মহাভারত (রাজশেখর বসু)/ভীষ্মপর্ব/ভীষ্মবধপর্বাধ্যায়

॥ ভীষ্মবধপর্বাধ্যায়॥

৬। যুধিষ্ঠিরের শিষ্টাচার ― কর্ণ ― যুযুৎসু

 যুধিষ্ঠির দেখলেন, সাগরতুল্য দুই সেনা যুদ্ধের জন্য সমুদ্যত ও চঞ্চল হয়েছে। তিনি তাঁর বর্ম খুলে ফেলে অস্ত্র ত্যাগ ক’রে সত্বর রথ থেকে নামলেন এবং শত্রুসেনার ভিতর দিয়ে পদব্রজে কৃতাঞ্জলিপুটে ভীষ্মের অভিমুখে চললেন। তাঁকে এইরূপে যেতে দেখে তাঁর ভ্রাতারা, কৃষ্ণ, এবং প্রধান প্রধান রাজারা উৎকণ্ঠিত হয়ে তাঁর অনুসরণ করলেন। ভীমার্জুনাদি জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, আপনার অভিপ্রায় কি? আমাদের ত্যাগ করে নিরস্ত্র হয়ে একাকী শত্রুসেনার অভিমুখে কেন যাচ্ছেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন না, যেতে লাগলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, আমি এঁর অভিপ্রায় বুঝেছি, ইনি ভীষ্মদ্রোণাদি গুরুজনকে সম্মান দেখিয়ে তার পর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। শাস্ত্রে আছে, গুরুজনকে সম্মানিত ক’রে যুদ্ধ করলে নিশ্চয় জয়লাভ হয়, আমিও তাই মনে করি।

 যুধিষ্ঠিরকে আসতে দেখে দুর্যোধনের সৈন্যরা বলাবলি করতে লাগল, এই কুলাঙ্গার ভয় পেয়ে ভ্রাতাদের সঙ্গে ভীষ্মের শরণ নিতে আসছে; ভীমার্জুনাদি থাকতে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে ভীত হ’ল কেন? প্রখ্যাত ক্ষত্রিয় বংশে নিশ্চয় এঁর জন্ম হয় নি। সৈন্যরা এই ব’লে আনন্দিতমনে তাদের উত্তরীয় নাড়তে লাগল।

 ভীষ্মের কাছে এসে দুই হাতে তাঁর পা ধ’রে যুধিষ্ঠির বললেন, দুর্ধর্ষ পিতামহ, আপনাকে আমন্ত্রণ করছি, আপনার সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করব, আপনি অনুমতি দিন, আশীর্বাদ করুন। ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, যদি এই ভাবে আমার কাছে না আসতে তবে তোমাকে আমি পরাজয়ের জন্য অভিশাপ দিতাম। পাণ্ডুপুত্র, আমি প্রীত হয়েছি, তুমি যুদ্ধ কর, জয়ী হও, তোমার আর যা অভীষ্ট তাও লাভ কর। মানষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়, এ সত্য। কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই ক্লীবের ন্যায় তোমাকে বলছি—আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না; এ ভিন্ন আমার কাছে তুমি আর কি চাও বল। যুধিষ্ঠির বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ, আমার হিতের জন্য আপনি মন্ত্রণা দিন এবং কৌরবদের জন্য যুদ্ধ করুন, এই আমার প্রার্থনা। ভীষ্ম বললেন, আমি তোমার শত্রুদের পক্ষে যুদ্ধে করব, তুমি আমার কাছে কি সাহায্য চাও? যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি অপরাজেয়, যদি আমাদের শুভকামনা করেন তবে বলুন আপনাকে কোন্ উপায়ে জয় করব? ভীষ্ম বললেন, কৌন্তেয়, আমাকে যুদ্ধে জয় করতে পারে এমন পুরুষ দেখি না, এখন আমার মৃত্যুকালও উপস্থিত হয় নি; তুমি আবার আমার কাছে এসো।

 ভীষ্মের কাছে বিদায় নিয়ে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের কাছে গেলেন এবং প্রণাম ও প্রদক্ষিণ ক’রে বললেন, ভগবান, আপনাকে আমন্ত্রণ করছি, আমি নিষ্পাপ হয়ে যুদ্ধ করব, কোন, উপায়ে সকল শত্রু জয় করতে পারব তা বলুন। ভীষ্মের ন্যায় দ্রোণাচার্যও বললেন, যুদ্ধের পূর্বে যদি আমার কাছে না আসতে তবে আমি অভিশাপ দিতাম। মানুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়। কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, সেজন্য ক্লীবের ন্যায় তোমাকে বলছি—আমি কৌরবদের জন্যই যুদ্ধ করব, কিন্তু তোমার বিজয়কামনায় আশীর্বাদ করছি। যেখানে ধর্ম সেখানেই কৃষ্ণ, যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়। তুমি যাও, যুদ্ধ কর। আর যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তো বল। যুধিষ্ঠির বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি অপরাজেয়, যুদ্ধে কি ক’রে আপনাকে জয় করব? দ্রোণ বললেন, বৎস, আমি যখন রথারূঢ় হয়ে শরবর্ষণ করি তখন আমাকে বধ করতে পারে এমন লোক দেখি না। আমি যদি অস্ত্র ত্যাগ ক’রে অচেতনপ্রায় হয়ে মরণের প্রতীক্ষা করি তবেই আমাকে বধ করা যেতে পারে। যদি কোনও বিশ্বস্ত পুরুষ আমাকে অত্যন্ত অপ্রিয় সংবাদ দেয় তবে আমি যুদ্ধকালে অস্ত্র ত্যাগ করি— তোমাকে এই কথা সত্য বলছি।

 তার পর যুধিষ্ঠির কৃপাচার্যের কাছে গেলেন। তিনিও ভীষ্ম-দ্রোণের ন্যায় নিজের পরাধীনতা জানিয়ে বললেন, মহারাজ, আমি অবধ্য, তথাপি তুমি যদ্ধ কর, জয়ী হও। তোমার আগমনে আমি প্রীত হয়েছি; সত্য বলছি, আমি প্রত্যহ নিদ্রা থেকে উঠে তোমার জয়কামনা করব।

 তার পর যুধিষ্ঠির শল্যের কাছে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করলেন। শল্যও বললেন, তোমার সম্মান প্রদর্শনে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি না এলে আমি শাপ দিতাম। আমি কৌরবগণের বশীভূত, তোমার কি সাহায্য করব বল। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি পূর্বে[] বর দিয়েছিলেন যে যুদ্ধকালে সূতপত্রের তেজ নষ্ট করবেন, সেই বরই আমার কাম্য। শল্য বললেন, কুন্তীপুত্র, তোমার কামনা পূর্ণ হবে, তুমি যাও, যুদ্ধ কর, তুমি নিশ্চয় জয়ী হবে।

 কৌরবগণের মহাসৈন্য থেকে নির্গত হয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে ফিরে গেলেন। তখন কৃষ্ণ কর্ণের কাছে গিয়ে বললেন, শুনেছি তুমি ভীষ্মের প্রতি বিদ্বেষের জন্য এখন যুদ্ধ করবে না; যত দিন ভীষ্ম না মরেন তত দিন তুমি আমাদের পক্ষে থাক। ভীষ্মের মৃত্যুর পর যদি দুর্যোধনকে সাহায্য করা উচিত মনে কর তবে পুনর্বার কৌরবপক্ষে যেয়ো। কর্ণ বললেন, কেশব, আমি দুর্যোধনের অপ্রিয় কার্য করব না; জেনে রাখ, আমি তাঁর হিতৈষী, তাঁর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছি।

 কৃষ্ণ পাণ্ডবদের কাছে ফিরে গেলেন। অনন্তর যুধিষ্ঠির কুরসৈন্যের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে বললেন, যিনি আমাদের সাহায্য করতে চান তাঁকে আমি বরণ করে নেব। এই কথা শুনে যুযুৎসু বললেন, যদি আমাকে নেন তবে আমি ধার্তরাষ্ট্রদের সঙ্গে যুদ্ধে করব। যুধিষ্ঠির বললেন, যুযুৎসু, এস এস, আমরা সকলে মিলে তোমার নির্বোধ ভ্রাতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, বাসুদেব ও আমরা একযোগে তোমাকে বরণ করছি। দেখছি তুমিই ধৃতরাষ্ট্রের পিণ্ড ও বংশ রক্ষা করবে।

 ভ্রাতাদের ত্যাগ ক’রে যুযুৎসু দুন্দুভি বাজিয়ে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার বর্ম ধারণ ক’রে রথে উঠলেন, রণবাদ্য বেজে উঠল, বীরগণ সিংহনাদ করলেন। পাণ্ডবগণ মান্যজনকে সম্মানিত করেছেন দেখে আর্য ও ম্লেচ্ছ সকলেই গদ্‌গদ কণ্ঠে প্রশংসা করতে লাগলেন।

৭। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধারম্ভ ― বিরাটপুত্র উত্তর ও শ্বেতের মৃত্যু

(প্রথম দিনের যুদ্ধ)

 ভীষ্মকে অগ্রবর্তী ক’রে কৌরবসেনা এবং ভীমকে অগ্রবর্তী ক’রে পাণ্ডবসেনা পরস্পরের প্রতি ধাবিত হ’ল। সিংহনাদ, কোলাহল, ভেরী মৃদঙ্গ প্রভৃতির বাদ্য এবং অশ্ব ও হস্তীর রবে রণস্থল ব্যাপ্ত হ’ল। মহাবাহু ভীমসেন বৃষভের ন্যায় গর্জন করতে লাগলেন, তাতে অন্য সমস্ত নিনাদ অভিভূত হয়ে গেল।

 দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি দ্বাদশ ভ্রাতা ও ভূরিশ্রবা ভীষ্মকে বেষ্টন, ক’রে রইলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, অভিমন্যু, নকুল, সহদেব ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বাণ বর্ষণ করতে করতে দুর্যোধনাদির অভিমুখে এলেন। তখন দুই পক্ষের রাজারা পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। স্বয়ং ভীষ্ম যমদণ্ডতুল্য কার্মুক নিয়ে গাণ্ডীবধারী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকি ও কৃতবর্মা, অভিমন্যু ও কোশলরাজ বৃহদ্‌বল, ভীমসেন ও দুর্যোধন, নকুল ও দুঃশাসন, সহদেব ও দুর্যোধনভ্রাতা দুর্মুখ, যুধিষ্ঠির ও মদ্ররাজ শল্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রোণ, বিরাটপুত্র শঙ্খ ও ভূরিশ্রবা, ধৃষ্টকেতু ও বাহ্ণীক, ঘটোৎকচ ও অলম্বুষ রাক্ষস, শিখণ্ডী ও অশ্বত্থামা, বিরাট ও ভগদত্ত, কেকয়রাজ বৃহৎক্ষত্র ও কৃপাচার্য, দ্রুপদ ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, ভীমের পুত্র সুতসোম ও দুর্যোধনভ্রাতা বিকর্ণ, চেকিতান ও সুশর্মা, যুধিষ্ঠিরপুত্র প্রতিবিন্ধ্য ও শকুনি, অজুর্ন-সহদেব-পুত্র শ্রুতকর্মা-শ্রুতসেন ও কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, অর্জুনপত্র ইরাবান[] ও কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু, কুন্তিভোজ ও বিন্দ-অনুবিন্দ, বিরাটপুত্র উত্তর ও দুর্যোধনভ্রাতা বীরবাহু, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু ও শকুনিপুত্র উলূক—এদের পরস্পরের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ হ’তে লাগল। ক্ষণকাল পরেই শৃঙ্খলা নষ্ট হ’ল, সকলে উন্মত্তের ন্যায় যুদ্ধ করতে লাগলেন। পিতা পুত্র ভ্রাত। মাতুল ভাগিনেয় সখা পরস্পরকে চিনতে পারলেন না, পাণ্ডবগণ ভূতাবিষ্টের ন্যায় কৌরবগণের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন।

 অভিমন্যুর শরাঘাতে ভীষ্মের স্বর্ণভূষিত রজ ছিন্ন ও ভূপতিত হ’ল। ভীষ্ম অভিমন্যুকে শরজালে আবৃত করলেন, বিরাট ভীমসেন সাত্যকি প্রভৃতি অভিমন্যুকে রক্ষা করতে এলেন। বিরাটপুত্র উত্তর একটি বৃহৎ হস্তীতে চ’ড়ে শল্যকে আক্রমণ করলেন, সেই হস্তীর পদাঘাতে শল্যের রথের চার অশ্ব বিনষ্ট হ’ল। শল্য ভুজঙ্গসদৃশ শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, তার আঘাতে উত্তর প্রাণশূন্য হয়ে প’ড়ে গেলেন। উত্তরকে নিহত দেখে বিরাটের অপর পুত্র ও সেনাপতি শ্বেত শল্যকে আক্রমণ করলেন। শল্য কৃতবর্মার রথে উঠলেন, শল্যপুত্র রুক্মরথ এবং বৃহদ্‌বল প্রভৃতি অপর ছ জন বীর শল্যকে বেষ্টন ক’রে রইলেন। শ্বেতের শরাঘাতে শত শত যোদ্ধা নিহত হচ্ছে দেখে ভীষ্ম সত্বর এলেন এবং ভল্লের আঘাতে শ্বেতের অশ্ব ও সারথি বধ করলেন। রথ থেকে লাফিয়ে নেমে শ্বেত ভীষ্মের প্রতি শক্তিঅস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। ভীষ্মের শরাঘাতে শক্তি ছিন্ন হ’লে শ্বেত গদার প্রহারে ভীষ্মের রথ অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করলেন। তখন ভীষ্ম এক মন্ত্রসিদ্ধ বাণ মোচন করলেন, জ্বলন্ত অশনির ন্যায় সেই বাণ শ্বেতের বর্ম ও হৃদয় ভেদ ক’রে ভূমিতে প্রবিষ্ট হ’ল। নরশার্দূল শ্বেতের মৃত্যুতে পাণ্ডবপক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ শোকমগ্ন হলেন, ঘোর বাদ্যধ্বনির সহিত দুঃশাসন নেচে বেড়াতে লাগলেন।

 তার পর সূর্যাস্ত হ’ল। পাণ্ডবগণ সৈন্যদের নিবৃত্ত করলেন, দুই পক্ষের অবহার (যুদ্ধবিরাম) ঘোষিত হ’ল।

৮। ভীমার্জুনের কৌরবসেনা দলন

(দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ)

 প্রথম দিনের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির শোকার্ত হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, গ্রীষ্ম কালে অগ্নি যেমন তৃণরাশি দগ্ধ করে সেইরূপ ভীষ্ম আমাদের সৈন্য ধ্বংস করছেন। যম ইন্দ্র বরুণ ও কুবেরকেও জয় করা যায়, কিন্তু ভীষ্মকে জয় করা অসম্ভব। কেশব, আমি বুদ্ধির দোষে ভীষ্মরূপ অগাধ জলে মগ্ন হয়েছি। আমি বরং বনে যাব, সাক্ষাৎ মৃত্যুবরূপ ভীষ্মের কবলে আমার মিত্র এই নরপতিগণকে ফেলতে চাই না। মাধব, কিসে আমার মঙ্গল হবে বল। আমি দেখছি সব্যসাচী অর্জুন যুদ্ধে উদাসীন হয়ে আছেন, একমাত্র ভীমই ক্ষত্রধর্ম স্মরণ ক’রে যথাশক্তি যুদ্ধে গদাঘাতে শত্রুর সৈন্য রথ অশ্ব ও হস্তী বিনষ্ট করছেন। কিন্তু এই সরল যুদ্ধে শত শত বৎসরেও ভীম শত্রুসেনা ক্ষয় করতে পারবেন না।

 কৃষ্ণ বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনার শোক করা উচিত নয়; আমি, মহারথ সাত্যকি, বিরাট ও দ্রুপদ সকলেই আপনার প্রিয়কারী। এই রাজারা এবং এঁদের সৈন্যদল আপনার অনুরক্ত। এও শুনেছি যে শিখণ্ডী ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। কৃষ্ণের এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, তুমি বাসুদেবতুল্য যোদ্ধা, কার্তিকেয় যেমন দেবগণের সেনাপতি, সেইরূপ তুমি আমাদের সেনাপতি। পুরুষ-শার্দূল, তুমি কৌরবগণকে সংহার কর, আমরা সকলে তোমার অনুগমন করব। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, মহারাজ, মহাদেবের বিধানে আমিই দ্রোণের হন্তা, ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ শল্য জয়দ্রথ সকলের সঙ্গেই আজ আমি যুদ্ধ করব।

 যুধিষ্ঠিরের উপদেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রৌঞ্চারুণ নামক ব্যূহ রচনা করলেন। পরদিন পুনর্বার যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল, অভিমন্যু ভীমসেন সাত্যকি কেকয়রাজ বিরাট ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং চেদি ও মৎস্য সেনার উপর ভীষ্ম শরবর্ষণ করতে লাগলেন। দুই পক্ষেরই ব্যূহ চঞ্চল হ’ল, পাণ্ডবদের বহু সৈন্য হত হ’ল, রথারোহী সৈন্য পালাতে লাগল। তখন অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ভীষ্মের রথ নিয়ে চল। অর্জুনের অর্থ রথ পতাকায় শোভিত, তার অশ্বসকল বলাকার ন্যায় শুভ্র, চক্রের ঘর্ঘর মেঘধ্বনির তুল্য, ধ্বজের উপর মহাকপি গর্জন করছেন। কৌরবপক্ষে ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ শল্য দুর্যোধন ও বিকর্ণ এবং পাণ্ডবপক্ষে অর্জুন সাত্যকি বিরাট ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ যুদ্ধে নিরত হলেন।

 অর্জুন বহু কৌরবসৈন্য বধ করছেন দেখে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, গাঙ্গেয়, আপনি ও রথিশ্রেষ্ঠ দ্রোণ জীবিত থাকতেও অর্জুন আমাদের সমস্ত সৈন্য উচ্ছেদ করছে, আমার হিতকামী কর্ণও আপনার জন্য অস্ত্রত্যাগ করেছেন। অর্জুন যাতে নিহত হয় আপনি সেই চেষ্টা করুন। এই কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্রধর্মকে ধিক! এই বলে তিনি অর্জুনের সম্মুখীন হলেন। তাঁদের শঙ্খের নিনাদে এবং রথচক্রের ঘর্ঘরে ভূমি কম্পিত শব্দিত ও বিদীর্ণ হ’তে লাগল। দেবতা গন্ধর্ব চারণ ও ঋষিগণ বললেন, এই দুই মহারথই অজেয়, এঁদের যুদ্ধে প্রলয়কাল পর্যন্ত চলবে।

 ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রোণের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল। পাণ্ডবপক্ষীয় চেদিসৈন্য বিপক্ষের কলিঙ্গ ও নিষাদ-সৈন্য কর্তৃক পরাভূত হয়েছে দেখে ভীমসেন কলিঙ্গসৈন্যের উপর শরাঘাত করতে লাগলেন। কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু এবং তাঁর পুত্র শক্রদেব ও ভানুমান ভীমকে বাধা দিতে এলেন। ভীম অসংখ্য সৈন্য বধ করছেন দেখে ভীষ্ম তাঁর কাছে এলেন এবং শরাঘাতে ভীমের অশ্বসকল বিনষ্ট করলেন। ভীম ভীষ্মের সারথিকে বধ করলেন, ভীষ্মের চার অশ্ব বায়ুবেগে তাঁর রথ নিয়ে রণভূমি থেকে চ’লে গেল। কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু ও তাঁর দুই পুত্র ভীমের হস্তে সসৈন্যে নিহত হলেন। দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হ’তে লাগল, দুর্যোধন ও অর্জুন নিজ নিজ পুত্রকে সাহায্য করতে এলেন। অর্জুনের শরাঘাতে অসংখ্য সৈন্য নিহত হচ্ছে এবং বহু যোদ্ধা পালাচ্ছে দেখে ভীষ্ম দ্রোণকে বললেন, এই কালান্তক যম তুল্য অর্জুনকে আজ কিছুতেই জয় করা যাবে না, আমাদের যোদ্ধারা শ্রান্ত ও ভীত হয়েছে।

 বিজয়ী পাণ্ডবগণ সিংহনাদ করতে লাগলেন। এই সময়ে সূর্যাস্ত হওয়ায় অবহার ঘোষিত হ’ল।

৯। কৃষ্ণের ক্রোধ

(তৃতীয় দিনের যুদ্ধ)

 রাত্রি প্রভাত হ’লে কুরুপিতামহ ভীষ্ম গারুড় ব্যূহ এবং পাণ্ডবগণ অর্ধচন্দ্র ব্যূহ রচনা করলেন। দুই পক্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল, দ্রোণরক্ষিত কৌরবব্যূহ এবং ভীমার্জুনরক্ষিত পাণ্ডবব্যূহ কোনওটি বিচ্ছিন্ন হ’ল না, সৈন্যগণ ব্যূহের অগ্রভাগ থেকে নির্গত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। মনুষ্য অশ্ব ও হস্তীর মৃতদেহে এবং মাংসশোণিতের কর্দমে রণভূমি অগম্য হয়ে উঠল। জগতের বিনাশসূচক অসংখ্য কবন্ধ চতুর্দিকে উঠতে লাগল। কুরুপক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ জয়দ্রথ পুরুমিত্র বিকর্ণ ও শকুনি, এবং পাণ্ডবপক্ষে ভীমসেন ঘটোৎকচ সাত্যকি চেকিতান ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ বিপক্ষের সৈন্য বিদ্রাবিত করতে লাগলেন। ভীমের শরাঘাতে দুর্যোধন অচেতন হয়ে রথের উপর পড়ে গেলেন। তাঁর সারথি তাঁকে সত্বর রণভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল, তাঁর সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল।

 সংজ্ঞালাভ ক’রে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, আপনি, অস্ত্রজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ দ্রোণ, এবং মহাধনুর্ধর কৃপ জীবিত থাকতে আমাদের সৈন্য পালাচ্ছে, এ অতি অসংগত মনে করি। পাণ্ডবগণ কখনও আপনাদের সমান নয়, তারা নিশ্চয় আপনার অনুগ্রহভাজন তাই আমাদের সৈন্যক্ষয় আপনি উপেক্ষা করছেন। আপনার উচিত ছিল পূর্বেই আমাকে বলা যে পাণ্ডব, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করবেন না। আপনার দ্রোণের ও কৃপের মনোভাব পূর্বে জানতে পারলে আমি কর্ণের সঙ্গেই কর্তব্য স্থির করতাম। যদি আপনারা আমাকে ত্যাগ না ক’রে থাকেন তবে এখন যথাশক্তি যুদ্ধ করুন।

 ক্রোধে চক্ষু বিস্ফাতি ক’রে ভীষ্ম সহাস্যে বললেন, রাজা, তোমাকে আমি বহু বার বলেছি যে পাণ্ডবগণ ইন্দ্রাদি দেবতারও অজেয়। আমি বৃদ্ধ, তথাপি যথাশক্তি যুদ্ধ করব, আজ আমি একাকীই পাণ্ডবগণকে তাদের সৈন্য ও বন্ধু সমেত প্রত্যাহত করব। ভীষ্মের এই প্রতিজ্ঞা শুনে দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা আনন্দিত হয়ে শঙ্খ ও ভেরী বাজালেন।

 সেই দিনে পূর্বাহ্ন অতীত হ’লে ভীষ্ম বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে এবং দুর্যোধনাদি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবিত হলেন। তাঁর শরবর্ষণে পীড়িত হয়ে পাণ্ডবগণের মহাসেনা প্রকম্পিত হ’ল, মহারথগণ পালাতে লাগলেন, অর্জুন প্রভৃতি চেষ্টা ক’রেও তাঁদের নিবারণ করতে পারলেন না। পাণ্ডবসেন। ভগ্ন হ’ল, পালাবার সময়েও দুজন একত্র রইল না, সকলে বিমূঢ় হয়ে হাহাকার করতে লাগল।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, পার্থ, তোমার আকাঙ্ক্ষিত কাল উপস্থিত হয়েছে, যদি মোহগ্রস্ত না হও তবে ভীষ্মকে প্রহার কর। অর্জুনের অনুরোধে কৃষ্ণ ভীষ্মের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। তখন ভীষ্ম ও অর্জুনের ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল। অর্জুনের হস্তলাঘব দেখে ভীষ্ম বললেন, সাধু পার্থ, সাধু পাণ্ডুপুত্র! বৎস, আমি অতিশয় প্রীত হয়েছি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর। এই সময়ে কৃষ্ণ অশ্বচালনায় পরম কৌশল দেখালেন, তিনি ভীষ্মের বাণ ব্যর্থ ক’রে দ্রুতবেগে মণ্ডলাকারে রথ চালাতে লাগলেন।

 ভীষ্মের পরাক্রম এবং অর্জুনের মৃদু যুদ্ধ দেখে ভগবান কেশব এই চিন্তা করলেন—যুধিষ্ঠির বলহীন হয়েছেন, তাঁর মহাসৈন্য ভগ্ন হয়ে পালাচ্ছে এবং কৌরবগণ হৃষ্ট হয়ে দ্রুতবেগে আসছে। তীক্ষ্ণ শরে আহত হয়েও অর্জুন নিজের কর্তব্য বুঝছেন না, ভীষ্মের গৌরব তাঁকে অভিভূত করেছে। আজ আমিই ভীষ্মকে বধ ক’রে পাণ্ডবদের ভার হরণ করব।

 সাত্যকি দেখলেন, কৌরবগণের শত সহস্র অশ্বারোহী গজারোহী রথী ও পদাতি অর্জুনকে বেষ্টন করছে এবং ভীষ্মের শরবর্ষণে পীড়িত হয়ে বহু পাণ্ডবসৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। সাত্যকি বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, কোথায় যাচ্ছ? পলায়ন সজ্জনের ধর্ম নয়, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ক'রো না, বীরধর্ম পালন কর। কৃষ্ণ বললেন, সাত্যকি, যারা যাচ্ছে তারা যাক, যারা আছে তারাও যাক। দেখ, আজ আমিই অনুচর সহ ভীষ্ম-দ্রোণকে নিপাতিত করব। এই পার্থসারথির কাছে কোনও কৌরব নিস্তার পাবে না, আজ আমি ভীষ্ম-দ্রোণাদি এবং ধার্তরাষ্ট্রগণকে বধ ক’রে অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরকে রাজপদে বসাব।

 স্মরণমাত্র কৃষ্ণের হস্তাগ্রে সুদর্শন চক্র আরূঢ় হ’ল। তিনি রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সেই ক্ষুরধার সূর্যপ্রভ সহস্রবজ্রতুল্য চক্র ঘূর্ণিত করলেন, এবং সিংহ যেমন মদমত্ত হস্তীকে বধ করতে যায় সেইরূপ ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। কৃষ্ণের অঙ্গে লম্বমান পীতবর্ণ উত্তরীয়, তিনি বিদ্যদ্‌বেষ্টিত মেঘের ন্যায় সগর্জনে সক্রোধে চক্রহস্তে আসছেন, এই দেখে কৌরবগণের বিনাশের ভয়ে সকলে আর্তনাদ ক’রে উঠল। ভীষ্ম তাঁর ধনুর জ্যাকর্ষণে ক্ষান্ত হলেন এবং ধীরভাবে কৃষ্ণকে বললেন, দেবেশ জগন্নিবাস চক্রপাণি মাধব, এস এস, তোমাকে নমস্কার করি। সর্বশরণ্য লোকনাথ, আমাকে রথ থেকে নিপাতিত কর। কৃষ্ণ, তোমার হস্তে নিহত হ’লে আমি ইহলোকে ও পরলোকে শ্রেয়োলাভ করব। তুমি আমার প্রতি ধাবিত হয়েছ তাতেই আমি সর্বলোকের নিকট সম্মানিত হয়েছি।

 অর্জুন রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কৃষ্ণের দুই বাহু ধরলেন এবং প্রবল বায়ুতে বৃক্ষ যেমন চালিত হয় সেইরূপ কৃষ্ণ কর্তৃক কিছুদূর বেগে চালিত হলেন, তার পর কৃষ্ণের দুই চরণ ধ’রে তাঁকে সবলে নিবৃত্ত করলেন। অর্জুন প্রণাম ক’রে বললেন, কেশব, তুমিই পাণ্ডবদের গতি, ক্রোধ সংবরণ কর। আমি পুত্র ও ভ্রাতাদের নামে শপথ করছি, আমার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করব না, তোমার নিয়োগ অনুসারে কৌরবগণকে বধ করব। কৃষ্ণ প্রসন্ন হয়ে আবার রথে উঠলেন এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে সর্ব দিক ও আকাশ নিনাদিত করলেন।

 তার পর অর্জুন অতি ভয়ংকর মাহেন্দ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। কৌরবপক্ষের বহু পদাতি অশ্ব রথ ও গজ বিনষ্ট হ’ল, রণভূমিতে রক্তের নদী বইতে লাগল। সূর্যাস্ত হ’লে ভীষ্ম দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতি যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন। কৌরব সৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ অর্জুন দশ হাজার রথী, সাত শ হস্তী এবং সমস্ত প্রাচ্য সৌবীর ক্ষুদ্রক ও মালব সৈন্য নিপাতিত করেছেন, তিনি একাকীই ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ভূরিশ্রবা শল্য প্রভৃতি বীরগণকে জয় করেছেন। এই ব’লে তারা বহু সহস্র মশাল জ্বেলে ত্রস্ত হয়ে শিবিরে চ’লে গেল।

১০। ঘটোৎকচের জয়

(চতুর্থ দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন প্রভাতে ভীষ্ম সসৈন্যে মহাবেগে অর্জুনের অভিমুখে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা শল্য শল্যপুত্র ও চিত্রসেনের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হ’তে লাগল। ধৃষ্টদ্যুম্ন গদাঘাতে শল্যপুত্রের মস্তক চূর্ণ করলেন। শল্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন, দুর্যোধন দুঃশাসন বিকর্ণ প্রভৃতি শল্যের রথ রক্ষা করতে লাগলেন। ভীমসেন আসছেন দেখে তাঁকে বাধা দেবার জন্য দুর্যোধন দশ হাজার গজসৈন্য পাঠালেন। ভীম সেই হস্তীর দল গদাঘাতে বিনষ্ট ক’রে রণস্থলে শংকরের ন্যায় নৃত্য করতে লাগলেন।

 সেনাপতি, জলসন্ধ, সুষেণ, বীরবাহু, ভীম, ভীমরথ, সুলোচন প্রভৃতি দুর্যোধনের চোদ্দ জন ভ্রাতা ভীমসেনকে আক্রমণ করলেন। পশুদলের মধ্যে ব্যাঘ্রের ম্যায় সৃক্কণী লেহন ক’রে ভীমসেন সেনাপতির শিরশ্ছেদন করলেন, জলসন্ধের হৃদয় বিদীর্ণ করলেন এবং সুষেণ বীরবাহু ভীম ভীমরথ ও সুলোচনকে যমালয়ে পাঠালেন। দুর্যোধনের অন্য ভ্রাতারা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তখন ভীষ্মের আদেশে ভগদত্ত এক বৃহৎ হস্তীতে চড়ে ভীমসেনকে দমন করতে এলেন। ভগদত্তের শরাঘাতে ভীম মূর্ছিত হয়ে রথের ধ্বজদণ্ড ধ’রে রইলেন। পিতা ভীমসেনের এই অবস্থা দেখে ঘটোৎকচ তখনই অন্তর্হিত হলেন এবং মায়াবলে ঘোর মূর্তি ধারণ করে ঐরাবত হস্তীতে আরূঢ় হয়ে দেখা দিলেন। তাঁর অনুচর রাক্ষসগণ অঞ্জন বামন ও মহাপদ্ম (পুণ্ডরীক) নামক দিগ্‌গজে চ’ড়ে উপস্থিত হ’ল। এইসকল চতুর্দন্ত দিগ্‌গজ চতুর্দিক থেকে ভগদত্তের হস্তীকে আক্রমণ করলে। ভগদত্তের হস্তী আর্তনাদ ক’রে পালাতে লাগল।

 ভীষ্ম দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতি ভগদত্তকে রক্ষা করবার জন্য দ্রুতবেগে এলেন, যুধিষ্ঠিরাদিও তাঁদের পিছনে চললেন। সেই সময়ে ঘটোৎকচ অশনিগর্জনের ন্যায় সিংহনাদ করলেন। ভীষ্ম বললেন, দুরাত্মা হিড়িম্বাপুত্রের সঙ্গে এখন আমি যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না, ও এখন বলবীর্য ও সহায় সম্পন্ন। আমাদের বাহনসকল শ্রান্ত হয়েছে, আমরা ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, সূর্যও অস্তে যাচ্ছেন, অতএব এখন যুদ্ধের বিরাম হ’ক।

১১। সাত্যকিপুত্রগণের মৃত্যু

(পঞ্চম দিনের যুদ্ধ)

 রাত্রিকালে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, আপনি এবং দ্রোণ শল্য কৃপ অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা ভগদত্ত প্রভৃতি সকলেই মহারথ, আপনারা এই যুদ্ধে দেহত্যাগে প্রস্তুত এবং ত্রিলোকজয়েও সমর্থ। তথাপি পাণ্ডবরা আমাদের জয় করছে কেন?

 ভীষ্ম বললেন, রাজা, এ বিষয়ে তোমাকে আমি বহুবার বলেছি, কিন্তু তুমি আমার কথা শোন নি। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর, তাতে তোমার ও জগতের মঙ্গল হবে। তুমি পাণ্ডবদের অবজ্ঞা করতে, তার ফল এখন পাচ্ছ। শার্ঙ্গধর কৃষ্ণ যাঁদের রক্ষা করেন সেই পাণ্ডবদের জয় করতে পারে এমন কেউ অতীত কালে ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আমি এবং বেদজ্ঞ মুনিরা পূর্বেই তোমাকে বারণ করেছিলাম যে বাসুদেবের সঙ্গে বিরোধ ক’রো না, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রো না, কিন্তু তুমি মোহবশে এ কথা গ্রাহ্য কর নি। আমার মনে হয় তুমি মোহগ্রস্ত রাক্ষস। গাণ্ডবগণ কৃষ্ণের সাহায্য ও আত্মীয়তায় রক্ষিত, সেজন্য তারা জয়ী হবেই।

 পরদিন প্রভাতকালে ভীষ্ম মকর ব্যূহ এবং পাণ্ডবগণ শোন ব্যূহ রচনা করলেন। দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হ’তে লাগল। পূর্বদিনে কৌরবপক্ষের সৈন্যক্ষয় এবং ভ্রাতাদের মৃত্যু স্মরণ ক’রে দুর্যোধন বললেন, আচার্য, আপনি সর্বদা আমার হিতকামী, আপনার ও পিতামহ ভীষ্মের সাহায্যে আমরা দেবগণকেও জয় করতে পারি, হীনবল পাণ্ডবরা দূরের কথা। আপনি এমন চেষ্টা করুন যাতে পাণ্ডবরা মরে। দ্রোণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি নির্বোধ তাই পাণ্ডবদের পরাক্রম জান না। তাদের জয় করা অসম্ভব, তথাপি আমি যথাশক্তি তোমার কর্ম করব।

 ভীষ্ম তুমল যুদ্ধ করতে লাগলেন। ভীষ্মের সহিত অর্জুন, দুর্যোধনের সহিত ভীম, শল্যের সহিত যুধিষ্ঠির, এবং দ্রোণ-অশ্বত্থামার সহিত সাত্যকি চেকিতান ও দ্রুপদ যুদ্ধে নিরত হলেন। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি হ’লে যেমন শব্দ হয়, তীক্ষ বাণে ছিন্ন নরমুণ্ডের পতনে সেইরূপ শব্দ হতে লাগল। সাত্যকির মহাবল দশ পুত্র ভূরিশ্রবাকে বেষ্টন ক’রে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। ভূরিশ্রবা ভল্লের আঘাতে দশ জনেরই শিরশ্ছেদন করলেন।

 পুত্রদের নিহত দেখে সাত্যকি ভূরিশ্রবাকে আক্রমণ করলেন। দুজনেরই রথ ও অশ্ব বিনষ্ট হ’ল, তাঁরা খড়্‌গ ও চর্ম (ঢাল) ধারণ ক’রে লম্ফ দিয়ে পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। তখন ভীমসেন সাত্যকিকে এবং দুর্যোধন ভূরিশ্রবাকে নিজের রথে তুলে নিলেন। এই দিনে অর্জুনের শরাঘাতে কৌরবপক্ষের পঁচিশ হাজার মহারথ নিহত হলেন। তার পর সূর্যাস্ত হ’লে ভীষ্ম অবহার ঘোষণা করলেন।

১২। ভীমের জয়

(ষষ্ঠ দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন ধৃষ্টদ্যুম্ন মকর ব্যূহ এবং ভীষ্ম ক্রৌঞ্চ ব্যূহ নির্মাণ করলেন। ভীষ্ম-দ্রোণের সঙ্গে ভীমার্জুনের ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল, তাঁদের শরবর্ষণে পীড়িত হয়ে দুই পক্ষের অসংখ্য সেনা পালিয়ে গেল।


 যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, সঞ্জয়, আমার সৈন্যগণ বহু গুণসম্পন্ন, তারা অতিবৃদ্ধ বা বালক নয়, কৃশ বা স্থূল নয়, তারা ক্ষিপ্রকারী দীর্ঘাকার দৃঢ়দেহ ও নীরোগ। তারা সর্বপ্রকার অস্ত্রপ্রয়োগে শিক্ষিত এবং হস্তী অশ্ব ও রথ চালনায় নিপুণ। পরীক্ষা ক’রে উপযুক্ত বেতন দিয়ে তাদের নিযুক্ত করা হয়েছে, গোষ্ঠী (আড্‌ডা) থেকে তাদের আনা হয় নি, বন্ধুদের অনুরোধেও নেওয়া হয় নি। সেনাপতির কর্মে অভিজ্ঞ বিখ্যাত মহারথগণ তাদের নেতা, তথাপি যুদ্ধের বিপরীত ফল দেখা যাচ্ছে। হয়তো দেবতারাই পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধে নেমে আমার সৈন্য সংহার করছেন। বিদুর সর্বদাই হিতবাক্য বলেছেন, কিন্তু আমার মূর্খ পুত্র তা শোনে নি। বিধাতা যা নির্দিষ্ট করেছেন তার অন্যথা হবে না।

 সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আপনার দোষেই দ্যূতক্রীড়া হয়েছিল, তার ফল এই যুদ্ধ। আপনি এখন নিজ কর্মের ফল ভোগ করছেন। তার পর সঞ্জয় পুনর্বার যুদ্ধবিবরণ বলতে লাগলেন।


 ভীম রথ থেকে নেমে তাঁর সারথিকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং কৌরবসেনার মধ্যে প্রবেশ ক’রে গদাঘাতে হস্তী অশ্ব রথী ও পদাতি বিনষ্ট করতে লাগলেন। ভীমের শূন্য রথ দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন উদ্‌বিগ্ন হয়ে ভীমের কাছে গেলেন এবং তাঁর দেহে বিদ্ধ বাণসকল তুলে ফেলে তাঁকে আলিঙ্গন করে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন। দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমোহন অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, তাতে দুর্যোধনাদি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। এই অবকাশে ভীমসেন বিশ্রাম ও জলপান ক’রে সুস্থ হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের সহযোগে আবার যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনাদির অবস্থা শুনে দ্রোণাচার্য সত্বর এলেন এবং প্রজ্ঞাস্ত্র দ্বারা প্রমোহন অস্ত্রের প্রভাব নষ্ট করলেন।

 যুধিষ্ঠিরের আদেশে অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও ধৃষ্টকেতু সসৈন্যে ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সাহায্য করতে এলেন এবং সূচীমুখ ব্যূহ রচনা করে কুরুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন। তখন দ্রোণ ও দুর্যোধনাদির সঙ্গে ভীমসেন ও ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রবল যুদ্ধ হচ্ছিল।

 অপরাহ্ন আগত হ’ল, ভাস্কর লোহিত বর্ণ ধারণ করলেন। ভীম দুর্যোধনকে বললেন, বহু বর্ষ যার কামনা করেছি সেই কাল এখন এসেছে, যদি যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত না হও তো আজ তোমাকে বধ করব, জননী কুন্তী ও দ্রৌপদীর সকল ক্লেশ এবং বনবাসের কষ্টের প্রতিশোধ নেব। আজ তোমাকে সবান্ধবে বধ ক’রে তোমার সমস্ত পাপের শান্তি করাব। ভীমের শরাঘাতে দুর্যোধনের ধনু ছিন্ন, সারথি আহত, এবং চার অশ্ব নিহত হ’ল। দুর্যোধন শরবিদ্ধ হয়ে মূর্ছিত হলেন, কৃপাচার্য তাঁকে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন।

 অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীপুত্র শ্রুতকর্মা সুতসোম শ্রুতসেন ও শতানীকের শরাঘাতে দুর্যোধনের চার ভ্রাতা বিকর্ণ দুর্মুখ জয়ৎসেন ও দুষ্কর্ণ বিদ্ধ হয়ে ভূপতিত হলেন। সূর্যাস্তের পরেও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল, তার পর অবহার ঘোষিত হ’লে কৌরব ও পাণ্ডবগণ নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলেন।

১৩। বিরাটপুত্র শঙ্খের মৃত্যু ― ইরাবান ও নকুল-সহদেবের জয়

(সপ্তম দিনের যুদ্ধ)

 রক্তাক্তদেহে চিন্তাকুলমনে দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে গিয়ে বললেন, পাণ্ডবরা আমাদের ব্যূহবদ্ধ বীর সৈন্যগণকে নিপীড়িত ক’রে হৃষ্ট হয়েছে। আমাদের মকর ব্যূহের ভিতরে এসে ভীম আমাকে পরাস্ত করেছে, তার ক্রোধ দেখে আমি মূর্ছিত হয়েছিলাম, এখনও আমি শান্তি পাচ্ছি না। সত্যসন্ধ পিতামহ, আপনার প্রসাদে যেন পাণ্ডবগণকে বধ ক’রে আমি জয়লাভ করতে পারি। ভীষ্ম হেসে বললেন, রাজপুত্র, আমি নিজের মনোভাব গোপন করছি না, সর্বপ্রযত্নে তোমাকে বিজয়ী ও সুখী করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু পাণ্ডবদের সহায় হ’য়ে যাঁরা ক্রোধবিষ উদ্‌গার করছেন তাঁরা সকলেই মহারথ অস্ত্রবিশারদ ও বলগর্বিত, তুমি পূর্বে তাঁদের সঙ্গে শত্রুতাও করেছিলে। তোমার জন্য আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করব, নিজের জীবনরক্ষার চেষ্টা করব না। পাণ্ডবগণ ইন্দ্রের তুল্য বিক্রমশালী, বাসুদেব তাঁদের সহায়, তাঁরা দেবগণেরও অজেয়। তথাপি আমি তোমার কথা রাখব, হয় আমি পাণ্ডবদের জয় করব নতুবা তাঁরা আমাকে জয় করবেন।

 ভীষ্ম দুর্যোধনকে বিশল্যকরণী ওষধি দিলেন, তার প্রয়োগে দুর্যোধন সুস্থ হলেন। পরদিন ভীষ্ম মণ্ডল ব্যূহ এবং যধিষ্ঠির বজ্র ব্যূহ রচনা করলেন। যুদ্ধকালে অর্জুনের বিক্রম দেখে দুর্যোধন স্বপক্ষের রাজাদের বললেন, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম জীবনের মায়া ত্যাগ করে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, আপনারা সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন। রাজারা তখনই সসৈন্যে ভীষ্মের কাছে গেলেন।

 দ্রোণ বিরাট পরস্পরকে শরাঘাত করতে লাগলেন। বিরাটের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হ’লে তিনি তাঁর পুত্র শঙ্খের রথে উঠলেন। দ্রোণ এক আশীবিষতুল্য বাণ নিক্ষেপ করলেন, তার আঘাতে শঙ্খ নিহত হয়ে প’ড়ে গেলেন। তখন ভীত বিরাট কালান্তক যমতুল্য দ্রোণকে ত্যাগ করে চ’লে গেলেন।

 সাত্যকির ঐন্দ্র অস্ত্রে রাক্ষস অলম্বুষ রণস্থল থেকে বিতাড়িত হ’ল। ধৃষ্টদ্যুম্নের শরাঘাতে দুর্যোধনের রথের অশ্ব বিনষ্ট হ’ল, শকুনি তাঁকে নিজের রথে তুলে নিলেন। অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনপুত্র ইরাবানের[] সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অনুবিন্দের চার অশ্ব নিহত হ’ল, তিনি বিন্দের রথে উঠলেন। ইরাবান বিন্দের সারথিকে বধ করলেন, তখন বিন্দের অশ্বসকল উদ্ভ্রান্ত হয়ে রথ নিয়ে চার দিকে ছুটতে লাগল। ভগদত্তের সহিত যুদ্ধে ঘটোৎকচ পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেলেন। শল্য ও তাঁর দুই ভাগিনেয় নকুল-সহদেব পরম প্রীতি সহকারে যুদ্ধ করতে লাগলেন। শল্য সহাস্যে বাণ দ্বারা নকুলের রথধ্বজ ও ধনু ছিন্ন এবং সারথি ও অশ্ব নিপাতিত করলেন, নকুল সহদেবের রথে উঠলেন। তখন সহদেব মহাবেগে এক শর নিক্ষেপ ক’রে মাতুলের দেহ ভেদ করলেন, শল্য অচেতন হয়ে রথমধ্যে পড়ে গেলেন, তাঁর সারথি তাঁকে নিয়ে রণস্থল থেকে চলে গেল। চেকিতান ও কৃপাচার্যের রথ নষ্ট হওয়ায় তাঁরা ভূমিতে যুদ্ধ করছিলেন। তাঁরা পরস্পরের খড়্‌গাঘাতে আহত হয়ে মূর্ছিত হলেন, শিশুপালপুত্র করকর্ষ ও শকুনি নিজ নিজ রথে তাঁদের তুলে নিলেন।

 ভীষ্ম শিখণ্ডীর ধনু ছেদন করলেন। যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, শিখণ্ডী, তুমি তোমার পিতার সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে ভীষ্মকে বধ করবে। তোমার প্রতিজ্ঞা যেন মিথ্যা না হয়, স্বধর্ম যশ ও কুলমর্যাদা রক্ষা কর। ভীষ্মের কাছে পরাস্ত হয়ে তুমি নিরুৎসাহ হয়েছ। ভ্রাতা ও বন্ধুদের ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ? তোমার বীর খ্যাতি আছে, তবে ভীষ্মকে ভয় করছ কেন?

 যুধিষ্ঠিরের ভর্ৎসনায় লজ্জিত হয়ে শিখণ্ডী পুনর্বার ভীষ্মের প্রতি ধাবিত হলেন। শল্য আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, শিখণ্ডী তা বরণাস্ত্র দিয়ে প্রতিহত করলেন। তার পর শিখণ্ডী ভীষ্মের সম্মুখীন হলেন, কিন্তু তাঁর পূর্বের স্ত্রীত্ব স্মরণ ক’রে ভীষ্ম শিখণ্ডীকে অগ্রাহ্য করলেন।

 সূর্যাস্ত হ’লে পাণ্ডব ও কৌরবগণ রণস্থল ত্যাগ করে নিজ নিজ শিবিরে গিয়ে পরস্পরের প্রশংসা করতে লাগলেন। তার পর তাঁরা দেহ থেকে শল্য (বাণাগ্র প্রভৃতি) তুলে ফেলে নানাবিধ জলে স্নান ক’রে স্বস্ত্যয়ন করলেন। স্তুতিপাঠক বন্দী এবং গায়ক ও বাদকগণ তাঁদের মনোরঞ্জন করতে লাগল! সমস্ত শিবির যেন স্বর্গতুল্য হ’ল, কেউ যুদ্ধের আলোচনা করলেন না। তার পর তাঁরা শ্রান্ত হয়ে নিদ্রিত হলেন।

১৪। ইরাবানের মৃত্যু ― ঘটোৎকচের মায়া

(অষ্টম দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন ভীষ্ম কূর্ম ব্যূহ এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন শৃঙ্গাটক ব্যূহ রচনা করলেন। যোদ্ধারা পরস্পরের নাম ধরে আহ্বান ক’রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। ভীষ্ম পাণ্ডবসৈন্য মর্দন করতে লাগলেন। এই দিনের যুদ্ধে দুর্যোধনের ভাতা সুনাভ অপরাজিত কুণ্ডধার পণ্ডিত বিশালাক্ষ মহোদৱ আদিত্যকেতু ও বহ্বাশী ভীমের হস্তে নিহত হলেন। ভ্রাতৃশোকে কাতর হয়ে দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে বিলাপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম বললেন, বৎস, আমি দ্রোণ বিদুর ও গান্ধারী পূর্বেই তোমাকে সাবধান করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমাদের কথা বোঝ নি। এ কথাও তোমাকে পূর্বে বলেছি যে আমি বা আচার্য দ্রোণ পাণ্ডবদের হাত থেকে কাকেও রক্ষা করতে পারব না। ভীম ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের যাকে পাবে তাকেই বধ করবে। অতএব তুমি স্থিরভাবে দৃঢ়চিত্তে স্বর্গকামনায় যুদ্ধ কর।

 অর্জনপুত্র ইরাবান কৌরবসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন, কম্বোজ সিন্ধু প্রভৃতি বহুদেশজাত দ্রুতগামী অশ্ব সুসজ্জিত হয়ে তাঁকে বেষ্টন ক’রে চলল। এই ইরাবান নাগরাজ ঐরাবতের দুহিতার গর্ভে অর্জুনের ঔরসে জন্মেছিলেন। ঐরাবতদুহিতার পূর্বপতি গরুড় কর্তৃক নিহত হন; তার পর ঐরাবত তাঁর শোকাতুরা অনপত্যা কন্যাকে অর্জুনের নিকট অর্পণ করেন। কর্তব্যবোধে অর্জুন সেই কামার্তা পরপত্নীর গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। এই পুত্রই ইরাবান। ইনি নাগলোকে জননী কর্তৃক পালিত হন। অর্জুনের প্রতি বিদ্বেষবশত এঁর পিতৃব্য দুরাত্মা অশ্বসেন এঁকে ত্যাগ করেন। অর্জুন যখন সুরলোকে অস্ত্রশিক্ষা করছিলেন তখন ইরাবান তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। অর্জুন তাঁকে বলেছিলেন, যুদ্ধকালে আমাদের সাহায্য ক’রো।

 গজ গবাক্ষ বৃষক চর্মবান আর্জক ও শুক—শকুনির এই ছয় ভ্রাতার সঙ্গে ইরাবানের যুদ্ধ হ’ল। ইরাবানের অনুগামী যোদ্ধারা গান্ধারসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন, গজ গবাক্ষ প্রভৃতি ছ জনকেই ইরাবান বধ করলেন। তখন দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে অলম্বুষ রাক্ষসকে বললেন, অর্জুনের এই মায়াবী পুত্র আমার ঘোর ক্ষতি করছে, তুমি ওকে বধ কর। বহু যোদ্ধায় পরিবেষ্টিত হয়ে অলম্বুষ ইরাবানকে আক্রমণ করলে। দুজনে মায়াযদ্ধ হ’তে লাগল। ইরাবান অনন্তনাগের ন্যায় বিশাল মূর্তি ধারণ করলেন, তাঁর মাতৃবংশীয় বহু নাগ তাঁকে ঘিরে রইল। অলম্বুষ গরুড়ের রূপ ধ’রে সেই নাগদের খেয়ে ফেললে। তখন ইরাবান মোহগ্রস্ত হলেন, অলম্বুষ খড়্‌গাঘাতে তাঁকে বধ করলে।

 ইরাবানকে নিহত দেখে ঘটোৎকচ ক্রোধে গর্জন ক’রে উঠলেন, তাতে কুরুসৈন্যদের ঊরুস্তম্ভ কম্প ও ঘর্মস্রাব হ’ল। দুর্যোধন ঘটোৎকচের দিকে ধাবিত হলেন, বঙ্গরাজ্যের অধিপতি দশ সহস্র হস্তী নিয়ে তাঁর পিছনে গেলেন। দুর্যোধনের উপর ঘটোৎকচ বর্ষার জলধারার ন্যায় শরবর্ষণ করতে লাগলেন, তাঁর শক্তির আঘাতে বঙ্গাধিপের বাহন হস্তী নিহত হ’ল। ঘটোৎকচ দ্রোণের ধনু ছেদন করলেন, বাহ্ণীক চিত্রসেন ও বিকর্ণকে আহত করলেন, এবং বৃহদ্‌বলের বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। এই লোমহর্ষকর সংগ্রামে কৌরবসৈন্য প্রায় পরাস্ত হ’ল।

 অশ্বত্থামা সত্বর এসে ঘটোৎকচ ও তাঁর অনুচর রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ঘটোৎকচ এক দারুণ মায়া প্রয়োগ করলেন, তার প্রভাবে কৌরবপক্ষের সকলে দেখলে, দ্রোণ দুর্যোধন শল্য ও অশ্বত্থামা রক্তাক্ত হয়ে ছিন্নদেহে ছটফট করছেন, কৌরববীরগণ প্রায় সকলে নিপাতিত হয়েছেন, এবং বহু সহস্র অশ্ব ও আরোহী খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। সৈন্যগণ শিবিরের দিকে ধাবিত হ’ল। তখন ভীষ্ম ও সঞ্জয় বললেন, তোমরা পালিও না, যুদ্ধ কর, যা দেখছ তা রাক্ষসী মায়া। সৈন্যরা বিশ্বাস করলে না, পালিয়ে গেল।

 দুর্যোধনের মুখে এই পরাজয়সংবাদ শুনে ভীষ্ম বললেন, বৎস, তুমি সর্বদা আত্মরক্ষায় সতর্ক থেকে যুধিষ্ঠির বা তাঁর কোনও ভ্রাতার সঙ্গে যুদ্ধ করবে, কারণ রাজধর্ম অনুসারে রাজার সঙ্গেই রাজা যুদ্ধ করেন। তার পর ভীষ্ম ভগদত্তকে বললেন, মহারাজ, আপনি শীঘ্র হিড়িম্বাপুত্র ঘটোৎকচের কাছে সসৈন্যে গিয়ে তাকে বধ করুন, আপনিই তার উপযুক্ত প্রতিযোদ্ধা।

 ঘটোৎকচের সঙ্গে ভীমসেন, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, চেদিরাজ, দশার্ণরাজ প্রভৃতি ছিলেন। ভগদত্ত সুপ্রতীক নামক বৃহৎ হস্তীতে আরোহণ ক’রে এলেন এবং ভীষণ শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। ঘটোৎকচ তা জানুতে রেখে ভেঙে ফেললেন। তখন ভগদত্ত সকলের উপর শরবর্ষণ করতে লাগলেন। এই সময়ে অর্জুন তাঁর পুত্র ইরাবানের মৃত্যুসংবাদ শুনে শোকাবিষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষ্ম কৃপ প্রভৃতিকে আক্রমণ করলেন। ভীমের শরাঘাতে দুর্যোধনেব সাত ভ্রাতা অনাধৃষ্টি কুণ্ডভেদী বিরাজ দীপ্তলোচন, দীর্ঘবাহু সুবাহু ও কনকধ্বজ বিনষ্ট হলেন, তাঁদের অন্য ভ্রাতারা ভয়ে পালিয়ে গেলেন।

 সন্ধ্যাকালে যুদ্ধের বিরাম হ’ল, কৌরব ও পাণ্ডবগণ নিজ নিজ শিবিরে চ’লে গেলেন।

১৫। ভীষ্মের পরাক্রম

(নবম দিনের যুদ্ধ)

 কর্ণ ও শকুনিকে দুর্যোধন বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ শল্য ও ভূরিশ্রবা পাণ্ডবগণকে কেন দমন করছেন না তার কারণ জানি না, তারা জীবিত থেকে আমার বল ক্ষয় করছে। দ্রোণের সমক্ষেই ভীম আমার ভ্রাতাদের বধ করেছে। কর্ণ বললেন, রাজা, শোক ক’রো না। ভীষ্ম যুদ্ধ থেকে সরে যান, তিনি দেহত্যাগ করলে তাঁর সমক্ষেই আমি পাণ্ডবদের সসৈন্যে বধ করব। ভীষ্ম সর্বদাই পাণ্ডবদের দয়া করেন, সেই মহারথগণকে জয় করবার শক্তিও তাঁর নেই। অতএব তুমি শীঘ্র ভীষ্মের শিবিরে যাও, বৃদ্ধ পিতামহকে সম্মান দেখিয়ে তাঁকে অস্ত্রত্যাগে সম্মত করাও।

 দুর্যোধন অশ্বারোহণে ভীষ্মের শিবিরে চললেন, তাঁর ভ্রাতারাও সঙ্গে গেলেন। ভৃত্যগণ গন্ধতৈলযুক্ত প্রদীপ নিয়ে পথ দেখাতে লাগল। উষ্ণীষকঞ্চুকধারী রক্ষিগণ বেত্রহস্তে ধীরে ধীরে চারিদিকের জনতা সরিয়ে দিলে। ভীষ্মের কাছে গিয়ে দুর্যোধন কৃতাঞ্জলি হয়ে সাশ্রুনয়নে গদ্‌গদকণ্ঠে বললেন, শত্রুহন্তা পিতামহ, আমার উপর কৃপা করুন, ইন্দ্র যেমন দানবদের বধ করেছিলেন আপনি সেইরূপ পাণ্ডবগণকে বধ করুন। আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করুন, পাণ্ডব পাঞ্চাল কেকয় প্রভৃতিকে বধ ক’রে সত্যবাদী হ’ন। যদি আমার দুর্ভাগ্যক্রমে কৃপাবিষ্ট হয়ে বা আমার প্রতি বিদ্বেষের বশে আপনি পাণ্ডবদের রক্ষা করতেই চান, তবে কর্ণকে যুদ্ধ করবার অনুমতি দিন, তিনিই পাণ্ডবগণকে জয় করবেন।

 দূর্যোধনের বাক্‌শল্যে বিদ্ধ হয়ে মহামনা ভীষ্ম অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হলেন, কিন্তু কোনও অপ্রিয় বাক্য বললেন না। দীর্ঘকাল চিন্তার পর তিনি মৃদুবাক্যে বললেন, দুর্যোধন, আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করছ কেন, আমি যথাশক্তি চেষ্টা করছি, তোমার প্রিয়কামনায় সমরানলে প্রাণ আহুতি দিতে প্রস্তুত হয়েছি। পাণ্ডবগণ কিরূপ পরাক্রান্ত তার প্রচুর নিদর্শন তুমি পেয়েছ। খাণ্ডবদাহকালে অর্জুন ইন্দ্রকেও পরাস্ত করেছিলেন। তোমার বীর ভ্রাতারা আর কর্ণ যখন পালিয়েছিলেন তখন অর্জুন তোমাকে গন্ধর্বদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বিরাটনগরে গোহরণকালে একাকী অর্জুন আমাদের সকলকে জয় ক’রে উত্তরকে দিয়ে আমাদের বস্ত্র হরণ করিয়েছিলেন। শঙ্খচক্রগদাধর অনন্তশক্তি সর্বেশ্বর পরমাত্মা বাসুদেব যাঁর রক্ষক সেই অর্জুনকে যুদ্ধে কে জয় করতে পারে? নারদাদি মহর্ষিগণ বহুবার তোমাকে বলেছেন কিন্তু তুমি মোহবশে বুঝতে পার না, মুমূর্ষু লোক যেমন সকল বৃক্ষই কাঞ্চনময় দেখে তুমিও সেইরূপ বিপরীত দেখছ। তুমিই এই মহাবৈর সৃষ্টি করেছ, এখন নিজেই যুদ্ধে ক’রে পৌরুষ দেখাও। আমি সোমক পাঞ্চাল ও কেকয়গণকে বিনষ্ট করব, হয় তাদের হাতে ম’রে যমালয়ে যাব নতুবা তাদের সংহার করে তোমাকে তুষ্ট করব। কিন্তু আমার প্রাণ গেলেও শিখণ্ডীকে বধ করব না, কারণ বিধাতা তাকে পূর্বে শিখণ্ডিনী রূপেই সৃষ্টি করেছিলেন। গান্ধারীপুত্র, সুখে নিদ্রা যাও, কাল আমি এমন মহাযুদ্ধ করব যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন নতমস্তকে প্রণাম ক’রে নিজের শিবিরে চলে গেলেন। ভীষ্ম নিজেকে তিরস্কৃত মনে করলেন, তাঁর অতিশয় আত্মগ্লানি হল।

 পরদিন ভীষ্ম সর্বতোভদ্র নামে এক মহাব্যূহ রচনা করলেন। কৃপ কৃতবর্মা জয়দ্রথ দ্রোণ ভূরিশ্রবা শল্য ভগদত্ত দুর্যোধন প্রভৃতি এই ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে রইলেন। পাণ্ডবগণও এক মহাব্যূহ রচনা করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, পাঞ্চালপুত্র, তুমি আজ শিখণ্ডীকে ভীষ্মের সম্মুখে রাখ, আমি তাঁর রক্ষক হব।

 যুদ্ধকালে নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা গেল, ভূমিকম্প ও উল্কাপাত হ’ল, শৃগাল কুক্কুর প্রভৃতি ভয়ংকর শব্দ করতে লাগল। পিঙ্গলতুরঙ্গবাহিত রথে আরূঢ় হয়ে মহাবীর অভিমন্যু শরাঘাতে কৌরবসৈন্য মথিত করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে রাক্ষস অলম্বুষ তাঁকে বাধা দিতে গেল। সে অরিঘাতিনী তামসী মায়া প্রয়োগ করলে, সর্ব স্থান অন্ধকারময় হ’ল, স্বপক্ষ বা পরপক্ষ কিছুই দেখা গেল না। তখন অভিমন্যু ভাস্কর অস্ত্রে সেই মায়া নষ্ট ক’রে অলম্বুষকে শরাঘাতে আচ্ছন্ন করলেন, অলম্বুষ রথ ফেলে ভয়ে পালিয়ে গেল।

 যুদ্ধকালে একবার পাণ্ডবপক্ষের অন্যবার কৌরবপক্ষের জয় হ’তে লাগল। অবশেষে ভীষ্মের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে পাণ্ডবসেনা বিধ্বস্ত হ’ল, মহারথগণও বারণ না শুনে পালাতে লাগলেন। নিহত হস্তী ও অশ্বের মৃতদেহে এবং ভগ্ন রথ ও ধজে রণস্থল ব্যাপ্ত হ’ল, সৈন্যগণ বিমূঢ় হয়ে হাহাকার করতে লাগল।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, বীর, তুমি বিরাটনগরে সঞ্জয়কে বলেছিলে যে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখ সমস্ত কুরুসৈন্য সংহার করবে। ক্ষত্রধর্ম স্মরণ ক’রে এখন সেই বাক্য সত্য কর। অর্জুন অধোমুখে অনিচ্ছুর ন্যায় বললেন, যাঁরা অবধ্য তাঁদের বধ ক’রে নরকের পথ স্বরূপ রাজ্যলাভ ভাল, না বনবাসে কষ্টভোগ করা ভাল? কৃষ্ণ, তোমার কথাই রাখব, ভীষ্মের কাছে রথ নিয়ে চল, কুরুপিতামহকে নিপাতিত করব। ভীষ্মের বাণবর্ষণে অর্জুনের রথ আচ্ছন্ন হ’ল, কৃষ্ণ অবিচলিত হয়ে আহত অশ্বদের বেগে চালাতে লাগলেন।[]

 ভীষ্ম ও পাণ্ডবগণের শরবর্ষণে দুই পক্ষেরই বহু সৈন্য বিনষ্ট হ’ল। পাণ্ডবসৈন্যগণ ভয়ার্ত হয়ে ভীষ্মের অমানুষিক বিক্রম দেখতে লাগল। এই সময়ে সূর্যাস্ত হ’ল, পাণ্ডব ও কৌরবগণ যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ শিবিরে চ’লে গেলেন। দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা বিজয়ী ভীষ্মের প্রশংসা করতে লাগলেন।

১৬। ভীষ্ম-সকাশে যুধিষ্ঠিরাদি

 শিবিরে এসে যুধিষ্ঠির তাঁর মিত্রদের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। তিনি কৃষ্ণকে বললেন, হস্তী যেমন নলবন মর্দন করে সেইরূপ ভীষ্ম আমাদের সৈন্য মর্দন করছেন। আমি বুদ্ধির দোষে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে শোকসাগরে নিমগ্ন হয়েছি। কৃষ্ণ, আমার বনে যাওয়াই ভাল, যুদ্ধে আর রুচি নেই, ভীষ্ম প্রতিদিনই আমাদের হনন করছেন। যে জীবনকে অতি প্রিয় মনে করি তা আজ দুর্লভ হয়েছে, এখন অবশিষ্ট জীবন ধর্মাচরণে যাপন করব। মাধব, যদি আমাদের প্রতি তোমার অনুগ্রহ থাকে তবে এমন উপদেশ দাও যাতে আমার স্বধর্মের বিরোধ না হয়।

 কৃষ্ণ বললেন, ধর্মপুত্র, বিষণ্ণ হবেন না, আপনার ভ্রাতারা শত্রুহন্তা দুর্জয় বীর। অর্জুন যদি ভীষ্মবধে অনিচ্ছুক হন তবে আপনি আমাকে নিযুক্ত করুন, আমি ভীষ্মকে যুদ্ধে আহ্বান ক’রে দুর্যোধনাদির সমক্ষেই তাঁকে বধ করব। যে পাণ্ডবদের শত্রু সে আমারও শত্রু, আপনার ও আমার একই ইষ্ট। আপনার ভ্রাতা অর্জুন আমার সখা সম্বন্ধী ও শিষ্য, তাঁর জন্য আমি নিজ দেহের মাংসও কেটে দিতে পারি। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে ভীষ্মকে নিপাতিত করবেন। এখন তিনি সেই কথা রাখুন, অথবা আমাকেই ভার দিন। ভীষ্ম বিপরীত পক্ষে যোগ দিয়েছেন, নিজের কর্তব্য বুঝছেন না, তাঁর বল ও জীবন শেষ হয়ে এসেছে।

 যুধিষ্ঠির বললেন, গোবিন্দ, তুমি আমাদের রক্ষক থাকলে আমরা ভীষ্মকে কেন, ইন্দ্রকেও জয় করতে পারি। কিন্তু স্বার্থের জন্য তোমাকে মিথ্যাবাদী করতে পারি না, তুমি যুদ্ধ না করেই আমাদের সাহায্য কর। ভীষ্ম আমাকে বলেছিলেন যে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করলেও তিনি আমার হিতের জন্য মন্ত্রণা দেবেন। অতএব আমরা সকলে মিলে তাঁর কাছে যাব এবং তাঁর বধের উপায় জেনে নেব। তিনি নিশ্চয় আমাদের হিতকর সত্য বাক্য বলবেন, আমাদের যাতে জয় হয় এমন মন্ত্রণা দেবেন। বালক ও পিতৃহীন অবস্থায় তিনিই আমাদের বর্ধিত করেছিলেন। মাধব, সেই বৃদ্ধ প্রিয় পিতামহকে আমি হত্যা করতে চাচ্ছি —ক্ষত্রজীবিকায় ধিক!

 পাণ্ডবগণ ও কৃষ্ণ কবচ ও অস্ত্র ত্যাগ ক’রে ভীষ্মের কাছে গিয়ে নতমস্তকে প্রণাম করলেন। সাদরে স্বাগত জানিয়ে ভীষ্ম বললেন, বৎসগণ, তোমাদের কি প্রিয়কার্য করব? নিঃশঙ্ক হয়ে বল, যদি অতি দুষ্কর কর্ম হয় তাও আমি করব। ভীষ্ম প্রীতিপূর্বক বার বার এইরূপ বললে যুধিষ্ঠির দীনমনে বললেন, সর্বজ্ঞ, কোন্ উপায়ে আমরা জয়ী হব, রাজ্যলাভ করব? প্রজারা কিসে রক্ষা পাবে? আপনার বধের উপায় বলুন। যুদ্ধে আপনার বিক্রম আমরা কি করে সইব? আপনার সূক্ষ্ম ছিদ্রও দেখা যায় না, কেবল মণ্ডলাকার ধনুই দেখতে পাই। আপনি রথে সূর্যের ন্যায় বিরাজ করেন; কখন বাণ নেন, কখন সন্ধান করেন, কখন জ্যাকর্ষণ করেন, কিছুই দেখতে পাই না। আপনার শরবর্ষণে আমাদের বিপুল সেনা ক্ষয় পাচ্ছে। পিতামহ, বলন কিরূপে আমরা জয়ী হব।

 ভীষ্ম বললেন, পাণ্ডবগণ, আমি জীবিত থাকতে তোমাদের জয়লাভ হবে না। যদি জয়ী হ’তে চাও তবে অনুমতি দিচ্ছি তোমরা শীঘ্র যথাসুখে আমাকে প্রহার কর। এই কার্যই তোমাদের কর্তব্য মনে করি, আমি হত হ’লে সকলেই হত হবে। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি দণ্ডধর ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় যুদ্ধ করেন, বজ্রধর ইন্দ্র এবং সমস্ত সুরাসুরও আপনাকে জয় করতে পারেন না, আমরা কি করে জয়ী হব তার উপায় বলুন। ভীষ্ম বললেন, পাণ্ডুপুত্র, তোমার কথা সত্য, সশস্ত্র হয়ে যুদ্ধ করলে আমি সুরাসুরেরও অজেয়। কিন্তু আমি যদি অস্ত্র ত্যাগ করি তবে তোমরা আমাকে বধ করতে পারবে। নিরস্ত্র, ভূপতিত, বর্ম ও ধ্বজ বিহীন, পলায়মান, ভীত, শরণাপন্ন, স্ত্রী, স্ত্রীনামধারী, বিকলেন্দ্রিয়, একপুত্রের পিতা, এবং নীচজাতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। যার ধ্বজ অমঙ্গলসূচক তার সঙ্গেও যুদ্ধ করি না। তোমার সেনাদলে দ্রুপদপুত্র মহারথ শিখণ্ডী আছেন, তিনি পূর্বে স্ত্রী ছিলেন তা তোমরা জান। শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে অর্জুন আমার প্রতি তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করুন। এই উপায়ে তোমরা ধার্তরাষ্ট্রগণকে জয় করতে পারবে।

 কুরুপিতামহ মহাত্মা ভীষ্মকে অভিবাদন ক’রে পাণ্ডবগণ নিজেদের শিবিরে ফিরে গেলেন। ভীষ্মকে প্রাণবিসর্জনে প্রস্তুত দেখে অর্জুন দুঃখিত ও লজ্জিত হয়ে বললেন, মাধব, কুরুবৃদ্ধ পিতামহের সঙ্গে কি ক’রে যদ্ধ করব? আমি বাল্যকালে গায়ে ধূলি মেখে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকেও ধূলিলিপ্ত করেছি, তাঁর কোলে উঠে পিতা ব’লে ডেকেছি[]। তিনি বলতেন, বৎস, আমি তোমার পিতা নই, পিতার পিতা। সেই ভীষ্মকে কি ক’রে বধ করব? তিনি যেমন ইচ্ছা আমাদের সৈন্য ধ্বংস করুন, আমি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করব না, তাতে আমার জয় বা মৃত্যু যাই হ’ক। কৃষ্ণ, তুমি কি বল?

 কৃষ্ণ বললেন, তুমি ক্ষাত্রধর্মানুসারে ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞা করেছ, এখন পশ্চাৎপদ হচ্ছ কেন? তুমি ওই দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয় বীরকে রথ থেকে নিপাতিত কর, নতুবা তোমার জয়লাভ হবে না। দেবতারা পূর্বেই জেনেছেন যে ভীষ্ম যমালয়ে যাবেন, এর অন্যথা হবে না। মহাবুদ্ধি বৃহস্পতি ইন্দ্রকে কি বলেছিলেন শোন—বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ গুণবান পুরুষও যদি আততায়ী হয়ে আসেন তবে তাঁকে বধ করবে।

১৭। ভীষ্মের পতন

(দশম দিনের যুদ্ধ)

 পরদিন সূর্যোদয় হ’লে পাণ্ডবগণ সর্বশত্রুজয়ী ব্যূহ রচনা ক’রে শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে যুদ্ধ করতে গেলেন। ভীম অর্জুন দ্রৌপদীপুত্রগণ অভিমন্যু সাত্যকি চেকিতান ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে রইলেন। যুধিষ্ঠির নকুল-সহদেব বিরাট কেকয়-পঞ্চভ্রাতা ও ধৃষ্টকেতু পশ্চাতে গেলেন। ভীষ্ম কৌরবসেনার অগ্রভাগে রইলেন; দুর্যোধনাদি দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ ভগদত্ত কৃতবর্মা শকুনি বৃহদ্‌বল প্রভৃতি পশ্চাতে গেলেন।

 শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী ক’রে অর্জুন প্রভৃতি শরবর্ষণ করতে করতে ভীষ্মের প্রতি ধাবিত হলেন। ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি প্রভৃতি মহারথগণ কৌরবসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। ভীষ্ম জীবনের আশা ত্যাগ ক’রে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, তাঁর শরাঘাতে পাণ্ডবপক্ষের বহু রথী অশ্বারোহী গজারোহী ও পদাতি বিনষ্ট হ’ল। শিখণ্ডী তাঁকে শরাঘাত করলে ভীষ্ম একবার মাত্র তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত ক’রে সহাস্যে বললেন, তুমি আমাকে প্রহার কর বা না কর আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধে করব না, বিধাতা তোমাকে শিখণ্ডিনী রূপে সৃষ্টি করেছিলেন, এখনও তুমি তাই আছ। ক্রোধে ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন ক’রে শিখণ্ডী বললেন, মহাবাহু, আপনার পরাক্রম যে ভয়ংকর তা আমি জানি, জামদগ্ন্য পরশুরামের সঙ্গে আপনার যুদ্ধের বিষয়ও জানি, তথাপি নিজের এবং পাণ্ডবগণের প্রিয়সাধনের জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে বধ করব। আপনি যুদ্ধ করুন বা না করুন, আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবেন না, অতএব এই পৃথিবী ভাল করে দেখে নিন।

 অর্জুন শিখণ্ডীকে বললেন, তুমি ভীষ্মকে আক্রমণ কর, আমি তোমাকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করব, তোমাকে কেউ পীড়ন করতে পারবে না। আজ যদি ভীষ্মকে বধ না ক’রে ফিরে যাও তবে তুমি আর আমি লোকসমাজে হাস্যাস্পদ হব।

 অর্জুনের শরবর্ষণে কৌরবসেনা ত্রস্ত হ’য়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, অগ্নি যেমন বন দগ্ধ করে সেইরূপ অর্জুন আমার সেনা বিধবস্ত করছেন, ভীম সাত্যকি নকুল-সহদেব অভিমন্যু ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘটোৎকচ প্রভৃতিও সৈন্য নিপীড়ন করছেন, আপনি রক্ষা করুন। মুহূর্তকাল চিন্তা ক’রে ভীষ্ম বললেন, দুর্যোধন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে প্রতিদিন দশ সহস্র, ক্ষত্রিয় বিনষ্ট ক’রে রণস্থল থেকে ফিরব, সেই প্রতিজ্ঞা আমি পালন করেছি। আজ আমি আর এক মহৎ কর্ম করব, হয় নিহত হ’য়ে রণভূমিতে শয়ন করব, না হয় পাণ্ডবগণকে বধ করব। রাজা, তুমি আমাকে অন্নদান করেছ, সেই মহৎ ঋণ আজ তোমার সেনার সম্মুখে নিহত হ’য়ে শোধ করব।

 ভীম নকুল সহদেব ঘটোৎকচ সাত্যকি অভিমন্যু বিরাট দ্রুপদ যধিষ্ঠির, শিখণ্ডীর পশ্চাতে অর্জুন, এবং সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই ভীষ্মকে বধ করবার জন্য ধাবিত হলেন। ভুরিশ্রবা বিকর্ণ কৃপ দুর্মুখ অলম্বুষ, কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, অশ্বত্থামা দ্রোণ দুঃশাসন প্রভৃতি ভীষ্মকে রক্ষা করতে লাগলেন। দ্রোণ তাঁর পুত্র অশ্বত্থামাকে বললেন, বৎস, আমি নানাপ্রকার নিমিত্ত দেখতে পাচ্ছি, ভীষ্ম ও অর্জুন যুদ্ধে মিলিত হবেন এই চিন্তা ক’রে আমার রোমহর্ষ হচ্ছে, মন অবসন্ন হচ্ছে। পাপমতি শঠ শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে এসেছেন, কিন্তু শিখণ্ডী পূর্বে স্ত্রী ছিল এজন্য ভীষ্ম তাকে প্রহার করবেন না। অর্জুন সকল যোদ্ধার শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়। আজ যুদ্ধে ভয়ংকর মহামারী হবে। পুত্র, উপজীবী (পরাশ্রিত) জনের প্রাণরক্ষার সময় এ নয়, তুমি স্বর্গলাভের উদ্দেশ্যে এবং যশ ও বিজয়ের নিমিত্ত যুদ্ধে যাও। ভীমার্জুন নকুল-সহদেব যাঁর ভ্রাতা, বাসুদেব যাঁর রক্ষক, সেই যুধিষ্ঠিরের ক্রোধই দুর্মতি দুর্যোধনের বাহিনী দগ্ধ করছে। কৃষ্ণের আশ্রয়ে অর্জুন দুর্যোধনের সমক্ষেই তাঁর সর্ব সৈন্য বিদীর্ণ করছেন। বৎস, তুমি অর্জুনের পথে থেকো না, শিখণ্ডী ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ কর, আমি যুধিষ্ঠিরের দিকে যাচ্ছি। প্রিয়পুত্রের দীর্ঘ জীবন কে না চায়, তথাপি ক্ষত্রধর্ম বিচার করে তোমাকে যুদ্ধে পাঠাচ্ছি।

 দশ দিন পাণ্ডববাহিনী নিপীড়িত ক’রে ধর্মাত্মা ভীষ্ম নিজের জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি স্থির করলেন, আমি আর নরশ্রেষ্ঠগণকে হত্যা করব না। নিকটে যুধিষ্ঠিরকে দেখে তিনি বললেন, বৎস, আমার এই দেহের উপর অত্যন্ত বিরাগ জন্মেছে, আমি যুদ্ধে বহু প্রাণী বধ করেছি। এখন অর্জুন এবং পাঞ্চাল ও সঞ্জয়গণকে অগ্রবর্তী ক’রে আমাকে বধ করবার চেষ্টা কর। ভীষ্মের এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির ও ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের সৈন্যগণকে বললেন, তোমরা ধাবিত হ’য়ে ভীষ্মকে জয় কর, অর্জুন তোমাদের রক্ষা করবেন।

 এই দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম একাকী অসংখ্য অশ্ব ও গজ, সাত মহারথ, পাঁচ হাজার রথী, চোদ্দ হাজার পদাতি এবং বহু গজারোহী ও অশ্বারোহী সংহার করলেন। বিরাট রাজার ভ্রাতা শতানীক এবং বহু সহস্র ক্ষত্রিয় ভীষ্ম কর্তৃক নিহত হলেন। শিখণ্ডীকে সম্মখে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে শরাঘাত করতে লাগলেন। ভীষ্ম ক্ষিপ্রগতিতে বিভিন্ন যোদ্ধাদের মধ্যে বিচরণ ক’রে পাণ্ডবগণের নিকটে এলেন। অর্জুন বার বার ভীষ্মের ধনু ছেদন করলেন। ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনের প্রতি এক ভয়ংকর শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুন পাঁচ ভল্লের আঘাতে ত। খণ্ড খণ্ড ক’রে দিলেন।

 ভীষ্ম এই চিন্তা করলেন—কৃষ্ণ যদি এদের রক্ষক না হতেন তবে আমি এক ধনু দিয়েই পাণ্ডবপক্ষ বিনষ্ট করতে পারতাম। পিতা (শান্তনু) যখন সত্যবতীকে বিবাহ করেন তখন তুষ্ট হ’য়ে আমাকে দুই বর দিয়েছিলেন, ইচ্ছামত্যু ও যুদ্ধে অবধ্যত্ব। আমার মনে হয় এই আমার মৃত্যুর উপযুক্ত কাল। ভীষ্মের সংকল্প জেনে আকাশ থেকে ঋষিগণ ও বসুগণ বললেন, বৎস, তুমি যা স্থির করেছ তা আমাদেরও প্রীতিকর, তুমি যুদ্ধে বিরত হও। তখন জলকণাযুক্ত সুগন্ধ সুখস্পর্শ বায়ু বইতে লাগল, মহাশব্দে দেবদুন্দুভি বেজে উঠল, ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি হ’ল। কিন্তু ভীষ্ম এবং ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় ভিন্ন আর কেউ তা জানতে পারলে না।

 ভীষ্ম অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে বিরত হলেন। শিখণ্ডী নয়টি তীক্ষ বাণ দিয়ে তাঁর বক্ষে আঘাত করলেন, কিন্তু ভীষ্ম বিচলিত হলেন না। তখন অর্জুন ভীষ্মের প্রতি বহু বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম ঈষৎ হাস্য ক’রে দুঃশাসনকে বললেন, এইসকল মর্মভেদী বজ্রতুল্য বাণ নিরবচ্ছিন্ন হয়ে আসছে, এ বাণ শিখণ্ডীর নয়, অর্জনেরই। ভীষ্ম একটি শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুনের শরাঘাতে তা তিন খণ্ড হ’ল। ভীষ্ম তখন চর্ম (ঢাল) ও খড়্গ নিয়ে রথ থেকে নামবার উপক্রম করলেন। অর্জুনের বাণে চর্ম শত খণ্ডে ছিন্ন হ’ল। যুধিষ্ঠিরের আদেশে পাণ্ডবসৈন্যগণ নানা অস্ত্র নিয়ে চতুর্দিক থেকে ভীষ্মের প্রতি ধাবিত হ’ল, দুর্যোধনাদি ভীষ্মকে রক্ষা করতে লাগলেন।

 পঞ্চ পাণ্ডব এবং সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন অভিমন্যু প্রভৃতির বাণে নিপীড়িত হ’য়ে দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ শল্য প্রভৃতি ভীষ্মকে পরিত্যাগ করলেন। যিনি সহস্র সহস্র বিপক্ষ যোদ্ধাকে সংহার করেছেন সেই ভীষ্মের গাত্রে দুই অঙ্গলি পরিমাণ স্থানও অবিদ্ধ রইল না। সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হ’য়ে ভীষ্ম পূর্ব দিকে মাথা রেখে রথ থেকে পড়ে গেলেন। আকাশে দেবগণ এবং ভূতলে রাজগণ হা হা ক’রে উঠলেন। উন্মূলিত ইন্দ্রধ্বজের ন্যায় ভীষ্ম রণভূমি অনুনাদিত ক’রে নিপতিত হলেন, কিন্তু শরে আবৃত থাকায় তিনি ভূমি স্পর্শ করলেন না। দক্ষিণ দিকে সূর্য দেখে ভীষ্ম বুঝলেন এখন দক্ষিণায়ন। তিনি আকাশ থেকে এই বাক্য শুনলেন—মহাত্মা নরশ্রেষ্ঠ গাঙ্গেয় দক্ষিণায়নে কি ক’রে প্রাণত্যাগ করবেন? ভীষ্ম বললেন, ভূতলে পতিত থেকেই আমি উত্তরায়ণের প্রতীক্ষায় প্রাণধারণ করব।

 মানসসরোবরবাসী মহর্ষিগণ হংসের রূপ ধ’রে ভীষ্মকে দর্শন করতে এলেন। ভীষ্ম বললেন, হংসগণ, সূর্য দক্ষিণায়নে থাকতে আমি মরব না, উত্তরায়ণেই দেহত্যাগ করব, পিতা শান্তনুর বরে মৃত্যু আমার ইচ্ছাধীন।

 কৌরবগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন। কৃপ দুর্যোধন প্রভৃতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদন করতে লাগলেন, তাঁদের আর যুদ্ধে মন গেল না, যেন ঊরুস্তম্ভে আক্রান্ত হ’য়ে রইলেন। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন। শান্তনুপুত্র ভীষ্ম যোগস্থ হ’য়ে মহোপনিষৎ জপে নিরত থেকে মৃত্যুকালের প্রতীক্ষায় রইলেন।

১৮। শরশয্যায় ভীষ্ম

 ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধে নিবৃত্ত হলেন। সকলে বলতে লাগলেন, ইনি ব্রহ্মবিদগণের শ্রেষ্ঠ, এই মহাপুরুষ পিতা শান্তনুকে কামার্ত জেনে নিজে ঊর্দ্ধরেতা হয়েছিলেন। পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে সহস্র সহস্র তূর্য ও শঙ্খ বাজতে লাগল, ভীমসেন মহাহর্ষে ক্রীড়া করতে লাগলেন। দুঃশাসনের মুখে ভীষ্মের পতনসংবাদ শুনে দ্রোণ মূর্ছিত হলেন এবং সংজ্ঞালাভের পর নিজ সৈন্যগণকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করলেন। রাজারা বর্ম ত্যাগ ক’রে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন, কৌরব ও পাণ্ডবগণ তাঁকে প্রণাম ক’রে সম্মুখে দাঁড়ালেন।

 সকলকে স্বাগত সম্ভাষণ ক’রে ভীষ্ম বললেন, মহারথগণ, তোমাদের দর্শন ক’রে আমি তুষ্ট হয়েছি। আমার মাথা ঝুলছে, উপধান (বালিশ) দাও। রাজারা কোমল উত্তম উপধান নিয়ে এলে ভীষ্ম সহাস্যে বললেন, এসব উপধান বীরশয্যার উপযুক্ত নয়। তিনি অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অর্জুন অশ্রুপূর্ণনয়নে বললেন, পিতামহ, আদেশ করুন কি করতে হবে। ভীষ্ম বললেন, বৎস, তুমি ক্ষত্রধর্ম জান, বীরশয্যার উপযুক্ত উপধান আমাকে দাও। মন্ত্রপূত তিন বাণ গাণ্ডীব ধনু দ্বারা নিক্ষেপ ক’রে অর্জুন ভীষ্মের মাথা তুলে দিলেন। ভীষ্ম তুষ্ট হ’য়ে বললেন, রাজগণ, অর্জুন আমাকে কিরূপ উপধান দিয়েছেন দেখ উত্তরায়ণের আরম্ভ পর্যন্ত আমি এই শয্যায় শুয়ে থাকব, সূর্য যখন উত্তর দিকে গিয়ে সর্বলোক প্রতপ্ত করবেন তখন আমার প্রিয় সুহৃৎ তুল্য প্রাণ ত্যাগ করব। তোমরা আমার চতুর্দিকে পরিখা খনন করিয়ে দাও।

 শল্য উদ্ধারে নিপুণ বৈদ্যগণ চিকিৎসার উপকরণ নিয়ে উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, তুমি এঁদের উপযুক্ত ধন দিয়ে সসম্মানে বিদায় কর। বৈদ্যের প্রয়োজন নেই, আমি ক্ষত্রিয়ের প্রশস্ত গতি লাভ করেছি, এইসকল শর সমেত যেন আমাকে দাহ করা হয়। সমাগত রাজারা এবং কৌরব ও পাণ্ডবগণ ভীষ্মকে অভিবাদন ও তিন বার প্রদক্ষিণ করলেন, তার পর তাঁর রক্ষার ব্যবস্থা ক’রে শোকার্ত মনে নিজ নিজ শিবিরে চলে গেলেন।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে সকলে পুনর্বার ভীষ্মের নিকটে এলেন। বহু সহস্র কন্যা ভীষ্মের দেহে চন্দনচূর্ণ লাজ ও মাল্য অর্পণ করতে লাগল। স্ত্রী বালক বৃদ্ধ তূর্যবাদক নট নর্তক ও শিল্পিগণও তাঁর কাছে এল। কৌরব ও পাণ্ডবগণ বর্ম ও আয়ূধ ত্যাগ ক’রে পূর্বের ন্যায় পরস্পর প্রীতিসহকারে বয়স অনুসারে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। ধৈর্য বলে বেদনা নিগৃহীত ক’রে ভীষ্ম রাজাদের দিকে দৃষ্টিপাত ক’রে জল চাইলেন। সকলে নানাপ্রকার খাদ্য ও শীতল জলের কলস নিয়ে এলেন। ভীষ্ম বললেন, বৎসগণ, আমি মানুষের ভোগ্য বস্তু নিতে পারি না। তার পর তিনি অর্জুনকে বললেন, তোমার বাণে আমার শরীর গ্রথিত হয়েছে, বেদনায় মুখ শুষ্ক হচ্ছে, তুমি আমাকে বিধিসম্মত জল দাও।

 ভীষ্মকে প্রদক্ষিণ ক’রে অর্জুন রথে উঠলেন এবং মন্ত্রপাঠের পর গাণ্ডীবে পর্জন্যাস্ত্রযুক্ত বাণ সন্ধান ক’রে ভীষ্মের দক্ষিণ পার্শ্বের ভূমি বিদ্ধ করলেন। সেখান থেকে অমৃততুল্য দিব্যগন্ধ স্বাদু নির্মল শীতল জলধারা উত্থিত হ’ল, অর্জুন সেই জলে ভীষ্মকে তৃপ্ত করলেন। রাজারা বিস্মিত হ’য়ে উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন, চতুর্দিকে তুমুল রবে শঙ্খ ও দুন্দুভি বেজে উঠল।

 ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, তুমি অর্জুনকে জয় করতে পারবে না, তাঁর সঙ্গে সন্ধি কর। পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হ’ক, তুমি তাঁদের অর্ধ রাজ্য দাও, যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে যান, তুমি মিত্রদ্রোহী হ’য়ে অকীর্তি ভোগ ক’রো না। আমার মৃত্যুতেই প্রজাদের শান্তি হ’ক, রাজারা প্রীতির সহিত মিলিত হ’ন, পিতা পুত্রকে, মাতুল ভাগিনেয়কে, ভ্রাতা ভ্রাতাকে লাভ করুন। মুমূর্ষু লোকের যেমন ঔষধে রুচি হয় না, দুর্যোধনের সেইরূপ ভীষ্মবাক্যে রুচি হ’ল না।

 ভীষ্ম নীরব হ’লে সকলে পুনর্বার নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলেন। এই সময়ে কর্ণ কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে ভীষ্মের কাছে এলেন এবং তাঁর চরণে পতিত হয়ে বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললেন, কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি রাধেয় কর্ণ, নিরপরাধ হয়েও আমি আপনার বিদ্বেষভাজন। ভীষ্ম সবলে তাঁর চক্ষু উন্মীলিত করে দেখলেন, তাঁর সন্নিকটে আর কেউ নেই। তিনি রক্ষীদের সরিয়ে দিলেন এবং এক হস্তে পিতার ন্যায় কর্ণকে আলিঙ্গন ক’রে সস্নেহে বললেন, তুমি যদি আমার কাছে না আসতে তবে নিশ্চয়ই তা ভাল হ’ত না। আমার সঙ্গে স্পর্ধা করতে সেজন্য তুমি আমার অপ্রিয় হও নি। আমি নারদের কাছে শুনেছি তুমি কুন্তীপুত্র, সূর্য হ’তে তোমার জন্ম। সত্য বলছি, তোমার প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। তুমি অকারণে পাণ্ডবদের দ্বেষ কর, নীচস্বভাব দুর্যোধনের আশ্রয়ে থেকে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ। তোমার তেজোহানি করবার জন্যই আমি তোমাকে কুরুসভায় বহুবার রুক্ষ কথা শুনিয়েছি। আমি তোমার দুঃসহ বীরত্ব, বেদনিষ্ঠা এবং দানের বিষয় জানি, অস্ত্রপ্রয়োগে তুমি কৃষ্ণের তুল্য। পূর্বে তোমার উপর আমার যে ক্রোধ ছিল তা দূর হয়েছে। পাণ্ডবগণ তোমার সহোদর, তুমি তাঁদের সঙ্গে মিলিত হও, আমার পতনেই শত্রুতার অবসান হ’ক, পৃথিবীর রাজারা নিরাময় হ’ন।

 কর্ণ বললেন, মহাবাহু, আপনি যা বললেন তা আমি জানি। কিন্তু কুন্তী আমাকে ত্যাগ করলে সূতজাতীয় অধিরথ আমাকে বর্ধিত করেছিলেন! আমি দুর্যোধনের ঐশ্বর্য ভোগ করেছি, তা নিষ্ফল করতে পারি না। বাসুদেব যেমন পাণ্ডবদের জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আমিও সেইরূপ দুর্যোধনের জন্য ধন শরীর পুত্র দারা সমস্তই উৎসর্গ করেছি। আমি ক্ষত্রিয়, রোগ ভোগ ক’রে মরতে চাই না, সেজন্যই দুর্যোধনকে আশ্রয় ক’রে পাণ্ডবদের ক্রোধ বৃদ্ধি করেছি। যা অবশ্যম্ভাবী তা নিবারণ করা যাবে না। এই দারুণ শত্রুতার অবসান করা আমার অসাধ্য, আমি স্বধর্ম রক্ষা ক’রেই ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করব। পিতামহ, আমি যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়েছি, আমাকে অনুমতি দিন। হঠাৎ বা চপলতার বশে আপনাকে যে কটুবাক্য বলেছি বা অন্যায় করেছি তা ক্ষমা করুন।

 ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, তুমি যদি এই দারুণ বৈরভাব দূর করতে না পার তবে অনুমতি দিচ্ছি, স্বর্গকামনায় যুদ্ধ কর। আক্রোশ ত্যাগ কর, সদাচার রক্ষা কর, নিরহংকার হয়ে যথাশক্তি যুদ্ধ ক’রে ক্ষত্রিয়োচিত লোক লাভ কর। ধর্মযুদ্ধ ভিন্ন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছু নেই। দুই পক্ষের শান্তির জন্য আমি দীর্ঘকাল বহু যত্ন করেছি, কিন্তু তা সফল হ’ল না।

 ভীষ্মকে অভিবাদন ক’রে কর্ণ সরোদনে রথে উঠে দুর্যোধনের কাছে চ’লে গেলেন।

  1. উদ্‌যোগপর্ব ৩-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  2. ১৪-পরিচ্ছেদের পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
  3. মহাভারতে ইরাবানের জননীর নাম দেওয়া নেই। বিষ্ণুপুরাণে আছে, ইনিই উলূপী। আদিপর্ব ৩৯-পরিচ্ছেদ ও ভীষ্মপর্ব ১৪-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  4. ৯-পরিচ্ছেদে আছে, অর্জুনের মৃদু যদ্ধ দেখে কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে ভীষ্মকে মারবার জন্য নিজেই ধাবিত হলেন। মহাভারতে এই স্থানে সেই ঘটনার পুনরুক্তি আছে।
  5. কিন্তু আদিপর্ব ২১-পরিচ্ছেদে আছে, পঞ্চ পাণ্ডব যখন হস্তিনাপুরে প্রথমে আসেন তখন অর্জনের বয়স চোদ্দ। তিনি শিশু নন।