মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপর্বাধ্যায়
॥নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপর্বাধ্যায়॥
২১। অশ্বত্থামার সংকল্প—ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকির কলহ
দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবগণ ভীত হয়ে পালাতে লাগলেন। কর্ণ শল্য কৃপ দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি রণস্থল থেকে চ’লে এলেন। অশ্বত্থামা তখনও শিখণ্ডী প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কৌরবসৈন্যের ভঙ্গ দেখে তিনি দুর্যোধনের কাছে এসে বললেন, রাজা, তোমার সৈন্য পালাচ্ছে কেন? তোমাকে এবং কর্ণ প্রভৃতিকে প্রকৃতিস্থ দেখছি না, কোন্ মহারথ নিহত হয়েছেন? দুর্যোধন অশ্বত্থামার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, তাঁর চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হ’ল। তখন কৃপাচার্য দ্রোণের মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানালেন। অশ্বত্থামা বার বার চক্ষু মুছে ক্রোধে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার পিতা অস্ত্র ত্যাগ করার পর নীচাশয় পাণ্ডবগণ যে ভাবে তাঁকে বধ করেছে এবং ধর্মধ্বজী নৃশংস অনার্য যুধিষ্ঠির যে পাপকর্ম করেছে তা শুনলাম। যুদ্ধে নিহত হওয়া দুঃখজনক নয়, কিন্তু সকল সৈন্যের সমক্ষে পিতার কেশাকর্ষণ করা হয়েছে এতেই আমি মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি। নৃশংস দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন শীঘ্রই এর দারুণ প্রতিফল পাবে। যে মিথ্যাবাদী পাণ্ডব আচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করিয়েছে, আজ রণভূমি সেই যুধিষ্ঠিরের রক্ত পান করবে। আমি এমন কর্ম করব যাতে পরলোকগত পিতার নিকট ঋণমুক্ত হ’তে পারি। আমার কাছে যে অস্ত্র আছে তা পাণ্ডবগণ কৃষ্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী বা সাত্যকি কেউ জানেন না। আমার পিতা নারায়ণের পূজা ক’রে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। অস্ত্রদানকালে নারায়ণ বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ, এই অস্ত্র সহসা প্রয়োগ করবে না। শত্রুসংহার না করে এই অস্ত্র নিবৃত্ত হয় না। এতে কে নিহত হবে না তা পূর্বে জানা যায় না, যারা অবধ্য তারাও নিহত হ’তে পারে। কিন্তু রথ ও অস্ত্র ত্যাগ করে শরণাগত হ’লে এই মহাস্ত্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। দুর্যোধন, আজ আমি সেই নারায়ণাস্ত্র দিয়ে পাণ্ডব পাঞ্চাল মৎস্য ও কেকয়গণকে বিদ্রাবিত করব। গুরুত্যাকারী পাপিষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন আজ রক্ষা পাবে না।
দ্রোণপুত্রের এই কথা শুনে কৌরবসৈন্য আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এল, কৌরবশিবিরে শঙ্খ ও রণবাদ্য বাজতে লাগল। অশ্বত্থামা জলস্পর্শ করে নারায়ণাস্ত্র প্রকাশিত করলেন। তখন সগর্জনে বায়ু বইতে লাগল, পৃথিবী কম্পিত ও মহাসাগর বিক্ষুব্ধ হ’ল, নদীস্রোত বিপরীতগামী হ’ল, সূর্য মলিন হলেন।
কৌরবশিবিরে তুমুল শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, দ্রোণাচার্যের নিধনের পর কৌরবরা হতাশ হয়ে রণস্থল থেকে পালিয়েছিল, এখন আবার ওদের ফিরিয়ে আনলে কে? ওদের মধ্যে ওই লোমহর্ষকর নিনাদ হচ্ছে কেন? অর্জুন বললেন, অশ্বত্থামা গর্জন করছেন। তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েই উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় হ্রেষারব করেছিলেন সেজন্য তাঁর নাম অশ্বত্থামা। ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার গুরুর কেশাকর্ষণ করেছিলেন, অশ্বত্থামা তা ক্ষমা করবেন না। মহারাজ, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়েও রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা ব’লে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে। এই পাণ্ডুপুত্র সর্বধর্মসম্পন্ন, এ আমার শিষ্য, এ মিথ্যা বলবে না — আপনার উপর দ্রোণের এই বিশ্বাস ছিল। আপনি অস্ত্রত্যাগী গুরুকে অধর্ম অনুসারে হত্যা করিয়েছেন, এখন যদি পারেন তো সকলে মিলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করুন। যিনি সর্বভূতে প্রীতিমান সেই অতিমানুষ অশ্বত্থামা পিতার কেশাকর্ষণ শুনে আজ আমাদের সংহার করবেন। আমাদের বয়সের অধিকাংশই অতীত হয়েছে, এখন যে অল্পকাল অবশিষ্ট আছে তা অধর্মাচরণের জন্য বিকারগ্রস্ত হ’ল। যিনি স্নেহের জন্য এবং ধর্মত পিতার তুল্য ছিলেন, অল্প কাল রাজ্যভোগের লোভে তাঁকে আমরা হত্যা করিয়েছি। হা, আমরা মহৎ পাপ করেছি!
ভীমসেন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অর্জুন, তুমি অরণ্যবাসী ব্রতধারী মুনির ন্যায় ধর্ম কথা বলছ। কৌরবগণ অধর্ম অনুসারে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য হরণ করেছে, দ্রৌপদীর কৈশাকর্ষণ করেছে, আমাদের তের বৎসর নির্বাসিত করেছে; এখন আমরা সেইসকল দুষ্কার্যের প্রতিশোধ নিচ্ছি। তুমি ক্ষত্রধর্ম না বুঝে আমাদের ক্ষতস্থানে ক্ষার দিচ্ছ। তোমরা চার ভ্রাতা না হয় যুদ্ধ ক’রো না, আমি একাই গদাহস্তে অশ্বত্থামাকে জয় করব।
ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনকে বললেন, ব্রাহ্মণদের কার্য যজন যাজন অধ্যয়ন অধ্যাপন দান ও প্রতিগ্রহ। দ্রোণ তার কি করেছেন? তিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়বৃত্তি নিয়ে অলৌকিক অস্ত্রে আমাদের ধ্বংস করছিলেন। সেই নীচ ব্রাহ্মণকে যদি আমরা কুটিল উপায়ে বধ করে থাকি তবে কি অন্যায় হয়েছে? দ্রোণকে মারবার জন্যই যজ্ঞাগ্নি থেকে দ্রুপদপুত্ররূপে আমার উৎপত্তি। সেই নৃশংসকে আমি নিপাতিত করেছি, তার জন্য আমাকে অভিনন্দন করছ না কেন? তুমি জয়দ্রথের মুণ্ড নিষাদের দেশে নিক্ষেপ করেছিলে, কিন্তু আমি দ্রোণের মুখ সেরূপে নিক্ষেপ করি নি, এই আমার দুঃখ। ভীষ্মকে বধ করলে যদি অধর্ম না হয় তবে দ্রোণের বধে অধর্ম হবে কেন? অর্জুন, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব মিথ্যাবাদী নন, আমিও অধার্মিক নই, আমরা শিষ্যদ্রোহী পাপীকেই মেরেছি।
ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শুনে অর্জুন বললেন, ধিক ধিক! যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ, এবং আর সকলে লজ্জিত হলেন। সাত্যকি বললেন, এখানে কি এমন কেউ নেই যে এই অকল্যাণভাষী নরাধম ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করে? ক্ষুদ্রমতি, তোমার জিহ্বা আর মস্তক বিদীর্ণ হচ্ছে না কেন? কুলাঙ্গার, গুরুহত্যা করে তোমার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সাত পুরুষকে তুমি নরকস্থ করেছ। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় ব’লে দিয়েছিলেন, এবং তোমার ভ্রাতা শিখণ্ডীই তাঁকে বধ করেছে। তুমি যদি আবার এপ্রকার কথা বল তবে গদাঘাতে তোমার মস্তক চূর্ণ করব।
সাত্যকির ভর্ৎসনা শুনে ধৃষ্টদ্যুম্ন হেসে বললেন, তোমার কথা শুনেছি শুনেছি, ক্ষমাও করেছি। সাত্যকি, তোমার কেশাগ্র থেকে নখাগ্র পর্যন্ত নিন্দনীয়, তথাপি আমার নিন্দা করছ! সকলে বারণ করলেও তুমি প্রায়োপবিষ্ট ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার শিরশ্ছেদ করেছিলে। তার চেয়ে পাপকর্ম আর কি হ’তে পারে? ধৃষ্টদ্যুম্নের তিরস্কার শুনে সাত্যকি বললেন, আমি আর কিছু বলতে চাই না, তুমি বধের যোগ্য, তোমাকে বধ করব।
সাত্যকি গদা নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীমসেন সাত্যকিকে জড়িয়ে ধরে নিরস্ত করলেন। সহদেব মিষ্টবাক্যে বললেন, নরশ্রেষ্ঠ সাত্যকি, অন্ধক বৃষ্ণি ও পাঞ্চাল ভিন্ন আমাদের মিত্র নেই। আপনারা, আমরা এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই পরস্পরের মিত্র, অতএব ক্ষমা করুন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে বললেন, ভীম, শিনির পৌত্রটাকে ছেড়ে দাও, আমি তীক্ষ্ণ শরের আঘাতে ওর ক্রোধ, যুদ্ধের ইচ্ছা আর জীবন শেষ ক’রে দেব, ও মনে করেছে আমি ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবা।
সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বৃষের ন্যায় গর্জন করতে লাগলেন, তখন কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টায় তাঁদের শান্ত করলেন।
২২। অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র মোচন
(পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধোন্ত)
প্রলয়কালে যমের ন্যায় অশ্বত্থামা পাণ্ডবসৈন্য সংহার করতে লাগলেন। তাঁর নারায়ণাস্ত্র থেকে সহস্র সহস্র দীপ্তমুখ সর্পের ন্যায় বাণ এবং লৌহগোলক শতঘ্নী শূল গদা ও ক্ষুরধার চক্র নির্গত হ’ল, পাণ্ডবসৈন্য তৃণরাশির ন্যায় দগ্ধ হতে লাগল। সৈন্যগণ জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে এবং অর্জুন উদাসীন হয়ে আছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, তুমি পাঞ্চাল সৈন্য নিয়ে পালাও; সাত্যকি, তুমি বৃষ্ণি-অন্ধক সৈন্য নিয়ে গৃহে চ’লে যাও; ধর্মাত্মা বাসুদেব যা কর্তব্য মনে করেন করবেন। আমি সকল সৈন্যকে বলছি — যুদ্ধ ক’রো না, আমি ভ্রাতাদের সঙ্গে অগ্নিপ্রবেশ করব। ভীষ্ম ও দ্রোণ রূপ দুস্তর সাগর পার হয়ে এখন আমরা অশ্বত্থামা রূপ গোষ্পদে নিমজ্জিত হব। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী আচার্যকে নিপাতিত করিয়েছি, অতএব অর্জুনের ইচ্ছা পূর্ণ হ’ক। এই দ্রোণ যুদ্ধে অপটু বালক অভিমন্যুকে হত্যা করিয়েছেন; দ্যূতসভায় নিগৃহীত দ্রৌপদীর প্রশ্ন শুনে নীরব ছিলেন; পরিশ্রান্ত অর্জুনকে মারবার জন্য দুর্যোধন যখন যুদ্ধে যান তখন ইনিই তাঁর দেহে অক্ষয় কবচ বেঁধে দিয়েছিলেন; ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ পাঞ্চালগণকে ইনি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে নিপাতিত করেছিলেন; কৌরবগণ যখন আমাদের নির্বাসিত করে তখন ইনি আমাদের যুদ্ধ করতে দেন নি, আমাদের সঙ্গে বনেও যান নি। আমাদের সেই পরম সুহৃৎ দ্রোণাচার্য নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।
কৃষ্ণ সত্বর এসে দুই হাত তুলে সৈন্যগণকে বললেন, তোমরা শীঘ্র অস্ত্রত্যাগ কর, বাহন থেকে নেমে পড়, নারায়ণাস্ত্র নিবারণের এই উপায়। ভীম বললেন, কেউ অস্ত্রত্যাগ ক’রো না, আমি শরাঘাতে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারিত করব। এই ব’লে তিনি রথারোহণে অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামাও হাস্যমুখে অভিভাষণ ক’রে অনলোদ্গারী বাণে ভীমকে আচ্ছন্ন করলেন।
পাণ্ডবসৈন্য অস্ত্র পরিত্যাগ ক’রে হস্তী অশ্ব ও রথ থেকে নেমে পড়ল, তখন অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র কেবল ভীমের দিকে যেতে লাগল। অর্জুন সত্বর রথ থেকে নেমে ভীমের কাছে গেলেন। কৃষ্ণ বললেন, পাণ্ডুপুত্র, এ কি করছেন? বারণ করলেও যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হচ্ছেন না কেন? যদি আজ জয়ী হওয়া সম্ভবপর হ’ত তবে আমরা সকলেই যুদ্ধ করতাম। দেখুন, পাণ্ডবপক্ষের সকলেই রথ থেকে নেমেছেন। এই ব’লে কৃষ্ণ ও অর্জুন সবলে ভীমকে রথ থেকে নামালেন এবং তাঁর অস্ত্র কেড়ে নিলেন। ভীম ক্রোধে রক্তনয়ন হয়ে সর্পের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন, নারায়ণাস্ত্রও নিবৃত্ত হ’ল।
হতাবশিষ্ট পাণ্ডবসৈন্য আবার যুদ্ধে উদ্যত হয়েছে দেখে দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, আবার অস্ত্র প্রয়োগ কর। অশ্বত্থামা বিষণ্ণ হয়ে বললেন, রাজা, এই নারায়ণাস্ত্র দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করলে প্রয়োগকারীকেই বধ করে। নিশ্চয় কৃষ্ণ পাণ্ডবগণকে এই অস্ত্র নিবারণের উপায় বলেছেন, নতুবা আজ সমস্ত শত্রু ধ্বংস হ’ত। তখন দুর্যোধনের অনুরোধে অশ্বত্থামা অন্য অস্ত্র নিয়ে আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে পরাস্ত ক’রে মালবরাজ সুদর্শন, পুরুবংশীয় বৃদ্ধক্ষত্র ও চেদি দেশের যুবরাজকে বধ করলেন। তার পর তিনি অর্জুনের দিকে ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুন ব্রহণাস্ত্র প্রয়োগ ক’রে অশ্বত্থামার অস্ত্র ব্যর্থ করে দিলেন।
এই সময়ে স্নিগ্ধজলদবর্ণ সর্ববেদের আধার সাক্ষাৎ ধর্ম সদৃশ মহর্ষি ব্যাস আবির্ভূত হলেন। অশ্বত্থামা কাতর হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান, আমার অস্ত্র মিথ্যা হ’ল কেন? কৃষ্ণার্জুনের মায়ায় না দৈব ঘটনায় এমন হ’ল? কৃষ্ণ ও অর্জুন মানুষ হয়ে আমার অস্ত্র থেকে কি করে নিস্তার পেলেন?
ব্যাসদেব বললেন, স্বয়ং নারায়ণ মায়ার দ্বারা জগৎ মোহিত ক’রে কৃষ্ণরূপে বিচরণ করছেন। তাঁর তপস্যার ফলে তাঁরই তুল্য নর-ঋষি জন্মেছিলেন, অর্জুন সেই নরের অবতার। অশ্বত্থামা, তুমিও রুদ্রের অংশে জন্মেছ। কৃষ্ণ অর্জুন ও তোমার অনেক জন্ম হয়ে গেছে, তোমরা বহু কর্ম যোগ ও তপস্যা করেছ, যুগে যুগে কৃষ্ণার্জুন শিবলিঙ্গের পূজা করেছেন, তুমি শিবপ্রতিমার পূজা করেছ। কৃষ্ণ রুদ্রের ভক্ত এবং রুদ্র হ’তেই তাঁর উৎপত্তি।
ব্যাসের বাক্য শুনে অশ্বত্থামা রুদ্রকে নমস্কার করলেন এবং কেশবের প্রতি শ্রদ্ধাবান হলেন। তিনি রোমাঞ্চিতদেহে মহর্ষি ব্যাসকে অভিবাদন করে কৌরবগণের নিকট ফিরে গেলেন। সে দিনের যুদ্ধ শেষ হ’ল।
২৩। মহাদেবের মাহাত্ম্য
ব্যাসদেবকে দেখে অর্জুন বললেন, মহামুনি, আমি যুদ্ধ করবার সময় দেখেছি এক অগ্নিপ্রভ পুরুষ প্রদীপ্ত শূল নিয়ে আমার আগে আগে যাচ্ছেন, এবং যে দিকে যাচ্ছেন সেই দিকেই শত্রুরা পরাভূত হচ্ছে। তাঁর চরণ ভূমিস্পর্শ করে না, তিনি শূলও নিক্ষেপ করেন না, অথচ তাঁর শূল থেকে সহস্র সহস্র শূল নির্গত হয়। তাঁর প্রভাবেই শত্রু পরাভূত হয়, কিন্তু লোকে মনে করে আমিই পরাভূত করেছি। এই শূলধারী সূর্যসন্নিভ পুরুষশ্রেষ্ঠ কে তা বলুন।
ব্যাস বললেন, অর্জুন, তুমি মহাদেবকে দেখেছ। তিনি প্রজাপতিগণের প্রধান, সর্বলোকেশ্বর, ঈশান, শিব, শংকর, ত্রিলোচন, রুদ্র, হর, স্থাণু, শম্ভু, স্বয়ম্ভু, ভূতনাথ, বিশ্বেশ্বর, পশুপতি, সর্ব, ধূর্জটি, বৃষধ্বজ, মহেশ্বর, পিনাকী, ত্র্যম্বক। তাঁর বহু পারিষদ আছেন, তাঁদের নানা রূপ — বামন, জটাধারী, মুণ্ডিতমস্তক, মহোদর, মহাকায়, মহাকর্ণ, বিকৃতমুখ, বিকৃতচরণ, বিকৃতকেশ। তিনিই যুদ্ধে তোমার আগে আগে যান। তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও। পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ এক যজ্ঞ করেছিলেন, মহাদেবের ক্রোধে তা পণ্ড হয়। পরিশেষে দেবতারা তাঁকে প্রণিপাত করে তাঁর শরণাপন্ন হলেন এবং তাঁর জন্য বিশিষ্ট যজ্ঞভাগ নির্দিষ্ট করে দিলেন। তখন মহাদেব প্রসন্ন হলেন। পুরাকালে কমলাক্ষ তারকাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী নামে তিন অসুর ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে নগরতুল্য বৃহৎ তিন বিমানে আকাশে ঘুরে বেড়াত। এই বিমানের একটি স্বর্ণময়, আর একটি রজতময়, আর একটি লৌহময়। এই ত্রিপুরাসুরের উপদ্রবে পীড়িত হয়ে দেবতারা মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ত্রিশূলের আঘাতে সেই ত্রিপুর বিনষ্ট করলেন। সেই সময়ে ভগবতী উমা পঞ্চশিখাযুক্ত একটি বালককে কোলে নিয়ে দেবগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই বালক? ইন্দ্র অসূয়াবশে বালকের উপর বজ্রপ্রহার করতে গেলেন, মহাদেব ইন্দ্রের বাহু স্তম্ভিত ক’রে দিলেন। তার পর পিতামহ ব্রহ্মা মহেশ্বরকে শ্রেষ্ঠ জেনে বন্দনা করলেন, দেবতারাও রুদ্র ও উমাকে প্রসন্ন করলেন। তখন ইন্দ্রের বাহু পূর্ববৎ হ’ল। পাণ্ডুনন্দন, আমি সহস্র বৎসরেও মহাদেবের সমস্ত গুণ বর্ণনা করতে পারি না। বেদে এঁর শতরুদ্রিয় স্তোত্র এবং অনন্তরুদ্র নামে উপাসনামন্ত্র আছে। জয়দ্রথবধের পূর্বে তুমি কৃষ্ণের প্রসাদে স্বপ্নযোগে এই মহাদেবকেই দেখেছিলে। কৌন্তেয়, যাও, যুদ্ধ কর, তোমার পরাজয় হবে না, মন্ত্রী ও রক্ষক রূপে স্বয়ং জনার্দন তোমার পার্শ্বে রয়েছেন।