মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/দ্রোণাভিষেকপর্বাধ্যায়
দ্রোণপর্ব
॥ দ্রোণাভিষেকপবাধ্যায়॥
১। ভীষ্ম-সকাশে কর্ণ
কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ শরশয্যায় শয়ান ভীষ্মের রক্ষার ব্যবস্থা ক’রে তাঁকে সসম্মানে প্রদক্ষিণ করলেন এবং পরস্পর আলাপের পর পুনর্বার বৈরভাবাপন্ন হয়ে যুদ্ধের জন্য উদ্যোগী হলেন। শ্বাপদসংকুল বনে পালকহীন ছাগ ও মেষের দল যেমন হয়, ভীষ্মের অভাবে কৌরবগণ সেইরূপ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, মহাযশা কর্ণ এবং তাঁর অমাত্য ও বন্ধুগণ দশ দিন যুদ্ধ করেন নি। যিনি অতিরথের দ্বিগুণ সেই কর্ণকে ভীষ্ম সকল ক্ষত্রিয়ের সমক্ষে অর্ধরথ ব’লে গণনা করেছিলেন। সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ ভীষ্মকে বলেছিলেন, আপনি জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করব না; আপনি যদি পাণ্ডবগণকে বধ করতে পারেন তবে আমি দুর্যোধনের অনুমতি নিয়ে বনে যাব; আর যদি পাণ্ডবগণের হস্তে আপনার স্বর্গলাভ হয় তবে আপনি যাদের রথী মনে করেন তাদের সকলকেই আমি বধ করব। এখন ভীষ্ম নিপাতিত হয়েছেন, অতএব কর্ণের যুদ্ধ করবার সময় এসেছে। এই ব’লে কৌরবগণ কর্ণকে ডাকতে লাগলেন।
সকলকে আশ্বাস দিয়ে কর্ণ বললেন, মহাত্মা ভীষ্ম এই কৌরবগণকে যেমন রক্ষা করতেন আমিও সেইরূপ করব। আমি পাণ্ডবদের যমালয়ে পাঠিয়ে পরম যশস্বী হব, অথবা শত্রুহস্তে নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করব।
কর্ণ রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে রথারোহণে ভীষ্মের কাছে এলেন এবং বাষ্পাকুলনয়নে অভিবাদন ক’রে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি কর্ণ, আপনি প্রসন্ননয়নে চেয়ে দেখুন, শুভ বাক্য বলুন। সৎকর্মের ফল নিশ্চয় ইহলোকে লভ্য নয়, তাই আপনি ধর্মপরায়ণ বৃদ্ধ হয়েও ভূতলে শয়ন করেছেন। কুরুবীরগণকে বিপৎসাগরে ফেলে আপনি পিতৃলোকে যাচ্ছেন, ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্র যেমন মৃগ বিনাশ করে, পাণ্ডবগণ সেইরূপ কৌরবগণকে বিনাশ করবে। আমি অসহিষ্ণু হয়েছি, আপনি অনুমতি দিলে আমি প্রচণ্ডবিক্রমশালী অর্জুনকে অস্ত্রের বলে বধ করতে পারব।
ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, সমুদ্র যেমন নদীগণের, ভাস্কর যেমন সকল তেজের, সাধুজন যেমন সত্যের, উর্বরা ভূমি যেমন বীজের, মেঘ যেমন জীবগণের, তুমিও তেমন বান্ধবগণের আশ্রয় হও। আমি প্রসন্নমনে বলছি, তুমি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে কর, কৌরবগণকে উপদেশ দাও, দুর্যোধনের জয়বিধান কর। দুর্যোধনের ন্যায় তুমিও আমার পৌত্রতুল্য। মনীষিগণ বলেন, সজ্জনের সঙ্গে সজ্জনের যে সম্বন্ধ তা জন্মগত সম্বন্ধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কৌরবসৈন্য যেমন দুর্যোধনের, সেইরূপ তোমরাও, এই জ্ঞান করে তাদের রক্ষা কর।
ভীষ্মের চরণে প্রণাম ক’রে কর্ণ সত্বর রণস্থলের অভিমূখে প্রস্থান করলেন।
২। দ্রোণের অভিষেক ও দুর্যোধনকে বরদান
দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, বয়স বিক্রম শাস্ত্রজ্ঞান ও যোদ্ধার উপযুক্ত সমস্ত গণের জন্য ভীষ্ম আমার সেনাপতি হয়েছিলেন। তিনি দশ দিন শত্রুবিনাশ ও আমাদের রক্ষা ক’রে স্বর্গযাত্রায় প্রস্তুত হয়েছেন। এখন তুমি কাকে সেনাপতি করা উচিত মনে কর? কর্ণ বললেন, এখানে যেসকল পুরুষশ্রেষ্ঠ আছেন তাঁরা প্রত্যেকে সেনাপতিত্বের যোগ্য, কিন্তু সকলেই এককালে সেনাপতি হ’তে পারেন না। এঁরা পরস্পরকে স্পর্ধা করেন, একজনকে সেনাপতি করলে আর সকলে ক্ষুণ্ণ হয়ে যুদ্ধে বিরত হবেন। দ্রোণ সকল যোদ্ধার শিক্ষক, স্থবির, মাননীয়, এবং শ্রেষ্ঠ অস্ত্রধর, ইনি ভিন্ন আর কেউ সেনাপতি হ’তে পারেন না। এমন যোদ্ধা নেই যিনি যুদ্ধে দ্রোণের অনুবর্তী হবেন না।
দুর্যোধন তখনই দ্রোণকে সেনাপতি হবার জন্য অনুরোধ করলেন। দ্রোণ বললেন, রাজা, আমি ষড়ঙ্গ বেদ ও মনুর নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ; পাশুপত অস্ত্র ও বিবিধ বাণের প্রয়োগও জানি। তোমার বিজয়কামনায় আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে করব, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করব না, কারণ সে আমাকে বধ করবার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে। আমি বিপক্ষের সকল সৈন্য বিনষ্ট করব, কিন্তু পাণ্ডবরা আমার সঙ্গে হৃষ্টমনে যুদ্ধ করবেন না।
দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে যথাবিধি সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত করলেন। দ্রোণ বললেন, রাজা, কুরুশ্রেষ্ঠ গাঙ্গেয় ভীষ্মের পর আমাকে সেনাপতির পদ দিয়ে তুমি আমাকে সম্মানিত করেছ, তার যোগ্য ফল লাভ কর। তুমি অভীষ্ট বর চাও, আজ তোমার কোন, কামনা পূর্ণ করব বল। দুর্যোধন বললেন, রথিশ্রেষ্ঠ, এই বর দিন যে যুধিষ্ঠিরকে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে ধ’রে আনবেন। দ্রোণ বললেন, যুধিষ্ঠির ধন্য, তুমি তাঁকে ধ’রে আনতে বলছ, বধ করতে চাচ্ছ না। আমি তাঁকে মারব এ বোধ হয় তুমি অসম্ভব মনে কর, অথবা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দ্বেষ্টা কেউ নেই তাই তুমি তাঁর জীবনরক্ষা করতে চাও। অথবা পাণ্ডবগণকে জয় ক’রে তুমি তাঁদের রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছা কর। যুধিষ্ঠির ধন্য, তাঁর জন্ম সফল, অজাতশত্রু নামও সার্থক, কারণ তাঁকে তুমি স্নেহ কর।
দ্রোণের এই কথা শুনে দুর্যোধন তাঁর হৃদ্গত অভিপ্রায় প্রকাশ করে ফেললেন, কারণ বৃহস্পতিতুল্য লোকেও মনোভাব গোপন করতে পারেন না। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, যুধিষ্ঠিরকে মারলে আমার বিজয়লাভ হবে না, অন্য পাণ্ডবরা আমাদের হত্যা করবে। তাদের যদি একজনও অবশিষ্ট থাকে তবে সে আমাদের নিঃশেষ করবে। কিন্তু যদি সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনা যায় তবে তাঁকে পুনর্বার দ্যূতক্রীড়ায় পরাস্ত করলে তাঁর অনুগত ভ্রাতারাও আবার বনে যাবে। এইপ্রকার জয়ই দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে, সেজন্য ধর্মরাজকে বধ করতে ইচ্ছা করি না।
দুর্যোধনের কুটিল অভিপ্রায় জেনে বুদ্ধিমান দ্রোণ চিন্তা করে এই বাক্ছলযুক্ত বর দিলেন—যুদ্ধকালে অর্জুন যদি যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা না করেন তবে ধরে নিও যে যুধিষ্ঠির আমাদের বশে এসেছেন। বৎস, অর্জুন সুরাসুরেরও অজেয়, তাঁর কাছ থেকে আমি যুধিষ্ঠিরকে হরণ করতে পারব না। অর্জুন আমার শিষ্য, কিন্তু যুবা, পুণ্যবান ও একাগ্রচিত্ত, তিনি ইন্দ্র ও রুদ্রের নিকট অনেক অস্ত্র লাভ করেছেন এবং তোমার প্রতি তাঁর ক্রোধ আছে। তুমি যে উপায়ে পার অর্জুনকে অপসারিত করো, তা হ’লেই ধর্মরাজ বিজিত হবেন। অর্জুন বিনা যুধিষ্ঠির যদি মুহূর্তকালও যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সম্মুখে থাকেন তবে তাঁকে নিশ্চয় তোমার বশে আনব।
দ্রোণের এই কথা শুনে নির্বোধ ধার্তরাষ্ট্রগণ মনে করলেন যে যুধিষ্ঠির ধরাই পড়েছেন। তাঁরা জানতেন যে দ্রোণ পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। তাঁর প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করবার জন্য দুর্যোধন দ্রোণের বরদানের সংবাদ সৈন্যগণের মধ্যে ঘোষণা করলেন।
৩। অর্জুনের জয়
(একাদশ দিনের যুদ্ধ)
বিশ্বস্ত চরের নিকট সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, তুমি দ্রোণের অভিপ্রায় শুনলে, যাতে তা সফল না হয় তার জন্য যত্ন কর। দ্রোণের প্রতিজ্ঞায় ছিদ্র আছে, আবার সেই ছিদ্র তিনি তোমার উপরেই রেখেছেন। অতএব আজ তুমি আমার কাছে থেকেই যুদ্ধ কর, যেন দুর্যোধনের অভীষ্ট সিদ্ধ না হয়।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, দ্রোণকে বধ করা যেমন আমার অকর্তব্য, আপনাকে পরিত্যাগ করাও সেইরূপ। প্রাণ গেলেও আমি দ্রোণের আততায়ী হব না, আপনাকেও ত্যাগ করব না। আমি জীবিত থাকতে দ্রোণ আপনাকে নিগৃহীত করতে পারবেন না।
পাণ্ডব ও কৌরবগণের শিবিরে শঙ্খ ভেরী মৃদঙ্গ প্রভৃতি রণবাদ্য বেজে উঠল, দুই পক্ষের সৈন্যদল ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে পরস্পরের সম্মুখে এল। অনন্তর দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে তুমূল সংগ্রাম আরম্ভ হ’ল। স্বর্ণময় উজ্জল রথে আরূঢ় হয়ে দ্রোণ তাঁর সৈন্যদলের অগ্রভাগে বিচরণ করতে লাগলেন, তাঁর শরক্ষেপণে পাণ্ডববাহিনী ত্রস্ত হ’ল। যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ যোদ্ধারা সকল দিক থেকে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। সহদেব ও শকুনি, দ্রোণাচার্য ও দ্রুপদ, ভীমসেন ও বিবিংশতি, নকুল ও তাঁর মাতুল শল্য, ধৃষ্টকেতু ও কৃপ, সাত্যকি ও কৃতবর্মা, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সুশর্মা, বিরাট ও কর্ণ, শিখণ্ডী ও ভূরিশ্রবা, ঘটোৎকচ ও অলম্বুষ, অভিমন্যু ও বৃহদ্বল—এঁদের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল। অভিমন্যু বৃহদ্বলকে রথ থেকে নিপাতিত ক’রে খড়্গ ও চর্ম নিয়ে পিতার মহাশত্রু জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন। জয়দ্রথ পরাস্ত হ’লে শল্য অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। শল্যের সারথি নিহত হ’ল, তিনি গদাহস্তে রথ থেকে নামলেন, অভিমন্যুও প্রকাণ্ড গদা নিয়ে শল্যকে বললেন, আসুন আসুন। সেই সময়ে ভীমসেন এসে অভিমন্যুকে নিরস্ত করলেন এবং স্বয়ং শল্যের সঙ্গে গদাযুদ্ধ করতে লাগলেন। দুই গদার সংঘর্ষে অগ্নির উদ্ভব হ’ল, বহুক্ষণ যুদ্ধের পর দুজনেই আহত হয়ে ভূপতিত হলেন। শল্য বিহ্বল হয়ে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন, তখন কৃতবর্মা তাঁকে নিজের রথে তুলে নিয়ে রণভূমি থেকে চ’লে গেলেন। ভীম নিমেষমধ্যে গদাহস্তে উঠে দাঁড়ালেন।
কুরুসৈন্য পরাজিত হচ্ছে দেখে কর্ণপুত্র বৃর্ষসেন রণস্থলে এসে নকুলপুত্র শতানীকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দ্রৌপদীর অপর পুত্রগণ ভ্রাতা শতানীককে রক্ষা করতে এলেন। পাণ্ডবগণের সঙ্গে পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য ও সঞ্জয় যোদ্ধগণ অস্ত্র উদ্যত ক’রে উপস্থিত হলেন। কৌরবসৈন্য মর্দিত ও ভগ্ন হচ্ছে দেখে দ্রোণ বললেন, বীরগণ, তোমরা পালিও না। এই বলে তিনি সুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যরক্ষক পাঞ্চালবীর কুমার দ্রোণের বক্ষে শরাঘাত করলেন, দ্রোণও পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের প্রতি শরক্ষেপণ করতে লাগলেন। পাঞ্চালবীর ব্যাঘ্রদত্ত ও সিংহসেন দ্রোণের হস্তে নিহত হলেন। দ্রোণকে যুধিষ্ঠিরের নিকটবর্তী দেখে কৌরবসৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ রাজা দুর্যোধন কৃতার্থ হবেন, যুধিষ্ঠির ধরা পড়বেন। এই সময়ে অর্জুন দ্রুতবেগে দ্রোণসৈন্যের প্রতি ধাবিত হয়ে শরজালে সর্বদিক আচ্ছন্ন করলেন। দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতি যুদ্ধ থেকে বিরত হলেন, শত্রুপক্ষকে ত্রস্ত ও যুদ্ধে অনিচ্ছু দেখে অর্জুনও পাণ্ডবসৈন্যগণকে নিরস্ত করলেন।