মহাভারত (রাজশেখর বসু)/ভীষ্মপর্ব/ভগবদ্গীতাপর্বাধ্যায়

॥ ভগবদ্‌গীতাপর্বাধ্যায়॥

৪। কুরুপাণ্ডবের ব্যূহরচনা

 পরদিন সূর্যোদয় হ’লে কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যগণ সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ল। বিশাল কৌরববাহিনীর অগ্রভাগে ভীষ্ম শ্বেত উষ্ণীষ ও বর্ম ধারণ ক’রে শ্বেতাশ্বযুক্ত রজতময় রথে উঠলেন, বোধ হ’ল যেন চন্দ্র উদিত হয়েছেন। কুরুপিতামহ ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্য প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠে বলতেন—পাণ্ডুপত্রদের জয় হ’ক; কিন্তু তাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন এই কারণেই কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করতে এলেন।

 কুরুপক্ষীয় রাজাদের আহ্বান ক’রে ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, স্বর্গযাত্রার এই মহৎ দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, এই পথে তোমরা ইন্দ্রলোকে ও ব্রহ্মলোকে যেতে পারবে। গৃহে রোগভোগ ক’রে মরা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অধর্মকর, লৌহাস্ত্রের আঘাতে যিনি মরেন তিনিই সনাতন ধর্ম লাভ করেন। এই কথা শুনে রাজারা রথারোহণে নিজ নিজ সৈন্যসহ নির্গত হলেন, কেবল কর্ণ ও তাঁর বন্ধুগণকে ভীষ্ম নিবৃত্ত করলেন। অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা দ্রোণাচার্য দুর্যোধন শল্য কৃপাচার্য জয়দ্রথ ভগদত্ত প্রভৃতি সসৈন্যে অগ্রসর হলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা দুর্যোধন ও বাহ্ণীকরাজ যে ব্যূহ রচনা করলেন তার অঙ্গে গজারোহী সৈন্য, শীর্ষদেশে নপতিগণ এবং পার্শ্বদেশে অশ্বারোহী সৈন্য স্থাপিত হ’ল। সেই সর্বতোমুখ ভয়ংকর ব্যূহ যেন হাসতে হাসতে চলতে লাগল।

 কৌরববাহিনী ব্যূহবদ্ধ হয়েছে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, বৃহস্পতির-উপদেশ এই যে সৈন্য যদি অল্প হয়, তবে সংহত ক’রে যুদ্ধ করবে, যদি বহু হয়, তবে ইচ্ছানুসারে বিস্তারিত করবে। বহু সৈন্যের সঙ্গে যদি অল্প সৈন্যের যুদ্ধ করতে হয়, তবে সূচীমূখে ব্যূহ করবে। অর্জুন, আমাদের সৈন্য বিপক্ষের তুলনায় অল্প, তুমি মহর্ষি বৃহস্পতির বচন অনুসারে ব্যূহ রচনা কর। অর্জুন বললেন, মহারাজ, বজ্রপাণি ইন্দ্র যে ব্যূহের বিধান দিয়েছেন সেই ‘অচল’ ও ‘বজ্র’ নামক ব্যূহ আমি রচনা করছি।

 কৌরবসেনা অগ্রসর হচ্ছে দেখে পরিপূর্ণ গঙ্গার ন্যায় পাণ্ডববাহিনী ক্ষণকাল নিশ্চল থেকে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। গদাহস্তে ভীম সেই বাহিনীর অগ্রে রইলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন নকুল সহদেব এবং ভ্রাতা ও পুত্রের সহিত বিরাট রাজা ভীমের পৃষ্ঠভাগ রক্ষা করতে লাগলেন। অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র ও শিখণ্ডী সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। সাত্যকি অর্জুনের পৃষ্ঠরক্ষক হয়ে চললেন। চলন্ত পর্বতের নায় বৃহৎ হস্তিদলসহ রাজা যুধিষ্ঠির সেনার মধ্যদেশে রইলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ বিরাটের অনুগমন করলেন। পাণ্ডব ও কৌরবগণের সমস্ত রথধ্বজ অভিভূত ক’রে মহাকপি হনুমান অর্জুনের রথের উপর অধিষ্ঠিত হলেন।

 দুর্যোধনের বিশাল সৈন্যদল এবং ভীষ্মরচিত ব্যূহ দেখে যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ হয়ে বললেন, ধনঞ্জয়, পিতামহ ভীষ্ম যাদের যোদ্ধা সেই ধার্তরাষ্ট্রগণের সঙ্গে আমরা কি ক’রে যুদ্ধ করতে পারব? তিনি যে অক্ষোভ্য অভেদ্য ব্যূহ নির্মাণ করেছেন তা থেকে কোন উপায়ে আমরা নিস্তার পাব? অর্জুন বললেন, মহারাজ, সত্য অনিষ্ঠুরতা ধর্ম ও উদ্যম দ্বারা যে জয়লাভ হয়, বলবীর্য দ্বারা তেমন হয় না। আপনি সর্বপ্রকার অধর্ম ও লোভ ত্যাগ করে নিরহংকার হয়ে উদ্যমসহকারে যুদ্ধ করুন, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে। আপনি জানবেন আমরা নিশ্চয় জয়ী হব, কারণ নারদ বলেছেন, যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়।

 যুধিষ্ঠিরের মাথার উপর গজদন্তের শলাকাযুক্ত শ্বেতবর্ণ ছত্র ধরা হ’ল, মহর্ষিরা স্তুতি করে তাঁকে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। পুরোহিত ব্রহ্মর্ষি ও সিদ্ধগণ শত্রুবধের আশীর্বাদ ক’রে যথাবিধি স্বস্ত্যয়ন করলেন। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে বস্ত্র গো ফল পুষ্প ও স্বর্ণ দান ক’রে ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধযাত্রা করলেন।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, মহাবাহু, তুমি শুচি হয়ে যুদ্ধের অভিমুখে থেকে শত্রুর পরাজয়ের নিমিত্ত দুর্গাস্তোত্র পাঠ কর। অর্জুন স্তব করলে দুর্গা প্রীত হয়ে অন্তরীক্ষ থেকে বললেন, পাণ্ডুপুত্র, তুমি শীঘ্রই শত্রু জয় করবে, কারণ নারায়ণ তোমার সহায় এবং তুমিও নর-ঋষির অবতার। এই ব’লে দুর্গা অন্তর্হিত হলেন।

৫। ভগবদ্‌গীতা

 দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আচার্য, পাণ্ডুপুত্রগণের বিপুল সেনা দেখুন, আপনার শিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন ওদের ব্যূহবদ্ধ করেছেন। ওখানে সাত্যকি বিরাট ধৃষ্টকেতু চেকিতান কাশীরাজ প্রভৃতি এবং অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ সকল মহারথই আছেন। আমাদের পক্ষে আপনি ভীষ্ম কর্ণ অশ্বত্থামা বিকর্ণ ভূরিশ্রবা প্রভৃতি যুদ্ধবিশারদ বহু বীর রয়েছেন, আপনারা সকলেই আমাদের জন্য জীবনত্যাগে প্রস্তুত। এখন আপনারা সর্বপ্রকারে ভীষ্মকে রক্ষা করুন।

 এমন সময় কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম সিংহনাদ ক’রে শঙ্খ বাজালেন। তখন ভেরী পণব আনক প্রভৃতি রণবাদ্য সহসা তুমুল শব্দে বেজে উঠল। হষীকেশ কৃষ্ণ তাঁর পাঞ্চজন্য শঙ্খ এবং ধনঞ্জয় দেবদত্ত নামক শঙ্খ বাজালেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতিও নিজ নিজ শঙ্খ বাজালেন। সেই নির্ঘোষ আকাশ ও পৃথিবী অনুনাদিত ক’রে দুর্যোধনাদির হৃদয় যেন বিদীর্ণ ক’রে দিলে। শস্ত্রসম্পাত আসন্ন জেনে অর্জুন তাঁর সারথি কৃষ্ণকে বললেন, অচ্যুত, দুই সেনার মধ্যে আমার রথ রাখ, কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে আমি দেখব।

 কৃষ্ণ কুরুপাণ্ডব সেনার মধ্যে রথ নিয়ে গেলেন। দুই পক্ষেই পিতা ও পিতামহ স্থানীয় গুরুজন, আচার্য মাতুল শ্বশুর ভ্রাতা পুত্র ও সুহৃদ্‌গণ রয়েছেন দেখে অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এই যুদ্ধার্থী স্বজনবর্গকে দেখে আমার সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে, মুখ শুখচ্ছে, শরীর কাঁপছে, রোমহর্ষ হচ্ছে, হাত থেকে গাণ্ডীব প’ড়ে যাচ্ছে। আমি বিজয় চাই না, যাঁদের জন্য লোকে রাজ্য ও সুখ কামনা করে তাঁরাই যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে এসেছেন। স্বজন বধ ক’রে আমাদের কোন্ সুখ হবে? হায়, আমরা রাজ্যের লোভে মহাপাপ করতে উদ্যত হয়েছি। যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করে তাও আমার পক্ষে শ্রেয় হবে। এই ব’লে অর্জন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের মধ্যে ব’সে পড়লেন।

 বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, এই সংকটকালে তুমি মোহগ্রস্ত হ’লে কেন? ক্লীব হয়ো না, ক্ষুদ্র হদয়দৌর্বল্য ত্যাগ কর। অর্জুন বললেন, মধুসূদন, পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণকে আমি কি ক’রে শরাঘাত করব? মহানুভাব গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্ষা ভিক্ষান্ন ভোজন করাও শ্রেয়। আমি বিহ্বল হয়েছি, ধর্মাধর্ম বুঝতে পারছি না, আমাকে উপদেশ দাও, আমি তোমার শরণাপন্ন।

 কৃষ্ণ বললেন, যারা অশোচ্য তাদের জন্য তুমি শোক করছ আবার প্রজ্ঞাবাক্যও বলছ। মৃত বা জীবিত কারও জন্য পণ্ডিতগণ শোক করেন না।—

দেহিনোঽস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি॥
অবিনাশি তু তদ্ বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি॥

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহাতি নরোঽপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
নন্যানি সংযাতি নবানি দেহী॥

—দেহধারী আত্মার যেমন এই দেহে কৌমার যৌবন জরা হয়, সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তি ঘটে; ধীর ব্যক্তি তাতে মোহগ্রস্ত হন না। যাঁর দ্বারা এই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপ্ত তাঁকে অবিনাশী জেনো; কেউ এই অব্যয়ের বিনাশ করতে পারে না। ইনি কদাচ জন্মেন না বা মরেন না, অথবা একবার জন্মগ্রহণ ক’রে আবার জন্মাবেন না—এও নয়; ইনি জন্মহীন নিত্য অক্ষয় অনাদি, শরীর হত হ’লে এই আত্মা হত হন না। মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ ক’রে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ দেহী (আত্মা) জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নব শরীর পান।—

জাতস্য চ ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেঽর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি॥
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যৈব তত্র কা পরিদেবনা॥
স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেরোনাৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্॥
অথ চেৎ ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিঞ্চ হিত্বা পাপমবাপ্‌স্যসি॥
হতো বা প্রাপ্‌স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ॥
সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্‌স্যসি॥

―যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চয় হবে এবং মৃতব্যক্তি নিশ্চয় পুনর্বার জন্মাবে; অতএব এই অপরিহার্য বিষয়ে তুমি শোক করতে পার না। হে ভারত, জীবসকল আদিতে (জন্মের পর্বে) অব্যক্ত, মধ্যে (জীবিতকালে) ব্যক্ত, নিধনে (মরণের পর) অব্যক্ত; তবে কিসের খেদ? আর, তোমার স্বধর্ম বিচার ক’রেও তুমি বিকম্পিত হ’তে পার না, কারণ ধর্মযুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়স্কর কিছু নেই। উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার আপনা থেকেই উপস্থিত হয়েছে, সুখী ক্ষত্রিয়রাই এমন যুদ্ধ লাভ করেন। যদি তুমি এই ধর্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম ও কীর্তি হারিয়ে পাপগ্রস্ত হবে। যদি হত হও তবে স্বর্গ পাবে, যদি জয়ী হও তবে পৃথিবীর রাজ্য ভোগ করবে। অতএব হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়ে গাত্রোত্থান কর। সুখদুঃখ লাভ-অলাভ জয়-পরাজয় সমান জ্ঞান ক’রে যুদ্ধে নিযুক্ত হও, এরূপ করলে তুমি পাপগ্রস্ত হবে না।

 তার পর কৃষ্ণ বললেন, এখন আমি কর্মযোগ অনুসারে ধর্মতত্ত্ব বলছি শোন, এই ধর্মের স্বল্পও মহাভয় হ’তে ত্রাণ করে। বেদসকল ত্রিগুণাত্মক পার্থিব বিষয়ের বর্ণনায় পূর্ণ, তুমি ত্রিগুণ অতিক্রম ক’রে রাগদ্বেষাদির অতীত, সঞ্চয় ও রক্ষণে নিস্পৃহ এবং আত্মনির্ভরশীল হও।—

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি॥
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে॥

—কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মের ফলে কদাচ নয়; কর্মের ফল কামনা ক’রো না, নিষ্কর্মাও হয়ো না। ধনঞ্জয়, যোগস্থ হয়ে আসক্তি ত্যাগ করে সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমান হয়ে কর্ম কর; সমত্বকেই যোগ বলা হয়।—

যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে॥
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি॥
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥

—শ্রেষ্ঠ পুরুষ যে যে আচরণ করেন ইতর (সাধারণ) জনও সেইরূপ করে; তিনি যা প্রমাণ বা পালনীয় গণ্য করেন লোকে তারই অনুবর্তী হয়। পার্থ, ত্রিলোকে আমার কিছুই কর্তব্য নেই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্যও নেই, তথাপি আমি কর্মে নিযুক্ত আছি। স্বধর্ম যদি গুণহীনও হয় তথাপি তা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্মের চেয়ে শ্রেয়; স্বধর্মে নিধনও ভাল, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ।—

অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া॥
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥

—জন্মহীন অবিকারী এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হয়েও আমি স্বীয় প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান ক’রে আপনার মায়াবলে জন্মগ্রহণ করি। হে ভারত, যখন যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয় তখন আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতগণের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

 কৃষ্ণ পরমার্থবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন এবং অর্জুনের অনুরোধে নিজের বিশ্বরূপ প্রকাশ করলেন। বিস্ময়ে অভিভূত ও রোমাঞ্চিত হয়ে অর্জুন কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন,

পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসংঘান্।
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থ-
মৃষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্॥
অনেকবাহূদরবক্ত্রনেত্রং
পশ্যামি ত্বাং সর্বতোঽনন্তরূপম্।
নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং
পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ॥

—হে দেব, তোমার দেহে সর্ব দেবগণ, বিভিন্ন প্রাণিসংঘ, কমলাসনস্থ প্রভু ব্রহ্মা, সর্ব ঋষিগণ এবং দিব্য উরগগণ দেখছি। হে বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ, অনেক-বাহু-উদর-মুখ-নেত্র-শালী অনন্তরূপ তোমাকে সর্বত্র দেখছি, কিন্তু তোমার অন্ত মধ্য বা আদি দেখতে পাচ্ছি না।—

দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি
দৃষ্ট্বেব কালানলসন্নিভানি।
দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম
প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস॥
অমী চ ত্বাং ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ
সর্বে সহৈবাবনিপালসংঘৈঃ।
ভীষ্মো দ্রোণঃ সূতপুত্রস্তথাসৌ
সহাস্মদীয়ৈরপি যোধমুখ্যৈঃ॥
বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি
দংষ্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি।
কেচিদ্ বিলগ্না দশনান্তরেষু
সংদৃশ্যতে চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ॥

—দংষ্ট্রাকরাল কালানলসন্নিভ তোমার মুখসকল দেখে দিক জানতে পারছি না, সুখও পাচ্ছি না; হে দেবেশ জগন্নিবাস, প্রসন্ন হও। ওই ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ, রাজাদের সঙ্গে ভীষ্ম দ্রোণ ও সূতপুত্র, এবং তাঁদের সঙ্গে আমাদের মুখ্য যোদ্ধারাও তোমার অভিমূখে ত্বরান্বিত হয়ে তোমার দংষ্ট্রাকরাল ভয়ানক মুখসমূহে প্রবেশ করছে; কেউ বা চূর্ণিতমস্তকে তোমার দর্শনের অন্তরালে বিলগ্ন হয়ে দৃষ্ট হচ্ছে।—

যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা
বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ।
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকা-
স্তবাপি বক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ॥
লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তা-
ল্লোকান্ সমগ্রান্ বদনৈর্জ্বলদ্‌ভিঃ।
তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং
ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো॥
আখ্যহি মে কো ভাবানুগ্ররূপো
নমোহস্তুতে দেববর প্রসীদ।
বিজ্ঞাতুমিচ্ছামি ভবন্তমাদ্যং
ন হি প্রজানামি তব প্রবৃত্তিম্॥

—পতঙ্গগণ যেমন নাশের জন্য সমৃদ্ধবেগে প্রদীপ্ত অনলে প্রবেশ করে সেইরূপ সর্বলোকও নাশের জন্য সমবেগে তোমার মুখসমূহে প্রবেশ করছে। তুমি জ্বলন্ত বদনে সর্বদিক থেকে সমগ্র লোক গ্রাস করতে করতে লেহন করছ; বিষ্ণু, তোমার উগ্র প্রভা সমস্ত জগৎ তেজে পূরিত ক’রে সন্তপ্ত করছে। বল, কে তুমি উগ্ররূপে? তোমাকে নমস্কার; হে দেবেশ, প্রসন্ন হও, আদিস্বরূপ তোমাকে জানতে ইচ্ছা করি; তোমার প্রবৃত্তি বুঝতে পারছি না।

 তখন ভগবান বললেন, আমি লোকক্ষয়কারী কাল। এখানে যে যোদ্ধারা সমবেত হয়েছে, তুমি না মারলেও তারা মরবে। আমি পূর্বেই তাদের মেরেছি; সব্যসাচী, তুমি নিমিত্তমাত্র হও। ওঠ, যশোলাভ কর, শত্রু জয় ক’রে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ কর।

 অর্জুন বললেন, হে সর্ব, তোমাকে সহস্রবার সর্বদিকে নমস্কার করি। তোমার মহিমা না জেনে প্রমাদবশে বা প্রণয়বশে তোমাকে কৃষ্ণ যাদব ও সখা ব’লে সম্বোধন করেছি, বিহার ভোজন ও শয়ন কালে উপহাস করেছি, সে সমস্ত ক্ষমা কর। তোমার অদৃষ্টপূর্ব রূপ দেখে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি, ভয়ে আমার মন প্রব্যথিত হয়েছে, তুমি প্রসন্ন হও, পূর্বরূপ ধারণ কর।

 কৃষ্ণ তাঁর স্বাভাবিক রূপ গ্রহণ করলেন এবং আরও বহু উপদেশ দিয়ে পরিশেষে বললেন, অর্জুন, যদি অহংকারবশে মনে কর যে যুদ্ধ করব না, তবে সে সংকল্প মিথ্যা হবে, তোমার প্রকৃতিই তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবে। আমি করছি—এই ভাব যাঁর নেই তাঁর বুদ্ধি কর্মে আসক্ত হয় না, তিনি সর্বলোক হত্যা ক’রেও হত্যা করেন না। ঈশ্বর হৃদয়ে অধিষ্ঠান ক’রে সর্বভূতকে যন্ত্রারূঢ়ের ন্যায় চালিত করেন, তুমি সর্বভাবে তাঁর শরণ নাও।—

মন্‌মনা ভব মদ্‌ভক্তো মদ্‌যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে॥
সর্বধর্মান্ পরিত্যজা মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ॥

—আমাতে চিত্ত অপর্ণ কর, আমার ভক্ত ও উপাসক হও, আমাকে নমস্কার কর; তুমি আমার প্রিয়, তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি—তুমি আমাকেই পাবে। সর্ব ধর্ম ত্যাগ ক’রে একমাত্র আমাকে শরণ ক’রে চল, আমি তোমাকে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত করব, শোক ক’রো না।

 অর্জুন বললেন, অচ্যুত, আমার মোহ বিনষ্ট হয়েছে, তোমার প্রসাদে আমি ধর্মজ্ঞান লাভ করেছি, আমার সন্দেহ দূর হয়েছে, তোমার আদেশ আমি পালন করব।