মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/অর্জুনাভিগমনপর্বাধ্যায়

॥অর্জুনাভিগমনপর্বাধ্যায়॥

৫। কৃষ্ণের আগমন—দ্রৌপদীর ক্ষোভ

 পাণ্ডবগণের বনবাসের সংবাদ পেয়ে ভোজ বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ তাঁদের দেখতে এলেন। পাঞ্চালরাজের পুত্রগণ, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং কেকয়রাজপুত্রগণও এলেন। সেই ক্ষত্রিয়বীরগণ বাসুদেব কৃষ্ণকে পুরোবর্তী করে যুধিষ্ঠিরের চতুর্দিকে উপবেশন করলেন।

 বিষণ্ণমনে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন ক’রে কৃষ্ণ বললেন, যুদ্ধভূমি দুরাত্মা দুর্যোধন কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসনের শোণিত পান করবে। তাদের নিহত এবং দলের সকলকে পরাজিত ক’রে আমরা ধর্ম রাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করব। অনিষ্টকারী শঠকে বধ করাই সনাতন ধর্ম।

 পাণ্ডবগণের পরাজয়ে জনার্দন কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তিনি যেন সর্বলোক দগ্ধ করতে উদ্যত হলেন। অর্জুন তাঁকে শান্ত ক’রে তাঁর পূর্বজন্মের কর্মকলাপ কীর্তন করলেন।—কৃষ্ণ, ভূমি পুরাকালে গন্ধমাদন পর্বতে যত্রসায়ংগৃহ[] মুনি হয়ে দশ সহস্র বৎসর বিচরণ করেছিলে। আমি ব্যাসদেবের কাছে শুনেছি, তুমি বহু বৎসর পুষ্কর তীর্থে, বিশাল বদরিকায়, সরস্বতীনদীতীরে ও প্রভাস তীর্থে কৃচ্ছসাধন করেছিলে। তুমি ক্ষেত্রজ্ঞ, সর্বভূতের আদি ও অনন্ত, তপস্যার নিধান, সনাতন যজ্ঞস্বরূপ। তুমি সমস্ত দৈত্যদানব বধ ক’রে শচীপতিকে সর্বেশ্বর করেছিলে। তুমিই নারায়ণ হরি ব্রহ্মা সূর্য চন্দ্র কাল আকাশ পৃথিবী। তুমি শিশু বামনরূপে তিন পদক্ষেপে স্বর্গ আকাশ ও মর্ত্য আক্রমণ করেছিলে। তুমি নিসুন্দ নরকাসুর শিশুপাল জরাসন্ধ শৈব্য শতধন্বা প্রভৃতিকে জয় করেছ, রুক্মীকে পরাস্ত ক’রে ভীষ্মকদুহিতা রুক্মিণীকে হরণ করেছ; ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা, যবন কসেরুমান ও শাল্বকে বধ করেছ। জনার্দন, তুমি দ্বারকা নগরী আত্মসাৎ ক’রে সমুদ্রে নিমগ্ন করবে। তোমাতে ক্রোধ বিদ্বেষ অসত্য নৃশংসতা কুটিলতা নেই। ব্রহ্মা তোমার নাভিপদ্ম থেকে উৎপন্ন, তুমি মধ্যকৈটভের হন্তা, শূলপাণি শম্ভু তোমার ললাট থেকে জন্মেছেন।

 কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি আমারই, আমি তোম।রই, যা আমার তাই তোমার, যে তোমাকে শেষ করে সে আমাকেও করে, যে তোমার অনুগত সে আমারও অনুগত। তুমি নর আর আমি নারায়ণ ঋষি ছিলাম, আমরা এখন নরলোকে এসেছি।

 শরণার্থিনী দ্রৌপদী পুণ্ডরীকাক্ষকে বললেন, হৃষীকেশ, ব্যাস বলেছেন তুমি দেবগণেরও দেব। তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর, সেজন্য প্রণয়বশে আমি তোমাকে দুঃখ জানাচ্ছি। আমি পাণ্ডবগণের ভার্যা, তোমার সখী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী; দুঃশাসন কেন আমাকে কুরুসভায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল? আমার একমাত্র বস্ত্র শোণিতসিক্ত, আমি লজ্জায় কাঁপছি, আমাকে দেখে পাপাত্মা ধার্তরাষ্ট্রগণ হেসে উঠল। পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র, পাঞ্চালগণ ও বৃষ্ণিগণ জীবিত থাকতে তারা আমাকে দাসীরূপে ভোগ করতে চেয়েছিল। ধিক পাণ্ডবগণ, ধিক ভীমসেনের বল, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব! তাঁদের ধর্ম—পত্নীকে যখন নীচজন পীড়ন করছিল তখন তাঁরা নীরবে দেখছিলেন। স্বামী দুর্বল হ’লেও স্ত্রীকে রক্ষা করে, এই সনাতন ধর্ম। পাণ্ডবরা শরণাপন্নকে ত্যাগ করেন না, কিন্তু আমাকে রক্ষা করেন নি। কৃষ্ণ, আমি বহু ক্লেশ পেয়ে আর্যা কুন্তীকে ছেড়ে পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয়ে বাস করছি। আমি যে নির্যাতন ভোগ করেছি তা এই সিংহবিক্রান্ত বীরগণ কেন উপেক্ষা করছেন? দেবতার বিধানে মহৎ কুলে আমার জন্ম, আমি পাণ্ডবদের প্রিয়া ভার্যা, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, তথাপি পঞ্চপাণ্ডবের সমক্ষেই দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করেছিল।

 মৃদুভাষিণী কৃষ্ণা পদ্মকোষতুল্য হস্তে মুখ আবৃত ক’রে সরোদনে বললেন, মধুদসূদন, আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব ভ্রাতা পিতা নেই, তুমিও নেই। ক্ষুদ্রেরা আমাকে নির্যাতিত করেছে, কর্ণ আমাকে উপহাস করেছে, তোমরা তার কোনও প্রতিকার করছ না। কেশব, আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক[] আছে, তোমার যশোগৌরব আছে, তুমি সখা ও প্রভু[], এই চার কারণে আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।

 কৃষ্ণ বললেন, ভাবিনী, তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ তারা অর্জুনের শরে আচ্ছন্ন হয়ে রক্তাক্তদেহে ভূমিতে শোবে, তা দেখে তাদের ভার্যারা রোদন করবে। পাণ্ডবদের জন্য যা সম্ভবপর তা আমি করব, তুমি শোক ক’রো না। কৃষ্ণা, আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি রাজগণের রাজ্ঞী হবে। যদি আকাশ পতিত হয়, হিমালয় শীর্ণ হয়, পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়, সমুদ্র শুষ্ক হয়, তথাপি আমার বাক্য ব্যর্থ হবে না।

 দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, দেবী, রোদন ক’রো না, মধুসূদন যা বললেন তার অন্যথা হবে না। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে বধ করব; শিখণ্ডী ভীষ্মকে, ভীমসেন দুর্যোধনকে এবং ধনঞ্জয় কর্ণকে বধ করবেন। ভগিনী, বলরাম আর কৃষ্ণকে সহায় রূপে পেলে আমরা ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধেও অজেয় হব।

 কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি যদি দ্বারকায় থাকতাম তবে আপনাদের এই কষ্ট হ’ত না। আমাকে না ডাকলেও আমি কুরুসভায় যেতাম এবং ভীষ্ম দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতিকে বুঝিয়ে দ্যূতক্রীড়া নিবারণ করতাম। ধৃতরাষ্ট্র যদি মিষ্ট কথা না শুনতেন তবে তাঁকে সবলে নিগৃহীত করতাম, সুহৃদবেশী শত্রু, দ্যূতকারগণকে বধ করতাম। আমি দ্বারকায় ফিরে এসে সাত্যকির কাছে আপনার বিপদের কথা শুনে উদ্‌বিগ্ন হয়ে আপনাকে দেখতে এসেছি। হা, আপনারা সকলেই বিষাদসাগরে নিমগ্ন হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন।

৬। শাল্ববধের বৃত্তান্ত — দ্বৈতবন

 যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কৃষ্ণ, তুমি দ্বারকা ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে? তোমার কি প্রয়োজন ছিল?

 কৃষ্ণ বললেন, আমি শাল্ব রাজার সৌভনগর বিনষ্ট করতে গিয়েছিলাম। আপনার রাজসূয় যজ্ঞে আমি শিশুপালকে বধ করেছি শুনে শাল্ব ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বারকাপুরী আক্রমণ করেন। তিনি তাঁর সৌভবিমানে ব্যূহ রচনা করে আকাশে অবস্থান করলেন। এই বৃহৎ বিমানই তাঁর নগর। যাদববীরগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দ্বারকাপুরী সর্বপ্রকারে সুরক্ষিত করলেন। উগ্রসেন[] উদ্ভব[] প্রভৃতি ঘোষণা করলেন, কেউ সুরাপান করতে পাবে না। আনর্ত[] দেশবাসী নট নর্তক ও গায়কগণকে অন্যত্র পাঠানো হল। সমস্ত সেতু ভেঙে দেওয়া হ’ল এবং নৌকার যাতায়াত নিষিদ্ধ হ’ল। সৈন্যদের বেতন খাদ্য ও পরিচ্ছদ দিয়ে সন্তুষ্ট করা হ’ল। শাল্বের চতুরঙ্গিণী সেনা সর্বদিক বেষ্টন ক’রে দ্বারকা অবরুদ্ধ করলে। তখন চারুদেষ্ণ প্রদ্যুম্ন শাম্ব[] প্রভৃতি বীরগণ রথারোহণে শাল্বের সম্মুখীন হলেন। জাম্ববতীপুত্র শাম্ব শাল্বের সেনাপতি ক্ষেমবৃদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ক্ষেমবৃদ্ধি আহত হয়ে পালিয়ে গেলে বেগবান নামে এক দৈত্য শাম্বকে আক্রমণ করলে, কিন্তু সে শাম্বের গদাঘাতে নিহত হ’ল। বিবিন্ধ্য নামক এক মহাবল দানবকে চারুদেষ্ণ বধ করলেন।

 প্রদ্যুম্ন শাল্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি শরাঘাতে মূর্ছিত হয়ে প’ড়ে গেলে সারথি দারুকপুত্র তাঁকে দ্রুতগামী রথে যুদ্ধেভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। সংজ্ঞালাভ করে প্রদ্যুম্ন বললেন, তুমি রথ ফিরিয়ে নাও, যুদ্ধ থেকে পালানো বৃষ্ণিকুলের রীতি নয়। আমাকে পশ্চাৎপদ দেখলে কৃষ্ণ বলরাম সাত্যকি প্রভৃতি কি বলবেন? কৃষ্ণ আমাকে দ্বারকারক্ষার ভার দিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে গেছেন, তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। রুক্মিণীপুত্র প্রদ্যুম্ন আবার রণস্থলে গেলেন এবং শাল্বকে শরাঘাতে ভূপাতিত করে এক ভয়ংকর শর ধনুতে সন্ধান করলেন। তখন ইন্দ্রাদি দেবগণের আদেশে নারদ ও পবনদেব দ্রুতবেগে এসে প্রদ্যূম্নকে বললেন, বীর, শাল্বরাজ তোমার বধ্য নন, বিধাতা সংকল্প করেছেন যে কৃষ্ণের হাতে এঁর মৃত্যু হবে। প্রদ্যুম্ন নিবৃত্ত হলেন, শাল্বও দ্বারকা ত্যাগ করে সৌভবিমানে আকাশে উঠলেন।

 মহারাজ যুধিষ্ঠির, আপনার রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হলে আমি দ্বারকায় ফিরে এসে দেখলাম যে শাল্বের আক্রমণে নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে। উগ্রসেন বসুদেব প্রভৃতিকে আশ্বস্ত ক’রে চতুরঙ্গ বল নিয়ে আমি মার্তিকাবত দেশে গেলাম এবং সেখান থেকে শাল্বের অনুসরণ করলাম। শাল্ব সমূদ্রের উপরে আকাশে অবস্থান করছিলেন। আমার শার্ঙ্গধনু থেকে নিক্ষিপ্ত শর তাঁর সৌভবিমান স্পর্শ করতে পারল না। তখন আমি মন্ত্রাহূত অসংখ্য শর নিক্ষেপ করলাম, তার আঘাতে সৌভমধ্যস্থ যোদ্ধার। কোলাহল ক’রে মহার্ণবে নিপতিত হ’ল। সৌভপতি শাল্ব মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলেন, আমি প্রজ্ঞার দ্বারা তাঁর মায়া অপসারিত করলাম।

 এই সময়ে উগ্রসেনের এক ভৃত্য এসে আমাকে তার প্রভুর এই বার্তা জানালে।—কেশব, শাল্ব দ্বারকায় গিয়ে তোমার পিতা বসুদেবকে বধ করেছে, আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, তুমি ফিরে এস। এই সংবাদ শুনে আমি বিহ্বল হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলাম। সহসা দেখলাম, আমার পিতা হস্তপদ প্রসারিত করে সৌভবিমান থেকে নিপতিত হচ্ছেন। কিছুক্ষণ সংজ্ঞাহীন হয়ে থাকবার পর প্রকৃতিস্থ হয়ে দেখলাম, সৌভবিমান নেই, শাল্ব নেই, আমার পিতাও নেই। তখন বুঝলাম সমস্তই মায়া। দানবগণ অদৃশ্য বিমান থেকে শিলাবর্ষণ করতে লাগল। অবশেষে আমি ক্ষুরধার নির্মল কালান্তক যমতুল্য সুদর্শন চক্রকে অভিমন্ত্রিত করে বললাম, তুমি সৌভবিমান এবং তার অধিবাসী রিপুগণকে বিনষ্ট কর। তখন যুগান্তকালীন দ্বিতীয় সূর্যের ন্যায় সুদর্শন চক্র আকাশে উঠল, এবং ব্রুকচ (করাত) যেমন কাঠ বিদারিত করে সেইরূপ সৌভবিমানকে বিদারিত করলে। সুদর্শন চক্র আমার হাতে ফিরে এলে তাকে আবার আদেশ দিলাম, শাল্বের অভিমুখে যাও। সুদর্শনের আঘাতে শাল্ব দ্বিখণ্ডিত হলেন, তাঁর অনুচর দানবগণ হা হা রব ক’রে পালিয়ে গেল।

 শাল্ববধের বিবরণ শেষ করে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আমি দ্যূতসভায় কেন যেতে পারি নি তার কারণ বললাম। আমি গেলে দ্যূতক্রীড়া হ’ত না। তার পর কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর কাছে বিদায় নিয়ে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর সঙ্গে রথারোহণে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর পুত্রদের নিয়ে পাঞ্চালরাজ্যে এবং ধৃষ্টকেতু নিজের ভগিনী[]র সঙ্গে চেদিরাজ্যে গেলেন, কৈকেয়গণ[] ও স্বরাজ্যে প্রস্থান করলেন।

 ব্রাহ্মণগণকে বহু ধন দান করে এবং কুরজাঙ্গলবাসী প্রজাবর্গের নিকট বিদায় নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী ও ধৌম্য রথারোহণে অন্য বনে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, আমাদের বার বৎসর বনবাস করতে হবে, তোমরা এই মহারণ্যে এমন একটি স্থান দেখ যেখানে বহু মৃগ পক্ষী পুষ্প ফল পাওয়া যায় এবং যেখানে সাধুলোকে বাস করেন। অর্জুন বললেন, দ্বৈতবন রমণীয় স্থান, ওখানে সরোবর আছে, পুষ্পফল পাওয়া যায়, দ্বিজগণও বাস করেন। আমরা ওখানেই বার বৎসর কাটাব।

 পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে সরস্বতী নদীর নিকটে আশ্রম নির্মাণ ক’রে বাস করতে লাগলেন। একদিন মহামুনি মার্কণ্ডেয় তাঁদের আশ্রমে এলেন। তিনি পাণ্ডবগণের পূজা গ্রহণ করে তাঁদের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। যুধিষ্ঠির দুঃখিত হয়ে বললেন, আমাদের দুর্ভোগ্যের জন্য এই তপস্বীরা সকলেই অপ্রফুল্ল হয়ে আছেন, কিন্তু আপনি হৃষ্ট হয়ে হাসলেন কেন? মার্কণ্ডেয় বললেন, বৎস আমি আনন্দের জন্য হাসি নি, তোমার বিপদ দেখে আমার সত্যব্রত দাশরথি রামকে মনে পড়েছে, আমি তাঁকে ঋষ্যমূক পর্বতে দেখেছিলাম। তিনি ইন্দ্রতুল্য মহাপ্রভাব এবং সমরে অজেয় হয়েও ধর্মের জন্য রাজভোগ ত্যাগ ক’রে বনে গিয়েছিলেন। নিজেকে শক্তিমান ভেবে অধর্ম করা কারও উচিত নয়। যুধিষ্ঠির, তোমার প্রতিজ্ঞা অনুসারে বনবাসের কষ্ট সয়ে তুমি আবার রাজশ্রী লাভ করবে।

 মার্কণ্ডেয় চ’লে গেলে দাল্‌ভগোত্রীয় বক মুনি এলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কুন্তীপুত্র, অগ্নি ও বায়ু, মিলিত হয়ে যেমন বন দগ্ধ করে, সেইরূপ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় মিলিত হয়ে শত্রুবিনাশ করতে পারেন। ব্রাহ্মণের উপদেশ না পেলে ক্ষত্রিয় চালকহীন হস্তীর ন্যায় সংগ্রামে দুর্বল হয়। যুধিষ্ঠির, অলব্ধ বিষয়ের লাভের জন্য, লব্ধ বিষয়ের বৃদ্ধির জন্য, এবং যোগ্যপাত্রে দানের জন্য তুমি যশস্বী বেদবিৎ ব্রাহ্মণগণের সংসর্গ কর।

৭। দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের বাদানুবাদ

 একদিন সায়াহ্ন কালে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী কথোপকথন করছিলেন। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, তুমি যখন মৃগচর্ম প’রে বনবাসের জন্য যাত্রা করেছিলে তখন দুরাত্মা দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ আর শকুনি ছাড়া সকলেই অশ্রুপাত করেছিলেন। পূর্বে তুমি শুভ্র কৌষেয় বস্ত্র পরতে, এখন তোমাকে চীরধারী দেখছি। কুণ্ডলধারী যুবক পাচকগণ সযত্নে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে তোমাদের খাওয়াত, এখন তোমরা বনজাত খাদ্যে জীবনধারণ করছ। বনবাসী ভীমসেনের দুঃখ দেখে কি তোমার ক্রোধবৃদ্ধি হয় না? বৃকোদর একাই সমস্ত কৌরবদের বধ করতে পারেন, কেবল তোমার জন্যই কষ্ট সইছেন। পুরুষব্যাঘ্র অর্জুন আর নকুল-সহদেবের দুর্দশা দেখেও কি তুমি শত্রুদের ক্ষমা করবে? দ্রুপদের কন্যা, মহাত্মা পাণ্ডুর পত্রবধূ, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, পতিব্রতা বীরপত্নী আমাকে বনবাসিনী দেখেও কি তুমি সয়ে থাকবে? লোকে বলে, ক্রোধশূন্য ক্ষত্রিয় নেই, কিন্তু তোমাতে তার ব্যতিক্রম দেখছি। যে ক্ষত্রিয় যথাকালে তেজ দেখায় না তাকে সকলেই অবজ্ঞা করে। প্রাচীন ইতিহাসে আছে, একদিন বলি তাঁর পিতামহ মহাপ্রজ্ঞ অসুরপতি প্রহ্লাদকে প্রশ্ন করেছিলেন ক্ষমা ভাল না তেজ ভাল? প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, বৎস, সর্বদা তেজ ভাল নয়, সর্বদা ক্ষমাও ভাল নয়। যে সর্বদা ক্ষমা করে তার বহু ক্ষতি হয়, ভৃত্য শত্রু, ও নিরপেক্ষ লোকেও তাকে অবজ্ঞা করে এবং কটুবাক্য বলে। আবার যারা কখনও ক্ষমা করে না তাদেরও বহু দোষ। যে লোক ক্রোধবশে স্থানে অস্থানে দণ্ডবিধান করে তার অর্থ হানি সন্তাপ মোহ ও শত্রু লাভ হয়। অতএব যথাকালে মৃদু হবে এবং যথাকালে কঠোর হবে। যে পূর্বে তোমার উপকার করেছে সে গুরু অপরাধ করলেও তাকে ক্ষমা করবে। যে না বুঝে অপরাধ করে সেও ক্ষমার যোগ্য, কারণ সকলেই পণ্ডিত নয়। কিন্তু যারা সজ্ঞানে অপরাধ করে বলে যে না বুঝে করেছি, সেই কুটিল লোকদের অল্প অপরাধেও দণ্ড দেবে। সকলেরই প্রথম অপরাধ ক্ষমার যোগ্য, কিন্তু দ্বিতীয় অপরাধ অল্প হ’লেও দণ্ডনীয়। মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা লোভী ও সর্বদা অপরাধী; তারা কোনও কালে ক্ষমার যোগ্য নয়, তাদের প্রতি তেজ প্রকাশ করাই তোমার কর্তব্য।

 যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী, তুমি মহাপ্রজ্ঞাবতী, জেনে রাখ যে ক্রোধ থেকে শুভাশুভ দুইই হয়। ক্রোধ সয়ে থাকলে মঙ্গল হয়। ক্রুদ্ধ লোকে পাপ করে, গুরুহত্যাও করে। তাদের অকার্য কিছু নেই, তারা অবধ্যকে বধ করে, বধ্যকে পূজা করে। এই সমস্ত বিবেচনা করে আমার ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অপরের কোধ দেখলেও যে ক্রুদ্ধ হয় না সে নিজেকে এবং অপরকেও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। ক্লোধ উৎপন্ন হ’লে যিনি প্রজ্ঞার দ্বারা রোধ করতে পারেন, পণ্ডিতরা তাঁকেই তেজস্বী মনে করেন। মূর্খরাই সর্বদা ক্রোধকে তেজ মনে করে, মানুষের বিনাশের জন্যই রজোগুণজাত ক্রোধের উৎপত্তি। ভীষ্ম কৃষ্ণ দ্রোণ বিদুর কৃপ সঞ্জয় ও পিতামহ ব্যাস সর্বদাই শমগুণের কথা বলেন। এঁরা ধৃতরাষ্ট্রকে শান্তির উপদেশ দিলে তিনি অবশ্যই আমাকে রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন, যদি লোভের বশে না দেন, তবে বিনষ্ট হবেন।

 দ্রৌপদী বললেন, ধাতা আর বিধাতাকে নমস্কার, যাঁরা তোমার মোহ সৃষ্টি করেছেন, তার ফলে পিতৃপিতামহের বৃত্তি ত্যাগ ক’রে তোমার মতি অন্য দিকে গেছে। জগতে কেউ ধর্ম অনিষ্ঠুরতা ক্ষমা সরলতা ও দয়ার দ্বারা লক্ষ্মীলাভ করতে পারে না! তুমি বহুপ্রকার মহাযজ্ঞ করেছ তথাপি বিপরীত বুদ্ধির বশে দ্যূতক্রীড়ায় রাজ্য ধন ভ্রাতৃগণ আর আমাকেও হারিয়েছ। তুমি সরল মৃদুস্বভাব বদান্য লজ্জাশীল সত্যবাদী, তথাপি দ্যুতব্যসনে তোমার মতি হ’ল কেন? বিধাতাই পূর্বজন্মের কর্ম অনুসারে প্রাণিগণের সুখদুঃখ বিধান করেন। কাষ্ঠময় পুত্তলিকা যেমন অঙ্গচালনা করে সেইরূপে সকল মনুষ্য বিধাতার নির্দেশেই ক্রিয়া করে। যেমন সূত্রে গ্রথিত মণি, নাসাবদ্ধ বৃষ, স্রোতে পতিত বৃক্ষ, সেইরূপ মানষও স্বাধীনতাহীন, তাকে বিধাতার বিধানেই চলতে হয়। সর্বভূতে ব্যাপ্ত হয়ে ঈশ্বরই পাপপুণ্য করাচ্ছেন তা কেউ লক্ষ্য করে না। মানুষ যেমন অচেতন নিশ্চেষ্ট কাষ্ঠ-পাষাণ-লৌহ দ্বারাই তদ্রূপ পদার্থ ছিন্ন করে, ঈশ্বর সেইরূপ জীব দ্বারাই জ়ীবহিংসা করেন। মহারাজ, বিধাতা প্রাণিগণকে মাতা-পিতার দৃষ্টিতে দেখেন না, তিনি রুষ্ট ইতর জনের ন্যায় ব্যবহার করেন। তোমার বিপদ আর দুর্যোধনের সমৃদ্ধি দেখে আমি বিধাতারই নিন্দা করছি যিনি এই বিষম ব্যবস্থা করেছেন। যদি লোকে পাপকর্মের ফলভোগ করে তবে ঈশ্বরও সেই পাপকর্মে লিপ্ত। আর, যদি কেউ পাপ করেও ফলভোগ না করে তবে তার কারণ—সে বলবান। দুর্বল লোকের জন্যই আমার শোক হচ্ছে।

 যুধিষ্ঠির বললেন, যাজ্ঞসেনী, তোমার কথা সুন্দর, আশ্চর্য ও মনোহর, কিন্তু নাস্তিকের যোগ্য। আমি ধর্মের ফল অন্বেষণ করি না, দাতব্য ব’লেই দান করি, যজ্ঞ করা উচিত ব’লেই যজ্ঞ করি। ফলের আকাঙ্ক্ষা না করেই আমি যথাশক্তি গৃহাশ্রমবাসীর কর্তব্য পালন করি। যে লোক ধর্মকে দোহন ক’রে ফল পেতে চায় এবং নাস্তিক বুদ্ধিতে যে লোক ফললাভ হবে কি হবে না এই আশঙ্কা করে, সে ধর্মের ফল পায় না। দ্রৌপদী, তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে তর্ক করছ। ধর্মের প্রতি সন্দেহ ক’রো না, তাতে তির্যগ্‌গতি লাভ হয়। কল্যাণী, তুমি মূঢ় বুদ্ধির বশে বিধাতার নিন্দা করো না, সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ঋষিগণ যার কথা বলেছেন, শিষ্টজন যার আচরণ করছেন, সেই ধর্মের সম্বন্ধে সংশয়াপন্ন হয়ো না।

 দ্রোপদী বললেন, আমি ধর্মের বা ঈশ্বরের নিন্দা করি না, দুঃখিত হয়েই অধিক কথা বলে ফেলেছি। আরও কিছু বলছি, তুমি প্রসন্ন হয়ে শোন। মহারাজ, তুমি অবসাদগ্রস্ত না হয়ে কর্ম কর। যে লোক কেবল দৈবের উপর নির্ভর করে, এবং যে হঠবাদী[১০] তারা উভয়েই মন্দবুদ্ধি। দেবারাধনায় যা লাভ হয় তাই দৈব, নিজ কর্মের দ্বারা যে প্রত্যক্ষ ফল লাভ হয় তাই পৌরুষ। ফলসিদ্ধির তিনটি কারণ, দৈব, প্রাক্তনকর্ম ও পুরুষকার। আমাদের যে মহাবিপদ উপস্থিত হয়েছে, তুমি পুরুষকার অবলম্বন করে কর্মে প্রবৃত্ত হ’লে তা নিশ্চয় দূর হবে।

৮। ভীম-যুধিষ্ঠিরের বাদানুবাদ ― ব্যাসের উপদেশ

 ভীম অসহিষ্ণু ও ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ধর্ম অর্থ ও কাম ত্যাগ করে কেন আমরা তপোবনে বাস করব? উচ্ছিষ্টভোজী শৃগাল যেমন সিংহের কাছ থেকে মাংস হরণ করে সেইরূপ দুর্যোধন আমাদের রাজ্য হরণ করেছে। রাজা, আপনি প্রতিজ্ঞা পালন করছেন, অল্প একটু ধর্মের জন্য রাজ্য বিসর্জন দিয়ে দুঃখ ভোগ করছেন। আমরা আপনার শাসন মেনে নিয়ে বন্ধুদের দুঃখিত এবং শত্রুদের আনন্দিত করছি। ধার্তরাষ্ট্রগণকে বধ করি নি এই অন্যায় কার্যের জন্য আমরা দুঃখ পাচ্ছি। সর্বদা ধর্ম ধর্ম ক’রে আপনি কি ক্লীবের দশা পান নি? যাতে নিজের ও মিত্রবর্গের দুঃখ উৎপন্ন হয় তা ধর্ম নয়, ব্যসন ও কুপথ। কেবল ধর্মে বা কেবল অর্থে বা কেবল কামে আসক্ত হওয়া ভাল নয়, তিনটিরই সেবা করা উচিত। শাস্ত্রকাররা বলেছেন, পূর্বাহ্ণে ধর্মের, মধ্যাহ্ণে অর্থের এবং সায়াহ্ণে কামের চর্চা করবে। আরও বলেছেন, প্রথম বয়সে কামের, মধ্য বয়সে অর্থের, এবং শেষ বয়সে ধর্মের আচরণ করবে। যাঁরা মুক্তি চান তাঁদের পক্ষেই ধর্ম-অর্থ-কাম বর্জন করা বিধেয়, গৃহবাসীর পক্ষে এই ত্রিবর্গের সেবাই শ্রেয়। মহারাজ, আপনি হয় সন্ন্যাস নিন না হয় ধর্ম-অর্থ-কামের চর্চা করুন, এই দুইএর মধ্যবর্তী অবস্থা আতুরের জীবনের ন্যায় দুঃখময়। জগতের মূল ধর্ম ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই, কিন্তু বহু অর্থ থাকলেই ধর্মকার্য করা যায়। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বল আর উৎসাহই ধর্ম, ভিক্ষা বা বৈশ্য-শদ্রের বৃত্তি বিহিত নয়। আপনি ক্ষত্রিয়োচিত দৃঢ়হহৃদয়ে শৈথিল্য ত্যাগ ক’রে বিক্রম প্রকাশ করুন, ধুরন্ধরের ন্যায় ভার বহন করুন। কেবল ধর্মাত্মা হ’লে কোনও রাজাই রাজ্য ধন ও লক্ষ্মী লাভ করতে পারেন না। বলবানরা কপটতার দ্বারা শত্রু জয় করেন, আপনিও তাই করুন। কৃষক যেমন অল্প পরিমাণ বীজের পরিবর্তে বহু শস্য পায়, বুদ্ধিমান সেইরূপ অল্প ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ ধর্ম লাভ করেন। আমরা যদি কৃষ্ণ প্রভৃতি মিত্রগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করি তবে অবশ্যই রাজ্য উদ্ধার করতে পারব।

 বধিষ্ঠির বললেন, তুমি আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছ তার জন্য তোমার দোষ দিতে পারি না, আমার অন্যায় কর্মের ফলেই তোমাদের বিপদ হয়েছে। আমি দুর্যোধনের রাজ্য জয় করবার ইচ্ছায় দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আমার সরলতার সুযোগে ধূর্ত শকুনি শঠতার দ্বারা আমাকে পরাস্ত করেছিল। দুর্যোধন আমাদের দাস করেছিল, দ্রৌপদীই তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন। দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ায় যে পণ নির্ধারিত হয়েছিল তা আমি মেনে নিয়েছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা এখন লঙ্ঘন করতে পারি না। তুমি দ্যূতসভায় আমার বাহু দগ্ধ করতে চেয়েছিলে, অর্জুন তোমাকে নিরস্ত করেন। সেই সময়ে তুমি তোমার লৌহগদা পরিষ্কার করছিলে, কিন্তু তখনই কেন তা প্রয়োগ করলে না? আমার প্রতিজ্ঞার সময়ে কেন আমাকে বাধা দিলে না? উপযুক্ত কালে কিছু না করে এখন আমাকে ভর্ৎসনা ক’রে লাভ কি? লোকে বীজরোপণ ক’রে যেমন ফলের প্রতীক্ষা করে, তুমিও সেইরূপ ভবিষ্যৎ সুখোদয়ের প্রতীক্ষায় থাক।

 ভীম বললেন, মহারাজ, যদি তের বৎসর প্রতীক্ষা করতে হয় তবে তার মধ্যেই আমাদের আয়ু শেষ হবে। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতমূর্খের ন্যায় আপনার বুদ্ধি শাস্ত্রের অনুসরণ ক’রে নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি ব্রাহ্মণের ন্যায় দয়ালু হয়ে পড়েছেন, ক্ষত্রিয়কুলে কেন আপনি জন্মেছেন? আমরা তের মাস বনে বাস করেছি, ভেবে দেখুন তের বৎসর কত বৃহৎ। মনীষীরা বলেন, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা (পুঁই শাক), সেইরূপ বৎসরের প্রতিনিধি মাস। আপনি তের মাসকেই তের বৎসর গণ্য করুন। যদি এইরূপ গণনা অন্যায় মনে করেন তবে একটা সাধুস্বভাব ষণ্ডকে প্রচুর আহার দিয়ে তৃপ্ত করুন, তাতেই পাপমুক্ত হবেন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, উত্তমরূপে মন্ত্রণা আর বিচার করে যদি বিক্রম প্রয়োগ করা হয় তবেই সিদ্ধিলাভ হয়, দৈবও তাতে অনুকূল হন। কেবল বলদর্পে চঞ্চল হয়ে কর্ম আরম্ভ করা উচিত নয়। দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা দুর্ধর্ষ এবং অস্ত্রপ্রয়োগে সুশিক্ষিত। আমরা দিগ্‌বিজয়কালে যেসকল রাজাদের উৎপীড়িত করেছি তাঁরা সকলেই কৌরবপক্ষে আছেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ পক্ষপাতহীন, কিন্তু অন্নদাতা ধৃতরাষ্ট্রের ঋণ শোধ করবার জন্য তাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত হবেন। কোপনস্বভাব সর্বাস্ত্রবিশারদ অজেয় অভেদ্যকবচধারী কর্ণও আমাদের উপর বিদ্বেষযুক্ত। এই সকল পুরুষশ্রেষ্ঠকে জয় না ক’রে তুমি দুর্যোধনকে বধ করতে পারবে না।

 যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীমসেন বিষণ্ণ হয়ে চুপ করে রইলেন। এমন সময় মহাযোগী ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে অন্তবালে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভরতসত্তম, তোমাকে আমি প্রতিস্মৃতি নামে বিদ্য। দিচ্ছি, তার প্রভাবে অর্জুন কার্যসিদ্ধি করবে। অস্ত্রলাভ করবার জন্য সে ইন্দ্র রুদ্র বরুণ কুবের ও যমের নিকট যাক। তোমরাও এই বন ত্যাগ করে অন্য বনে যাও, এক স্থানে দীর্ঘ কাল থাকা তপস্বীদের উদ্‌বেগজনক, তাতে উদ্ভিদ-মৃগাদিরও ক্ষয় হয়। এই ব’লে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন। যুধিষ্ঠির প্রতিস্মৃতি মন্ত্র লাভ করে অমাত্য ও অনুচরদের সঙ্গে কাম্যকবনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।

৯। অর্জুনের দিবাস্ত্রসংগ্রহে গমন

 কিছুকাল পরে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ ও অশ্বত্থামা— এঁরা সমগ্র ধনর্বেদে বিশারদ, দুর্যোধন এঁদের সম্মানিত ও সন্তুষ্ট করেছে। সমস্ত পৃথিবীই এখন তার বশে এসেছে। তুমি আমাদেন প্রিয়, তোমার উপরেই আমরা নির্ভর করি। বৎস, আমি ব্যাসদেবের নিকট একটি মন্ত্র লাভ করেছি, তুমি তা শিখে নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে কঠোর তপস্যা কর। সমস্ত দিব্যাস্ত্র ইন্দ্রের কাছে আছে, তুমি তাঁর শরণাপন্ন হয়ে সেই সকল অস্ত্র লাভ কর।

 স্বস্ত্যয়নেব পর অর্জুন সশস্ত্র হয়ে যাত্রার উদ্‌যোগ করলেন। দ্রৌপদী তাঁকে বললেন, পার্থ, আমাদের সুখ দুঃখ জীবন মরণ রাজ্য ঐশ্বর্য সবই তোমার উপর নির্ভর করছে। তোমার মঙ্গল হ’ক, বলবানদের সঙ্গে তুমি বিরোধ করো না। জয়লাভের জন্য যাত্রা কর, ধাতা ও বিধাতা তোমাকে কুশলে নীরোগে রাখুন।

 অর্জুন হিমালয় ও গন্ধমাদন পার হয়ে ইন্দ্রকীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি আকাশবাণী শুনলেন—তিষ্ঠ। অর্জুন দেখলেন, পিঙ্গলবর্ণ কৃশকায় জটাধারী এক তপস্বী বৃক্ষমূলে ব’সে আছেন। তিনি বললেন, বৎস, তুমি কে? অস্ত্রধারী হয়ে কেন এখানে এসেছ? এই শান্ত তপোবনে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, তুমি ধনু ত্যাগ কর, তপস্যার প্রভাবে তুমি পরমগতি পেয়েছ। অর্জুনকে অবিচলিত দেখে তপস্বী সহাস্যে বললেন, আমি ইন্দ্র, তোমার মঙ্গল হক, তুমি অভীষ্ট স্বর্গ প্রার্থনা কর। অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমাকে সর্ববিধ অস্ত্র দান করুন, আর কিছুই আমি চাই না। যদি আমার ভ্রাতাদের বনে ফেলে রাখি এবং শত্রুর উপর প্রতিশোধ নিতে না পারি তবে আমার অকীর্তি সর্বত্র চিরস্থায়ী হবে। তখন ইন্দ্র বললেন, বৎস, তুমি যখন ভূতনাথ ত্রিলোচন শূলধর শিবের দর্শন পাবে তখন সমস্ত দিব্য অস্ত্র তোমাকে দেব। এই বলে ইন্দ্র অদৃশ্য হলেন।

  1. যেখানে সন্ধ্যা হয় সেই স্থানই যাঁর গৃহ।
  2. কৃষ্ণ দ্রৌপদীর মামাতো দেওর।
  3. নিগ্রহ-অনুগ্রহ-সমর্থ।
  4. ইনি কংসের পিতা এবং দ্বারকার অভিজাততন্ত্রের অধিনায়ক বা প্রেসিডেণ্ট।
  5. কৃষ্ণের এক বন্ধু।
  6. দ্বারকার নিকটস্থ দেশ।
  7. এঁরা তিনজনেই কৃষ্ণপুত্র।
  8. টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেন, ইনি করেণুমতী, নকুলের পত্নী।
  9. সহদেবের শ্যালক।
  10. যে মনে করে সমস্তই অকস্মাৎ ঘটে।