মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/ঘোষযাত্রাপর্বাধ্যায়

॥ ঘোষযাত্রাপবাধ্যায়॥

৪৭। দুর্যোধনের ঘোষযাত্রা ও গন্ধর্বহস্তে নিগ্রহ

 মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি চ’লে গেলে পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে সরোবরের নিকট গৃহ নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। সেই সময়ে হস্তিনাপুরে একদিন শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, তুমি এখন শ্রীসম্পন্ন হয়ে রাজ্যভোগ করছ, আর পাণ্ডবরা শ্রীহীন রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছে। এখন একবার তাদের দেখে এস। পর্বতবাসী যেমন ভূতলবাসীকে দেখে, সমৃদ্ধিশালী লোকে সেইরূপ দুর্দশাপন্ন শত্রুকে দেখে, এর চেয়ে সুখজনক আর কিছুই নেই। তোমার পত্নীরাও বেশভূষায় সুসজ্জিত হয়ে মৃগচর্মধারিণী দীনা দ্রৌপদীকে দেখে আনে।

 দুর্যোধন বললেন, তোমরা আমার মনের মতন কথা বলেছ, কিন্তু বৃদ্ধ রাজা আমাদের যেতে দেবেন না। শকুনির সঙ্গে পরামর্শ ক’রে কর্ণ বললেন, গোপপল্লীর কাছে আমাদের গোপরা থাকে, তারা তোমার প্রতীক্ষা করছে। ঘোষযাত্রা[] সর্বদাই কর্তব্য, ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে অনুমতি দেবেন। এই কথার পর তিনজনে সহাস্যে হাতে হাত মেলালেন।

 কর্ণ ও শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বললেন, কুরুরাজ, আপনার গোপপল্লীর গরুদের গণনা আর বাছুরদের চিহ্নিত করবার সময় এসেছে, মৃগয়ারও এই সময়, অতএব আপনি দুর্যোধনকে যাবার অনুমতি দিন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মৃগয়া আর গরু দেখে আসা দুইই ভাল, কিন্তু শুনেছি গোপপল্লীর নিকটেই নরব্যাঘ্র পাণ্ডবরা বাস করেন, সেজন্য তোমাদের সেখানে যাওয়া উচিত নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাদের দেখলে ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু ভীম অসহিষ্ণু আর যাজ্ঞসেনী তো মূর্তিমতী তেজ। তোমরা দর্প ও মোহের বশে অপরাধ করবে, তার ফলে তপস্বী পাণ্ডবরা তোমাদের দগ্ধ ক’রে ফেলবেন। অর্জুনও ইন্দ্রলোকে অস্ত্রশিক্ষা করে ফিরে এসেছেন। অতএব দুর্যোধন, তুমি নিজে যেয়ো না, পরিদর্শনের জন্য বিশ্বস্ত লোক পাঠাও।

 শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ, তিনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, অন্য পাণ্ডবরাও তাঁর অনুগত। আমরা মৃগয়া আর গরু গোনবার জন্যই যেতে চাচ্ছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নয়। তাঁরা যেখানে আছেন সেখানে আমরা যাব না। ধৃতরাষ্ট্র অনিচ্ছায় অনুমতি দিলেন। তখন দুর্যোধন কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসন প্রভৃতি দ্বৈতবনে যাত্রা করলেন, তাঁদের সঙ্গে অশ্ব-গজ-রথ সমেত বিশাল সৈন্য, বহু স্ত্রীলোক, বিপণি ও শকট সহ বণিকের দল, বেশ্যা, স্তুতিপাঠক, মৃগয়াজীবী প্রভৃতিও গেল। গোপালনস্থানে উপস্থিত হয়ে দুর্যোধন বহু সহস্র গাভী ও বৎস পরিদর্শন গণনা ও চিহ্নিত করলেন এবং গোপালকদের মধ্যে আনন্দে বাস করতে লাগলেন। নৃত্যগীতবাদ্যে নিপুণ গোপ ও গোপকন্যারা দুর্যোধনের মনোরঞ্জন করতে লাগল। তিনি সেই রমণীয় দেশে মৃগয়া দুগ্ধপান ও বিবিধ ভোগবিলাসে রত হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন।

 দ্বৈতবনের নিকটে এসে দুর্যোধন তাঁর ভৃত্যদের আদেশ দিলেন, তোমরা শীঘ্র বহু ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ কর। সেই সময়ে কুবেরভবন থেকে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন ক্রীড়া করবার জন্য দ্বৈতবনের সরোবরের নিকট সদলবলে অবস্থান করছিলেন। দুর্যোধনের লোকরা দ্বৈতবনের কাছে এলেই গন্ধর্বরা তাদের বাধা দিলে। এই সংবাদ পেয়ে দুর্যোধন তাঁর একদল দুর্ধর্ষ সৈনাদের বললেন, গন্ধর্বদের তাড়িয়ে দাও। তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলে দুর্যোধন বহু সহস্র যোদ্ধা পাঠালেন। গন্ধর্বগণ মৃদুবাক্যে বারণ করলেও কুরুসৈন্য সবলে দ্বৈতবনে প্রবেশ করলে।

 গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর যোদ্ধাদের বললেন, তোমরা ওই অনার্যদের শাসন কর। সশস্ত্র গন্ধর্বসেনার আক্রমণে কুরুসেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণও যদ্ধে বিমুখ হলেন। কিন্তু মহাবীর কর্ণ নিরস্ত হলেন না, তিনি শত শত গন্ধর্ব বধ ক’রে চিত্রসেনের বাহিনী বিধ্বস্ত ক’রে দিলেন। তখন দুর্যোধনাদি কর্ণের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। নিজের সৈন্যদল নিপীড়িত হচ্ছে দেখে চিত্রসেন মায়া অবলম্বন করলেন। গন্ধর্বসৈন্যরা কর্ণের রথ ধ্বংস করে ফেললে, কর্ণ লম্ফ দিয়ে নেমে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণের রথে উঠে চ’লে গেলেন। কর্ণের পরাজয় এবং কুরুসেনার পলায়ন দেখেও দুর্যোধন যুদ্ধে বিরত হলেন না। তাঁর রথও নষ্ট হ’ল, তিনি ভূপতিত হয়ে চিত্রসেনের হাতে বন্দী হলেন। তখন গন্ধর্বরা দুঃশাসন প্রভৃতি এবং তাঁদের সকলের পত্নীদের ধ’রে নিয়ে দ্রুতবেগে চ’লে গেল।

 গন্ধর্বগণ দুর্যোধনকে হরণ করে নিয়ে গেলে পরাজিত কুরুসৈন্য বেশ্যা ও বণিক প্রভৃতি পাণ্ডবগণের শরণাপন্ন হ’ল। দুর্যোধনের বৃদ্ধ মন্ত্রীরা দীনভাবে যুধিষ্ঠিরের সাহায্য ভিক্ষা করলেন। ভীম বললেন, আমরা গজবাজি নিয়ে যুদ্ধ ক’রে অনেক চেষ্টায় যা করতাম গন্ধর্বরা তা সম্পন্ন করেছে। দুর্যোধন যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা সিদ্ধ না হয়ে অন্য প্রকার ঘটেছে। আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে এমন লোকও আছেন যিনি আমাদের প্রিয়সাধনের ভার স্বয়ং নিয়েছেন। ভীমের এই কর্কশ কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, এখন নিষ্ঠুরতার সময় নয়, কৌরবগণ ভয়ার্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়ে আমাদের শরণ নিয়েছে। জ্ঞাতিদের মধ্যে ভেদ হয়, কলহ হয়, কিন্তু তার জন্য কুলধর্ম নষ্ট হ’তে পারে না। দুর্যোধন আর কুরুনারীদের হরণের ফলে আমাদের কুল নষ্ট হ’তে বসেছে, দুর্বুদ্ধি চিত্রসেন আমাদের অবজ্ঞা ক’রে এই দুষ্কার্য করেছেন। বীরগণ, তোমরা বিলম্ব ক’রো না, ওঠ, চার ভ্রাতায় মিলে দুর্যোধনকে উদ্ধার কর। ভীম, বিপন্ন দুর্যোধন জীবনরক্ষার জন্য তোমাদেরই বাহুবল প্রার্থনা করেছে এর চেয়ে গৌরবের বিষয় আর কি হতে পারে? আমি এখন সাদ্যস্ক যজ্ঞে নিযুক্ত আছি, নয়তো বিনা বিচারে নিজেই তার কাছে দৌড়ে যেতাম। তোমরা মিষ্ট কথায় দুর্যোধনাদির মুক্তি চাইবে, যদি তাতে ফল না হয় তবে বলপ্রয়োগে গন্ধর্বরাজকে পরাস্ত করবে।

 ভীম অর্জুন নকুল সহদেব বর্ম ধারণ ক’রে সশস্ত্র হয়ে রথারোহণে যাত্রা করলেন, তাঁদের দেখে কৌরবসৈন্যগণ আনন্দধ্বনি করতে লাগল। গন্ধর্বসেনার নিকটে গিয়ে অর্জুন বললেন, আমাদের ভ্রাতা দুর্যোধনকে ছেড়ে দাও। গন্ধর্বরা ঈষৎ হাস্য ক’রে বললে, বৎস, আমরা দেবরাজ ভিন্ন আর কারও আদেশ শুনি না। অর্জুন আবার বললেন, যদি ভাল কথায় না ছাড় তবে বলপ্রয়োগ করব। তার পর গন্ধর্ব ও পাণ্ডবগণের যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। অর্জুনের শরবর্ষণে গন্ধর্বসেনা বিনষ্ট হচ্ছে দেখে চিত্রসেন গদাহস্তে যুদ্ধ করতে এলেন, অর্জুন তাঁর গদা শরাঘাতে কেটে ফেললেন। চিত্রসেন মায়াবলে অন্তর্হিত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে শব্দবেধী বাণ দিয়ে তাঁকে বধ করতে উদ্যত হলেন। তখন চিত্রসেন দর্শন দিয়ে বললেন, আমি তোমার সখা।

 চিত্রসেনকে দুর্বল দেখে অর্জুন তাঁর বাণ সংহরণ ক’রে সহাস্যে বললেন, বীর, তুমি দুর্যোধনাদি আর তাঁর ভার্যাদের হরণ করেছ কেন? চিত্রসেন বললেন, ধনঞ্জয়, দুরাত্মা দুর্যোধন আর কর্ণ তোমাদের উপহাস করবার জন্য এখানে এসেছে জানতে পেরে দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে বললেন, যাও, দুর্যোধন আর তার মন্ত্রণাদাতাদের বেঁধে নিয়ে এস। তাঁর আদেশ অনুসারে আমি এদের সুরলোকে নিয়ে যাব। তার পর চিত্রসেন যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং তাঁর অনুরোধে দুর্যোধন প্রভৃতিকে মুক্তি দিলেন। যুধিষ্ঠির গন্ধর্বদের প্রশংসা করে বললেন, তোমরা বলবান, তথাপি ভাগ্যক্রমে এঁদের বধ কর নি। বৎস চিত্রসেন, তোমরা আমার মহা উপকার করেছ, আমার কুলের মর্যাদাহানি কর নি।

 চিত্রসেন বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন। ইন্দ্র দিব্য অমৃত বর্ষণ ক’রে নিহত গন্ধর্বগণকে পুনর্জীবিত করলেন। কৌরবগণ তাঁদের স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে মিলিত হযে পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, আর কখনও এমন দুঃসাহসের কাজ করো না। এখন তোমরা নিরাপদে স্বচ্ছন্দে গৃহে যাও, মনে কোনও দুঃখ রেখো না। ধর্মপুত্র যধিষ্ঠিরকে অভিবাদন ক’রে দুর্যোধন লজ্জায় ও দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে বিকলেন্দ্রিয় আতুরের ন্যায় হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।

৪৮। দুর্যোধনের প্রয়োপবেশন

 শোকে অভিভূত হয়ে নিজের পরাভবের বিষয় ভাবতে ভাবতে দুর্যোধন তাঁর চতুরঙ্গ বলের পশ্চাতে যেতে লাগলেন। পথে এক স্থানে যখন তিনি বিশ্রাম করছিলেন তখন কর্ণ তাঁর কাছে এসে বললেন, রাজা, ভাগ্যক্রমে তুমি কামরূপী গন্ধর্বদের জয় করেছ, ভাগ্যক্রমে আবার তোমার সঙ্গে আমার মিলন হ’ল। আমি শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম, গন্ধর্বরা আমার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল, সেজন্যই আমি যুদ্ধস্থল থেকে চ’লে গিয়েছিলাম। এই অমানুষিক যুদ্ধে তুমি ও তোমার ভ্রাতারা জয়ী হয়ে অক্ষতদেহে ফিরে এসেছ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।

 অধোমুখে গদ্‌গদস্বরে দুর্যোধন বললেন, কর্ণ, তুমি প্রকৃত ঘটনা জান না। বহুক্ষণ যদ্ধের পর গন্ধর্বরা আমাদের পরাস্ত করে এবং স্ত্রী পুত্র অমাত্য প্রভৃতি সহ বন্ধন ক’রে আকাশপথে হরণ ক’রে নিয়ে যায়। পাণ্ডবগণ সংবাদ পেয়ে আমাদের উদ্ধার করতে আসেন। তার পর চিত্রসেন আর অর্জুন আমাকে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে যান, যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে আমরা মুক্তি পেয়েছি। চিত্রসেন যখন বললেন যে আমরা সপত্নীক পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে এসেছিলাম তখন লজ্জায় আমার ভূগর্ভে প্রবেশ করতে ইচ্ছা হ’ল। এর চেয়ে যুদ্ধে মরাই আমার পক্ষে ভাল হ’ত। আমি হস্তিনাপুরে যাব না, এইখানেই প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করব, তোমরা ফিরে যাও। দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনির সহায়তায় তুমিই রাজ্যশাসন ক’রো।

 দুঃশাসন কাতর হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পদতলে প’ড়ে বললেন, এ কখনই হ’তে পারে না। কর্ণ বললেন, রাজা, তোমার চিত্তদৌর্বল্য আজ দেখলাম। সেনানায়কগণ অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধে শত্রু হস্তে বন্দী হন, আবার নিজ সৈন্য কর্তৃক মুক্তও হন। তোমারই রাজ্যবাসী পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করেছে, তাতে দুঃখ কিসের? পাণ্ডবরা তোমার দাস, সে কারণেই তোমার সহায় হয়েছে।

 শকুনি বললেন, আমি তোমাকে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী করেছি, কিন্তু তুমি নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সমস্ত ত্যাগ ক’রে মরতে চাচ্ছ। পাণ্ডবরা তোমার উপকার করেছে তাতে তোমার আনন্দিত হওয়াই উচিত। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সৌভ্রাত্র কর, তাদের পৈতৃক রাজ্য ফিরিয়ে দাও[], তাতে তোমার যশ ধর্ম ও সুখ লাভ হবে।

 দুর্যোধন কিছুতেই প্রবোধ মানলেন না, প্রায়োপবেশনের সংকল্পও ছাড়লেন না। তখন তাঁর সুহৃদ্‌গণ বললেন, রাজা, তোমার যে গতি আমাদেরও তাই, আমরা তোমাকে ছেড়ে যাব না। তার পর দুর্যোধন আচমন করে শুচি হলেন এবং কুশচীর ধারণ ক’রে মৌনী হয়ে স্বর্গলাভের কামনায় কুশশয্যায় শয়ন করলেন।


 দেবগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দানবগণ পাতালে বাস করছিল। দুর্যোধনের প্রায়োপবেশনের ফলে তাদের স্বপক্ষের ক্ষতি হবে জেনে তারা এক যজ্ঞ করলে। যজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে এক অদ্ভুত কৃত্যা মখব্যাদান ক’রে উত্থিত হয়ে বললে, কি করতে হবে? দানবরা বললে, দুর্যোধন প্রায়োপবেশন করেছেন, তাঁকে এখানে নিয়ে এস। নিমেষমধ্যে কৃত্যা দুর্যোধনকে পাতালে নিয়ে এল। দানবরা তাঁকে বললে, ভরতকুলপালক রাজা দুর্যোধন, আত্মহত্যায় অধোগতি ও যশোহানি হয়, প্রায়োপবেশনের সংকল্প ত্যাগ কর। আমরা মহাদেবের তপস্যা ক’রে তোমাকে পেয়েছি, তিনি তোমার পূর্বকায় (নাভির ঊর্ধ্ব দেহ) বজ্রের ন্যায় দৃঢ় ও অশ্বের অভেদ্য করেছেন, আর পার্বতী তোমার অধঃকায় পুষ্পের ন্যায় কোমল ও নারীদের মনোহর করেছেন। মহেশ্বর-মহেশ্বরী তোমার দেহ নির্মাণ করেছেন সেজন্য তুমি দিব্যপুত্র, মানুষ নও। তোমাকে সাহায্য করবার জন্য দানব ও অসুরগণ ভূতলে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতির দেহে প্রবেশ করবেন, তার ফলে ভীষ্মাদি দয়া ত্যাগ ক’রে তোমার শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, পুত্র ভ্রাতা বন্ধু শিষ্য কাকেও নিষ্কৃতি দেবেন না। নিহত নরকাসুরের আত্মা কর্ণের দেহে অধিষ্ঠান ক’রে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। আমরা সংশপ্তক নামে বহু সহস্র দৈত্য ও রাক্ষস নিযুক্ত করেছি, তারা অর্জুনকে বধ করবে। তুমি শত্রুহীন হয়ে পৃথিবী ভোগ করবে, অতএব শোক ত্যাগ করে স্বগৃহে যাও। তুমি আমাদের আর পাণ্ডবগণ দেবতাদের অবলম্বন।

 দানবগণ দুর্যোধনকে প্রিয়বাক্যে আশ্বাস দিয়ে আলিঙ্গন করলে। কৃত্যা তাঁকে পূর্বস্থানে রেখে এল। এইরূপ স্বপ্নদর্শনের পর দুর্যোধনের দৃঢ়বিশ্বাস হ’ল যে পাণ্ডবগণ যুদ্ধে পরাজিত হবেন। তিনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত প্রকাশ করলেন না। রাত্রিশেষে কর্ণ কৃতাঞ্জলি হয়ে সহাস্যে তাঁকে বললেন, রাজা, ওঠ, মরলে শত্রুজয় করা যায় না, জীবিত থাকলেই শুভ হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করব। তার পর দুর্যোধন সদলে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।

৪৯। দুর্যোধনের বৈষ্ণব যজ্ঞ

 দুর্যোধন ফিরে এলে ভীষ্ম তাঁকে বললেন, বৎস, আমার অমত সত্ত্বেও তুমি দ্বৈতবনে গিয়েছিলে। গন্ধর্বরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, অবশেষে পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করলেন। সূতপুত্র কর্ণ ভয় পেয়ে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলেন। মহাত্মা পাণ্ডবদের আর দুর্মতি কর্ণের বিক্রম তুমি দেখেছ, এখন বংশের মঙ্গলার্থে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর। দুর্যোধন হেসে শকুনির সঙ্গে উঠে গেলেন। ভীষ্ম লজ্জিত হয়ে নিজের ভবনে প্রস্থান করলেন।

 দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, পাণ্ডবদের ন্যায় আমিও রাজসূয় যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করি। কর্ণ প্রভৃতি সোৎসাহে এই প্রস্তাবের সমর্থন করলেন, কিন্তু পুরোহিত দুর্যোধনকে বললেন, তোমার পিতা আর যুধিষ্ঠির জীবিত থাকতে তোমাদের বংশে আর কেউ এই যজ্ঞ করতে পারেন না। তবে আর একটি মহাযজ্ঞ আছে যা রাজসূয়ের সমান, তুমি তাই কর। তোমার অধীন করদ রাজারা সুবর্ণ দেবেন, সেই সুবর্ণে লাঙ্গল নির্মাণ ক’রে যজ্ঞভূমি কর্ষণ করতে হবে, তার পর যথাবিধি যজ্ঞ আরম্ভ হবে। এই ষজ্ঞের নাম বৈষ্ণব যজ্ঞ, এর অনুষ্ঠান করলে তোমার অভিলাষ সফল হবে।

 মহাসমারোহে প্রভূত অর্থব্যয়ে যজ্ঞের আয়োজন হ’ল। দূতরা দ্রুতগামী রথে রাজা ও ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করতে গেল। দুঃশাসন একজন দূতকে বললেন, শীঘ্র দ্বৈতবনে গিয়ে পাপী পাণ্ডবগণ আর সেখানকার ব্রাহ্মণগণকে নিমন্ত্রণ করে এস। দূতের বার্তা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা দুর্যোধন ভাগ্যবান তাই এই মহাযজ্ঞ করছেন, এতে তাঁর পূর্বপুরুষদের কীর্তি বৃদ্ধি পাবে। আমরাও তাঁর কাছে যাব বটে, কিন্তু এখন নয়, ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্ণ হ’লে। ভীম বললেন, তের বৎসর পরে যখন যুদ্ধযজ্ঞে অস্ত্রশস্ত্রে অগ্নি প্রজ্বলিত হবে আর সেই অগ্নিতে দুর্যোধনকে ফেলা হবে তখন যুধিষ্ঠির যাবেন; যখন ধার্তরাষ্ট্ররা সেই যজ্ঞাগ্নিতে দগ্ধ হবে আর পাণ্ডবগণ তাতে ক্রোধরূপ হবি অর্পণ করবেন তখন আমি যাব; দূত, এই কথা দুর্যোধনকে জানিও।

 যজ্ঞ সমাপ্ত হ’লে কয়েকজন বায়ুরোগগ্রস্ত লোক দুর্যোধনকে বললে, আপনার এই যজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের তুল্য হয় নি। কেউ বললে, ষোল কলার এক কলাও হয় নি। সুহৃদগণ বললেন, এই যজ্ঞ সকল যজ্ঞকে অতিক্রম করেছে। কর্ণ বললেন, রাজা, পাণ্ডবরা যুদ্ধে বিনষ্ট হ’লে তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করবে। আমি যা বলছি শোন— যত দিন অর্জুন নিহত না হবে তত দিন আমি পা ধোব না, মাংস খাব না, সুরাপান করব না, কেউ কিছু চাইলে ‘না’ বলব না।

  1. ঘোষ—গোপপল্লী বা বাথান যেখানে অনেক গরু রাখা হয়।
  2. বোধ হয় দুর্যোধনকে উত্তেজিত করার জন্য শকুনি বিদ্রূপ করছেন।