মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/যক্ষযুদ্ধপর্বাধ্যায়
॥ যক্ষযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥
৩৫। ভীমের সহিত যক্ষরাক্ষসাদির যুদ্ধ
বদরিকাশ্রমে বাস কালে একদিন যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের বনবাসকালের চার বৎসর নিরাপদে অতীত হয়েছে। অস্ত্রশিক্ষার জন্য সুরলোকে যাবার সময় অর্জুন বলেছিলেন যে পঞ্চম বৎসর প্রায় পূর্ণ হ’লে তিনি কৈলাস পর্বতে আমাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হবেন। অতএব আমরা কৈলাসে গিয়েই তাঁর প্রতীক্ষা করব।
যুধিষ্ঠিরাদি, লোমশ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ এবং ঘটোৎকচ ও তাঁর অনুচরগণ সতর দিনে হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশে উপস্থিত হলেন। তার পর তাঁরা গন্ধমাদন পর্বতের নিকটে রাজর্ষি বৃষপর্বার পবিত্র আশ্রমে এলেন। সেখানে সাত রাত্রি সুখে বাস করার পর অতিরিক্ত পরিচ্ছদ আভবণ ও যজ্ঞপাত্র বৃষপর্বার কাছে রেখে তাঁরা উত্তর দিকে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবদের সহচর ব্রাহ্মণগণ বৃষপর্বার আশ্রমেই রইলেন। যুধিষ্ঠিরাদি, দ্রৌপদী, লোমশ ও ধৌম্য চতুর্থ দিনে কৈলাস পর্বতের নিকটস্থ হলেন। তার পর তাঁরা মাল্যবান পর্বত অতিক্রম করে রমণীয় গন্ধমাদন পর্বতে রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে এলেন। উগ্রতপা কৃশকায় সর্বধর্মজ্ঞ আর্ষ্টিষেণ তাঁদের সাদরে গ্রহণ করে বললেন, বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা এখানেই অর্জুনের জন্য অপেক্ষা কর। পাণ্ডবগণ সুস্বাদু ফল, বাণহত মৃগের পবিত্র মাংস, পবিত্র মধু, এবং মুনিগণের অন্যান্য খাদ্য খেয়ে এবং লোমশের মুখে বিবিধ কথা শুনে বনবাসের পঞ্চম বর্ষ যাপন করলেন।
ঘটোৎকচ তাঁর অনুচরদের সঙ্গে চ’লে গেলেন। একদিন দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, তোমার ভ্রাতা অর্জুন খাণ্ডবদাহকালে গন্ধর্ব নাগ রাক্ষস এবং ইন্দ্রকেও নিবারিত করেছিলেন। তিনি দারুণ মায়াবীদের বধ করেছেন, গাণ্ডীব ধনুও লাভ করেছেন। তোমারও ইন্দ্রের ন্যায় তেজ ও অজেয় বাহুবল আছে। তুমি এখানকার রাক্ষসদের বিতাড়িত করে দাও, আমরা সকলে এই রমণীয় পর্বতের উপরিভাগ দেখব।
মহাবৃষ যেমন প্রহার সইতে পারে না, ভীম সেইরূপ দ্রৌপদীর তিরস্কারতুল্য বাক্য সইতে পারলেন না, সশস্ত্র হয়ে পর্বতশৃঙ্গে উঠলেন। সেখান থেকে তিনি কুবেরভবন দেখতে পেলেন। তার প্রাসাদসমূহ কাঞ্চন ও স্ফটিকে নির্মিত, সর্বদিক স্বর্ণপ্রাচীরে বেষ্টিত এবং নানাপ্রকার উদ্যানে শোভিত। কিছুক্ষণ বিষণ্ণমনে নিশ্চল হয়ে কুবেরপুরী দেখে ভীম শঙ্খধ্বনি ও জ্যানির্ঘোষ ক’রে করতালি দিলেন। শব্দ শুনে যক্ষ রাক্ষস ও গন্ধর্বগণ বেগে আক্রমণ করতে এল। ভীমের অস্ত্রাঘাতে অনেকে বিনষ্ট হ’ল, অবশিষ্ট সকলে পালিয়ে গেল। তখন কুবেরসখা মণিমান নামক মহাবল রাক্ষস শক্তি শূল ও গদা নিয়ে যুদ্ধ করতে এলেন, কিন্তু ভীম তাঁকেও গদাঘাতে বধ করলেন।
যুদ্ধের শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে আর্ষ্টিষেণের কাছে রেখে নকুল-সহদেবের সঙ্গে সশস্ত্র হয়ে পর্বতের উপরে উঠলেন। মহাবাহু ভীম বহু রাক্ষস সংহার ক’রে ধন, আর গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে যুধিষ্ঠির তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভীম, তুমি হঠকারিতার বশে অকারণে রাক্ষস বধ করেছ, তাতে দেবতারা রুদ্ধ হবেন। এমন কার্য আর ক’রো না।
ভীম দ্বিতীয়বার রাক্ষসদের বধ করেছেন শুনে কুবের ক্রুদ্ধ হয়ে পুষ্পক বিমানে গন্ধমাদন পর্বতে এলেন। পাণ্ডবগণ রোমাঞ্চিত হয়ে যক্ষ-রাক্ষসপরিবেষ্টিত প্রিয়দর্শন কুবেরকে দেখতে লাগলেন। কুবেরও খড়্গধনুর্ধারী মহাবল পাণ্ডবগণকে দেখে এবং তাঁরা দেবতাদের প্রিয়কার্য করবেন জেনে প্রীত হলেন। যুধিষ্ঠির নকুল ও সহদেব কুবেরকে প্রণাম করলেন এবং নিজেদের অপরাধী মনে করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভীম খড়্গ ও ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে কুবেরকে দেখতে লাগলেন।
কুবের যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি প্রাণিগণের হিতে রত তা সকলেই জানে; তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে তুমি নির্ভয়ে এই পর্বতের উপরে বাস কর। ভীমের হঠকারিতার জন্য ক্রুদ্ধ বা লজ্জিত হয়ো না, এই যক্ষ-রাক্ষসদের বিনাশ হবে তা দেবতারা পূর্বেই জানতেন। তার পর কুবের ভীমকে বললেন, বৎস, তুমি দ্রৌপদীর জন্য আমাকে ও দেবগণকে অগ্রাহ্য করে এই যে সাহসের কাজ করেছ তাতে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি আমাকে শাপমুক্ত করেছ। কুশবতী নগরীতে যখন দেবগণের মন্ত্রণাসভা হয় তখন আকাশপথে সেখানে যাবার সময় আমি মহর্ষি অগস্ত্যকে দেখেছিলাম, তিনি যমনাতীরে উগ্র তপস্যা করছিলেন। আমার সখা রাক্ষসপতি মণিমান মূর্খতা মোহ ও দর্পের বশে অগস্ত্যের মস্তকে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করেন। ক্রোধে চতুর্দিক যেন দগ্ধ ক’রে অগস্ত্য আমাকে বললেন, তোমার এই দুরাত্মা সখা সসৈন্যে মানুষের হাতে মরবে; তুমিও সৈন্যবিনাশের দুঃখ ভোগ করবে, সেই সৈন্যহন্তা মনুষ্যকে দেখে পাপমুক্ত হবে।
তার পর কুবের যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই ভীমসেন ধর্মজ্ঞানহীন, গর্বিত, বালবুদ্ধি, অসহিষ্ণু ও ভয়শূন্য; একে তুমি শাসনে রেখো। রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে ফিরে গিয়ে তুমি সেখানে কৃষ্ণপক্ষ যাপন ক’রো, আমার নিযুক্ত গন্ধর্ব যক্ষ কিন্নর ও পর্বতবাসিগণ তোমাদের রক্ষা করবে এবং খাদ্যপানীয় এনে দেবে। কুবেরকে প্রণাম ক’রে ভীম তাঁর শক্তি গদা খড়্গ ধনু প্রভৃতি অস্ত্র সমর্পণ করলেন। শরণাগত ভীমকে কুবের বললেন, বৎস, তুমি শত্রুগণের গৌরব নাশ কর, সুহৃদ্গণের আনন্দ বর্ধন কর। এই গন্ধমাদন পর্বতে সকলে নির্ভয়ে বাস কর। অর্জুন শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। এই ব’লে কুবের অন্তর্হিত হলেন।