মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/জটাসুরবধপর্বাধ্যায়
॥ জটাসুরবধপর্বাধ্যায়॥
৩৪। জটাসুরবধ
জটাসুর নামে এক রাক্ষস ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করত। সর্বশাস্ত্রজ্ঞ উত্তম ব্রাহ্মণ ব’লে সে নিজের পরিচয় দিত, যুধিষ্ঠির অসন্দিগ্ধমনে সেই পাপীকে পালন করতেন। একদিন ভীম মৃগয়ায় গেছেন, ঘটোৎকচ ও তাঁর অনুচর রাক্ষসরাও আশ্রমে নেই, এবং লোমশ প্রভৃতি মহর্ষিরা ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন, এই সুযোগে জটাসুর বিকট রূপ ধারণ ক’রে যুধিষ্ঠির নকুল সহদেব দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবদের সমস্ত অস্ত্র হরণ করে নিয়ে চলল। সহদেব বিশেষ চেষ্টা করে তার বাহপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন এবং খড়্গ কোষমুক্ত ক’রে উচ্চকণ্ঠে ভীমকে ডাকতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির জটাসুরকে বললেন, দূর্বুদ্ধি, তুমি আমাদের আশ্রমে সসম্মানে বাস ক’রে এবং আমাদের অন্ন খেয়ে কেন আমাদের হরণ করছ? দ্রৌপদীকে স্পর্শ করার ফলে তুমি কলসস্থিত বিষ আলোড়ন ক’রে পান করেছ।
যুধিষ্ঠির নিজেকে গুরুভার করলেন, তাতে রাক্ষসের গতি মন্দীভূত হ’ল। সহদেব বললেন, মহারাজ, আমি এর সঙ্গে যুদ্ধ করব, সূর্যাস্তের পূর্বেই যদি একে বধ করতে না পারি তবে আমি নিজেকে ক্ষত্রিয় বলব না। সহদেব যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন এমন সময়ে গদাহস্তে ভীম সেখানে এলেন। ভীম রাক্ষসকে বললেন, পাপী, তুমি যখন আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিরীক্ষণ করতে তখনই তোমাকে আমি চিনেছিলাম, কিন্তু তুমি ব্রাহ্মণবেশী অতিথি হয়ে আমাদের প্রিয়কার্য করতে এজন্য বিনা অপরাধে তোমাকে বধ করি নি। তুমি এখন কালসূত্রে বন্ধ মৎস্যের ন্যায় দ্রৌপদীরূপ বড়িশ গ্রাস করেছ। বক আর হিড়িম্ব রাক্ষস যেখানে গেছে তুমিও সেখানে যাবে। জটাসুর যুধিষ্ঠিরাদিকে ছেড়ে দিয়ে ভীমকে বললে, তুমি যেসব রাক্ষস বধ করেছ আজ তোমার রক্তে তাদের তর্পণ করব।
ভীম ও জটাসুরের দারুণ বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল। নকুল-সহদেব সাহায্য করতে এলে ভীম তাঁদের নিরস্ত ক’রে সহাস্যে বললেন, আমি একে মারতে পারব, তোমরা দাঁড়িয়ে দেখ। ভীমের মুষ্টির আঘাতে রাক্ষস ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ল, তখন ভীম তার সর্বাঙ্গ নিষ্পিষ্ট করে চূর্ণ ক’রে দিলেন, বৃন্তচ্যুত ফলের ন্যায় তার মস্তক ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হ’ল।