মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/কুণ্ডলাহরণপর্বাধ্যায়
॥ কুণ্ডলাহরণপর্বাধ্যায়
৫৬। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দান
লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন[১] যে ইন্দ্র কর্ণের সহজাত কুণ্ডল ও কবচ হরণ ক’রে তাঁর শক্তিক্ষয় করবেন। পাণ্ডবদের বনবাসের দ্বাদশ বৎসর প্রায় অতিক্রান্ত হ’লে ইন্দ্র তাঁর প্রতিজ্ঞাপালনে উদ্যোগী হলেন। ইন্দ্রের অভিপ্রায় বুঝে সূর্য নিদ্রিত কর্ণের নিকট গেলেন এবং স্বপ্নযোগে ব্রাহ্মণের মূর্তিতে দর্শন দিয়ে বললেন, বৎস, পাণ্ডবদের হিতের জন্য ইন্দ্র তোমার কুণ্ডল ও কবচ হরণ করতে চান। তিনি জানেন যে সাধুলোকে তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি দান কর। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে কবচ-কুণ্ডল ভিক্ষা করতে তোমার কাছে যাবেন। তুমি দিও না, তাতে তোমার আয়ুক্ষয় হবে।
কর্ণ প্রশ্ন করলেন, ভগবান, আপনি কে? সূর্য বললেন, আমি সহস্রাংশু সূর্য, তোমার প্রতি স্নেহের জন্য দেখা দিয়েছি। কর্ণ বললেন, বিভাবসু, সকলেই আমার এই ব্রত জানে যে প্রার্থী ব্রাহ্মণকে আমি প্রাণও দিতে পারি। ইন্দ্র যদি পাণ্ডবদের হিতের জন্য ব্রাহ্মণবেশে কবচ-কুণ্ডল ভিক্ষা করেন তবে আমি অবশ্যই দান করব, তাতে আমার কীর্তি এবং ইন্দ্রের অকীর্তি হবে।
কর্ণকে নিবৃত্ত করবার জন্য সূর্য বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কর্ণ সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না, অর্জুন যদি কার্তবীর্যার্জুনের তুল্যও হয় তথাপি তাকে আমি যুদ্ধে জয় করব। আপনি তো জানেন যে আমি পরশুরাম ও দ্রোণের নিকট অস্ত্রবল লাভ করেছি। সূর্য বললেন, তবে তুমি ইন্দ্রকে এই কথা বলো, সহস্রাক্ষ, আপনি আমাকে শত্রুনাশক অব্যর্থ শক্তি অস্ত্র দিন তবে কবচ-কুণ্ডল দেব। কর্ণ সম্মত হলেন।
প্রত্যহ মধ্যাহ্ণকালে কর্ণ স্নানের পর জল থেকে উঠে সূর্যের স্তব করতেন, সেই সময়ে ধনপ্রার্থী ব্রাহ্মণেরা তাঁর কাছে আসতেন, তখন তাঁর কিছুই অদেয় থাকত না। একদিন ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে তাঁর কাছে এসে বললেন, কর্ণ, তুমি যদি সত্যব্রত হও তবে তোমার সহজাত কবচ ও কুণ্ডল ছেদন ক’রে আমাকে দাও। কর্ণ বললেন, ভূমি স্ত্রী গো বাসস্থান বিশাল রাজ্য প্রভৃতি যা চান দেব, কিন্তু আমার সহজাত কবচ-কুণ্ডল দিতে পারি না, তাতেই আমি জগতে অবধ্য হয়েছি। ইন্দ্র আর কিছুই নেবেন না শুনে কর্ণ সহাস্যে বললেন, দেবরাজ, আপনাকে আমি পূর্বেই চিনেছি। আমার কাছ থেকে বৃথা বর নেওয়া আপনার অযোগ্য। আপনি দেবগণের ও অন্য প্রাণিগণের ঈশ্বর, আপনারও উচিত আমাকে বর দেওয়া। ইন্দ্র বললেন, সূর্যই পূর্বে জানতে পেরে তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বৎস কর্ণ, আমার বজ্র ভিন্ন যা ইচ্ছা কর তা নাও। কর্ণ বললেন, আমার কবচ-কুণ্ডলের পরিবর্তে আমাকে অব্যর্থ শক্তি-অস্ত্র দিন যাতে শত্রুসংঘ ধ্বংস করা যায়।
ইন্দ্র একট, চিন্তা ক’রে বললেন, আমার শক্তি তোমাকে দেব, তুমি তা নিক্ষেপ করলে একজন মাত্র শত্রুকে বধ করে সেই অস্ত্র আমার কাছে ফিরে আসবে। কর্ণ বললেন, আমি মহাযুদ্ধে একজন শত্রুকেই বধ করতে চাই, যাকে আমি ভয় করি। ইন্দ্র বললেন, তুমি এক শত্রুকে মারতে চাও, কিন্তু লোকে যাকে হরি নারায়ণ অচিন্ত্য প্রভৃতি বলে সেই কৃষ্ণই তাকে রক্ষা করেন। কর্ণ বললেন, যাই হক আপনি আমাকে অমোঘ শক্তি দিন যাতে একজন প্রতাপশালী শত্রুকে বধ করা যায়। আমি কবচ-কুণ্ডল ছেদন ক’রে দেব, কিন্তু আমার গাত্র যেন বিরূপ না হয়। ইন্দ্র বললেন, তোমার দেহের কোনও বিকৃতি হবে না। কিন্তু অন্য অস্ত্র থাকতে অথবা তোমার প্রাণসংশয় না হ’লে যদি অসাবধানে এই অস্ত্র নিক্ষেপ কর তবে তোমার উপরেই পড়বে। কর্ণ বললেন, আমি সত্য বলছি, পরম প্রাণসংশয় হ’লেই আমি এই অস্ত্র মোচন করব।
ইন্দ্রের কাছ থেকে শক্তি-অস্ত্র নিয়ে কর্ণ নিজের কবচ-কুণ্ডল কেটে দিলেন, তা দেখে দেব দানব মানব সিংহনাদ ক’রে উঠল। কর্ণের মুখের কোনও বিকার দেখা গেল না। কর্ণ থেকে কুণ্ডল কেটে দিয়েছিলেন সেজন্যই তাঁর নাম কর্ণ। আর্দ্র কবচ-কুণ্ডল নিয়ে ইন্দ্র সহাস্যে চ’লে গেলেন। তিনি মনে করলেন, তাঁর বঞ্চনার ফলে কর্ণ যশস্বী হয়েছেন, পাণ্ডবরাও উপকৃত হয়েছেন।
- ↑ বনপর্ব, ২০-পরিচ্ছেদে।