মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/তীর্থযাত্রাপর্বাধ্যায়

॥তীর্থযাত্রাপর্বাধ্যায়॥

২০। যুধিষ্ঠিরাদির তীর্থযাত্রা

 অর্জুনের বিরহে বিষণ্ণ হয়ে পাণ্ডবগণ কাম্যকবন ত্যাগ করে অন্যত্র বাবার ইচ্ছা করলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ এসে দধিষ্ঠিরকে বললেন, ধার্মিকশ্রেষ্ঠ, তোমার কি প্রয়োজন বল। যুধিষ্ঠির প্রণাম ক’রে বললেন আপনি প্রসন্ন থাকায় আমার সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হয়েছে মনে করি। তীর্থ পর্যটনে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলে কি ফললাভ হয় তাই আপনি বলুন।

 বহু শত তীর্থের[] কথা সবিস্তারে বিবৃত করে নারদ বললেন, যে লোক যথারীতি তীর্থ পরিভ্রমণ করে সে শত অশ্বমেধ যজ্ঞেরও অধিক ফল পায়। এখানকার ঋষিগণ তোমার প্রতীক্ষা করছেন, লোমশ মুনিও আসছেন, তুমি এঁদের সঙ্গে তীর্থপর্যটন কর। নারদ চ’লে গেলে পুরোহিত ধৌম্যও বহু তীর্থের বর্ণনা করলেন। তার পর লোমশ মুনি এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বৎস, আমি একটি অতিশয় প্রিয় সংবাদ বলব, তোমরা শোন। আমি ইন্দ্রলোক থেকে আসছি, অর্জুন মহাদেবের নিকট ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র লাভ করেছেন, যম কুবের বরুণ ইন্দ্রও তাঁকে বিবিধ দিব্যাস্ত্র দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাবসুর পুত্র চিত্রসেনের নিকট নৃত্য গীত বাদ্য ও সামগান যথাবিধি শিখেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র তোমাকে এই কথা বলতে বলেছেন।—অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা শেষ হয়েছে, তিনি একটি মহৎ দেবকার্য সম্পাদন ক’রে শীঘ্র তোমাদের কাছে ফিরে যাবেন। আমি জানি যে সূর্য পুত্র কর্ণ সত্যপ্রতিজ্ঞ, মহোৎসাহী, মহাবল, মহাধনুর্ধর; কিন্তু তিনি এখন অর্জুনের ষোড়শাংশের একাংশের তুল্যও না। কর্ণের যে সহজাত কবচকে তোমরা ভয় কর তাও আমি হরণ করব। তোমার যে তীর্থযাত্রার অভিলাষ হয়েছে তার সম্বন্ধে এই ব্রহ্মর্ষি লোমশই তোমাকে উপদেশ দেবেন।

 এই বার্তা জানিয়ে লোমশ বললেন, ইন্দ্র আর অর্জুনের অনুরোধে আমি তোমার সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করব এবং সকল ভয় থেকে তোমাকে রক্ষা করব। যুধিষ্ঠির, তুমি লঘু[] হও, লঘু হ’লে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারবে।

 উপস্থিত সকল লোককে যুধিষ্ঠির বললেন, যে ব্রাহ্মণ ও যতিগণ ভিক্ষাভোজী, যাঁরা ক্ষুধা তৃষ্ণা পথশ্রম আর শীতের কষ্ট সইতে পারেন না, তাঁরা নিবৃত্ত হ’ন। যাঁরা মিষ্টভোজী, বিবিধ পক্কান্ন লেহ্য পেয় মাংস প্রভৃতি খেতে চান, যাঁরা পাচকের পিছনে পিছনে থাকেন, তাঁরাও আমার সঙ্গে যাবেন না। যাঁদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তাঁরাও নিবৃত্ত হ’ন। যেসকল পুরবাসী রাজভক্তির বশে আমার সঙ্গে এসেছেন, তাঁরা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যান, তিনিই সকলকে উপযুক্ত বৃত্তি দেবেন। যদি তিনি না দেন তবে আমার প্রীতির নিমিত্ত পাঞ্চালরাজ দেবেন। তখন বহু পুরবাসী দুঃখিতমনে হস্তিনাপুরে চ’লে গেলেন. ধৃতরাষ্ট্রও তাঁদের তুষ্ট করলেন।

 কাম্যকবনবাসী ব্রাহ্মণগণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমাদেরও তীর্থভ্রমণে নিয়ে চলুন, আপনাদের সঙ্গে না হলে আমরা যেতে পারব না। লোমশ ও ধৌম্যের মত নিয়ে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তার পর ব্যাস পর্বত ও নারদ ঋষি এসে স্বস্ত্যয়ন করলেন। তাঁদের প্রণাম করে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী অগ্রহায়ণ-পূর্ণিমার শেষে পুষ্যা-নক্ষত্রযোগে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিষ্ক্রান্ত হলেন। পাণ্ডবগণ চীর অজিন ও জটা ধারণ করে এবং অভেদ্য কবচ ও অশ্বে সজ্জিত হয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যগণ, চতুর্দশাধিক রথ পাচকগণ ও পরিচারকগণ তাঁদের সঙ্গে গেল।

২১। ইল্বল-বাতাপি ― অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা ― ভৃগুতীর্থ

 পাণ্ডবগণ নৈমিযারণ্য প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থ দর্শন করে অগস্ত্যের আশ্রম মণিমতী পুরীতে এলেন। লোমশ বললেন, পুরাকালে এখানে ইল্বল নামে এক দৈত্য বাস করত, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম বাতাপি। একদিন ইল্বল এক তপস্বী ব্রাহ্মণকে বললে, আমাকে একটি ইন্দ্রতুল্য পুত্র দিন। ব্রাহ্মণ তার প্রার্থনা পূর্ণ করলেন না। ইল্বল অতিশয় ক্রুদ্ধ হল এবং মায়াবলে বাতাপিকে ছাগ বা মেষে রূপান্তরিত ক’রে তার মাংস রেঁধে ব্রাহ্মণভোজন করাতে লাগল। ভোজনের পর ইল্বল তার ভ্রাতাকে উচ্চস্বরে ডাকত, তখন ব্রাহ্মণের পার্শ্ব ভেদ ক’রে বাতাপি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসত। দুরাত্মা ইল্বল এইরূপে বহু ব্রাহ্মণ হত্যা করলে।

 এই সময়ে অগস্ত্য মুনি একদিন দেখলেন, একটি গর্তের মধ্যে তাঁর পিতৃপুরুষগণ অধোমুখে ঝুলছেন। অগস্ত্যের প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, বংশলোপের সম্ভাবনায় আমরা এই অবস্থায় আছি; যদি তুমি সৎপুত্রের জন্ম দিতে পার তবে আমরা নরক থেকে মুক্ত হব, তুমিও সদ্‌গতি লাভ করবে। অগস্ত্য বললেন, পিতৃগণ, নিশ্চিত হ’ন, আমি আপনাদের অভিলাষ পূর্ণ করব।

 অগস্ত্য নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি সর্ব প্রাণীর শ্রেষ্ঠ অঙ্গের সমবায়ে এক অত্যুত্তমা স্ত্রী কল্পনা করলেন। সেই সময়ে বিদর্ভ দেশের রাজা সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন, তাঁর মহিষীর গর্ভ থেকে অগস্ত্যের সেই সংকল্পিত ভার্যা ভূমিষ্ঠ হলেন। সৌদামিনীর ন্যায় সুন্দরী সেই কন্যার নাম রাখা হ’ল লোপামুদ্রা। লোপামুদ্রা বিবাহযোগ্যা হ’লে অগস্ত্য বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনার কন্যা আমাকে দিন। অগস্ত্যকে কন্যাদান করতে রাজার ইচ্ছা হ’ল না, শাপের ভয়ে প্রত্যাখ্যান করতেও তিনি পারলেন না। মহিষীও নিজের মত বললেন না। তখন লোপামুদ্রা বললেন, আমার জন্য দুঃখ করবেন না, অগস্ত্যের হাতে আমাকে দিন। রাজা যথাবিধি কন্যা সম্প্রদান করলেন।

 বিবাহের পর অগস্ত্য তাঁর পত্নীকে বললেন, তোমার মহার্ঘ বসন ও আভরণ ত্যাগ কর। লোপামুদ্রা চীর বল্কল ও মৃগচর্ম ধারণ ক’রে পতির ন্যায় ব্রতচারিণী হলেন। অনেক দিন গঙ্গাদ্বারে কঠোর তপস্যার পর একদিন অগস্ত্য পত্নীর নিকট সহবাস প্রার্থনা করলেন। লোপামুদ্রা কৃতাঞ্জলি হয়ে লজ্জিতভাবে বললেন, পিতার প্রাসাদে আমার যেমন শয্যা ছিল সেইরূপ শয্যায় আমাদের মিলন হ’ক। আপনি মাল্য ও ভূষণ ধারণ করুন, আমিও দিব্য আভরণে ভূষিত হই। আমি চীর আর কাষায় বস্ত্র প’রে আপনার কাছে যাব না, এই পরিচ্ছদ অপবিত্র করা উচিত নয়। অগস্ত্য বললেন, কল্যাণী, তোমার পিতার যে ধন আছে তা আমার নেই। আমার তপস্যার যাতে ক্ষয় না হয় এমন উপায়ে আমি ধন আহরণ করতে যাচ্ছি।

 শ্রুতর্বা রাজার কাছে এসে অগস্ত্য বললেন, আমি ধনার্থী, অন্যের ক্ষতি না করে আমাকে যথাশক্তি ধন দিন। রাজা বললেন, আমার যত আয় তত ব্যয়। এই রাজার কাছে ধন নিলে অপরের কষ্ট হবে এই বুঝে অগস্ত্য শ্রুতর্বাকে সঙ্গে নিয়ে একে একে ব্রধ্ণশ্ব ও ত্রসদস্যু রাজার কাছে গেলেন। তাঁরা জানালেন যে তাঁদেরও আয়-ব্যয় সমান, উদ্‌বৃত্ত কিছু থাকে না। তার পর রাজারা পরামর্শ ক’রে বললেন, ইল্বল দানব সর্বাপেক্ষা ধনী, চলুন আমরা তার কাছে যাই!

 অগস্ত্য ও তাঁর সঙ্গী তিন রাজাকে ইল্বল সসম্মানে গ্রহণ করলে। রাজারা ব্যাকুল হয়ে দেখলেন, বাতাপি মেষ হয়ে গেল, ইল্বল তাকে কেটে অতিথিসেবার জন্য রন্ধন করলে। অগস্ত্য বললেন, আপনারা বিষণ্ণ হবেন না, আমিই এই অসুরকে খাব। তিনি প্রধান আসনে উপবিষ্ট হ’লে ইল্বল তাঁকে সহাস্যে মাংস পরিবেশন করলে। অগস্ত্য সমস্ত মাংস খেয়ে ফেললে ইল্বল তার ভ্রাতাকে ডাকতে লাগল। তখন মহামেঘের ন্যায় গর্জন করে মহাত্মা অগস্ত্যের অধোদেশ থেকে বায়ু, নির্গত হ’ল। ইল্বল বার বার বললে, বাতাপি, নিষ্ক্রান্ত হও। অগস্ত্য হেসে বললেন, কি করে নিষ্ক্রান্ত হবে, আমি তাকে জীর্ণ করে ফেলেছি।

 ইল্বল বিষাদগ্রস্ত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে বললে, আপনারা কি চান বলুন। অগস্ত্য বললেন, আমরা জানি যে তুমি মহাধনী। অন্যের ক্ষতি না করে আমাদের যথাশক্তি ধন দাও। ইল্বল বললে, আমি যা যা দান করতে চাই তা যদি বলতে পারেন তবেই দেব। অগস্ত্য বললেন, তুমি এই রাজাদের প্রত্যেককে দশ হাজার গরু আর দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং আমাকে তার দ্বিগুণ দিতে চাও, তা ছাড়া একটি হিরণ্ময় রথ ও দুই অশ্বও আমাকে দিতে ইচ্ছা করেছ। ইল্বল দুঃখিতমনে এই সকল ধন এবং তারও অধিক দান করলে। তখন সমস্ত ধন নিয়ে অগস্ত্য তাঁর আশ্রমে এলেন, রাজারাও বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন।

 লোপামুদ্রাকে তাঁর অভীষ্ট শয্যা ও বসনভূষণাদি দিয়ে অগস্ত্য বললেন, তুমি কি চাও — সহস্র পুত্র, শত পুত্র, দশ পুত্র, না সহস্র পুত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এক পুত্র? লোপামুদ্রা এক পুত্র চাইলেন। তিনি গর্ভবতী হয়ে সাত মাস পরে দৃঢ়স্যু নামে পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র মহাকবি মহাতপা এবং বেদাদি শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়েছিলেন। এঁর অন্য নাম ইধ্ণবাহ।

 উপাখ্যান শেষ করে লোমশ বললেন, যুধিষ্ঠির, অগস্ত্য এইরূপে প্রহ্লাদবংশজাত বাতাপিকে বিনষ্ট করেছিলেন। এই তাঁর আশ্রম। এই পুণ্যসলিলা ভাগীরথী, পতাকার ন্যায় বায়ুতে আন্দোলিত এবং পর্বতশৃঙ্গে প্রতিহত হয়ে শিলাতলে নাগিনীর ন্যায় নিপতিত হচ্ছেন। তোমরা এই নদীতে ইচ্ছানুসারে অবগাহন কর।

 তার পর পাণ্ডবগণ ভৃগুতীর্থে এলে লোমশ বললেন, পুরাকালে রামরূপে বিষ্ণু ভার্গব পরশুরামের তেজোহরণ করেছিলেন। পরশুরাম ভীত ও লজ্জিত হয়ে মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে পিতৃগণ তাঁকে নিস্তেজ গর্বহীন ও দুঃখিত দেখে বললেন, পুত্র, বিষ্ণুর নিকটে তোমার দর্পপ্রকাশ উচিত হয় নি। তুমি দীপ্তোদ তীর্থে যাও, সেখানে সত্যযুগে তোমার প্রপিতামহ ভৃগু তপস্যা করেছিলেন। সেই তীর্থে পবিত্র বধূসর নদীতে স্নান করলে তোমার পূর্বের তেজ ফিরে পাবে। পিতৃগণের উপদেশ অনুসারে পরশুরাম এই ভৃগুতীর্থে স্নান ক’রে তাঁর পূর্বতেজ লাভ করেছিলেন।

২২। দধীচ ― বৃত্রবধ ― সমুদ্রশোষণ

 যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে লোমশ অগস্ত্যের কীর্তিকথা আরও বললেন।— সত্যযুগে কালেয় নামে এক দল দুর্দান্ত দানব ছিল, তারা বৃত্রাসুরের সহায়তায় দেবগণকে আক্রমণ করে। ব্রহ্মার উপদেশে দেবগণ নারায়ণকে অগ্রবর্তী ক’রে দধীচ মুনির কাছে গেলেন এবং চরণ বন্দনা ক’রে তাঁর অস্থি প্রার্থনা করলেন। দধীচ প্রীতমনে তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন, দেবগণ তাঁর অস্থি নিয়ে বিশ্বকর্মাকে দিলেন। সেই অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্মা ভীমরূপ বজ্র নির্মাণ করলেন। ইন্দ্র সেই বজ্র ধারণ করে দেবগণ কর্তৃক রক্ষিত হয়ে বৃত্রকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু দেবতারা কালেয় দানবদের বেগ সইতে পারলেন না, রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করলেন। তখন মোহাবিষ্ট ইন্দ্রের বলবৃদ্ধির জন্য নারায়ণ ও মহর্ষিগণ নিজ নিজ তেজ দিলেন। দেবরাজ বলান্বিত হয়েছেন জেনে বৃত্র ভয়ংকর সিংহনাদ করে উঠল, সেই শব্দে সন্ত্রস্ত হয়ে ইন্দ্র অবশভাবে বজ্র নিক্ষেপ করলেন। মহাসুর বৃত্র নিহত হয়ে মন্দর পর্বতের ন্যায় ভূপতিত হ’ল। তার পর দেবতারা ত্বরিত হয়ে দৈত্যদের বধ করতে লাগলেন, তারা পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রগর্ভে আশ্রয় নিলে।

 কালেয় দানবগণ রাত্রিকালে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসে তপস্বী ব্রাহ্মণদের বধ করতে লাগল। বিষ্ণুর উপদেশে ইন্দ্রাদি দেবগণ অগস্ত্যের কাছে গিয়ে বললেন, আপনি মহাসমুদ্র পান ক’রে ফেলুন, তা হলে আমরা কালেয়গণকে বধ করতে পারব। অগস্ত্য সম্মত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ফেনময় তরঙ্গায়িত জলজন্তুসমাকুল সমুদ্রের তীরে এলেন এবং জলরাশি পান করলেন। দেবতারা দানবদের বধ করলেন, হতাবশিষ্ট কয়েকজন কালেয় বসুধা বিদীর্ণ ক’রে পাতালে আশ্রয় নিলে। অনন্তর দেবগণ অগস্ত্যকে বললেন, আপনি যে জল পান করেছেন তা উদ্‌গার ক’রে সমুদ্র আবার পূর্ণ করুন। অগস্ত্য বললেন, সে জল জীর্ণ হয়ে গেছে, তোমরা অন্য ব্যবস্থা কর। তখন ব্রহ্মা দেবগণকে আশ্বাস দিলেন বহুকাল পরে মহারাজ ভগীরথ সমুদ্রকে আবার জলপূর্ণ করবেন।

 একদা বিন্ধ্যপর্বত সূর্যকে বললে, উদয় ও অস্তের সময় তুমি যেমন মেরু পর্বত প্রদক্ষিণ কর সেইরূপ আমাকেও প্রদক্ষিণ কর। সূর্য বললেন, আমি স্বেচ্ছায় মেরু প্রদক্ষিণ করি না, এই জগতের যিনি নির্মাতা তাঁরই বিধানে করি। বিন্ধ্য ক্রুদ্ধ হয়ে সহসা বাড়তে লাগল, যাতে চন্দ্রসূর্যের পথরোধ হয়। দেবতারা অগস্ত্যের শরণ নিলেন। অগস্ত্য তাঁর পত্নীর সঙ্গে বিন্ধ্যের কাছে গিয়ে বললেন, আমি কোনও কার্যের জন্য দক্ষিণ দিকে যাব, তুমি আমাকে পথ দাও। আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা কর, তার পর ইচ্ছামত বর্ধিত হয়ো। অগস্ত্য দক্ষিণদিকে চ’লে গেলেন, কিন্তু আর ফিরলেন না, সেজন্য বিন্ধ্যপর্বতেরও আর বৃদ্ধি হ’ল না।

২৩। সগর রাজা ― ভগীরথের গঙ্গানয়ন

 যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে লোমশ এই আখ্যান বললেন।— ইক্ষ্বাকুবংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি পত্নীদের সঙ্গে কৈলাস পর্বতে গিয়ে পুত্রকামনায় কঠোর তপস্যা করেন। মহাদেবের বরে তাঁর এক পত্নীর গর্ভে ষাট হাজার পত্র এবং আর এক পত্নীর গর্ভে একটি পুত্র হল। বহুকাল পরে সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞের অশ্ব সগরের ষাট হাজার পুত্র কর্তৃক রক্ষিত হয়ে বিচরণ করতে করতে জলশূন্য সমুদ্রের তীরে এসে অন্তর্হিত হয়ে গেল। এই সংবাদ শুনে সগর তাঁর পুত্রদের আদেশ দিলেন, তোমরা সকলে সকল দিকে অপহৃত অশ্বের অন্বেষণ কর। সগরপুত্রগণ যজ্ঞাশ্ব কোথাও না পেয়ে সমুদ্র খনন করতে লাগলেন, অসুর নাগ রাক্ষস এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রাণী নিহত হ’ল। অবশেষে তাঁরা সমুদ্রের উত্তরপূর্ব দেশ বিদীর্ণ ক’রে পাতালে গিয়ে সেই অশ্ব এবং তার নিকটে তেজোরাশির ন্যায় দীপ্যমান মহাত্মা কপিলকে দেখতে পেলেন। সগরপত্রগণ চোর মনে ক’রে কপিলের প্রতি সক্রোধে ধাবিত হলেন, কিন্তু তাঁর দৃষ্টির তেজে তখনই ভস্ম হয়ে গেলেন।

 সগর রাজার দ্বিতীয়া পত্নী শৈব্যার গর্ভে জাত পুত্রের নাম অসমঞ্জা। ইনি দুর্বল বালকদের ধ’রে ধ’রে নদীতে ফেলে দিতেন সেজন্য সগর তাঁকে নির্বাসিত করেন। অসমঞ্জার পুত্রের নাম অংশুমান। নারদের নিকট ষাট হাজার পত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে সগর শোকে সন্তপ্ত হয়ে পৌত্র অংশুমানকে বললেন, তুমি যজ্ঞাশ্ব খুঁজে নিয়ে এসে আমাদের নরক থেকে উদ্ধার কর। অংশুমান পাতালে গিয়ে কপিলকে প্রণাম ক’রে যজ্ঞাশ্ব ও পিতৃব্যগণের তর্পণের জন্য জল চাইলেন। কপিল প্রসন্ন হয়ে বললেন, তুমি অশ্ব নিয়ে গিয়ে সগরের যজ্ঞ সমাপ্ত কর। তোমার পিতৃব্যগণের উদ্ধারের জন্য তোমার পৌত্র মহাদেবকে তুষ্ট ক’রে স্বর্গ থেকে গঙ্গা আনবেন।

 অংশুমান ফিরে এলে সগরের যজ্ঞ সমাপ্ত হল, তিনি সমুদ্রকে নিজের পুত্ররূপে[] কল্পনা করলেন। সগর স্বর্গারোহণ করলে অংশুমান রাজা হলেন। তাঁর পুত্র দিলীপ, দিলীপের পুত্র ভগীরথ। ভগীরথ রাজ্যলাভ করে মন্ত্রীদের উপর রাজকার্যের ভার দিয়ে হিমালয়ে গিয়ে গঙ্গার আরাধনা করতে লাগলেন। সহস্র দিব্য বৎসর অতীত হ’লে গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে দেখা দিলেন। ভগীরথ তাঁকে বললেন, আমার পূর্বপুরুষ ষাট হাজার সগরপুত্র কপিলের শাপে ভস্মীভূত হয়েছেন, আপনি তাঁদের দেহাবশেষ জলসিক্ত করুন তবে তাঁরা স্বর্গে যেতে পারবেন। গঙ্গা বললেন, মহারাজ, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করব, এখন তুমি মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট ক’রে এই বর চাও, যেন পতনকালে আমাকে তিনি মস্তকে ধারণ করেন। ভগীরথ কৈলাস পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করলেন, মহাদেব গঙ্গাকে ধারণ করতে সম্মত হলেন।

 ভগীরথ প্রণত হয়ে সংযতচিত্তে গঙ্গাকে স্মরণ করলেন। হিমালয় কন্যা পুণ্যতোয়া গঙ্গা মৎস্যাদি জলজন্তু সহিত গগনমেখলার ন্যায় মহাদেবের ললাটে পতিত হলেন এবং ত্রিধা বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হ’তে লাগলেন। ভগীরথ তাঁকে পথ দেখিয়ে সগরসন্তানগণের ভস্মরাশির নিকট নিয়ে গেলেন। গঙ্গার পবিত্র জলে সিক্ত হয়ে সগরসন্তানগণ উদ্ধার লাভ করলেন, সমুদ্র পুনর্বার জলপূর্ণ হ’ল, ভগীরথ গঙ্গাকে নিজ দুহিতারূপে কল্পনা করলেন।

২৪। ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান

 পাণ্ডবগণ নন্দা ও অপরনন্দা নদী এবং ঋযভকূট পর্বত অতিক্রম ক’রে কৌশিকী নদীর তীরে এলেন। লোমশ বললেন, ওই বিশ্বামিত্রের আশ্রম দেখা যাচ্ছে। কশ্যপগোত্রজ মহাত্মা বিভাণ্ডকের আশ্রমও এইখানে ছিল। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যার প্রভাবে ইন্দ্র অনাবৃষ্টির কালেও জলবর্ষণ করেছিলেন। তাঁর আখ্যান বলছি শোন।—

 একদিন বিভাণ্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্রান্ত হয়ে কোনও মহাহ্রদে স্নান করছিলেন এমন সময় উর্বশী অপ্সরাকে দেখে তিনি কামাবিষ্ট হলেন। তৃষিতা হরিণী জলের সঙ্গে বিভাণ্ডকের শুক্র পান ক’রে গর্ভিণী হ’ল এবং যথাকালে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসব করলে। এই মুনিকুমারের মস্তকে একটি শৃঙ্গ ছিল, তিনি সর্বদা ব্রহ্মচর্যে নিরত থাকতেন এবং পিতা বিভাণ্ডক ভিন্ন অন্য মানুষেও দেখেন নি। এই সময়ে অঙ্গদেশে লোমপাদ নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি দশরথের সখা। আমরা শুনেছি, লোমপাদ ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের প্রতি অসদাচরণ করেছিলেন সেজন্য ব্রাহ্মণগণ তাঁকে ত্যাগ করেন এবং ইন্দ্রও জলবর্ষণে বিরত হন, তার ফলে প্রজারা কষ্টে পড়ে। একজন মুনি রাজাকে বললেন, আপনি প্রায়শ্চিত্ত ক’রে ব্রাহ্মণদের কোপ শান্ত করুন এবং মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনান, তিনি আপনার রাজ্যে এলে তখনই বৃষ্টিপাত হবে।

 লোমপাদ প্রায়শ্চিত্ত ক’রে ব্রাহ্মণদের প্রসন্ন করলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকে আনাবার জন্য শাস্ত্রজ্ঞ কর্মকুশল মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তিনি প্রধান প্রধান বেশ্যাদের ডেকে আনিয়ে বললেন, তোমরা ঋষ্যশঙ্গকে প্রলোভিত ক’রে আমার রাজ্যে নিয়ে এস। বেশ্যারা ভীত হয়ে জানালে যে তা অসাধ্য। তখন এক বৃদ্ধবেশ্যা বললে, মহারাজ, আমি সেই তপোধনকে নিয়ে আসব, আমার যা যা আবশ্যক তা আমাকে দিন। রাজার নিকট সমস্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ও ধনরত্নাদি পেয়ে সেই বৃদ্ধবেশ্যা একটি নৌকায় কৃত্রিম বৃক্ষ গুল্ম লতা ও পুষ্পফল দিয়ে সাজিয়ে রমণীয় আশ্রম নির্মাণ করলে এবং কয়েকজন রূপযৌবনবতী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের অদূরে এসে নৌকা বাঁধলে।

 বিভাণ্ডক তাঁর আশ্রমে নেই জেনে নিয়ে সেই বৃদ্ধা তার বুদ্ধিমতী কন্যাকে উপদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলে। বেশ্যাকন্যা ঋষ্যশঙ্গের কাছে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বললে, আপনারা এই আশ্রমে সুখে আছেন তো? ফলমূলের অভাব নেই তো? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আপনাকে জ্যোতিঃপুঞ্জের ন্যায় দেখছি, আপনি আমার বন্দনীয়, পাদ্য ফল মূল দিয়ে আমি আপনার যথাবিধি সৎকার করব। এই কৃষ্ণাজিনাবৃত সুখাসনে সুখে উপবেশন করুন। আপনার আশ্রম কোথায়? আপনি দেবতার ন্যায় কোন্ ব্রত আচরণ করছেন?

 বেশ্যাকন্যা বললে, এই ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের অপর দিকে আমার রমণীয় আশ্রম আছে। আমার স্বধর্ম এই, যে আমি অভিবাদন বা পাদ্য জল গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমাকে অভিবাদন করবেন না, আমিই করব, আমার ব্রত অনুসারে আপনাকে আলিঙ্গন করব। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আমি আপনাকে পক্ক ভল্লাতক আমলক করুষক ইঙ্গুদ ধন্বন ও প্রিয়লক ফল দিচ্ছি, আপনি ইচ্ছানুসারে ভোজন করুন। বেশ্যাকন্যা উপহৃত ফলগুলি বর্জন ক’রে ঋষ্যশৃঙ্গকে মহামূল্য সুন্দর সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য, সুগন্ধ মাল্য, বিচিত্র উজ্জ্বল বসন এবং উত্তম পানীয় দিলে, তার পর নানাপ্রকার খেলা ও হাস্যপরিহাসে রত হ’ল। সে লতার ন্যায় বক্র হয়ে কন্দুক নিয়ে খেলতে লাগল এবং ঋষ্যশৃঙ্গের গায়ে গা দিয়ে বার বার আলিঙ্গন করলে। মুনিকুমারকে এইরূপে প্রলোভিত ক’রে এবং তাঁকে বিকারগ্রস্ত দেখে সে অগ্নিহোত্র-হোম করবার ছলে ধীরে ধীরে চ’লে গেল।

 ঋষ্যশৃঙ্গ মদনাবিষ্ট হয়ে অচেতনের ন্যায় শূন্যমনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরে বিভাণ্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। তাঁর চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, নখের অগ্রভাগ থেকে সমস্ত গাত্র রোমাবৃত। পুত্রকে বিহ্বল দেখে তিনি বললেন, বৎস, তোমাকে পূর্বের ন্যায় দেখছি না, তুমি চিন্তামগ্ন অচেতন ও কাতর হয়ে আছ কেন? কে এখানে এসেছিল? ঋষ্যশৃঙ্গ উত্তর দিলেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারী এসেছিলেন, তিনি আকারে অধিক দীর্ঘ নন, খর্বও নন, তাঁর বর্ণ সুবর্ণের ন্যায়, চক্ষু পদ্মপলাশতুল্য আয়ত, তিনি দেবপুত্রের ন্যায় সুন্দর। তাঁর জটা দীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধ এবং স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত। আকাশে বিদ্যুতের ন্যায় তাঁর কণ্ঠে কি এক বস্তু দুলছে, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড আছে। তাঁর কটি পিপীলিকার মধ্যভাগের ন্যায় ক্ষীণ, পরিধেয় চীরবসনের ভিতরে সুবর্ণ মেখলা দেখা যাচ্ছিল। আমার এই জপমালার ন্যায় তাঁর চরণে ও হস্তে শব্দকারী আশ্চর্য মালা আছে। তাঁর পরিধেয় অতি অদ্ভুত, আমার চীরবসনের মতন নয়। তাঁর মুখ সুন্দর, কণ্ঠস্বর কোকিলের তুল্য, তাঁর বাক্য শুনলে আনন্দ হয়। তিনি তাঁর ডান হাত দিয়ে একটি গোলাকার ফলকে বার বার আঘাত করছিলেন, সেই ফলটি ভূমি থেকে লাফিয়ে উঠছিল। সেই দেবপুত্রের উপর আমার অত্যন্ত অনুরাগ হয়েছে, তিনি আমাকে আলিঙ্গন ক’রে আমার জটা ধরে মুখে মুখে ঠেকিয়ে একপ্রকার শব্দ করলেন, তাতে আমার হর্ষ হ’ল। তিনি যেসব ফল আমাকে খেতে দিয়েছিলেন তার ত্বক আর বীজ নেই, আমাদের আশ্রমের ফল তেমন নয়। তাঁর প্রদত্ত সুস্বাদু জল পান ক’রে আমার অত্যন্ত আনন্দ হ’ল, বোধ হল যেন পৃথিবী ঘুরছে। এইসকল বিচিত্র সুগন্ধ মালা তিনি ফেলে গেছেন, তাঁর বিরহে আমি অসুখী হয়েছি, আমার গাত্র যেন দগ্ধ হচ্ছে। পিতা, আমি তাঁর কাছে যেতে চাই, তাঁর ব্রহ্মচর্য কি প্রকার? আমি তাঁর সঙ্গেই তপস্যা করব।

 বিভাণ্ডক বললেন, ওরা রাক্ষস, অদ্ভুত রূপ ধারণ ক’রে তপস্যার বিঘ্ন জন্মায়, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও তপম্বীদের উচিত নয়। পুত্র, অসৎ লোকেই সুরাপান করে, মুনিদের তা পান করা অনুচিত, আর এই সকল মাল্যও আমাদের অব্যবহার্য।

 ওরা রাক্ষস, এই ব’লে পত্রকে নিবারণ ক’রে বিভাণ্ডক বেশ্যাকে খুঁজতে গেলেন, কিন্তু তিন দিনেও না পেয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। তার পর যখন তিনি ফল আহরণ করতে গেলেন তখন বেশ্যাকন্যা আবার আশ্রমে এল। ঋষ্যশৃঙ্গ হৃষ্ট ও ব্যস্ত হয়ে তাকে বললেন, আমার পিতা ফিরে আসবার আগেই আমরা আপনার আশ্রমে যাই চলুন। বেশ্যা তাঁকে নৌকায় নিয়ে গেল এবং বিবিধ উপায়ে তাঁকে প্রলোভিত ক’রে অঙ্গদেশের অভিমুখে যাত্রা করলে। নৌকা যেখানে উপস্থিত হ’ল তার তীরদেশে লোমপাদ এক বিচিত্র আশ্রম নির্মাণ করলেন। রাজা ঋষ্যশৃঙ্গকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ামাত্র দেবরাজ প্রচুর বৃষ্টিপাত করলেন। অঙ্গরাজের কামনা পূর্ণ হ’ল, তিনি তাঁর কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের হস্তে সম্প্রদান করলেন!

 বিভাণ্ডক আশ্রমে ফিরে এসে পুত্রকে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। লোমপাদের আজ্ঞায় এই কার্য হয়েছে এইরূপ অনুমান করে তিনি অঙ্গরাজধানী চম্পার অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে তিনি এক গোপপল্লীতে এলে গোপগণ তাঁকে যথোচিত সংস্কার করলে, বিভাণ্ডক রাজার ন্যায় সুখে রাত্রিবাস করলেন। তিনি তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলেন, গোপগণ, তোমরা কার প্রজা? লোমপাদের শিক্ষা অনুসারে তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে উত্তর দিলে, মহর্ষি, এইসব পশু ও কৃষিক্ষেত্র আপনার পুত্রের অধিকারভুক্ত। এইরূপে সম্মান পেয়ে এবং মিষ্ট বাক্য শুনে বিভাণ্ডকের ক্রোধ দূর হ’ল, তিনি রাজধানীতে এসে লোমপাদ কর্তৃক পূজিত হয়ে এবং পত্র-পত্রবধূকে দেখে তুষ্ট হলেন। বিভাণ্ডকের আজ্ঞায় ঋষ্যশৃঙ্গ কিছুকাল অঙ্গরাজ্যে রইলেন এবং পুত্রজন্মের পর আবার পিতার আশ্রমে ফিরে গেলেন।

২৫। পরশুরামের ইতিহাস ― কার্তবীর্যার্জুন

 পাণ্ডবগণ কৌশিকী নদীর তটদেশ থেকে যাত্রা ক’রে গঙ্গাসাগরসংগম, কলিঙ্গদেশস্থ বৈতরণী নদী প্রভৃতি তীর্থ দেখে মহেন্দ্র পর্বতে এলেন। যুধিষ্ঠির পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণকে বললেন, ভগবান পরশুরাম কখন তপস্বীদের দর্শন দেন? আমি তাঁকে দেখতে ইচ্ছা করি। অকৃতব্রণ বললেন, আপনার আগমন তিনি জানেন, শীঘ্রই তাঁর দেখা পাবেন। চতুর্দশী ও অষ্টমী তিথিতে তিনি দেখা দেন, এই রাত্রি অতীত হ’লেই চতুর্দশী পড়বে। তার পর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অকৃতব্রণ পরশুরামের এই ইতিহাস বললেন।—

 হৈহয়রাজ কার্তবীর্যের সহস্র বাহু ছিল, মহর্ষি দত্রাত্রেয়র বরে তিনি স্বর্ণময় বিমান এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর উপর আধিপত্য লাভ করেছিলেন। তাঁর উপদ্রবে পীড়িত হয়ে দেবগণ ও ঋষিগণ বিষ্ণুকে বললেন, আপনি কার্তবীর্যকে বধ ক’রে প্রাণীদের রক্ষা করুন। বিষ্ণু সম্মত হয়ে তাঁর স্বকীয় আশ্রম বদরিকায় গেলেন। এই সময়ে খ্যাতনামা মহাবল গাধি কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন, তাঁর অপ্সরার ন্যায় রূপবতী একটি কন্যা ছিল। ভৃগুপুত্র ঋচীক সেই কন্যাকে চাইলে গাধি বললেন, কৌলিক রীতি রক্ষা করা আমার কর্তব্য, আপনি যদি শুল্ক স্বরূপ আমাকে এক সহস্র দ্রুতগামী অশ্ব দেন যাদের কর্ণের এক দিক শ্যামবর্ণ এবং দেহ পাণ্ডুবর্ণ, তবে কন্যা দান করতে পারি। ঋচীক বরুণের নিকট ওইরূপ সহস্র অশ্ব চেয়ে নিয়ে গাধিকে দিলেন এবং তাঁর কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করলেন।

 একদিন সপত্নীক মহর্ষি ভৃগু তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূকে দেখতে এলেন। ভৃগু হৃষ্ট হয়ে বধূকে বললেন, সৌভাগ্যবতী, তুমি বর চাও। সত্যবতী নিজের এবং তাঁর মাতার জন্য পুত্র চাইলেন। ভৃগু বললেন, ঋতুস্নানের পর তোমার মাতা অশ্বত্থ বৃক্ষকে আলিঙ্গন করবেন, তুমি উডুম্বর বৃক্ষকে করবে, এবং দুজনে এই দুই চরু ভক্ষণ করবে। সত্যবতী ও তাঁর মাতা (গাধির মহিষী) বৃক্ষ আলিঙ্গন ও চরু ভক্ষণে বিপর্যয় করলেন। ভৃগু তা দিব্যজ্ঞানে জানতে পেরে সত্যবতীকে বললেন, তোমরা বিপরীত কার্য করেছ, তোমার মাতাই তোমাকে বঞ্চনা করেছেন। তোমার পুত্র ব্রাহণ হ’লেও বৃত্তিতে ক্ষত্রিয় হবে, তোমার মাতার পুত্র ক্ষত্রিয় হ’লেও আচারে ব্রাহ্মণ হবে। সত্যবতী বার বার অনুনয় করলেন, আমার পুত্র যেন ক্ষত্রিয়াচারী না হয়, বরং আমার পৌত্র সেইরূপ হ’ক। ভৃগু বললেন, তাই হবে। জমদগ্নি নামে খ্যাত এই পুত্র কালক্রমে সমগ্র ধনুর্বেদ ও অস্ত্রপ্রয়োগবিধি আয়ত্ত করলেন। তাঁর সঙ্গে রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকার বিবাহ হ’ল। রেণুকার পাঁচ পুত্র, তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠ রাম (বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম) গুণে শ্রেষ্ঠ।

 একদিন রেণুকা স্নান করতে গিয়ে দেখলেন, মার্তিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথ তাঁর পত্নীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করছেন। চিত্তবিকারের জন্য বিহ্বল ও ত্রস্ত হয়ে রেণুকা আর্দ্রদেহে আশ্রমে ফিরে এলেন। পত্নীকে অধীর ও ব্রাহ্মীশ্রীবর্জিত দেখে জমদগ্নি ধিক্‌কার দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন এবং তাঁকে হত্যা করবার জন্য পুত্রদের একে একে আজ্ঞা দিলেন। মাতৃস্নেহে অভিভূত হয়ে চার পুত্র নীরবে রইলেন। জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের অভিশাপ দিলেন, তাঁরা পশুপক্ষীর ন্যায় জড়বুদ্ধি হয়ে গেলেন। তার পর পরশুরাম আশ্রমে এলে জমদগ্নি তাঁকে বললেন, পুত্র, দুশ্চরিত্রা মাতাকে বধ কর, ব্যথিত হয়ো না। পরশুরাম কুঠার দিয়ে তাঁর মাতার শিরশ্ছেদ করলেন। জমদগ্নি প্রসন্ন হয়ে বললেন, বৎস, আমার আজ্ঞায় তুমি দুষ্কর কর্ম করেছ, তোমার বাঞ্ছিত বর চাও। পরশরাম এই বর চাইলেন— মাতা জীবিত হয়ে উঠুন, তাঁর হত্যার স্মৃতি যেন না থাকে, আমার যেন পাপস্পর্শ না হয়, আমার ভ্রাতারা যেন তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান, আমি যেন যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হই, এবং দীর্ঘায়ু লাভ করি। জমদগ্নি এই সকল বর দিলেন।

 একদিন জমদগ্নির পুত্রগণ অন্যত্র গেলে রাজা কার্তবীর্য আশ্রমে এসে সবলে হোমধেনুর বৎস হরণ করলেন এবং আশ্রমের বৃক্ষসকল ভগ্ন করলেন। পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতার নিকট সমস্ত শুনে কার্তবীর্যের প্রতি ধাবিত হলেন এবং তীক্ষ্ণ ভল্লের আঘাতে তাঁর সহস্র বাহু ছেদন ক’রে তাঁকে বধ করলেন। তখন কার্তবীর্যের পুত্রগণ আশ্রমে এসে জমদগ্নিকে আক্রমণ করলেন। তিনি তপোনিষ্ঠ ছিলেন সেজন্য মহাবলশালী হয়েও যুদ্ধ করলেন না, অনাথের ন্যায় ‘রাম রাম’ ব’লে পুত্রকে ডাকতে লাগলেন। কার্তবীর্যের পুত্রগণ তাঁকে বধ ক’রে চ’লে গেলেন।

 পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতাকে নিহত দেখে বহু বিলাপ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন ক’রে একাকীই কার্তবীর্যের পুত্র ও অনুচরগণকে যুদ্ধে বিনষ্ট করলেন। তিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করে সমন্তপঞ্চক প্রদেশে পাঁচটি রুধিরময় হ্রদ সৃষ্টি করে পিতৃগণের তর্পণ করলেন। অবশেষে পিতামহ ঋচীকের অনুরোধে তিনি ক্ষত্রিয়হত্যা থেকে নিবৃত্ত হলেন এবং এক মহাযজ্ঞ সম্পন্ন ক’রে মহাত্মা কশ্যপকে একটি প্রকাণ্ড স্বর্ণময় বেদী দান করলেন। কশ্যপের অনুমতিক্রমে ব্রাহ্মণগণ সেই বেদী খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে নিলেন, সেজন্য তাঁদের নাম খাণ্ডবায়ন হ’ল। তার পর ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দান করলেন। তদবধি তিনি এই মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।

 চতুর্দশী তিথিতে মহাত্মা পরশুরাম পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণদের দর্শন দিলেন। তাঁর অনুরোধে যুধিষ্ঠির এক রাত্রি মহেন্দ্র পর্বতে বাস করে পরদিন দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন।

২৬। প্রভাস ―চ্যবন ও সুকন্যা ― অশ্বিনীকুমারদ্বয়

 পাণ্ডবগণ গোদাবরী নদী, দ্রবিড় দেশ, অগস্ত্য তীর্থ, সূর্পারক তীর্থ প্রভৃতি দর্শন ক’রে সুবিখ্যাত প্রভাসতীর্থে— উপস্থিত হলেন। তাঁদের আগমনের সংবাদ পেয়ে বলরাম ও কৃষ্ণ সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। পাণ্ডবগণ ভূমিতে শয়ন করেন, তাঁদের গাত্র মলিন, এবং সুকুমারী দ্রৌপদীও কষ্টভোগ করছেন দেখে সকলে অতিশয় দুঃখিত হলেন। বলরাম কৃষ্ণ প্রদ্যুম্ন শাম্ব সাত্যকি প্রভৃতি

বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ যুধিষ্ঠির কর্তৃক যথাবিধি সম্মানিত হয়ে তাঁকে বেষ্টন ক’রে উপবেশন করলেন।

 গোদুগ্ধ কুন্দপুষ্প ইন্দু মৃণাল ও রজতের ন্যায় শুভ্রবর্ণ বলরাম বললেন, ধর্মাচরণ করলেই মঙ্গল হয় না, অধর্ম করলেই অমঙ্গল হয় না। মহাত্মা যুধিষ্ঠির জটা ও চীর ধারণ ক’রে বনবাসী হয়ে ক্লেশ পাচ্ছেন, আর দুর্যোধন পৃথিবী শাসন করছেন, এই দেশে অল্পবুদ্ধি লোকে মনে করবে ধর্মের চেয়ে অধর্মের আচরণই ভাল। ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ ও ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে তাঁরা কি সুখ পাচ্ছেন? ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের নির্বাসন আর দুর্যোধনের বৃদ্ধি দেখে পৃথিবী বিদীর্ণ হচ্ছেন না কেন?

 সাত্যকি বললেন, এখন বিলাপের সময় নয়, যুধিষ্ঠির কিছু না বললেও আমাদের যা কর্তব্য তা করব। আমরা ত্রিলোক জয় করতে পারি, বৃষ্ণি ভোজ অন্ধক প্রভৃতি যদুবংশের বীরগণ আজই সসৈন্যে যাত্রা করে দুর্যোধনকে যমালয়ে পাঠান। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করুন, তাঁর বনবাসের কাল সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিমন্যু রাজ্য শাসন করবে।

 কৃষ্ণ বললেন, সাত্যকি, আমরা তোমার মতে চলতাম, কিন্তু যা নিজ ভুজবলে বিজিত হয় নি এমন রাজ্য যুধিষ্ঠির চান না। ইনি এঁর ভ্রাতারা, এবং দ্রুপদকন্যা, কেউ স্বধর্ম ত্যাগ করবেন না।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সত্যই রক্ষণীয়, রাজ্য নয়। একমাত্র কৃষ্ণই আমাকে যথার্থভাবে জানেন, আমিও তাঁকে জানি। সাত্যকি, পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ যখন মনে করবেন যে বলপ্রকাশের সময় এসেছে তখন তোমরা দুর্যোধনকে জয় ক’রো।


 যাদবগণ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার যাত্রা ক’রে পুণ্যতোয়া পয়োষ্ণী নদী অতিক্রম ক’রে নর্মদার নিকটস্থ বৈদূর্য পর্বতে উপস্থিত হলেন। লোমশ এই আখ্যান বললেন।— মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন এই স্থানে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন, তাঁর দেহ বল্মীক পিপীলিকা ও লতায় আবৃত হয়ে যায়। একদিন রাজা শর্যাতি এখানে বিহার করতে এলেন, তাঁর চার হাজার স্ত্রী এবং সুকন্যা নামে এক রূপবতী কন্যা ছিল। সুকন্যাকে সেই মনোরম স্থানে বিচরণ করতে দেখে চ্যবন আনন্দিত হয়ে ক্ষীণকণ্ঠে তাঁকে ডাকলেন। সুকন্যা শুনতে পেলেন না, তিনি বল্মীকস্তূপের ভিতরে চ্যবনের দুই চক্ষু দেখতে পেয়ে বললেন, একি! তার পর কৌতূহল ও মোহের বশে কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করলেন। চ্যবন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শর্যাতির সৈন্যদের মলমূত্র রুদ্ধ করলেন। সৈন্যদের কষ্ট দেখে রাজা সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, বৃদ্ধ ক্রোধী চ্যবন ঋষি এখানে তপস্যা করেন, কেউ তাঁর অপকার করে নি তো? সুকন্যা বললেন, বল্মীকস্তূপের ভিতরে খদ্যোতের ন্যায় দীপ্যমান কি রয়েছে দেখে আমি কণ্টক দিয়ে বিদ্ধ করেছি। শর্যাতি তখনই চ্যবনের কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আমার বালিকা কন্যা অজ্ঞানবশে আপনাকে পীড়া দিয়েছে, ক্ষমা করুন। চ্যবন বললেন, রাজা, তোমার কন্যা দর্প ও অবজ্ঞার বশে আমাকে বিদ্ধ করেছে, তাকে যদি দান কর তবে ক্ষমা করব। শর্যাতি বিচার না করেই তাঁর কন্যাকে সমর্পণ করলেন।

 সুকন্যা সযত্নে চ্যবনের সেবা করতে লাগলেন। একদিন অশ্বিনীকুমারদ্বয় সুকন্যাকে স্নানের পর নগ্নাবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁকে বললেন, ভাবিনী, তোমার ন্যায় সুন্দরী দেবতাদের মধ্যেও নেই। তোমার পিতা তোমাকে বৃদ্ধের হস্তে দিয়েছেন কেন? তুমি শ্রেষ্ঠ বেশভূষা ধারণের যোগ্য, জরাজর্জরিত অক্ষম চ্যবনকে ত্যাগ ক’রে আমাদের একজনকে বরণ কর। সুকন্যা বললেন, আমি আমার স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। অশ্বিনীকুমারদ্বয় বললেন, আমরা দেবচিকিৎসক, তোমার পতিকে যুবা ও রূপবান ক’রে দেব, তার পর তিনি এবং আমরা এই তিন জনের মধ্যে একজনকে তুমি পতিত্বে বরণ করো। সুকন্যা চ্যবনকে জানালে তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় চ্যবনকে নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন এবং মুহূর্তকাল পরে তিন জনেই দিব্য রূপ ও সমান বেশ ধারণ ক’রে জল থেকে উঠলেন। সকলে তুল্যরূপধারী হ’লেও সুকন্যা চ্যবনকে চিনতে পেরে তাঁকেই বরণ করলেন। চ্যবন হৃষ্ট হয়ে অশ্বিনীদ্বয়কে বললেন, আপনারা আমাকে রূপবান যুবা করেছেন, আমি এই ভার্যাকেও পেয়েছি। আমি দেবরাজের সমক্ষেই আপনাদের সোমপায়ী করব।

 চ্যবনের অনুরোধে রাজা শর্যাতি এক যজ্ঞ করলেন। চ্যবন যখন অশ্বিদ্বয়কে দেবার জন্য সোমরসের পাত্র নিলেন তখন ইন্দ্র তাঁকে বারণ করে বললেন, এঁরা দেবতাদের চিকিৎসক ও কর্মচারী মাত্র, মর্ত্যলোকেও বিচরণ করেন, এঁরা সোমপানের অধিকারী নন। চ্যবন নিরস্ত হলেন না, ঈষৎ হাস্য করে অশ্বিদ্বয়ের জন্য সোমপাত্র তুলে নিলেন। ইন্দ্র তখন বজ্রপ্রহারে উদ্যত হলেন। চ্যবন ইন্দ্রের বাহু স্তম্ভিত ক’রে মন্ত্রপাঠ ক’রে অগ্নিতে আহূতি দিলেন, অগ্নি থেকে মদ নামক এক মহাবীর্য মহাকায় ঘোরদর্শন কৃত্যা[] উদ্‌ভূত হয়ে মুখব্যাদান ক’রে ইন্দ্রকে গ্রাস করতে গেল। ভয়ে ওষ্ঠ লেহন করতে করতে ইন্দ্র চ্যবনকে বললেন, ব্রহ্মর্ষি, প্রসন্ন হ’ন, আজ থেকে দুই অশ্বিনীকুমারও সোমপানের অধিকারী হবেন। চ্যবন প্রসন্ন হ’য়ে ইন্দ্রের স্তম্ভিত বাহদ্বয় মুক্ত করলেন এবং মদকে বিভক্ত ক’রে সুরাপান, স্ত্রী, দ্যূত ও মৃগয়ায় স্থাপিত করলেন। শর্যাতির যজ্ঞ সমাপ্ত হ’ল, চ্যবন তাঁর ভার্যার সঙ্গে বনে চলে গেলেন।

২৭। মান্ধাতা, সোমক ও জন্তুর ইতিহাস

 পাণ্ডবগণ নানা তীর্থ দর্শন ক’রে যমুনা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন, যেখানে মান্ধাতা ও সোমক রাজা যজ্ঞ করেছিলেন। লোমশ এই ইতিহাস বললেন ৷—

 ইক্ষ্বাকুবংশে যুবনাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্যভার দিয়ে বনে গিয়ে সন্তান কামনায় যোগসাধনা করতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন যজ্ঞবেদীর উপর এক কলস জল রয়েছে। যুবনাশ্ব জল চাইলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পেলেন না। তখন তিনি জলপান ক’রে অবশিষ্ট জল কলস থেকে ফেলে দিলেন। চ্যবন ও অন্যান্য মুনিরা নিদ্রা থেকে উঠে দেখলেন, কলস জলশূন্য। যুবনাশ্বের স্বীকারোক্তি শুনে চ্যবন বললেন, রাজা, আপনি অনুচিত কার্য করেছেন, আপনার পুত্রোৎপত্তির জন্যই এই তপঃসিদ্ধ জল রেখেছিলাম। জলপান করার ফলে আপনিই পুত্র প্রসব করবেন কিন্তু গর্ভধারণের ক্লেশ পাবেন না। শতবর্ষ পূর্ণ হ’লে যুবনাশ্বের বাম পার্শ্ব ভেদ করে এক সূর্যতুল্য তেজস্বী পুত্র নির্গত হ’ল। দেবতারা শিশুকে দেখতে এলেন। তাঁরা বললেন, এই শিশু কি পান করবে? ‘মাং ধাস্যতি’ — আমাকে পান করবে — এই ব’লে ইন্দ্র তার মুখে নিজের তর্জনী পুরে দিলেন, সে চুষতে লাগল। এজন্য তার নাম হল মান্ধাতা। মান্ধাতা বড় হয়ে ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং বিবিধ দিব্যাস্ত্র ও অভেদ্য কবচের অধিকারী হলেন। স্বয়ং ইন্দ্র তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। মান্ধাতা ত্রিভুবন জয় এবং বহু যজ্ঞ ক’রে ইন্দ্রের অর্ধাসন লাভ করেছিলেন।

 সোমক রাজার এক শ ভার্যা ছিল। বৃদ্ধ বয়সে জন্তু নামে তাঁর একটি মাত্র পুত্র হ’ল, সোমকের শতপত্নী সর্বদা তাকে বেষ্টন ক’রে থাকতেন। একদিন সেই বালক পিপীলিকার দংশনে কেঁদে উঠল, তার মাতারাও কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা সোমক সেই আর্তনাদ শুনে অন্তঃপুরে এসে পুত্রকে শান্ত করলেন। তার পর তিনি তাঁর পুরোহিত ও মন্ত্রিবর্গকে বললেন, এক পুত্রের চেয়ে পুত্র না থাকাই ভাল, এক পুত্রে কেবলই উদ্‌বেগ হয়। আমি পুত্রার্থী হয়ে শত ভার্যার পাণিগ্রহণ করেছি, কিন্তু শুধু একটি পুত্র হয়েছে, এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে। আমার ও পত্নীদের যৌবন অতীত হয়েছে, আমাদের প্রাণ এখন একটিমাত্র বালককে আশ্রয় ক’রে আছে। এমন উপায় কি কিছু নেই যাতে আমার শত পুত্র হতে পারে?

 পুরোহিত বললেন, আমি এক যজ্ঞ করব, তাতে যদি আপনি আপনার পুত্র জন্তুকে আহূতি দেন তবে শীঘ্র শত পুত্র লাভ করবেন। জন্তুও আবার তার মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করবে, তার বাম পার্শ্বে একটি কনকবর্ণ চিহ্ন থাকবে। রাজা সম্মত হ’লে পুরোহিত যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, রাজপত্নীরা জন্তুর হাত ধ’রে ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। যাজক (পুরোহিত) তখন বালককে সবলে টেনে নিয়ে কেটে ফেললেন এবং তার বসা দিয়ে যথাবিধি হোম করলেন। তার গন্ধ আঘ্রাণ ক’রে রাজপত্নীরা শোকার্ত হয়ে সহসা ভূমিতে প’ড়ে গেলেন এবং সকলেই গর্ভবতী হলেন। যথাকালে সোমক শত পুত্র লাভ করলেন। জন্তু কনকবর্ণ চিহ্ণ ধারণ ক’রে তার ভূতপূর্ব মাতার গর্ভ থেকেই ভূমিষ্ট হ’ল।

 তার পর সেই যাজক ও সোমক দুজনেই পরলোকে গেলেন। যাজককে নরকভোগ করতে দেখে সোমক তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। যাজক বললেন, আমি আপনার জন্য যে যজ্ঞ করেছিলাম তারই এই ফল। তখন সোমক ধর্মরাজ যমকে বললেন, যাজককে মুক্তি দিন, এর পরিবর্তে আমিই নরকভোগ করব। যম বললেন, রাজা, একজনের পাপের ফল অন্যে ভোগ করতে পারে না। সোমক বললেন, এই ব্রহ্মবাদী যাজককে ছেড়ে আমি পুণ্যফল ভোগ করতে চাই না, এঁর সঙ্গেই আমি স্বর্গে বা নরকে বাস করব। আমরা একই কর্ম করেছি, আমাদের পাপপণ্যের ফল সমান হ’ক। তখন যমের সম্মতিক্রমে যাজকের সঙ্গে সোমকও নরকভোগ করলেন এবং পাপক্ষয় হ’লে দুজনেই মুক্ত হয়ে শুভলোক লাভ করলেন।

২৮। উশীনর, কপোত ও শ্যেন

 যুধিষ্ঠিরাদি প্রসর্পণ ও প্লক্ষাবতরণ তীর্থ, সরস্বতী নদী, কুরুক্ষেত্র, সিন্ধু নদ, কাশ্মীরমণ্ডল, পরশুরামকৃত মানস সরোবরের দ্বার ক্রৌঞ্চরন্ধ্র, ভৃগুতুঙ্গ, বিতস্তা নদী প্রভৃতি দেখে যমুনার পার্শ্ববর্তী জলা ও উপজলা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন।

 লোমশ বললেন, রাজা উশীনর এখানে যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য ইন্দ্র শ্যেনরূপে এবং অগ্নি কপোতরূপে রাজার কাছে আসেন। শ্যেনের ভয়ে কপোত রাজার শরণাপন্ন হয়ে তাঁর ঊরুদেশে লুকিয়ে রইল। শ্যেন বললে, আমি ক্ষুধার্ত, এই কপোত আমার বিহিত খাদ্য, ধর্মের লোভে ওকে রক্ষা করবেন না, তাতে আপনি ধর্মচ্যুত হবেন। উশীনর বললেন, এই কপোত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কাছে এসেছে, শরণাগতকে আমি ত্যাগ করতে পারি না। শ্যেন বললে, যদি আমাকে আহার থেকে বঞ্চিত করেন তবে আমার প্রাণবিয়োগ হবে, আমি মরলে আমার স্ত্রীপুত্রাদিও মরবে। আপনি একটা কপোতকে রক্ষা করতে গিয়ে বহু প্রাণ নষ্ট করবেন। যে ধর্ম অপর ধর্মের বিরোধী তা কুধর্ম। রাজা, গুরুত্ব ও লঘুত্ব বিচার করে ধর্মাধর্ম নিরূপণ করা উচিত। উশীনর বললেন, বিহগশ্রেষ্ঠ, তোমার বাক্য কল্যাণকর, কিন্তু শরণাগতকে পরিত্যাগ করতে বলছ কেন? ভোজন করাই তোমার উদ্দেশ্য, তোমাকে আমি গো বৃষ বরাহ মৃগ মহিষ বা অন্য যে মাংস চাও তাই দেব। শ্যেন বললে, মহারাজ, বিধাতা এই কপোতকে আমার ভক্ষ্যরূপে নির্দিষ্ট করেছেন, আর কিছুই আমি খাব না। উশীনর বললেন, শিবিবংশের[] এই সমৃদ্ধ রাজ্য অথবা যা চাও তাই তোমাকে দেব। শ্যেন বললে, কপোতের উপরে যদি আপনার এতই স্নেহ তবে তার সমপরিমাণ মাংস নিজের দেহ থেকে কেটে আমাকে দিন। উশীনর বললেন, শ্যেন, তোমার এই প্রার্থনাকে আমি অনুগ্রহ মনে করি। এই ব’লে তিনি তুলাযন্ত্রের এক দিকে কপোতকে রেখে অপর দিকে নিজের মাংস কেটে রাখলেন, কিন্তু বার বার মাংস কেটে দিলেও কপোতের সমান হ’ল না। অবশেষে উশীনর নিজেই তুলায় উঠলেন।

 তখন শোন বললে, ধর্মজ্ঞ, আমি ইন্দ্র, এই কপোত অগ্নি; তোমার ধর্মজ্ঞান পরীক্ষার জন্য এখানে এসেছিলাম। জগতে তোমার এই কীর্তি চিরস্থায়ী হবে। এই ব’লে তাঁরা চ’লে গেলেন। ধর্মাত্মা উশীনর নিজের যশে পৃথিবী ও আকাশ আবৃত ক’রে যথাকালে স্বর্গারোহণ করলেন।

২৯। উদ্দালক, শ্রেতকেতু, কহোড়, অষ্টাবক্র ও বন্দী

 লোমশ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই দেখ উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুর আশ্রম। ত্রেতাযুগে অষ্টাবক্র ও তাঁর মাতুল শ্বেতকেতু শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা জনক রাজার যজ্ঞে গিয়ে বরুণপত্র বন্দীকে বিতর্কে পরাস্ত করেছিলেন। উদ্দালক ঋষি তাঁর শিষ্য কহোড়ের সঙ্গে নিজের কন্যা সুজাতার বিবাহ দেন। সুজাতা গর্ভবতী হ’লে গর্ভস্থ শিশু বেদপাঠরত কহোড়কে বললে, পিতা, আপনার প্রসাদে আমি গর্ভে থেকেই সর্ব শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, আপনার পাঠ ঠিক হচ্ছে না। মহর্ষি কহোড় ব্রুদ্ধ হয়ে গর্ভস্থ শিশুকে শাপ দিলেন— তোর দেহ অষ্ট স্থানে বক্র হবে। কহোড়ের এই পুত্র অষ্টাবক্র নামে খ্যাত হন, তিনি তাঁর মাতুল শ্বেতকেতুর সমবয়স্ক ছিলেন।

 গর্ভের দশম মাসে সুজাতা তাঁর পতিকে বললেন, আমি নিঃস্ব, আমাকে অর্থ সাহায্য করে এমন কেউ নেই, কি ক’রে সন্তানপালন করব? কহোড় ধনের জন্য জনক রাজার কাছে গেলেন, সেখানে তর্ককুশল বন্দী তাঁকে বিচারে পরাস্ত ক’রে জলে ডুবিয়ে দিলেন। এই সংবাদ পেয়ে উদ্দালক তাঁর কন্যা সুজাতাকে বললেন, গর্ভস্থ শিশু যেন জানতে না পারে। জন্মগ্রহণ ক’রে অষ্টাবক্র তাঁর পিতার বিষয় কিছুই জানলেন না, তিনি উদ্দালককে পিতা এবং শ্বেতকেতুকে ভ্রাতা মনে করতে লাগলেন। বার বৎসর বয়সে একদিন অষ্টাবক্র তাঁর মাতামহের কোলে বসে আছেন এমন সময় শ্বেতকেতু তার হাত ধ’রে টেনে বললেন, এ তোমার পিতার কোল নয়। অষ্টাবক্র দুঃখিত হয়ে তাঁর মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা কোথায়? তখন সুজাতা পূর্বঘটনা বললেন।

 অষ্টাবক্র তাঁর মাতুল শ্বেতকেতুকে বললেন, চল, আমরা জনক রাজার যজ্ঞে যাই, সেখানে ব্রাহ্মণদের বিতর্ক শুনব, উত্তম অন্নও ভোজন করব। মাতুল ও ভাগিনেয় যজ্ঞসভার নিকটে এলে দ্বারপাল বাধা দিয়ে বললে, আমরা বন্দীর আজ্ঞাধীন, এই সভায় বালকরা আসতে পারে না, কেবল বিদ্বান বৃদ্ধ ব্রাহ্মণেরাই পারেন। অষ্টাবক্র বললেন, আমরা ব্রতচারী, বেদজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানশাস্ত্রে পারদর্শী, অতএব আমরা বৃদ্ধই। দ্বারপাল পরীক্ষা করবার জন্য কতকগুলি প্রশ্ন করলে। অষ্টাবক্র তার যথাযথ উত্তর দিয়ে জনক রাজাকে সম্বোধন করে বললেন, মহারাজ, শুনেছি বন্দীর সঙ্গে বিতর্কে যাঁরা হেরে যান আপনার আজ্ঞায় তাঁদের জলে ডোবানো হয়। কোথায় সেই বন্দী? আমি তাঁকে পরাস্ত করব। জনক বললেন, বৎস, তুমি না জেনেই বন্দীকে জয় করতে চাচ্ছ, জ্ঞানগর্বিত অনেক পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে বিচার করতে এসে পরাস্ত হয়েছেন। অষ্টাবক্র বললেন, বন্দী আমার তুল্য প্রতিপক্ষ পান নি তাই বিচারসভায় সিংহের ন্যায় আস্ফালন করেন। আমার সঙ্গে বিতর্কে তিনি পরাস্ত হয়ে ভগ্নচক্র শকটের ন্যায় পথে প’ড়ে থাকবেন। তখন রাজা জনক অষ্টাবক্রকে বিবিধ দুরূহ প্রশ্ন করলেন এবং তার সদুত্তর পেয়ে বললেন, দেবতুল্য বালক, বাক্‌পটুতায় তোমার সমান কেউ নেই, তুমি বালক নও, স্থবির। তোমাকে আমি দ্বার ছেড়ে দিচ্ছি। অষ্টাবক্র সভায় প্রবেশ ক’রে বন্দীর সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হলেন। অনেক প্রশ্ন উত্তর ও প্রত্যুত্তরের পর বন্দী অধোমুখে নীরব হলেন। সভায় মহা কোলাহল উঠল, ব্রাহ্মণগণ কৃতাঞ্জলি হ’য়ে সসম্মানে অষ্টাবক্রের কাছে এলেন। অষ্টাবক্র বললেন, এই বন্দী ব্রাহ্মণদের জয় ক’রে জলে ডুবিয়েছিলেন, এখন এঁকেই আপনারা ডুবিয়ে দিন। বন্দী বললেন, আমি বরুণের পুত্র, জনক রাজার এই বজ্ঞের সমকালে বরুণও এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন, আমি ব্রাহ্মণদের জলমজ্জিত ক’রে সেই যজ্ঞ দেখতে পাঠিয়েছি, তাঁরা এখন ফিরে আসছেন। আমি অষ্টাবক্রকে সম্মান করছি, তাঁর জন্যই আমি (জলমজ্জিত হয়ে) পিতার সঙ্গে মিলিত হব। অষ্টাবক্রও তাঁর পিতা কহোড়কে এখনই দেখতে পাবেন।

 অনন্তর কহোড় ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ বরুণের নিকট পূজা লাভ করে জনকের সভায় ফিরে এলেন। কহোড় বললেন, মহারাজ, এই জন্যই লোকে পুত্রকামনা করে, আমি যা করতে পারি নি আমার পুত্র তা করেছে। তার পর বন্দী সমুদ্রে প্রবেশ করলেন, পিতা ও মাতুলের সঙ্গে অষ্টাবক্রও উদ্দালকের আশ্রমে ফিরে এলেন। কহোড় তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই নদীতে প্রবেশ কর। পিতার আজ্ঞা পালন ক’রে অষ্টাবক্র নদী থেকে অবক্র সমান-অঙ্গ হয়ে উত্থিত হলেন। সেই কারণে এই নদী সমঙ্গা নামে খ্যাত।

৩০। ভরদ্বাজ, যবক্রীত, রৈভ্য, অর্বাবসু ও পরাবসু

 লোমশ বললেন, যুধিষ্ঠির, এই সেই সমঙ্গা বা মধুবিলা নদী, বৃত্রবধের পর ইন্দ্র যাতে স্নান ক’রে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এই ঋষিগণের প্রিয় কনখল পর্বত, এই মহানদী গঙ্গা, ওই রৈভ্যাশ্রম যেখানে ভরদ্বাজপুত্র যবক্রীত বিনষ্ট হয়েছিলেন। সেই ইতিহাস শোন।—

 ভরদ্বাজ তাঁর সখা রৈভ্যের নিকটেই বাস করতেন। রৈভ্য এবং তাঁর দুই পত্র অর্বাবসু ও পরাবসু বিদ্বান্ ছিলেন, ভরদ্বাজ শুধু তপস্বী ছিলেন। ব্রাহ্মণগণ ভরদ্বাজকে সম্মান করেন না কিন্তু রৈভ্য ও তাঁর দুই পুত্রকে করেন দেখে ভরদ্বাজপুত্র যবক্রীত কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। ইন্দ্র উদ্‌বিগ্ন হয়ে তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তপস্যা করছ? যবক্রীত বললেন, দেবরাজ, গুরুমুখ থেকে বহুকালে বেদবিদ্যা লাভ করতে হয়; অধ্যয়ন না করেই যাতে বেদবিৎ হওয়া যায় সেই কামনায় আমি তপস্যা করছি। ইন্দ্র বললেন, তুমি কুপথে যাচ্ছ, আত্মহত্যা ক’রো না, ফিরে গিয়ে গুরুর নিকট বেদবিদ্যা শেখ। যবক্রীত তথাপি তপস্যা করতে লাগলেন। ইন্দ্র আবার এসে তাঁকে নিরস্ত হ’তে বললেন কিন্তু যবক্রীত শুনলেন না। তখন ইন্দ্র অতিজরাগ্রস্ত দুর্বল যক্ষ্মাক্রান্ত ব্রাহ্মণের রূপে গঙ্গাতীরে এসে নিরন্তর বালুকামুষ্টি ফেলতে লাগলেন। যবক্রীত তাঁকে সহাস্যে প্রশ্ন করলেন ব্রাহ্মণ, নিরর্থক একি করছেন? ইন্দ্র বললেন, বৎস, আমি গঙ্গায় সেতু বাঁধছি, লোকে যাতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। যবক্রীত বললেন, তপোধন, এই অসাধ্য কার্যের চেষ্টা করবেন না। ইন্দ্র বললেন, তুমি যেমন বেদজ্ঞ হবার আশায় তপস্যা করছ আমিও সেইরূপ বৃথা চেষ্টা করছি। যবক্রীত বললেন, দেবরাজ, যদি আমার তপস্যা নিরর্থক মনে করেন তবে বর দিন যেন আমি বিদ্বান্ হই। ইন্দ্র বর দিলেন— তোমরা পিতা-পুত্রে বেদজ্ঞান লাভ করবে।

 যবক্রীত পিতার কাছে এসে বরলাভের বিষয় জানালেন। ভরদ্বাজ বললেন, বৎস, অভীষ্ট বর পেয়ে তোমার দর্প হবে, মন ক্ষুদ্র হবে, তার ফলে তুমি বিনষ্ট হবে। মহর্ষি রৈভ্য কোপনস্বভাব, তিনি যেন তোমার অনিষ্ট না করেন। যবক্রীত বললেন, আপনি ভয় পাবেন না, রৈভ্য আপনার তুল্যই আমার মান্য। পিতাকে এইরূপে সান্ত্বনা দিয়ে যবক্রীত মহানন্দে অন্যান্য ঋষিদের অনিষ্ট করতে লাগলেন।

 একদিন বৈশাখ মাসে যবক্রীত রৈভ্যের অশ্রামে গিয়ে কিন্নরীর ন্যায় রূপবতী পরাবসুর পত্নীকে দেখতে পেলেন। যবক্রীত নির্লজ্জ হয়ে তাঁকে বললেন, আমাকে ভজনা কর। পরাবসুপত্নী ভয় পেয়ে ‘তাই হবে’ বলে পালিয়ে গেলেন। রৈভ্য আশ্রমে এসে দেখলেন তাঁর কনিষ্ঠা পুত্রবধূ কাঁদছেন। যবক্রীতের আচরণ শুনে রৈভ্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দু গাছি জটা ছিঁড়ে অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন, তা থেকে পরাবসুপত্নীর তুল্য রূপবতী এক নারী এবং এক ভয়ংকর রাক্ষস উৎপন্ন হ’ল। রৈভ্য তাদের আজ্ঞা দিলেন, যবক্রীতকে বধ কর। তখন নারী যবক্রীতের কাছে গিয়ে তাঁকে মুগ্ধ ক’রে কমণ্ডলু হরণ করলে। যবক্রীতের মুখ তখন উচ্ছিষ্ট ছিল। রাক্ষস শূল উদ্যত করে তাঁর দিকে ধাবিত হল। যবক্রীত তাঁর পিতার অগ্নিহোত্রগৃহে আশ্রয় নিতে গেলেন, কিন্তু সেই গৃহের রক্ষী এক অন্ধ শূদ্র তাঁকে সবলে দ্বারদেশে ধ’রে রাখলে। তখন রাক্ষস শূলের আঘাতে যবক্রীতকে বধ করলে।

 পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভরদ্বাজ বিলাপ করতে লাগলেন— পুত্র, তুমি ব্রাহ্মণদের জন্য তপস্যা করেছিলে যাতে তাঁরা অধ্যয়ন না ক’রেই বেদজ্ঞ হ’তে পারেন। ব্রাহ্মণের হিতার্থী ও নিরপরাধ হয়েও কেন তুমি বিনষ্ট হ’লে? আমার নিষেধ সত্ত্বেও কেন রৈভ্যের আশ্রমে গিয়েছিলে? আমি বৃদ্ধ, তুমি আমার একমাত্র পুত্র, তথাপি দুর্মতি রৈভ্য আমাকে পুত্রহীন করলেন। রৈভ্যও শীঘ্র তাঁর কনিষ্ঠ পত্র কর্তৃক নিহত হবেন। এইরূপ অভিশাপ দিয়ে ভরদ্বাজ পুত্রের অগ্নিসৎকার করে নিজেও অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।

 এই সময়ে রাজা বৃহদ্‌দ্যুম্ন এক যজ্ঞ করছিলেন। সাহায্যের জন্য রৈভ্যের দুই পুত্র সেখানে গিয়েছিলেন, আশ্রমে কেবল রৈভ্য ও তাঁর পুত্রবধূ ছিলেন। একদিন পরাবসু আশ্রমে আসছিলেন, তিনি শেষরাত্রে বনমধ্যে কৃষ্ণাজিনধারী পিতাকে দেখে মৃগ মনে ক’রে আত্মরক্ষার্থ তাঁকে বধ করলেন। পিতার অন্ত্যেষ্টি ক’রে পরাবসু যজ্ঞস্থানে ফিরে গিয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অর্বাবসুকে বললেন, আমি মৃগ মনে ক’রে পিতাকে বধ করেছি। আপনি আশ্রমে ফিরে গিয়ে আমার হয়ে ব্রহ্মহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করুন, আমি একাকীই এই যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারব। অর্বাবসু সম্মত হয়ে আশ্রমে গেলেন এবং প্রায়শ্চিত্তের পর যজ্ঞস্থানে ফিরে এলেন। তখন পরাবসু হষ্ট হয়ে রাজা বৃহদ্‌দ্যুম্নকে বললেন, এই ব্রহ্মহত্যাকারী যেন আপনার যজ্ঞ না দেখে ফেলে, তা হ’লে আপনার অনিষ্ট হবে। বাজা অর্বাবসুকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ভৃত্যদের আজ্ঞা দিলেন। অর্বাবসু বার বার বললেন, আমার এই ভ্রাতাই ব্রহ্মহত্যা করেছে, আমি তাকে সেই পাপ থেকে মুক্ত করেছি। তাঁর কথায় কেউ বিশ্বাস করলে না দেখে অর্বাবসু বনে গিয়ে সূর্যের আরাধনায় নিরত হলেন। মূর্তিমান সূর্য ও অন্যান্য দেবগণ প্রীত হয়ে অর্বাবসুকে সংবর্ধনা এবং পরাবসুকে প্রত্যাখান করলেন। অর্বাবসুর প্রার্থনায় দেবগণ বর দিলেন, তার ফলে রৈভ্য ভরদ্বাজ ও যবক্রীত পুনর্জীবিত হলেন, পরাবসুর পাপ দূর হ’ল, রৈভ্য বিস্মৃত হলেন যে পরাবসু তাঁকে হত্যা করেছিলেন, এবং সূর্যমন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হ’ল।

 জীবিত হয়ে যবক্রীত দেবগণকে বললেন, আমি বেদাধ্যায়ী তপম্বী ছিলাম তথাপি রৈভ্য আমাকে কি করে বধ করতে পারলেন? দেবতারা বললেন, তুমি গুরুর সাহায্য না নিয়ে (কেবল তপস্যার প্রভাবে) বেদপাঠ করেছিলে, আর রৈভ্য অতি কষ্টে গুরুদের তুষ্ট ক’রে দীর্ঘকালে বেদজ্ঞান লাভ করেছিলেন, সেজন্য তাঁর জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

৩১। নরকাসুর ― বরাহরূপী বিষ্ণু ― বদরিকাশ্রম

 উশীরবীজ ও মৈনাক পর্বত, শ্বেতগিরি এবং কালশৈল অতিক্রম করে যুধিষ্ঠিরাদি সপ্তধারা গঙ্গার নিকট উপস্থিত হলেন। লোমশ বললেন, এখন আমরা মণিভদ্র ও যক্ষরাজ কুবেরের স্থান কৈলাসে যাব। সেই দুর্গম প্রদেশ গন্ধর্ব কিন্নর যক্ষ ও রাক্ষসগণ কর্তৃক রক্ষিত, তোমরা সতর্ক হয়ে চল। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, তুমি দ্রৌপদী ও অন্য সকলের সঙ্গে এই গঙ্গাদ্বারে অপেক্ষা কর, কেবল আমি নকুল ও মহাতপা লোমশ এই তিনজন লঘু আহার ক’রে ও সংযত হয়ে এই দুর্গম পথে যাত্রা করব। ভীম বললেন, অর্জুনকে দেখবার জন্য দ্রৌপদী এবং আমরা সকলেই উৎসুক হয়ে আছি। এই রাক্ষসসংকুল দুর্গম স্থানে আপনাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না। পাঞ্চালী বা নকুল-সহদেব যেখানে চলতে পারবেন না সেখানে আমি তাঁদের বহন ক’রে নিয়ে যাব। দ্রৌপদী সহাস্যে বললেন, আমি চলতে পারব, অমার জন্য ভেবো না।

 যুধিষ্ঠিরাদি সকলে পুলিন্দরাজ সুবাহুর বিশাল রাজ্যে উপস্থিত হলেন এবং সসম্মানে গৃহীত হয়ে সেখানে সুখে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন সূর্যোদয় হ’লে পাচক ও ভৃত্যদের পুলিন্দরাজের নিকটে রেখে তাঁরা পদব্রজে হিমালয় পর্বতের দিকে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে এক স্থানে এসে লোমশ বললেন, দূরে ওই যে কৈলাসশিখরতুল্য সুবিশাল সদৃশ্য স্তূপ দেখছ তা নরকাসুরের অস্থি। নরকাসুর তপস্যার প্রভাবে ও বাহুবলে দুর্ধর্ষ হয়ে দেবগণের উপর উৎপীড়ন করত। ইন্দ্রের প্রার্থনায় বিষ্ণু হস্তদ্বারা স্পর্শ করে সেই অসুরের প্রাণহরণ করেন।

 তার পর লোমশ বরাহরূপী বিষ্ণুর এই আখ্যান বললেন।— সত্যযুগে এক ভয়ংকর কালে আদিদেব বিষ্ণু যমের কার্য করতেন। তখন কেউ মরত না, কেবল জন্মগ্রহণ করত। পশু পক্ষী মানুষ প্রভৃতির সংখ্যা এত হ’ল যে তাদের গুরুভারে বসুমতী শত যোজন নিম্নে চ’লে গেলেন। তিনি সর্বাঙ্গে ব্যথিত হয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তখন বিষ্ণু রক্তনয়ন একদন্ত ভীষণাকার বরাহের রূপে পৃথিবীকে দন্তে ধারণ করে শত যোজন ঊর্ধ্বে তুললেন। চরাচর সংক্ষোভিত হ’ল, দেবতা ঋষি প্রভৃতি সকলেই কম্পিত হয়ে ব্রহ্মার নিকটে গেলেন, ব্রহ্মা আশ্বাস দিয়ে তাঁদের ভয় দূর করলেন।

 পাণ্ডবগণ গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হ’লে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হ’তে লাগল, সকলে ভীত হয়ে বৃক্ষ বল্মীকস্তূপ প্রভৃতির নিকট আশ্রয় নিলেন। দুর্যোগ থেমে গেলে তাঁরা আবার চলতে লাগলেন। এক ক্রোশ গিয়ে দ্রৌপদী শ্রান্ত ও অবশ হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে কোলে নিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন— আমি পাপী, আমার কর্মের ফলেই ইনি শোকে ও পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ভূপতিত হয়েছেন। ধৌম্য প্রভৃতি ঋষিগণ শান্তির জন্য মন্ত্র জপ করলেন, পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে মগচর্মের উপর শুইয়ে নানাপ্রকারে তাঁর সেবা করতে লাগলেন। যাধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, তুষারাবৃত দুর্গম গিরিপথে দ্রৌপদী কি ক’রে যাবেন? ভীম স্মরণ করা মাত্র মহাবাহু ঘটোৎকচ সেখানে এসে করজোড়ে বললেন, আজ্ঞা করুন কি করতে হবে। ভীম বললেন, বৎস, তামার মাতা পরিশ্রান্ত হয়েছেন, এঁকে বহন করে নিয়ে চল। তুমি এঁকে স্কন্ধে নিয়ে আমাদের নিকটবর্তী হয়ে আকাশমার্গে চল, যেন এঁর কষ্ট না হয়।

 ঘটোৎকচ দ্রৌপদীকে বহন করে নিয়ে চললেন, তাঁর অনুচর রাক্ষসরা পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণদের নিয়ে চলল, কেবল মহর্ষি লোমশ নিজের প্রভাবে সিদ্ধমার্গে দ্বিতীয় ভাস্করের ন্যায় অগ্রসর হলেন। বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হয়ে সকলে রাক্ষসদের স্কন্ধ থেকে নেমে নরনারায়ণের রমণীয় আশ্রম দর্শন করলেন। দেখানকার মহর্ষিগণ যুধিষ্ঠিরাদিকে সাদরে গ্রহণ ক’রে যথাবিধি অতিথিসৎকার করলেন। সেই আনন্দজনক অতি দুর্গম স্থানে বিশাল বদরী তরুর নিকটে ভাগীরথী নদী প্রবাহিত হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরাদি সেখানে পিতৃগণের তর্পণ করলেন।

৩২। সহস্রদল পদ্ম ― ভীম-হনুমান-সংবাদ

 অর্জুনের প্রতীক্ষায় পাণ্ডবগণ ছ রাত্রি শুদ্ধভাবে বদরিকাশ্রমে বাস করলেন। একদিন উত্তরপূর্ব দিক থেকে বায়ুদ্দ্বারা বাহিত একটি সহস্রদল পদ্ম দেখে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, দেখ এই দিব্য পদ্মটি কি সুন্দর ও সুগন্ধ! আমি ধর্মরাজকে এটি দেব। ভীম, আমি যদি তোমার প্রিয়া হই তবে এইপ্রকার বহু পদ্ম সংগ্রহ ক’রে নিয়ে এস, আমি কাম্যক বনে নিয়ে যাব। এই বলে দ্রৌপদী পদ্মটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন, ভীমও ধনুর্বাণহস্তে পদ্মবনের সন্ধানে যাত্রা করলেন।

 ভীম মনোহর গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন এবং আনন্দিতমনে লতাসমূহ সঞ্চালিত ক’রে যেন খেলা করতে করতে চললেন। ভয়শূন্য হরিণের দল ঘাস মুখে ক’রে তাঁর দিকে সকৌতুকে চেয়ে রইল। যক্ষ ও গন্ধর্ব রমণীরা পতির পার্শ্বে ব’সে পরম রূপবান দীর্ঘকায় কাঞ্চনবর্ণ ভীমকে অদৃশ্যভাবে নানা ভঙ্গী সহকারে দেখতে লাগল। বনচর বরাহ মহিষ সিংহ ব্যাঘ্র শৃগাল প্রভৃতিকে সন্ত্রস্ত ক’রে চলতে চলতে ভীম গন্ধমাদনের সানুদেশে এক রমণীয় বিশাল কদলীবন দেখতে পেলেন। তিনি গর্জন ক’রে কদলীতরু উৎপাটিত করতে লাগলেন। সহস্র সহস্র জলচর পক্ষী ভয় পেয়ে আর্দ্রপক্ষে আকাশে উড়তে লাগল। তাদের অনুসরণ ক’রে তিনি পদ্ম ও উৎপল সমন্বিত একটি রমণীয় বিশাল সরোবরে উপস্থিত হলেন এবং উদ্দাম মহাগজের ন্যায় বহহৃক্ষণ জলক্রীড়া ক’রে তীরে উঠে তাল ঠুকে শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই শব্দ শুনে পর্বতগুহায় সুপ্ত সিংহসকল গর্জন ক’রে উঠল এবং সিংহনাদে ত্রস্ত হয়ে হস্তীর দলও উচ্চ রব করতে লাগল।

 হনুমান সেখানে ছিলেন। ভ্রাতা ভীমসেন স্বর্গের পথে এসে পড়েছেন দেখে তাঁর প্রাণরক্ষার জন্য হনুমান কদলীতরুর মধ্যবর্তী পথ রুদ্ধ করলেন। সেই সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একজন চলতে পারে। হনুমান সেখানে শুয়ে প’ড়ে হাই তুলে তাঁর বিশাল লাঙ্গুল আস্ফোটন করতে লাগলেন, তার শব্দ পর্বতের গুহায় গৃহায় প্রতিধ্বনিত হ’ল। সেই শব্দ শুনে ভীমের রোমাঞ্চ হ’ল, তিনি নিকটে এসে দেখলেন, কদলীবনের মধ্যে এক বিশাল শিলার উপরে হনুমান শুয়ে আছেন, তিনি বিদ্যৎসম্পাতের ন্যায় দুর্নিরীক্ষ্য পিঙ্গলবর্ণ ও চঞ্চল। তাঁর গ্রীবা স্থূল ও খর্ব, কটিদেশ ক্ষীণ, ওষ্ঠদ্বয় হ্রস্ব, জিহ্বা ও মুখ তাম্রবর্ণ, ভ্রূ চঞ্চল, দন্ত শুক্ল ও তীক্ষ্ণ, তিনি স্বর্গের পথ রোধ ক’রে হিমাচলের ন্যায় বিরাজ করছেন। ভীম নির্ভয়ে হনুমানের কাছে গিয়ে ঘোর সিংহনাদ করলেন। মধুর ন্যায় পিঙ্গলবর্ণ চক্ষু ঈষৎ উন্মীলিত ক’রে হনুমান ভীমের দিকে অবজ্ঞাভরে চাইলেন এবং একটু হেসে বললেন, আমি রুগ্ন, সুখে নিদ্রামগ্ন ছিলাম, কেন আমাকে জাগালে? আমি তির্যগ্‌যোনি, ধর্ম জানি না, কিন্তু তুমি তো জান যে সকল প্রাণীকেই দয়া করা উচিত। তুমি কে, কোথায় যাবে? এই পথ দেবলোকে যাবার, মানুষের অগম্য।

 ভীম নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তুমি কে? হনুমান বললেন, আমি বানর, তোমাকে পথ ছেড়ে দেব না। ভাল চাও তো নিবৃত্ত হও, নতুবা তোমার মৃত্যু হবে। ভীম বললেন, মৃত্যুই হ’ক বা যাই হ’ক, তুমি ওঠ, পথ ছেড়ে দাও, তাহ’লে আমিও তোমার হানি করব না। হনুমান বললেন, আমি রুগ্ন, ওঠবার শক্তি নেই, যদি নিতান্তই যেতে চাও তো আমাকে ডিঙিয়ে যাও। ভীম বললেন, নির্গুণ পরমাত্মা দেহ ব্যাপ্ত ক’রে আছেন, তাঁকে অবজ্ঞা ক’রে আমি তোমাকে ডিঙিয়ে যেতে পারি না; নতুবা হনুমান যেমন সাগর লঙ্ঘন করেছিলেন সেইরূপ আমিও তোমাকে লঙ্ঘন করতাম। হনুমান বললেন, কে সেই হনুমান? ভীম বললেন, তিনি আমার ভ্রাতা, মহাগুণবান বুদ্ধিমান ও বলবান, রামায়ণোক্ত অতি বিখ্যাত বানরশ্রেষ্ঠ। আমি তাঁরই তুল্য বলশালী, তোমাকে নিগৃহীত করবার শক্তি আমার আছে। তুমি পথ দাও, নয়তো যমালয়ে যাবে। হনুমান বললেন, বার্ধক্যের জন্য আমার ওঠবার শক্তি নেই। তুমি দয়া কর, আমার লাঙ্গুলটি সরিয়ে গমন কর।

 বানরটাকে যমালয়ে পাঠাবেন স্থির করে ভীম তার পুচ্ছ ধরলেন, কিন্তু নড়াতে পারলেন না। তিনি দু হাত দিয়ে ধ’রে তোলবার চেষ্টা করলেন, তাঁর চক্ষু বিস্ফারিত হ’ল, ঘর্মস্রাব হ’তে লাগল, কিন্তু কোনও ফল হ’ল না। তখন তিনি অধোবদনে প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কপিশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হ’ন, আমার কটুবাক্য ক্ষমা করুন। আমি শরণাপন্ন হয়ে শিষ্যের ন্যায় প্রশ্ন করছি — আপনি কে?

 হনুমান তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, রাজ্যলাভের পর রাম আমাকে এই বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর কথা যত দিন জগতে প্রচলিত থাকবে তত দিন আমি জীবিত থাকব। সীতার বরে সর্বপ্রকার দিব্য ভোগ্যবস্তু আমি ইচ্ছা করলেই উপস্থিত হয়। কুরুনন্দন, এই দেবপথ মানুষের অগম্য সেজন্যই আমি রোধ করেছিলাম। তুমি যে পদ্মের সন্ধানে এসেছ তার সরোবর নিকটেই আছে। ভীম হৃষ্ট হয়ে বললেন, আমার চেয়ে ধন্যতর কেউ নেই, কারণ আপনার দর্শন পেয়েছি। বীর, সমুদ্রলঙ্ঘনের সময় আপনার যে রূপ ছিল তাই দেখিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন। হনুমান ভীমের প্রার্থনা পূরণ করলেন, তাঁর সেই আশ্চর্য ভীষণ বিন্ধ্যপর্বততুল্য দেহ দেখে ভীম রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, প্রভু, আপনার বিপুল শরীর দেখলাম, এখন সংকুচিত করুন। আপনি পার্শ্বে থাকতে রাম স্বয়ং কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন? আপনি তো নিজের বাহুবলেই রাবণকে সদলবলে ধ্বংস করতে পারতেন। হনুমান বললেন, তোমার কথা যথার্থ, রাবণ আমার সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাঁকে বধ করলে রামের কীর্তি নষ্ট হ’ত। ভীম, এই পদ্মবনে যাবার পথ, এখান দিয়ে গেলে তুমি কুবেরের উদ্যান দেখতে পাবে, কিন্তু তুমি বলপ্রয়োগ ক’রে পুষ্পচয়ন ক’রো না।

হনুমান তাঁর দেহ সংকুচিত করে ভীমকে আলিঙ্গন করলেন। ভীমের সকল শ্রম দূর হ’ল, তাঁর বোধ হ’ল তিনি অত্যন্ত বলশালী হয়েছেন। হনুমান বললেন, কুন্তীপুত্র, যদি চাও তবে আমি ক্ষুদ্র ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সংহার করব, শিলার আঘাতে হস্তিনাপর বিমর্দিত করব। ভীম বললেন, মহাবাহু, আপনার প্রসাদেই আমরা শত্রুজয় করব। হনুমান বললেন, তুমি যখন যুদ্ধে সিংহনাদ করবে তখন আমিও তার সঙ্গে আমার কণ্ঠস্বর যোগ করব; আমি অর্জুনের ধ্বজের উপরে বসে প্রাণান্তকর দারুণ নিনাদ করব; তাতে তোমরা অনায়াসে শত্রুবধ করতে পারবে। এই ব’লে হনুমান অন্তর্হিত হলেন।

৩৩। ভীমের পদ্মসংগ্রহ

 ভীম গন্ধমাদনের উপর দিয়ে হনুমানের প্রদর্শিত পথে যাত্রা করলেন। দিনশেষে তিনি বনমধ্যে হংস কারণ্ডব ও চক্রবাকে সমাকীর্ণ একটি বৃহৎ নদী দেখতে পেলেন, তার জল অতি নির্মল এবং পরম সুন্দর স্বর্ণময় দিব্য পদ্মে আচ্ছন্ন। এই নদী কৈলাসশিখর ও কুবেরভবনের নিকটবর্তী, ক্রোধবশ নামক রাক্ষসগণ তা রক্ষা করে। মৃগচর্মধারী স্বর্ণাঙ্গদভূষিত ভীম নিঃশঙ্কচিত্তে খড়্‌গহস্তে পদ্ম নিতে আসছেন দেখে রাক্ষসগণ তাঁকে প্রশ্ন করলে, মুনিবেশধারী অথচ সশস্ত্র কে তুমি? ভীম তাঁর পরিচয় দিয়ে জানালেন যে তিনি দ্রৌপদীর জন্য পদ্ম নিতে এসেছেন। রাক্ষসরা বললে, এখানে কুবের ক্রীড়া করেন, মানুষ এখানে আসতে পারে না। যক্ষরাজের অনুমতি না নিয়ে যে আসে সে বিনষ্ট হয়। তুমি ধর্মরাজের ভ্রাতা হয়ে সবলে পদ্ম হরণ করতে এসেছ কেন? ভীম বললেন, যক্ষপতি কুবেরকে তো এখানে দেখছি না, আর তাঁর দেখা পেলেও আমি অনুমতি চাইতে পারি না, কারণ ক্ষত্রিয়রা প্রার্থনা করেন না, এই সনাতন ধর্ম। তা ছাড়া এই নদীর উৎপত্তি পর্বতনির্ঝর থেকে, কুবেরভবনে নয়, সকলেরই এতে সমান অধিকার।

 নিষেধ অগ্রাহ্য ক’রে ভীম জলে নামছেন দেখে রাক্ষসরা তাঁকে মারবার জন্য ধাবিত হ’ল। শতাধিক রাক্ষস ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হ’ল, আর সকলে কৈলাস পর্বতে পালিয়ে গেল। ভীম তখন নদীতে নেমে অমৃততুল্য জল পান করলেন এবং পদ্মতরু উৎপাটিত ক’রে অনেক পদ্ম সংগ্রহ করলেন। পরাজিত রাক্ষসদের কাছে সমস্ত শুনে কুবের হেসে বললেন, আমি সব জানি, কৃষ্ণার জন্য ভীম ইচ্ছামত পদ্ম নিন।

 সেই সময়ে বদরিকাশ্রমে বালুকাময় খরস্পর্শ বায়ু বইতে লাগল, উল্কাপাত হ’ল, এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। বিপদের আশঙ্কায় যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়? দ্রৌপদী জানালেন যে ভীম তাঁর অনুরোধে পদ্ম আনতে গেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরাও শীঘ্র সেখানে যাব। তখন ঘটোৎকচ তাঁর অনুচরদের সাহায্যে যুধিষ্ঠিরাদি, দ্রৌপদী, লোমশ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের বহন ক’রে ভীমের নিকট উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির দেখলেন, অনেক যক্ষ নিহত হয়ে প’ড়ে আছে, ক্রুদ্ধ ভীম স্তব্ধনয়নে ওষ্ঠ দংশন ক’রে গদা তুলে নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, একি করেছ? এতে দেবতারা অসন্তুষ্ট হবেন আর এমন ক’রো না। সেই সময়ে উদ্যানরক্ষিগণ এসে সকলকে প্রণাম করলে। যুধিষ্ঠির সেই রাক্ষসদের সান্ত্বনা দিলে তারা কুবেরের কাছে ফিরে গেল।

 পাণ্ডবগণ অর্জুনের প্রতীক্ষায় গন্ধমাদনের সেই সানুদেশে কিছুকাল সুখে যাপন করলেন। তার পর একদিন যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, মহাত্মা লোমশ আমাদের বহু তীর্থ দেখিয়েছেন, বিশালা বদরী এবং এই দিব্য নদীও আমরা দেখেছি, এখন কোন্ উপায়ে আমরা কুবেরভবনে যাব তা ভেবে দেখ। এই সময়ে আকাশবাণী হ’ল— এখান থেকে কেউ সেখানে যেতে পারে না। আপনি বদরিকাশ্রমে ফিরে গিরে সেখান থেকে বৃষপর্বার আশ্রম হয়ে আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে যান, তা হলে কুবেরভবন দেখতে পাবেন। আকাশবাণী শুনে সকলে বদরিকায় ফিরে গেলেন।

  1. এই প্রসঙ্গে দ্বারবতীর পরে পিণ্ডারক তীর্থের বর্ণনায় আছে—এখনও এই তীর্থে পদ্মচিহ্ণিত ত্রিশূলাঙ্কিত বহু মদ্রা (seal) পাওয়া যায়। বোধ হয় এইসকল মুদ্রা মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত মুদ্রার অনুরূপ।
  2. অর্থাৎ বেশী লোকজন জিনিসপত্র সঙ্গে নিও না।
  3. ষাট হাজার সন্তানের ভস্মের আধার এজন্য সমুদ্র সগরের পুত্ররূপে কল্পিত এবং ‘সাগর’ নামে খ্যাত।
  4. অভিচার ক্রিয়ার জন্য আবির্ভূত দেবতা।
  5. উশীনর শিবিবংশীয়। ৪১-পরিচ্ছেদে উশীনরের পুত্রের নামও শিবি।