মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/পতিব্রতামাহাত্ম্যপর্বাধ্যায়

॥ পতিব্রতামাহাত্ম্যপর্বাধ্যায়॥

৫৫। সাবিত্রী-সত্যবান

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমার নিজের জন্য বা ভ্রাতাদের জন্য বা রাজ্যনাশের জন্য আমার তত দুঃখ হয় না যত দ্রৌপদীর জন্য হয়। দুরাত্মারা দ্যূতসভায় আমাদের যে ক্লেশ দিয়েছিল দ্রৌপদীই তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেছিলেন। আবার তাঁকে জয়দ্রথ হরণ করলে। এই দ্রুপদকন্যার তুল্য পতিব্রতা মহাভাগা কোনও নারীর কথা আপনি জানেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, মহারাজ, তুমি রাজকন্যা সাবিত্রীর ইতিহাস শোন, তিনি কুলস্ত্রীর সমস্ত সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।—

 মদ্র দেশে অশ্বপতি নামে এক ধর্মাত্মা রাজা ছিলেন। তিনি সন্তানকামনায় সাবিত্রী[] দেবীর উদ্দেশ্যে লক্ষ হোম করেন। আঠার বৎসর পূর্ণ হ’লে সাবিত্রী তুষ্ট হয়ে হোমকুণ্ড থেকে উঠে রাজাকে বর দিতে চাইলেন। অশ্বপতি বললেন, আমার বহু পুত্র হক। সাবিত্রী বললেন, তোমার অভিলাষ আমি পূর্বেই ব্রহ্মাকে জানিয়েছিলাম, তাঁর প্রসাদে তোমার একটি তেজস্বিনী কন্যা হবে। আমি তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার আদেশে এই কথা বলছি, তুমি আর প্রত্যুক্তি ক’রো না।

 যথাকালে রাজার জ্যেষ্ঠা মহিষী এক রাজীবলোচনা কন্যা প্রসব করলেন। দেবী সাবিত্রী দান করেছেন এজন্য কন্যার নাম সাবিত্রী রাখা হ’ল। মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় এই কন্যা ক্রমে যৌবনবতী হলেন, কিন্তু তাঁর তেজের জন্য কেউ তাঁর পাণি প্রার্থনা করলেন না। একদিন অশ্বপতি তাঁকে বললেন, পুত্রী, তোমাকে সম্প্রদান করবার সময় এসেছে, কিন্তু কেউ তোমাকে চাচ্ছে না। তুমি নিজেই তোমার উপযুক্ত গুণবান পতির অন্বেষণ কর। এই ব’লে রাজা কন্যার ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সাবিত্রী লজ্জিতভাবে পিতাকে প্রণাম ক’রে বৃদ্ধ সচিবদের সঙ্গে রথারোহণে যাত্রা করলেন। তিনি রাজর্ষিগণের তপোবন দর্শন এবং তীর্থস্থানে ব্রাহ্মণকে ধনদান করতে লাগলেন।

 একদিন মদ্ররাজ অশ্বপতি সভায় ব’সে নারদের সঙ্গে কথা বলছেন এমন সময় সাবিত্রী ফিরে এসে প্রণাম করলেন। নারদ বললেন, রাজা, তোমার কন্যা কোথায় গিয়েছিল? এ যুবতী হয়েছে, পতির হস্তে সম্প্রদান করছ না কেন? রাজা বললেন, দেবর্ষি, সেই উদ্দেশ্যেই একে পাঠিয়েছিলাম, এ কাকে বরণ করেছে তা শুনুন। পিতার আদেশে সাবিত্রী বললেন, শাল্ব দেশে দ্যুমৎসেন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং তাঁর পুত্রও তখন বালক, এই সুযোগ পেয়ে শত্রু তাঁর রাজ্য হরণ করে। তিনি ভার্যা ও পুত্রের সঙ্গে মহারণ্যে আসেন এবং এখন সেখানেই তপশ্চর্যা করছেন। তাঁর পুত্র সত্যবান বড় হয়েছেন, আমি তাঁকেই মনে মনে বরণ করেছি।

 নারদ বললেন, হা, কি দুর্ভাগ্য, সাবিত্রী না জেনে সত্যবানকে বরণ করেছে! তার পিতা-মাতা সত্য বলেন, সেজন্য ব্রাহ্মণেরা তার সত্যবান নাম রেখেছেন। বাল্যকালে সে অশ্বপ্রিয় ছিল, মৃত্তিকার অশ্ব গড়ত, অশ্বের চিত্র আঁকত, সেজন্য তার আর এক নাম চিত্রাশ্ব। সে রন্তিদেবের ন্যায় দাতা, শিবির ন্যায় ব্রাহ্মণসেবী ও সত্যবাদী, চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন। তার একটিমাত্র দোষ আছে—এক বৎসর পরে তার মৃত্যু হবে।

 রাজা বললেন, সাবিত্রী, তুমি আবার যাও, অন্য কাকেও বরণ কর। সাবিত্রী বললেন,

সুকৃদংশো নিপততি সকৃৎ কন্যা প্রদীয়তে।
সকৃদাহ দদানীতি ত্রীণ্যেতানি সকৃৎ সকৃৎ॥
দীর্ঘায়ুরথবাল্পায়ুঃ সগুণো নির্গণোঽপি বা।
সকৃদ্‌বৃতো ময়া ভর্তা ন দ্বিতীয়ং বৃণোম্যহম্॥
মনসা নিশ্চয়ং কৃত্বা ততো বাচাভিধীয়তে।
ক্রিয়তে কর্মণা পশ্চাৎ প্রমাণং মে মনস্ততঃ॥

—পৈতৃক ধনের অংশ একবারই প্রাপ্য হয়, কন্যাদান একবারই হয়, একবারই ‘দিলাম’ বলা হয়; এই তিন কার্যই এক-একবার মাত্র হয়। দীর্ঘায়ু বা অল্পায়ু, গুণবান বা গুণহীন, আমি একবারই পতিবরণ করেছি, দ্বিতীয় কাকেও বরণ করব না। লোকে আগে মনে মনে কর্তব্য স্থির করে, তার পর বাক্যে প্রকাশ করে, তার পর কার্য করে; অতএব আমার মনই প্রমাণ[]

 নারদ বললেন, মহারাজ, তোমার কন্যা তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে, তাকে বারণ করা যাবে না। অতএব সত্যবানকেই কন্যাদান কর। নারদ আশীর্বাদ ক’রে চ’লে গেলেন। রাজা অশ্বপতি বিবাহের উপকরণ সংগ্রহ করলেন এবং শুভদিনে সাবিত্রী ও পুরোহিতাদিকে নিয়ে দ্যুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হলেন।

 অশ্বপতি বললেন, রাজর্ষি, আমার এই সুন্দরী কন্যাকে আপনি পুত্রবধূরূপে নিন। দ্যুমৎসেন বললেন, আমরা রাজ্যচ্যুত হয়ে বনবাসে আছি, আপনার কন্যা কি ক’রে কষ্ট সইবেন? অশ্বপতি বললেন, সুখ বা দুঃখ চিরস্থায়ী নয়, আমার কন্যা আর আমি তা জানি। আমি আশা ক’রে আপনার কাছে এসেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। দ্যুমৎসেন সম্মত হলেন, আশ্রমবাসী ব্রাহ্মণগণের সমক্ষে সাবিত্রী-সত্যবানের বিবাহ যথাবিধি সম্পন্ন হ’ল। উপযুক্ত বসনভূষণ সহ কন্যাকে দান করে অশ্বপতি আনন্দিতমনে প্রস্থান করলেন। তার পর সাবিত্রী তাঁর সমস্ত আভরণ খুলে ফেলে বল্কল ও গৈরিক বস্ত্র ধারণ করলেন এবং সেবার দ্বারা শ্বশুর শাশুড়ী ও স্বামীকে পরিতুষ্ট করলেন। কিন্তু নারদের বাক্য সর্বদাই তাঁর মনে ছিল।

 এইরূপে অনেক দিন গত হ’ল। সাবিত্রী দিন গণনা করে দেখলেন, আর চার দিন পরে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হবে। তিনি ত্রিরাত্র উপবাসের সংকল্প করলেন। দ্যুমৎসেন দুঃখিত হয়ে তাঁকে বললেন, রাজকন্যা, তুমি অতি কঠোর ব্রত আরম্ভ করেছ, তিন রাত্রি উপবাস অতি দুঃসাধ্য। সাবিত্রী উত্তর দিলেন, পিতা, আপনি ভাববেন না, আমি ব্রত উদ্‌যাপন করতে পারব। সত্যবানের মৃত্যুর দিনে সাবিত্রী পূর্বাহ্ণের সমস্ত কার্য সম্পন্ন করলেন এবং গুরুজনদের প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে রইলেন। তপোবনবাসী সকলেই তাঁকে আশীর্বাদ করলেন, অবিধবা হও। সাবিত্রী ধ্যানস্থ হয়ে মনে মনে বললেন, তাই যেন হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী তাঁকে বললেন, তোমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে, এখন আহার কর। সাবিত্রী বললেন, সূর্যাস্তের পর আহার করব এই সংকল্প করেছি।

 সত্যবান কাঁধে কুঠার নিয়ে বনে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রী বললেন, আমিও যাব, তোমার সঙ্গ ছাড়ব না। সত্যবান বললেন, তুমি পূর্বে কখনও বনে যাও নি, পথও কষ্টকর, তার উপর উপবাস ক’রে দুর্বল হয়ে আছ, কি ক’রে পদব্রজে যাবে? সাবিত্রী বললেন, উপবাসে আমার কষ্ট হয় নি, যাবার জন্য আমার উৎসাহ হয়েছে, তুমি বারণ ক’রো না। সত্যবান বললেন, তবে আমার পিতা-মাতার অনুমতি নাও, তা হ’লে আমার দোষ হবে না। সাবিত্রীর অনুরোধ শুনে দ্যুমৎসেন বললেন, সাবিত্রী আমাদের পুত্রবধূ হবার পর কিছু চেয়েছেন ব’লে মনে পড়ে না, অতএব এঁর অভিলাষ পূর্ণ হ’ক। পুত্রী, তুমি সত্যবানের সঙ্গে সাবধানে যেয়ো। অনুমতি পেয়ে সাবিত্রী যেন সহাস্যবদনে কিন্তু সন্তপ্তহহৃদয়ে স্বামীর সঙ্গে গেলেন। যেতে যেতে সত্যবান পুণ্যসলিলা নদী, পুষ্পিত পর্বত প্রভৃতি দেখাতে লাগলেন। সাবিত্রী নিরন্তর স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন এবং নারদের বাক্য স্মরণ ক’রে তাঁকে মৃত জ্ঞান করলেন।

 সত্যবান ফল পেড়ে তাঁর থলি ভরতি করলেন, তার পর কাঠ কাটতে লাগলেন। পরিশ্রমে তাঁর ঘাম হ’তে লাগল, মাথায় বেদনা হ’ল। তিনি বললেন, সাবিত্রী, আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি, আমার মাথা যেন শূল দিয়ে বিঁধছে, দাঁড়াতে পারছি না। সাবিত্রী স্বামীর মাথা কোলে রেখে ভূতলে ব’সে পড়লেন। মুহূর্তকাল পরে তিনি দেখলেন, এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ—রক্তলোচন ভয়ংকর পুরুষ পার্শ্বে এসে সত্যবানকে নিরীক্ষণ করছেন, তাঁর পরিধানে রক্তবাস, কেশ চূড়াবদ্ধ, হতে পাশ। তাঁকে দেখে সাবিত্রী ধীরে ধীরে তাঁর স্বামীর মাথা কোল থেকে নামালেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে কম্পিতহহৃদয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আপনার মূর্তি দেখে বুঝেছি আপনি দেবতা। আপনি কে, কি ইচ্ছা করেন?

 যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি পতিব্রতা তপশ্চারিণী, এজন্য তোমার সঙ্গে কথা বলছি। আমি যম। তোমার স্বামীর আয়ু শেষ হয়েছে, আমি এঁকে পাশবন্ধ করে নিয়ে যাব। সত্যবান ধার্মিক, গুণসাগর, সেজন্য আমি অনুচর না পাঠিয়ে নিজেই এসেছি। এই ব’লে যম সত্যবানের দেহ থেকে অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ পুরুষ[] পাশবদ্ধ করে টেনে নিলেন, প্রাণশূন্য দেহ শ্বাসহীন নিষ্প্রভ নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে রইল; যম দক্ষিণ দিকে চললেন। সাবিত্রীকে পশ্চাতে আসতে দেখে যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি ভর্তার ঋণ শোধ করেছ, এখন ফিরে গিয়ে এঁর পারলৌকিক ক্রিয়া কর।

 সাবিত্রী বললেন, আমার স্বামী যেখানে যান অথবা তাঁকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আমারও সেখানে যাওয়া কর্তব্য, এই সনাতন ধর্ম। আমার তপস্যা ও পতিপ্রেমের বলে এবং আপনার প্রসাদে আমার গতি প্রতিহত হবে না। পণ্ডিতরা বলেন, একসঙ্গে সাত পা গেলেই মিত্রতা হয়; সেই মিত্রতায় নির্ভর করে আপনাকে কিছু বলছি শুনুন। পতিহীনা নারীর পক্ষে বনে বাস ক’রে ধর্মাচরণ করা অসম্ভব। যে ধর্মপথ সাধুজনের সম্মত সকলে তারই অনুসরণ করে, অন্য পথে যায় না। সাধুজন গার্হস্থ্য ধর্মকেই প্রধান বলেন।

 যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি আর এসো না, নিবৃত্ত হও। তোমার শুদ্ধ ভাষা আর যুক্তিসম্মত বাক্য শুনে আমি তুষ্ট হয়েছি, তুমি বর চাও। সত্যবানের জীবন ভিন্ন যা চাও তাই দেব। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর অন্ধ ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছেন, আপনার প্রসাদে তিনি চক্ষু লাভ ক’রে অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হ’ন। যম বললেন, তাই হবে। তোমাকে পথশ্রমে ক্লান্ত দেখছি, তুমি ফিরে যাও।

 সাবিত্রী বললেন, স্বামীর নিকটে থাকলে আমার ক্লান্তি হবে কেন? তাঁর যে গতি আমারও সেই গতি। তা ছাড়া আপনার ন্যায় সজ্জনের সঙ্গে একবার মিলনও বাঞ্ছনীয়, তা নিষ্ফল হয় না, সেজন্য সাধুসঙ্গেই থাকা উচিত। যম বললেন, তুমি যে হিতবাক্য বললে তা মনোহর বুদ্ধিপ্রদ। সত্যবানের জীবন ভিন্ন দ্বিতীয় একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর তাঁর রাজ্য পুনর্বার লাভ করুন, তিনি যেন স্বধর্ম পালন করতে পারেন।

 যম বললেন, রাজকন্যা, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। এখন নিবৃত্ত হও, আর পরিশ্রম ক’রো না। সাবিত্রী বললেন, দেব, আপনি জগতের লোককে নিয়মানসারে সংযত রাখেন এবং আয়ুঃশেষে তাদেরই কর্মানুসারে নিয়ে যান, আপনার নিজের ইচ্ছায় নয়; এজন্যই আপনার নাম যম। আমার আর একটি কথা শুনুন। কর্ম মন ও বাক্য দ্বারা কোনও প্রাণীর অনিষ্ট না করা, অনুগ্রহ ও দান করা—এই সনাতন ধর্ম। জগতের লোক সাধারণত অল্পায়ু ও দুর্বল, সেজন্য সাধুজন শরণাগত অমিত্রকেও দয়া করেন। যম বললেন, পিপাসিতের পক্ষে যেমন জল, সেইরূপ তোমার বাক্য। কল্যাণী, সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও।

 সাবিত্রী বললেন, আমার পিতা পুত্রহীন, বংশরক্ষার্থ তাঁর যেন শতপুত্র হয়, এই তৃতীয় বর আমি চাচ্ছি। যম বললেন, তাই হবে। তুমি বহুদূরে এসে পড়েছ, এখন ফিরে যাও। সাবিত্রী বললেন, আমার পক্ষে এ দূর নয়, কারণ স্বামীর নিকটে আছি। আমার মন আরও দূরে ধাবিত হচ্ছে। আপনি বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র, সেজন্য আপনি বৈবস্বত; আপনি সমবুদ্ধিতে ধর্মানুসারে প্রজাশাসন করেন সেজন্য আপনি ধর্মরাজ। আপনি সজ্জন, সজ্জনের উপরে যেমন বিশ্বাস হয় তেমন নিজের উপরেও হয় না।

 যম বললেন, তুমি যা বলছ তেমন বাক্য আমি কোথাও শুনি নি। তুমি সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার গর্ভে সত্যবানের ঔরসে যেন বলবীর্যশালী শতপুত্র হয়, এই চতুর্থ বর চাচ্ছি। যম বললেন, বলবীর্যশালী শতপুত্র তোমাকে আনন্দিত করবে। রাজকন্যা, দূর পথে এসেছ, ফিরে যাও।

 সাবিত্রী বললেন, সাধুজন সর্বদাই ধর্মপথে থাকেন, তাঁরা দান ক’রে অনুতপ্ত হন না। তাঁদের অনুগ্রহ ব্যর্থ হয় না, তাঁদের কাছে কারও প্রার্থনা বা সম্মান নষ্ট হয় না, তাঁরা সকলেরই রক্ষক। যম বললেন, তোমার ধর্মসম্মত হৃদয়গ্রাহী বাক্য শুনে তোমার প্রতি আমার ভক্তি হয়েছে। পতিব্রতা, তুমি আর একটি বর চাও।

 সাবিত্রী বললেন, হে মানদ, যে বর আমাকে দিয়েছেন তা আমার পুণ্য না থাকলে আপনি দিতেন না। সেই পুণ্যবলে এই বর চাচ্ছি—সত্যবান জীবন লাভ করুন, পতি বিনা আমি মৃততুল্য হয়ে আছি। পতিহীন হয়ে আমি সুখ চাই না, স্বর্গ চাই না, প্রিয়বস্তু চাই না, বাঁচতেও চাই না। আপনি শতপুত্রের বর দিয়েছেন, অথচ আমার পতিকে হরণ ক’রে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যবান বেঁচে উঠুন এই বর চাচ্ছি, তাতে আপনার বাক্য সত্য হবে। ধর্মরাজ যম বললেন, তাই হবে। সত্যবানকে পাশমুক্ত ক’রে যম হৃষ্টচিত্তে বললেন, তোমার পতিকে মুক্তি দিলাম, ইনি নীরোগ বলবান ও সফলকাম হবেন, চার শত বৎসর তোমার সঙ্গে জীবিত থাকবেন, যজ্ঞ ও ধর্মকার্য ক’রে খ্যাতিলাভ করবেন।

 যম চ’লে গেলে সাবিত্রী তাঁর স্বামীর মৃতদেহের নিকট ফিরে এলেন। তিনি সত্যবানের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, রাজপুত্র, তুমি বিশ্রাম করেছ, তোমার নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে, যদি পার তো ওঠ। দেখ, রাত্রি গাঢ় হয়েছে। সত্যবান সংজ্ঞালাভ ক’রে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, তার পর বললেন, আমি শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তুমি আমাকে আলিঙ্গন করে ধরে ছিলে। আমি নিদ্রাবস্থায় ঘোর অন্ধকার এবং এক মহাতেজা পুরুষকে দেখেছি। একি স্বপ্ন না সত্য? সাবিত্রী বললেন, কাল তোমাকে বলব। এখন রাত্রি গভীর হয়েছে, ওঠ, পিতা-মাতার কাছে চল। সত্যবান বললেন, এই ভয়ানক বনে নিবিড় অন্ধকারে পথ দেখতে পাবে না। সাবিত্রী বললেন, এই বনে একটি গাছ জ্বলছে, তা থেকে আগুন এনে আমাদের চারিদিকে জ্বালব, কাঠ আমাদের কাছেই আছে। তোমাকে রুগ্নের ন্যায় দেখাচ্ছে, যদি যেতে না পার তবে আমরা এখানেই রাত্রিযাপন করব। সত্যবান বললেন, আমি সুস্থ হয়েছি, ফিরে যেতে ইচ্ছা করি। দিনমানেও যদি আমি আশ্রমের বাইরে যাই তবে পিতা-মাতা উদ্‌বিগ্ন হয়ে আমার অন্বেষণ করেন, বিলম্বের জন্য ভর্ৎসনা করেন। আজ তাঁদের কি অবস্থা হয়েছে তাই আমি ভাবছি।

 সত্যবান শোকার্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। সাবিত্রী তাঁর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, যদি আমি তপস্যা দান ও হোম ক’রে থাকি তবে এই রাত্রি আমার শ্বশুর শাশুড়ী আর স্বামীর পক্ষে শুভ হ’ক। সাবিত্রী তাঁর কেশপাশ সংযত ক’রে দুই বাহু দিয়ে স্বামীকে তুললেন। সত্যবান তাঁর ফলের থলির দিকে তাকাচ্ছেন দেখে সাবিত্রী বললেন, কাল নিয়ে যেয়ো, তোমার কুঠার আমি নিচ্ছি। ফলের থলি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে কুঠার নিয়ে সাবিত্রী সত্যবানের কাছে এলেন এবং তাঁর বাঁ হাত নিজের কাঁধে রেখে নিজের ডান হাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে চললেন। সত্যবান বললেন, এই পলাশবনের উত্তর দিকের পথ দিয়ে দ্রুত চল, আমি এখন সুস্থ হয়েছি, পিতামাতাকে শীঘ্র দেখতে চাই।

 এই সময়ে দ্যুমৎসেন চক্ষু লাভ করলেন। সত্যবান না আসায় তিনি উদ্‌বিগ্ন হয়ে তাঁর ভার্যা শৈবার সঙ্গে চারিদিকে উন্মত্তের ন্যায় খুঁজতে লাগলেন। আশ্রমবাসী ঋষিরা তাঁদের ফিরিয়ে এনে নানাপ্রকারে আশ্বাস দিলেন। এমন সময় সাবিত্রী সত্যবানকে নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণেরা আগুন জ্বাললেন এবং শৈব্যা সত্যবান ও সাবিত্রীর সঙ্গে সকলে রাজা দ্যুমৎসেনের নিকটে বসলেন। সত্যবান জানালেন যে তিনি শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেজন্য ফিরতে বিলম্ব হয়েছে। গৌতম নামে এক ঋষি বললেন, তোমার পিতা অকস্মাৎ চক্ষু লাভ করেছেন, তুমি এর কারণ জান না। সাবিত্রী, তুমি বলতে পারবে, তুমি সবই জান, তোমাকে ভগবতী সাবিত্রী দেবীর ন্যায় শক্তিমতী মনে করি। যদি গোপনীয় না হয় তো বল।

 সাবিত্রী বললেন, নারদের কাছে শুনেছিলাম যে, আমার পতির মৃত্যু হবে। আজ সেই দিন, সেজন্য আমি পতির সঙ্গ ছাড়ি নি। তার পর সাবিত্রী যমের আগমন, সত্যবানকে গ্রহণ, এবং স্তবে প্রসন্ন হয়ে পাঁচটি বরদান প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন। ঋষিরা বললেন, সাধ্বী, তুমি সুশীলা পণ্যবতী সদ্‌বংশীয়া; তমোময় হ্রদে নিমজ্জমান বিপদ্‌গ্রস্ত রাজবংশকে তুমি উদ্ধার করেছ। তার পর তাঁরা সাবিত্রীর বহু প্রশংসা ও সম্মাননা ক’রে হষ্টচিত্তে নিজ নিজ গৃহে চ’লে গেলেন।

 পরদিন প্রভাতকালে শাল্বদেশের প্রজারা এসে দ্যুমৎসেনকে জানালে যে তাঁর মন্ত্রী তাঁর শত্রুকে বিনষ্ট করেছেন এবং রাজাকে নিয়ে যাবার জন্য চতুরঙ্গ সৈন্য উপস্থিত হয়েছে। দ্যুমৎসেন তাঁর মহিষী, পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং সত্যবানকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। যথাকালে সাবিত্রীর শত পুত্র হ’ল এবং অশ্বপতির ঔরসে মালবীর গর্ভে সাবিত্রীর এক শত ভ্রাতাও হ’ল।

 এই সাবিত্রীর উপাখ্যান যে ভক্তিসহকারে শোনে সে সুখী ও সর্ববিষয়ে সিদ্ধকাম হয়, কখনও দুঃখ পায় না।

  1. সূর্যাধিষ্ঠাত্রী দেবী।
  2. আমি মনে মনে পতি বরণ করেছি, বিবাহের তাই প্রমাণস্বরূপ।
  3. সূক্ষ্ম বা লিঙ্গ শরীর।