর প্রথমে লাঙ্গুল চালনা, তার পর গর্জন, তার পর দন্তপ্রকাশ, তার পর যুদ্ধ করে, তাদের মধ্যে যে বলবান সেই মাংস ভক্ষণ করে। মানুষেরও এই স্বভাব, কোনও প্রভেদ নেই। মাধব, এখন কি করা উচিত? যাতে আমাদের স্বার্থ ও ধর্ম দুই রক্ষা হয় এমন উপায় তুমি বল, তোমার তুল্য সুহৃৎ আমাদের কেউ নেই।
কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনাদের দুই পক্ষের হিতার্থে আমি কৌরবসভায় যাব, যদি আপনাদের স্বার্থহানি না করে শান্তি স্থাপন করতে পারি তবে আমার মহাপুণ্য হবে। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি কৌরবদের কাছে যাবে এ আমার মত নয়। দুর্যোধন তোমার কথা রাখবে না, সে যদি তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করে তবে তা আমাদের অত্যন্ত দঃখকর হবে। কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন পাপমতি তা আমি জানি, কিন্তু আমি যদি সন্ধির জন্য তাঁর কাছে যাই তবে অন্য লাভ না হলেও লোকে আমাদের যুদ্ধপ্রিয় ব’লে দোষ দেবে না, কৌরবগণ আমাকে ক্রুদ্ধ করতেও সাহস করবেন না।
যধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তোমার যা অভিরুচি তাই কর, তুমি কৃতকার্য হয়ে নিরাপদে ফিরে এস। তুমি কথা বলতে জান, যে বাক্য ধর্ম সংগত ও আমাদের হিতকর তা মৃদু বা কঠোর যাই হ’ক তুমি বলবে। কৃষ্ণ বললেন, আপনার বুদ্ধি ধর্মাশ্রিত, কিন্তু কৌরবগণ শত্রুতা করতে চান। যুদ্ধ না ক’রে যা পাওয়া যাবে তাই আপনি যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হওয়া বা হত হওয়াই ক্ষত্রিয়ের সনাতন ধর্ম, দুর্বলতা তাঁর পক্ষে প্রশংসনীয় নয়। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সন্ধি করবেন এমন সম্ভাবনা নেই, ভীষ্মদ্রোণাদির ভরসায় তাঁরা নিজেদের প্রবল মনে করেন, আপনি মৃদুভাবে অনুরোধ করলে তাঁরা শুনবেন না। আমি কৌরবসভায় গিয়ে আপনার গুণ আর দুর্যোধনের দোষ দুইই বলব, সকলের সমক্ষে দুর্যোধনের নিন্দা করব। কিন্তু আমি যুদ্ধেরই আশঙ্কা করছি, বিবিধ দুর্লক্ষণও দেখছি, অতএব আপনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ন।
ভীম বললেন, মধুসূদন, তুমি এমনভাবে কথা ব’লো যাতে শান্তি হয়, যুদ্ধের ভয় দেখিও না। দুর্যোধন অসহিষ্ণু ক্রোধী, কিসে ভাল হয় তা বোঝে না, তাকে মিষ্ট বাক্য ব’লো। আমরা বরং হীনতা স্বীকার করব, কিন্তু ভরতবংশ যেন বিনষ্ট না হয়। তুমি পিতামহ ভীষ্ম ও সভাসদ্গণকে ব’লো, তাঁদের যত্নে যেন দুর্যোধন শান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপিত হয়। আমি শান্তির জন্যই বলছি, ধর্মরাজও শান্তির প্রশংসা করেন; অর্জুন দয়ালু, তিনিও যদ্ধার্থী নন।
কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ভীমসেন, ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করবার ইচ্ছায় তুমি অন্য সময়ে যুদ্ধের প্রশংসাই ক’রে থাক। তুমি নিদ্রা যাও না, উবুড় হয়ে শোও, সর্বদাই অশান্ত বাক্য বল, অকারণে হাস বা কাঁদ, দুই জানুর মধ্যে মাথা রেখে দীর্ঘকাল চক্ষু মুদে থাক এবং প্রায়ই ভ্রূকুটি ও ওষ্ঠদংশন কর। ক্রোধের জন্যই এমন তুমি বলেছিলে, ‘পূর্বদিকে সূর্যোদয় এবং পশ্চিম দিকে সূর্যাস্ত যেমন ধ্রুব সত্য, আমি গদাঘাতে দুর্যোধনকে বধ করব এও সেরূপ সত্য।’ তুমি ভ্রাতাদের কাছে গদা স্পর্শ ক’রে এই শপথ করেছ, অথচ আজ তুমি শান্তিকামী হয়েছ। কি আশ্চর্য, যুদ্ধকাল উপস্থিত হ’লে যুদ্ধকামীরও চিত্ত বিমুখ হয়, তুমিও ভয় পেয়েছ! পর্বতের বিচলন যেমন আশ্চর্য তোমার কথাও সেইরূপ। ভরতবংশধর, তোমার কুলগৌরব স্মরণ কর, উৎসাহী হও, অবসাদ ত্যাগ কর। অরিন্দম, এই গ্লানি তোমার অযোগ্য, ক্ষত্রিয় নিজের বীর্যে যা লাভ করে না তা ভোগও করে না।
কোপনস্বভাব ভীম উত্তম অশ্বের ন্যায় কিঞ্চিৎ ধাবিত হয়ে বললেন, কৃষ্ণ আমার উদ্দেশ্য না বুঝেই তুমি অন্যরূপ মনে করছ। তুমি দীর্ঘকাল আমার সঙ্গে বাস করেছ সেজন্য আমার স্বভাব তোমার জানা উচিত; অথবা অগাধ জলে যে ভাসে সে যেমন জলের পরিমাণ বোঝে না তেমনই তুমিও আমাকে বোঝ না। মাধব, তুমি অন্যায় বাক্যে আমাকে ভর্ৎসনা করেছ, আর কেউ এমন করতে সাহস করে না। আত্মপ্রশংসা নীচ লোকের কর্ম, কিন্তু তোমার তিরস্কারে তাড়িত হয়ে আমি নিজের বলের কথা বলছি। —এই অন্তরীক্ষ ও এই জগৎ যদি সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে দুই শিলাখণ্ডের ন্যায় ধাবিত হয় তবে আমি দুই বাহু দিয়ে তাদের রোধ করতে পারি। সমস্ত পাণ্ডবশত্রুকে আমি ভূতলে ফেলে পা দিয়ে মর্দন করব। জনার্দন, যখন ঘোর যুদ্ধ উপস্থিত হবে তখন তুমি আমাকে জানতে পারবে। আমার দেহ অবসন্ন হয় না, মন কম্পিত হয় না, সর্বলোক রুদ্ধ হ’লেও আমি ভয় পাই না। সৌহার্দ্য ও ভরতবংশের রক্ষার জন্যই আমি শান্তির কথা বলেছি।
কৃষ্ণ বললেন, তোমার মনোভাব জানবার জন্য আমি প্রণয়বশেই বলেছি, তিরস্কার বা পাণ্ডিত্যপ্রকাশের জন্য নয়। তোমার মাহাত্ম্য বল ও কীর্তি আমি জানি। তুমি ক্লীবের ন্যায় কথা বলছিলে সেজন্য শঙ্কিত হয়ে আমি তোমার তেজ উদ্দীপিত করেছি।
অর্জুন বললেন, জনার্দন, আমার যা বলবার ছিল তা যুধিষ্ঠিরই বলেছেন। তুমি মনে করছ যে ধৃতরাষ্ট্রের লোভ এবং আমাদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য শান্তিস্থাপন সুসাধ্য হবে না। সম্যক যত্ন করলে কর্ম নিশ্চয়ই সফল হয়। তুমি আমাদের হিতার্থে যা করতে যাচ্ছ তা মৃদু বা কঠোর কি ভাবে সম্পন্ন হবে তা অনিশ্চিত। তুমি যদি মনে কর যে ওদের বধ করাই উচিত তবে অবিলম্বে আমাদের সেই উপদেশই দিও, আর বিচার ক’রো না।
কৃষ্ণ বললেন, তুমি যা বললে আমি তাই করব, কিন্তু দৈব অনুকূল না হ’লে কেবল পুরুষকারে কর্ম সম্পন্ন হয় না। ধর্মরাজ পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন, কিন্তু দুর্যোধনকে তা বলা উচিত নয়, সেই পাপাত্মা তাতেও সম্মত হবে না। বাক্য ও কর্ম দ্বারা যা সাধ্য তা আমি করব, কিন্তু শান্তির আশা করি না।
নকুল বললেন, মাধব, ধর্মরাজ ভীমসেন ও অর্জুনের মত তুমি শুনেছ; সে সমস্ত অতিক্রম ক’রে তুমি যা কালোচিত মনে কর তাই করবে। মানুষের মতের স্থিরতা নেই, বনবাসকালে আমাদের একপ্রকার মত ছিল, অজ্ঞাতবাসকালে অন্যপ্রকার হয়েছিল, এখন আবার অন্যপ্রকার হয়েছে। তোমার প্রসাদে আমাদের কাছে সাত অক্ষৌহিণী সেনা সমাগত হয়েছে, এদের দেখলে কে ভীত হবে না? তুমি কৌরবসভায় গিয়ে প্রথমে মৃদুবাক্য বলবে, তার পর ভয় দেখাবে। তোমার কথা শুনে ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ও বাহ্ণীকরাজ অবশ্যই বুঝবেন কিসে সকলের শ্রেয় হবে এবং তাঁরা ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনকেও বোঝাতে পারবেন।
সহদেব বললেন, কৃষ্ণ, ধর্মরাজ যা বলেছেন তা সনাতন ধর্ম বটে, কিন্তু যাতে যুদ্ধ হয় তুমি তাই করবে, কৌরবরা শান্তি চাইলেও তুমি যুদ্ধ ঘটাবে। দ্যূতসভায় পাঞ্চালীর নিগ্রহের পর যদি দুর্যোধন নিহত না হয় তবে আমার ক্রোধ কি ক’রে শান্ত হবে? ধর্মরাজ আর ভীমার্জুন যদি ধর্ম নিয়েই থাকেন তবে আমি ধর্ম ত্যাগ ক’রে যুদ্ধ করব। মূর্খ দুর্যোধনকে তুমি ব’লো, আমরা হয় বনবাসের কষ্টভোগ করব নতুবা হস্তিনাপুরে রাজত্ব করব।
সাত্যকি বললেন, মহামতি সহদেব সত্য বলেছেন, দুর্যোধন হত হ’লেই আমার ক্রোধের শান্তি হবে। রণকর্কশ বীর সহদেবের যে মত, সকল যোদ্ধারই সেই মত। সাত্যকির কথা শনে যোদ্ধারা চারিদিক থেকে সিংহনাদ ক’রে উঠলেন এবং সকলেই সাধু সাধু বললেন।
অশ্রুপূর্ণ নয়নে দ্রৌপদী বললেন, মধুসূদন, তুমি জান যে দুর্যোধন শঠতা করে পাণ্ডবগণকে রাজ্যচ্যুত করেছে, ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায়ও সঞ্জয়ের মুখে শুনেছ। যুধিষ্ঠির পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন, দুর্যোধন সে অনুরোধও গ্রাহ্য করে নি। রাজ্য না দিয়ে সে যদি সন্ধি করতে চায় তবে তুমি সম্মত হয়ো না, পাণ্ডবগণ তাঁদের মিত্রদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুর্যোধনের সৈন্য বিনষ্ট করতে পারবেন। তুমি কৃপা ক’রো না, সাম বা দান নীতিতে যে শত্রু শান্ত হয় না তার উপর দণ্ডপ্রয়োগই বিধেয়। এই কার্য পাণ্ডবদের কর্তব্য, তোমার পক্ষে যশস্কর, ক্ষত্রিয়েরও সুখকর। ধর্মজ্ঞরা জানেন, অবধ্যকে বধ করলে যে দোষ হয় বধ্যকে বধ না করলে সেই দোষ হয়। জনার্দন, যজ্ঞবেদী থেকে আমার উৎপত্তি, আমি দ্রুপদরাজের কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, তোমার প্রিয়সখী, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, পঞ্চ ইন্দ্রতুল্য পঞ্চ পাণ্ডবের মহিষী; আমার মহারথ পঞ্চ পুত্র তোমার কাছে অভিমন্যুরই সমান। কেশব, তোমরা জীবিত থাকতে আমি দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের সমক্ষেই নিগৃহীত হয়েছি, এঁদের নিশ্চেষ্ট দেখে আমি ‘গোবিন্দ রক্ষা কর’ ব’লে তোমাকে স্মরণ করেছি। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের বরে এঁরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে বনবাসে যাত্রা করেন। ধিক অর্জুনের ধনুর্ধারণ, ধিক ভীমসেনের বল, দুর্যোধন মুহূর্তকালও জীবিত আছে!
তার পর অসিতনয়না কৃষ্ণা তাঁর সুবাসিত সুন্দর বক্রাগ্র মহাভূজঙ্গসদৃশ বেণী বাম হস্তে ধ’রে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, তুমি যখন সন্ধির কথা বলবে তখন আমার এই বেণী স্মরণ ক’রো—যা দুঃশাসন হাত দিয়ে টেনেছিল। ভীমার্জুন যদি সন্ধি কামনা করেন তবে আমার বৃদ্ধ পিতা ও তাঁর মহারথ পুত্রগণ কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, অভিমন্যুকে অগ্রবর্তী ক’রে আমার পাঁচ বীর পুত্রও যুদ্ধ করবে, দুঃশাসনের শ্যামবর্ণ বাহু যদি ছিন্ন ও ধূলিলণ্ঠিত না দেখি তবে আমার হৃদয় কি ক’রে শান্ত হবে? প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় ক্রোধ নিরুদ্ধ রেখে আমি তের বৎসর কাটিয়েছি, এখন ধর্মভীরু ভীমের শান্ত বাক্য শুনে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। এই ব’লে দ্রৌপদী অশ্রুধারায় বক্ষ সিক্ত করে কম্পিতদেহে গদ্গদকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন।
কৃষ্ণ বললেন, ভাবিনী, যাদের উপর তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ সেই কৌরবগণ সসৈন্যে সবান্ধবে বিনষ্ট হবে, তাদের ভার্যারা রোদন করবে। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ যদি আমার কথা না শোনে তবে তারা নিহত হয়ে ভূমিতে পড়ে শৃগালকুক্করের খাদ্য হবে। হিমালয় যদি বিচলিত হয়, মেদিনী যদি শতধা বিদীর্ণ হয়, নক্ষত্রসমেত আকাশ যদি পতিত হয়, তথাপি আমার কথা ব্যর্থ হবে না। কৃষ্ণা, অশ্রুসংবরণ কর, তুমি শীঘ্রই দেখতে পাবে তোমার পতিগণ শত্রুবধ ক’রে রাজশ্রী লাভ করেছেন।
১১। কৃষ্ণের হস্তিনাপুরগমন
শরৎকালের অন্তে কার্তিক মাসে একদিন প্রভাতকালে শভ মুহূর্তে কৃষ্ণ স্নানাহ্ণিক ক’রে সূর্য ও অগ্নির উপাসনা করলেন। তার পর তিনি শুভযাত্রার জন্য বৃষস্পর্শ, ব্রাহ্মণদের অভিবাদন এবং অগ্নি প্রদক্ষিণ ক’রে শিনির পৌত্র সাত্যকিকে বললেন, শঙ্খ চক্র গদা তূণীর শক্তি ও অন্যান্য সর্বপ্রকার অস্ত্র আমার রথে রাখ, কারণ শত্রুকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। কৃষ্ণের পরিচারকগণ তাঁর রথ প্রস্তুত করলে। এই রথ চতুরশ্বযোজিত, অর্ধচন্দ্র চন্দ্র মৎস্য পশু পক্ষী ও পুষ্পের চিত্রে শোভিত, স্বর্ণ ও মণিরত্নে ভূষিত, এবং ব্যাঘ্রচর্মে আবৃত। রথের উপরে গরুড়ধ্বজ স্থাপিত হলে কৃষ্ণ সাত্যকিকে তুলে নিলেন। বশিষ্ঠ বামদেব শুক্র নারদ প্রভৃতি দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ কৃষ্ণের দক্ষিণ দিকে দাঁড়ালেন। পাণ্ডবগণ এবং দ্রুপদ বিরাট প্রভৃতি কিছুদূর অনুগমন করলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, জনার্দন, যিনি আমাদের বাল্যকাল থেকে বর্ধিত করেছেন, দুর্যোধনের ভয় ও মৃত্যুসংকট থেকে রক্ষা করেছেন, আমাদের জন্য বহু দুঃখ ভোগ করেছেন, পুত্রবিরহবিধুরা আমাদের সেই মাতাকে তুমি অভিবাদন ও আলিঙ্গন ক’রে আশ্বস্ত ক’রো। আমরা যখন বনে যাই তখন তিনি সরোদনে আমাদের পশ্চাতে ধাবিত হয়েছিলেন, আমরা তাঁকে পরিত্যাগ করে প্রস্থান করেছিলাম। তুমি ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও অশ্বত্থামা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ রাজগণকে আমাদের হয়ে অভিবাদন করো, মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরকে আলিঙ্গন ক’রো।
অর্জুন বললেন, গোবিন্দ, দুর্যোধন যদি তোমার কথায় অবজ্ঞা না ক’রে অর্ধরাজ্য আমাদের দেয় তবে আমরা সুখী হব, তা যদি না করে তবে তার পক্ষের সকল ক্ষত্রিয়কে আমি বিনষ্ট করব। এই কথা শুনে ভীম আনন্দিত হয়ে কম্পিত দেহে সগর্বে গর্জন ক’রে উঠলেন। সেই নিনাদ শুনে সৈন্যগণ কম্পিত হ’ল, হস্তী অশ্ব প্রভৃতি মলমূত্র ত্যাগ করলে।
কৃষ্ণের সারথি দারুক দ্রুতবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর যাবার পর নারদ দেবল মৈত্রেয় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পরশুরাম প্রভৃতি মহর্ষিগণ কৃষ্ণের কাছে এসে বললেন, মহামতি কৃষ্ণ, আমরা তোমার বাক্য ও তার প্রত্যুত্তর শোনবার জন্য কৌরবসভায় যাচ্ছি। তুমি নির্বিঘ্নে অগ্রসর হও, সভায় আবার আমরা তোমাকে দেখব। সূর্যাস্তকালে আকাশ লোহিতবর্ণ হ’লে কৃষ্ণ বুকস্থলগ্রামে পৌঁছলেন। পরিচারকগণ তাঁর রাত্রিবাসের জন্য সেখানে শিবিরস্থাপন ও খাদ্যপানীয় প্রস্তুত করলে। কৃষ্ণ স্থানীয় ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ ক’রে ভোজন করালেন।
কৃষ্ণ আসছেন এই সংবাদ দূতমুখে শুনে ধৃতরাষ্ট্র হৃষ্ট হয়ে তাঁর উপযুক্ত সংবর্ধনার জন্য পুত্রকে আদেশ দিলেন। দুর্যোধন নানা স্থানে সুসজ্জিত পটমণ্ডপ নির্মাণ এবং খাদ্য পেয় প্রভৃতির আয়োজন করলেন। কৃষ্ণ সে সকল উপেক্ষা করে কৌরবরাজধানীর দিকে চললেন।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, আমি কৃষ্ণকে অশ্বসমেত ষোলটি স্বর্ণ ভূষিত রথ, আটটি মদস্রাবী হস্তী, যাদের সন্তান হয় নি এমন এক শ রূপবতী দাসী, এক শ দাস এবং বহু কম্বল ও মৃগচর্ম উপহার দেব। এই উজ্জ্বল বিমল মণি যা দিনে ও রাত্রিতে দীপ্তি দেয়, এটিও দেব। দুর্যোধন ভিন্ন আমার সকল পুত্র ও পৌত্র, সালংকারা বারাঙ্গনাগণ এবং অনাবৃতমুখে কল্যাণীয়া কন্যাগণ কৃষ্ণর প্রত্যূদ্গমনের জন্য যাবে। ধ্বজপতাকায় নগর সাজানো হ’ক, পথে জল দেওয়া হ’ক।
বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনি সরল পথে চলুন, আমি বুঝতে পারছি আপনি ধর্মের জন্য বা কৃষ্ণের প্রিয়কামনায় উপহার দিচ্ছেন না, আপনার এই ভূরিদক্ষিণা মিথ্যা ছল মাত্র। পাণ্ডবরা পাঁচটি গ্রাম চান, আপনি তাও দিতে প্রস্তুত নন, অথচ অর্থ দিয়ে কৃষ্ণকে স্বপক্ষে আনবার ইচ্ছা করছেন। ধনদান বা নিন্দা বা অন্য উপায়ে আপনি কৃষ্ণার্জুনের মধ্যে ভেদ ঘটাতে পারবেন না। পূর্ণ কুম্ভ, পাদপ্রক্ষালনের জল এবং কুশলপ্রশ্ন ভিন্ন জনার্দন কিছুই গ্রহণ করবেন না। তিনি কুরু পাণ্ডবের মঙ্গলকামনায় আসছেন, আপনি তাঁর সেই কামনা পূর্ণ করুন।
দুর্যোধন বললেন, বিদুর সত্য বলেছেন, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রতি অনুরক্ত, তাঁকে আমাদের পক্ষে আনা যাবে না। তিনি নিশ্চয়ই পূজার্হ, কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা ক’রে তাঁকে এখন মহার্ঘ উপহার দেওয়া উচিত নয়, তিনি মনে করবেন আমরা ভয় পেয়েছি। আমরা যুদ্ধে উদ্যোগী হয়েছি, যুদ্ধ ভিন্ন শান্তি হবে না।
কুরুপিতামহ ভীষ্ম বললেন, তোমরা কৃষ্ণের সমাদর কর বা না কর তিনি ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু তাঁকে যেন অবজ্ঞা করা না হয়। তিনি যা বলবেন বিশ্বস্তচিত্তে তোমাদের তাই করা উচিত। তিনি ধর্মসংগত ন্যায্য কথাই বলবেন, তোমরাও তাঁকে প্রিয়বাক্য ব’লো।
দুর্যোধন বললেন, আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজ্যভোগ করতে পারব না। যা স্থির করেছি শুনুন—আমি জনার্দনকে আবদ্ধ ক’রে রাখব, তা হলে যাদবগণ পাণ্ডবগণ এবং সমস্ত পৃথিবী আমার বশে আসবে।
দুর্যোধনের এই দুরভিসন্ধি শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, এমন ধর্ম বিরুদ্ধে কথা ব’লো না, হৃষীকেশ দূত হয়ে আসছেন, তার উপর তিনি তোমার বৈবাহিক, আমাদের প্রিয় এবং নিরপরাধ। ভীষ্ম বললেন, ধৃতরাষ্ট্র, তোমার দুর্বুদ্ধি পুত্র কেবল অনর্থ বরণ করে, তুমিও এই পাপাত্মার অনুসরণ করছ। কৃষ্ণকে বন্ধন করলে দুর্যোধন তার অমাত্য সহ ক্ষণমধ্যে বিনষ্ট হবে। এই ব’লে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সভা ত্যাগ ক’রে চ’লে গেলেন।
প্রাতঃকালে কৃষ্ণ বৃকস্থল ত্যাগ করে হস্তিনাপুরে এলেন। দুর্যোধনের ভ্রাতারা এবং ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি অগ্রসর হয়ে তাঁর প্রত্যুদ্গমন করলেন। রাজপথে বহু লোক কৃষ্ণের স্তুতি করতে লাগল, বরনারীগণ উপর থেকে দেখতে লাগলেন, তাঁদের ভারে অতিবৃহৎ অট্টালিকাও যেন স্থানচ্যুত হল। তিন কক্ষ্যা (মহল) অতিক্রম ক’রে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রাদি সকলেই গাত্রোত্থান ক’রে সংবর্ধনা করলেন। পুরোহিতগণ যথাবিধি গো মধুপর্ক ও জল দিয়ে কৃষ্ণের সৎকার করলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর কৃষ্ণ বিদুরের ভবনে গেলেন এবং অপরাহ্ণে পিতৃষ্বসা কুন্তীর সঙ্গে দেখা করলেন।
১২। কুন্তী, দুর্যোধন ও বিদুরের গৃহে কৃষ্ণ
কৃষ্ণের কণ্ঠ আলিঙ্গন ক’রে কুন্তী সরোদনে বললেন, বৎস, আমার পুত্রেরা বাল্যকালেই পিতৃহীন হয়েছিল, আমিই তাদের পালন করেছিলাম। পূর্বে যারা বহু ঐশ্বর্যের মধ্যে সুখে বাস করত তারা কি করে বনবাসের কষ্ট সইল? ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির ও মহাবল ভীমার্জুন কেমন আছে? জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বশবর্তী আমার সেবাকারী বীর সহদেব কেমন আছে? যাকে আমি নিমেষমাত্র না দেখে থাকতে পারতাম না সেই নকুল কেমন আছে? যিনি আমার সকল পুত্র অপেক্ষা প্রিয়, যিনি কুরসভায় নিগৃহীত হয়েছিলেন, সেই কল্যাণী দ্রৌপদী কেমন আছেন? আমি দুর্যোধনের দোষ দিচ্ছি না, নিজের পিতারই নিন্দা করি। বাল্যকালে যখন আমি কন্দুক নিয়ে খেলতাম তখন তিনি কেন আমাকে কুন্তিভোজের[১] হাতে দিয়েছিলেন? আমি পিতা ও ভাশুর ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক বঞ্চিত হয়েছি, আমার বেঁচে লাভ কি? অর্জুনের জন্মকালে দৈববাণী হয়েছিল—এই পুত্র পৃথিবীজয়ী হবে, এর যশ স্বর্গ স্পর্শ করবে। কৃষ্ণ, যদি ধর্ম থাকেন তবে যাতে সেই দৈববাণী সফল হয় তার চেষ্টা করো। ধনঞ্জয় আর বৃকোদরকে ব’লো, ক্ষত্রিয় নারী যে নিমিত্ত পুত্র প্রসব করে তার কাল উপস্থিত হয়েছে। এই কাল যদি বৃথা অতিক্রম কর তবে তা অতি অশভকর কর্ম হবে। উপযুক্ত কাল সমাগত হ’লে জীবনত্যাগও করতে হয়, তোমরা যদি নীচ কর্ম কর তবে চিরকালের জন্য আমি তোমাদের ত্যাগ করব। নকুল-সহদেবকে ব’লো, তোমরা বিক্রমার্জিত সম্পদ ভোগ কর, প্রাণের মায়া ক’রো না। অর্জুনকে ব’লো, তুমি দ্রৌপদীর নির্দিষ্ট পথে চলবে।
কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, আপনার ন্যায় মহীয়সী কে আছেন? হংসী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে আসে সেইরূপ আপনার পিতা শূরের[২] বংশ থেকে আপনি কুন্তিভোজের বংশে এসেছেন। আপনি বীরপত্নী, বীরজননী। শীঘ্রই পুত্রদের নীরোগ কৃতকার্য হতশত্রু, রাজশ্রীসমন্বিত ও পৃথিবীর অধিপতি দেখবেন।
কুন্তীর নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ দুর্যোধনের গৃহে গেলেন। সেখানে দুঃশাসন কর্ণ শকুনি এবং নানা দেশের রাজারা ছিলেন। সংবর্ধনার পর কৃষ্ণ আসনে উপবিষ্ট হ’লে দুর্যোধন তাঁকে ভোজনের অনুরোধ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণ সম্মত হলেন না। দুর্যোধন বললেন, জনার্দন, তোমার জন্য যে খাদ্য পানীয় বসন ও শয্যার আয়োজন করা হয়েছে তা তুমি নিলে না কেন? তুমি কুরুপাণ্ডব দুই পক্ষেরই হিতাকাঙ্ক্ষী ও আত্মীয়, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়, তথাপি আমাদের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করলে এর কারণ কি?
কৃষ্ণ তাঁর বিশাল বাহু তুলে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, ভরতবংশধর, দূত কৃতকার্য হ’লেই ভোজন ও পূজা গ্রহণ করে। দুর্যোধন বললেন, এমন কথা বলা তোমার উচিত নয়, তুমি কৃতকার্য বা অকৃতকার্য যাই হও আমরা তোমাকে পূজা করবার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে আছি, তোমার সঙ্গে আমাদের শত্রুতা বা কলহ নেই, তবে আপত্তি করছ কেন? ঈষৎ হাস্য ক’রে কৃষ্ণ বললেন, সম্প্রীতি থাকলে অথবা বিপদে পড়লে পরের অন্ন খাওয়া যায়। রাজা, তুমি আমাদের উপর প্রীত নও, আমি বিপদেও পড়ি নি। শত্রুর অন্ন খাওয়া অনুচিত, তাকে অন্ন দেওয়াও অনুচিত। তুমি পাণ্ডবদের বিদ্বেষ কর, কিন্তু তাঁরা আমার প্রাণস্বরূপ। যে পাণ্ডবদের শত্রুতা করে সে আমারও করে, যে তাঁদের অনুকূল সে আমারও অনুকূল। দুরভিসন্ধির জন্য তোমার অন্ন দুষিত, তা আমার গ্রহণীয় নয়, আমি কেবল বিদুরের অন্নই খেতে পারি।
তার পর কৃষ্ণ বিদুরের গৃহে গেলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি সেখানে গিয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তোমার বাসের জন্য সুসজ্জিত বহু গৃহ নিবেদন করছি। কৃষ্ণ বললেন, আপনাদের আগমনেই আমি সৎকৃত হয়েছি। ভীষ্মাদি চ’লে গেলে বিদুর বিবিধ পবিত্র ও উপাদেয় খাদ্যপানীয় এনে বললেন, গোবিন্দ, এতেই তুষ্ট হও, তোমার যোগ্য সমাদর কে করতে পারে? ব্রাহ্মণগণকে নিবেদনের পর কৃষ্ণ তাঁর অনুচরদের সঙ্গে বিদুরের অন্ন ভোজন করলেন।
রাত্রিকালে বিদুর বললেন, কেশব, এখানে আসা তোমার উচিত হয় নি। দুর্যোধন অধার্মিক ক্রোধী দুর্বিনীত ও মূর্খ। সে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতির ভরসায় এবং বহু সেনা সংগ্রহ করে নিজেকে অজেয় মনে করে। যার হিতাহিত জ্ঞান নেই তাকে কিছু বলা বধিরের নিকট গান গাওয়ার সমান। দুর্যোধন তোমার কথা গ্রাহ্য করবে না। নানা দেশের রাজারা সসৈন্যে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে পূর্বে তোমার শত্রুতা ছিল, যাঁদের ধন তুমি হরণ করেছ, তাঁরা সকলেই এখানে এসেছেন। কৌরবসভায় এইসকল শত্রুদের মধ্যে তুমি কি ক’রে যাবে? মাধব, পাণ্ডবদের উপর আমার যে প্রীতি আছে তারও অধিক প্রীতি তোমার উপর আছে, সেজন্যই এই কথা বলছি।
কৃষ্ণ বললেন, আপনার কথা মহাপ্রাজ্ঞ বিচক্ষণ এবং পিতামাতার ন্যায় হিতৈষী ব্যক্তিরই উপযুক্ত। আমি দুর্যোধনের দুষ্ট স্বভাব এবং তার অনুগত রাজাদের শত্রুতা জেনেও এখানে এসেছি। মৃত্যুপাশ থেকে পৃথিবীকে যে মুক্ত করতে পারে সে মহান ধর্ম লাভ করে। মানুষ যদি ধর্মকার্যে যথাসাধ্য যত্ন করে তবে সম্পন্ন করতে না পারলেও তার পুণ্য হয়। আবার, কেউ যদি মনে মনে পাপচিন্তা করে কিন্তু কার্যত করে না তবে সে পাপের ফল পায় না, ধর্মজ্ঞগণ এইরূপ বলেন। আমি কুরুপাণ্ডবের মধ্যে শান্তিস্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যাতে তাঁরা যুদ্ধে বিনষ্ট না হন। জ্ঞাতিদের মধ্যে ভেদ হ’লে যিনি সর্বপ্রযত্নে মধ্যস্থতা না করেন তাঁকে মিত্র বলা যায় না। আমি শান্তির চেষ্টা করলে কোনও শত্রু বা মূর্খ লোক বলতে পারবে না যে কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ কুরুপাণ্ডবগণকে বারণ করলেন না। দুর্যোধন যদি আমার ধর্ম সম্মত হিতকর কথা না শোনেন তবে তিনি কালের কবলে পড়বেন।
১৩। কৌরবসভায় কৃষ্ণের অভিভাষণ
পরদিন প্রভাতকালে সুকণ্ঠ সূতমাগধগণের বন্দনায় এবং শঙ্খ ও দুন্দুভির রবে কৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গ হ’ল। তাঁর প্রাতঃকৃত্য শেষ হ’লে দুর্যোধন ও শকুনি তাঁর কাছে এসে বললেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্ম প্রভৃতি তোমার প্রতীক্ষা করছেন। কৃষ্ণ অগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং কৌস্তুভ মণি ধারণ ক’রে বিদুরকে নিয়ে রথে উঠলেন। দুর্যোধন শকুনি এবং সাত্যকি প্রভৃতি রথে গজে ও অশ্বে অনুর্গমন করলেন। বহু সহস্র অস্ত্রধারী সৈন্য কৃষ্ণের অগ্রে এবং বহু হস্তী ও রথ তাঁর পশ্চাতে গেল। রাজসভার নিকট এসে কৃষ্ণের অনুচরগণ শঙ্খ ও বেণুর রবে সর্বদিক নিনাদিত করলে। বিদুর ও সাত্যকির হাত ধ’রে কৃষ্ণ সভাদ্বারে রথ থেকে নামলেন। তিনি সভায় প্রবেশ করলে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণাদি এবং সমস্ত রাজারা সসম্মানে গাত্রোত্থান করলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে সর্বতোভদ্র নামে একটি স্বর্ণভূষিত আসন কৃষ্ণের জন্য রাখা ছিল। সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ ক’রে কৃষ্ণ ভীষ্মকে বললেন, নারদাদি ঋষিগণ অন্তরীক্ষে রয়েছেন, তাঁরা এই রাজসভা দেখতে এসেছেন; তাঁদের সংবর্ধনা ক’রে আসন দিন, তাঁরা না বসলে আমরা কেউ বসতে পারি না। ভীষ্মের আদেশে ভৃত্যেরা মণিকাঞ্চনভূষিত বহউ আসন নিয়ে এল, ঋষিরা তাতে ব’সে অর্ঘ্য গ্রহণ করলেন।
অতসীপুষ্পের ন্যায় শ্যামবর্ণ পীতবসনধারী জনার্দন সুবর্ণে গ্রথিত ইন্দ্রনীলমণির ন্যায় শোভমান হলেন। তাঁর আসন স্পর্শ ক’রে বিদুর একটি মৃগচর্মাবৃত মণিময় পীঠে বসলেন। কর্ণ ও দুর্যোধন কৃষ্ণের অদূরে একই আসনে বসলেন। সভা নীরব হল। নিদাঘান্তে মেঘধ্বনির ন্যায় গম্ভীরকণ্ঠে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ভরতনন্দন, যাতে কুরুপাণ্ডবদের শান্তি হয় এবং বীরগণের বিনাশ না হয় তার জন্য আমি প্রার্থনা করতে এসেছি। আপনাদের বংশ সকল রাজবংশের শ্রেষ্ঠ, এই মহাবংশে আপনার নিমিত্ত কোনও অন্যায় কর্ম হওয়া উচিত নয়। দুর্যোধনাদি আপনার পুত্রগণ অশিষ্ট, মর্যাদাজ্ঞানশূন্য ও লোভী, এঁরা ধর্ম ও অর্থ পরিহার ক’রে নিজের শ্রেষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন। কৌরবগণের ঘোর বিপদ উপস্থিত হয়েছে, আপনি যদি উপেক্ষা করেন তবে পৃথিবীর ধ্বংস হবে। আপনি ইচ্ছা করলেই এই বিপদ নিবারিত হ’তে পারে। মহারাজ, যদি পুত্রদের শাসন করেন এবং সন্ধির জন্য যত্নবান হন তবে দুই পক্ষেরই মঙ্গল হবে। পাণ্ডবগণ যদি আপনার রক্ষক হন তবে ইন্দ্রও আপনাকে জয় করতে পারবেন না। যে পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ প্রভৃতি আছেন সেই পক্ষে যদি পঞ্চপাণ্ডব ও সাত্যকি প্রভৃতি যোগ দেন তবে কোন্ দুর্বদ্ধি তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইবে? কৌরব ও পাণ্ডবগণ মিলিত হ’লে আপনি অজেয় ও পৃথিবীর অধিপতি হবেন, প্রবল রাজারাও আপনার সঙ্গে সন্ধি করবেন। পাণ্ডবগণ অথবা আপনার পুত্রগণ যুদ্ধে নিহত হ’লে আপনার কি সুখ হবে বলুন। পৃথিবীর সকল রাজা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে সৈন্য ধ্বংস করবেন। মহারাজ, এই প্রজাবর্গকে আপনি ত্রাণ করুন, আপনি প্রকৃতিস্থ হ’লে এরা জীবিত থাকবে। এরা নিরপরাধ, দাতা, লজ্জাশীল, সজ্জন, সদ্বংশীয়, এবং পরস্পরের সুহৃৎ, আপনি মহাভয় থেকে এদের রক্ষা করুন। এই রাজারা, যাঁরা উত্তম বসন ও মাল্য ধারণ ক’রে এখানে সমবেত হয়েছেন, এঁরা ক্রোধ ও শত্রুতা ত্যাগ ক’রে পানভোজনে তৃপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজ নিজ গৃহে ফিরে যান। পিতৃহীন পাণ্ডবগণ আপনার আশ্রয়েই বর্ধিত হয়েছিলেন, আপনি এখনও তাঁদের পুত্রের ন্যায় পালন করুন। পাণ্ডবগণ আপনাকে এই কথা বলেছেন—আপনার আজ্ঞায় আমরা দ্বাদশ বৎসর বনবাসে এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে বহু দুঃখ ভোগ করেছি, তথাপি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি নি। আপনি আমাদের পিতা, আপনিও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, আমাদের প্রাপ্য রাজ্যের ভাগ দিন। আমরা সকলে বিপথে চলেছি, আপনি পিতা হয়ে আমাদের সৎপথে আনুন, নিজেও সৎপথে থাকুন। পাণ্ডবরা এই সভাসদ্গণকে লক্ষ্য করে বলেছেন, এঁরা ধর্মজ্ঞ, যেন অন্যায় কার্যা না করেন; যে সভায় অধর্ম ধর্মকে এবং অসত্য সত্যকে বিনষ্ট করে সেখানকার সভাসদ্গণও বিনষ্ট হন।
তার পর কৃষ্ণ বললেন, এই সভায় যেসকল মহীপাল আছেন তাঁরা বলুন আমার বাক্য ধর্ম সংগত ও অর্থকর কিনা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনি ক্ষত্রিয়গণকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করুন, ক্রোধের বশীভূত হবেন না। অজাতশত্রু ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আপনার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করেছেন তা আপনি জানেন। জতুগৃহদাহের পর তিনি আপনার আশ্রয়েই ফিরে এসেছিলেন। আপনি তাঁকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সকল রাজাকে বশে এনে আপনারই অধীন করেছিলেন, আপনার মর্যাদা লঙ্ঘন করেন নি। তার পর শকুনি কপট দ্যূতে তাঁর সর্বস্ব হরণ করেছিলেন। সে অবস্থাতেও এবং দ্রৌপদীর নিগ্রহ দেখেও যুধিষ্ঠির ধৈর্যচ্যুত হন নি। মহারাজ, পাণ্ডবগণ আপনার সেবা করতে প্রস্তুত, যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত; আপনি যা হিতকর মনে করেন তাই করুন।
১৪। রাজা দম্ভোদ্ভব — সুমুখ ও গরুড়
সভায় যে রাজারা ছিলেন তাঁরা সকলেই মনে মনে কৃষ্ণবাক্যের প্রশংসা করলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না, নীরবে রোমাঞ্চিত হয়ে রইলেন। তখন জামদগ্ন্য পরশুরাম বললেন, মহারাজ, আমি একটি সত্য দৃষ্টান্ত বলছি শুনুন।—পুরাকালে দম্ভোদ্ভব নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি সর্বদা সকলকে প্রশ্ন করতেন, আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা আমার সমান যোদ্ধা কেউ আছে কিনা। এক তপস্বী ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে বললেন, গন্ধমাদন পর্বতে নর ও নারায়ণ নামে দুই পুরুষশ্রেষ্ঠ তপস্যা করছেন, তুমি কখনও তাঁদের সমান নও, তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। দম্ভোদ্ভব বিশাল সৈন্য নিয়ে গন্ধমাদনে গিয়ে ক্ষুৎপিপাসা ও শীতাতপে শীর্ণ দুই ঋষিকে দেখলেন এবং তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ প্রার্থনা করলেন। নর-নারায়ণ বললেন, এই আশ্রমে ক্রোধ লোভ অস্ত্রশস্ত্র বা কুটিলতা নেই, এখানে যুদ্ধ হ’তে পারে না, তুমি অন্যত্র যাও, পৃথিবীতে বহু ক্ষত্রিয় আছে। দম্ভোেদ্ভব শুনলেন না, বার বার যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন নর ঋষি এক মুষ্টি ঈষীকা (কাশ তৃণ) নিয়ে বললেন, যুদ্ধকামী ক্ষত্রিয়, তোমার অস্ত্র আর সৈন্যদল নিয়ে এস। রাজা শরবর্ষণ করতে লাগলেন, কিন্তু তাঁর আক্রমণ ব্যর্থ হ’ল। নর ঋষি ঈষীকা দিয়ে সৈন্যগণের চক্ষু, কর্ণ নাসিকা বিদ্ধ করতে লাগলেন। ঈষীকায় আচ্ছন্ন হয়ে আকাশ শ্বেতবর্ণ হয়ে গেছে দেখে রাজা নর ঋষির চরণে পড়লেন। নর বললেন, আর এমন ক’রো না, তুমি ব্রাহ্মণের হিতকামী এবং নির্লোভ নিরহংকার জিতেন্দ্রিয় ক্ষমাশীল হয়ে প্রজাপালন কর, বলাবল না জেনে কাকেও আক্রমণ ক’রো না। তখন রাজা দভোদ্ভব প্রণাম ক’রে চ’লে গেলেন।
উপাখ্যান শেষ করে পরশুরাম বললেন, মহারাজ, নারায়ণ ঋষি নর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, নর-নারায়ণই অজুর্ন-কৃষ্ণ হয়ে জন্মেছেন। আপনি সদ্বুদ্ধি অবলম্বন ক’রে পাণ্ডবগণের সঙ্গে সন্ধি করুন, যুদ্ধে মত দেবেন না।
মহর্ষি কণ্ব বললেন; দুর্যোধন, মনে ক’রো না যে তুমিই বলবান, বলবান অপেক্ষাও বলবান দেখা যায়। একটি পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।—ইন্দ্রসারথি মাতলির একটি অনুপমরূপবতী কন্যা ছিল, তার নাম গুণকেশী। মাতলি তাঁর কন্যার যোগ্য বর কোথাও না পেয়ে পাতালে গেলেন। সেই সময়ে নারদও বরুণের কাছে যাচ্ছিলেন; তিনি বললেন, আমরা তোমার কন্যার জন্য বর নির্বাচন করে দেব। নারদ মাতলিকে নাগলোকে নিয়ে গিয়ে বিবিধ আশ্চর্য বস্তু দেখালেন। মাতলি বললেন, এখানে আমার কন্যার যোগ্য বর কেউ নেই, অন্যত্র চলুন। নারদ মাতলিকে দৈত্যদানবদের নিবাস হিরণ্যপুরে নিয়ে গিয়ে বললেন, এখানকার কোনও পুরুষকে নির্বাচন করতে পার। মাতলি বললেন, দানবদের সঙ্গে আমি সম্বন্ধ করতে পারি না, তারা দেবগণের বিপক্ষ। অন্যত্র চলন, আমি জানি আপনি কেবল বিরোধ ঘটাতে চান! তার পর নারদ গরুড়বংশীয় পক্ষীদের লোকে এসে বললেন, এরা নির্দয় সপভোজী, কিন্তু কার্যত ক্ষত্রিয় এবং বিষ্ণুর উপাসক। মাতলি সেখানেও বর নির্বাচন করলেন না। নারদ তাঁকে রসাতল নামক সপ্তম পৃথিবীতলে নিয়ে গেলেন, যেখানে গোমাতা সুরভি বাস করেন, যাঁর ক্ষীরধারা থেকে ক্ষীরোদ সাগরের উৎপত্তি।
তার পর তাঁরা অনন্ত নাগ বাসুকির পুরীতে গেলেন। একটি নাগকে বহুক্ষণ দেখে মাতলি প্রশ্ন করলেন, এই সুদর্শন নাগ কার বংশধর? একে গুণকেশীর যোগ্য মনে করি। নারদ বললেন, ইনি ঐরাবত বংশজাত আর্যকের পৌত্র, এঁর নাম সুমুখ। কিছুকাল পূর্বে এঁর পিতা চিকুর গরুড় কর্তৃক নিহত হয়েছেন। মাতলি প্রীত হয়ে বললেন, এই সমুখই আমার জামাতা হবেন। সুমুখের পিতামহ আর্যকের কাছে গিয়ে নারদ মাতলির ইচ্ছা জানালেন। আর্যক বললেন, দেবর্ষি, ইন্দ্রের সখা মাতলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ কে না চায়? কিন্তু গরুড় আমার পুত্র চিকুরকে ভক্ষণ করেছে এবং বলেছে এক মাস পরে সুমুখকেও খাবে; এই কারণে আমার মনে সুখ নেই। মাতলি বললেন, সুমুখ আমার সঙ্গে ইন্দ্রের কাছে চলুন, ইন্দ্র গরুড়কে নিবৃত্ত করবেন।
নারদ ও মাতলি সুমুখকে নিয়ে দেবরাজের কাছে গেলেন, সেখানে ভগবান বিষ্ণুও ছিলেন। নারদের মুখে সকল বৃত্তান্ত শুনে বিষ্ণু বললেন, বাসব, সুমুখকে অমৃত পান করিয়ে অমর কর। ইন্দ্র সুমুখকে দীর্ঘায়ু দিলেন, কিন্তু অমৃত পান করালেন না। তার পর সুমুখ ও মাতলিকন্যা গুণকেশীর বিবাহ হ’ল।
সুমুখ দীর্ঘায়ু পেরেছেন জেনে গরুড় ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে বললেন, তুমি আমাকে নাগভোজনের বর দিয়েছিলে, এখন বাধা দিলে কেন? ইন্দ্র বললেন, আমি বাধা দিই নি, বিষ্ণুই সুমুখকে অভয় দিয়েছেন। গরুড় বললেন, দেবরাজ, আমি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হবার যোগ্য, তথাপি পরের ভৃত্য হয়েছি। তুমি থাকতে বিষ্ণু আমার জীবিকায় বাধা দিতে পারেন না, তুমি আর বিষ্ণুই আমার গৌরব নষ্ট করেছ। তার পর গরুড় বিষ্ণুকে বললেন, আমার পক্ষের এক অংশ দিয়েই তোমাকে আমি অক্লেশে বইতে পারি, ভেবে দেখ কে অধিক বলবান। বিষ্ণু বললেন, তুমি অতি দুর্বল হয়েও নিজেকে বলবান মনে করছ; অণ্ডজ, আমার কাছে আত্মশ্লাঘা ক’রো না। আমি নিজেই নিজেকে বহন করি, তোমাকেও ধারণ করি। তুমি যদি আমার বাম বাহুর ভার সইতে পার তবেই তোমার গর্ব সার্থক হবে। এই ব’লে বিষ্ণু তাঁর বাম বাহু গরুড়ের স্কন্ধে রাখলেন, হতচেতন হয়ে গরুড় প’ড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে গরুড় প্রণাম ক’রে বললেন, প্রভু, আমি তোমার ধ্বজবাসী পক্ষী মাত্র, আমাকে ক্ষমা কর। তোমার বল জানতাম না তাই মনে করতাম আমার বলের তুলনা নেই। তখন বিষ্ণু তাঁর পদাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে সুমুখকে গরুড়ের বক্ষে নিক্ষেপ করলেন। সেই অবধি সুমুখের সঙ্গে গরুড় অবিরোধে বাস করেন।
উপাখ্যান শেষ ক’রে কণ্ব বললেন, গরুড়ের গর্ব এইরূপে নষ্ট হয়েছিল। বৎস দুর্যোধন, যে পর্যন্ত তুমি যুদ্ধে পাণ্ডবদের সম্মুখীন না হচ্ছ সেই পর্যন্তই তুমি জীবিত আছ। তুমি বিরোধ ত্যাগ কর, বাসুদেবকে আশ্রয় করে নিজের কুল রক্ষা কর। সর্বদর্শী নারদ জানেন, এই কৃষ্ণই চক্রগদাধর বিষ্ণু।
দুর্যোধন কণ্বের দিকে চেয়ে উচ্চহাস্য করলেন এবং গজশুণ্ডতুল্য নিজের ঊরুতে চপেটাঘাত ক’রে বললেন, মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভাবেই চলছি, কেন প্রলাপ বকছেন?
১৫। বিশ্বামিত্র, গালব, যযাতি ও মাধবী
নারদ বললেন, দুর্যোধন, সুহৃদগণের কথা তোমার শোনা উচিত, কোনও বিষয়ে নির্বন্ধ (জিদ) ভাল নয়, তার ফল ভয়ংকর হয়। একটি প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।—পুরাকালে বিশ্বামিত্র যখন তপস্যা করছিলেন, তখন তাঁর কাছে বশিষ্ঠের রূপ ধরে স্বয়ং ধর্মদেব উপস্থিত হলেন। ক্ষুধার্ত অতিথিকে দেখে বিশ্বামিত্র ব্যস্ত হয়ে পরমান্নের চরু পাক করতে লাগলেন। ধর্ম অপেক্ষা করলেন না, অন্য তপস্বীদের অন্ন ভোজন করলেন। তার পর বিশ্বামিত্র অভুক্ত অন্ন নিয়ে এলে ধর্ম বললেন, আমি ভোজন করেছি, যে পর্যন্ত ফিরে না আসি তত কাল তুমি অপেক্ষা কর। বিশ্বামিত্র দুই হাতে মাথার উপর অন্নপাত্র ধ’রে বায়ুভোজী ও নিশ্চেষ্ট হয়ে রইলেন। এই সময়ে শিষ্য গালব তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে বশিষ্ঠরূপী ধর্ম ফিরে এসে বললেন, বিপ্রর্ষি, আমি তুষ্ট হয়েছি। এই ব’লে তিনি অন্ন ভোজন ক’রে চ’লে গেলেন।
বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়ত্ব ত্যাগ করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করলেন এবং প্রীত হয়ে গালবকে বললেন, বৎস, এখন যেখানে ইচ্ছা হয় যেতে পার। গালব বললেন, আপনাকে গুরুদক্ষিণা কি দেব? তিনি বার বার এই প্রশ্ন করায় বিশ্বামিত্র কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমাকে আট শত এমন অশ্ব দাও যাদের কান্তি চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র এবং একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ।
গালব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিষ্ণুকে স্মরণ করতে লাগলেন। তখন তাঁর সখা গরুড় এসে বললেন, গালব, আমার সঙ্গে এস, তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। গরুড় গালবকে নিয়ে নানা দিকে নানা লোকে ভ্রমণ করলেন এবং পরিশেষে রাজা যযাতির কাছে এসে গালবের গুরুদক্ষিণার জন্য অশ্ব প্রার্থনা করলেন। যযাতি বললেন, সখা, আমি পূর্বের ন্যায় ধনবান নই, কিন্তু এই ব্রহ্মর্ষিকে নিরাশ করতেও পারি না। গালব, আপনি আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যান, রাজারা এই কন্যার শুল্কস্বরূপ নিশ্চয় আপনার অভীষ্ট আট শত অশ্ব দেবেন, আমিও দৌহিক লাভ করব।
যযাতির কন্যা মাধবীকে নিয়ে গালব অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে গেলেন। তাঁর প্রার্থনা শুনে হর্যশ্ব বললেন, এই কন্যা অতি শুভলক্ষণা, ইনি রাজচক্রবর্তী পুত্রের জন্ম দিতে পারবেন। কিন্তু আপনি শুল্কস্বরূপ যা চান তেমন অশ্ব দুই শত মাত্র আমার আছে। আমি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করব, আপনি আমার অভীষ্ট পূর্ণ করুন। মাধবী গালবকে বললেন, এক ব্রহ্মবাদী মুনি আমাকে বর দিয়েছেন—তুমি প্রত্যেক বার প্রসবের পর আবার কুমারী হবে। অতএব আপনি দুই শত অশ্ব নিয়ে আমাকে দান করুন; এর পরে আরও তিন রাজার কাছে আমাকে নিয়ে যাবেন, তাতে আপনার আট শত অশ্ব পূর্ণ হবে, আমারও চার পুত্র লাভ হবে। গালব হর্যশ্বকে বললেন, মহারাজ, আমার শুল্কের চতুর্থাংশ নিয়ে আপনি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করুন।
যথাকালে হর্যশ্ব বসুমনা নামে একটি পুত্র লাভ করলেন। তখন গালব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনি অভীষ্ট পুত্র পেয়েছেন, এখন অবশিষ্ট শুল্কের জন্য আমাকে অন্য রাজার কাছে যেতে হবে। সত্যবাদী হর্যশ্ব তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে মাধবীকে প্রত্যর্পণ করলেন, মাধবীও পুনর্বার কুমারী হয়ে গালবের সঙ্গে চললেন। তার পর গালব একে একে কাশীরাজ দিবোদাস এবং ভোজরাজ উশীনরের কাছে গেলেন। তাঁরাও প্রত্যেকে দুই শত অশ্ব দিয়ে মাধবীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলেন। তাঁদের পুত্রের নাম যথাক্রমে প্রতর্দন ও শিবি।
গরুড় গালবকে বললেন, পূর্বে মহর্ষি ঋচীক কান্যকুব্জরাজ গাধিকে এইরূপ সহস্র অশ্ব শুল্ক দিয়ে তাঁর কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেছিলেন। এই সকল অশ্ব ঋচিক বরুণালয়ে পেয়েছিলেন। মহারাজ গাধি ব্রাহ্মণগণকে সমস্ত অশ্ব দান করেন, তাঁদের কাছ থেকে হর্যশ্ব দিবোদাস ও উশীনর প্রত্যেকে দুই শত অশ্ব ক্রয় করেন, অবশিষ্ট চার শত পথে অপহৃত হয়। এই কারণে আর এরূপ অশ্ব পাওয়া যাবে না, তুমি এই ছয় শতই বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দাও।
বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে গালব বললেন, আপনি গুরুদক্ষিণা স্বরূপ এই ছয় শত অশ্ব নিন এবং অবশিষ্ট দুই শতের পরিবর্তে এই কন্যাকে নিন। তিন জন রাজর্ষি এঁর গর্ভে তিনটি ধার্মিক পুত্র উৎপাদন করেছেন, আপনি চতুর্থ পুত্র উৎপাদন করুন। বিশ্বামিত্র বললেন, গালব, তুমি প্রথমেই এই কন্যা আমাকে দাও নি কেন, তা হ’লে আমার চারটি বংশধর পুত্র হত। বিশ্বামিত্রমাধবীকে নিলেন, অশ্বগুলি তাঁর আশ্রমে বিচরণ করতে লাগল। যথাকালে অষ্টক নামে মাধবীর একটি পুত্র হল। বিশ্বামিত্র এই পুত্রকে ধর্ম অর্থ ও অশ্বগুলি-দান করলেন এবং মাধবীকে শিষ্য গালবের হাতে দিয়ে বনে চ’লে গেলেন।
গালব মাধবীকে বললেন, তোমার প্রথম পুত্র বসুমনা দাতা, দ্বিতীয় প্রতর্দন বীর, তৃতীয় শিবি সত্যধর্মরত এবং চতুর্থ অষ্টক যজ্ঞকারী। তুমি এই চার পুত্র প্রসব ক’রে আমাকে, চার জন রাজাকে এবং তোমার পিতাকে উদ্ধার করেছ। তার পর গরুড়ের সম্মতি নিয়ে গালব মাধবীকে যযাতির হস্তে প্রত্যর্পণ ক’রে বনে তপস্যা করতে গেলেন।
যযাতি তাঁর কন্যার স্বয়ংবর করাবার ইচ্ছা করলেন। যযাতিপুত্র যদু ও পুরু ভগিনীকে রথে নিয়ে গঙ্গাযমুনাসংগমস্থ আশ্রমে গেলেন। বহু রাজা এবং নাগ যক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি স্বয়ংবরে উপস্থিত হলেন, কিন্তু মাধবী সকলকে প্রত্যাখ্যান ক’রে তপোবনকেই বরণ করলেন। তিনি মৃগীর ন্যায় বনচারিণী হয়ে বিবিধ ব্রতনিয়ম ও ব্রহ্মচর্য পালন ক’রে ধর্ম সঞ্চয় করতে লাগলেন।
দীর্ঘ আয়ু ভোগ ক’রে যযাতি স্বর্গে গেলেন। বহু বর্ষ স্বর্গবাসের পর তিনি মোহবশে দেবতা ঋষি ও মনুষ্যকে অবজ্ঞা করতে লাগলেন। স্বর্গবাসী রাজর্ষিগণ তাঁকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, এ কেন স্বর্গে এল? কে একে চেনে? সকলেই বললেন, আমরা একে চিনি না। তখন যযাতির তেজ নষ্ট হ’ল, তিনি তাঁর আসন থেকে চ্যুত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পড়তে লাগলেন। দেবরাজের এক দূত এসে তাঁকে বললেন, রাজা, তুমি অত্যন্ত মদগর্বিত, সকলকেই অপমান কর, তুমি স্বর্গবাসের যোগ্য নও, গর্বের জন্যই তোমার পতন হ’ল। যযাতি স্থির করলেন, আমি সাধুজনের মধ্যেই পতিত হব। সেই সময়ে প্রতর্দন বসুমনা শিবি ও অষ্টক নৈমিষারণ্যে বাজপেয় যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞের ধূম অবলম্বন ক’রে যযাতি সেই চার রাজার মধ্যে অবতরণ করলেন। তখন মাধবীও বিচরণ করতে করতে সেখানে এলেন এবং পিতা যযাতিকে প্রণাম ক’রে বললেন, এই চার জন আমার পুত্র, আপনার দৌহিত্র। আমি যে ধর্ম সঞ্চয় করেছি তার অর্ধ আপনি নিন। প্রতর্দন প্রভৃতি রাজারা তাঁদের জননী ও মাতামহকে প্রণাম করলেন। গালবও অকস্মাৎ সেখানে এসে বললেন, রাজা, আমার তপস্যার অষ্টম ভাগ নিয়ে আপনি স্বর্গারোহণ করুন।
সাধুজন যেমন তাঁকে চিনতে পারলেন তৎক্ষণাৎ যযাতির পতন নিবারিত হ’ল। প্রতর্দন প্রভৃতি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমরা সৎকর্মের ফলে যে পুণ্য লাভ করেছি তা আপনাকে দিলাম, তার প্রভাবে আপনি স্বর্গারোহণ করুন। যযাতি ভূমি স্পর্শ করলেন না, দৌহিত্রগণের উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গে উঠতে লাগলেন। দেবতারা তাঁকে সাদরে অভিনন্দন করলেন। ব্রহ্মা বললেন, মহারাজ, তুমি বহু যজ্ঞ দান ও প্রজাপালন ক’রে যে পুণ্য অর্জন করেছিলে তা তোমার অভিমানের ফলে নষ্ট হয়েছিল, তাই তুমি স্বর্গবাসীদের ধিক্কার পেয়ে পতিত হয়েছিলে। অভিমান বলগর্ব হিংসা কপটতা বা শঠতা থাকলে স্বর্গভোগ চিরস্থায়ী হয় না। উত্তম মধ্যম বা অধম কাকেও তুমি অপমান ক’রো না, গর্বিত লোকে শান্তি পায় না।
উপাখ্যান শেষ ক’রে নারদ বললেন, অভিমানের ফলে যযাতি স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন, অতিশয় নির্বন্ধের জন্য গালবও দুঃখভোগ করেছিলেন। দুর্যোধন, তুমি অভিমান ক্রোধ ও যুদ্ধের অভিপ্রায় ত্যাগ কর, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর।
১৬। দুর্যোধনের দুরাগ্রহ
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভগবান নারদের কথা সত্য, আমিও সেরূপ ইচ্ছা করি, কিন্তু আমার শক্তি নেই। কৃষ্ণ, তুমি যা বলেছ তা ধর্মসংগত ও ন্যায্য, কিন্তু বৎস, আমি স্বাধীন নই, দুরাত্মা পুত্রেরা আমার আদেশ মানবে না, গান্ধারী বিদুর ভীষ্ম প্রভৃতির কথাও দুর্যোধন শোনে না। তুমিই ওই দুর্বুদ্ধিকে বোঁঝাবার চেষ্টা কর।
কৃষ্ণ মিষ্ট বাক্যে দুর্যোধনকে বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, মহাপ্রাজ্ঞ বংশে তোমার জন্ম, তুমি শাস্ত্রজ্ঞ ও সর্বগুণান্বিত, যা ন্যায়সম্মত তাই কর। সজ্জনের প্রবৃত্তি ধর্মার্থযুক্ত দেখা যায়, কিন্তু তোমাতে তার বিপরীতই দেখছি। ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সোমদত্ত, বাহ্নীকরাজ, বিকর্ণ[৩], বিবিংশতি[৪], সঞ্জয় এবং তোমার জ্ঞাতি ও মিত্রগণ সকলেই সন্ধি চান। তুমি পিতামাতার বশবর্তী হও। যে লোক শ্রেষ্ঠ সুহৃদ্গণের উপদেশ অগ্রাহ্য ক’রে হীন মন্ত্রণাদাতাদের মতে চলে সে ঘোর বিপদে পড়ে। তুমি আজন্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছ কিন্তু তাঁরা তা সয়েছেন। পাণ্ডবরা যে রাজ্য জয় করেছিলেন তা এখন তুমি ভোগ করছ, কর্ণ দুঃশাসন শকুনি প্রভৃতির সহায়তায় তুমি ঐশ্বর্যলাভ করতে চাচ্ছ। তোমার সমস্ত সৈন্য এবং ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি সকলে মিলেও ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না। খাণ্ডবপ্রস্থে যিনি দেবতা গন্ধর্ব যক্ষ প্রভৃতিকে জয় করেছিলেন, কোন্ মানুষ তাঁর সমকক্ষ? শুনেছি বিরাটনগরে বহুজনের সঙ্গে একজনের আশ্চর্য যুদ্ধে হয়েছিল, সেই যুদ্ধই আমার উক্তির যথেষ্ট প্রমাণ। যিনি সাক্ষাৎ মহাদেবকে যুদ্ধে সন্তুষ্ট করেছিলেন, আমি যাঁর সঙ্গে থাকব, সেই অর্জুনকে তুমি জয় করবার আশা কর! রাজা দুর্যোধন, কৌরবকুল যেন বিনষ্ট না হয়, লোকে যেন তোমাকে নষ্টকীর্তি কুলঘ্ন না বলে। পাণ্ডবগণ তোমাকে যুবরাজের পদে এবং ধৃতরাষ্ট্রকে মহারাজের পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তুমি তাঁদের অর্ধ রাজ্য দিয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ কর।
ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, তুমি কৃষ্ণের কথা শোন, কুলঘ্ন কুপুরুষ হয়ো না, হিতৈষীদের বাক্য লঙ্ঘন ক’রে, কুপথে যেয়ো না, পিতামাতাকে লোকসাগরে মগ্ন করো না। দ্রোণ বললেন, বৎস, কেশব ও ভীষ্ম তোমাকে ধর্মসংগত হিতবাক্যই বলেছেন, তুমি এঁদের কথা রাখ, কৃষ্ণের অপমান ক’রো না। আত্মীয়বর্গ ও সমস্ত প্রজার মৃত্যুর কারণ হয়ো না, কৃষ্ণার্জুন যে পক্ষে আছেন সে পক্ষকে তুমি অজেয় জেনো। বিদর বললেন, দুর্যোধন, তোমার জন্য শোক করি না, তোমার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্যই করি। তোমার কর্মের ফলে এঁরা অনাথ ও মিত্রহীন হয়ে ছিন্নপক্ষ পক্ষীর ন্যায় বিচরণ করবেন, কুলনাশক কুপুত্রকে জন্ম দেবার ফলে ভিক্ষুক হবেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন, মহাত্মা কৃষ্ণের কথা অতিশয় মঙ্গলজনক, তাতে অলব্ধ বিষয়ের লাভ হবে, লব্ধ বিষয়ের রক্ষা হবে। তুমি যদি এঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান কর তবে নিশ্চয় পরাভূত হবে। ভীষ্ম ও দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, যুদ্ধারম্ভের পূর্বেই শত্রুতার অবসান হ’ক। তুমি নতমস্তকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম কর, তিনি তাঁর সুলক্ষণ দক্ষিণ বাহু তোমার স্কন্ধে রাখুন, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিন; ভীমসেন তোমাকে আলিঙ্গন করুন, পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমাকে মিলিত দেখে এই রাজারা সকলে আনন্দাশ্রু মোচন করুন।
দুর্যোধন কৃষ্ণকে বললেন, তুমি বিবেচনা না করে কেবল পাণ্ডবদের প্রতি প্রীতির বশে আমাকে নিন্দা করছ। তুমি বিদুর পিতা পিতামহ ও আচার্য দ্রোণ—তোমরা কেবল আমাকেই দোষ দাও, পাণ্ডবদের দোষ দেখ না। বিশেষ চিন্তা ক’রেও আমি নিজের বৃহৎ বা ক্ষুদ্র কোনও অপরাধই দেখতে পাই না। পাণ্ডবগণ দ্যূতক্রীড়া ভালবাসেন সেজন্যই আমাদের সভায় এসেছিলেন। সেখানে শকুনি তাঁদের রাজ্য জয় করেছিলেন তাতে আমার কি দোষ? বিজিত ধন পিতার আজ্ঞায় তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পর তাঁরা আবার পরাজিত হয়ে বনে গিয়েছিলেন, তাতেও আমাদের অপরাধ হয় নি। তবে কি জন্য তাঁরা কৌরবদের শত্রুগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বিনষ্ট করতে চান? উগ্র কর্মে বা কঠোর বাক্যে ভয় পেয়ে আমরা ইন্দ্রের কাছেও নত হবে না। পাণ্ডবদের কথা দূরে থাক, দেবতারাও ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণকে পরাস্ত করতে পারেন না। আমরা শত্রুর নিকট নত না হয়ে যদি যুদ্ধে বীরশয্যা লাভ করি তবে বন্ধুগণ আমাদের জন্য শোক করবেন না। কেশব, পূর্বে আমার পিতা পাণ্ডবগণকে যে রাজ্যাংশ দেবার আদেশ দিয়েছিলেন, আমি জীবিত থাকতে পাণ্ডবরা তা পাবেন না। যখন আমি অল্পবয়স্ক ও পরাধীন ছিলাম, তখন অজ্ঞতা বা ভয়ের বশে পিতা বা দিতে চেয়েছিলেন এখন তা আমি দেব না। তীক্ষ্ণ সূচীর অগ্রভাগে যে পরিমাণ ভূমি বিদ্ধ হয়, তাও আমি ছাড়ব না।
ক্রোধচঞ্চলনয়নে হাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, তুমি আর তোমার মন্ত্রীরা যুদ্ধে বীরশয্যাই লাভ করবে। পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি শকুনির সঙ্গে দ্যূতসভার আয়োজন করেছিলে। তুমি ভিন্ন আর কে ভ্রাতৃজায়াকে সভায় আনিয়ে নির্যাতন করতে পারে? তুমি কর্ণ আর দুঃশাসন অনার্যের ন্যায় বহু নিষ্ঠুর কথা বলেছিলে। বারণাবতে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে তুমি দগ্ধ করবার চেষ্টা করেছিলে। সর্বদাই তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে এইরূপে ব্যবহার করে আসছ, তবে তুমি অপরাধী নও কেন? তাঁরা তাঁদের পৈতৃক অংশই চাচ্ছেন, তাতেও তুমি সম্মত নও। পাপাত্মা, ঐশ্বর্যভ্রষ্ট ও নিপাতিত হয়ে তোমাকে অবশেষে সবই দান করতে হবে।
দুঃশাসন দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, আপনি যদি সন্ধি না করেন, তবে ভীষ্ম দ্রোণ ও পিতা আপনাকে আমাকে ও কর্ণকে বন্ধন ক’রে পাণ্ডবদের হাতে দেবেন। এই কথা শুনে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে মহানাগের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সভা থেকে উঠে চ’লে গেলেন; তাঁর ভ্রাতারা মন্ত্রীরা এবং অনুগত রাজারাও তাঁর অনুসরণ করলেন।
ভীষ্ম বললেন, ধর্ম ও অর্থ বিসর্জন দিয়ে যে লোক ক্রোধের বশবর্তী হয়, শীঘ্রই সে বিপদে পড়ে এবং তার শত্রুরা হাসে। কৃষ্ণ বললেন, কুরুবংশের বৃদ্ধগণ মহা অন্যায় করেছেন, একটা মূর্খকে রাজার ক্ষমতা দিয়েছেন অথচ তাকে নিয়ন্ত্রিত করেন নি। ভরতবংশীয়গণ, আপনাদের হিতার্থে আমি যা বলছি আশা করি তা আপনাদের অনুমোদিত হবে।—দুরাত্মা কংস তার পিতা ভোজরাজ উগ্রসেন জীবিত থাকতেই তাঁর রাজত্ব হরণ করেছিল। আমি তাকে বধ ক’রে পুনর্বার উগ্রসেনকে রাজপদে বসিয়েছি। কুলরক্ষার জন্য যাদব বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ কংসকে ত্যাগ ক’রে স্বস্তিলাভ করেছেন। দেবাসুরের যুদ্ধকালে যখন সমস্ত লোক দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে ধ্বংসের মুখে যাচ্ছিল তখন ব্রহ্মার আদেশে ধর্মদেব দৈত্যদানবগণকে বন্ধন ক’রে বরুণের নিকট সমর্পণ করেছিলেন। আপনারাও দুর্যোধন কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসনকে বন্ধন ক’রে পাণ্ডবদের হাতে দিন। অথবা কেবল দর্যোধনকেই সমর্পণ ক’রে সন্ধি স্থাপন করুন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনার দুর্বলতার জন্য যেন ক্ষত্রিয়গণ বিনষ্ট না হন।
ত্যজেৎ কুলার্থে পুরুষং গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।
গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ॥
—কুলরক্ষার প্রয়োজনে একজনকে ত্যাগ করবে, গ্রামরক্ষার জন্য কুলত্যাগ, দেশরক্ষার জন্য গ্রামত্যাগ এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করবে।
১৭। গান্ধারীর উপদেশ—কৃষ্ণের সভাত্যাগ
কৃষ্ণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে বিদুরকে বললেন, দূরদর্শিনী গান্ধারীকে এখানে ডেকে আন, আমি তাঁর সঙ্গে দুর্যোধনকে অনুনয় করব। গান্ধারী এলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তোমার দুরাত্মা অবাধ্য পুত্র প্রভুত্বের লোভে রাজ্য ও প্রাণ দুই হারাচ্ছে, সুহৃদ্গণের উপদেশ না শুনে সে অশিষ্টের ন্যায় সভা থেকে চ’লে গেছে।
গান্ধারী বললেন, অশিষ্ট অবিনীত ধর্মনাশক লোকের রাজ্য পাওয়া উচিত নয় তথাপি সে পেয়েছে। মহারাজ, তুমিই দোষী, পুত্রের দুষ্ট প্রবৃত্তি জেনেও স্নেহবশে তার মতে চলেছ, মূঢ় দুরাত্মা লোভী কুসঙ্গী পুত্রকে রাজ্য দিয়ে এখন তার ফল ভোগ করছ।
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর দুর্যোধনকে আবার সভায় নিয়ে এলেন। গান্ধারী বললেন, পুত্র, তোমার পিতা ও ভীষ্মদ্রোণাদি সুহৃদ্বর্গের কথা রাখ। রাজত্বের অর্থ মহৎ প্রভুত্ব, দুরাত্মারা এই পদ কামনা করে কিন্তু রাখতে পারে না। যে লোক কামনা বা ক্রোধের বশে আত্মীয় বা অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করে, কেউ তার সহায় হয় না। পাণ্ডবগণ ঐক্যবদ্ধ মহাপ্রাজ্ঞ বীর, তাঁদের সঙ্গে মিলিত হ’লে তুমি সুখে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। বৎস, ভীষ্ম-দ্রোণ যা বলেছেন তা সত্য, কৃষ্ণার্জুন অজেয়। তুমি কেশবের শরণাপন্ন হও, তা হ’লে তিনি উভয় পক্ষের মঙ্গল করবেন। যুদ্ধে কল্যাণ নেই, ধর্ম বা অর্থ নেই, সুখ নেই, সর্বদা জয়ও হয় না। তুমি তের বৎসর পাণ্ডবদের প্রচুর অপকার করেছ, তোমার কামনা আর ক্রোধের জন্য তা বর্ধিত হয়েছে, এখন তার উপশম কর। মূঢ় তুমি মনে কর ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি তোমার জন্য যুদ্ধে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করবেন, কিন্তু তা হবে না। কারণ, এই রাজ্যে তোমাদের আর পাণ্ডবদের সমান অধিকার, দুই পক্ষের সঙ্গেই এঁদের সমান স্নেহসম্বন্ধ, কিন্তু পাণ্ডবরা অধিকতর ধর্মশীল। ভীষ্মাদি তোমার অন্নে পালিত সেজন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে শত্রুরূপে দেখতে পারবেন না। বৎস, কেবল লোভ করলে সম্পত্তিলাভ হয় না, লোভ ত্যাগ কর, শান্ত হও।
মাতার কথায় অনাদর দেখিয়ে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে শকুনি কর্ণ ও দুঃশাসনের কাছে গেলেন। তাঁরা মন্ত্রণা করে স্থির করলেন, কৃষ্ণ ক্ষিপ্রকারী, তিনি ধৃতরাষ্ট্র আর ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বন্ধন করতে চান; অতএব আমরাই আগে তাঁকে সবলে নিগৃহীত করব, তাতে পাণ্ডবরা বিমূঢ় ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়বে। ধৃতরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হয়ে বারণ করলেও আমরা কৃষ্ণকে বন্ধন ক’রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।
দুর্যোধনাদির এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সাত্যকি সভা থেকে বেরিয়ে কৃতবর্মাকে বললেন, শীঘ্র আমাদের সৈন্য ব্যূহবন্ধ কর এবং বর্ম ধারণ ক’রে তুমি এই সভার দ্বারদেশে থাক। তার পর সাত্যকি সভায় গিয়ে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে দুর্যোধনাদির অভিসন্ধি জানিয়ে বললেন, বালক ও জড়বুদ্ধি যেমন বস্ত্রদ্বারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নি আবরণ করতে চায়, এই মূর্খগণ সেইরূপে কৃষ্ণকে বন্ধন করতে চাচ্ছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কালের কবলে পড়েছে, তারা বিগর্হিত অসাধ্য কর্ম করতে যাচ্ছে।
কৃষ্ণ বললেন, রাজা, এরা যদি আমাকে সবলে বন্দী করতে চায় তবে আপনি অনুমতি দিন, এরা আমাকে বাঁধুক কিংবা আমিই এদের বাঁধি। আমি এদের সকলকে নিগৃহীত করে পাণ্ডবদের হাতে দিতে পারি, তাতে অনায়াসে তাঁদের কার্যসিদ্ধি হবে। কিন্তু আপনার সমক্ষে আমি এই নিন্দিত কর্ম করব না। আমি অনুমতি দিচ্ছি, দুর্যোধন যা ইচ্ছা হয় করুক।
দুর্যোধনকে আবার ডেকে আনিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, নৃশংস পাপিষ্ঠ, তুমি ক্ষুদ্রবুদ্ধি পাপাত্মাদের সাহায্যে পাপকর্ম করতে চাচ্ছ! হস্ত দ্বারা বায়ুকে ধরা যায় না, চন্দ্রকেও স্পর্শ করা যায় না, মস্তকদ্বারা পৃথিবী ধারণ করা যায় না; সেইরূপ কৃষ্ণকেও সবলে গ্রহণ করা যায় না।
কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন, তুমি মোহবশে মনে করছ আমি একাকী, তাই আমাকে সবলে বন্দী করতে চাচ্ছ। এই দেখ—পাণ্ডবগণ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ, আদিত্য রূদ্র ও বসুগণ, মহর্ষিগণ, সকলেই এখানে আছেন। এই ব’লে কৃষ্ণ উচ্চহাসা করলেন। তখন সহসা তাঁর ললাটে ব্রহ্মা, বক্ষে রুদ্র, মুখ থেকে অগ্নি, এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে ইন্দ্রাদি দেবতা যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি, হলধর বলরাম ও পঞ্চ পাণ্ডব আবির্ভূত হলেন। আয়ুধ উদ্যত ক’রে অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ তাঁর সম্মুখে এলেন এবং শঙ্খ চক্র গদা শক্তি শার্ঙ্গধনু সর্বপ্রকার প্রহরণও উপস্থিত হ’ল। সহস্রচরণ সহস্রবাহু সহস্রনয়ন কৃষ্ণের ঘোর মূর্তি দেখে সভাস্থ সকলে ভয়ে চোখ বুজলেন, কেবল ভীষ্ম দ্রোণ সঞ্জয় ও ঋষিরা চেয়ে রইলেন, কারণ ভগবান জনার্দন তাঁদের দিব্যচক্ষু দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রও দিব্যদৃষ্টি পেয়ে কৃষ্ণের পরম রূপ দেখলেন। দেবতা গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, প্রভু, প্রসন্ন হও, তোমার রূপ সংবরণ কর, নতুবা জগৎ বিনষ্ট হবে। তখন কৃষ্ণ পূর্ব রূপ গ্রহণ করলেন এবং ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সাত্যকি আর বিদুরের হাত ধ’রে সভা থেকে বেরিয়ে এলেন। নারদাদি মহর্ষিগণও অন্তর্হিত হলেন।
দারুকের আনীত রথে উঠে কৃষ্ণ যখন প্রস্থানের উপক্রম করছিলেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁর কাছে এসে বললেন, জনার্দন, পুত্রদের উপর আমার কতটুকু প্রভাব তা তুমি দেখলে। আমার দুরভিসন্ধি নেই, দুর্যোধনকে যা বলেছি তা তুমি শুনেছ। সকলেই জানে যে আমি সর্বপ্রযত্নে শান্তির চেষ্টা করেছি।
ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মদ্রোণাদিকে কৃষ্ণ বললেন, কৌরবসভায় যা হ’ল তা আপনারা দেখলেন, দুর্যোধন আমাকে বন্দী করবার চেষ্টা করেছে তাও জানেন। ধৃতরাষ্ট্রও বলছেন তাঁর কোনও প্রভুত্ব নেই। এখন আপনারা আজ্ঞা দিন আমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যাব। এই ব’লে কৃষ্ণ রথারোহণে কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
১৮। কৃষ্ণ ও কুন্তী—বিদুলার উপাখ্যান
কুন্তীকে প্রণাম ক’রে কৃষ্ণ তাঁকে কৌরবসভার সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। কুন্তী বললেন, কেশব, তুমি যুধিষ্ঠিরকে আমার এই কথা ব’লো।—পত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা ক’রে তোমার বদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করছ। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা নির্দিষ্ট করেছেন তুমি তার দিকে মন দাও। তিনি তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয় সৃষ্টি করেছেন সেজন্য বাহুবলই ক্ষত্রিয়গণের উপজীব্য, সর্বদা নির্দয় কর্মে নিযুক্ত থেকে তাঁদের প্রজাপালন করতে হয়। রাজা যদি উপযুক্ত রূপে দণ্ডনীতি প্রয়োগ করেন তবেই চার বর্ণের লোক স্বধর্ম পালন করেন। এমন মনে করো না যে কালপ্রভাবেই রাজার দোষগুণ হয়; রাজার সদসৎ কর্ম অনুসারেই সত্য ত্রেতা দ্বাপর বা কলি যুগ উৎপন্ন হয়। তুমি পিতৃপিতামহের আচরিত রাজধর্ম পালন কর, তুমি যে ধর্ম চাও তা রাজর্ষিদের ধর্ম নয়। দুর্বল বা অহিংসাপরায়ণ রাজা প্রজাপালন করতে পারেন না। আমি সর্বদা এই আশীর্বাদ করছি যে তুমি যজ্ঞ দান ও তপস্যা কর, শৌর্য প্রজা বংশ বল ও তেজ লাভ কর। মহাবাহু সাম দান ভেদ বা দণ্ডনীতির দ্বারা তোমার পৈতৃক রাজ্যাংশ উদ্ধার কর। তোমার জননী হয়েও আমাকে পরদত্ত অন্নপিণ্ডের প্রত্যাশায় থাকতে হয় এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? কৃষ্ণ, আমি বিদুলা ও তাঁর পুত্রের কথা বলছি, তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও।—
বিদুলা নামে এক যশস্বিনী তেজস্বিনী ক্ষত্রিয়নারী ছিলেন। তাঁর পুত্র সঞ্জয় সিন্ধুরাজ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দুঃখিতমনে শুয়ে আছেন দেখে বিদুলা বললেন, তুমি আমার পুত্র নও, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তুমি ক্রোধহীন ক্লীবতুল্য, তুমি যাবজ্জীবন নিরাশ হয়ে থাকতে চাও। নিজেকে অবজ্ঞা ক’রো না, অল্পে তুষ্ট হয়ো না, নির্ভীক ও উৎসাহী হও। রে ক্লীব, তোমার সকল কীর্তি নষ্ট হয়েছে, রাজ্য পরহস্তগত হয়েছে, তবে বেঁচে আছ কেন? লোকে যার মহৎ চরিত্রের আলোচনা করে না সে পুরুষ নয়, স্ত্রীও নয়, সে কেবল মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। যার দান তপস্যা শৌর্য বিদ্যা বা অর্থের খ্যাতি নেই সে তার মাতার বিষ্ঠা মাত্র। পুত্র, নির্বাপিত অগ্নির ন্যায় কেবল ধূমায়িত হয়ো না, মুহূর্তকালের জন্যও জ্ব’লে ওঠ, শত্রুকে আক্রমণ কর।
বিদুলার পুত্র সঞ্জয় বললেন, আমি যদি যুদ্ধে মরি তবে সমস্ত পৃথিবী পেয়েও আপনার কি লাভ হবে? অলংকার সুখভোগ বা জীবনেই বা কি হবে? বিদুলা বললেন, যিনি নিজের বাহুবল আশ্রয় ক’রে জীবনধারণ করেন তিনিই কীর্তি ও পরলোকে সদ্গতি লাভ করেন। সিন্ধুরাজের প্রজারা সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু তারা মূঢ় ও দুর্বল, তাই রাজার বিপদের প্রতীক্ষায় নিশ্চেষ্ট হয়ে আছে। তুমি যদি নিজের পৌরুষ দেখাও তবে অন্য রাজারা সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তুমি গিরিদুর্গে থেকে সুযোগের প্রতীক্ষা কর, সিন্ধুরাজ অজর অমর নন। যুদ্ধের ফলে তোমার সমৃদ্ধিলাভ হবে কিংবা ক্ষতি হবে তার বিচার না ক’রেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আমি মহাকুলে জন্মগ্রহণ ক’রে তোমাদের মহাকুলে এসেছি, আমি রাজ্যের অধিশ্বরী মঙ্গলময়ী ও পতির আদরিণী ছিলাম। সঞ্জয়, আমাকে আর তোমার পত্নীকে যদি দীনদশাগ্রস্ত দেখ তবে তোমার জীবনে প্রয়োজন কি? শত্রুদের বশে আনতে পারলে ক্ষত্রিয় যে সুখ লাভ করেন সে সুখে ইন্দ্রভবনেও নেই। যুদ্ধে প্রাণবিসর্জন অথবা শত্রুর বিনাশ—এ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের শান্তিলাভ হ’তে পারে না।
সঞ্জয় বললেন, আপনি আমার প্রতি নিষ্ঠুর, আপনার হৃদয় কৃষ্ণলৌহে নির্মিত। আমার ধন নেই, সহায়ও নেই, কি করে জয়লাভ করব? এই দারুণ অবস্থা জেনেই আমার রাজ্যোদ্ধারের ইচ্ছা নিবৃত্ত হয়েছে। আপনি পরিণতবুদ্ধি, যদি কোনও উপায় জানেন তো বলুন, আমি সর্বতোভাবে আপনার আদেশ পালন করব।
বিদুলা বললেন, তুমি পূর্বে যে বীরত্ব দেখিয়েছ তা আবার দেখাও, তা হ’লেই রাজ্য উদ্ধার করতে পারবে। যারা সিন্ধুরাজের উপর কুদ্ধ, যাদের তিনি শক্তিহীন ও অপমানিত করেছেন, যারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়, তাদের সঙ্গে তুমি মিত্রতা কর। তুমি জান না, আমাদের রাজকোষে বহু ধন আছে। তোমার অনেক সুহৃৎও আছেন যাঁরা সুখদুঃখ সইতে পারেন এবং যুদ্ধ থেকে পালান না।
বিদুলার কথায় সঞ্জয়ের মোহ দূর হ’ল, তিনি বাক্যবাণে তাড়িত হয়ে জননীর উপদেশে যুদ্ধের উদ্যোগ করলেন এবং জয়ী হলেন। কোনও রাজা শত্রুর পীড়নে অবসন্ন হ’লে তাঁকে তাঁর মন্ত্রী এই উৎসাহজনক তেজোবর্ধক উপাখ্যান শোনাবেন। বিজয়েচ্ছু রাজা ‘জয়’ নামক এই ইতিহাস শুনবেন। গর্ভিণী এই উপাখ্যান বার বার শুনলে বীরপ্রসবিনী হন।
কুন্তীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে কৃষ্ণ ভীষ্মাদির নিকট বিদায় নিলেন, তার পর কর্ণকে নিজের রথে তুলে নিয়ে সাত্যকির সঙ্গে যাত্রা করলেন।
১৯। কৃষ্ণ-কর্ণ-সংবাদ
যেতে যেতে কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, রাধেয়, তুমি বেদজ্ঞ রাহ্মণদের সেবা করেছ এবং তাঁদের কাছে ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বসকল শিখেছ। কুমারী কন্যার গর্ভে দুইপ্রকার পুত্র হয়, কানীন[৫] ও সহোঢ়[৬]। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ বলেন, কন্যাকে যে বিবাহ করে সেই লোকই এই দুইপ্রকার পুত্রের পিতা। কর্ণ, তুমি কানীন পুত্র এবং ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পত্র। অতএব তুমিই রাজা হও, তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চল, পাণ্ডবরা জানুন যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচ ভ্রাতা, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং অভিমন্যু তোমার চরণ ধারণ করবেন; সমাগত রাজারা এবং অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় সকলেই তোমার পদানত হবেন। রাজা ও রাজকন্যারা তোমার অভিষেকের জন্য হিরণ্ময় রজতময় ও মৃণ্ময় কুম্ভ এবং ওষধি বীজ রত্ন প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে আসবেন দ্রৌপদীও ষষ্ঠ[৭] কালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে অভিষিক্ত করব, যুধিষ্ঠির যুবরাজ হবেন এবং শ্বেতচামরহস্তে তোমার পশ্চাতে থাকবেন। ভীমসেন তোমার মস্তকে শ্বেত ছত্র ধরবেন, অর্জুন তোমার রথ চালাবেন, অভিমন্যু সর্বদা তোমার কাছে থাকবেন। নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, পাঞ্চালগণ ও মহারথ শিখণ্ডী তোমার অনুগমন করবেন। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজা শাসন কর, কুন্তী ও মিত্রগণ আনন্দিত হ’ন, পাণ্ডব দ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হ’ক।
কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, তুমি যা বললে তা আমি জানি, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমি পাণ্ডুরই পুত্র। কুন্তী কন্যা অবস্থায় সূর্যের ঔরসে আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং হিতচিন্তা না ক’রে আমাকে ত্যাগ করেন। সূতবংশীয় অধিরথ আমাকে তাঁর গৃহে আনেন, স্নেহবশে তখনই তাঁর পত্নী রাধার স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হয়েছিল, তিনি আমার মলমূত্রও ঘেঁটেছিলেন। আমি কি ক’রে তাঁর পিণ্ডলোপ করতে পারি? অধিরথ আমাকে পুত্র মনে করেন, আমিও তাঁকে পিতা মনে করি। তিনি আমার জাতকর্মাদি করিয়েছেন, তাঁর নিযুক্ত ব্রাহ্মণেরা আমাকে বসুষেণ নাম দিয়েছেন, তাঁর আশ্রয়েই যৌবনলাভ ক’রে আমি বিবাহ করেছি। পত্নীদের সঙ্গে আমার প্রেমের বন্ধন আছে, তাঁদের গর্ভে আমার পুত্র-পৌত্রও হয়েছে। গোবিন্দ, সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবর্ণ পেলেও আমি সেই সম্বন্ধ মিথ্যা করতে পারি না, সুখের লোভে বা ভয় পেয়েও নয়। আমি দুর্যোধনের আশ্রয়ে তের বৎসর নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছি; সূতগণের সঙ্গে আমি বহু যজ্ঞ করেছি, তাঁদের সঙ্গে আমার বিবাহাদি সম্বন্ধও আছে। আমার ভরসাতেই দুর্যোধন যুদ্ধের উদ্যোগ করেছেন, দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা রূপে আমাকেই বরণ করেছেন। মৃত্যু বা বন্ধনের ভয়ে অথবা লোভের বশে আমি তাঁর সঙ্গে মিথ্যাচরণ করতে পারি না। তুমি যা বললে তা অবশ্য হিতের জন্যই। মধুসুদন, তুমি আমাদের এই আলোচনা গোপনে রেখো, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির যদি জানতে পারেন যে আমিই কুন্তীর প্রথম পুত্র তবে আর তিনি রাজ্য নেবেন না। যদি আমিই সেই রাজ্য পাই তবে দুর্যোধনকেই সমর্পণ করব। অতএব যুধিষ্ঠিরই রাজ্য লাভ করুন, হৃষীকেশ তাঁর নেতা এবং অর্জুন তাঁর যোদ্ধা হয়ে থাকুন। কেশব, ত্রিলোকের মধ্যে পুণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে বিশাল ক্ষত্রিয়মণ্ডল যেন অস্ত্রযুদ্ধেই নিহত হন, সমস্ত ক্ষত্রিয়ই যেন স্বর্গলাভ করেন।
মৃদু হাস্য ক’রে কৃষ্ণ বললেন, কর্ণ, আমি তোমাকে পৃথিবীর রাজ্য দিতে চাই, কিন্তু তুমি তা নেবে না। পাণ্ডবদের জয় হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি ফিরে গিয়ে ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপকে ব’লো, এই মাস[৮] অতি শুভকাল, এখন পশুখাদ্য ও ইন্ধন সুলভ, শস্য পরিপুষ্ট, বৃক্ষ সকল ফলবান, মক্ষিকা অল্প, পথে কর্দম নেই, জল স্বাদু হয়েছে, শীত বা গ্রীষ্ম অধিক নয়। সাত দিন পরে অমাবস্যা, সেই দিন সংগ্রাম আরম্ভ হ’ক। যুদ্ধের জন্য সমাগত রাজাদের ব’লো যে তাঁদের অভীষ্ট পূর্ণ হবে, দুর্যোধনের অনুগামী রাজা ও রাজপুত্রগণ অস্ত্রাঘাতে নিহত হয়ে উত্তম গতি লাভ করবেন।
কর্ণ বললেন, মহাবাহু সব জেনেও কেন আমাকে ভোলাতে চাচ্ছ? এই পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, দুর্যোধন দুঃশাসন শকুনি আর আমি তার নিমিত্তস্বরূপ। আমি দারুণ স্বপ্ন ও দুর্লক্ষণ দেখেছি, তুমি যেন রুধিরাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধ’রে নিক্ষেপ করছ, অস্থিস্তূপের উপরে উঠে যুধিষ্ঠির যেন সুবর্ণ পাত্রে ঘৃতপায়স ভোজন করছেন এবং তোমার প্রদত্ত পৃথিবী গ্রাস করছেন। কৃষ্ণ বললেন, আমার কথা যখন তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করলে না তখন অবশ্যই পৃথিবীর বিনাশ হবে। কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, এই মহাযুদ্ধ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আমরা কি আবার তোমাকে দেখতে পাব? অথবা স্বর্গেই আমাদের মিলন হবে? এখন আমি যাচ্ছি। এই ব’লে কর্ণ কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন ক’রে রথ থেকে নামলেন এবং নিজের রথে উঠে দীনমনে প্রস্থান করলেন। কৃষ্ণ ও সাত্যকি তাঁদের সারথিকে বললেন, শীঘ্র চল।
২০। কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ
কৃষ্ণ চ’লে গেলে বিদুর কুন্তীকে বললেন, আপনি জানেন, যুদ্ধ নিবারণের জন্য আমি সর্বদা চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুর্যোধন আমার কথা শোনে নি। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের বশবর্তী হয়ে অধর্মের পথে চলেছেন। কৃষ্ণ অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেলেন, এখন পাণ্ডবগণ যুদ্ধের উদ্যোগ করবেন। কৌরবদের দুর্নীতির ফলে বীরগণ বিনষ্ট হবেন, এই চিন্তা করে আমি দিবারাত্র বিনিদ্র হয়ে আছি।
কুন্তী দঃখার্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, যদ্ধে হ’লেও দোষ না হ’লেও দোষ। দুর্যোধনাদির পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ আর কর্ণ থাকবেন এজন্যই আমার ভয়। হয়তো দ্রোণ তাঁর শিষ্যের সঙ্গে যুদ্ধ কামনা করেন না, পিতামহ ভীষ্ম হয়তো পাণ্ডবগণের প্রতি স্নেহশীল হবেন। অবিবেচক দুর্মতি কর্ণই দুর্যোধনের বশবর্তী হয়ে পাণ্ডবদের বিদ্বেষ করে, তার জন্যই আমার ভয়। কন্যাকালে যাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি সেই কর্ণ কি আমার হিতকর বাক্য শুনবে না?
এই চিন্তা ক’রে কুতী গঙ্গাতীরে গেলেন। দয়ালু সত্যনিষ্ঠ কর্ণ সেখানে পূর্বমুখ ও ঊর্ধ্ববাহু হয়ে জপ করছিলেন। সূর্যতাপে পীড়িত হয়ে শুষ্ক পদ্মমালার ন্যায় কুন্তী কর্ণের উত্তরীয়বস্ত্রের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কর্ণ মধ্যাহ্ণকাল পর্যন্ত জপ করলেন, তার পর পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখতে পেলেন। তিনি সবিস্ময়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, আমি অধিরথ-রাধার পুত্র কর্ণ, আপনাকে অভিবাদন করছি, আজ্ঞা করুন আমাকে কি করতে হবে।
কুন্তী বললেন, কর্ণ, তুমি কৌন্তেয়, রাধার গর্ভজাত নও, অধিরথ তোমার পিতা নন, সূতকুলেও তোমার জন্ম হয় নি। বৎস, রাজা কুন্তিভোজের গৃহে আমার কন্যা অবস্থায় তুমি আমার প্রথম পুত্ররূপে জন্মেছিলে। তুমি পার্থ[৯], জগৎপ্রকাশক তপনদেব তোমার জনক। তুমি কবচকুণ্ডল ধারণ করে দেবশিশুর ন্যায় শ্রীমণ্ডিত হয়ে আমার পিতার গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। পুত্র, তুমি নিজের ভ্রাতাদের না চিনে মোহবশে দুর্যোধনাদির সেবা করেছ, তা উচিত নয়। যে রাজলক্ষ্মী অর্জুন পূর্বে অর্জন করেছিলেন, ধার্তরাষ্ট্রগণ যা লোভবশে হরণ করেছে, তা তুমি সবলে অধিকার করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভোগ কর। কৌরবগণ আজ দেখাক যে কর্ণার্জুন সৌভ্রাত্রবন্ধনে মিলিত হয়েছেন। কৃষ্ণ-বলরামের ন্যায় মিলিত হ’লে তোমাদের অসাধ্য কি থাকতে পারে? তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ; তুমি পার্থ; তোমাকে যেন কেউ সূতপুত্র না বলে।
তখন কর্ণ তাঁর পিতা ভাস্করের এই স্নেহবাক্য শুনতে পেলেন—তোমার জননী পৃথা সত্য বলেছেন, তাঁর কথা শোন, তোমার মঙ্গল হবে। মাতাপিতার অনুরোধেও কর্ণ বিচলিত হলেন না। তিনি কুন্তীকে বললেন, ক্ষত্রিয়জননী, আপনার বাক্যে আমার শ্রদ্ধা নেই, আপনার অনুরোধও ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করে ঘোর অন্যায় করেছেন, তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট হয়েছে। জন্মে ক্ষত্রিয় হ’লেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সংস্কার পাই নি, কোন্ শত্রু এর চেয়ে অধিক অপকার করতে পারে? আপনি যথাকালে আমাকে দয়া করেন নি, আজ কেবল নিজের হিতের জন্যই আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। কৃষ্ণের সহিত মিলিত অর্জুনকে কে না ভয় করে? এখন যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে সকলেই বলবে আমি ভয় পেয়ে এমন করেছি। কেউ জানে না যে আমি পাণ্ডবদের ভ্রাতা। এখন যুদ্ধকালে যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে ক্ষত্রিয়রা আমাকে কি বলবেন? ধার্তরাষ্ট্রগণ আমার সর্ব কামনা পূর্ণ করেছেন, আমাকে সম্মানিত করেছেন, এখন আমি কি করে তা নিষ্ফল করতে পারি? যাঁরা আমাকে শ্রদ্ধা করেন, যাঁরা আমার ভরসাতেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন, তাঁদের মনোরথ আমি কি করে ছিন্ন করব? যে সকল অস্থিরমতি পাপাত্মা রাজার অনুগ্রহে পুষ্ট ও কৃতার্থ হয়ে কার্যকালে কর্তব্য পালন করে না, সেই কৃতঘ্নদের ইহলোক নেই পরলোকও নেই। আমি সৎপুরুষোচিত অনৃশংসতা ও চরিত্র রক্ষা ক’রে আপনার পুত্রদের সঙ্গে যথাশক্তি যুদ্ধ করব, আপনার বাক্য হিতকর হলেও তা পালন করতে পারি না। কিন্তু আপনার আগমন ব্যর্থ হবে না, সমর্থ হ’লেও আমি আপনার সকল পুত্রকে বধ করব না। কেবল অর্জুনকে নিহত ক’রে অভীষ্ট ফল লাভ করব, অথবা তাঁর হাতে নিহত হয়ে যশোলাভ করব। যশস্বিনী, যেই মরুক, অর্জুন অথবা আমাকে নিয়ে আপনার পাঁচ পুত্রই থাকবে।
শোকার্তা কুন্তী কম্পিতদেহে পুত্রকে আলিঙ্গন করে বললেন, কর্ণ, তুমি যা বললে তাই হবে, কুরুকুলের ক্ষয় হবে, দৈবই প্রবল। অর্জুন ভিন্ন অন্য চার ভ্রাতাকে তুমি অভয় দিয়েছ এই প্রতিজ্ঞা মনে রেখো।
কুন্তী শুভাশীর্বাদ করলেন, কর্ণও তাঁকে অভিবাদন করলেন, তারপর দুজনে দুদিকে চ’লে গেলেন।
২১। কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন
উপপ্লব্য নগরে ফিরে এসে কৃষ্ণ তাঁর দৌত্যের বিবরণ যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে বললেন, আমি দুর্যোধনকে মিষ্টবাক্যে অনুরোধ করেছি, তার পর সভাস্থ রাজাদের ভর্ৎসনা করেছি, দুর্যোধনকে তৃণতুল্য অবজ্ঞা ক’রে কর্ণ ও শকুনিকে ভয় দেখিয়েছি, দ্যূতসভায় ধার্তরাষ্ট্রগণের আচরণের বহু নিন্দা করেছি। অবশেষে দুর্যোধনকে বলেছি, পাণ্ডবগণ অভিমান ত্যাগ ক’রে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুরের আজ্ঞাধীন হয়ে থাকবেন, নিজের রাজ্যাংশ শাসনের ভারও তোমার হাতে দেবেন; ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুর তোমাকে যে হিতকর উপদেশ দিয়েছেন তা পালন কর। অন্তত পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দাও, কারণ তাঁদের ভরণ করা ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্য। তার পর কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনাদের জন্য আমি কৌরব সভায় সাম দান ও ভেদ নীতি অনুসারে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। এখন চতুর্থ নীতি দণ্ড ছাড়া আর কোনও উপায় দেখি না। কৌরবপক্ষের রাজারা বোধ হয় এখন বিনাশের নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করেছেন। দুর্যোধনাদি বিনা যুদ্ধে আপনাকে রাজ্য দেবেন না।