মহাভারত (রাজশেখর বসু)/কর্ণপর্ব

কর্ণপর্ব

১। কর্ণের সেনাপতিত্বে অভিষেক

 দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মনে করেছিলেন যে নারায়ণাস্ত্র দ্বারা সমস্ত পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করবেন। তাঁর সে সংকল্প ব্যর্থ হ’ল। সন্ধ্যাকালে দুর্যোধন যুদ্ধবিরতির আদেশ দিয়ে নিজ শিবিরে ফিরে এলেন। তিনি কোমল আস্তরণযুক্ত সুখশয্যায় উপবিষ্ট হয়ে স্বপক্ষীয় মহাধনুর্ধরগণকে মধুরবাক্যে অনুনয় ক’রে বললেন, হে বুদ্ধিমান রাজগণ, আপনারা অবিলম্বে নিজের নিজের মত বলুন, এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত।

 দুর্যোধনের কথা শুনে রাজারা যুদ্ধসূচক নানাপ্রকার ইঙ্গিত করলেন। অশ্বত্থামা বললেন, পণ্ডিতগণের মতে কার্যসিদ্ধির উপায় এই চারটি — কার্যে অনুরাগ, উদ্‌যোগ, দক্ষতা ও নীতি; কিন্তু সবই দৈবের অধীন। আমাদের পক্ষে যেসকল অনুরক্ত উদ্‌যোগী দক্ষ ও নীতিজ্ঞ দেবতুল্য মহারথ ছিলেন তাঁরা হত হয়েছেন; তথাপি আমাদের হতাশ হওয়া উচিত নয়, কারণ উপযুক্ত নীতির প্রয়োগে দৈবকেও অনুকূল করা যায়। আমরা কর্ণকে সেনাপতি ক’রে শত্রুকুল মথিত করব। ইনি মহাবল, অস্ত্রবিশারদ, যুদ্ধে দুর্ধর্ষ, এবং কৃতান্তের ন্যায় অসহনীয়। ইনিই যুদ্ধে শত্রুজয় করবেন।

 দুর্যোধন আশ্বস্ত ও প্রীত হয়ে কর্ণকে বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার বীর্য এবং আমার প্রতি সৌহার্দ জানি। ভীষ্ম আর দ্রোণ মহাধনুর্ধর হ’লেও বৃদ্ধ এবং ধনঞ্জয়ের পক্ষপাতী ছিলেন, তোমার কথাতেই আমি তাঁদের সেনাপতির পদ দিয়েছিলাম। তাঁরা নিহত হয়েছেন, এখন তোমার তুল্য অন্য যোদ্ধা আমি দেখছি না। তুমি জয়ী হবে তাতে আমার সন্দেহ নেই, অতএব তুমি আমার সৈন্যচালনার ভার নাও, নিজেই নিজেকে সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত কর। সূতপুত্র, তুমি সম্মুখে থাকলে অর্জুন যুদ্ধ করতেই চাইবে না। কর্ণ বললেন, মহারাজ, আমি পুত্রসমেত পাণ্ডবগণ ও জনার্দনকে জয় করব। তুমি নিশ্চিন্ত হও, আমি তোমার সেনাপতি হব; ধ’রে নাও যে পাণ্ডবরা পরাজিত হয়েছে।

 তার পর দুর্যোধন ও অন্যান্য রাজারা ক্ষৌমবস্ত্রে আচ্ছাদিত তাম্রময় আসনে কর্ণকে বসালেন, এবং জলপূর্ণ স্বর্ণময় ও মৃন্ময় কুম্ভ এবং মণিমুক্তাভূষিত গজদন্ত, গণ্ডারশৃঙ্গ ও মহাবৃষের শৃঙ্গে নির্মিত পাত্র দ্বারা শাস্ত্রবিধি অনুসারে অভিষিক্ত করলেন। বন্দিগণ ও ব্রাহ্মণগণ বললেন, রাধেয় কর্ণ, সূর্য যেমন উদিত হয়ে অন্ধকার নষ্ট করেন, আপনি সেইরূপ পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে ধ্বংস করুন। পেচক যেমন সূর্যের প্রখর রশ্মি সইতে পারে না, কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরাও সেইরূপ আপনার শরবর্ষণ সইতে পারবেন না। বজ্রধর ইন্দ্রের সম্মুখে দানবদের ন্যায় পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণও আপনার সম্মুখে দাঁড়াতে পারবেন না।

২। অশ্বত্থামার পরাজয়

(ষোড়শ দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন সূর্যোদয় হ’লে কর্ণ যুদ্ধসজ্জার আদেশ দিলেন। তখন হস্তী অশ্ব ও বর্মাবৃত রথ সকল প্রস্তুত হ’ল, যোদ্ধারা পরস্পরকে ডাকতে লাগলেন। কর্ণ শঙ্খধ্বনি করতে করতে যুদ্ধযাত্রা করলেন। তাঁর রথ শ্বেতপতাকায় ভূষিত এবং বহু ধনু তূণীর গদা শতঘ্নী শক্তি শূল তোমর প্রভৃতি অস্ত্র সমন্বিত। রথধ্বজের উপর লাঞ্ছনাস্বরূপ গজবন্ধনরজ্জু ছিল। বলাকাবর্ণ চার অশ্ব সেই রথ বহন ক’রে নিয়ে চলল। কর্ণ মকরব্যূহ রচনা ক’রে স্বয়ং তার মুখে রইলেন এবং শকুনি, তৎপুত্র উলূক, অশ্বত্থামা, দুর্যোধনাদি, নারায়ণী সেনা সহ কৃতবর্মা, ত্রিগর্ত ও দাক্ষিণাত্য সৈন্য সহ কৃপাচার্য, মদ্রদেশীয় বৃহৎ সৈন্য সহ শল্য, সহস্র রথ ও তিন শত হস্তী সহ সুষেণ, এবং বিশাল বাহিনী সহ রাজা চিত্র ও তাঁর ভ্রাতা চিত্রসেন সেই ব্যূহের বিভিন্ন অংশ রক্ষা করতে লাগলেন।

 কর্ণকে সসৈন্যে আসতে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, মহাবাহু, কৌরববাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীরগণ হত হয়েছেন, কেবল নিকৃষ্ট যোদ্ধারা অবশিষ্ট আছেন। সূতপত্র কর্ণই ও পক্ষের একমাত্র মহাধনুর্ধর, তাঁকে বধ ক’রে তুমি বিজয়ী হও। যে শল্য দ্বাদশ বৎসর আমার হৃদয়ে বিদ্ধ আছে তা কর্ণ নিহত হ’লে উদ্ধৃত হবে, এই বুঝে তুমি ইচ্ছামত ব্যূহ রচনা কর। তখন অর্জুন অর্ধচন্দ্রব্যূহ রচনা করলেন, তাঁর বাম পার্শ্বে ভীমসেন, দক্ষিণে ধৃষ্টদ্যুম্ন, এবং মধ্যদেশে যুধিষ্ঠির ও তাঁর পশ্চাতে অর্জুন নকুল সহদেব রইলেন। দুই পাঞ্চালবীর যুধামন্য, ও উত্তমৌজা এবং অন্যান্য যোদ্ধারা ব্যূহের উপযুক্ত স্থানে অবস্থান করলেন।

 দুই পক্ষে শঙ্খ ভেরী পণব প্রভৃতি রণবাদ্য বেজে উঠল, জয়াকাঙ্ক্ষী বীরগণ সিংহনাদ করতে লাগলেন। অশ্বের হ্রেষা, হস্তীর বৃংহিতধ্বনি, এবং রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দে সর্ব দিক নিনাদিত হ’ল। গজারোহী ভীমসেন ও কুলূত দেশের রাজা ক্ষেমধূর্তি সসৈন্যে পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। ক্ষেমধূর্তি ভীমের গদাঘাতে নিহত হলেন। কর্ণের সঙ্গে নকুল, অশ্বত্থামার সঙ্গে ভীম, কেকয়দেশীয় বিন্দ অনুবিন্দের সঙ্গে সাত্যকি, অর্জুনপুত্র শ্রুতকর্মার সঙ্গে অভিসাররাজ চিত্রসেন, যুধিষ্ঠিরপুত্র প্রতিবিন্ধ্যের সঙ্গে চিত্র, দুর্যোধনের সঙ্গে যুধিষ্ঠির, সংশপ্তকগণের সঙ্গে অর্জুন, কৃপাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন, কৃতবর্মার সঙ্গে শিখণ্ডী, শল্যের সঙ্গে সহদেবপুত্র শ্রুতসেন, এবং দুঃশাসনের সঙ্গে সহদেব ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন।

 সাত্যকির শরাঘাতে অনুবিন্দ এবং অসির আঘাতে বিন্দ নিহত হলেন। শ্রুতকর্মা ভল্লের আঘাতে চিত্রসেনের মস্তক ছেদন করলেন। প্রতিবিন্ধ্যের তোমরের আঘাতে চিত্র নিহত হলেন। ভীমের প্রচণ্ড বল এবং অশ্বত্থামার আশ্চর্য অস্ত্রশিক্ষা দেখে আকাশচারী সিদ্ধ চারণ মহর্ষি ও দেবগণ সাধু সাধু বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামা ও ভীম পরস্পরের শরাঘাতে অচেতন হয়ে নিজ নিজ রথের মধ্যে পড়ে গেলেন, তাঁদের সারথিরা রথ সরিয়ে নিয়ে গেল।

 কিছুক্ষণ পরে অশ্বত্থামা পুনর্বার রণভূমিতে এসে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। অর্জুন তখন সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কৃষ্ণ অশ্বত্থামার কাছে রথ নিয়ে গিয়ে বললেন, অশ্বত্থামা, আপনি স্থির হয়ে অস্ত্রপ্রহার করুন এবং অর্জুনের প্রহার সহ্য করুন, উপজীবীদের ভর্তৃপিণ্ড শোধ করবার এই সময়[]। ব্রাহ্মণদের বাদানুবাদ সূক্ষ্ম, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের জয়পরাজয় স্থূল অস্ত্রে সাধিত হয়। আপনি মোহবশে অর্জুনের কাছে যে সৎকার চেয়েছেন তা পাবার জন্য স্থির হয়ে যুদ্ধ করুন। ‘তাই হবে’ এই ব’লে অশ্বত্থামা অনেক গুলি নারাচ নিক্ষেপ ক’রে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। অর্জুনও তাঁর গাণ্ডীব ধনু থেকে নিরন্তর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। কলিঙ্গ বঙ্গ অঙ্গ ও নিষাদ বীরগণ ঐরাবততুল্য হস্তীর দল নিয়ে অর্জুনের প্রতি ধাবিত হলেন, কিন্তু বিধ্বস্ত হয়ে পলায়ন করলেন।

 অশ্বত্থামার লৌহময় বাণের আঘাতে কৃষ্ণ ও অর্জুন রক্তাক্ত হলেন, লোকে মনে করলে তাঁরা নিহত হয়েছেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি অসাবধান হয়ে আছ কেন, অশ্বত্থামাকে বধ কর। প্রতিকার না করলে ব্যাধি যেমন কষ্টকর হয়, অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা করা সেইরূপ বিপজ্জনক হবে। তখন অর্জুন সাবধানে শরক্ষেপণ ক’রে অশ্বত্থামার চন্দনচর্চিত দুই বাহু বক্ষ মস্তক ও ঊরুদ্বয় বিদ্ধ করলেন। অশ্বত্থামার রথের অশ্বসকল আহত হয়ে রথ নিয়ে সবেগে দূরে চ’লে গেল। অর্জুনের শরাঘাতে অভিভূত ও নিরুৎসাহ হয়ে অশ্বত্থামা আর যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করলেন না, কৃষ্ণার্জুনের জয় হয়েছে জেনে কর্ণের সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন।

৩। দণ্ডধার-দণ্ড-বধ—রণভূমির ভীষণতা

(ষোড়শ দিনের আরও যুদ্ধ)

 মগধরাজ দণ্ডধার পাণ্ডবসেনার উত্তর দিকে রথ হস্তী অশ্ব ও পদাতি বিনষ্ট করছিলেন। আর্তনাদ শুনে কৃষ্ণ রথ ফিরিয়ে নিয়ে অর্জুনকে বললেন, রাজা দণ্ডধার অস্ত্রবিদ্যায় ও পরাক্রমে ভগদত্তের চেয়ে নিকৃষ্ট নন, তাঁর হস্তীও বিপক্ষসেনা মর্দন করে। অতএব তুমি আগে তাঁকে বধ ক’রে তার পর সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রো। এই ব’লে কৃষ্ণ অর্জুনের রথ দণ্ডধারের কাছে নিয়ে গেলেন। দণ্ডধার তখন শরাঘাতে পাণ্ডবসৈন্য সংহার করছিলেন, তাঁর হস্তীও চরণ ও শুণ্ডের প্রহারে রথ অশ্ব গজ ও সৈন্য মর্দন করছিল। অর্জুন ক্ষুরধার তিন বাণে দণ্ডধারের বাহুদ্বয় ও মস্তক ছেদন করলেন এবং হস্তী ও হস্তিচালককেও নিপাতিত করলেন। মগধরাজকে নিহত দেখে তাঁর ভ্রাতা দণ্ড হস্তিপৃষ্ঠে এসে কৃষ্ণার্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু তিনিও অর্জুনের অর্ধচন্দ্র বাণে ছিন্নবাহু ছিন্নমুণ্ড হলেন। তার পর অর্জুন ফিরে গিয়ে পুনর্বার সংশপ্তকদের বধ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি খেলা করছ কেন, সংশপ্তকদের বিনষ্ট ক’রে কর্ণবধে ত্বরান্বিত হও।

 অর্জুন অবশিষ্ট[] সংশপ্তকগণকে বধ করলেন। শরক্ষেপণে অর্জুনের ক্ষিপ্রতা দেখে গোবিন্দ বললেন, আশ্চর্য! তার পর তিনি রথের শ্বেতবর্ণ চার অশ্ব চালিত করলেন। হংস যেমন সরোবরে যায় সেইরূপ অশ্বগুলি শত্রুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলে। সংগ্রামভূমি দেখতে দেখতে কৃষ্ণ বললেন, পার্থ, দুর্যোধনের জন্যই পৃথিবীর রাজাদের এই ভীষণ ক্ষয় হচ্ছে। দেখ, চতুর্দিকে স্বর্ণভূষিত ধনুর্বাণ তোমর প্রাস চর্ম প্রভৃতি বিকীর্ণ হয়ে রয়েছে, জয়াভিলাষী অস্ত্রধারী যোদ্ধারা প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তাদের জীবিতের ন্যায় দেখাচ্ছে। বীরগণের কুণ্ডলভূষিত চন্দ্রবদন এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত মখমুণ্ডলে যুদ্ধস্থল আবৃত হয়েছে, ভূমিতে শোণিতের কর্দম হয়েছে, চারিদিকে জীবিত মানুষ কাতর শব্দ করছে। আত্মীয়রা অস্ত্র ত্যাগ ক’রে সরোদনে জলসেক ক’রে আহতদের পরিচর্যা করছে। কেউ কেউ মৃত বীরগণকে আচ্ছাদিত ক’রে আবার যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, কেউ কেউ অচেতন প্রিয় বন্ধুকে আলিঙ্গন করছে। অর্জুন, তুমি এই মহাযুদ্ধে যে কর্ম করেছ তা তোমারই অথবা দেবরাজেরই যোগ্য।

৪। পাণ্ড্যরাজবধ—দুঃশাসনের পরাজয়

(ষোড়শ দিনের আরও যুদ্ধ)

 লোকবিশ্রুত বীরশ্রেষ্ঠ পাণ্ড্যরাজ পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। ইনি ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অর্জুন কৃষ্ণ প্রভৃতি মহারথগণকে নিজের সমকক্ষ মনে করতেন না, ভীষ্ম-দ্রোণের সঙ্গে নিজের তুলনাও সইতে পারতেন না। এই মহাধনবান সর্বাস্ত্রবিশারদ পাণ্ড্য পাশহস্ত কৃতান্তের ন্যায় কর্ণের সৈন্য বধ করছিলেন। অশ্বত্থামা তাঁর কাছে গিয়ে মিষ্টবাক্যে সহাস্যে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। দুজনে তুমুল যুদ্ধ হ’ল। আট গরুতে টানে এমন আটখানা গাড়িতে যত অস্ত্র ধরে, অশ্বত্থামা তা চার দণ্ডের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। দ্রোণপুত্রের সেই বাণবর্ষণ বায়ব্যাস্ত্রে অপসারিত ক’রে পাণ্ড্যরাজ আনন্দে গর্জন করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা পাণ্ড্যের রথ অশ্ব সারধি এবং সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট করলেন, কিন্তু শত্রুকে আয়ত্তিতে পেয়েও বধ করলেন না। এই সময়ে একটি চালকহীন সুসজ্জিত বলশালী হস্তী সবেগে পাণ্ড্যরাজের কাছে এসে পড়ল। সিংহ যেমন পর্বতশৃঙ্গে ওঠে, গজযুদ্ধপটু পাণ্ড্য সেইরূপ সেই মহাগজের পৃষ্ঠে চ’ড়ে বসলেন এবং সিংহনাদ ক’রে অশ্বত্থামার প্রতি একটি তোমর নিক্ষেপ করলেন। তোমরের আঘাতে অশ্বথামার মণিমুক্তাভূষিত কিরীট বিদীর্ণ হয়ে ভূপাতিত হ’ল। তখন অশ্বত্থামা পদাহত সর্পের ন্যায় ক্রুদ্ধ হয়ে শরাঘাতে হস্তীর পদ ও শুণ্ড এবং পাণ্ড্যরাজের বাহু ও মস্তক ছেদন করলেন, পাণ্ড্যের ছয় অনুচরকেও বধ করলেন।

 পাণ্ড্যরাজ নিহত হ’লে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আমি যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য পাণ্ডবদের দেখছি না, ওদিকে কর্ণ প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছেন, অশ্বত্থামাও সৃঞ্জয়গণকে বধ করছেন এবং আমাদের হস্তী অশ্ব রথ পদাতি মর্দন করছেন। অর্জুন বললেন, হৃষীকেশ, শীঘ্র রথ চালাও।

 কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধে মিলিত হলেন। প্রাচ্য দাক্ষিণাত্য অঙ্গ বঙ্গ পুণ্ড্র মগধ তাম্রলিপ্ত মেকল কোশল মদ্র দশার্ণ নিষধ ও কলিঙ্গ দেশের গজযুদ্ধবিশারদ যোদ্ধারা পাঞ্চালসৈন্যের উপর অস্ত্রবর্ষণ করতে লাগলেন। সাত্যকি নারাচের আঘাতে বঙ্গরাজকে হস্তী থেকে নিপাতিত করলেন। নকুল অর্ধচন্দ্র বাণে অঙ্গরাজপুত্রের মস্তক ছেদন করলেন। পাণ্ডবগণের বাণবর্ষণে বিপক্ষের বহু হস্তী নিহত হ’ল। সহদেবের শরাঘাতে দুঃশাসন জ্ঞানহীন হয়ে প’ড়ে গেলেন, তাঁর সারথি অত্যন্ত ভীত হয়ে রথ নিয়ে পালিয়ে গেল।

৫। কর্ণের হস্তে নকুলের পরাজয় —যুযুৎসু প্রভৃতির যুদ্ধ

(ষোড়শ দিনের আরও যুদ্ধ)

 নকুল কৌরবসেনা মথন করছেন দেখে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বাধা দিতে এলেন। নকুল সহাস্যে তাঁকে বললেন, বহুদিন পরে দেবতারা আমার উপর সদয় হয়েছেন, তুমি আমার সমক্ষে এসেছ। পাপী, তুমিই সমস্ত অনর্থ শত্রুতা ও কলহের মূল, আজ তোমাকে সমরে বধ ক’রে কৃতার্থ ও বিগতজ্বর হব। কর্ণ বললেন, ওহে বীর, আগে তোমার পৌরুষ দেখাও তার পর গর্ব ক’রো। বৎস, বীরগণ কিছু না ব’লেই যথাশক্তি যুদ্ধ করেন, তুমিও তাই কর, আমি তোমার দর্প চূর্ণ করব। তার পর নকুল ও কর্ণ পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। দুই পক্ষের সৈন্য শরাঘাতে নিপীড়িত হয়ে দূরে সরে গিয়ে দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। কর্ণের বাণে সমস্ত আকাশ মেঘাবৃতের ন্যায় ছায়াময় হ’ল। কর্ণ নকুলের চার অশ্ব, রথ পতাকা গদা খড়্‌গ চর্ম প্রভৃতি বিনষ্ট করলেন, নকুল রথ থেকে নেয়ে একটা পরিঘ নিয়ে দাঁড়ালেন। কর্ণের শরাঘাতে সেই পরিঘও নষ্ট হ’ল, তখন নকুল ব্যাকুল হয়ে পালাতে লাগলেন। কর্ণ বেগে পিছনে গিয়ে তাঁর জ্যা সমেত বৃহৎ ধনু নকুলের গলায় লাগিয়ে সহাস্যে বললেন, তুমি যে মিথ্যা বাক্য বলেছিলে, এখন বার বার আহত হবার পর আবার তা বল দেখি! বৎস, তুমি বলবান কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রো না, নিজের সমান যোদ্ধাদের সঙ্গেই যুদ্ধ ক’রো; আমার কাছে পরাজয়ের জন্য লজ্জিত হয়ো না। মাদ্রীপুত্র, এখন গৃহে যাও অথবা কৃষ্ণার্জুনের কাছে যাও। বীর ও ধর্মজ্ঞ কর্ণ নকুলকে বধ করতে পারতেন, কিন্তু কুন্তীর অনুরোধ স্মরণ ক’রে মুক্তি দিলেন। দুঃখসন্তপ্ত নকুল কলসে রুদ্ধ সর্পের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে তাঁর রথে উঠলেন। কর্ণ তখন পাঞ্চালসৈন্যদের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর পাঞ্চালসৈন্য বিধস্ত হ’ল, হতাবশিষ্ট পাঞ্চালবীরগণ বেগে পালাতে লাগলেন, কর্ণও তাঁদের পিছনে ধাবিত হলেন।

 বৈশ্যাগভর্জাত ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসু পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন[]। তিনি দুর্যোধনের বিশাল বাহিনী মথন করছেন দেখে শকুনিপুত্র উলূক তাঁকে আক্রমণ করলেন। যুযুৎসুর অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হ’ল, তিনি অন্য রথে উঠলেন। বিজয়ী উলূক তখন পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে বধ করতে গেলেন।

 দুর্যোধনভ্রাতা শ্রুতকর্মা নকুলপুত্র শতানীকের অশ্ব রথ ও সারথি বিনষ্ট করলেন, শতানীক ভগ্ন রথে থেকেই একটি গদা নিক্ষেপ করলেন, তার আঘাতে শ্রুতকর্মারও অশ্ব রথ সারথি বিনষ্ট হ’ল। তখন রথহীন দুই বীর পরস্পরকে দেখতে দেখতে রণভূমি থেকে চ’লে গেলেন।

 ভীমের পত্র সুতসোম শকুনির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। শকুনির শরাঘাতে সুতসোমের অশ্ব সারথি রথ ও ধনু প্রভৃতি নষ্ট হ’ল, সুতসোম তখন ভূমিতে নেমে যমদণ্ডতুল্য খড়্‌গ ঘোরাতে লাগলেন। তিনি চতুর্দশ প্রকার মণ্ডলাকারে বেগে বিচরণ ক’রে ভ্রান্ত উদ্‌ভ্রান্ত আবিদ্ধ আপ্লুত বিপ্লুত সূত সম্পাত সমুদীর্ণ প্রভৃতি গতি দেখালেন। শকুনি তীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্রের আঘাতে সুতসোমের খড়্‌গ দ্বিখণ্ড করলেন, সুতসোম তাঁর হস্তধৃত খড়্‌গাংশ নিক্ষেপ ক’রে শকুনির ধনু ছেদন করলেন। তার পর শকুনি অন্য ধনু নিয়ে পাণ্ডবসৈন্যের অভিমুখে ধাবিত হলেন।

 কৃপাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্নের যুদ্ধ হচ্ছিল। কৃপের শরাঘাতে আহত ও অবসন্ন হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমের কাছে চ’লে গেলেন, তখন কৃপ শিখণ্ডীকে আক্রমণ করলেন। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর শিখণ্ডী শরাঘাতে মূর্ছিত হলেন, তাঁর সারথি রণভূমি থেকে সত্বর রথ সরিয়ে নিয়ে গেল।

৬। পাণ্ডবগণের জয়

(ষোড়শ দিনের যুদ্ধান্ত)

 কৌরবসৈন্যের সঙ্গে ত্রিগর্ত শিবি শাল্ব সংশপ্তক ও নারায়ণ সৈন্যগণ, এবং ভ্রাতা ও পুত্রগণে বেষ্টিত হয়ে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা অর্জুনের অভিমুখে চললেন। পতঙ্গ যেমন অগ্নিতে দগ্ধ হয় সেইরূপ শতসহস্র যোদ্ধা অর্জুনের বাণে বিনষ্ট হলেন, তথাপি তাঁরা স’রে গেলেন না। রাজা শত্রুঞ্জয় এবং সুশর্মার ভ্রাতা সৌশ্রুতি নিহত হলেন। সুশর্মার আর এক ভ্রাতা সত্যসেন তোমরের আঘাতে কৃষ্ণের বাম বাহু বিদ্ধ করলেন, কৃষ্ণের হাত থেকে কশা ও রশ্মি প’ড়ে গেল। অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শানিত ভল্লের আঘাতে সত্যসেনের মস্তক ছেদন এবং শরাঘাতে তাঁর ভ্রাতা চিত্রসেনকে বধ করলেন। তার পর অর্জুন ইন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করলেন, তা থেকে বহু সহস্র বাণ নির্গত হয়ে শত্রুবাহিনী ধ্বংস করতে লাগল। কৌরবপক্ষীয় প্রায় সকল সৈন্য যুদ্ধে বিমুখ হয়ে পালিয়ে গেল।

 রণভূমির অন্য দিকে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন পরস্পরের প্রতি বাণবর্ষণ করছিলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের চার অশ্ব ও সারথি বধ ক’রে তাঁর রথধ্বজ ধনু ও খড়্‌গ ভূপাতিত করলেন। দুর্যোধন বিপন্ন হয়ে রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন, তখন কর্ণ অশ্বত্থামা কৃপ প্রভৃতি তাঁকে রক্ষা করতে এলেন, পাণ্ডবগণও যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তাঁকে বেষ্টন করলেন। দুই পক্ষে ভয়ংকর যুদ্ধ হ’তে লাগল, রণভূমিতে শতসহস্র কবন্ধ উত্থিত হ’ল। কর্ণ পাঞ্চালগণকে, ধনঞ্জয় ত্রিগর্তগণকে, এবং ভীমসেন কুরুসৈন্য ও সমস্ত হস্তিসৈন্য বধ করতে লাগলেন। দুর্যোধন পুনর্বার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন এবং দুজনে বৃষের ন্যায় গর্জন ক’রে পরস্পরকে শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করলেন। অবশেষে কলহের অন্ত করবার জন্য দুর্যোধন গদাহস্তে ধাবিত হলেন, যুধিষ্ঠির প্রজ্বলিত উল্কার ন্যায় দীপ্যমান একটি বৃহৎ শক্তি অস্ত্র দুর্যোধনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্রে দুর্যোধনের মর্মস্থান বিদ্ধ হ’ল, তিনি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে গেলেন। ভীম নিজের প্রতিজ্ঞা স্মরণ ক’রে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন আপনার বধ্য নয়। তখন যুধিষ্ঠির যুদ্ধে নিবৃত্ত হলেন।

 কর্ণের সঙ্গে সাত্যকির যুদ্ধ হচ্ছিল। সায়ংকালে কৃষ্ণার্জুন যথাবিধি আহ্ণিককৃত্য ও শিবপূজা ক’রে কৌরবসৈন্যের দিকে এলেন। তখন দুর্যোধন অশ্বত্থামা কৃতবর্মা কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে অর্জুন সাত্যকি ও অন্যান্য পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল। অর্জুনের বাণবর্ষণে কৌরবসৈন্য বিধ্বস্ত হ’ল। কিছুকাল পরে সূর্য অস্তাচলে গেলেন, অন্ধকার ও ধূলিতে সমস্তই দৃষ্টির অগোচর হ’ল। রাত্রিযুদ্ধের ভয়ে কৌরবযোদ্ধগণ তাঁদের সেনা অপসারিত করলেন, বিজয়ী পাণ্ডবগণ হৃষ্টমনে শিবিরে ফিরে গেলেন। তার পর রুদ্রের ক্রীড়াভূমিতুল্য সেই ঘোর রণস্থলে রাক্ষস পিশাচ ও শ্বাপদগণ দলে দলে আসতে লাগল।

৭। কর্ণ-দুর্যোধন-শল্য-সংবাদ

 শত্রুর হস্তে পরাজিত প্রহৃত ও বিধ্বস্ত হয়ে কৌরবগণ ভগ্নদন্ত হতবিষ পদাহত সর্পের ন্যায় শিবিরে ফিরে এসে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। কর্ণ হাতে হাত ঘ’ষে দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, অর্জুন দৃঢ় দক্ষ ও ধৈর্যশালী, আবার কৃষ্ণ তাকে কালোপযোগী মন্ত্রণা দিয়ে থাকেন। আজ সে অতর্কিতে অস্ত্রপ্রয়োগ ক’রে আমাদের বঞ্চিত করেছে, কিন্তু কাল আমি তার সকল সংকল্প নষ্ট করব।

 পরদিন প্রভাতকালে কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, আজ আমি হয় অর্জুনকে বধ করব নতুবা তার হাতেই নিহত হব। আমি আর অর্জুন এপর্যন্ত নানা দিকে ব্যাপৃত ছিলাম, সেজন্য আমাদের যুদ্ধে মিলনই হয় নি। আমাদের পক্ষের প্রধান বীরগণ হত হয়েছেন, ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্রও আর আমার নেই; তথাপি অস্ত্রবিদ্যায় শৌর্যে ও জ্ঞানে সব্যসাচী আমার সমকক্ষ নয়। যে ধনুর দ্বারা ইন্দ্র দৈত্যগণকে জয় করেছিলেন, ইন্দ্র যে ধনু পরশুরামকে দিয়েছিলেন, যার দ্বারা পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী জয় করেছিলেন, যা পরশুরাম আমাকে দান করেছেন, বিজয়-নামক সেই ভয়ংকর দিব্য ধনু গাণ্ডীব ধনু অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। সেই ধনুর দ্বারা আমি যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করব। কিন্তু যে যে বিষয়ে আমি অর্জুনের তুলনায় হীন তাও আমার অবশ্য বলা উচিত। অর্জুনের ধনুতে দিব্য জ্যা আছে, তার দুই অক্ষয় তূণীর আছে, আবার গোবিন্দ তার সারথি ও রক্ষক। তার অগ্নিদত্ত দিব্য অচ্ছেদ্য রথ আছে, তার অশ্বসকল মনের ন্যায় দ্রুতগামী, এবং রথধ্বজের উপর যে বানর আছে তাও ভয়ংকর। এইসকল বিষয়ে আমি অর্জুন অপেক্ষা হীন, তথাপি তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি। শল্য কৃষ্ণের সমান, তিনি যদি আমার সারথি হন তবে নিশ্চয় তোমার বিজয়লাভ হবে। আরও, বহু শকট আমার বাণ ও নারাচ বহন করে চলুক, উত্তম অশ্বযুক্ত বহু রথ আমার পশ্চাতে থাকুক। শল্যের সমান অশ্বতত্ত্বজ্ঞ কেউ নেই, তিনি আমার সারথি হ’লে ইন্দ্রাদি দেবগণও আমার সম্মুখীন হ’তে পারবেন না।

 দদূর্যোধন বললেন, কর্ণ, তুমি যা চাও তা সমস্তই হবে। তার পর দুর্যোধন শল্যের কাছে গিয়ে সবিনয়ে বললেন, মদ্ররাজ, কর্ণ আপনাকে সারথি রূপে বরণ করতে চান। আমি মস্তক অবনত ক’রে প্রার্থনা করছি, ব্রহ্মা যেমন সারথি হয়ে মহাদেবকে রক্ষা করেছিলেন, কৃষ্ণ যেমন সর্ব বিপদ থেকে অর্জুনকে রক্ষা করছেন, আপনিও সেইরূপ কর্ণকে রক্ষা করুন। পাণ্ডবরা ছল ক’রে মহাধনুর্ধর বৃদ্ধ ভীষ্ম ও দ্রোণকে হত্যা করেছে, আমাদের বহু যোদ্ধা যথাশক্তি যুদ্ধ ক’রে স্বর্গে গেছেন। পাণ্ডবরা বলবান স্থিরচিত্ত ও যথার্থবিক্রমশালী, আমাদের অবশিষ্ট সৈন্য যাতে তারা নষ্ট না করে আপনি তা করুন। আমাদের সেনার প্রধান বীরগণ নিহত হয়েছেন, কেবল আমার হিতৈষী মহাবল কর্ণ আছেন এবং সর্বলোকমহারথ আপনি আছেন। মহারাজ শল্য, জয়লাভ সম্বন্ধে কর্ণের উপর আমার বিপুল আশা আছে, কিন্তু আপনি ভিন্ন আর কেউ তাঁর সারথি হ’তে পারেন না। অতএব, কৃষ্ণ যেমন অর্জুনের, আপনি সেইরূপ কর্ণের সারথি হ’ন। অরুণের সঙ্গে সূর্য যেমন অন্ধকার বিনষ্ট করেন সেইরূপ আপনি কর্ণের সহিত মিলিত হয়ে অর্জুনকে বিনষ্ট করুন।

 কুল ঐশ্বর্য শাস্ত্রজ্ঞান ও বলের জন্য শল্যের গর্ব ছিল। তিনি দুর্যোধনের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে ভ্রুকুটি ক’রে হাত নেড়ে বললেন, মহারাজ, এমন কর্মে তুমি আমাকে নিযুক্ত করতে পার না, উচ্চ জাতি নীচ জাতির দাসত্ব করে না। আমি উচ্চবংশীয়, মিত্ররূপে তোমার কাছে এসেছি; তুমি যদি আমাকে কর্ণের বশবর্তী কর তবে নীচকে উচ্চ করা হবে। ক্ষত্রিয় কখনও সূতজাতির আজ্ঞাবহ হ’তে পারে না; আমি রাজর্ষিকুলজাত, মূর্ধাভিষিক্ত[], মহারথ ব’লে খ্যাত, বন্দিগণ আমার স্তুতি করে। আমি সূতপত্রের সারথ্য করতে পারি না। দুর্যোধন, তুমি আমার অপমান করছ, কর্ণকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করছ। কর্ণ আমার ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। আমি সামান্য লোক নই, তোমার পক্ষে যোগ দিতে আমি স্বয়ং আসি নি, অপমানিত হয়ে আমি যুদ্ধ করতে পারি না। গান্ধারীর পুত্র, অনুমতি দাও আমি গৃহে ফিরে যাই। এই কথা ব’লে শল্য রাজাদের মধ্য থেকে উঠে গমনে উদ্যত হলেন।

 তখন দুর্যোধন সসম্মানে শল্যকে ধ’রে সবিনয়ে মিষ্টবাক্যে বললেন, মদ্রেশ্বর শল্য, আপনি যা বললেন তা যথার্থ, কিন্তু আমার অভিপ্রায় শুনুন। কর্ণ বা অন্য কোনও রাজা আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন, কৃষ্ণও আপনার বিক্রম সইতে পারবেন না। আপনি যুদ্ধে শত্রুদের শল্যস্বরূপ, সেজন্যই আপনার নাম শল্য। রাধেয় কর্ণ বা আমি আপনার অপেক্ষা বীর্যবান নই, তথাপি আপনাকে যুদ্ধে সারথি রূপে বরণ করছি; কারণ, আমি কর্ণকে অর্জুন অপেক্ষা অধিক মনে করি এবং লোকে আপনাকে বাসুদেব অপেক্ষা অধিক মনে করে। কৃষ্ণ যেরূপ অশ্বহৃদয় জানেন, আপনি তার দ্বিগুণ জানেন।

 শল্য বললেন, বীর দুর্যোধন, তুমি এই সৈন্যমধ্যে আমাকে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলছ সেজন্য আমি প্রীত হয়েছি। যশস্বী কর্ণ যখন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তখন আমি তাঁর সারথ্য করব, কিন্তু এই নিয়ম থাকবে যে আমি তাঁকে যা ইচ্ছা হয় তাই বলব[]

 দুর্যোধন ও কর্ণ শল্যের কথা মেনে নিয়ে বললেন, তাই হবে।

৮। ত্রিপুরসংহার ও পরশুরামের কথা

 দুর্যোধন বললেন, মদ্ররাজ, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় আমার পিতাকে দেবাসুরযুদ্ধের যে ইতিহাস বলেছিলেন তা শুনুন। দৈত্যগণ দেবগণের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হ’লে তারকাসুরের তিন পুত্র তারাক্ষ কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী কঠোর তপস্যা ক’রে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে। ব্রহ্মা বর দিতে এলে তিন ভ্রাতা এই বর চাইলে, তারা যেন সর্বভূতের অবধ্য হয়। ব্রহ্মা বললেন, সকলেই অমরত্ব পেতে পারে না, তোমরা অন্য বর চাও। তখন তারকের পুত্রেরা বহু বার মন্ত্রণা ক’রে বললে, প্রপিতামহ, আমরা তিনটি কামগামী নগরে বাস করতে ইচ্ছা করি যেখানে সর্বপ্রকার অভীষ্ট বস্তু থাকবে, দের দানব যক্ষ রাক্ষস প্রভৃতি যা বিনষ্ট করতে পারবে না, এবং আভিচারিক ক্রিয়া, অস্ত্রশস্ত্র বা ব্রহ্মশাপেও যার হানি হবে না। আমরা এই তিন পুরে অবস্থান ক’রে জগতে বিচরণ করব। সহস্র বৎসর পরে আমরা তিন জনে মিলিত হব, তখন আমাদের ত্রিপুর এক হয়ে যাবে। ভগবান, সেই সময়ে যে দেবশ্রেষ্ঠ সম্মিলিত ত্রিপুরকে এক বাণে ভেদ করতে পারবেন তিনিই আমাদের মৃত্যুর কারণ হবেন। ব্রহ্মা ‘তাই হবে’ ব’লে প্রস্থান করলেন।

 তারকপুত্রগণ ময় দানবকে ত্রিপুরনির্মাণের ভার দিলে। ময় দানব তপস্যার প্রভাবে একটি স্বর্ণের, একটি রৌপ্যের এবং একটি কৃষ্ণলৌহের পুর নির্মাণ করলেন। প্রথম পুরটি স্বর্গে, দ্বিতীয়টি অন্তরীক্ষে এবং তৃতীয়টি পৃথিবীতে থাকত। এই পুরত্রয়ের প্রত্যেকটি চক্রযুক্ত; দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে শত যোজন, এবং বৃহৎ প্রাকার তোরণ প্রাসাদ মহাপথ প্রভৃতি সমন্বিত। তারকাক্ষ স্বর্ণময় পুরে, কমলাক্ষ রৌপ্যময় পুরে, এবং বিদ্যুন্মালী লৌহময় পুরে বাস করতে লাগল। দেবগণ কর্তৃক বিতাড়িত কোটি কোটি দৈত্য এসে সেই ত্রিপুরদুর্গে আশ্রয় নিলে। ময় দানব তাদের সকল মনস্কাম মায়াবলে সিদ্ধ করলেন। তারকাক্ষের হরি নামে এক পুত্র ছিল, সে ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে প্রত্যেক পুরে মৃতসঞ্জীবনী পুষ্করিণী নির্মাণ করলে। মৃত দৈত্যগণকে সেইসকল পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করলে তারা পূর্বের রূপে ও বেশে জীবিত হয়ে উঠত।

 সেই দর্পিত তিন দৈত্য ইচ্ছানুসারে বিচরণ ক’রে দেবগণ ঋষিগণ পিতৃগণ এবং ত্রিলোকের সকলের উপর উৎপীড়ন করতে লাগল। ইন্দ্র ত্রিপুরের সকল দিকে বজ্রাঘাত করলেন কিন্তু ভেদ করতে পারলেন না। তখন দেবগণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা বললেন, এই ত্রিপুর কেবল একটি বাণে ভেদ করা যায়, কিন্তু ঈশান ভিন্ন আর কেউ তা পারবেন না, অতএব তোমরা তাঁকে যোদ্ধা রূপে বরণ কর। দেবতারা বৃষভধ্বজ মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁকে স্তবে তুষ্ট করলেন। মহেশ্বর অভয় দিলে ব্রহ্মা তাঁর প্রদত্ত বরের কথা জানিয়ে বললেন, শূলপাণি, আপনি শরণাপন্ন দেবগণের উপর প্রসন্ন হয়ে দানবগণকে বধ করুন। মহাদেব বললেন, দানবরা প্রবল, আমি একাকী তাদের বধ করতে পারব না; তোমরা সকলে মিলিত হয়ে আমার অর্ধ তেজ নিয়ে তাদের জয় কর। দেবগণ বললেন, আমাদের যত তেজোবল, দানবদেরও তত, অথবা আমাদের দ্বিগুণ। মহাদেব বললেন, সেই পাপীরা তোমাদের কাছে অপরাধী সেজন্য সর্বপ্রকারে বধ্য; তোমরা আমার তেজোবলের অর্ধেক নিয়ে শত্রুদের বধ কর। দেবগণ বললেন, মহেশ্বর, আমরা আপনার তেজের অর্ধ ধারণ করতে পারব না, অতএব আপনিই আমাদের সকলের অর্ধ তেজ নিয়ে শত্রু বধ করুন।

 শংকর সম্মত হয়ে দেবগণের অর্ধ তেজ নিলেন। তার ফলে তাঁর বল সকলের অপেক্ষা অধিক হ’ল এবং তিনি মহাদেব নামে খ্যাত হলেন। তখন দেবতাদের নির্দেশ অনুসারে বিশ্বকর্মা মহাদেবের রথ নির্মাণ করলেন। পৃথিবী দেবী, মন্দর পর্বত, দিগ্‌বিদিক, নক্ষত্র ও গ্রহগণ, নাগরাজ বাসুকি, হিমালয় পর্বত, বিন্ধ্য গিরি, সপ্তর্ষিমণ্ডল, গঙ্গা সরস্বতী ও সিন্ধু নদী, শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষ, রাত্রি ও দিন, প্রভৃতি দিয়ে রথের বিভিন্ন অংশ নির্মিত হ’ল। চন্দ্রসূর্য চক্র হলেন এবং ইন্দ্র বরুণ যম ও কুবের এই চার লোকপাল অশ্ব হলেন। কনকপর্বত সুমেরু রথের ধ্বজদণ্ড এবং তড়িদ্‌ভূষিত মেঘ পতাকা হ’ল। মহাদেব সংবৎসরকে ধনু এবং কালরাত্রিকে জ্যা করলেন। বিষ্ণু অগ্নি ও চন্দ্র মহাদেবের বাণ হলেন।

 খড়্‌গ বাণ ও শরাসন হাতে নিয়ে মহাদেব সহাস্যে দেবগণকে বললেন, সারথি কে হবেন? আমার চেয়ে যিনি শ্রেষ্ঠতর তাঁকেই তোমরা সারথি কর। তখন দেবতারা ব্রহ্মাকে বললেন, প্রভু, আপনি ভিন্ন আমরা সারথি দেখছি না, আপনি সর্বগুণযুক্ত এবং দেবগণের শ্রেষ্ঠ, অতএব আপনিই মহাদেবের অশ্বচালনা করুন। লোকপূজিত ব্রহ্মা সম্মত হয়ে রথে উঠলেন, অশ্বসকল মস্তক নত ক’রে ভূমি স্পর্শ করলে। ব্রহ্মা অশ্বদের উঠিয়ে মহাদেবকে বললেন, আরোহণ করুন। মহাদেব রথে উঠে ইন্দ্রাদি দেবগণকে বললেন, তোমরা এমন কথা বলবে না যে দানবদের বধ করুন, কোনও প্রকার দুঃখও করবে না। তার পর তিনি সহাস্যে ব্রহ্মাকে বললেন, যেখানে দৈত্যরা আছে সেদিকে সাবধানে অশ্বচালনা করুন।

 ব্রহ্মা ত্রিপুরের অভিমুখে রথ নিয়ে চললেন। মহাদেবের ধ্বজাগ্রে স্থিত বৃষভ ভয়ংকর গর্জন ক’রে উঠল, সকল প্রাণী ভীত হ’ল, ত্রিভুবন কাঁপতে লাগল, বিবিধ ঘোর দুর্লক্ষণ দেখা গেল। সেই সময়ে বাণস্থিত বিষ্ণু অগ্নি ও চন্দ্র এবং রথারূঢ় ব্রহ্মা ও রুদ্রের ভারে এবং ধনুর বিক্ষোভে রথ ভূমিতে ব’সে গেল। নারায়ণ বাণ থেকে নির্গত হয়ে বৃষের রূপ ধারণ করে সেই মহারথ ভূমি থেকে তুললেন। তখন ভগবান রুদ্র বৃষরূপী নারায়ণের পৃষ্ঠে এক চরণ এবং অশ্বের পৃষ্ঠে অন্য চরণ রেখে দানবপুর নিরীক্ষণ করলেন, এবং অশ্বের স্তন ছেদন ও বৃষের খুর দ্বিধা বিভক্ত করলেন! সেই অবধি অশ্বজাতির স্তন লুপ্ত হ’ল এবং গোজাতির খুর বিভক্ত হ’ল। মহাদেব তাঁর ধনুতে জ্যারোপন এবং পাশুপত অস্ত্র যোগ ক’রে অপেক্ষা করছিলেন এমন সময়ে দানবদের তিন পুর একত্র মিলিত হ’ল। দেবগণ সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ জয়ধ্বনি ক’রে উঠলেন, মহাদেব তাঁর দিব্য ধনু আকর্ষণ ক’রে ত্রিপুর লক্ষ্য ক’রে বাণ মোচন করলেন। তুমুল আর্তনাদ উঠল, ত্রিপুর আকাশ থেকে পড়তে লাগল এবং দানবগণের সহিত দগ্ধ হয়ে পশ্চিম সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হ’ল। মহেশ্বর তখন হা হা শব্দে তাঁর ক্রোধজনিত অগ্নিকে নির্বাপিত ক’রে বললেন, ত্রিলোক ভস্ম ক’রো না।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে দুর্যোধন শল্যকে বললেন, লোকস্রষ্টা পিতামহ ব্রহ্মা যেমন রুদ্রের সারথ্য করেছিলেন সেইরূপ আপনিও কর্ণের সারথ্য করুন। কর্ণ রুদ্রের তুল্য এবং আপনি ব্রহ্মার সমান। আপনার উপরেই কর্ণ ও আমরা নির্ভর করছি, আমাদের রাজ্য ও বিজয়লাভও আপনার অধীন। আর একটি ইতিহাস বলছি শুনুন, যা কোনও ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ আমার পিতাকে বলেছিলেন।—

 ভৃগুর বংশে জমদগ্নি নামে এক মহাতপা ঋষি জন্মেছিলেন, তাঁর একটি তেজস্বী গুণবান পুত্র ছিল যিনি রাম (পরশুরাম) নামে বিখ্যাত। এই পুত্রের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব বললেন, রাম, তুমি কি চাও তা আমি জানি। অপাত্র ও অসমর্থকে আমার অস্ত্রসকল দগ্ধ করে; তুমি যখন পবিত্র হবে তখন তোমাকে অস্ত্রদান করব। তার পর ভার্গব পরশরাম বহু বৎসর তপস্যা ইন্দ্রিয়দমন নিয়মপালন পূজা হোম প্রভৃতির দ্বারা মহাদেবের আরাধনা করলেন। মহাদেব বললেন, ভার্গব, তুমি জগতের হিত এবং আমার প্রীতির নিমিত্ত দেবগণের শত্রুদের বধ কর। পরশুরাম বললেন, দেবেশ, আমার কি শক্তি আছে? আমি অস্ত্রশিক্ষাহীন, আর দানবগণ সর্বাস্ত্রবিশারদ ও দুর্ধর্ষ। মহাদেব বললেন, তুমি আমার আজ্ঞায় যাও, সকল শত্রু জয় ক’রে তুমি সর্বগুণান্বিত হবে। পরশুরাম দৈত্যগণকে যুদ্ধে আহ্বান ক’রে বজ্রতুল্য অস্ত্রের প্রহারে তাদের বধ করলেন। যুদ্ধকালে পরশুরামের দেহে যে ক্ষত হয়েছিল মহাদেবের করস্পর্শে তা দূর হ’ল। মহাদেব তুষ্ট হয়ে বললেন, ভৃগুনন্দন, দানবদের অস্ত্রাঘাতে তোমার শরীরে যে পীড়া হয়েছিল তাতে তোমার মানব কর্ম শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমার কাছ থেকে অভীষ্ট দিব্য অস্ত্রসমূহ নাও।

 তার পর মহাতপা পরশুরাম অভীষ্ট দিব্যাস্ত্র ও বর লাভ ক’রে মহাদেবের অনুমতি নিয়ে প্রস্থান করলেন। মহারাজ শল্য, পরশুরাম প্রীত হয়ে মহাত্মা কর্ণকে সমগ্র ধনুর্বেদ দান করেছিলেন। কর্ণের যদি পাপ থাকত তবে পরশুরাম তাঁকে দিব্যাস্ত্র দিতেন না। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না যে কর্ণ সূতকুলে জন্মেছেন; আমি মনে করি তিনি ক্ষত্রিয়কুলে উৎপন্ন দেবপুত্র, পরিচয়গোপনের নিমিত্ত পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। সূতনারী কি ক’রে কবচকুণ্ডলধারী দীর্ঘবাহু সূর্যতুল্য মহারথের জননী হ’তে পারে? মৃগী কি ব্যাঘ্র প্রসব করে?

৯। কর্ণ-শল্যের যুদ্ধযাত্রা

 শল্য বললেন, ব্রহ্মা ও মহাদেবের এই দিব্য আখ্যান আমি বহুবার শুনেছি, কৃষ্ণও তা জানেন। কর্ণ যদি কোনও প্রকারে অর্জুনকে বধ করতে পারেন তবে শঙ্খচক্রগদাধারী কেশব নিজেই যুদ্ধ ক’রে তোমার সৈন্য ধ্বংস করবেন। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হ’লে কোনও রাজা তাঁর বিপক্ষে দাঁড়াতে পারবেন না।

 দুর্যোধন বললেন, মহাবাহু শল্য, আপনি কর্ণকে অবজ্ঞা করবেন না, ইনি অস্ত্রবিশারদগণের শ্রেষ্ঠ, এঁর ভয়ংকর জ্যানির্ঘোষ শুনে পাণ্ডবসৈন্য দশ দিকে পালায়। ঘটোৎকচ যখন রাত্রিকালে মায়াযুদ্ধ করছিল তখন কর্ণ তাকে বধ করেছিলেন। সেদিন অর্জুন ভয়ে কর্ণের সম্মুখীন হয় নি। কর্ণ ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে ভীমসেনকে আকর্ষণ করে বলেছিলেন, মূঢ় ঔদরিক। ইনি দুই মাদ্রীপপুত্রকে জয় ক’রেও কোনও কারণে তাদের বধ করেন নি। ইনি বৃষ্ণিবংশীয় বীরশ্রেষ্ঠ সাত্যকিকে রথহীন করেছেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতিকে বহুবার পরাজিত করেছেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ হ’লে বজ্রপাণি ইন্দ্রকেও বধ করতে পারেন, পাণ্ডবরা কি করে তাঁকে জয় করবে? বীর শল্য, বাহুবলে আপনার সমান কেউ নেই। অর্জুন নিহত হ’লে যদি কৃষ্ণ পাণ্ডবসৈন্য রক্ষা করতে পারেন তবে কর্ণের মৃত্যু হ’লে আপনিই আমাদের সৈন্য রক্ষা করবেন।

 শল্য বললেন, গান্ধারীপুত্র, তুমি সৈন্যগণের সম্মুখে আমাকে কৃষ্ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলেছ, এতে আমি প্রীত হয়েছি, আমি কর্ণের সারথি হব। কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, মদ্ররাজ বিশেষ হৃষ্টচিত্তে এ কথা বলছেন না, তুমি মধুরবাক্যে ওঁকে আরও কিছু বল। দুর্যোধন মেঘগম্ভীরস্বরে শল্যকে বললেন, পুরুষব্যাঘ্র, কর্ণ আজ যুদ্ধে আর সকলকে বিনষ্ট করে অর্জুনকে বধ করতে ইচ্ছা করেন; আমি বার বার প্রার্থনা করছি, আপনি তাঁর অশ্বচালনা করুন। কৃষ্ণ যেমন পার্থের সচিব ও সারথি, আপনিও সেইরূপ সর্বপ্রকারে কর্ণকে রক্ষা করুন। শল্য তুষ্ট হয়ে দুর্যোধনকে আলিঙ্গন ক’রে বললেন, রাজা, তোমার যা কিছু প্রিয়কার্য সে সমস্তই আমি করব। কিন্তু তোমাদের হিতকামনায় আমি কর্ণকে প্রিয় বা অপ্রিয় যে কথা বলব তা কর্ণকে আর তোমাকে সইতে হবে। কর্ণ বললেন, মদ্ররাজ, ব্রহ্মা যেমন মহাদেবের, কৃষ্ণ যেমন অর্জুনের, সেইরূপ আপনি সর্বদা আমাদের হিতে রত থাকুন।

 শল্য কর্ণকে বললেন, আত্মনিন্দা আত্মপ্রশংসা পরনিন্দা ও পরস্তুতি—এই চতুর্বিধ কার্য সজ্জনের অকর্তব্য, তথাপি তোমার প্রত্যয়ের জন্য আমি নিজের প্রশংসাবাক্য বলছি। অশ্বচালনায়, অশ্বতত্ত্বের জ্ঞানে এবং অশ্বচিকিৎসায় আমি মাতলির ন্যায় ইন্দ্রের সারথি হবার যোগ্য। সূতপুত্র, তুমি উদ্‌বিগ্ন হয়ো না, অর্জুনের সহিত যুদ্ধের সময় আমি তোমার রথ চালাব।

 পরদিন প্রভাতকালে রথ প্রস্তুত হ’লে শল্য ও কর্ণ তাতে আরোহণ করলেন। দুর্যোধন বললেন, অধিরথপুত্র মহাবীর কর্ণ, ভীষ্ম ও দ্রোণ যে দুষ্কর কর্ম করতে পারেন নি তুমি তা সম্পন্ন কর। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বন্দী কর, অথবা অর্জুন ভীম নকুল ও সহদেবকে বধ কর এবং সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য ভস্মসাৎ কর। তখন সহস্র সহস্র তূরী ও ভেরী মেঘগর্জনের ন্যায় বেজে উঠল। কর্ণ শল্যকে বললেন, মহাবাহু, আপনি অশ্বচালনা করুন, আজ আমি ধনঞ্জয়, ভীমসেন, দুই মাদ্রীপুত্র ও রাজা যুধিষ্ঠিরকে বধ করব। আজ অর্জুন আমার বাহুবল দেখবে, পাণ্ডবদের বিনাশ এবং দুর্যোধনের জয়ের নিমিত্ত আজ আমি শত শত অতি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করব।

 শল্য বললেন, সূতপত্র, পাণ্ডবরা মহাধনুর্ধর, তুমি তাঁদের অবজ্ঞা করছ কেন? যখন তুমি বজ্রনাদতুল্য গাণ্ডীবের নির্ঘোষ শুনবে তখন আর এমন কথা বলবে না। যখন দেখবে যে পাণ্ডবগণ বাণবর্ষণ ক’রে আকাশ মেঘাচ্ছন্নের ন্যায় ছায়াময় করছেন, ক্ষিপ্রহস্তে শত্রুসৈন্য বিদীর্ণ করছেন, তখন আর এমন কথা বলবে না। শল্যের কথা অগ্রাহ্য ক’রে কর্ণ বললেন, চলুন।

১০। কর্ণ-শল্যের কলহ

 কর্ণ যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন দেখে কৌরবগণ হৃষ্ট হলেন। সেই সময়ে ভূমিকম্প, উল্কাপাত, বিনা মেঘে বজ্রপাত, কর্ণের অশ্বসকলের পদস্খলন, আকাশ হতে অস্থিবর্ষণ প্রভৃতি নানা দুর্নিমিত্ত দেখা গেল, কিন্তু দৈববশে মোহগ্রস্ত কৌরবগণ সে সকল গ্রাহ্য করলেন না, কর্ণের উদ্দেশে জয়ধ্বনি করতে লাগলেন।

 অভিমানে দর্পে ও ক্রোধে যেন জ্ব’লে উঠে কর্ণ শল্যকে বললেন, আমি যখন ধনু হাতে নিয়ে রথে থাকি তখন বজ্রপাণি ক্রুদ্ধ ইন্দ্রকেও ভয় করি না, ভীষ্মপ্রমুখ বীরগণের পতন দেখেও আমার স্থৈর্য নষ্ট হয় না। আমি জানি যে কর্ম অনিত্য, সেজন্য ইহলোকে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আচার্য দ্রোণের নিধনের পর কোন্ লোক নিঃসংশয়ে বলতে পারে যে কাল সূর্যোদয়ের সময় সে বেঁচে থাকবে? মদ্ররাজ, আপনি সত্বর পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণের দিকে রথ নিয়ে চলুন, আমি তাদের যুদ্ধে বধ করব অথবা দ্রোণের ন্যায় যমলোকে যাব। পরশুরাম আমাকে এই ব্যাঘ্রচর্মাবৃত উত্তম রথ দিয়েছেন। এর চক্রে শব্দ হয় না, এতে তিনটি স্বর্ণময় কোষ এবং তিনটি রজতময় দণ্ড অছে, চারটি উত্তম অশ্ব এর বাহন। বিচিত্র ধনু, ধ্বজ, গদা, ভয়ংকর শর, উজ্জ্বল অসি ও অন্যান্য অস্ত্র এবং ঘোর শব্দকারী শুভ্র শঙ্খও তিনি আমাকে দিয়েছেন। এই রথে আরূঢ় থেকে আজ আমি অর্জুনকে মারব, কিংবা সর্বহর মৃত্যু যদি তাকে ছেড়ে দেন তবে আমিই ভীষ্মের পথে যমলোকে যাব।

 শল্য বললেন, কর্ণ, থাম থাম, আর আত্মপ্রশংসা ক’রো না, তুমি অতিরিক্ত ও অযোগ্য কথা বলছ। কোথায় পুরুষশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয়, আর কোথায় পুরুষাধম তুমি! অর্জুন ভিন্ন আর কে ইন্দ্রপুরীর তুল্য দ্বারকা থেকে কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করতে পারেন? কোন্ পুরুষ কিরাতবেশী মহাদেবকে যুদ্ধে আহ্বান করতে পারেন? তোমার মনে পড়ে কি, ঘোষযাত্রার সময় যখন গন্ধর্বরা দুর্যোধনকে ধ’রে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অর্জুনই তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন? সেই যুদ্ধে প্রথমেই তুমি পালিয়েছিলে এবং পাণ্ডবগণই কলহপ্রিয় ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তোমরা যখন সসৈন্যে ভীষ্ম দ্রোণ ও অশ্বত্থামার সঙ্গে বিরাটের গরু চুরি করতে গিয়েছিলে তখন অর্জুনই তোমাদের জয় করেছিলেন, তুমি তাঁকে জয় কর নি কেন? সূতপত্র, ঘোর যুদ্ধ আসন্ন হয়েছে, যদি পালিয়ে না যাও তবে আজ তুমি মরবে।

 কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শল্যকে বললেন, হয়েছে হয়েছে, অর্জুনের এত প্রশংসা করছেন কেন? সে যদি যুদ্ধে আজ আমাকে জয় করতে পারে তবেই আপনার প্রশংসা সার্থক হবে। ‘তাই হবে’ ব’লে শল্য আর উত্তর দিলেন না, কর্ণের ইচ্ছানুসারে রথচালনা করলেন। পাণ্ডবসৈন্যের নিকটে এসে কর্ণ বললেন, অর্জুন কোথায়? অর্জুনকে যে দেখিয়ে দেবে আমি তার অভীষ্ট পূরণ করব, তাকে একটি রত্নপূর্ণ শকট দেব, অথবা এক শত দুগ্ধবতী গাভী ও কাংস্যের দোহনপাত্র দেব, অথবা এক শত গ্রাম দেব। সে যদি চায় তবে সালংকারা গীতবাদ্যনিপুণা এক শত সুন্দরী যুবতী বা হস্তী রথ অশ্ব বা ভারবাহী বৃষ অথবা অন্য যে বস্তু তার কাম্য তা দেব।

 কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন ও তাঁর অনুচরগণ হৃষ্ট হলেন। শল্য হাস্য ক’রে বললেন, সূতপত্র, তোমাকে হস্তী বা সুবর্ণ বা গাভী কিছুই দিতে হবে না, তুমি পুরস্কার না দিয়েই ধনঞ্জয়কে দেখতে পাবে। পূর্বে মূর্খের ন্যায় বিস্তর ধন তুমি অপাত্রে দান করেছ, তাতে বহুবিধ যজ্ঞ করতে পারতে। তুমি বৃথা কৃষ্ণার্জুনকে বধ করতে চাচ্ছ, একটা শৃগাল দুই সিংহকে বধ করেছে এ আমরা শুনি নি। গলায় পাথর বেধে সমুদ্রে সাঁতার অথবা পর্বতের উপর থেকে পড়বার ইচ্ছা যেমন, তোমার ইচ্ছাও তেমন। যদি মঙ্গল চাও তবে সমস্ত যোদ্ধা এবং ব্যূহবদ্ধ সৈন্যে সুরক্ষিত হয়ে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যেয়ো। যদি বাঁচতে চাও তবে আমার কথায় বিশ্বাস কর।

 কর্ণ বললেন, আমি নিজের বাহুবলে নির্ভর করে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি। আপনি মিত্ররূপী শত্রু, তাই আমাকে ভয় দেখাতে চান। শল্য বললেন, অর্জুনের হস্তনিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ বাণসমূহ যখন তোমাকে বিদ্ধ করবে তখন তোমার অনুতাপ হবে। মাতার ক্রোড়ে শুয়ে বালক যেমন চন্দ্রকে হরণ করতে চায়, সেইরূপ তুমি মোহগ্রস্ত হয়ে অর্জুনকে জয় করতে চাচ্ছ। তুমি ভেক হয়ে মহামেঘ স্বরূপ অর্জুনের উদ্দেশে গর্জন করছ। গৃহবাসী কুক্কুর যেমন বনস্থিত ব্যাঘ্রকে লক্ষ্য করে ডাকে তুমি সেইরূপ নরব্যাঘ্র ধনঞ্জয়কে ডাকছ। মূঢ়, তুমি সর্বদাই শগাল, অর্জুন সর্বদাই সিংহ।

 কর্ণ স্থির করলেন, বাক্‌শল্যের জন্যই এঁর নাম শল্য। তিনি বললেন, শল্য, আপনি সর্বগুণহীন, অতএব গুণাগুণ বুঝবেন কি করে? কৃষ্ণের মাহাত্ম্য আমি যেমন জানি আপনি তেমন জানেন না; আমি নিজের ও অর্জুনের শক্তি জেনেই তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। আমার এই চন্দনচূর্ণে পূজিত সর্পতুল্য বিষমুখ ভয়ংকর বাণ বহু বৎসর ধরে তূণের মধ্যে পড়ে আছে, এই বাণ নিয়েই আমি কৃষ্ণার্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। পিতৃষ্বসার পুত্র এবং মাতুলের পুত্র এই দুই ভ্রাতা (অর্জুন ও কৃষ্ণ) এক সূত্রে গ্রথিত দুই মণির তুল্য। আপনি দেখবেন দুজনেই আমার বাণে নিহত হবেন। কুদেশজাত শল্য, আজ কৃষ্ণার্জুনকে বধ ক’রে আপনাকেও সবান্ধবে বধ করব। দুর্বুদ্ধি ক্ষত্রিয়কুলাঙ্গার, আপনি সুহৃৎ হয়ে শত্রুর ন্যায় আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আপনি চুপ করে থাকুন, সহস্র বাসুদেব বা শত অর্জুন এলেও আমি তাঁদের বধ করব। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই যে গাথা গান করে এবং পূর্বে ব্রাহ্মণগণ রাজার নিকট যা বলেছিলেন, দুরাত্মা মদ্রদেশবাসীদের সেই গাথা শুনুন। — মদ্রকগণ তুচ্ছভাষী নরাধম মিথ্যাবাদী কুটিল এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত দুষ্টস্বভাব। তারা পিতা পুত্র মাতা শ্বশুর শাশুড়ী মাতুল জামাতা কন্যা পৌত্র বান্ধব বয়স্য অভ্যাগত দাস দাসী প্রভৃতি স্ত্রীপরুষ মিলিত হয়ে শক্তু (ছাতু) ও মৎস্য খায়, গোমাংসের সহিত মদ্যপান করে, হাসে, কাঁদে, অসম্বন্ধ গান গায় এবং কামব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়। মদ্রকের সঙ্গে শত্রুতা বা মিত্রতা করা অনুচিত, তারা সর্বদাই কলুষিত। বিষচিকিৎসকগণ এই মন্ত্র পাঠ ক’রে বৃশ্চিকদংশনের চিকিৎসা করে থাকেন।—রাজা স্বয়ং যাজক হ’লে যেমন হবি নষ্ট হয়, শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণ এবং বেদবিদ্বেষী লোকে যেমন পতিত হয়, সেইরূপ মদ্রকের সংসর্গে লোকে পতিত হয়। হে বৃশ্চিক, আমি অথর্বোক্ত মন্ত্রে শান্তি করছি—মদ্রকের প্রণয় যেমন নষ্ট হয় সেইরূপ তোমার বিষ নষ্ট হ’ল।

 তার পর কর্ণ বললেন, মদ্রদেশের স্ত্রীলোকে মদ্যপানে মত্ত হয়ে বস্ত্র ত্যাগ ক’রে নৃত্য করে, তারা অসংযত স্বেচ্ছাচারিণী। যারা উষ্ট্র ও গর্দভের ন্যায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে সেই ধর্মভ্রষ্ট নির্লজ্জ স্ত্রীদের পুত্র হয়ে আপনি ধর্মের কথা বলতে চান! মদ্রদেশের নারীদের কাছে কেউ যদি কাঞ্জিক[] বা সুবীরক[] চায় তবে তারা নিতম্ব আকর্ষণ ক’রে বলে, আমি পুত্র বা পতি দিতে পারি কিন্তু কাঞ্জিক দিতে পারি না। আমরা শুনেছি, মদ্রনারীরা কম্বল[] পরে, তারা গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, নির্লজ্জ, উদরপরায়ণ ও অশুচি। মদ্র সিন্ধু ও সৌবীর এই তিনটি পাপদেশ, সেখানকার লোকেরা ম্লেচ্ছ ও ধর্মজ্ঞানহীন। নিশ্চয় পাণ্ডবরা আমাদের মধ্যে ভেদ ঘটাবার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছে। শল্য, আপনি দুর্যোধনের মিত্র, আপনাকে হত্যা করলে নিন্দা হবে, এবং আমাদের ক্ষমাগুণও আছে; এই তিন কারণে আপনি এখনও জীবিত আছেন। যদি আবার এরূপ কথা বলেন তবে এই বজ্রতুল্য গদার আঘাতে আপনার মস্তক চূর্ণ করব।

১১। কাক ও হংসের উপাখ্যান

 শল্য বললেন, কর্ণ, তোমাকে মদ্যপের ন্যায় প্রমাদগ্রস্ত দেখছি, সৌহার্দের জন্য আমি তোমার চিকিৎসা করব। তোমার হিত বা অহিত যা আমি জানি তা অবশ্যই আমার বলা উচিত। একটি উপাখ্যান বলছি শোন।—

 সমদ্রতীরবর্তী কোনও দেশে এক ধনবান বৈশ্য ছিলেন, তাঁর বহু পত্র ছিল। সেই পুত্রেরা তাদের ভুক্তাবশিষ্ট মাংসযক্ত অন্ন দধি ক্ষীর প্রভৃতি এক কাককে খেতে দিত। উচ্ছিষ্টভোজী সেই কাক গর্বিত হয়ে অন্য পক্ষীদের অবজ্ঞা করত। একদিন গরুড়ের ন্যায় দ্রুতগামী এবং চক্রবাকের ন্যায় বিচিত্রদেহ কতকগুলি হংস বেগে উড়ে এসে সমুদ্রের তীরে নামল। বৈশ্যপুত্রেরা কাককে বললে, বিহঙ্গম, তুমি ওই হংসদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তখন সেই উচ্ছিষ্টভোজী কাক সগর্বে হংসদের কাছে গিয়ে বললে, চল, আমরা উড়ব। হংসেরা বললে, আমরা মানস সরোবরে থাকি, ইচ্ছানুসারে সর্বত্র বিচরণ করি, বহুদূর যেতে পারি, সেজন্য পক্ষীদের মধ্যে আমরা বিখ্যাত। দুর্মতি, তুমি কাক হয়ে কি ক’রে আমাদের সঙ্গে উড়বে?

 কাক বললে, আমি এক শ এক প্রকার ওড়বার পদ্ধতি জানি এবং প্রত্যেক পদ্ধতিতে বিচিত্র গতিতে শত যোজন যেতে পারি। আজ আমি উড্ডীন অবডীন প্রডীন ডীন নিডীন সংডীন তির্যগ্‌ডীন পরিডীন প্রভৃতি বহুপ্রকার গতিতে উড়ব, তোমরা আমার শক্তি দেখতে পাবে। বল, এখন কোন গতিতে আমি উড়ব, তোমরাও আমার সঙ্গে উড়ে চল। একটি হংস হাস্য ক’রে বললে, সকল পক্ষী যে গতিতে ওড়ে আমি সেই গতিতেই উড়ব, অন্য গতি জানি না। রক্তচক্ষু কাক, তোমার যেমন ইচ্ছা সেই গতিতে উড়ে চল।

 হংস ও কাক পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক’রে উড়তে লাগল, হংস একই গতি এবং কাক বহুপ্রকার গতি দেখাতে দেখাতে চলল। হংস নীরব রইল, দর্শকদের বিস্মিত করবার জন্য কাক নিজের গতির বর্ণনা করতে লাগল। অন্যান্য কাকেরা হংসদের নিন্দা করতে করতে একবার বৃক্ষের উপর উড়ে বসল, আবার নীচে নেমে এল। হংস মৃদু গতিতে উড়ে কিছুকাল কাকের পিছনে রইল, তার পর দর্শক কাকদের উপহাস শুনে বেগে সমুদ্রের উপর দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়ে চলল। কাক শ্রান্ত ও ভীত হয়ে ভাবতে লাগল, কোথাও দ্বীপ বা বৃক্ষ নেই, আমি কোথায় নামব? হংস পিছনে ফিরে দেখলে, কাক জলে পড়ছে। তখন সে বললে, কাক, তুমি বহুপ্রকার গতির বর্ণনা করেছিলে, কিন্তু এই গুহ্য গতির কথা তো বল নি! তুমি পক্ষ ও চক্ষু দিয়ে বার বার জলস্পর্শ করছ, এই গতির নাম কি?

 পরিশ্রান্ত কাক জলে পড়তে পড়তে বললে, হংস, আমরা কাক রূপে সৃষ্ট হয়েছি, কা কা রব করে বিচরণ করি। প্রাণরক্ষার জন্য আমি তোমার শরণ নিলাম, আমাকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে চল। প্রভু, আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর, যদি ভালয় ভালয় নিজের দেশে ফিরতে পারি তবে আর কাকেও অবজ্ঞা করব না। কাকের এই বিলাপ শুনে হংস কিছু না ব’লে তাকে পা দিয়ে উঠিয়ে পিঠে তুলে নিলে এবং দ্রুতবেগে উড়ে তাকে সমুদ্রতীরে রেখে অভীষ্ট দেশে চ’লে গেল।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে শল্য বললেন, কর্ণ, তুমি সেই উচ্ছিষ্টভোজী কাকের তুল্য; ধৃতরাষ্ট্রপউত্রদের উচ্ছিষ্টে পালিত হয়ে তোমার সমান এবং তোমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সকল লোককে তুমি অবজ্ঞা ক’রে থাক। কাক যেমন শেষকালে বুদ্ধি ক’রে হংসের শরণ নিয়েছিল তুমিও তেমন কৃষ্ণার্জুনের শরণ নাও।

১২। কর্ণের শাপবৃত্তান্ত

 কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ ও অর্জুনের শক্তি আমি যথার্থরূপে জানি, তথাপি আমি নির্ভয়ে তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। কিন্তু ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ পরশুরাম আমাকে যে শাপ দিয়েছিলেন তার জন্যই আমি উদ্‌বিগ্ন হয়ে আছি। পূর্বে আমি দিব্যাস্ত্র শিক্ষার জন্য ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পরশুরামের নিকট বাস করতাম। একদিন গুরুদেব আমার ঊরুতে মস্তক রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন সেই সময়ে অর্জুনের হিতকামী দেবরাজ ইন্দ্র এক বিকট কীটের রূপ ধারণ ক’রে আমার ঊরু বিদীর্ণ করলেন। সেখান থেকে অত্যন্ত রক্তস্রাব হ’তে লাগল, কিন্তু গুরুর নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে আমি নিশ্চল হয়ে রইলাম। জাগরণের পর তিনি আমার সহিষ্ণুতা দেখে বললেন, তুমি ব্রাহ্মণ নও, সত্য বল তুমি কে। তখন আমি নিজের যথার্থ পরিচয় দিলাম। পরশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে এই শাপ দিলেন—সূত, তুমি কপট উপায়ে আমার কাছে যে অস্ত্র লাভ করেছ, কার্যকালে তা তোমার স্মরণ হবে না, মৃত্যুকাল ভিন্ন অন্য সময়ে মনে পড়বে; কারণ, বেদমন্ত্রযুক্ত অস্ত্র অব্রাহ্মণের নিকট স্থায়ী হয় না।

 তার পর কর্ণ বললেন, আজ যে তুমুল সংগ্রাম আসন্ন হয়েছে তাতে সেই অস্ত্রই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত হ’ত। কিন্তু আজ আমি অন্য অস্ত্র স্মরণ করছি যার দ্বারা অর্জুন প্রভৃতি শত্রুকে নিপাতিত করব। আজ আমি অর্জুনের প্রতি যে ব্রাহ্ম অস্ত্র নিক্ষেপ করব তার শক্তি ধারণাতীত। যদি আমার রথচক্র গর্তে না পড়ে তবে অর্জুন আজ মুক্তি পাবে না। মদ্ররাজ, পূর্বে অস্ত্রাভ্যাসকালে অসাবধানতার ফলে আমি এক ব্রাহ্মণের হোমধেনুর বৎসকে শরাঘাতে বধ করেছিলাম। তার জন্য তিনি আমাকে শাপ দিয়েছিলেন—যুদ্ধকালে তোমার মহাভয় উপস্থিত হবে এবং রথচক্র গর্তে পড়বে। আমি সেই ব্রাহ্মণকে বহু ধেনু বৃষ হস্তী দাসদাসী সুসজ্জিত গৃহ এবং আমার সমস্ত ধন দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি প্রসন্ন হলেন না। শল্য, আপনি আমার নিন্দা করলেও সৌহার্দের জন্য এইসব কথা বললাম। আপনি জানবেন যে কর্ণ ভয় পাবার জন্য জন্মগ্রহণ করে নি, বিক্রমপ্রকাশ ও যশোলাভের জন্যই জন্মেছে। সহস্র শল্যের অভাবেও আমি শত্রুজয় করতে পারি।

 শল্য বললেন, তুমি বিপক্ষদের উদ্দেশে যা বললে তা প্রলাপ মাত্র। আমি সহস্র কর্ণ ব্যতীত যুদ্ধে শত্রুজয় করতে পারি।

 শল্যের নিষ্ঠুর কথা শুনে কর্ণ আবার মদ্রদেশের নিন্দা করতে লাগলেন। তিনি বললেন, কোনও ব্রাহ্মণ আমার পিতার নিকট বাহীক[] ও মদ্র দেশের এই কুৎসা করেছিলেন।—যে দেশ হিমালয় গঙ্গা সরস্বতী যমুনা ও কুরুক্ষেত্রের বহির্ভাগে, এবং যা সিন্ধু শতদ্রু বিপাশা ইরাবতী চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার মধ্যে অবস্থিত, সেই ধর্মহীন অশুচি বাহীক দেশ বর্জন করবে। জর্তিক নামক বাহীকদেশবাসীর আচরণ অতি নিন্দিত, তারা গুড়ের মদ্য পান করে, লসুনের সহিত গোমাংস খায়, তাদের নারীরা দুশ্চরিত্রা ও অশ্লীলভাষিণী। আরট্ট নামক বাহীকগণ মেষ উষ্ট্র ও গর্দভের দুগ্ধ পান করে এবং জারজ পুত্র উৎপাদন করায়। কোনও এক সতী নারীর অভিশাপের ফলে সেখানকার নারীরা বহুভোগ্যা, সেদেশে ভাগিনেয়ই উত্তরাধিকারী হয়, পুত্র নয়। পাঞ্চনদ প্রদেশের আরট্টগণ কৃতঘ্ন পরস্বাপহারী মদ্যপ গুরুপত্নীগামী নিষ্ঠুরভাষী গোঘাতক, তাদের ধর্ম নেই, অধর্মই আছে।

 শল্য বললেন, কর্ণ, তুমি যে দেশের রাজা সেই অঙ্গদেশের লোকে আতুরকে পরিত্যাগ করে, নিজের স্ত্রীপুত্র বিক্রয় করে। কোনও দেশের সকল লোকেই পাপাচরণ করে না, অনেকে এমন সচ্চরিত্র যে দেবতারাও তেমন নন।

 তার পর দুর্যোধন এসে মিত্ররূপে কর্ণকে এবং স্বজনরূপে শল্যকে কলহ থেকে নিবৃত্ত করলেন। কর্ণ হাস্য ক’রে শল্যকে বললেন, এখন রথ চালান।

১৩। কর্ণের সহিত যুধিষ্ঠির ও ভীমের যুদ্ধ

(সপ্তদশ দিনের যুদ্ধ)

 ব্যূহ রচনা ক’রে কর্ণ পাণ্ডববাহিনীর দিকে অগ্রসর হলেন। কৃপ ও কৃতবর্মা ব্যূহের দক্ষিণে রইলেন। পিশাচের ন্যায় ভীষণদর্শন দুর্জয় অশ্বারোহী গান্ধার সৈন্য ও পার্বত সৈন্য সহ শকুনি ও উলূক তাঁদের পার্শ্ব রক্ষা করতে লাগলেন। চৌত্রিশ হাজার সংশপ্তকের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ব্যূহের বামে রইলেন এবং তাঁদের পার্শ্বে কাম্বোজ শক ও যবন যোদ্ধারা অবস্থান করলেন। ব্যূহের মধ্য দেশে কর্ণ এবং পশ্চাতে দুঃশাসন রইলেন।

 পুরাকালে বেদমন্ত্রে উদ্দীপিত অগ্নি যে রথের অশ্ব হয়েছিলেন, যে রথ ব্রহ্মা ঈশান ইন্দ্র ও বরুণকে পর পর বহন করেছিল, সেই আদিম আশ্চর্য রথে কৃষ্ণার্জুন আসছেন দেখে শল্য বললেন, কর্ণ, শ্বেত অশ্ব যার বাহন এবং কৃষ্ণ যার সারথি সেই রথ আসছে। তুমি যাঁর অনুসন্ধান করছিলে, কর্মবিপাকের ন্যায় দুর্নিবার সেই অর্জুন শত্রুবধ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছেন। দেখ, নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, একটা ঘোরদর্শন মেঘতুল্য কবন্ধ সূর্যমণ্ডল আবৃত করে রয়েছে, বহু সহস্র কঙ্ক ও গৃধ্র সমবেত হয়ে ঘোর রব করছে। অর্জুনের গাণ্ডীব আকৃষ্ট হয়ে কূজন করছে, তাঁর হস্তনিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ শরজাল শত্রু বিনাশ করছে। নিহত রাজাদের মুণ্ডে রণভূমি আবৃত হয়েছে, আরোহীর সহিত অশ্বগণ মুমূর্ষু হয়ে ভূমিতে শুয়ে পড়ছে, নিহত হস্তীরা পর্বতের ন্যায় পতিত হচ্ছে। রাধেয় কর্ণ, কৃষ্ণ যাঁর সারথি এবং গাণ্ডীব যাঁর ধনু, সেই অর্জুনকে যদি বধ করতে পার তবে তুমিই আমাদের রাজা হবে।

 এই সময়ে সংশপ্তকগণের আহ্বানে অর্জুন তাদের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন। কর্ণ বললেন, শল্য, দেখুন, মেঘ যেমন সূর্যকে আবৃত করে, সংশপ্তকগণ সেইরূপ অর্জুনকে ঘিরে অদৃশ্য ক’রে ফেলেছে। অর্জুন যোদ্ধৃসাগরে নিমগ্ন হয়েছে, এই তার শেষ। শল্য বললেন, জল দ্বারা কে বরুণকে বধ করতে পারে? কাষ্ঠ দ্বারা কে অগ্নি নির্বাপন করতে পারে? কোন লোক বায়ুকে ধ’রে রাখতে বা মহার্ণব পান করতে পারে? যুদ্ধে অর্জুনের নিগ্রহ আমি সেইরূপই অসম্ভব মনে করি। তবে কথা ব’লে যদি তোমার পরিতোষ হয় তবে তাই বল।

 কর্ণ ও শল্য এইরূপ আলাপ করছিলেন এমন সময়ে দুই পক্ষের সেনা গঙ্গাযমুনার ন্যায় মিলিত হ’ল। রুদ্র যেমন পশু সংহার করেন অর্জুন সেইরূপ তাঁর চতুর্দিকের শত্রু বধ করতে লাগলেন। কর্ণের শরাঘাতে বহু পাঞ্চালবীর নিহত হলেন, তাঁদের সৈন্যমধ্যে হাহাকার উঠল। পাণ্ডববাহিনী ভেদ ক’রে কর্ণ বহু রথ হস্তী অশ্ব ও পদাতি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের নিকটে এলেন। শিখণ্ডী ও সাত্যকির সহিত পাণ্ডবগণ যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টন করলেন। সাত্যকি কর্তৃক প্রেরিত হয়ে দ্রবিড় অন্ধ্র ও নিষাদ দেশীয় পদাতি সৈন্যরা কর্ণকে মারবার জন্য সবেগে এল, কিন্তু শরাহত হয়ে ছিন্ন শালবনের ন্যায় ভূপতিত হ’ল। পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও কেকয়গণ কর্তৃক রক্ষিত হয়ে যুধিষ্ঠির কর্ণকে বললেন, সূতপত্র, তুমি সর্বদাই অর্জুনের সহিত স্পর্ধা কর, দুর্যোধনের মতে চ’লে সর্বদাই আমাদের শত্রুতা কর। তোমার যত বীর্য আর পাণ্ডবদের উপর যত বিদ্বেষ আছে আজ সে সমস্তই দেখাও। আজ মহাযুদ্ধে তোমার যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা দূর করব। এই ব’লে যুধিষ্ঠির কর্ণকে আক্রমণ করলেন। তাঁর বজ্রতুল্য বাণের প্রহারে কর্ণের বাম পার্শ্ব বিদীর্ণ হ’ল, কর্ণ মূর্ছিত হয়ে রথের মধ্যে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ ক’রে কর্ণ যুধিষ্ঠিরের চক্ররক্ষক পাঞ্চালবীর চন্দ্রদেব ও দণ্ডধারকে বধ করলেন এবং যুধিষ্ঠিরের বর্ম বিদীর্ণ করলেন। রক্তাক্তদেহে যুধিষ্ঠির এক শক্তি ও চার তোমর নিক্ষেপ করলেন। কর্ণ ভল্লের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথ নষ্ট করলেন। তখন যুধিষ্ঠির অন্য রথে উঠে যুদ্ধে বিমুখ হয়ে পালাতে লাগলেন। কর্ণ দ্রুতবেগে এসে যুধিষ্ঠিরের স্কন্ধ স্পর্শ করে বললেন, ক্ষত্রিয়বীর প্রাণরক্ষার জন্য কি ক’রে রণস্থল ত্যাগ করতে পারেন? আপনি ক্ষত্রধর্মে পটু নন, বেদাধ্যয়ন আর যজ্ঞ ক’রে ব্রাহ্মণের শক্তিই লাভ করেছেন। কুন্তীপুত্র, আর যুদ্ধ করবেন না, বীরগণের কাছে যাবেন না, তাঁদের অপ্রিয় বাক্যও বলবেন না।

 যুধিষ্ঠির লজ্জিত হয়ে সরে এলেন এবং কর্ণের বিক্রম দেখে নিজ পক্ষের যোদ্ধাদের বললেন, তোমরা নিশ্চেষ্ট হয়ে আছ কেন, শত্রুদের বধ কর। তখন ভীমসেন প্রভৃতি কৌরবসৈন্যের প্রতি ধাবিত হলেন। তুমুল যুদ্ধে সহস্র সহস্র হস্তী অশ্ব রথ ও পদাতি বিনষ্ট হ’তে লাগল। অপ্সরারা সম্মুখ সমরে নিহত বীরগণকে বিমানে তুলে স্বর্গে নিয়ে চলল। এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখে বীরগণ স্বর্গলাভের ইচ্ছায় ত্বরান্বিত হয়ে পরস্পরকে বধ করতে লাগলেন। ভীম সাত্যকি প্রভৃতি যোদ্ধাদের শরাঘাতে আকুল হয়ে কৌরবসৈন্য পালাতে লাগল। তখন কর্ণের আদেশে শল্য ভীমের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। শল্য বললেন, দেখ, মহাবাহু ভীম কিরূপ ক্রুদ্ধ হয়ে আসছেন, ইনি দীর্ঘকালসঞ্চিত ক্রোধ নিশ্চয় তোমার উপর মুক্ত করবেন। কর্ণ বললেন, মদ্ররাজ, আপনার কথা সত্য, কিন্তু দণ্ডধারী যমের সঙ্গে ভীম কি ক’রে যুদ্ধ করবেন? আমি অর্জুনকে চাই, ভীমসেন পরাস্ত হ’লে অর্জুন নিশ্চয় আমার কাছে আসবেন।

 কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর ভীমের শরাঘাতে কর্ণ অচেতন হয়ে রথের মধ্যে ব’সে পড়লেন, শল্য তাঁকে রণস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। তখন ভীমসেন বিশাল কৌরববাহিনী নিপীড়িত করতে লাগলেন, পুরাকালে ইন্দ্র যেমন দানবগণকে করেছিলেন।

১৪। অশ্বত্থামা ও কর্ণের সহিত যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের যুদ্ধ

(সপ্তদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 দুর্যোধন তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, কর্ণ বিপৎসাগরে পড়েছেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে তাঁকে রক্ষা কর। তখন ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ সকল দিক থেকে ভীমকে আক্রমণ করলেন। ভীমের ভল্ল ও নারাচের আঘাতে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিবিৎসু বিকট সহ ক্রাথ নন্দ ও উপনন্দ নিহত হলেন। কর্ণ ভীমের ধনু ও রথ বিনষ্ট করলেন, ভীম গদা নিয়ে শত্রুসৈন্য বধ করতে লাগলেন।

 এই সময়ে সংশপ্তক কোশল ও নারায়ণ সৈন্যের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হচ্ছিল। সংশপ্তকগণ অর্জুনের রথ ঘিরে ফেলে তাঁর অশ্ব রথচক্র ও রথদণ্ড ধ’রে সিংহনাদ করতে লাগল। কয়েকজন কৃষ্ণের দুই বিশাল বাহু ধরলে। দুষ্ট হস্তী যেমন চালককে নিপাতিত করে, কৃষ্ণ সেইরূপ তাঁর বাহুদ্বয় সঞ্চালন ক’রে সংশপ্তকগণকে নিপাতিত করলেন। অর্জুন নাগপাশ অস্ত্র প্রয়োগ ক’রে অন্যান্য সংশপ্তকদের পাদবন্ধন করলেন, তারা সর্পবেষ্টিত হয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে রইল। তখন মহারথ সুশর্মা গরুড় অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, সর্পগণ ভয়ে পালিয়ে গেল। অর্জুন ঐন্দ্র অস্ত্র মোচন করলেন, তা থেকে অসংখ্য বাণ নির্গত হয়ে শত্রুসৈন্য সংহার করতে লাগল। সংশপ্তকদের চোদ্দ হাজার পদাতি, দশ হাজার রথী এবং তিন হাজার গজারোহী যোদ্ধা ছিল, তাদের মধ্যে দশ হাজার অর্জুনের শরাঘাতে নিহত হ’ল।

 কৌরবসৈন্য অর্জুনের ভয়ে অবসন্ন হয়েছে দেখে কৃতবর্মা কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ শকুনি উলূক এবং ভ্রাতাদের সঙ্গে দুর্যোধন তাদের রক্ষা করতে এলেন। শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃপাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা শরাঘাতে আকাশ আচ্ছন্ন ক’রে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছেন দেখে সাত্যকি, যুধিষ্ঠির, প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতি পাঁচ সহোদর এবং অন্যান্য বহু বীর সকল দিক থেকে তাঁকে আক্রমণ করলেন। তিমির আলোড়নে নদীমুখ যেমন হয়, দ্রোণপুত্রের প্রতাপে পাণ্ডবসৈন্য সেইরূপ বিক্ষোভিত হ’ল। যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে অশ্বত্থামাকে বললেন, পুরুষব্যাঘ্র, তোমার প্রীতি নেই, কৃতজ্ঞতাও নেই, তুমি আমাকেই বধ করতে চাচ্ছ। ব্রাহ্মণের কার্য তপ দান ও অধ্যয়ন; তুমি নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ তাই ক্ষত্রিয়ের কার্য করছ। অশ্বত্থামা একটু হাসলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অনুযোগ ন্যায্য ও সত্য জেনে কোনও উত্তর দিলেন না, তাঁকে শরবর্ষণে আচ্ছন্ন করলেন। তখন যুধিষ্ঠির সত্বর রণভূমি থেকে চলে গেলেন।

 দুর্যোধনের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের রথ নষ্ট হওয়ায় তিনি অন্য রথে উঠে চলে গেলেন। তখন কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন। সিংহ যেমন ভীত মৃগযূথকে করে, কর্ণ সেইরূপ পাঞ্চালরথিগণকে বিদ্রাবিত করতে লাগলেন। তখন যুধিষ্ঠির পুনর্বার রণস্থলে এসে শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ণকে বেষ্টন করলেন। অন্যত্র বাহ্ণীক কেকয় মদ্র সিন্ধু প্রভৃতি দেশের সৈন্যের সঙ্গে ভীমসেন একাকী যুদ্ধ করতে লাগলেন।

 অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, জনার্দন, এই সংশপ্তক সৈন্য ভগ্ন হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, এখন কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল। অর্জুনের বানরধ্বজ রথ কৃষ্ণ কর্তৃক চালিত হয়ে মেঘগম্ভীরশব্দে কৌরববাহিনীর মধ্যে এল। অশ্বত্থামা অর্জুনকে বাধা দিতে এলেন এবং শত শত বাণ নিক্ষেপ ক’রে কৃষ্ণার্জুনকে নিশ্চেষ্ট করলেন। অশ্বত্থামা অর্জুনকে অতিক্রম করছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তোমার বীর্য ও বাহুবল পূর্বের ন্যায় আছে কি? তোমার হাতে গাণ্ডীব আছে তো? গুরুপুত্র মনে ক’রে তুমি অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা ক’রো না। তখন অর্জুন ত্বরান্বিত হয়ে চোদ্দটা ভল্লের আঘাতে অশ্বত্থামার ধ্বজ পতাকা রথ ও অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করলেন। অশ্বত্থামা সংজ্ঞাহীন হলেন, তাঁর সারথি তাঁকে রণস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

 এই সময়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দুর্যোধনাদির ঘোর যুদ্ধ হচ্ছিল। কৌরবরা যুধিষ্ঠিরকে ধরবার চেষ্টা করছে দেখে ভীম নকুল সহদেব ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বহু সৈন্য নিয়ে তাঁকে রক্ষা করতে এলেন। কর্ণ বাণবর্ষণ ক’রে সকলকেই নিরস্ত করলেন, যুধিষ্ঠিরের সৈন্য বিধ্বস্ত হয়ে পালাতে লাগল। কর্ণ তিনটি ভল্ল নিক্ষেপ ক’রে যুধিষ্ঠিরের বক্ষ বিদ্ধ করলেন। ধর্মরাজ যধিষ্ঠির রথে ব’সে পড়ে তাঁর সারথিকে বললেন, যাও। তখন দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য সকল দিক থেকে ধাবিত হলেন, কেকয় ও পাঞ্চালবীরগণ তাঁদের বাধা দিতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির ক্ষতবিক্ষতদেহে নকুল ও সহদেবের মধ্যে থেকে শিবিরে ফিরছিলেন, এমন সময় কর্ণ পুনর্বার তাঁকে তিন বাণে বিদ্ধ করলেন, যুধিষ্ঠির এবং নকুল-সহদেবও কর্ণকে শরাহত করলেন। তখন যুধিষ্ঠির ও নকুলের অশ্ব বধ ক’রে কর্ণ ভল্লের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের শিরস্ত্রাণ নিপাতিত করলেন। যুধিষ্ঠির ও নকুল আহতদেহে সহদেবের রথে উঠলেন।

 মাতুল শল্য অনুকম্পাপরবশ হয়ে কর্ণকে বললেন, তুমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ না ক’রে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ করছ কেন? এতে তোমার অস্ত্রশস্ত্রের বৃথা ক্ষয় হবে, তূণীর বাণশূন্য হবে, সারথি ও অশ্ব শ্রান্ত হবে, তুমিও আহত হবে; এমন অবস্থায় অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে লোকে তোমাকে উপহাস করবে। তুমি অর্জুনকে মারবে ব’লেই দুর্যোধন তোমার সম্মান করেন, যুধিষ্ঠিরকে মেরে তোমার কি হবে? ওই দেখ, ভীমসেন দুর্যোধনকে গ্রাস করছেন, তুমি দুর্যোধনকে রক্ষা কর। তখন যুধিষ্ঠির ও নকুল-সহদেবকে ত্যাগ ক’রে কর্ণ সত্বর দুর্যোধনের দিকে গেলেন।

 যুধিষ্ঠির লজ্জিত হয়ে ক্ষতবিক্ষতদেহে সেনানিবেশে ফিরে এলেন এবং রথ থেকে নেমে শয়নগৃহে প্রবেশ করলেন। তাঁর দেহে যেসকল শল্য বিদ্ধ ছিল তা তুলে ফেলা হ’ল, কিন্তু তাঁর মনের শল্য দূর হ’ল না। তিনি নকুল-সহদেবকে বললেন; তোমরা শীঘ্র ভীমসেনের কাছে যাও, তিনি মেঘের ন্যায় গর্জন করে যুদ্ধ করছেন।

 এদিকে কর্ণ তাঁর বিজয় নামক ধনু থেকে ভার্গবাত্র মোচন করলেন, তা থেকে অসংখ্য বাণ নির্গত হয়ে পাণ্ডবসৈন্য সংহার করতে লাগল। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, কর্ণের ভার্গবাস্ত্রের শক্তি দেখ, আমি কোনও প্রকারে এই অস্ত্র নিবারণ করতে পারব না, কর্ণের সহিত যুদ্ধে পালাতেও পারব না। কৃষ্ণ বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির কর্ণের সহিত যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা ক’রে তাঁকে আশ্বাস দাও, তার পর ফিরে গিয়ে কর্ণকে বধ করবে। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য— কর্ণকে যুদ্ধে নিযুক্ত রেখে পরিশ্রান্ত করা, এজন্যই তিনি অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে চললেন।

১৫। যুধিষ্ঠিরের কটুবাক্য

 যেতে যেতে ভীমকে দেখে অর্জুন বললেন, রাজার সংবাদ কি? তিনি কোথায়? ভীম বললেন, কর্ণের বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ধর্মরাজ এখান থেকে চ’লে গেছেন, হয়তো কোনও প্রকারে বেঁচে উঠবেন। অর্জুন বললেন, আপনি শীঘ্র গিয়ে তাঁর অবস্থা জানুন, আমি এখানে শত্রুদের রোধ করে রাখব। ভীম বললেন, তুমিই তাঁর কাছে যাও, আমি গেলে বীরগণ আমাকে ভীত বললেন। অর্জুন বললেন, সংশপ্তকদের বধ না ক’রে আমি যেতে পারি না। ভীম বললেন, ধনঞ্জয়, আমিই সমস্ত সংশপ্তকের সঙ্গে যুদ্ধ করব, তুমি যাও।

 শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য ভীমসেনকে রেখে এবং তাঁকে উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ দ্রুতবেগে যুধিষ্ঠিরের শিবিরে রথ নিয়ে এলেন। যুধিষ্ঠির একাকী শুয়ে ছিলেন, কৃষ্ণার্জুন তাঁর পাদবন্দনা করলেন। কর্ণ নিহত হয়েছেন ভেবে ধর্মরাজ হর্ষ গদ্‌গদকণ্ঠে স্বাগত সম্ভাষণ ক’রে বললেন, তোমাদের দুজনকে দেখে আমি অত্যন্ত প্রীত হয়েছি, তোমরা অক্ষতদেহে নিরাপদে সর্বাস্ত্রবিশারদ মহারথ কর্ণকে বধ করেছ তো? কৃতান্ততুল্য সেই কর্ণ আজ আমার সঙ্গে ঘোর যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তাতে আমি কাতর হই নি। সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরগণকে জয় ক’রে তাঁদের সমক্ষেই কর্ণ আমাকে পরাভূত করেছিলেন, আমাকে বহু নিষ্ঠুর বাক্য বলেছিলেন। ধনঞ্জয়, আমি ভীমের প্রভাবেই জীবিত আছি, এ আমি সইতে পারছি না। কর্ণের ভয়ে আমি তের বৎসর রাত্রিতে নিদ্রা যেতে পারি নি, দিনেও সুখ পাই নি, সকল সময়েই আমি জগৎ কর্ণময় দেখি। সেই বীর আমাকে অশ্ব ও রথ সমেত জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছেন, আমার এই ধিকৃত জীবনে ও রাজ্যে কি প্রয়োজন? ভীষ্ম দ্রোণ আর কৃপের কাছে আমি যে লাঞ্ছনা পাই নি আজ সূতপত্রের কাছে তা পেয়েছি। অর্জুন, ভাই জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কিপ্রকারে কর্ণকে বধ করে নিরাপদে ফিরে এসেছ তা সবিস্তারে বল। কর্ণ তোমাকে বধ করবেন এই আশাতেই ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রেরা কর্ণের সম্মান করতেন; সেই কর্ণ তোমার হাতে কি ক’রে নিহত হলেন? যিনি বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণা, তুমি দুর্বল পতিত দীনপ্রকৃতি পাণ্ডবদের ত্যাগ করছ না কেন?’ যে দুরাত্মা দ্যূতসভায় হাস্য ক’রে দুঃশাসনকে বলেছিল, ‘যাজ্ঞসেনীকে সবলে ধরে নিয়ে এস’ — সেই পাপবুদ্ধি কর্ণ শরাঘাতে বিদীর্ণদেহ হয়ে শুয়ে আছে তো?

 অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম সেই সময়ে অশ্বত্থামা আমার সম্মুখে এলেন। আটটি শকট তাঁর বাণ বহন করছিল, আমার সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি সেই সমস্ত বাণই নিক্ষেপ করলেন। তথাপি আমার শরাঘাতে তাঁর দেহ শজারুর ন্যায় কণ্টকিত হ’ল, তিনি রুধিরাক্তদেহে কর্ণের সৈন্যমধ্যে আশ্রয় নিলেন। তখন কর্ণ পঞ্চাশ জন রথীর সঙ্গে আমার কাছে এলেন। আমি কর্ণের সহচরদের বিনষ্ট ক’রে সত্বর আপনাকে দেখবার জন্য এসেছি। আমি শুনেছি, অশ্বত্থামা ও কর্ণের সহিত যুদ্ধে আপনি আহত হয়েছেন, সে কারণে উপযুক্ত সময়েই আপনি ক্রূরস্বভাব কর্ণের কাছ থেকে চলে এসেছেন। মহারাজ, যুদ্ধকালে আমি কর্ণের আশ্চর্য ভার্গবাস্ত্র দেখেছি, কর্ণের আক্রমণ সইতে পারেন এমন যোদ্ধা সৃঞ্জয়গণের মধ্যে নেই। আপনি আসুন, দেখবেন আজ আমি রণস্থলে কর্ণের সহিত মিলিত হব। যদি আজ কর্ণকে সবান্ধবে বধ না করি তবে প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারীর যে কষ্টকর গতি হয়, আমার যেন তাই হয়। আপনি জয়াশীর্বাদ করুন, যেন আমি সূতপুত্র ও শত্রুগণকে সসৈন্যে বধ করতে পারি।

 কর্ণ সুস্থশরীরে আছেন জেনে শরাঘাতে পীড়িত যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, বৎস, তোমার সৈন্যরা পালিয়েছে, তুমি তাদের পিছনে ফেলে এসেছ। কর্ণবধে অক্ষম হয়ে তুমি ভীমকে ত্যাগ ক’রে ভীত হয়ে চলে এসেছ। অর্জুন, তুমি কুন্তীর গর্ভকে হেয় করেছ। আমরা তোমার উপর অনেক আশা রেখেছিলাম, কিন্তু অতিপুষ্পশালী বৃক্ষ যেমন ফল দেয় না সেইরূপ আমাদের আশা বিফল হয়েছে। ভূমিতে উপ্ত বীজ যেমন দৈবকৃত বৃষ্টির প্রতীক্ষায় জীবিত থাকে, আমরাও সেইরূপ রাজ্যলাভের আশায় তের বৎসর তোমার উপর নির্ভর করেছিলাম, কিন্তু এখন তুমি আমাদের সকলকেই নরকে নিমজ্জিত করেছ। মন্দবুদ্ধি, তোমার জন্মের পর কুন্তী আকাশবাণী শুনেছিলেন, ‘এই পুত্র ইন্দ্রের ন্যায় বিক্রমশালী ও সর্বশত্রুজয়ী হবে, মদ্র কলিঙ্গ ও কেকয়গণকে জয় করবে, কৌরবগণকে বধ করবে।’ শতশৃঙ্গ পর্বতের শিখরে তপস্বিগণ এই দৈববাণী শুনেছিলেন, কিন্তু তা সফল হ’ল না, অতএব দেবতারাও অসত্য বলেন। আমি জানতাম না যে তুমি কর্ণের ভয়ে অভিভূত। কেশব যার সারথি সেই বিশ্বকর্মা-নির্মিত শব্দহীন কপিধ্বজ রথে আরোহণ ক’রে এবং স্বর্ণমণ্ডিত খড়্‌গ ও গাণ্ডীবধনু ধারণ ক’রে তুমি কর্ণের ভয়ে পালিয়ে এলে! দুরাত্মা, তুমি যদি কেশবকে ধনু দিয়ে নিজে সারথি হ’তে তবে বজ্রধর দেবরাজ ইন্দ্র যেমন বৃত্রবধ করেছিলেন সেইরূপ কেশব কর্ণকে বধ করতেন। তুমি যদি রাধেয় কর্ণকে আক্রমণ করতে অসমর্থ হও তবে তোমার চেয়ে অস্ত্রবিশারদ অন্য রাজাকে গাণ্ডীবধনু দাও। দুরাত্মা, তুমি যদি পঞ্চম মাসে গর্ভচ্যুত হ’তে কিংবা কুতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ না করতে তবে তাই তোমার পক্ষে শ্রেয় হ’ত, তা হ’লে তোমাকে যুদ্ধ থেকে পালাতে হ’ত না। তোমার গাণ্ডীবকে ধিক, তোমার বাহুবল ও বাণসমূহকে ধিক, তোমার কপিধ্বজ ও অগ্নিদত্ত রথকেও ধিক।

১৬। অর্জুনের ক্রোধ—কৃষ্ণের উপদেশ

 যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার শুনে অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হ’য়ে তাঁর খড়্‌গ ধারণ করলেন। চিত্তজ্ঞ কেশব বললেন, ধনঞ্জয়, তুমি খড়্‌গ হাতে নিলে কেন? যুদ্ধের যোগ্য কোনও লোককে এখানে দেখছি না, এখন ভীমসেন দুর্যোধনাদিকে আক্রমণ করেছেন, তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরকে দেখতে এসেছ, তিনিও কুশলে আছেন। এই নৃপশ্রেষ্ঠকে দেখে তোমার আনন্দই হওয়া উচিত, তবে ক্রোধ হ’ল কেন? তোমার অভিপ্রায় কি?

 সর্পের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে অর্জুন বললেন, আমার এই গূঢ় প্রতিজ্ঞা আছে, যে আমাকে বলবে, ‘অন্য লোককে গাণ্ডীব দাও’, তার আমি শিরশ্ছেদ করব। গোবিন্দ, তোমার সমক্ষেই রাজা যুধিষ্ঠির আমাকে তাই বলেছেন। আমি ধর্মভীরু সেজন্য এঁকে বধ ক’রে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব, সত্যের নিকট ঋণমুক্ত হব। তুমিই বল এ সময়ে কি কর্তব্য। জগৎপিতা, তুমি ভূত ভবিষ্যৎ সবই জান, আমাকে যা বলবে তাই আমি করব।

 কৃষ্ণ বললেন, ধিক ধিক! অর্জুন, আমি বুঝেছি তুমি বৃদ্ধের নিকট উপদেশ লাভ কর নি, তাই অকালে ক্রুদ্ধ হয়েছ। তুমি ধর্মভীরু কিন্তু অপণ্ডিত; যাঁরা ধর্মের সকল বিভাগ জানেন তাঁরা এমন করেন না। যে লোক অকর্তব্য কর্মে প্রবৃত্ত হয় এবং কর্তব্য কর্মে বিরত থাকে সে পুরুষাধম। আমার মতে প্রাণিবধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বরং অসত্য বলবে কিন্তু প্রাণিহিংসা করবে না। যিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা, ধর্মজ্ঞ ও রাজা, নীচ লোকের ন্যায় তুমি তাঁকে কি ক’রে হত্যা করতে পার? তুমি বালকের ন্যায় প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এখন মূঢ়তার বশে অধর্ম কার্যে উদ্যত হয়েছ। ধর্মের সূক্ষ্ম ও দুরূহ তত্ত্ব না জেনেই তুমি গুরুহত্যা করতে যাচ্ছ। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, বিদুর বা যশস্বিনী কুন্তী যে ধর্মতত্ত্ব বলতে পারেন, আমি তাই বলছি শোন।—

সত্যস্য বচনং সাধু ন সত্যাদ্‌বিদ্যতে পরম্।
তত্ত্বেনৈব সুদুর্জ্ঞেয়ং পশ্য সত্যমনুষ্ঠিতম্॥
ভবেৎ সত্যমবক্তব্যং বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।
যন্ত্রানৃতং ভবেৎ সত্যং সত্যঞ্চাপানৃতং ভবেৎ॥

— সত্য বলাই ধর্মসংগত, সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছু নেই; কিন্তু জানবে যে সত্যানুসারে কর্মের অনুষ্ঠান উচিত কিনা তা স্থির করা অতি দুরূহ। যেখানে মিথ্যাই সত্যতুল্য হিতকর এবং সত্য মিথ্যাতুল্য অহিতকর হয়, সেখানে সত্য বলা অনুচিত, মিথ্যাই বলা উচিত।—

বিবাহকালে রতিসম্প্রয়োগে
প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে।
বিপ্রস্য চার্থে হ্যনৃতং বদেত
পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি॥

— বিবাহকালে, রতিসম্বন্ধে, প্রাণসংশয়ে, সর্বস্বনাশের সম্ভাবনায়, এবং ব্রাহ্মণের উপকারার্থে মিথ্যা বলা যেতে পারে; এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।[১০]

 তার পর কৃষ্ণ বললেন, শিক্ষিত জ্ঞানী লোকে নিদারূণ কর্ম ক’রেও মহৎ পুণ্যের অধিকারী হ’তে পারেন, যেমন বলাক নামক ব্যাধ অন্ধকে হত্যা ক’রে হয়েছিল। আবার, মূঢ় অপণ্ডিত ধর্মকামীও মহাপাপগ্রস্ত হতে পারেন, যেমন কৌশিক হয়েছিলেন।

 পুরাকালে বলাক নামে এক ব্যাধ ছিল, সে বৃথা পশু বধ করত না, কেবল স্ত্রী পুত্র পিতা মাতা প্রভৃতির জীবনযাত্রানির্বাহের জন্যই করত। একদা সে বনে গিয়ে কোনও মৃগ পেলে না, অবশেষে সে দেখলে, একটি শ্বাপদ জলপান করছে। এই পশুর চক্ষু ছিল না, ঘ্রাণশক্তিই তার দৃষ্টির কাজ করত। বলাক সেই অদৃষ্টপূর্ব অন্ধ পশুকে বধ করলে আকাশ থেকে তার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হ’ল। তার পর সেই ব্যাধকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য একটি মনোরম বিমান এল, তাতে অপ্সরারা গীতবাদ্য করছিল। অর্জুন, সেই পশু সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট ক’রে অভীষ্ট বর পেয়েছিল, কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে অন্ধ করে দেন। সেই সর্বপ্রাণিহিংসক শ্বাপদকে বধ ক’রে বলাক স্বর্গে গিয়েছিল।

 কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ গ্রামের অদূরে নদীর সংগমস্থলে বাস করতেন। তিনি তপস্বী কিন্তু অল্পজ্ঞ ছিলেন। তাঁর এই ব্রত ছিল যে সর্বদাই সত্য বলবেন, সেজন্য তিনি সত্যবাদী ব’লে বিখ্যাত হয়েছিলেন। একদিন কয়েকজন লোক দস্যুর ভয়ে কৌশিকের তপোবনে আশ্রয় নিলে। দস্যুরা খুঁজতে খুঁজতে কৌশিকের কাছে এসে বললে, ভগবান, কয়েকজন লোক এদিকে এসেছিল, তারা কোন্ পথে গেছে যদি জানেন তো বলুন। সত্যবাদী কৌশিক বললেন, তারা বহু-বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-সমাকীর্ণ এই বনে আশ্রয় নিয়েছে। তখন নিষ্ঠুর দস্যুরা সেই লোকদের খুঁজে বার ক’রে হত্যা করলে। মূঢ় কৌশিক ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানতেন না, তিনি তাঁর দুরুক্তির জন্য পাপগ্রস্ত হয়ে কষ্টময় নরকে গিয়েছিলেন।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে কৃষ্ণ বললেন, কেউ কেউ তর্ক দ্বারা দুর্বোধ পরমজ্ঞান লাভ করবার চেষ্টা করে, আবার অনেকে বলে ধর্মের তত্ত্ব শ্রুতিতেই আছে। আমি এই দুই মতের কোনওটির দোষ ধরছি না, কিন্তু শ্রুতিতে সমস্ত ধর্মের বিধান নেই, সেজন্য প্রাণিগণের অভ্যুদয়ের নিমিত্ত প্রবচন রচিত হয়েছে।—

যৎ স্যাদহিংসাসংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।
অহিংসার্থায় ভূতানাং ধর্মপ্রবচনং কৃতম্॥
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহুধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎ স্যাদ্ধারণসংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ॥

— যে কর্মে হিংসা নেই তা নিশ্চয়ই ধর্ম; প্রাণিগণের অহিংসার নিমিত্ত ধর্মপ্রবচন রচিত হয়েছে। ধারণ (রক্ষা) করে এজন্যই ‘ধর্ম’ বলা হয়; ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে; যা ধারণ করে তা নিশ্চয়ই ধর্ম।—

অবশ্যং কূজিতব্যে বা শঙ্কেরন্ বাপ্যকূজতঃ।
শ্রেয়স্তত্রানৃতং বক্তুং তৎ সত্যমবিচারিতম্॥

— যেখানে অবশ্যই কিছু বলা প্রয়োজন, না বলা শঙ্কাজনক, সেখানে মিথ্যাই বলা শ্রেয়, সে মিথ্যাকে নির্বিচারে সত্যের সমান গণ্য করতে হবে।

 তার পর কৃষ্ণ বললেন, যদি মিথ্যা শপথ ক’রে দস্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীরা তাতে অধর্ম দেখতে পান না, কারণ উপায় থাকলে দস্যুকে কখনও ধন দেওয়া উচিত নয়। ধর্মের জন্য মিথ্যা বললে পাপ হয় না। অর্জুন, আমি তোমাকে সত্য-মিথ্যার স্বরূপ বুঝিয়ে দিলাম, এখন বল যুধিষ্ঠিরকে বধ করা উচিত কিনা।

 অর্জুন বললেন, তোমার বাক্য মহাপ্রাজ্ঞ মহামতি পুরুষের যোগ্য, আমাদেরও হিতকর। কৃষ্ণ, তুমি আমাদের মাতার সমান, পিতার সমান, আমাদের পরম গতি। আমি বুঝেছি যে ধর্মরাজ আমার অবধ্য। এখন তুমি আমার সংকল্পের বিষয় শুনে অনুগ্রহ ক’রে উপদেশ দাও। তুমি আমার এই প্রতিজ্ঞা জান— কেউ যদি আমাকে বলে, ‘অপর লোক তোমার চেয়ে অস্ত্রবিদ্যায় বা বীর্যে শ্রেষ্ঠ, তুমি তাকে গাণ্ডীব দাও,’— তবে আমি তাকে বধ করব। ভীমেরও প্রতিজ্ঞা আছে—যে তাঁকে তূবরক[১১] বলবে তাকে তিনি বধ করবেন। তোমার সমক্ষেই যুধিষ্ঠির একাধিক বার আমাকে বলেছেন, ‘গাণ্ডীব অন্য লোককে দাও’। কিন্তু যদি তাঁকে বধ করি তবে আমি অল্পকালও জীবিত থাকতে পারব না। কৃষ্ণ, তুমি আমাকে এমন বুদ্ধি দাও যাতে আমার সত্যরক্ষা হয় এবং যুধিষ্ঠির ও আমি দুজনেই জীবিত থাকি।

 কৃষ্ণ বললেন, কর্ণের সহিত যুদ্ধ করে যুধিষ্ঠির শ্রান্ত দুঃখিত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, সেজন্যই ক্ষোভ ও ক্রোধের বশে তোমাকে অনুচিত বাক্য বলেছেন। এঁর এই উদ্দেশ্যও আছে যে কুপিত হ’লে তুমি কর্ণকে বধ করবে। ইনি এও জানেন যে তুমি ভিন্ন আর কেউ কর্ণের বিক্রম সইতে পারে না। যুধিষ্ঠির অবধ্য, তোমার প্রতিজ্ঞাও পালনীয়। যে উপায়ে ইনি জীবিত থেকেই মৃত হবেন তা বলছি শোন। মাননীয় লোকে যত কাল সম্মান লাভ করেন তত কালই জীবিত থাকেন; যখন তিনি অপমানিত হন তখন তাঁকে জীবন্মৃত বলা যায়। রাজা যুধিষ্ঠির তোমাদের সকলের নিকট সর্বদাই সম্মান পেয়েছেন, এখন তুমি তাঁর কিঞ্চিৎ অপমান কর। পূজনীয় যুধিষ্ঠিরকে ‘তুমি’ বল; যিনি প্রভু ও গুরুজন তাঁকে তুমি বললে অবধেই তাঁর বধ হয়। এই অপমানে ধর্মরাজ নিজেকে নিহত মনে করবেন; তার পর তুমি চরণবদনা ক’রে এবং সান্ত্বনা দিয়ে তাঁর প্রতি পূর্ববৎ আচরণ করবে। প্রজ্ঞাবান রাজা যুধিষ্ঠির এতে কখনই কুপিত হবেন না। সত্যভঙ্গ ও ভ্রাতৃত্বধের পাপ থেকে এইরূপে মুক্ত হয়ে তুমি হৃষ্টচিত্তে সূতপুত্রকে বধ কর।

১৭। অর্জুনের সত্যরক্ষা — যুধিষ্ঠিরের অনুতাপ

 অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, রাজা, আমাকে কটুবাক্য ব’লো না, ব’লো না; তুমি রণভূমি থেকে এক ক্রোশ দূরে রয়েছ। ভীম আমার নিন্দা করতে পারেন, কারণ তিনি শ্রেষ্ঠ বীরগণের সঙ্গে সিংহবিক্রমে যুদ্ধ করছেন। ভরতন্দন, পণ্ডিতগণ বলেন, ব্রাহ্মণের বল বাক্যে আর ক্ষত্রিয়ের বল বাহুতে; কিন্তু তোমারও বল বাক্যে, এবং তুমি নিষ্ঠুর। আমি কিরূপ তা তুমি জান। স্ত্রী পুত্র ও জীবন দিয়েও আমি সর্বদা তোমার ইষ্টসাধনের চেষ্টা করি, তথাপি তুমি যখন আমাকে বাক্যবাণে আঘাত করছ তখন বুঝেছি তোমার কাছে আমাদের কোনও সুখলাভের আশা নেই। তুমি দ্রৌপদীর শয্যায় শুয়ে আমাকে অবজ্ঞা ক’রো না; তোমার জন্যই আমি মহারথগণকে বধ করেছি, তাতেই তুমি নিঃশঙ্ক ও নিষ্ঠুর হয়েছ। অধিরাজের পদ পেয়ে তুমি যা করেছ তার আমি প্রশংসা করতে পারি না। তোমার দ্যূতাসক্তির জন্য আমাদের রাজ্যনাশ হয়েছে, আমরা বিপদে পড়েছি। তুমি অল্পভাগ্য, এখন ক্রূর বাক্যের কশাঘাতে আমাদের ক্রুদ্ধ ক’রো না।

 যুধিষ্ঠিরকে এইপ্রকার পরুষ বাক্য ব’লে অর্জুন অনুতপ্ত হলেন এবং নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে অসি কোষমুক্ত করলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি, তুমি আবার অসি নিষ্কাশিত করলে কেন? অর্জুন বললেন, যে শরীরে আমি অহিত আচরণ করেছি সে শরীর আমি নষ্ট করব। কৃষ্ণ বললেন, রাজা যুধিষ্ঠিরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছ সেজন্য মোহগ্রস্ত হ’লে কেন? তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ? যদি তুমি সত্যরক্ষার নিমিত্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বধ করতে তবে তোমার কি অবস্থা হ’ত? পার্থ, ধর্মের তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও দুর্জ্ঞেয়, বিশেষত অজ্ঞ লোকের কাছে। আমি যা বলছি শোন। আত্মহত্যা করলে তোমার ভ্রাতৃহত্যার চেয়ে গুরুতর পাপ হবে। এখন তুমি নিজের মুখে নিজের গুণকীর্তন কর, তাতেই আত্মহত্যা হবে।

 তখন ধনঞ্জয় তাঁর ধনু নমিত ক’রে যুধিষ্ঠিরকে বলতে লাগলেন, মহারাজ, শুনুন—পিনাকপাণি মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্ধর কেউ নেই। আমি মহাদেবের অনুমতিতে ক্ষণমধ্যে চরাচর সহ সমস্ত জগৎ বিনষ্ট করতে পারি। রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে আমিই সকল দিক ও দিক্‌পালগণকে জয় ক’রে আপনার বশে এনেছিলাম। আমার তেজেই আপনার দিব্য সভা নির্মিত এবং রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হয়েছিল। আমার দক্ষিণ হস্তে বাণ, বাম হস্তে বাণযুক্ত বিস্তৃত ধনু, এবং দুই পদতলে রথ ও ধ্বজ অঙ্কিত আছে, আমার তুল্য পুরুষ যুদ্ধে অজেয়। সংশপ্তকদের অল্পই অবশিষ্ট আছে, শত্রু সৈন্যের অর্ধ ভাগ আমি বিনষ্ট করেছি। আমি অস্ত্র দ্বারাই অস্ত্রজ্ঞদের বধ করি, অশ্বপ্রয়োগে বিপক্ষ সৈন্য ভস্মসাৎ করি না। কৃষ্ণ, শীঘ্র চল, আমরা বিজয়রথে চড়ে সূতপত্রকে বধ করতে যাই। আমাদের রাজা আজ সুখলাভ করন, আমি কর্ণকে বিনষ্ট করব। আজ কর্ণের মাতা অথবা কুন্তী পুত্রহীনা হবেন, আমি সত্য বলছি — কর্ণকে বধ না ক’রে আমার কবচ খুলব না।

 এই কথা ব’লে অর্জুন তাঁর খড়্‌গ কোষবদ্ধ ক’রে ধনু ত্যাগ করলেন এবং লজ্জায় নতমস্তকে কৃতাঞ্জলিপুটে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, প্রসন্ন হ’ন, যা বলেছি তা ক্ষমা করুন, পরে আপনি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন, আপনাকে নমস্কার করছি। আমি ভীমকে যুদ্ধ থেকে মুক্ত করতে এবং সূতপত্রকে বধ করতে এখনই যাচ্ছি। সত্য বলছি, আপনার প্রিয়সাধনের জন্যই আমার জীবন। এই বলে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পাদস্পর্শ ক’রে যুদ্ধযাত্রার জন্য দণ্ডায়মান হলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শয্যা থেকে উঠে দুঃখিত মনে বললেন, অর্জুন, আমি অসাধু কর্ম করেছি, তার জন্যই তোমরা বিপদ্‌গ্রস্ত হয়েছ। আমি কুলনাশক পুরুষাধম, তুমি আমার শিরশ্ছেদ কর। আমার ন্যায় পাপী মূঢ়বৃদ্ধি অলস ভীরু নিষ্ঠুর পুরুষের অনুসরণ ক’রে তোমাদের কি লাভ হবে? আমি আজই বনে যাব, মহাত্মা ভীমসেনই তোমাদের যোগ্য রাজা, আমার ন্যায় ক্লীবের আবার রাজকার্য কি? তোমার পরুষ বাক্য আমি সইতে পারছি না, অপমানিত হয়ে আমার জীবনধারণের প্রয়োজন নেই।

 অর্জুনের প্রতিজ্ঞারক্ষার বিষয় যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আমি আর অর্জুন আপনার শরণাগত, আমি প্রণত হয়ে প্রার্থনা করছি, ক্ষমা করুন, আজ রণভূমি পাপী কর্ণের রক্ত পান করবে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সসম্ভ্রমে কৃষ্ণকে উঠিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, গোবিন্দ, আমরা অজ্ঞানে মোহিত হয়েছিলাম, ঘোর বিপৎসাগর থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করেছ।

 অর্জুন সরোদনে যুধিষ্ঠিরের চরণে পড়লেন। ভ্রাতাকে সস্নেহে উঠিয়ে আলিঙ্গন ক’রে যুধিষ্ঠিরও রোদন করতে লাগলেন। তার পর অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনার পাদস্পর্শ ক’রে প্রতিজ্ঞা করছি, আজ কর্ণকে বধ না ক’রে আমি যুদ্ধ থেকে ফিরব না। যুধিষ্ঠির প্রসন্নমনে বললেন, অর্জুন, তুমি যশস্বী হও, অক্ষয় জীবন ও অভীষ্ট লাভ কর, সর্বদা জয়ী হও, তোমার শত্রুর ক্ষয় হ’ক।

১৮। অর্জুন-কর্ণের অভিযান

(সপ্তদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 কৃষ্ণের আজ্ঞায় দারুক অর্জুনের ব্যাঘ্রচর্মাবৃত রথ সজ্জিত করলে। যথাবিধি স্বস্ত্যয়নের পর কৃষ্ণের সহিত অর্জুন সেই রথে উঠে রণভূমির অভিমুখে চললেন। সেই সময়ে সকল দিক নির্মল হ’ল, চাষ (নীলকণ্ঠ), শতপত্র (কাঠঠোকরা) ও ক্রৌঞ্চ (কোঁচ বক) প্রভৃতি শুভসূচক পক্ষী অনেকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। কঙ্ক গৃধ্র বক শ্যেন বায়স প্রভৃতি মাংসাশী পক্ষী খাদ্যের লোভে আগে আগে যেতে লাগল।

 কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তোমার সমান যোদ্ধা পৃথিবীতে নেই, তথাপি তুমি কর্ণকে অবজ্ঞা করো না। আজ যুদ্ধের সপ্তদশ দিন চলছে, তোমাদের এবং শত্রুপক্ষের বিপুল সৈন্যের এখন অল্পই অবশিষ্ট আছে। কৌরবপক্ষে এখন পাঁচ মহারথ জীবিত আছেন — অশ্বত্থামা কৃতবর্মা কর্ণ শল্য ও কৃপ। অশ্বত্থামা তোমার মাননীয় গুরু দ্রোণের পুত্র, কৃপ তোমার আচার্য, কৃতবর্মা তোমার মাতৃকুলের বান্ধব, মহারাজ শল্য তোমার বিমাতার ভ্রাতা, এই কারণে এঁদের উপর তোমার দয়া থাকতে পারে, কিন্তু পাপমতি ক্ষুদ্রাশয় কর্ণকে আজ তুমি সত্বর বধ কর। জতুগৃহদাহ, দ্যূতক্রীড়া, এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মূল দরাত্মা কর্ণ। অর্জুন বললেন, গোবিন্দ, ভূতভবিষ্যদ্‌বিৎ তুমি যখন আমার সহায় তখন কর্ণের কথা দূরে থাক, ত্রিলোকের সকলকেই আমি পরলোকে পাঠাতে পারি।

 এই সময়ে ভীম তুমুল যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর সারথি বিশোককে বললেন, আমি সর্বদিকে শত্রুদের রথ ও ধ্বজাগ্র দেখে উদ্‌বিগ্ন হয়েছি। অর্জুন এখনও এলেন না, ধর্মরাজও আহত হয়ে চলে গেছেন। এঁরা জীবিত আছেন কিনা জানি না। যাই হ’ক, এখন আমি শত্রুসৈন্য সংহার করব, তুমি দেখে বল আমার কত বাণ অবশিষ্ট আছে। বিশোক বললে, পাণ্ডুপুত্র, আপনার এত অস্ত্র আছে যে ছয় গোশকট তা বহন করতে পারে না। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে সহস্র সহস্র অস্ত্র নিক্ষেপ করুন।

 কিছুক্ষণ পরে বিশোক বললে, ভীমসেন, আপনি গাণ্ডীব আকর্ষণের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না? আপনার অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে, হস্তিসৈন্যের মধ্য থেকে অর্জুনের ধ্বজাগ্রে ওই ভয়ংকর বানর দেখা যাচ্ছে, তিনি কৌরবসৈন্য বিনষ্ট করতে করতে আপনার কাছে আসছেন। ভীম হৃষ্ট হয়ে বললেন, বিশোক, তুমি যে প্রিয়সংবাদ দিলে তার জন্য আমি তোমাকে চোদ্দটি গ্রাম, এক শ দাসী এবং কুড়িটি রথ দেব।


 অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, পাঞ্চালসৈন্যেরা কর্ণের ভয়ে পালাচ্ছে, তুমি শীঘ্র কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল, নতুবা তিনি পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে নিঃশেষ করবেন। অর্জুনের রথ দেখতে পেয়ে শল্য বললেন, কর্ণ, ওই দেখ অর্জুন আসছেন, তাঁর ভয়ে কৌরবসেনা সর্ব দিকে ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু তিনি সমস্ত সৈন্য বর্জন করে তোমার দিকেই আসছেন। রাধেয়, তুমি কৃষ্ণার্জুনকে বধ করতে সমর্থ, তুমি ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্যের সমান। আমাদের পক্ষের রাজারা অর্জুনের ভয়ে পালাচ্ছেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ এঁদের ভয় দূর করতে পারবে না। এই যুদ্ধে কৌরবগণ তোমাকেই দ্বীপের ন্যায় আশ্রয় মনে করেন। কর্ণ বললেন, মহারাজ, আপনি এখন প্রকৃতিস্থ হয়েছেন, আমার মনের মত কথা বলছেন, ধনঞ্জয়ের ভয়ও ত্যাগ করেছেন। আজ আমার বাহুবল দেখুন, আমি একাকীই পাণ্ডবগণের মহাচমূ ধ্বংস করব এবং পুরুষব্যাঘ্র কৃষ্ণার্জুনকেও বধ করব। এই দুই বীরকে না মেরে আমি ফিরব না।

 এই সময়ে দুর্যোধন কৃপ কৃতবর্মা শকুনি অশ্বত্থামা প্রভৃতিকে দেখে কর্ণ বললেন, আপনারা সকল দিক থেকে কৃষ্ণার্জুনকে আক্রমণ করুন, তাঁরা পরিশ্রান্ত ও ক্ষতবিক্ষত হ’লে আমি অনায়াসে তাঁদের বধ করব। কর্ণের উপদেশ অনুসারে কৌরবপক্ষীয় মহারথগণ সসৈন্যে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। অর্জুনের বাণবর্ষণে কৌরবসৈন্য নিষ্পিষ্ট ও বিধ্বস্ত হ’তে লাগল, যারা ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল তারাও পরাঙ্মুখ হ’ল। কৌরবসৈন্য ভগ্ন হ’লে অর্জুন ভীমের কাছে এলেন এবং তাঁকে যুধিষ্ঠিরের কুশলসংবাদ জানিয়ে অন্যত্র যুদ্ধ করতে গেলেন।

 দুঃশাসনের কনিষ্ঠ দশ জন অর্জুনকে পরিবেষ্টন করলেন, কিন্তু অর্জুন ভল্লের আঘাতে সকলেরই শিরশ্ছেদ করলেন। নব্বই জন সংশপ্তক রথী অর্জুনকে বাধা দিতে এলেন, কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর তাঁরাও নিহত হলেন।

১৯। দুঃশাসনবধ—ভীমের প্রতিজ্ঞাপালন

(সপ্তদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 কর্ণ পাঞ্চালগণের সহিত যুদ্ধ করছিলেন। তাঁর শরাঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের এক পুত্র নিহত হ’লে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, পার্থ, কর্ণ পাঞ্চালগণকে নিঃশেষ করছেন, তুমি সত্বর তাঁকে বধ কর। অর্জুন কিছুদূর অগ্রসর হ’লে মহাবীর ভীমসেন পুনর্বার তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন এবং পশ্চাতে থেকে অর্জুনের পৃষ্ঠরক্ষা করতে লাগলেন।

 এই সময়ে দুঃশাসন নির্ভয়ে শরক্ষেপণ করতে করতে ভীমের নিকটস্থ হলেন। হস্তিনী দেখলে দুই মদমত্ত হস্তীর যেমন সংঘর্ষ হয় সেইরূপ ভীম ও দুঃশাসন পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। ভীমের শরাঘাতে দুঃশাসনের ধনু ও ধ্বজ ছিন্ন এবং সারথি নিহত হ’ল। তখন দুঃশাসন নিজেই রথ চালাতে লাগলেন এবং অন্য ধনু নিয়ে ভীমকে শরাহত করলেন। বাহু প্রসারিত ক’রে ভীম প্রাণশূন্যের ন্যায় রথের মধ্যে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ ক’রে গর্জন ক’রে উঠলেন। দুঃশাসন ভীমসেনকে আবার শরাঘাতে নিপীড়িত করতে লাগলেন। ক্রোধে জ্ব’লে উঠে ভীম বললেন, দুরাত্মা, আজ যুদ্ধে তোমার রক্ত পান করব। দুঃশাসন মহাবেগে একটি শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, উগ্রমূর্তি ভীমও তাঁর ভীষণ গদা ঘূর্ণিত ক’রে প্রহার করলেন। গদার প্রহারে শক্তি ভগ্ন হ’ল, দুঃশাসন মস্তকে আহত হয়ে দশ ধনু (চল্লিশ হাত) দূরে নিক্ষিপ্ত হলেন, তাঁর অশ্ব ও রথও বিনষ্ট হ’ল।

 দুঃশাসন বেদনায় ছটফট করতে লাগলেন। তখন ভীমসেন নিরপরাধা রজস্বলা পতিকর্তৃক অরক্ষিতা দ্রৌপদীর কেশগ্রহণ বস্ত্রহরণ প্রভৃতি দুঃখ স্মরণ ক’রে ঘৃতসিক্ত হুতাশনের ন্যায় জ্ব’লে উঠলেন এবং কর্ণ দুর্যোধন কূপ অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মাকে বললেন, ওহে যোদ্ধৃগণ, আজ আমি পাপী দুঃশাসনকে হত্যা করছি, পারেন তো একে রক্ষা করুন। এই ব’লে ভীম তাঁর রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। সিংহ যেমন মহাগজকে ধরে, বৃকোদর ভীম সেইরূপ কম্পমান দুঃশাসনকে আক্রমণ ক’রে গলায় পা দিয়ে চেপে ধরলেন, এবং তীক্ষ অসি দিয়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে ঈষদুষ্ণ রক্ত পান করলেন। তার পর ভূপতিত দুঃশাসনের শিরশ্ছেদ ক’রে রক্ত চাখতে চাখতে বললেন, মাতার স্তনদুগ্ধ, মধু, ঘৃত, উত্তম মাধ্বীক মদ্য, দিব্য জল এবং মথিত দুগ্ধ ও দধি প্রভৃতি অমৃততুল্য যত পানীয় আছে, সে সমস্তের চেয়ে এই শত্রুরক্ত অধিক সুস্বাদু মনে হচ্ছে। তার পর দুঃশাসনকে গতাসু দেখে উগ্রকর্মা ক্রোধাবিষ্ট ভীমসেন হাস্য ক’রে বললেন, আর আমি কি করতে পারি, মৃত্যু তোমাকে রক্ষা করেছে।

 রক্তপায়ী ভীমকে যারা দেখছিল তারা ভয়ে ব্যাকুল হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেল। তাদের হাত থেকে অস্ত্র খ’সে পড়ল, অস্ফুট আর্তনাদ করতে করতে অর্ধনিমীলিতনেত্রে তারা ভীমকে দেখতে লাগল। এ মানুষ নয়, রাক্ষস — এই ব’লে সৈন্যগণ ভয়ে পালিয়ে গেল। কর্ণভ্রাতা চিত্রসেনও পালাচ্ছিলেন, পাঞ্চালবীর যুধামন্যু তাঁকে শরাঘাতে বধ করলেন।

 উপস্থিত বীরগণের সমক্ষে দুঃশাসনের রক্তে অঞ্জলি পূর্ণ ক’রে ভীম সগর্জনে বললেন, পুরুষাধম, এই আমি তোমার কণ্ঠরুধির পান করছি, এখন আবার আমাকে ‘গরু গরু’ বল দেখি! দ্যূতসভায় আমাদের পরাজয়ের পর যারা ‘গরু গরু’ ব’লে নৃত্য করেছিল, এখন প্রতিনৃত্য ক’রে তাদেরই আমরা ‘গরু গরু’ বলব। তার পর রক্তাত্তদেহে মুখ থেকে রক্ত ক্ষরণ করতে করতে ঈষৎ হাস্য ক’রে ভীমসেন কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, আমি দুঃশাসন সম্বন্ধে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা আজ পূর্ণ হ’ল। এখন দ্বিতীয় যজ্ঞপশু দুর্যোধনকেও বলি দেব, এবং কৌরবগণের সমক্ষে সেই দুরাত্মার মস্তক চরণ দিয়ে মর্দন ক’রে শান্তিলাভ করব। এই ব’লে মহাবল ভীমসেন বত্রহন্তা ইন্দ্রের ন্যায় সহর্ষে সিংহনাদ করলেন।

২০। কর্ণবধ

(সপ্তদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 দুঃশাসনবধের পর ভীম ধৃতরাষ্ট্রের আরও দশ পুত্রকে ভল্লের আঘাতে যমালয়ে পাঠালেন। কর্ণপুত্র কৃষসেন প্রবল বিক্রমে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের সঙ্গে বহু ক্ষণ যুদ্ধ করে অর্জুনের বাণে নিহত হলেন।

 পুত্রশোকার্ত কর্ণ ক্রোধে রক্তনয়ন হয়ে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের ন্যায় অর্জুন ও কর্ণকে যুদ্ধে সমাগত দেখে সমস্ত ভুবন যেন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে দুই বীরের পক্ষপাতী হ’ল। নক্ষত্রসমেত আকাশ ও আদিত্যগণ কর্ণের পক্ষে গেলেন; অসুর রাক্ষস প্রেত পিশাচ, বৈশ্য শূদ্র সূত ও সংকর জাতি, শৃগালকুক্কুরাদি, ক্ষুদ্র সর্প প্রভৃতি কর্ণের পক্ষপাতী হ’ল। বিশালা পৃথিবী, নদী সমুদ্র পর্বত বৃক্ষাদি, উপনিষৎ উপবেদ মন্ত্র ইতিহাসাদি সমেত চতুর্বেদ, বাসুকি প্রভৃতি নাগগণ, মাঙ্গলিক পশুপক্ষী, এবং দেবর্ষি ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ অর্জুনের পক্ষ নিলেন।

 ব্রহ্মা মহেশ্বর ও ইন্দ্রাদি দেবগণও যুদ্ধ দেখতে এলেন। ইন্দ্র ও সূর্য নিজ নিজ পুত্রের জয়কামনায় বিবাদ করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ও মহেশ্বর বললেন, অর্জুনের জয় হবে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ ইনি খাণ্ডবদাহ ক’রে অগ্নিকে তৃপ্ত করেছিলেন, স্বর্গে ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন, কিরাতরূপী বৃষধ্বজকে তুষ্ট করেছিলেন, এবং স্বয়ং বিষ্ণু এঁর সারথি। মহাবীর কর্ণ বসুলোকে বা বায়ুলোকে যান, কিংব। ভীষ্ম-দ্রোণের সঙ্গে স্বর্গে থাকুন; কিন্তু কৃষ্ণার্জুনই বিজয়লাভ করুন।

 অর্জুনের ধ্বজস্থিত মহাকপি লম্ফ দিয়ে সবেগে কর্ণের ধ্বজের উপরে পড়ল এবং কর্ণের লাঞ্ছন হস্তিবন্ধনরজ্জুকে আক্রমণ করলে। কৃষ্ণ ও শল্য পরস্পরকে নয়নবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, আজ তুমি কর্ণপত্নীদের বিধবা দেখবে; ঋণমুক্ত হয়ে অভিমন্যুজননী সুভদ্রা, তোমার পিতৃষ্বসা কুন্তী, বাষ্পমুখী দ্রৌপদী, এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আজ তুমি সান্ত্বনা দেবে।

 কর্ণ ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি নানাপ্রকার ভয়ানক মহাস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। উভয়পক্ষের হস্তী অশ্ব রথ ও পদাতি বিধ্বস্ত হয়ে সর্বদিকে ধাবিত হ’ল। অর্জুনের শরাঘাতে অসংখ্য কৌরবযোদ্ধা প্রাণত্যাগ করলেন। তখন অশ্বত্থামা দুর্যোধনের হাত ধ’রে বললেন, দুর্যোধন, প্রসন্ন হও, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ ত্যাগ কর, যুদ্ধকে ধিক। আমি বারণ করলে অর্জুন নিবৃত্ত হবেন, কৃষ্ণও বিরোধ ইচ্ছা করেন না। সন্ধি করলে পাণ্ডবরা সর্বদাই তোমার অনুগত হয়ে থাকবেন। তুমি যদি শান্তি কামনা কর তবে আমি কর্ণকেও নিরস্ত করব।

 দুর্যোধন দুঃখিতমনে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সখা, তোমার কথা সত্য, কিন্তু দুর্মতি ভীম ব্যাঘ্রের ন্যায় দুঃশাসনকে বধ ক’রে যা বলেছে তা আমার হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে আছে, তুমিও তা শুনেছ, অতএব শান্তি কি ক’রে হবে? পূর্বের বহু শত্রুতা স্মরণ ক’রে পাণ্ডবরা আমাকে বিশ্বাস করবে না। কর্ণকেও তোমার বারণ করা উচিত নয়। আজ অর্জুন অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে আছে, কর্ণ বলপ্রয়োগে তাকে বধ করবেন।

 অর্জুন ও কর্ণ আগ্নেয় বারুণ বায়ব্য প্রভৃতি নানা অস্ত্র পরস্পরের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুনের ঐন্দ্রাস্ত্র কর্ণের ভার্গবাস্ত্রে প্রতিহত হয়েছে দেখে ভীমসেন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তোমার সমক্ষেই পাপী সূতপুত্রের বাণে বহু পাঞ্চাল বীর কেন নিহত হলেন? তুমিই বা তার দশটা বাণে বিদ্ধ হ’লে কেন? তুমি যদি না পার তবে আমিই তাকে গদাঘাতে বধ করব। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, আজ তোমার সকল অস্ত্র কর্ণের অস্ত্রে নিবারিত হচ্ছে কেন? তুমি কি মোহগ্রস্ত হয়েছ তাই কৌরবদের আনন্দধ্বনি শুনতে পাচ্ছ না? যে ধৈর্য বলে তুমি রাক্ষস ও অসুরদের সংহার করেছিলে সেই ধৈর্যবলে আজ তুমি কর্ণকেও বধ কর। নতুবা আমার ক্ষুরধার সুদর্শনচক্র দিয়ে শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ কর।

 অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, সূতপত্রের বধ এবং লোকের মঙ্গলের নিমিত্ত আমি এক উগ্র মহাস্ত্র প্রয়োগ করব; তুমি অনুমতি দাও, দেবগণও অনুমতি দিন। এই ব’লে অর্জুন ব্রহ্মাকে নমস্কার ক’রে শত্রুর অসহ্য ব্রাহ্ম অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু কর্ণ বাণবর্ষণ ক’রে সেই অস্ত্র প্রতিহত করলেন। ভীমের উপদেশে অর্জুন আর এক ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। তা থেকে শত শত শূল পরশু চক্র নারাচ নির্গত হয়ে শত্রুসৈন্য বধ করতে লাগল। এই সময়ে যুধিষ্ঠির সুবর্ণ বর্ম ধারণ ক’রে কর্ণার্জুনের যুদ্ধ দেখতে এলেন; ভিষগ্‌গণের মন্ত্র ও ঔষধের গুণে তিনি শল্যমুক্ত ও বেদনাশূন্য হয়েছিলেন।

 অত্যন্ত আকর্ষণ করায় অর্জুনের গাণ্ডীবধনুর গুণ ছিন্ন হ’ল, সেই অবসরে কর্ণ এক শত ক্ষুদ্রক বাণে অর্জুনকে আচ্ছন্ন করলেন এবং কৃষ্ণকেও ষাটটি নারাচ দিয়ে বিদ্ধ করলেন। কৃষ্ণার্জুন পরাভূত হয়েছেন মনে ক’রে কৌরবসৈন্য করতলধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগল। গাণ্ডীবে নূতন গুণ পরিয়ে অর্জুন ক্ষণকালমধ্যে বাণে বাণে অন্ধকার ক’রে ফেললেন এবং কর্ণ শল্য ও সমস্ত কৌরবযোদ্ধাকে বিদ্ধ করে কর্ণের চক্ররক্ষক পাদরক্ষক অগ্ররক্ষক ও পৃষ্ঠরক্ষক যোদ্ধাদের বিনষ্ট করলেন। হতাবশিষ্ট কৌরববীরগণ কর্ণকে ফেলে পালাতে লাগলেন, দুর্যোধনের অনুরোধেও তাঁরা রইলেন না।

 খাণ্ডবদাহের সময় অর্জুন যার মাতাকে বধ করেছিলেন সেই তক্ষকপুত্র অশ্বসেন[১২] এতদিন পাতালে শুয়েছিল। রথ অশ্ব ও হস্তীর মর্দনে ভূতল কম্পিত হওয়ায় অশ্বসেন উঠে পড়ল এবং মাতৃবধের প্রতিশোধ নেবার জন্য শররূপ ধারণ ক’রে কর্ণের তূণে প্রবিষ্ট হ’ল। ইন্দ্র ও লোকপালগণ হাহাকার ক’রে উঠলেন। কর্ণ না জেনেই সেই শর তাঁর ধনুতে যোগ করলেন। শল্য বললেন, এই শরে অর্জনের গ্রীবা ছিন্ন হবে না, তুমি এমন শর সন্ধান কর যাতে তাঁর শিরশ্ছেদ হয়। কর্ণ বললেন, আমি দুবার শরসন্ধান করি না,— এই ব’লে তিনি শর মোচন করলেন। সেই ভীমদর্শন অত্যুজ্জ্বল শর সশব্দে নির্গত হয়ে যেন সীমন্ত রচনা ক’রে আকাশপথে জ্বলতে জ্বলতে যেতে লাগল। তখন কংসরিপু মাধব অবলীলাক্রমে তাঁর পায়ের চাপে অর্জুনের রথ মাটিতে এক হাত[১৩] বসিয়ে দিলেন, রথের চার অশ্ব জানু দ্বারা ভূমি স্পর্শ করলে। নাগবাণের আঘাতে অর্জুনের জগদ্‌বিখ্যাত স্বর্ণকিরীট দগ্ধ হয়ে মস্তক থেকে প’ড়ে গেল।

 শররূপী মহানাগ অশ্বসেন পুনর্বার কর্ণের তূণে প্রবেশ করতে গেল। কর্ণের প্রশ্নের উত্তরে সে বললে, তুমি না দেখেই আমাকে মোচন করেছিলে সেজন্য অর্জুনের মস্তক হরণ করতে পারি নি; আবার লক্ষ্য ক’রে আমাকে নিক্ষেপ কর, তোমার আর আমার শত্রুকে বধ করব। অশ্বসেনের ইতিহাস শুনে কর্ণ বললেন, অন্যের শক্তি অবলম্বন ক’রে আমি জয়ী হতে চাই না; নাগ, যদি শত অর্জুনকেও বধ করা যায়, তথাপি এই শর আমি পুনর্বার প্রয়োগ করব না, অতএব তুমি প্রসন্ন হয়ে চ’লে যাও। তখন অশ্বসেন অর্জুনকে মারবার জন্য নিজেই ধাবিত হ’ল। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি এই মহানাগকে বধ কর, খাণ্ডবদাহ কালে তুমি এর শত্রুতা করেছিলে; ওই দেখ, আকাশচ্যুত প্রজ্জ্বলিত উল্কার ন্যায় তোমার দিকে আসছে। অর্জুন ছয় বাণের আঘাতে অশ্বসেনকে কেটে ভূপাতিত করলেন। তখন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ স্বয়ং দুই হাতে টেনে অর্জুনের রথ ভূমি থেকে তুললেন।

 অর্জুন শরাঘাতে কর্ণের মণিভূষিত স্বর্ণকিরীট, কুণ্ডল ও উজ্জ্বল বর্ম বহু খণ্ডে ছেদন করলেন এবং বর্মহীন কর্ণকে ক্ষতবিক্ষত করলেন। বায়ু পিত্ত-কফ-জনিত জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ন্যায় কর্ণ বেদনা ভোগ করতে লাগলেন। তার পর অর্জুন যমদণ্ডতুল্য লৌহময় বাণে তাঁর বক্ষস্থল বিদ্ধ করলেন। কর্ণের মুষ্টি শিথিল হ’ল, তিনি ধনুর্বাণ ত্যাগ করে অবশ হয়ে টলতে লাগলেন। সৎস্বভাব পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন সেই অবস্থায় কর্ণকে মারতে ইচ্ছা করলেন না। তখন কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে বললেন, পাণ্ডুপুত্র, তুমি প্রমাদগ্রস্ত হচ্ছ কেন? বুদ্ধিমান লোকে দুর্বল বিপক্ষকে অবসর দেন না, বিপদগ্রস্ত শত্রুকে বধ ক’রে ধর্ম ও যশ লাভ করেন। তুমি ত্বরান্বিত হও, নতুবা কর্ণ সবল হয়ে আবার তোমাকে আক্রমণ করবেন। কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুন শরাঘাতে কর্ণকে আচ্ছন্ন করলেন, কর্ণও প্রকৃতিস্থ হয়ে কৃষ্ণার্জুনকে শরবিদ্ধ করতে লাগলেন।

 কর্ণের মৃত্যু আসন্ন হওয়ায় কাল অদৃশ্যভাবে তাঁকে ব্রাহ্মণের শাপের বিষয় জানিয়ে বললেন, ভূমি তোমার রথচক্র গ্রাস করছে। তখন কর্ণ পরশুরামপ্রদত্ত ব্রাহ্ম মহাস্ত্রের বিষয় ভুলে গেলেন, তাঁর রথও ভূমিতে মগ্ন হয়ে ঘুরতে লাগল। কর্ণ বিষণ্ণ হয়ে দুই হাত নেড়ে বললেন, ধর্মজ্ঞগণ সর্বদাই বলেন যে ধর্ম ধার্মিককে রক্ষা করেন। আমরা যথাযোগ্য ধর্মাচরণ করি, কিন্তু দেখছি ধর্ম ভক্তগণকে রক্ষা না ক’রে বিনাশই করেন। তার পর কর্ণ অনবরত শরবর্ষণ ক’রে অর্জুনের ধনুর্গুণ বার বার ছেদন করতে লাগলেন। কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন এক ভয়ংকর লৌহময় দিব্যাস্ত্র মন্ত্রপাঠ ক’রে তাঁর ধনুতে যোজনা করলেন। এই সময়ে কর্ণের রথচক্র আরও ভূপ্রবিষ্ট হ’ল। ক্রোধে অশ্রুপাত ক’রে কর্ণ বললেন, পাণ্ডুপুত্র, মুহূর্তকাল অপেক্ষা কর, দৈবক্রমে আমার রথের বাম চক্র ভূমিতে ব’সে গেছে। তুমি কাপুরুষের অভিসন্ধি ত্যাগ কর, সাধুস্বভাব বীরগণ যাচমান বা দুর্দশাপন্ন বিপক্ষের প্রতি অশ্বক্ষেপণ করেন না। তোমাকে বা বাসুদেবকে আমি ভয় করি না, তুমি মহাকুলবিবর্ধন ক্ষত্রিয়পুত্র, ধর্মোপদেশ স্মরণ ক’রে ক্ষণকাল ক্ষমা কর।

 কৃষ্ণ বললেন, রাধেয়, অদৃষ্টের বশে এখন তুমি ধর্ম স্মরণ করছ। নীচ লোকে বিপদে পড়লে দৈবের নিন্দা করে, নিজের কুকর্মের নিন্দা করে না। তুমি যখন দুর্যোধন দুঃশাসন আর শকুনির সঙ্গে মিলে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় আনিয়েছিলে তখন তোমার ধর্ম স্মরণ হয় নি। যখন অক্ষনিপুণ শকুনি অনভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তোমার সম্মতিতে দুর্যোধন ভীমকে বিষযুক্ত খাদ্য দিয়েছিল, জতুগৃহে সুপ্ত পাণ্ডবদের যখন দগ্ধ করবার চেষ্টা করেছিল, দুঃশাসন কর্তৃক গৃহীতা রজস্বলা দ্রৌপদীকে যখন তুমি উপহাস করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? ত্রয়োদশ বর্ষ অতীত হ’লেও তোমরা যখন পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দাও নি, বহু মহারথের সঙ্গে মিলে যখন বালক অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? এই সব সময়ে যদি তোমার ধর্ম না থাকে তবে এখন ধর্ম ধর্ম ক’রে তালু শুখিয়ে লাভ কি? আজ তুমি যতই ধর্মাচরণ কর তথাপি নিষ্কৃতি পাবে না।

 বাসুদেবের কথা শুনে কর্ণ লজ্জায় অধোবদন হলেন, কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি ক্রোধে ওষ্ঠ স্পন্দিত করে ধনু তুলে নিয়ে অর্জুনকে মারবার জন্য একটি ভয়ংকর বাণ যোজনা করলেন। মহাসর্প যেমন বল্মীকে প্রবেশ করে, কর্ণের বাণ সেইরূপ অর্জুনের বাহুমধ্যে প্রবেশ করলে। অর্জুনের মাথা ঘুরতে লাগল, দেহ কাঁপতে লাগল, হাত থেকে গাণ্ডীব প’ড়ে গেল। এই অবসরে কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে নেমে দুই হাত দিয়ে রথচক্র তোলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন অর্জুন সংজ্ঞালাভ ক’রে ক্ষুরপ্র বাণ দিয়ে কর্ণের রত্নভূষিত ধ্বজ এবং তার উপরিস্থ উজ্জ্বল হস্তিরজ্জুলাঞ্ছন কেটে ফেললেন। তার পর তিনি তূণ থেকে বজ্র অগ্নি ও যমদণ্ডের ন্যায় করাল অঞ্জলিক বাণ তুলে নিয়ে বললেন, যদি আমি তপস্যা ও যজ্ঞ ক’রে থাকি, গুরুজনকে সন্তুষ্ট করে থাকি, সুহৃদ্‌গণের বাক্য শুনে থাকি, তবে এই বাণ আমার শত্রুর প্রাণহরণ করুক।

 অপরাহ্ণকালে অর্জুন সেই অঞ্জলিক বাণ দ্বারা কর্ণের মস্তক ছেদন করলেন। রক্তবর্ণ সূর্য যেমন অস্তাচল থেকে পতিত হন, সেইরূপ সেনাপতি কর্ণের উত্তমাঙ্গ ভূমিতে পতিত হ’ল। সকলে দেখলে, কর্ণের নিপতিত দেহ থেকে একটি তেজ আকাশে উঠে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করলে। কৃষ্ণ অর্জুন ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ হৃষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণ সিংহনাদ ও তূর্যধ্বনি ক’রে বস্ত্র ও বাহু সঞ্চালন করতে লাগল। বীর কর্ণ শোণিতাক্তদেহে শরাচ্ছন্ন হয়ে ভূমিতে প’ড়ে আছেন দেখে মদ্ররাজ শল্য ধ্বজহীন রথ নিয়ে চ’লে গেলেন।

২১। দুর্যোধনের বিষাদ—যুধিষ্ঠিরের হর্ষ

(সপ্তদশ দিনের যুদ্ধান্ত)

 হতবুদ্ধি দুঃখার্ত শল্য দুর্যোধনের কাছে এসে বললেন, ভরতনন্দন, আজ কর্ণ ও অর্জুনের যে যুদ্ধ হয়েছে তেমন আর কখনও হয় নি। দৈবই পাণ্ডবদের রক্ষা করেছেন এবং আমাদের বিনষ্ট করেছেন। শল্যের কথা শুনে দুর্যোধন নিজের দুর্নীতির বিষয় চিন্তা ক’রে এবং শোকে অচেতনপ্রায় হয়ে বার বার নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তার পর তিনি সারথিকে রথ চালাবার আদেশ দিয়ে বললেন, আজ আমি কৃষ্ণ অর্জুন ভীম ও অবশিষ্ট শত্রুদের বধ ক’রে কর্ণের কাছে ঋণমুক্ত হব।

 রথ অশ্ব ও গজ বিহীন পঁচিশ হাজার কৌরবপক্ষীয় পদাতি সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ল। ভীমসেন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন চতুরঙ্গ বল নিয়ে তাদের আক্রমণ করলেন। পদাতি সৈন্যের সঙ্গে ধর্মানুসারে যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় ভীম রথ থেকে নামলেন এবং বৃহৎ গদা নিয়ে দণ্ডপাণি যমের ন্যায় সৈন্য বধ করতে লাগলেন। অর্জুন নকুল সহদেব ও সাত্যকিও যুদ্ধে রত হলেন। কৌরবসৈন্য ভগ্ন হয়ে পালাতে লাগল। তখন দুর্যোধন আশ্চর্য পৌরুষ দেখিয়ে একাকী সমস্ত পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি স্বপক্ষের পলায়মান যোদ্ধাদের বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, শোন, পৃথিবীতে বা পর্বতে এমন স্থান নেই যেখানে গেলে তোমরা পাণ্ডবদের হাত থেকে নিস্তার পাবে। ওদের সৈন্য অল্পই অবশিষ্ট আছে, কৃষ্ণার্জুনও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আমরা সকলে এখানে থাকলে নিশ্চয় আমাদের জয় হবে। কালান্তক যম সাহসী ও ভীরু উভয়কেই বধ করেন, তবে ক্ষত্রিয়ব্রতধারী কোন্ মূঢ় যুদ্ধ ত্যাগ করে? তোমরা পালালে নিশ্চয় ক্রুদ্ধশত্রু ভীমের হাতে পড়বে, তার চেয়ে যুদ্ধে নিহত হয়ে স্বর্গলাভ করা শ্রেয়।

 সৈন্যেরা দুর্যোধনের কথা না শুনে পালাতে লাগল। তখন ভীত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মদ্ররাজ শল্য দুর্যোধনকে বললেন, আমাদের অসংখ্য রথ অশ্ব গজ ও সৈন্য বিনষ্ট হয়ে এই রণভূমিতে প’ড়ে আছে। দুর্যোধন, নিবৃত্ত হও, সৈন্যেরা ফিরে যাক, তুমিও শিবিরে যাও, দিবাকর অস্তে যাচ্ছেন। রাজা, তুমিই এই লোকক্ষয়ের কারণ। দুর্যোধন ‘হা কর্ণ, হা কর্ণ’ ব’লে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা প্রভৃতি যোদ্ধারা দুর্যোধনকে বার বার আশ্বাস দিলেন এবং নর-অশ্ব-মাতঙ্গের রক্তে সিক্ত রণভূমি দেখতে দেখতে শিবিরে প্রস্থান করলেন। ভক্তবৎসল রক্তবর্ণ ভগবান সূর্য কিরণজালে কর্ণের রুধিরসিক্ত দেহ স্পর্শ ক’রে যেন স্নানের ইচ্ছায় পশ্চিম সমুদ্রে গমন করলেন।

 কল্পবৃক্ষ যেমন পক্ষীদের আশ্রয়, কর্ণ সেইরূপে প্রার্থীদের আশ্রয় ছিলেন। সৎস্বভাব প্রার্থীকে তিনি কখনও ফিরিয়ে দিতেন না। তাঁর সমস্ত বিত্ত এবং জীবন কিছুই ব্রাহ্মণকে অদেয় ছিল না। প্রার্থিগণের প্রিয় দানপ্রিয় সেই কর্ণ পার্থের হস্তে নিহত হয়ে পরমগতি লাভ করলেন।

 যুধিষ্ঠির কর্ণার্জুনের যুদ্ধ দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু পুনর্বার কর্ণের বাণে আহত হয়ে নিজের শিবিরে ফিরে যান। কর্ণবধের পর কৃষ্ণার্জুন তাঁর কাছে গেলেন এবং চরণবন্দনা ক’রে বিজয়সংবাদ দিলেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত প্রীত হয়ে কৃষ্ণার্জুনের রথে উঠলেন এবং রণভূমিতে শয়ান পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণকে দেখতে এলেন। তার পর তিনি কৃষ্ণ ও অর্জুনের বহু প্রশংসা ক’রে বললেন, গোবিন্দ, তের বৎসর পরে তোমার প্রসাদে আজ আমি সুখে নিদ্রা যাব।

  1. অর্থাৎ যুদ্ধ ক’রে আপনার অন্নদাতা কৌরবদের ঋণ শোধ করুন।
  2. কিন্তু এর পরেও সংশপ্তকরা যুদ্ধ করেছে।
  3. ভীষ্মপর্ব ৬-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  4. মাথায় জল দিয়ে যাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়েছে। আর এক অর্থ — ব্রাহ্মণ পিতা ও ক্ষত্রিয়া মাতার পুত্র।
  5. উদ্‌যোগপর্ব ৩-পরিচ্ছেদে শল্য-যুধিষ্ঠিরের আলাপ দ্রষ্টব্য।
  6. প্রচলিত অর্থ কাঁজি বা আমানি; এখানে বোধ হয় ধেনো মদ বা পচাই অর্থ।
  7. মদ্য বিশেষ।
  8. পশমী কাপড়।
  9. বাহ্ণীকের নামান্তর।
  10. আদিপর্ব ১২-পরিচ্ছেদে অনুরূপ শ্লোক আছে।
  11. গোঁফদাড়িহীন, মাকুন্দ। দ্রোণপর্ব ১৩-পরিচ্ছেদে কর্ণ ভীমকে তূবরক বলেছেন।
  12. আদিপর্ব ৪০-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  13. মূলে আছে ‘কিঙ্কুমাত্রম্’, তার অর্থ এক হাত বা এক বিঘত।