মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/সংশপ্তকবধপর্বাধ্যায়

॥ সংশপ্তকবধপর্বাধ্যায়॥

৪। সংশপ্তকগণের শপথ

 দুই পক্ষের যোদ্ধারা নিজ নিজ শিবিরে ফিরে এলেন। দ্রোণ দুঃখিত ও লজ্জিত হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই বলেছি যে ধনঞ্জয় উপস্থিত থাকলে দেবতারাও যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারবেন না। কৃষ্ণার্জুন অজেয়, এ বিষয়ে তুমি সন্দেহ ক’রো না। কোনও উপায়ে অর্জুনকে সরাতে পারলেই যুধিষ্ঠির তোমার বশে আসবেন। কেউ যদি অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান ক’রে অন্যত্র নিয়ে যায় তবে অর্জুন জয়লাভ না ক’রে কখনই ফিরবেন না, সেই অবকাশে আমি পাণ্ডবসৈন্য ভেদ ক’রে ধৃষ্টদ্যুম্নের সমক্ষেই যুধিষ্ঠিরকে হরণ করব।

 দ্রোণাচার্যের কথা শুনে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তাঁর ভ্রাতারা বললেন, অর্জুন সর্বদা অকারণে আমাদের অপমান করেন সেজন্য ক্রোধে আমাদের নিদ্রা হয় না। রাজা, যে কার্য আপনার প্রিয় আমাদের যশস্ব তা আমরা করব, অর্জুনকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বধ করব। আমরা সত্য প্রতিজ্ঞা করছি— পৃথিবী অর্জুনহীন অথবা ত্রিগর্তহীন হবে।

 অযুত রথারোহী যোদ্ধার সহিত ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তাঁর পাঁচ ভ্রাতা সত্যরথ সত্যবর্মা সত্যব্রত সত্যেষু ও সত্যকর্মা, তিন অযুত রথের সহিত মালব ও তুণ্ডিকেরগণ, অযুত রথের সহিত মাবেল্লক ললিত্থ ও মদ্রকগণ, এবং নানা জনপদ হ’তে আগত অযুত রথী, শপথ গ্রহণে উদ্‌যোগী হলেন। তাঁরা পৃথক পৃথক অগ্নিতে হোম ক’রে কুশনির্মিত কৌপীন ও বিচিত্র কবচ পরিধান করলেন এবং ঘৃতাক্তদেহে মৌবী মেখলা ধারণ ক’রে ব্রাহ্মণগণকে সম্পূর্ণ ধেনু ও বস্ত্র দান করলেন। তার পর অগ্নি প্রজ্বালিত ক’রে উচ্চস্বরে এই প্রতিজ্ঞা করলেন—

 যদি আমরা ধনঞ্জয়কে বধ না করে যুদ্ধ থেকে ফিরি, যদি তাঁর নিপীড়নে ভীত হয়ে যুদ্ধে পরাঙ্‌মুখ হই, তবে মিথ্যাবাদী ব্রহ্মঘাতী মদ্যপ গুরুদারগামী ও পরস্বহারকের যে নরক সেই নরকে আমরা যাব; যারা রাজবৃত্তি হরণ করে, শরণাগতকে ত্যাগ করে, প্রার্থীকে হত্যা করে, গৃহদাহ করে, গোহত্যা করে, অন্যের অপকার করে, বেদের বিদ্বেষ করে, ঋতুকালে ভার্যাকে প্রত্যাখ্যান করে, শ্রাদ্ধদিনে স্ত্রীগমন করে, ন্যস্ত ধন হরণ করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, দুর্বলের সঙ্গে যুদ্ধ করে, এবং নাস্তিক, অগ্নিহোত্রবর্জিত, পিতৃমাতৃত্যাগী ও অন্যবিধ পাপকারিগণ যে নরকে যায়, সেই নরকে আমরা যাব। আর, যদি আমরা যুদ্ধে দুষ্কর কর্ম সাধন করতে পারি তবে অবশ্যই অভীষ্ট স্বর্গলোক লাভ করব।[]

 সুশর্মা প্রভৃতি এইরূপ শপথ করে দক্ষিণ দিকে গিয়ে অর্জুনকে আহ্বান করতে লাগলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করলে আমি বিমুখ হই না, এই আমার ব্রত। সুশর্মা, তাঁর ভ্রাতারা ও অন্য সংশপ্তকগণ আমাকে ডাকছেন, এই আহ্বান আমি সইতে পারছি না, আপনি আজ্ঞা দিন আমি ওঁদের বধ করতে যাই। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, তুমি জান যে দ্রোণ আমাকে ধরতে চান, তাঁর এই অভিপ্রায় যাতে সিদ্ধ না হয় তাই কর। অর্জুন বললেন, এই পাঞ্চালবীর সত্যজিৎ আজ যুদ্ধে আপনাকে রক্ষা করবেন, ইনি জীবিত থাকতে দ্রোণের ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। যদি সত্যজিৎ নিহত হন তবে সকলের সঙ্গে মিলিত হয়েও আপনি রণস্থলে থাকবেন না।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে যুধিষ্ঠির সস্নেহে অর্জুনকে আলিঙ্গন ও আশীর্বাদ ক’রে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন।

৫। সংশপ্তকগণের যুদ্ধ ― ভগদত্তবধ

(দ্বাদশ দিনের যুদ্ধ)

 বর্ষাকালে স্ফীতসলিলা গঙ্গা ও সরযু যেমন বেগে মিলিত হয় সেইরূপ উভয় পক্ষের সেনা যুদ্ধে মিলিত হ’ল। অর্জুনকে আসতে দেখে সংশপ্তকগণ হৃষ্ট হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। অর্জুন সহাস্যে কৃষ্ণকে বললেন, দেবকীনন্দন, ত্রিগর্তভ্রাতারা আজ যুদ্ধে মরতে আসছে, তারা রোদন না ক’রে হর্ষপ্রকাশ করছে।

 অর্জুন মহারবে দেবদত্ত শঙ্খ বাজালেন, তার শব্দে বিত্রস্ত হয়ে সংশপ্তকবাহিনী কিছুক্ষণ পাষাণপ্রতিমার ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে রইল, তার পর দুই পক্ষ থেকে প্রবল শরবর্ষণ হ’তে লাগল। অর্জুনের শরাঘাতে নিপীড়িত হয়ে ত্রিগর্তসেনা ভগ্ন হ’ল। সুশর্মা বললেন, বীরগণ, ভয় নেই, পালিও না, তোমরা সকলের সমক্ষে ঘোর শপথ করেছ, এখন দুর্যোধনের সৈন্যদের কাছে ফিরে গিয়ে কি বলবে? পশ্চাৎপদ হ’লে লোকে আমাদের উপহাস করবে, অতএব সকলে যথাশক্তি যুদ্ধ কর। তখন সংশপ্তকগণ এবং নারায়ণী সেনা[] মৃত্যুপণ ক’রে পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হ’ল।

 অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এই সংশপ্তকগণ জীবিত থাকতে রণভূমি ত্যাগ করবে না, তুমি ওদের দিকে রথ নিয়ে চল। কিছুক্ষণ বাণবর্ষণের পর অর্জুন ত্বাষ্ট্র[] অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। তখন সহস্র সহস্র বিভিন্ন প্রতিমূর্তি আবির্ভূত হ’ল, বিপক্ষ সৈন্যগণ বিমূঢ় হয়ে ‘এই অর্জুন, এই গোবিন্দ’ ব’লে পরস্পরকে হতা করতে লাগল। অর্জুন সহাস্যে ললিত্থ মালব মাবেল্লক ও ত্রিগর্ত যোদ্ধাদের নিপীড়িত করতে লাগলেন। বিপক্ষের শরজালে আচ্ছন্ন হয়ে অর্জুনের রথ অদৃশ্য হ’ল, তিনি নিহত হয়েছেন মনে ক’রে শত্রুসৈন্যগণ সহর্ষে কোলাহল ক’রে উঠল। অর্জুন বায়ব্যাস্ত্র মোচন করলেন, প্রবল বায়ু প্রবাহে সংশপ্তকগণ এবং তাদের হস্তী রথ অশ্ব প্রভৃতি শুষ্ক পত্রের ন্যায় বিক্ষিপ্ত হ’ল। অর্জুন ক্ষিপ্রহস্তে তীক্ষ্ণ শরের আঘাতে সহস্র সহস্র শত্রুসৈন্য বধ করলেন। সংশপ্তকগণ বিনষ্ট হয়ে ইন্দ্রলোকে যেতে লাগল।

 অর্জুন যখন প্রমত্ত হয়ে যুদ্ধ করছিলেন তখন দ্রোণ গরুড় ব্যূহ রচনা করে সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন। এই ব্যূহের মুখে স্বয়ং দ্রোণ, মস্তকে দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা, নেত্রদ্বয়ে কৃতবর্মা ও কৃপাচার্য, গ্রীবায় কলিঙ্গ সিংহল প্রাচ্য প্রভৃতি দেশের যোদ্ধারা, দক্ষিণ পার্শ্বে ভূরিশ্রবা শল্য প্রভৃতি, বাম পার্শ্বে অবন্তিদেশীয় বিন্দ অনুবিন্দ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ ও অশ্বত্থামা, পৃষ্ঠদেশে কলিঙ্গ অম্বষ্ঠ মাগধ পৌণ্ড্র গান্ধার প্রভৃতি সৈন্যগণ, পশ্চাদ্‌ভাগে পুত্র জ্ঞাতি ও বান্ধব সহ কর্ণ, এবং বক্ষস্থলে জয়দ্রথ ভীমরথ নিষধরাজ প্রভৃতি রইলেন। রাজা ভগদত্ত এক সুসজ্জিত হস্তীর পৃষ্ঠে মাল্য ও শ্বেত ছত্রে শোভিত হয়ে ব্যূহমধ্যে অবস্থান করলেন।

 অর্ধচন্দ্র ব্যূহ রচনা করে যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে আমি দ্রোণের হাতে না পড়ি। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি জীবিত থাকতে আপনি উদ্‌বিগ্ন হবেন না, দ্রোণকে আমি নিবারণ করব। ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্মুখে দেখে দ্রোণ বিশেষ হৃষ্ট হলেন না, তিনি প্রবল শরবর্ষণে যুধিষ্ঠিরের সৈন্য বিনষ্ট ও বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরেই উভয় পক্ষ বিশৃঙ্খল হয়ে উন্মত্তের ন্যায় যুদ্ধে রত হ’ল। যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার জন্য সত্যজিৎ দ্রোণের সহিত যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু পরিশেষে নিহত হলেন। যুধিষ্ঠির ত্রস্ত হয়ে তখনই দ্রুতবেগে স’রে গেলেন। পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি যোদ্ধারা দ্রোণকে আক্রমণ করলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সাত্যকি চেকিতান ধষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী প্রভৃতি দ্রোণের নিকট পরাস্ত হলেন, বিজয়ী কৌরবগণ পলায়মান পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে লাগলেন।

 দুর্যোধন সহাস্যে কর্ণকে বললেন, রাধেয়, দেখ, পাঞ্চালগণ দ্রোণের শরাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে পালাচ্ছে, মহাক্রোধী দুর্মতি ভীম আমার সৈন্যে বেষ্টিত হয়ে জগৎ দ্রোণময় দেখছে, আজ সে জীবনরক্ষা ও রাজ্যলাভে নিরাশ হয়েছে। কর্ণ বললেন, এই মহাবীর ভীম জীবিত থাকতে রণস্থল ত্যাগ করবেন না, আমাদের সিংহনাদও সইবেন না। দ্রোণ যেখানে আছেন আমাদের শীঘ্র সেখানে যাওয়া উচিত, নতুবা কোক (নেকড়ে বাঘ) এর দল যেমন মহাহস্তীকে বধ করে সেইরূপ পাণ্ডবরা দ্রোণকে বধ করবে। এই কথা শুনে দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা দ্রোণকে রক্ষা করতে গেলেন।

 দ্রোণের রথধ্বজের উপর কৃষ্ণসার মগের চর্ম ও স্বর্ণময় কমণ্ডলু, ভীমসেনের ধ্বজে মহাসিংহ, যুধিষ্ঠিরের ধ্বজে গ্রহগণান্বিত চন্দ্র ও শব্দায়মান দুই মৃদঙ্গ, নকুলের ধ্বজে একটি ভীষণ শরভ, এবং সহদেবের ধ্বজে রজতময় হংস ছিল। যে হস্তীতে চ’ড়ে ইন্দ্র দৈত্যদানব জয় করেছিলেন, সেই হস্তীর বংশধরের পৃষ্ঠে চ’ড়ে ভগদত্ত ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। পাঞ্চাল সৈন্য সহ যুধিষ্ঠির তাঁকে বাধা দিতে গেলেন। ভগদত্তের সঙ্গে যুদ্ধে দশার্ণরাজ নিহত হলেন, পাঞ্চালসৈন্য ভয়ে পালাতে লাগল।

 হস্তীর গর্জন শুনে অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এ নিশ্চয় ভগদত্তের বাহনের শব্দ, এই হস্তী অস্ত্রের আঘাত এবং অগ্নির স্পর্শও সইতে পারে, সে আজ সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য বিনষ্ট করবে। তুমি সত্বর ভগদত্তের কাছে রথ নিয়ে চল, তাঁকে আজ আমি ইন্দ্রের অতিথি ক’রে পাঠাব। অর্জুন যাত্রা করলে চোদ্দ হাজার সংশপ্তক মহারথ এবং দশ হাজার ত্রিগর্ত যোদ্ধা চার হাজার নারায়ণসৈন্য সহ তাঁর অনুসরণ করলেন। দুর্যোধন ও কর্ণের উদ্‌ভাবিত এই কৌশলে অর্জুন সংশয়াপন্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন, সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, না যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করতে যাব? তিনি সংশপ্তকগণকে বধ করাই উচিত মনে করলেন, এবং ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ ক’রে তাদের প্রায় নিঃশেষ করে ফেললেন। তার পর তিনি কৃষ্ণকে বললেন, ভগদত্তের কাছে চল।

 ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তাঁর ভ্রাতারা অর্জুনের অনুসরণ করছিলেন। অর্জুন শরবর্ষণ করে সুশর্মাকে নিরস্ত এবং তাঁর ভ্রাতাদের বিনষ্ট করলেন। তার পর গজারোহী ভগদত্তের সঙ্গে রথারোহী অর্জনের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। কৃষ্ণার্জুনকে বধ করবার জন্য ভগদত্ত তাঁর হস্তীকে চালিত করলেন, কৃষ্ণ সত্বর দক্ষিণ পার্শ্বে রথ সরিয়ে নিলেন। যুদ্ধধর্ম স্মরণ ক’রে অর্জুন বাহনসমেত ভগদত্তকে পিছন থেকে মারতে ইচ্ছা করলেন না।

 অর্জুনের শরাঘাতে ভগদত্তের হস্তীর বর্ম ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হ’ল। ভগদত্ত মন্ত্র পাঠ করে বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুনকে পশ্চাতে রেখে কৃষ্ণ সেই অস্ত্র নিজের বক্ষে গ্রহণ করলেন। বৈষ্ণবাস্ত্র বৈজয়ন্তী মালা হয়ে কৃষ্ণের বক্ষে লগ্ন হ’ল। অর্জুন দুঃখিত হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তুমি বলেছিলে যে যুদ্ধ করবে না, কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা রাখলে না। আমি সতর্ক ও অস্ত্রনিবারণে সমর্থ থাকতে তোমার এমন করা উচিত হয় নি।

 কৃষ্ণ বললেন, একটি গুহ্য কথা বলছি শোন।—আমি চার মূর্তিতে বিভক্ত হয়ে লোকের হিতসাধন করি। আমার এক মূর্তি তপস্যা করে, দ্বিতীয় মূর্তি জগতের সাধু ও অসাধু কর্ম দেখে, তৃতীয় মূর্তি মনুষ্যালোকে কর্ম করে, এবং চতুর্থ মূর্তি সহস্র বৎসর শয়ন ক’রে নিদ্রিত থাকে। সহস্র বৎসরের অন্তে আমার চতুর্থ মূর্তি গাত্রোত্থান করে যোগ্য ব্যক্তিদের বর দেয়। সেই সময়ে পৃথিবীর প্রার্থনায় তাঁর পুত্র নরককে আমি বৈষ্ণবাস্ত্র দিয়েছিলাম। প্রাগ্‌জ্যোতিষরাজ ভগদত্ত নরকাসুরের কাছ থেকে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। জগতে এই অস্ত্রের অবধ্য কেউ নেই, তোমার রক্ষার নিমিত্তই আমি বৈষ্ণবাস্ত্র গ্রহণ করে মাল্যে পরিবর্তিত করেছি। ভগদত্ত পরমাস্ত্রহীন হয়েছেন, এখন ওই মহাসুরকে বধ কর।

 অর্জুন নারাচ নিক্ষেপ করলেন, তার আঘাতে ভগদত্তের মহাহস্তী আর্তনাদ করে নিহত হ’ল। অর্জুন তখনই অর্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তের হৃদয় বিদীর্ণ করলেন, ভগদত্ত প্রাণহীন হয়ে প’ড়ে গেলেন। তার পর অর্জুন রণস্থলের দক্ষিণ দিকে গেলেন, শকুনির ভ্রাতা কৃষক ও অচল তাঁকে বাধা দিতে এলেন। অর্জুন একই শরে দু’জনকে বধ করলেন। বহুমায়াবিশারদ শকুনি মায়া দ্বারা কৃষ্ণার্জুনকে সম্মোহিত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অর্জুনের শরবর্ষণে সকল মায়া দূরীভূত হ’ল, শকুনি ভীত হয়ে পালিয়ে গেলেন।

 দ্রোণের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতির অদ্ভুত যুদ্ধ হ’তে লাগল। অশ্বত্থামা নীল রাজার মস্তক ছেদন করলেন। পাণ্ডবপক্ষীয মহারথগণ উদ্‌বিগ্ন হয়ে অর্জুনের অপেক্ষা করতে লাগলেন, যিনি তখন অবশিষ্ট সংশপ্তক ও নারায়ণসৈন্য বিনাশ করছিলেন। ভীমসেন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দ্রোণ কর্ণ দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন দেখে সাত্যকি নকুল সহদেব প্রভৃতি তাঁকে রক্ষা করতে এলেন। পাণ্ডববীরগণকে আরও ত্বরান্বিত করবার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, এই সময়। তখন সকলে তুমল রবে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দ্রোণ শত শত বাণে চেদি পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। এমন সময় অর্জুন সংশপ্তকগণকে জয় ক’রে দ্রোণের নিকট উপস্থিত হলেন। যুগান্তকালে উদিত ধূমকেতু যেমন সর্বভূত দহন করে, অর্জুনের অস্ত্রের তেজে সেইরূপ কুরুসৈন্য দগ্ধ হ’তে লাগল। তাদের হাহাকার শুনে কর্ণ আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করলেন, অর্জুন তা শরাঘাতে নিবারিত করে কর্ণের তিন ভ্রাতাকে বধ করলেন। ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের খড়্‌গাঘাতে কর্ণপক্ষের পনর জন যোদ্ধা, চন্দ্রবর্মা ও নিষধরাজ বৃহৎক্ষত্র নিহত হলেন।

 তার পর সূর্য অস্তাচলে গেলেন, উভয় পক্ষ ক্লান্ত ও রুধিরাক্ত হয়ে পরস্পরকে দেখতে দেখতে শিবিরে প্রস্থান করলেন।

  1. এই প্রকার শপথ ও মরণ পণ ক’রে যারা যুদ্ধে যায় তারাই সংশপ্তক।
  2. কৃষ্ণ দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন। উদ্‌যোগপর্ব ২-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  3. ত্বষ্টা—বিশ্বকর্মা।