মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শল্যপর্ব/শল্যবধপর্বাধ্যায়

শল্যপর্ব

॥ শল্যবধপর্বাধ্যায়॥

১। কৃপ-দুর্যোধন-সংবাদ

 কৌরবপক্ষের দুরবস্থা দেখে সৎস্বভাব তেজস্বী বৃদ্ধ কৃপাচার্য কৃপাবিষ্ট হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধধর্মই শ্রেষ্ঠ, পিতা পুত্র ভ্রাতা মাতুল ভাগিনেয় সম্বন্ধী ও বান্ধবের সঙ্গেও ক্ষত্রিয়কে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে মৃত্যুই ক্ষত্রিয়ের পরমধর্ম এবং পলায়নই অধর্ম। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ জয়দ্রথ, তোমার ভ্রাতারা, এবং তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, সকলেই গত হয়েছেন, আমরা কাকে আশ্রয় করব? সাধুস্বভাব পাণ্ডবদের প্রতি তোমরা অকারণে অসদ্‌ব্যবহার করেছ, তারই ফল এখন উপস্থিত হয়েছে। বৎস, যুদ্ধে সাহায্যের জন্য তুমি যেসকল যোদ্ধাকে আনিয়েছ তাঁদের এবং তোমার নিজেরও প্রাণসংশয় হয়েছে, এখন তুমি আত্মরক্ষা কর। বৃহস্পতির নীতি এই—বিপক্ষের চেয়ে ক্ষীণ হ’লে অথবা তার সমান হ’লে সন্ধি করবে, বলবান হ’লে যুদ্ধ করবে। আমরা এখন হীনবল, অতএব পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করাই উচিত। ধৃতরাষ্ট্র ও কৃষ্ণ অনুরোধ করলে দয়ালু যুধিষ্ঠির নিশ্চয় তোমাকে রাজপদ দেবেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতিও সম্মত হবেন।

 শোকাতুর দুর্যোধন কিছুকাল চিন্তা করে বললেন, সুহৃদের যা বলা উচিত আপনি তাই বলেছেন, প্রাণের মায়া ত্যাগ ক’রে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছেন। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, মুমূর্ষুর যেমন ঔষধে রুচি হয় না সেইরূপ আপনার যুক্তিসম্মত হিতবাক্য আমার ভাল লাগছে না। আমরা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলাম, তাঁর প্রেরিত দূত কৃষ্ণকেও প্রতারিত করেছিলাম; এখন তিনি আমার অনুরোধ শুনবেন কেন? আমরা অভিমন্যুকে বিনষ্ট করেছি, কৃষ্ণ ও অর্জুন আমাদের হিতাচরণ করবেন কেন? কোপনস্বভাব ভীম উগ্র প্রতিজ্ঞা করেছে, সে মরবে তবু নত হবে না। যমতুল্য নকুল-সহদেব অসি ও চর্ম ধারণ ক’রেই আছে; ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর সঙ্গেও আমার শত্রুতা আছে। দ্যূতসভায় সকলের সমক্ষে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই দ্রৌপদী আমার বিনাশ ও ভর্তৃগণের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উগ্র তপস্যা করছেন, তিনি প্রত্যহ হোমস্থানে শয়ন করেন; কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা অভিমান ও দর্প ত্যাগ ক’রে সর্বদা দাসীর ন্যায় দ্রৌপদীর সেবা করেন। এইসকল কারণে এবং বিশেষত অভিমন্যুবধের ফলে যে বৈরানল প্রজ্বলিত হয়েছে তা নির্বাপিত হয় নি, অতএব কি ক’রে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি হবে? সাগরাম্বরা পৃথিবীর রাজা হয়ে আমি কি ক’রে পাণ্ডবদের প্রসাদে রাজ্য ভোগ করব, দাসের ন্যায় যুধিষ্ঠিরের পিছনে যাব, আত্মীয়দের সঙ্গে দীনভাবে জীবিকানির্বাহ করব? এখন ক্লীবের ন্যায় আচরণের সময় নয়, আমাদের যুদ্ধ করাই উচিত। যে বীরগণ আমার জন্য নিহত হয়েছেন তাঁদের উপকার স্মরণ ক’রে এবং তাঁদের ঋণ শোধের বাসনায় আমার রাজ্যের প্রতিও আর রুচি নেই। পিতামহ ভ্রাতা ও বয়স্যগণকে নিপাতিত ক’রে যদি আমি নিজের জীবন রক্ষা করি তবে লোকে নিশ্চয় আমার নিন্দা করবে। আমি যুধিষ্ঠিরকে প্রণিপাত ক’রে রাজ্যলাভ করতে চাই না, বরং ন্যায়যুদ্ধে হত হয়ে স্বর্গলাভ করব।

 দুর্যোধনের কথা শুনে ক্ষত্রিয়গণ প্রশংসা ক’রে সাধু সাধু বলতে লাগলেন এবং পরাজয়ের জন্য শোক না ক’রে যুদ্ধের নিমিত্ত ব্যগ্র হলেন। তার পর তাঁরা বাহনদের পরিচর্যা ক’রে হিমালয়ের নিকটবর্তী বৃক্ষহীন সমতল প্রদেশে গেলেন এবং অরুণবর্ণ সরস্বতী নদীতে স্নান ও তার জল পান করলেন। সেখানে কিছুকাল থেকে তাঁরা দুর্যোধন কর্তৃক উৎসাহিত হ’য়ে রাত্রিবাসের জন্য শিবিরে ফিরে এলেন।

২। শল্যের সেনাপতিত্বে অভিষেক

 কৌরবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ, আপনি সেনাপতি নিযুক্ত ক’রে যুদ্ধ করুন, আমরা তৎকর্তৃক রক্ষিত হয়ে শত্রু জয় করব। দুর্যোধন রথারোহণে অশ্বত্থামার কাছে গেলেন — যিনি তেজে সূর্যতুল্য, বুদ্ধিতে বৃহস্পতিতুল্য, যাঁর পিতা অযোনিজ এবং মাতাও অযোনিজা, যিনি রূপে অনুপম, সর্ববিদ্যার পারগামী এবং গুণের সাগর। দুর্যোধন তাঁকে বললেন, গুরু পুত্র, এখন আপনিই আমাদের পরমগতি, আদেশ করুন কে আমাদের সেনাপতি হবেন।

 অশ্বত্থামা বললেন, শল্যের কুল রূপ তেজ যশ শ্রী ও সর্বপ্রকার গুণই আছে, ইনিই আমাদের সেনাপতি হ’ন। এই কৃতজ্ঞ নরপতি নিজের ভাগিনেয়দের ত্যাগ ক’রে আমাদের পক্ষে এসেছেন। ইনি মহাসেনার অধীশ্বর এবং দ্বিতীয় কার্তিকের ন্যায় মহাবাহু। দুর্যোধন ভূমিতে দাঁড়িয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে রথস্থ শল্যকে বললেন, মিত্রবৎসল, মিত্র ও শত্রু পরীক্ষা করবার সময় উপস্থিত হয়েছে, আপনি আমাদের সেনার অগ্রে থেকে নেতৃত্ব করুন, আপনি রণস্থলে গেলে মন্দমতি পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এবং তাদের অমাত্যবর্গ নিরুদ্যম হবে। মদ্রাধিপ শল্য উত্তর দিলেন, কুরুরাজ, তুমি আমাকে দিয়ে যা করাতে চাও আমি তাই করব, আমার রাজ্য ধন প্রাণ সবই তোমার প্রিয়সাধনের জন্য। দুর্যোধন বললেন, বীরশ্রেষ্ঠ অতুলনীয় মাতুল, আপনাকে সেনাপতিত্বে বরণ করছি, কার্তিক যেমন দেবগণকে রক্ষা করেছিলেন সেইরূপ আপনি আমাদের রক্ষা করুন। শল্য বললেন, দুর্যোধন, শোন — কৃষ্ণ আর অর্জুনকে তুমি রথিশ্রেষ্ঠ মনে কর, কিন্তু তাঁরা বাহুবলে কিছুতেই আমার তুল্য নন। আমি ক্রুদ্ধ হ’লে সুরাসুর ও মানব সমেত সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি, পাণ্ডবরা তো দূরের কথা। আমি সেনাপতি হয়ে জয়লাভ করব এতে সন্দেহ নেই।

 দুর্যোধন শল্যকে যথাবিধি সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করলেন। সৈন্যেরা সিংহনাদ করে উঠল, নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি হ’ল, কৌরব ও মদ্রদেশীয় যোদ্ধারা হৃষ্ট হয়ে শল্যের স্তুতি করতে লাগলেন। সকলে সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।


 পাণ্ডবশিবিরে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, দুর্যোধন মহাধনুর্ধর শল্যকে সেনাপতি করেছেন। তুমিই আমাদের নেতা ও রক্ষক, অতএব এখন যা কর্তব্য তার ব্যবস্থা কর। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, আমি শল্যকে জানি, তিনি ভীষ্ম দ্রোণ ও কর্ণের সমান অথবা তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। শল্যের বল ভীম অর্জুন সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর অপেক্ষা অধিক। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি বিক্রমে শার্দূলতুল্য, আপনি ভিন্ন অন্য পুরুষ পৃথিবীতে নেই যিনি যুদ্ধে মদ্ররাজকে বধ করতে পারেন। তিনি সম্পর্কে মাতুল এই ভেবে দয়া করবেন না, ক্ষত্রধর্মকে অগ্রগণ্য ক’রে শল্যকে বধ করুন। ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণরূপ সাগর উত্তীর্ণ হ’য়ে এখন শল্য-রূপ গোষ্পদে নিমজ্জিত হবেন না। এইপ্রকার উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ সায়ংকালে তাঁর শিবিরে প্রস্থান করলেন। কর্ণবধে আনন্দিত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ সেই রাত্রিতে সুখে নিদ্রা গেলেন।

৩। শল্যবধ

(অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন প্রভাতে কৃপ কৃতবর্মা অশ্বত্থামা শল্য শকুনি প্রভৃতি দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নিয়ম করলেন যে তাঁরা কেউ একাকী পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে করবেন না, পরস্পরকে রক্ষা করে মিলিত হয়েই যুদ্ধ করবেন। শল্য সর্বতোভদ্র নামক ব্যূহ রচনা করলেন এবং মদ্রদেশীয় বীরগণ ও কর্ণপুত্রদের সঙ্গে ব্যূহের সম্মুখে রইলেন। ত্রিগর্ত সৈন্য সহ কৃতবর্মা ব্যূহের বামে, শক ও যবন সৈন্য সহ কৃপাচার্য দক্ষিণে, কাম্বোজ সৈন্য সহ অশ্বত্থামা পৃষ্ঠদেশে, এবং কুরুবীরগণ সহ দুর্যোধন ব্যূহের মধ্যদেশে অবস্থান করলেন। পাণ্ডবগণও নিজেদের সৈন্য ব্যূহবদ্ধ ও দ্বিধা বিভক্ত ক’রে অগ্রসর হলেন। কৌরবপক্ষে এগার হাজার রথী, দশ হাজার সাত শ গজারোহী, দু লক্ষ অশ্বারোহী ও তিন কোটি পদাতি, এবং পাণ্ডবপক্ষে ছ হাজার রথী, ছ হাজার গজারোহী, দশ হাজার অশ্বারোহী ও দু কোটি পদাতি অবশিষ্ট ছিল।

 দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। কর্ণপুত্র চিত্রসেন সত্যসেন ও সুশর্মা নকুলের হাতে নিহত হলেন। পাণ্ডবপক্ষের গজ অশ্ব রথী ও পদাতি সৈন্য শল্যের বাণে নিপীড়িত ও বিচলিত হ’ল। সহদেব শল্যের পুত্রকে বধ করলেন। ভীমের গদাঘাতে শল্যের চার অশ্ব নিহত হ’ল, শল্যও তোমর নিক্ষেপ ক’রে ভীমের বক্ষ বিদ্ধ করলেন। বৃকোদর অবিচলিত থেকে সেই তোমর টেনে নিলেন এবং তারই আঘাতে শল্যের সারথির হৃদয় বিদীর্ণ করলেন। পরস্পরের প্রহারে দুজনেই আহত ও বিহ্বল হলেন, তখন কৃপাচার্য শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চ’লে গেলেন। ক্ষণকাল পরে ভীমসেন উঠে দাঁড়ালেন এবং মত্তের ন্যায় বিহ্বল হয়ে মদ্ররাজকে আবার যুদ্ধে আহ্বান করলেন।

 দুর্যোধনের প্রাসের আঘাতে যাদববীর চেকিতান নিহত হলেন। শল্যকে অগ্রবর্তী ক’রে কৃপাচার্য কৃতবর্মা ও শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এবং তিন হাজার রথী সহ অশ্বত্থামা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের এবং কৃষ্ণকে ডেকে বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ও অন্যান্য পরাক্রান্ত বহু রাজা কৌরবদের জন্য যুদ্ধ ক’রে নিহত হয়েছেন, তোমরাও উৎসাহের সহিত নিজ নিজ কর্তব্যে পুরুষকার দেখিয়েছ। এখন আমার ভাগে কেবল মহারথ শল্য অবশিষ্ট আছেন, আজ আমি তাঁকে যুদ্ধে জয় করতে ইচ্ছা করি। বীরগণ, আমার সত্য বাক্য শোন—আজ শল্য আমাকে বধ করবেন অথবা আমি তাঁকে বধ করব, আজ আমি বিজয়লাভ বা মৃত্যুর জন্য ক্ষত্রধর্মানুসারে মাতুলের সঙ্গে যুদ্ধ করব। বথযোজকগণ[] আমার রথে প্রচুর অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ রাখুক; সাত্যকি দক্ষিণচক্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন বামচক্র, এবং অর্জুন আমার পৃষ্ঠ রক্ষা করুন, ভীম আমার অগ্রে থাকুন; এতে আমার শক্তি শল্য অপেক্ষা অধিক হবে। যুধিষ্ঠিরের প্রিয়কামিগণ তাঁর আদেশ পালন করলেন।

 আমিষলোভী দুই শার্দূলের ন্যায় যুধিষ্ঠির ও শল্য বিবিধ বাণ দ্বারা পরস্পর প্রহার করতে লাগলেন, ভীম ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি এবং নকুল-সহদেবও শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন। কৌরবগণ আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির যিনি পূর্বে মৃদু ও শান্ত ছিলেন, এখন তিনি দারুণ হয়েছেন, এবং ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ভল্লের আঘাতে শতসহস্র যোদ্ধাকে বধ করছেন। যুধিষ্ঠির শল্যের চার অশ্ব ও দুই পৃষ্ঠসারথিকে বিনষ্ট করলেন, তখন অশ্বত্থামা বেগে এসে শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চ’লে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে শল্য অন্য রথে চ’ড়ে পুনর্বার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন।

 শল্যের চার বাণে যুধিষ্ঠিরের চার অশ্ব নিহত হ’ল, তখন ভীমসেনও শল্যের চার অশ্ব ও সারথিকে বিনষ্ট করলেন। শল্য রথ থেকে নেমে খড়্‌গ ও চর্ম নিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন, কিন্তু ভীমসেন শরাঘাতে শল্যের চর্ম এবং ভল্ল দ্বারা তাঁর খড়্‌গের মুষ্টি ছেদন করলেন। যুধিষ্ঠির তখন গোবিন্দের বাক্য স্মরণ ক’রে শল্যবধে যত্নবান হলেন। তিনি অশ্বসারথিহীন রথে আরূঢ় থেকেই একটি স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল মন্ত্রসিদ্ধ শক্তি অস্ত্র নিলেন, এবং ‘পাপী, তুমি হত হ’লে’ — এই বলে বিস্ফারিত দীপ্তনয়নে মদ্ররাজকে লক্ষ্য ক’রে নিক্ষেপ করলেন। প্রলয়কালে আকাশ থেকে পতিত মহতী উল্কার ন্যায় সেই শক্তি অস্ত্র স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে মহাবেগে শল্যের অভিমুখে গেল, এবং তাঁর শুভ্র বর্ম ও বিশাল বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে জলের ন্যায় ভূমিতে প্রবিষ্ট হ’ল। বজ্রাহত পর্বতশৃঙ্গের ন্যায় শল্য বাহু প্রসারিত ক’রে ভূমিতে পড়ে গেলেন।

 শল্য নিপতিত হ’লে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রথারোহণে যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন এবং বহু নারাচ নিক্ষেপ ক’রে তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির শল্যভ্রাতার ধনু ও ধ্বজ ছেদন ক’রে ভল্লের আঘাতে তাঁর মস্তক দেহচ্যুত করলেন। কৌরবসৈন্য ভগ্ন হ’য়ে হাহাকার ক’রে পালাতে লাগল।

 শল্য নিহত হ’লে তাঁর অনুচর সাত শ রথী কৌরবসেনা থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই সময়ে একটি পর্বতাকার হস্তীতে চ’ড়ে দুর্যোধন সেখানে এলেন; একজন তাঁর মস্তকের উপর ছত্র ধরেছিল, আর একজন তাঁকে চামর বীজন করছিল। দুর্যোধন বার বার মদ্রযোদ্ধাদের বললেন, যাবেন না, যাবেন না। অবশেষে তাঁরা দুর্যোধনের অনুরোধে পুনর্বার পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। শল্য হত হয়েছেন এবং মদ্রদেশীয় মহারথগণ ধর্মরাজকে পীড়িত করছেন শুনে অর্জুন সত্বর সেখানে এলেন, ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি প্রভৃতিও যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার জন্য বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণের আক্রমণে মদ্রবীরগণ বিনষ্ট হলেন, তখন দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য ভীত ও চঞ্চল হয়ে পালাতে লাগল। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন।

৪। শাল্ববধ

(অষ্টাদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 মধ্যাহ্ণকালে যুধিষ্ঠির শল্যকে বধ করলেন, কৌরবসেনাও পরাজিত হয়ে যুদ্ধে পরাঙ্‌মুখ হ’ল। পাণ্ডব ও পাঞ্চাল সৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ ধৈর্যশালী যুধিষ্ঠির জয়ী হলেন, দুর্যোধন রাজশ্রীহীন হলেন। আজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনবেন এবং শোকাকুল হয়ে ভূমিতে প’ড়ে নিজের পাপ স্বীকার করবেন। আজ থেকে দুর্যোধন দাস হয়ে পাণ্ডবদের সেবা করবেন এবং তাঁরা যে দুঃখ পেয়েছেন তা বুঝবেন। যুধিষ্ঠির ভীমার্জুন নকুল-সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র যে পক্ষের যোদ্ধা সে পক্ষের জয় হবে না কেন? জগন্নাথ জনার্দন কৃষ্ণ যাঁদের প্রভু, যাঁরা ধর্মকে আশ্রয় করেছেন, সেই পাণ্ডবদের জয় হবে না কেন?

 ভীমসেনের ভয়ে ব্যাকুল হয়ে কৌরবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন তাঁর সারথিকে বললেন, তুমি ওই সৈন্যদের পশ্চাতে ধীরে ধীরে রথ নিয়ে চল, আমি রণস্থলে থেকে যুদ্ধ করলে আমার সৈন্যেরা সাহস পেয়ে ফিরে আসবে। সারথি রথ নিয়ে চলল, তখন হস্তী অশ্ব ও রথবিহীন একুশ হাজার পদাতি এবং নানাদেশজাত বহু যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ ক’রে পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হ’ল। ভীমসেন তাঁর স্বর্ণমণ্ডিত বৃহৎ গদার আঘাতে সকলকেই নিষ্পেষিত করলেন। দুর্যোধন তাঁর পক্ষের অবশিষ্ট সৈন্যদের উৎসাহ দিতে লাগলেন, তারা বার বার ফিরে এসে যুদ্ধে রত হ’ল, কিন্তু প্রতি বারেই বিধ্বস্ত হয়ে পালাল।

 দুর্যোধনের একটি মহাবংশজাত প্রিয় হস্তী ছিল, গজশাস্ত্রজ্ঞ লোকে তার পরিচর্যা করত। ম্লেচ্ছাধিপতি শাল্ব সেই পর্বতাকার হস্তীতে চ’ড়ে যুদ্ধ করতে এলেন এবং প্রচণ্ড বাণবর্ষণ ক’রে পাণ্ডবসৈন্যদের যমালয়ে পাঠাতে লাগলেন। সকলে দেখলে, সেই বিশাল হস্তী একাই যেন বহু সহস্র হয়ে সর্বত্র বিচরণ করছে। পাণ্ডবসেনা বিমর্দিত হ’য়ে পালাতে লাগল। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন বেগে ধাবিত হয়ে বহু নারাচ নিক্ষেপ ক’রে সেই হস্তীকে বিদ্ধ করলেন। শাল্ব অঙ্কুশ প্রহার ক’রে হস্তীকে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দিকে চালিয়ে দিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ভয় পেয়ে রথ থেকে নেমে পড়লেন, তখন সেই হস্তী শুণ্ড দ্বারা অশ্ব ও সারথি সমেত রথ তুলে নিয়ে ভূতলে ফেলে নিষ্পেষিত করলে। ভীম শিখণ্ডী ও সাত্যকি শরাঘাতে হস্তীকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাকে থামাতে পারলেন না। বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর পর্বতশৃঙ্গাকার গদা দিয়ে হস্তীর কুম্ভদেশে (মস্তকপার্শ্বস্থ দুই মাংসপিণ্ডে) প্রচণ্ড আঘাত করলেন। আর্তনাদ ও রক্তবমন ক’রে সেই গজেন্দ্র ভূপতিত হ’ল, তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন ভল্লের আঘাতে শাল্বের শিরশ্ছেদ করলেন।

৫। উলূক-শকুনি-বধ

(অষ্টাদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 মহাবীর শাল্ব নিহত হ’লে কৌরবসৈন্য আবার ভগ্ন হ’ল। রুদ্রের ন্যায় প্রতাপবান দুর্যোধন তথাপি অদম্য উৎসাহে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন, পাণ্ডবগণ মিলিত হয়েও তাঁর সম্মুখে দাঁড়াতে পারলেন না। অশ্বত্থামা শকুনি উলূক এবং কৃপাচার্যও পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে সাত শ রথী যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের হস্তে তাঁরা নিহত হলেন। তার পর নানা দিকে বিশৃঙ্খল ভাবে যুদ্ধ হ’তে লাগল। গান্ধাররাজ শকুনি দশ হাজার প্রাসধারী অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এলেন, কিন্তু তাঁর বহু সৈন্য নিহত হ’ল। ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধনের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করলেন, তখন দুর্যোধন একটি অশ্বের পৃষ্ঠে চ’ড়ে শকুনির কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁদের রথারোহী যোদ্ধাদের ত্যাগ ক’রে শকুনি-দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হলেন।

 ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ ক’রে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রতিদিন যুদ্ধশেষে ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবৃত্তান্ত জানাতেন[]। কৌরবসৈন্য ক্ষীণ এবং শত্রুসৈন্য বেষ্টিত হয়েছে দেখে সঞ্জয় ও চার জন যোদ্ধা প্রাণের মায়া ত্যাগ ক’রে ধৃষ্টদ্যুম্নের সৈন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে নিপীড়িত হয়ে অবশেষে যুদ্ধে বিরত হলেন। সাত্যকির প্রহারে সঞ্জয়ের বর্ম বিদীর্ণ হ’ল, তিনি মূর্ছিত হলেন, তখন সাত্যকি তাঁকে বন্দী করলেন।

 দুর্মর্ষণ শ্রুতান্ত জৈত্র প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের দ্বাদশ পুত্র ভীমসেনের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন, কিন্তু সকলেই নিহত হলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ভীমসেন ধৃতরাষ্ট্রের সকল পুত্রকেই বধ করেছেন, যে দুজন (দুর্যোধন ও সন্দর্শন) অবশিষ্ট আছে তারাও আজ নিহত হবে। শকুনির পাঁচ শত অশ্ব, দুই শত রথ, এক শত গজ ও এক সহস্র পদাতি, এবং কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা কৃপ সুশর্মা শকুনি উলূক ও কৃতবর্মা এই ছ’জন বীর অবশিষ্ট আছেন; দুর্যোধনের এর অধিক বল নেই। মূঢ় দুর্যোধন যদি যুদ্ধ থেকে না পালায় তবে তাকে নিহত ব’লেই জানবে।

 তার পর অর্জুন ত্রিগর্তদেশীয় সত্যকর্মা সত্যেষু সুশর্মা, সুশর্মার পঁয়তাল্লিশ জন পুত্র, এবং তাঁদের অনুচরদের বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধনভ্রাতা সুদর্শন ভীমসেন কর্তৃক নিহত হলেন। শকুনি, তাঁর পত্রে উলূক, এবং তাঁদের চরগণ মৃত্যুপণ ক’রে পাণ্ডবদের প্রতি ধাবিত হলেন। সহদেব ভল্লের আঘাতে উলূকের শিরশ্ছেদ করলেন। শকুনি সাশ্রুকণ্ঠে সাশ্রুনয়নে যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং একটি ভীষণ শক্তি অস্ত্র সহদেবের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সহদেব বাণদ্বারা সেই শক্তি ছেদন ক’রে ভল্লের আঘাতে শকুনির মস্তক দেহচ্যুত করলেন। শকুনির অনুচরগণও অর্জুনের হস্তে নিহত হ’ল।

  1. যারা রথে যুদ্ধোপকরণ যোগান দেয়।
  2. ভীষ্মপর্ব ২-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।