মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/মৃগস্বপ্নোদ্ভব- ও ব্রীহিদ্রৌণিক-পর্বাধ্যায়
॥ মৃগস্বপ্নোদ্ভব ও ব্রীহিদ্রৌণিক-পর্বাধ্যায়॥
৫০। যুধিষ্ঠিরের স্বপ্ন ― মুদ্গলের সিদ্ধিলাভ
একদা রাত্রিকালে যুধিষ্ঠির স্বপ্ন দেখলেন, মৃগগণ কম্পিতদেহে বাষ্পাকুলকণ্ঠে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁকে বলছে, মহারাজ, আমরা দ্বৈতবনের হতাবশিষ্ট মৃগ। আপনার অস্ত্রপটু বীর ভ্রাতারা আমাদের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছেন। আপনি দয়া করুন, যাতে আমরা বৃদ্ধি পেতে পারি। যুধিষ্ঠির দুঃখার্ত হয়ে বললেন, যা বললে তাই হবে। প্রভাতকালে তিনি স্বপ্নবৃত্তান্ত জানিয়ে ভ্রাতাদের বললেন, এখনও এক বৎসর আট মাস আমাদের মৃগমাংসভোজী হয়ে বনবাস করতে হবে। আমরা দ্বৈতবন ত্যাগ ক’রে আবার কাম্যকবনে যাব, সেখানে অনেক মৃগ আছে।
পাণ্ডবগণ কাম্যকবনে এলেন, সেখানে তাঁদের কষ্টকর বনবাসের একাদশ বর্ষ অতীত হ’ল। একদিন মহাযোগী ব্যাসদেব তাঁদের কাছে এলেন এবং উপদেশপ্রসঙ্গে এই উপাখ্যান বললেন।— কুরুক্ষেত্রে মুদ্গল নামে এক ধর্মাত্মা মুনি ছিলেন, তিনি কপোতের ন্যায় শিলোঞ্ছ[১] বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকানির্বাহ ও ব্রতাদি পালন করতেন। তিনি স্ত্রীপুত্রের সহিত পনর দিনে একদিন মাত্র খেতেন, প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় যাগ করতেন এবং অতিথিদের এক দ্রোণ[২] ব্রীহির (তণ্ডুলের) অন্ন দিতেন। যে অন্ন অবশিষ্ট থাকত তা অতিথি দেখলেই বৃদ্ধি পেত। একদিন দুর্বাসা ঋষি মুণ্ডিতমস্তকে দিগম্বর হয়ে কটুবাক্য বলতে বলতে উন্মত্তের ন্যায় উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে অন্ন দাও। মুদ্গল অন্ন দিলে দুর্বাসা সমস্ত ভোজন করলেন এবং গায়ে উচ্ছিষ্ট মেখে চ’লে গেলেন। এইরূপ পর পর ছবার পর্বদিনে এসে দুর্বাসা সমস্ত অন্ন খেয়ে গেলেন, মুদ্গল নির্বিকারমনে অনাহারে রইলেন। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার মহৎ দানের সংবাদ স্বর্গে ঘোষিত হয়েছে, তুমি সশরীরে সেখানে যাবে।
এই সময়ে এক দেবদূত বিচিত্র বিমান নিয়ে এসে মুদ্গলকে বললে, মুনি, আপনি পরমা সিদ্ধি লাভ করেছেন, এখন এই বিমানে উঠে স্বর্গে চলুন। মুদ্গল বললেন, স্বর্গবাসের গুণ আর দোষ কি আগে বল। দেবদূত বললে, যাঁরা ধর্মাত্মা জিতেন্দ্রিয় দানশীল, যাঁরা সম্মুখ সমরে নিহত, তাঁরাই স্বর্গবাসের অধিকারী। সেখানে ঈর্ষা শোক ক্লান্তি মোহ মাৎসর্য নেই। দেবগণ সাধ্যগণ মহর্ষিগণ প্রভৃতি সেখানে নিজ নিজ ধামে বাস করেন। তা ভিন্ন তেত্রিশ জন ঋভু আছেন, তাঁদের স্থান আরও উচ্চে, দেবতারাও তাঁদের পূজা করেন। আপনি দান ও তপস্যার প্রভাবে ঋভুগণের সম্পদ লাভ করেছেন। স্বর্গের গুণ আপনাকে বললাম, এখন দোষ শুনুন। স্বর্গে কৃতকর্মের ফলভোগ হয় কিন্তু নূতন কর্ম করা যায় না। সেখানে অপরের অধিকতর সম্পদ দেখে অসন্তোষ হয়, কর্মক্ষয় হ’লে আবার ধরাতলে পতন হয়।
মুদ্গল বললেন, বৎস দেবদূত, নমস্কার, তুমি ফিরে যাও, স্বর্গসুখ আমি চাই না। যে অবস্থায় মানুষ শোকদুঃখ পায় না, পতিতও হয় না, আমি সেই কৈবল্যের অন্বেষণ করব। দেবদূত চ’লে গেলে মুদ্গল শুদ্ধ জ্ঞানযোগ অবলম্বন ক’রে ধ্যানপরায়ণ হলেন এবং নির্বাণমুক্তিরূপ সিদ্ধি লাভ করলেন।
এই উপাখ্যান ব’লে এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিয়ে ব্যাসদেব নিজের আশ্রমে প্রস্থান করলেন।